Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines





পরবাসে
রঞ্জাবতী চট্টোপাধ্যায়ের

আরো লেখা




ISSN 1563-8685




অতুলনীয় অ্যরোভিল

রঞ্জাবতী চট্টোপাধ্যায়


স্বপ্নের বাড়ি -- মাতৃমন্দির

মাদের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস সেভেনে প্রথম পরীক্ষায় বসে। আমি তো সারাবছর কিছুই পড়ি না, কাজেই পরীক্ষা আমার কাছে একটা খুবই ঝামেলার ব্যাপার। আমার মতো ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার পরে আবার কম পড়াশোনার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই বোধহয় স্কুল আমাদের বেড়াতে নিয়ে যায় মাঝেমধ্যে। বেড়ানোর মধ্যে ক্লাস সেভেনে অ্যরোভিল যাওয়া আবার বিশেষ আকর্ষণ।

২৬ সেপ্টেম্বর ছিল আমাদের সেই শুভদিন। অবশ্য একথা আমি পঞ্জিকা দেখে বলছি না। আমরা সবাই এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম কিনা তাই সে শুভ। সন্ধেবেলা মা-বাবাকে 'টাটা' বলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম হাওড়ার উদ্দেশ্যে। রাত্রি দশটা নাগাদ আমাদের চেন্নাই মেল ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম বাবা-মা কে ছেড়ে অনেক দূরে। পরের দিন পুরোটা কাটল ট্রেনে। বন্ধুদের সঙ্গে হইহই, ঝগড়া, হাসিতে অনেক সময় কেটে গেল। আঠাশ তারিখ ভোরবেলা চোখ খুলেই নেচে উঠলাম। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে।

আমরা সবাই মিনিটখানেকের মধ্যে তৈরি হয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। এরই মধ্যে খুবই মজার একটা ঘটনা ঘটল। যারা ট্রেন ধোয় তারা একটা বড়ো পাইপ নিয়ে ট্রেনময় জল ছিটিয়ে দিচ্ছিল। একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা দুটো ভারী ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে ট্রেন থেকে নামছিলেন। যে লোকটা ট্রেন ধুচ্ছিলো সে ওনাকে দেখেনি। উনি বোধহয় লোকটাকে থামতেই বলছিলেন কিন্তু তার আগেই ওনাকে "আশাড়িমস্তক" চান করিয়ে দিল লোকটা। আর কোথা যায়! ভদ্রমহিলা মারমূর্তি হয়ে তেড়ে এলেন। আমরা যারা গান শিখি তারা বলাবলি করতে লাগলাম : 'উলঙ্গিনী নাচে রণরঙ্গে'। ভদ্রমহিলা এতই রেগে গেছিলেন যে তিনি লোকটাকে চটিপেটা করতে চাইছিলেন। তাঁর ওই রুদ্র-রূপ দেখে লোকটা দে চম্পট। অত জোয়ান লোককে বয়স্ক ভদ্রমহিলা ধরতে পারবেন কী করে? তাই তিনি লোকটাকে কিছুক্ষণ শাপ-শাপান্ত করে ক্ষান্ত দিলেন। আমরা হাসছিলাম বলে আমাদের দিকে একবার কটমট করে চেয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন। তাতে আমাদের আরো হাসি পেয়ে গেল। যাই হোক, এর পর আমরা বাসে উঠে পড়লাম। মাঝখানে একবার থেমে আমরা একটু ইড্‌লি খেয়ে নিয়ে আবার বাসে চড়ে বসলাম। তারপর দু পাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম অ্যরোভিল-এ।


লিসে ফ্রঁসে
দুপুরবেলা খুবই বিচ্ছিরি একটা খাবার খেলাম। ফ্রায়েড রাইস, চিলি পণির আর রায়তা। শুনে খুব ভালো লাগছে, তাই না? খেয়ে দেখো না একবার। মুখে দিলেই ডায়েরিয়া হয়ে স্রেফ মারা পড়তে হবে। নারকোল তেলে রান্না করা নারকোল-কুচিতে ভরতি। দু'চামচ খেয়েই আমরা সব ফেলে দিলাম। তারপর গেলাম লিসে ফ্রঁসেতে। আমাদের স্কুলের সঙ্গে এই স্কুলটার টাই-আপ আছে। এখানে আমরা বেশ কিছুক্ষণ "বিজ্ঞান-চর্চা" করে উদাভি স্কুলে আমাদের ডরমিটরিতে ফিরে গেলাম। ঘন্টা-খানেক একটা বিশাল মাঠে খেলে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।

বিজ্ঞান-চর্চা

২৯ এর সকালটা কলকাতার সকালের চেয়ে অনেক আলাদা লাগল। ওখানে সূর্যোদয়টাই অন্যরকম। সবকিছু ধীর-স্থির, আলোটা নরম। প্রথমে গেলাম বুদ্ধ গার্ডেনে। সেখানে আমরা আগাছা সাফ করে সেটা মুরগিদের খাওয়ালাম। গাছে সারও দিলাম আমরা। এছাড়াও কৃষিকার্য সম্পর্কে অনেক কিছু আমাদের বলা হল। এর পর বোটানিক্যাল গার্ডেনে আমরা প্রচুর গাছ চিনলাম। স্বরম্‌ খুবই অদ্ভুত একটা জায়গা। এখানে প্রচুর নাম-না-জানা, দারুন বাদ্যযন্ত্র দেখে আমরা মাঠে খেলতে চলে গেলাম। গল্পে গল্পে বাকি দিনটাও শেষ হয়ে গেল।


স্বরম সাউন্ড গার্ডেন

তার পরের দিন সে এক কাণ্ড! ঘুম থেকে উঠেই আমরা কালারি পায়াট্টু করতে বেরিয়ে গেলাম। কালারি খুবই কঠিন এক ধরণের ক্যারাটে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ঘেমে উঠলাম। এর পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হল 'প্লে অফ পেইনটিং' বলে একটা স্টুডিওতে। এখানে আমাদের যা প্রাণে চায় তাই আঁকলাম। তাছাড়া আমাদের উৎসাহ-ভরা প্রশ্নের চোটে প্রায় পাগল হয়ে ওখানকার লোকজন নানারকম রঙের কথা বিস্তারিত ভাবে আমাদের বোঝালেন। তারপর যেই জায়গাটায় গেলাম সেখানে আমি সারাজীবন থেকে যেতে পারি। কোথায় আবার? অসীম সমুদ্রের ধারে। এক একটা ঢেউয়ের সঙ্গে বুকে কখনো আনন্দ জেগে উঠছিল কখনো বা ব্যথা মুচড়ে উঠছিল। এই তো জীবন!

১ তারিখ ছিল আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি আর আনন্দের দিন। কেন বলো তো? কারণ এই দিনেই আমার স্বপ্নের বাড়ি : মাতৃমন্দিরে। মাতৃমন্দিরের প্রথম ঝলকেই আমার মাথায় একটা ঝটকা লাগল। মনে হল এই জায়গাটা আমার বহুদিনের চেনা। যেন কিছু একটা মনে পড়বে পড়বে করেও পড়লো না। বন্ধুরা গল্পে ঢুকিয়ে নিল। এত বড়ো একটা জায়গা, কিন্তু সব চুপচাপ। লম্বা, সাদা মোজা পরে আমরা একেবারে 'ইনার চেম্বার'-এ ঢুকে গেলাম। ঢুকতেই আমার কী যে হল, আমি যেন কীসের বশে ভেতরে, আরও ভেতরে ঢুকে যেতে লাগলাম। না, ঘরের ভেতরে নয়, নিজের মনের ভেতরে। চোখ দুটো বন্ধ ছিল। হঠাৎ খুলে গেলে কিছু দেখতে পেলাম না। অন্ধকার সমুদ্রে আমি একা। ভাবলাম, একি মায়ার জালে জড়িয়ে পড়লাম! তারপরেই আসল কথাটা মনে পড়ে গেল। কোথায় যেন পড়েছিলাম যে এই সুন্দর আকাশ-গাছ-ফুল-পশু-পাখি-মানুষ সবই মায়া। ওই অন্ধকারটাই বাস্তব। বাস্তবের সমুদ্রে আমি ডুবেই যেতাম। শ্বাস আটকে আসছিল। হঠাৎ একটা গোল মতো সাদা আলো যেন আমায় উদ্ধার করতেই এগিয়ে এল। আর একটা ঝটকার সঙ্গে আমিও আমার সাজানো, মায়ার পৃথিবীতে ফিরে এলাম। মায়ার কথা আমি অনেক জায়গায় পড়েছি বা শুনেছি। এভাবে বুঝিনি কখনো। এসব ভাবতে ভাবতেই আমাদের শ্রীমায়ের কাছে থাকবার সময় ফুরিয়ে এল। বেরিয়ে আসার সময় আমার উদ্ধারকর্তার (ইনার চেম্বারের ক্রিস্‌টাল) থেকে চোখ সরছিল না। মাটি থেকে পা উঠছিল না। বহু কষ্টে বেরিয়ে আসতে পারলাম। অ্যরোভিল এ আমি যত জায়গায় গেছি তার মধ্যে এটা সেরা। মাতৃমন্দির ঘুরে আমরা ইলেক্ট্রিক সাইকেল দেখতে গেলাম। সেখানে আমার এক বন্ধু সাইকেল চালাতে না জেনেই সাইকেলটা চালাতে গেল। ধাঁই ধপাস! বেচারা উঠেই পড়ে গেল। ও একটু মোটাসোটা বলেই বোধহয় ব্যাপারটাকে আমার মহাপতন মনে হল। আমার খুব হাসি পেয়ে গেল। এর পর আমাদের ফসিল পার্ক-এ নিয়ে যাওয়া হল। এখানকার সব ফসিল চেন্নাই থেকে আসে। এখানে প্রচুর গাছ দেখলাম আমরা। অনেক বয়স তাদের। অনেক কিছুর সাক্ষী তারা। আমার কিছু বন্ধুর এখানে আর ভালো লাগছিল না। তাই আমরা গেলাম 'ব্যাম্বু সেন্টার'-এ। এখানে সব কিছু বাঁশের তৈরি। একটা ঘর (যেখানে আমরা সবাই একবার করে ঢুকলাম) থেকে শুরু করে সাবানটা পর্যন্ত। মা-বাবার জন্য এখান থেকে জিনিসপত্র কিনলাম আমরা। সবকিছু খুবই সুন্দর তবে বড্ড দামি।


ফসিল পার্ক

দু'তারিখ অ্যরোভিলে আমাদের শেষ দিন ছিল। 'সোলার কিচেন', এক অদ্ভুত রান্নাঘরে আমরা খাওয়াদাওয়া সারলাম। এখানে সূর্যের আলোয় হাজার হাজার মানুষের জন্য রান্না হয়। তারপর আমরা 'প্রোবাওটিক্‌স হাউস' এ গেলাম। এখানে ব্যাকটিরিয়া সম্পর্কে অনেক কিছু তো আমরা জানলামই, তাছাড়াও উপহার পেলাম খুব ভালো, দামি সাবান। এখানকার ম্যানেজার মারগারিটাকে আমাদের খুব ভালো লাগল। উদাভিতে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। ফিরে এসে আমরা দলে ভাগ হয়ে গিয়ে নাটক করলাম। আবৃত্তি আর গানও চলল তার সঙ্গে। অতি কষ্টে নারকোল ভরতি খাবার খেয়ে আমরা গান চালিয়ে তার সঙ্গে নাচানাচি করলাম যতক্ষণ না ঘুমে চোখ বুজে গেল।

পরের দিন আমাদের অ্যরোভিলকে বিদায় জানাবার বেলা বড়ই তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল। বাড়ি ফেরার আনন্দ ছিল তবে এত সুন্দর একটা জায়গাকে ছেড়ে যেতে কম কষ্ট হচ্ছিল না। অবশেষে ট্রেনে উঠতেই হল। মনে থেকে গেল শ্রীমায়ের 'সিটি অফ ডন্‌'-এ ফিরে যাওয়ার একটা তীব্র ইচ্ছে। অ্যরোভিল, সমুদ্র, মাতৃমন্দির, তোমাদের কাছে আবার ঠিক ফিরে যাব। প্রমিস!




(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)