এটা উনিশ বছরের পুরোনো গল্প — বাসি গন্ধ ছাড়তেই পারে।
২৮শে ডিসেম্বর, ১৯৯৯
সকাল দশটা দশ- দার্জিলিং যাওয়ার শেয়ার গাড়িতে ছুটছি চেনা পথ ধরে। দুজনে চলেছি বর্ষশেষটা কাটাতে।
দুপুর একটা তিন- কার্শিয়াং, টুং, সোনাদা, ঘুম, বাতাসিয়া লুপ হয়ে দার্জিলিং স্টেশনে আমাদের নামিয়ে গাড়ি চলে গেল স্ট্যান্ডের দিকে দম ফেলবে বলে।
দুপুর একটা এগারো- পথের উলটোদিকেই তিনতলায় একফালি ঘর জুটল। বারান্দায় বেরোলে কোণা দিয়ে নাকি কাঞ্চনবাবুর দেখা মেলে।
২৯শে ডিসেম্বর, ১৯৯৯
সকাল সাতটা- কালকের দিনটা কাটল অকারণ অপেক্ষায়। তিনি দু-একবারের বেশি উঁকি দিলেন না। শেষমেশ দুত্তোর বলে রাত সাড়ে আটটায় খেয়েদেয়ে লেপের তলায়। হোটেলের ম্যানেজারকে বলে রেখেছিলাম, রিমবিকের পয়লা গাড়িতে দুটো সীট রাখতে। সেই গাড়ি হাজির জনা চারেক সওয়ার নিয়ে।
সকাল সাতটা সাঁইত্রিশ- বাঁকে উঁকি মারছে বাতাসিয়া লুপ। ঠাণ্ডা কুয়াশা এখনও পাহাড়ময় বিছিয়ে। কাঞ্চনজঙ্ঘা হাসছে।
সকাল সাতটা আটচল্লিশ- ঘুম এখনও ঘুমোচ্ছে। তারই মধ্যে একজন নামল, তিনজন উঠল। ইস্টিশনকে বেড় দিয়ে ডাইনে মোচড়মারা মোড়ে। সোজা শিলিগুড়ি নেমে যাওয়া পথটা কেমন ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে চেয়ে রইল। ঘুম ছাড়াতেই পাইনবন ভাব জমাতে পথের দুধারে হাজির।
সকাল আটটা সাতাশ- লাপচে, মানে লেপচাজগৎ পেরিয়ে অরণ্য মেখে চলে এলাম সুখিয়াপোখরি। ঘরবাড়িদের জায়গা দেবে বলে গাছপালারা সরে বসেছে। কুয়াশাও হতাশ হয়ে পাতলা হয়ে সরে পড়ছে। গাড়ি খানিক দম নিতে আমরাও চা সমোসা (শিঙাড়া বলে শিঙাড়াকে অপমান করব না) খেয়ে নিলাম।
সকাল আটটা দুই- মিরিকের পথকে বাঁয়ে ফেলে গাড়ি ছুটছে মানেভঞ্জ্যাংয়ের দিকে। অরণ্য আবার ভাব জমাতে ঘনিয়ে এলো; লম্বা ফার্নেরা ঝুঁকে পড়ে বন্ধু হতে চাইছে।
সকাল আটটা উনত্রিশ- বাঁকের পরে বাঁক ঘুরতে ঘুরতে গাড়ি নেমে এলো মানেভঞ্জ্যাংয়ে।
সকাল আটটা ছত্রিশ- সন্দকফু-র চেনা পথটাকে 'পরে আসছি' বলে এগিয়ে গেলাম।
সকাল দশটা এগারো- ধোতরের মাথায় মেঘের আলোয়ানটা আলতো করে গায়ে দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিয়ে গেল।
দুপুর বারোটা বাইশ- শেরপা লজের দোরগোড়ায় আমাদের নামিয়ে দিল গাড়ি, তারপর ঘন্টা দেড়েকের বিশ্রাম নিতে চলে গেল।
বিকেল চারটে চার- মহা আলস্যে দিন গড়াচ্ছে — কখনও বিছানায়, কখনও আঙিনায় — কখনও চা চেখে, কখনও কফি। ১৯৮৪-তে দেখা রিমবিকের অনেক উন্নতি হয়েছে, ঘরবাড়ি, দোকান, বাস, শেয়ার গাড়ি, টুরিস্ট সব বেড়েছে।
৩০শে ডিসেম্বর, ১৯৯৯
সকাল পৌনে সাতটা- বিচ্ছিরিরকম ঠান্ডা মেখে ফিরতি গাড়িতে সওয়ার। আমরা অবশ্য মানেভঞ্জ্যাং অবধি। পথের ধারে ফ্রেস্টের বিস্তার।
সকাল সাতটা তিন- গাড়ির মধ্যে রাশিরাশি/লোকজনে ঠাসাঠাসি হয়ে চলা শুরু হলো। চলে যাচ্ছি দেখে বোধহয় ঠান্ডার আক্রোশ আরও বেড়ে গেল।
সকাল নটা সতেরো- ঠান্ডাকে সঙ্গী করেই নেমে পড়লাম মানেভঞ্জ্যাংয়ে। সে এখন বেশ প্রাণচঞ্চল। অনেকেই হেথাহোথা রোদ্দুর পোয়াচ্ছে, বেচাকেনা করছে, শেয়ার গাড়িওয়ালারা 'সুখিয়া সুখিয়া' বলে হাঁক পাড়ছে, মোমো খাচ্ছে। আমরাও খেলাম, তারপর টংলু হয়ে যাওয়া গাড়িতে সেঁধিয়ে গেলাম।
সকাল নটা উনপঞ্চাশ- গাড়ি আড়মোড়া ভাঙল।
সকাল দশটা নয়- বোল্ডার বিছানো পথে হরিণছানার মতো লাফাতে লাফাতে চিত্রে। রোদ্দুর গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকা ধুমসো কুকুর একটা চোখ খুলে একবার দেখে নিয়ে আবার বুজে ফেলল।
সকাল দশটা চোদ্দো- পথের ধারে ছায়ায় দেখে দিতে শুরু করেছে বরফ।
সকাল এগারোটা সাত- মেঘমার গুম্বার সামনে দম নিতে দাঁড়াল গাড়ি। সামনের চড়াইতে তুষার পথের উপরেও। বাঁদিকে তুমলিংপানে যাওয়া পথেও তুষার। সাইলুং টীশপকে ঘিরে যথারীতি মেঘেরা আড্ডা মারছে।
সকাল এগারোটা একচল্লিশ- বেশ কয়েকটা তুষারমাখা কড়া বাঁকে উঠে এলাম দশ হাজারে। মেঘেরা মেঘমা থেকেই আমাদের সঙ্গী। তাদের আড়ালে ঠান্ডা হেল্থ ড্রিঙ্ক খেয়ে শক্তি বাড়াচ্ছে।
বেলা চারটে চোদ্দো- খেয়েদেয়ে খানিক জিরিয়ে বাইরে এসে বসলাম। কৌতূহলী মেঘের দল ঘিরে ধরেছে আমাদের। পুরো আঙিনা জুড়ে এখানে সেখানে তুষারের স্তূপ। ঠান্ডা ক্রমশ অসুরের রূপ ধারণ করছে।
বিকেল পাঁচটা দুই- ঠাণ্ডার চোখরাঙানিতে আর বাইরে থাকা গেল না।
'রাত' সাতটা সাতাশ- মোমবাতির আলোয় কম্বল মুড়ি দিয়ে আড়াই ঘন্টা কাটানো চাট্টিখানি কথা নয় — খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে যেন বাঁচলাম।
৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৯৯
ভোর ছটা আট- আজ বিংশ শতাব্দীর শেষ দিন। যন্ত্র বলছে ঘরের মধ্যেই -২ ডিগ্রী সেলসিয়াস!
সকাল নটা সাত-রাতের ঠান্ডায় দাসবাবুদের ল্যান্ডরোভারের ডিজেল জমে বরফ! বহু সাধ্যসাধনা, মান-অভিমান, ঠেলাঠেলি, ধমকধামকের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ সান্দাকফু যেতে রাজি হলেন। সাবধানে নেমে তিনি তুমলিংয়ে এসে রোদ পোয়াতে দাঁড়ালেন। সেই সুযোগে দৌড়ে গিয়ে নীলাকে কথা দিয়ে এলাম, গতকাল না থাকলেও আজ বিকেলেই আসছি দু-দিন থাকব বলে। দাসবাবুদের বন্ধু দম্পতি আমার সঙ্গে এসে গাড়ির গরম খানিক বাড়াতে সাহায্য করলেন। রোদ পেয়ে পথের তুষার গলে গেছে। গাড়ি গড়ালো আনন্দে। কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘের আলোয়ানটা সরাতে ব্যস্ত।
সকাল নটা ছাব্বিশ- গাছেদের টানেলে ঢুকতেই পথের তুষার গাছেদের ডালপালা পাতা আঁকড়ে থাকা তুষারদের সঙ্গী করে হাজির — ঠান্ডাও বত্রিশপাটি মেলে জুটে গেল। পথজোড়া তুষারে আগের গাড়িগুলোর চাকার দাগ ধরে চলল গাড়ি।
সকাল দশটা সাত গৈরিবাসে নেমে এসে গাছপালারা আকাশকে চোখ চালাবার বেশ খানিকটা সুযোগ করে দিল।
সকাল দশটা তেত্রিশ আবার চড়াইয়ের তুষারমোড়া বাঁকগুলো চড়তে চড়তে গাড়ি পাসে উঠে নেমে এলো কায়াকাঁটায়। তুষারমোড়া কায়াকাঁটা এখন প্রায় নিঝুমপুরী।
সকাল এগারোটা এগারো নিস্তব্ধ তুষারপথ ধরে সামলে সুমলে গাড়ি এনে ফেলল আধজমা কালপোখরিতে! পোখরিকে পেরিয়ে গ্রামে গাড়ি ঢুকল 'কে জানে কত পুরোনো মণি দেওয়াল-কে ডানদিকে রেখে — সেটাই প্রথা! সিজনে সরগরম থাকলেও এখন কালপোখরি মোটামুটি নিঝ্ঝুম।
সকাল এগারোটা একত্রিশ শরীরের আড় ভেঙে, গরম চায়ে শীত সরিয়ে আবার সান্দাকফুমুখী। গ্রাম ছাড়াতেই গাছের ছায়ায় আবার তুষারের আড্ডা। বিকেভঞ্জ্যাংয়ে না থেমে শেষবারের মতো চড়াইয়ে চাকা রাখল গাড়ি।
দুপুর বারোটা দুই- সান্দাকফু ০ লেখা পাথরটা পেরিয়ে এসেছি। আর দু-চার মিনিটেই পৌঁছব সান্দাকফু।
দুপুর বারোটা ছয়- গাড়ি এসে থামল পি. ডব্ল্যু. ডি. বাংলোর সামনে। রাস্তাটুকু বাদ দিলে প্রায় সর্বত্রই তুষারের দাদাগিরি। বাড়িগুলোর (PWD, D.I, Fund, Trekker's Hutগুলো, নেপালের অংশের লজ) চাল থেকে ঝুলছে Icicle বর্শার মতো। সামনেই দেখি একটা দল, আর তাদের গাইড আমার প্রাণের বন্ধু অর্জুন। এসে হাজির হয়েছেন দাসবাবুদের অন্য বন্ধু দম্পতি। সব মিলিয়ে মহামিলন মেলা। আমাদের আনন্দ দেখে কাঞ্চনজঙ্ঘা এভারেস্ট সবাই খুশি। ফালুট যাওয়ার রাস্তাটা সাদায় মেটেয় মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছে।
বেলা দুটো বত্রিশ- পি. ডব্লু.ডি-র ডাইনিং হলে সকলে হাজির হলাম বড়া হাজরী নিতে। কী কী খাচ্ছি দেখার জন্য মেঘেরা ভিড় করে এলো। তাদের সঙ্গে এসে দারুণ ঠান্ডা বাংলোর বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল বেরোলেই আমাদের পাকড়াবে বলে।
বেলা তিনটে সাতাশ- ঘন্টাখানেক শীতবাবাজীকে বাইরে অপেক্ষা করিয়ে শেষমেশ কয়েক মিনিটের জন্য তার হাতে নিজেকে সঁপে দিলাম — দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। সেও পালাবার জন্য উদগ্রীব ছিল — লাগালো পাঁই পাঁই ছুট।
বিকেল চারটে উনপঞ্চাশ- আমাদের আর দাসবাবুদের নায়ে বাকিদের নিয়ে ঊর্ধশ্বাসে গাড়ি দৌড় লাগাল মানেভঞ্জ্যাং পানে। ওদের পিছু পিছুই বোধহয় মেঘেরাও ছুটল — কে জানে হয়ত 'নিউ-ইয়ার্স ঈভ' পার্টিতে যোগ দিতে!
সন্ধ্যা ছ-টা- সূর্যরশ্মির শেষ ছটা পশ্চিম আকাশ রাঙিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রাত আটটা- আমাদের শতাব্দী বিদায় হলো গান, আবৃত্তি, গল্পগুজব আর নীলার পরিবারের ঊষ্ণ সান্নিধ্যে।
পয়লা জানুয়ারি,২০০০
ভোর পাঁচটা তিন- খানিকটা উত্তেজনায়, খানিকটা ঠান্ডায় ঘুম ভেঙে গেল। শতাব্দীর প্রথম সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকব বলে নিজেকে আপাদমস্তক মুড়তে লাগলাম।
সকাল ছ-টা নয়- দিনকর তাঁর প্রথম স্বর্ণকর বুলিয়ে দিলেন কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় — নূতন শতাব্দীর (শুভ) সূচনা হলো।
সকাল ছ-টা বারো- মেঘমার পিছন থেকে কুসুমরঙা সূর্য চতুর্দিক আলো করে দেখা দিল দিগন্তে।
সকাল ছ-টা সাঁইত্রিশ- কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপবদল দেখে আবিষ্ট আমরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও নেমে চললাম শিখর লজে — দাসবাবুদের আজ ফিরে যেতে হবে।
সকাল আটটা- জমিয়ে বছরের প্রথম ব্রেকফাস্ট সারা হতে দাসবাবুরা গাড়িতে উঠে বিদায় নিলেন।
সকাল আটটা সাঁইত্রিশ- দুজনে আবার উঠে এসেছি তুমলিং রিজে। সূর্যস্নান সারতে সারতে বছর দুয়েক আগে গড়ে ওঠা সিমেন্টের বেঞ্চিটার দখল নেওয়া গেল। গিন্নি বসলেন ডায়রি কলম নিয়ে, আমি ড্রইং খাতা নিয়ে।
সকাল ন-টা উনিশ- পিছনের বাড়ি থেকে বিক্রমের মা দু-কাপ চা নিয়ে এসে হাজির — 'নাও একটু গরম গরম চা খাও, ভালো লাগবে।' ভালোবাসায় ভেসে গেলাম।
সকাল সাতটা- দিনভর মহা আলস্যে কাটিয়ে, শীতবুড়ো যখন জমিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাতে লাগল, তখন সুড়সুড়িয়ে ঢুকে পড়লাম নীলার রান্নাঘরে। উনুনের ওমের খুশি ছড়িয়ে রয়েছে ঘরময়, তারই শরীক আমরা। নীলার পরিবারের সঙ্গে একাত্ম অনেকদিনই, ফলে গল্পে গুজবে, ঠাট্টা তামাশায় সময় কাটছে দিব্যি।
রাত ন-টা- আড্ডার মাঝে কিছুক্ষণের খাওয়ার বিরতি, আবার আড্ডা। তারপর সারাদিনের বিশ্রামের ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে এলে, ঘরে এসে লেপকম্বল জড়িয়ে ঘুমের দেশে আড্ডা জমালাম। আগামীকাল স্বর্গচ্যুত হতে হবে।
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)