মন দিয়ে জল রঙ ব্যবহার করে ছবি আঁকছিল টান্টু। হঠাৎ জলের বাটিটার দিকে চোখ যেতেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি কিলবিলিয়ে উঠল! আরে, জলটা তো একেবারে অরেঞ্জ স্কোয়াশের মতন দেখতে লাগছে! ব্যাস, আর যাবে কোথায়, আঁকা ছেড়ে উঠে পড়ল টান্টু। দিদির বন্ধু মিষ্টুদি বাইরের ঘরে বসে রয়েছে। টান্টু চট করে মার চোখ এড়িয়ে রান্নাঘর থেকে একটা কাচের গেলাস নিয়ে এসে রঙ গোলা জলটা তাতে ঢেলে মিষ্টুদিকে খেতে দিল!
“মিষ্টুদি, এটা মা দিলেন তোমার জন্যে!”
মিষ্টুদি কি একটা প্রোজেক্টের জন্যে ছবি কাটছিল। অন্যমনস্ক ভাবে টান্টুর হাত থেকে গেলাসটা নিয়ে ঢকঢক করে বেশ খানিকটা খেয়ে ফেলল! খেয়েই ওয়াক থু! টান্টু তো হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল!
একটু পরেই অবশ্য মার কাছে বেদম বকুনি খেয়ে হাসি ছুটে গেল, কিন্তু বকুনি তো সে অনেকই খেয়েছে! সেবার যখন দাদুর বন্ধু বিশ্বাসদাদুর দাঁড় করান ছাতার ভিতর প্লাস্টিকের সাপ ব্যাং টিকটিকি ভরে দিয়েছিল তখন কি কম বকুনি খেয়েছিল নাকি! ছাতা খুলতেই ভদ্রলোকের গায়ে ওই সব পড়তে ওনার তো ভয়ে প্রায় হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাওয়ার জোগাড়! কিন্তু টান্টুর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই! দুষ্টুমি করতে তার ভীষণ ভাল লাগে! ওর ওই সব কীর্তিকলাপের ফলে লোকদের যা দুর্দশা হয় সেটা দেখতে ওর ভারি মজা লাগে!
সেদিন যেমন মা কান্তামাসিকে বকছিলেন, “কান্তা, বাসন মাজার এ কি ছিরি হয়েছে!”
“নতুন বাসন মাজার সাবানটা একদম বাজে গো দিদি! একটুও ফেনা হয় না কিছু না!”
“দেখি তো কি হয়েছে।” বলে সাবানটা হাতে নিয়ে মা তো থ!
সাবানের উপর কেউ একটা ন্যাচুরাল কালারের নেল পালিশের পরত লাগিয়ে দিয়েছে ফলে সাবানটা গোটাই রয়েছে, গলছে না! এটা যে কার কাজ সেটা মার বুঝতে বাকি রইল না! টান্টু কাছেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল, তারপরই ছুটে পালিয়ে গেল!
সেদিন বিকেলে বাবার কাছে নালিশ হল ব্যাপারটা। প্রচণ্ড বকুনি খেল টান্টু, দু-দিন শান্ত হয়ে রইল তারপর আবার যে কে সেই! মা পনির করার জন্যে সাইট্রিক অ্যাসিড কিনে এনেছিলেন। টান্টু নুনদানিতে সাইট্রিক অ্যাসিড ভরে রেখে দিয়ে খেলতে চলে গেল। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে দেখল আবহাওয়া বেশ থমথমে! ঘরে ঢুকতেই দিদি ছুটে এসে ওকে গুম গুম করে কয়েকটা কিল মারল!
“কেন তুই এই রকম করলি? আর আজকেই কিনা কান্তামাসি স্যারকে ডিম ভাজা খেতে দিল! অন্যদিন মিষ্টি খেতে দেয়! স্যার ডিম ভাজায় নুন কম বলে দিব্যি নুনদানি থেকে বেশি করে নুন নিলেন! তারপর উনি শরীরটা খারাপ লাগছে বলে বাড়ি চলে গেলেন জানিস! স্যার যদি আমাকে আর না পড়াতে চান তাহলে তুই দায়ী!”
কিল খেয়েও টান্টু নির্বিকার! উলটে মাথা চাপড়ে বলল, “যাহ! দৃশ্যটা মিস করে গেলাম!”
দিদি তো সেটা শুনে হাঁউ মাঁউ করে মাকে ডেকে বসল! যাই হোক টান্টুকে দিদির অঙ্কের স্যারকে ‘সরি’ বলে ক্ষমা চাইতে হল তবে উনি দিদিকে আবার পড়াতে রাজি হলেন!
বন্ধু ঋতমকে টান্টু সেদিন বলল, “জানিস আমি হলাম শক্তিমান! সবাই আমাকে ভয় পায়! আমি যা খুশি করতে পারি! কাল রাতে মাসিরা বেড়াতে এসেছিল। মাসির ছেলে কিট্টু ঘুমিয়ে পড়তে মাসি ওকে নিয়ে গিয়ে আমার বিছানায় শুইয়ে দিল মুখে চকোলেট মাখা অবস্থায়! রাগের চোটে আমি মুখে বেশ করে পাউডার মেখে কিট্টুকে ঝাঁকিয়ে ঘুম থেকে তুললাম! ব্যাস আর যাবে কোথায়! পাউডার মাখা ভূত দেখে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে নিজের মার কাছে ছুটল! আমি আরাম করে আমার বিছানায় শুলাম!”
ঋতম সন্দেহের চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোকে বকল না কেউ?”
“দূর দূর--বুঝতে পারলে তো বকবে! সবাই ভাবল কিট্টূ ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখেছে, হে হে!”
ভালই চলছিল টান্টুর দুষ্টুমি, গণ্ডগোলটা শুরু হল দিদির নাচের অনুষ্ঠানের পরের দিন থেকে। আসলে হেয়ার ড্রায়ারটার ভিতরে বেশ করে পাউডার ঢেলে রেখছিল টান্টু। নাচের অনুষ্ঠানের দিন দিদি স্নান করে ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকোতে গিয়ে ওর সব চুল সাদা হয়ে গেল! বেচারিকে আবার শ্যাম্পু দিতে হল চুলে, ফলে অনেক দেরি হয়ে গেল। ওরা যখন পৌঁছল তখন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে; আর একটু হলেই দিদির নাচটাও হয়ে যেত দিদিকে ছাড়াই! দিদি টিচারের কাছে খুব বকুনি খেল। এসব অবশ্য টান্টুর শোনা কথা। ওকে তো শাস্তি স্বরূপ অনুষ্ঠানে নিয়েই যাওয়া হয়নি। তাতে ওর ভারি বয়ে গেছে! দিব্যি আরামে বাড়িতে বসে বসে টিভি দেখল সে!
এমনিতে টান্টু সকাল সাতটার আগে কিছুতেই ঘুম থেকে ওঠে না। স্কুল বাস এসে যাবে বলে মাকে টেনে টেনে ওকে ঘুম থেকে তুলতে হয়! সেদিন ভোর পাঁচটায় বিকট শব্দে ভয়ে ঘুম থেকে ধড় মড় করে উঠে বসল টান্টু! একি হচ্ছে রে বাবা ওর বিছানার পাশে কাড়া নাকাড়ার মতন? বিছানার পাশের টেবিলটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল টান্টু! পাঁচখানা অ্যালার্ম ঘড়ি রাখা রয়েছে সারি দিয়ে! সব গুলোতেই এক সাথে অ্যালার্ম বাজছে!
টান্টুর আর বুঝতে বাকি রইল না যে আগের দিনের ড্রায়ারে পাউডার ভরে রাখার বদলা নিচ্ছে দিদি! কিছুটা অনুতপ্ত হল টান্টু। কালকের হুড়োহুড়িতে দিদিকে ঠিক করে সরি বলা হয়নি! কিন্তু এখন তো বড্ড দেরি হয়ে গেছে, ঘুমটা তো গে্ল! উঠে অ্যালার্মগুলো বন্ধ করল টান্টু। আবার এসে বিছানায় শুলো কিন্তু ততক্ষণে ঘুম বাবাজি বেমালুম হাওয়া!
সেদিন স্কুলে টিফিন বাক্স খুলে আবার ধাক্কা খেল! বাক্সে কোন খাবার নেই! কেবল কয়েকটা কেঁচো কিলবিল করছে! মা লাঞ্চের বাক্সটা রোজ খাবার টেবিলে রাখেন ওদের দুজনের জন্যে। আজকে দিদি বলল, “টান্টু আমি তোর লাঞ্চবক্স তোর ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছি!” টান্টু ভেবেছিল বুঝি বা অ্যালার্ম দিয়ে ব্যাপারটা শোধবোধ হয়ে গেছে কিন্তু নাহ, হয়নি! কেঁচোগুলোর সঙ্গে দিদির হাতে লেখা চিরকুট, “এটা কান্তামাসিকে বকুনি খাওয়াবার জন্যে!”
স্কুল থেকে ফিরে ভাতের গ্রাস মুখে দিয়ে টান্টু দেখল ডালে নুন কম। নুনদানি থেকে নুন ঢেলে নিয়ে খেতে গিয়েই আবার ঝটকা! বেদম টক – সাইট্রিক অ্যাসিড! কিন্তু কাল রাতেই তো ওটাতে নুন ছিল!
মা মুচকি মুচকি হাসছেন, “কী? কেমন লাগছে এবার নিজের ফাঁদে নিজেই পা দিতে?” বলে কিছুটা নুন এনে ওর পাতে দিলেন।
এর পর মাঝরাতে কিসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে চমকে উঠে বসল টান্টু। নাইট ল্যাম্পের আবছা নীল আলোয় দেখল একটা বীভৎস মূর্তি ওর পাশে বিছানায় শুয়ে রয়েছে!
পরিত্রাহি চিৎকার করে খাট থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল টান্টু। বাবা এসে আলো জ্বালাতে দেখা গেল পাশ বালিশে একটা মুখোশ বাঁধা!
দিদিও এসেছে, হাসতে হাসতে বলল, “এটা কিট্টুকে ভয় দেখানোর জন্যে! কেমন লাগছে এখন? ততটাই মজা পাচ্ছিস তো?”
আশ্চর্য মা-বাবা কিন্তু দিদিকে একটুও বকলেন না, উলটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসলেন। তার মানে ওঁরাও জানতেন!
পরদিন স্কুলে ঋতম বলল, “কী রে? ওই রকম বাংলার পাঁচের মতন মুখ করে রয়েছিস কেন?”
“আর বলিস না! ভিনিগার!”
“ভিনিগার? মানে?”
“মানে জল মনে করে ভিনিগার খেয়েছি! দিদি জলের গেলাসে সাদা ভিনিগার ঢেলে দিয়েছিল! একদম জলের মতন দেখতে কিন্তু কী বিশ্রী খেতে! আমি এক ঢোঁক খেয়েই বমি করে ফেলতে দিদি বলল সেদিন মিষ্টুদিকে জলরঙ খেতে দেওয়ার বদলা!”
ঋতম শুনে হেসে ফেলল, “এখন তো তাহলে তোর দিদি শক্তিমান, তাই না?”
টান্টু একটু ভেবে বলল, “হ্যাঁ!”
সেদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে টান্টু দিদির জন্যে সুন্দর একটা কার্ড আঁকল। তাতে লিখল, ‘সরি দিদি, আর ওসব করব না! আমার প্রচুর শিক্ষা হয়ে গেছে। তুই ঠিকই বলেছিলি -
'নিজের ওপর যখন হয়
তখন মোটেই মজা নয়!’
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)