‘শুধু একটা প্লাস্টিক শিট আর কিছুটা দড়ি, এই দুটো থাকলেই, শেলটার বানানো যায়।’
অনেকদিন শুনে এসেছি কথাটা, এখন সেরমই একটাতে বসে আছি। টুপিতে গোঁজা টর্চ ছাড়া জানি এই জঙ্গলে এখন আর কোন আলো নেই। রাত প্রায় এগারোটা, ক্যাম্প-এর হিসেবে মাঝরাত! পাখিপাহাড়ে পৌঁছেই একের পর এক অনেক কিছু হয়ে গেলো --- শুনলাম দেখে যাওয়া ক্যাম্প সাইটের উপর দিয়ে একদিন আগেই হাতি গেছে। পড়ন্ত আলোয় তড়িঘড়ি অন্য সাইট খোঁজা, শেল্টার বানানো শেখা এবং অবশেষে চা হাতে আড্ডা। ক্যাম্প লাইটের ফিকে আলোতে খানবিশেক নানারকম ছায়া। সকালের চেনা মুখ আর এখন শোনা কথা দুটোই মনে থেকে গেল, কিন্তু ধাঁধার মত এলোমেলো হয়ে।
তবে এই জঙ্গলটা ঠিক মনে ধরেনি। বনতুলসীর ঝোপের এলাকাটা ছাড়া কোথাও কোন গন্ধ নেই! বনে যে শ্যাওলা, মাটি আর হেলায় মাড়ানো ঘাসের একটা গন্ধ --- ঝিঁঝিঁ, জোনাকি, কিছুই নেই? তাই হয়তো কানে বেজে যাচ্ছিল গাড়ির হর্ন, মোবাইলের রিং --- সঙ্গ ছাড়ছিল না শহরসুলভ একাকীত্ব।
জঙ্গল যদি নেশা ধরানো হয়, ভোর পাঁচটার জঙ্গল তাহলে মারণ নেশা। ফ্যাকাশে হয়ে আসা তারাগুলো পুরনো বাল্ব-এর মতো হাল্কা দপদপ করে। আকাশের কালচে থেকে লালচে রঙ ধরা। হাওয়াতে রাতের ঠান্ডা আর সকালের উষ্ণতার cold war শুরু হয়ে যায় একটা। মৃদু, তবে ওই নিঝুম নিস্তব্ধতায় চোখে-মুখে-ঠোঁটে জানান দেয়। স্টোভ-এর একঘেয়ে একটানা শোঁ শোঁ ছাপিয়ে পাতার মধ্যে হাওয়ার মর্মর সত্যি হয়ে ওঠে।
একদিনের মাথাতেই ছবিটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। পাখিপাহাড় টপ থেকে সূর্যাস্ত দেখা, আর নীচে তাকিয়ে পাহাড়ের তিনকোণা ছায়াটা দেখতে পাওয়ার মধ্যে একটা সুন্দর আনন্দ আছে। কাঁটাঝোপ, পাথরের চাতাল পেরিয়ে ক্যাম্প-এ যখন এসেছি তখন অন্ধকার নেমে গিয়েছে। রান্নার দল হল, খুব সামান্য হলেও মানুষ চিনলাম। অন্য কোন দল থেকে অত হাসাহাসির আওয়াজ এসেছিল বলে মনে হয়না। রাতে খাওয়ার সময়েই প্রথম বার মনে হল, আমরা এখন একটা ‘টিম’।
"রানাদা, আমরা .. এখানে থাকবো? এখানটাতেই?"
যে জায়গাতে পৌঁছে আমার একথা বলা, সেটা আরেকটু হলেই বাদই পড়ে যাচ্ছিল। নামখানি কি সুন্দর... "আমঝর্ণা"। যখন প্ল্যান চেঞ্জ হয়ে আমঝর্ণা যাওয়া ঠিক হল, মনটা নাচানাচি-ই করছিল। তা সে যতক্ষণ দেখিনি, যে জঙ্গল ছেড়ে আবার চড়াই ভাঙতে হবে। এমনকি যখন উপেনদা জলের ধারা দেখিয়ে বললেন "এইটেই গিয়ে আমঝর্ণা," তখনও শান্তি নেই। এইসব জায়গা দিয়ে রাতে হাতি চলাচল করে, ক্যাম্পসাইটের জন্য আবার চড়াই ভাঙো! তো দেরী না করে উঠেই পড়লাম। আর পৌঁছে একপলক তাকিয়েই আমার রানাদাকে সেই প্রশ্ন। সেই এক দেখাতেই রাস্তাচলার সব ক্লান্তি-যন্ত্রণা ফুরফুরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। যেন এক কেল্লার বারান্দা। পায়ের নীচে পাথর, একটু হেলে সামনের দিকে ঝোপঝাড়ে মিলিয়ে গেছে, একদম নীচে তিরতির করে কালচে হলুদ বালির উপর দিয়ে বয়ে চলেছে আমঝর্ণা। বারান্দার পাশে দেওয়ালও আছে! বেশ বড় কটা পাথরের চাঁই, উপরটা ফ্ল্যাট আর অদ্ভুতভাবে ব্যালেন্সড। আর সামনে এরমই একটা ছোট পাহাড়, তার ঘন সবুজ জঙ্গল দেখলে সিকিম-দার্জিলিঙ বলে ভুল হতেই পারে।
ট্রেক-এ একটা ব্যাপারে আমার বদনাম আছে। মানে, আরো আছে কিনা তা তো বলতে পারবনা, তবে এইটা আমি মেনে নিলুম। আর কিছু না, আসলে আমি ভোরে সবার আগে উঠি, আর বাকিদের ঘুম থেকে তোলা নামক পাপকাজও তাই আমার হাতেই হয়। তবে এবারে প্রথম দিন চা বানানোর সিদ্ধান্ত কিন্তু আমার না। ডিলার বিতানের আদেশে পাঁচটায় যখন কাঁপতে কাঁপতে শেল্টার থেকে বেরোলাম তখন ওর স্টোভ ধরানোও হয়ে গেছে। মনে গজরাতে গজরাতে তখন বেশ টের পেলাম এতদিন সবার আমার উপর রাগের কারণ। প্রত্যেক দিন সকালে ওঠার লোভটা ছাড়তে পারিনি। কারণ প্রতি সকালের এই আধ ঘণ্টা আমার একান্ত আপন। মাটির উপরে আঙুল দিয়ে দাগ কেটে, নখের খাঁজে উঠে আসা কণার দিকে তাকিয়ে অনুভব করি, আমি সত্যি এখানে। ভয়ঙ্কর সুন্দর পাহাড়ের কোলে একটা প্লাস্টিকের নীচে, স্টোভের আগুনে আঙুলগুলোকে গরম করার বিফল চেষ্টা, সেটাও আমিই করছি।
শেষ রাত এই ক্যাম্প-এর। এক সুযোগে শেল্টার-এর সামনের মাঠটায় খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থেকেছি কিছুক্ষণ। এই তারার ভিড় আবার কবে দেখব জানিনা। ক্যাম্পফায়ারের গানের রেশ কাটেনি, এক পাশ থেকে হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসছে এখনো। সামনে আজকে শেল্টারের মুখটা খোলা, অল্প দূরে বাঁশবন হাওয়ায় মর্মর শব্দে দুলছে। উপরে চাঁদও উঠে গিয়েছে, ঘুমিয়ে পড়েছে পুরুলিয়া।
কাল এই সময়ে কলকাতা। এই পরিবারের আত্মীয়তা কতদিন থাকবে জানিনা। পুরনো অভিজ্ঞতায় দেখেছি মাস কয়েক পরে গল্প শেষ হয়ে আসে, কথা ফুরিয়ে আসে, আবেগ শুকিয়ে আসে। তবু মনে হচ্ছে, এই ক্যাম্প একটু হয়তো আলাদা, বন্ধুত্বগুলো একটু বেশি গভীর। এই আশাতেই কাল এই স্বপ্নের জীবন রেখে ফিরে যাব বাড়ি। একটা ক্যাম্প থেকে না ফিরলে তো আরেকটা ক্যাম্প-এ যাওয়া যাবেনা!
(২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসে উব্যাক মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব থেকে সংগঠিত অ্যাডভেঞ্চার এন্ড সারভাইভাল ক্যাম্প-এর কিছু স্মৃতি। স্থান, পুরুলিয়ার অজানা অচেনা পাহাড় ও জঙ্গল।)
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)