Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines




পরবাসে
অপরাজিতা ভট্টাচার্যর

লেখা


ISSN 1563-8685




হিমবাহ আগুন এবং ওরা


ফ্ল্যাটটা বেশ পছন্দ হয়েছে সুধার। ওদের কলকাতার একতলা বাড়িটার থেকে বড়ই হবে। সুধার মা, বাবার ঘরটাতে পর্যাপ্ত হাওয়া আর পুবের রোদ খেলবে। টেরাস আর আয়তাকার হল মিলিয়ে আরও দুটো ঘরেরই সমান। দমবন্ধ লাগবে না। ভাল থাকবে বাবা, মা। পুণেতে জীবনের প্রথম ট্রান্সফার সুধার।

অফিসে পারতপক্ষে সুধা নিজস্ব সমস্যার অবতারণা করে না। আর সত্যি বলতে সুধা সংসারহীন, নির্ঝঞ্ঝাট। সুধার মত নিঃসন্তান, ডিভোর্সীর জীবন ভোঁতা, বৈশিষ্টহীন হবে। তার কোন হেদিয়ে মরার মত সমস্যা থাকার কথা নয়। এটাই স্বাভাবিক। সংসারী কলিগদের ছেলেমেয়ের পরীক্ষা, কাজের লোকের কামাই, শ্বশুর শাশুড়ির অসহযোগ ইত্যাদি আলোচনায় সুধা বাধ্য শ্রোতা। কিন্তু বাবা, মা বা তার নিজের সমস্যার উত্থাপন, নানা সময় কলিগদের বিরক্তির উদ্রেকই করেছে। কথা এগোলে কলিগ পরম্পরায় পরামর্শ একটাই। দ্বিতীয় বিয়ে। যে কোন সমস্যার মহৌষধ।

প্যাশন বলতে সুধার ছিল ছবি আঁকা। সে সব পাটবালাই তো কবেই চুকেছে। মাঝে মধ্যে তার নিজেরই বিশ্বাস হয় না যে বেশ কয়েকটা মেডেল, সার্টিফিকেট আছে তার আঁকার দৌলতে। ইদানীং প্যাস্টেল রঙ করতে ইচ্ছে করে। জলরঙ, তেলরঙে হাত পাকানোর পর এমন ইচ্ছে হবার কথা নয়। সুধা নিজেও জানে সেটা। কিন্তু কোনরকমে বেঁচেবর্তে থাকার মধ্যে শৈশবের অবোধ অবচেতন তাকে ঘিরে ধরে। আর তখনই এমন ইচ্ছে হয়। এসব কথা বলার নয়। এসবই দুঃখবিলাসে দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছাড়া কিছুই মনে হবে না কলিগদের।

সুধার কাছে প্রতিটা বিকেল নিষ্কর্মা মনে হয়। সে সময় রেস কোর্সের একটা কোণে একটা ঘোড়া ঘাস খায়। সে রেসের ঘোড়া নয়, বাতিল। তার সহিসটা পাথর মত, স্থির। এমন একটা ছবি সুধা প্যাস্টেলে আঁকতে চায়। কিন্তু তখনই সহিসটা কাশতে থাকে বাবার মত। সুধা জল খায় এক ঢোক। সহিসটা তখন বাজারের ব্যাগ হাতে সুধার বেতো মা। ঘোড়া আর সহিসের ছবি থেকে বেরিয়ে আসে সুধা। আরেকটা ছবিতে ঢুকে পড়ে। কোন একটা গ্রামের প্রান্তের বটগাছে মানতের লাল সুতো বাঁধছে সুধা। সুখী হওয়ার মানত। সুতোতে প্রথম ফাঁসের পরেই মিটিঙ ডাকে অফিসে। গিঁট বাঁধা হয় না। সচেতনে এসব অবচেতন হানা দিলে সুখী হওয়া যায় না। সুধাও হয় নি। না ভরা যৌবনের বছর তিনেকের বিবাহিত সময়ে, না এখন। দেখতে শুনতে সে যথেষ্ট ভালই। কিন্তু ফোর প্লেতে আনাড়ি। উত্তেজক নয়। উপরন্তু নীতিবাগীশ, অভিমানী। আবার আঁকাজোকার উটকো শখ। এসব নিয়ে নালিশ করাও যায় না। সুখী হওয়াও যায় না।

তেইশে বিয়ে, ছাব্বিশে ডিভোর্স। সেই থেকে মা বাবার সঙ্গেই সুধা। দ্বিতীয় বাঁধনের মত কোন তাগিদ বা তাড়না আসে নি। আর এখন তো বিকেল বয়স পঁয়ত্রিশ হল। ড্রাইভ করে ওয়েস্টার্ন আউটফিটে যে অফিসে আসে, সে ভ্যাজর ভ্যাজর করলে লোক হাসানো ছাড়া কিছুই হবে না।

কস্মিনকালেও কলকাতা ছাড়ার কথা ভাবে নি সুধা। ট্রান্সফারের পরিস্থিতি এলেই চাকরি বদল করেছে। কিন্তু এবার এই ট্রান্সফারটা যেচে পড়ে নিল। সুধার বাবার কফকাশি, হাঁপের সমস্যাটা পেরেনিয়াল হয়ে উঠেছে। ফুসফুসের সমস্যা ধরা পড়েছে। হসপিটালে দিতে হয় বাড়াবাড়ি হলেই। বেশ ভাল অফিস কামাই হয় তখন সুধার। কলকাতার আর্দ্র আবহাওয়া আর মাত্রাছাড়া দূষণ থেকে দূরে নিয়ে গেলে তুলনায় ভাল থাকবে বাবা। পালমনোলজিস্ট বলেছিলেন কথা প্রসঙ্গে। পুণেতে একটা পজিশান খালি ছিল। পুণের আবহাওয়া কলকাতার চেয়ে শুকনো। অফিসে বাবার কথা বলে ট্রান্সফার চাইল সুধা।

সুধার রাগ বিরাগকে সঙ্গে নিয়েই গোপন রন্ধ্রপথে উজিয়ে আসছিল ইম্যানুয়েল। কলকাতার অফিসে সুধার সুপার বস। ইম্যানুয়েলের আঁকা দুটো ক্যানভাস আছে ওর কেবিনে। সমুদ্রের সূর্যোদয় আর মরুভূমির সূর্যাস্ত। ক্যানভাস দুটো প্রথমবার দেখেই স্বপ্নোথ্থিতের মত চমকে যায় সুধা। কর্পোরেট দুনিয়ায় থেকেও বাক চাতুরি নেই মানুষটার। পঞ্চাশোর্ধ্ব ইম্যানুয়েলের ম্যান ম্যানেজমেন্ট টেকনিক, সমাহিত ব্যক্তিত্ব সুধাকে মুগ্ধ করে। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের ক্যানভাস ঘাই মারে। নিজেকে অনুশাসনে রাখা বোধ হয় কঠিনতম কাজ। চুলচেরা বিশ্লেষণে সুধা নিজের ওপর ক্যানভাস দুটোর প্রভাবকেই ইম্যানুয়েলের থেকে এগিয়ে রেখেছে। ইম্যানুয়েলের ক্যানভাসই তাকে টানে, ইম্যানুয়েল নয়।

সুপার বস হবার দরুন ইম্যানুয়েলের সঙ্গে সুধার বার্তালাপ কম, ফর্ম্যাল। বার কয়েক হোয়াট’স অ্যাপে জরুরি কাজের নির্দেশ। ইম্যানুয়েল বিবাহিত, সুখী। ইম্যানুয়েলের ছেলেমেয়ে, বউকে অফিসের ফ্যামিলি ডেতে বারকয়েক দেখেছে সুধা। ইম্যানুয়েল আর তার মধ্য চল্লিশের বউকে বেশ মানায়। ওদের বোঝাপড়াও ভালই মনে হয়। ইম্যানুয়েল ছবি আঁকলেও লক্ষণে সুধার মত উদাস নয়।

কিন্তু দেখ না দেখ ইম্যানুয়েল সহিস হয়ে যাচ্ছে। পাথর মত। ইম্যানুয়েলের চোখে তখন ভরে ওঠা জল দেখতে পায় সুধা। তার মানে কি ইম্যানুয়েল আত্মজন হয়ে উঠছে? মা বাবার পর একমাত্র ইম্যানুয়েল ...

তা হতে দেওয়া যায় না। এই অন্যায্য একতরফা উথালপাথাল অফিসে বলার মত নয়, সমীচিনও নয়। সুধা ডিভোর্সি। সে তো ইম্যানুয়েলকে ভালবাসে না। কিন্তু থেকে থেকেই ইম্যানুয়েলের সহিস হয়ে যাওয়াটায় ভয় পায় সুধা। নিজেকে ধরে রাখতে না পারার ভয়। ট্রান্সফার নেওয়ার এইটেই সবচেয়ে বড় কারণ।

জুলাইয়ের ভরা বর্ষায় পুণেতে এল সুধারা। মেঘ, বৃষ্টি, রোদ্দুরের পালাবদল হচ্ছে। কিন্তু এই বৃষ্টি, দলা দলা কালো মেঘ, বা বিরতির রোদ কোনটাই এখনো সুধার আপন হয়ে ওঠে নি। যে রোদ, যে বৃষ্টি, যে মেঘের রঙ সুধা প্যালেটে মিশিয়ে এসেছে, এরা যেন তারা নয়।

কলকাতার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েই একটা শনিমন্দির ছিল। সুধার মা বলে, ‘বারের ঠাকুরের দিকে সরাসরি তাকাতে নেই।’

সুধাও গাড়ির ভেতর থেকে মন্দিরের দিকে না তাকিয়ে বুকে হাত ঠেকিয়ে অফিসে রওয়ানা হত। সুধা নিজেও যে রোজ পুজোআচ্চা করে তা নয়। কিন্তু ঐ বারের ঠাকুর কেমন যেন বরাভয় ছিল সুধার। পুণের নতুন অফিস প্রায় বাড়ির দোরগোড়ায়। ফলে অফিস যাতায়াতের সময় রাস্তা, ল্যান্ডমার্ক ইত্যাদি চিনতে চিনতেই অফিস এসে যায়। রোদ বৃষ্টির সঙ্গে নিবিড় মোলাকাতের সুযোগ হয় না। পুণের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েই একটা হনুমান মন্দির। এখন সুধা অটো রিক্সাতে অফিস যায়। অটো ধরার জন্য হনুমান মন্দিরের সামনেই দাঁড়ায়। হনুমানজীর দিকে সরাসরি তাকিয়ে রোজ প্রণামও করে। কিন্তু পুণের হনুমানজী এখনও বরাভয় হয় নি।

গুছিয়ে বসতে মাস দুয়েক তো লেগেই গেল। এই অফিসে প্রথম থেকেই কাজের চাপ বেড়েছে সুধার। ফ্ল্যাট মূলতঃ গুছিয়েছে সুধার মা, সুধা পাশে থেকেছে। বাবাকে ধুলো ঘাঁটতে দেওয়ার প্রশ্নই নেই। বাজার, দোকানপত্র চিনে হোম ডেলিভারির ফোন নম্বর ইত্যাদি জোগাড় করেছে সুধার বাবা। তুলনায় কাশছে কম। নতুন জলে স্নান করেও বাবার ঠাণ্ডা লাগে নি। সুধা আশ্বস্ত। কলকাতার শিকড় উপড়ে সুধার বাবা, মা রীতিমত ছিন্নমূল। নতুন শহরে ভাল লাগছে না মোটেই। এই ফ্ল্যাটে ঢোকার পরের দিনেই সুধা টিভিটা চালু করার ব্যবস্থা করেছে। বাবা মায়ের একমাত্র বিনোদন। পাশাপাশি সুধা কাজের নতুন প্রোফাইলে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছে।

‘এবারে মনে হয় একটু বেশিই বৃষ্টি হচ্ছে।’

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে।’

সুধার ফ্লোরেই বাংলায় কথা বলতে বলতে লিফ্ট থেকে বেরোল দুই মহিলা। সুধার মুখোমুখি দুটো ফ্ল্যাটের চাবি ঘুরিয়ে খুলছে ওরা। সুধার সমবয়সীই হবে।

‘আপনারা বাঙালি?’ দুজনকেই প্রশ্ন করে সুধা।

‘হ্যাঁ।’ জোড়ায় উত্তর আসে।

‘আমি সুধা। সুধা রায়। মাস দুয়েক হল কলকাতা থেকে ট্রান্সফার নিয়ে এসেছি। একই ফ্লোরে তিনটে বাঙালি পরিবার। ভাবাই যায় না।’

‘আমি পূর্ণা পাল।’

‘আমি দোলনা মজুমদার। আমরা বছর তিনেক হল এখানে ভাড়া থাকি।’

‘আসলে বাবা, মাকে নিয়ে ঘর গুছিয়ে, সব ব্যবস্থা করতে গিয়ে নেমপ্লেট গুলোর দিকে তাকিয়েই দেখি নি। এই রবিবার বিকেলে আসুন না। একসঙ্গে চা খাওয়া যাবে। আমি আর আমার মা বাবা থাকি।’ কথাগুলো বলতে বলতেই কলিং বেল বাজায় সুধা। অফিসের ভারি ল্যাপটপ ব্যাগ আর লাঞ্চপ্যাক বয়ে কাঁধটা টনটন করছে। দাঁড়িয়ে আর কথা বলতে পারছে না।

সেই রবিবার চায়ের আড্ডা বসে নি। দোলনা, পূর্ণা দুজনেরই অন্য কাজ ছিল। কিন্তু লিফ্টে, রাস্তায় টুকটাক কথাবার্তা শুরু হল।

পূর্ণা আর তার বর থাকে। পূর্ণা একটা বিপিওতে চাকরি করে। পুণের এই ফ্ল্যাটেই তিন বছরের বিবাহিত জীবন পূর্ণার। পূর্ণারা প্রতিদিন কর্তাগিন্নি একসঙ্গে অফিসে বেরোয়। পূর্ণার বর খুব কেয়ারিং। সুধা বুঝতে পারে। সুধাদের ফ্ল্যাটে ঢুকতে বেরোতে পূর্ণার ফ্ল্যাটের হলটা দেখা যায়। বাছাই করা রকমারি সৌখিন জিনিসে সাজানো হলঘর পূর্ণার। ভাগ্যিস এখনও ছেলেমেয়ে নেই ওদের। থাকলে লণ্ডভণ্ড করে দিত ছোট ছোট ঘর সাজাবার উপকরণ। ভাবে সুধা। মা বাবাকে নিয়ে সদ্যই এসেছে সে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া কিছুই নেই সুধাদের ফ্ল্যাটে। বড্ড ন্যাড়া দেখায় পূর্ণার ফ্ল্যাটের পাশে। প্রথমদিন সৌজন্যে বলেছে আসার জন্য। কিন্তু পূর্ণা আর দোলনাকে ফ্ল্যাটে ডাকলে মান থাকবে না।

দোলনা আর ওর ছেলে থাকে। দোলনা মুম্বই থেকে ট্রান্সফার নিয়ে এসেছে বছর তিনেক হল। দোলনার বর আসতে পারে নি। দোলনা একাই সব সামলে আছে। দোলনার ছেলে সিক্সে পড়ে। সুধার ঘর থেকে দোলনার টেরাস দেখা যায়। দোলনার ছেলে টেরাসে ঘুরে ঘুরে বাবার সঙ্গে কথা বলে। সুধা শোনে ছেলেটার কথা। কত কত কথা বলে সে বাবার সঙ্গে হিন্দি, বাংলা, ইংলিশে। বিভিন্ন জিনিসের আবদার করে। দোলনাকেও টেরাসে ঘুরে ঘুরে ফোনে কথা বলতে দেখেছে সুধা। কিন্তু দোলনার কথা শোনা যায় না। দোলনার ছেলে স্কুল থেকে ফিরে ডে কেয়ারে থাকে। দোলনা অফিস থেকে ফেরার পথে ছেলেকে নিয়ে ফেরে। দোলনার ছেলে বড় স্বাবলম্বী।

সুধা জানে সুখী হবার কোন ফ্যাক্টর তার জীবনে নেই। কলকাতার বারের ঠাকুরের রক্ষা করার মত ছিলটাই বা কি? সুধা বোকাও বটে। থাকার মধ্যে তার অতি ব্যক্তিগত কিছু কষ্ট, অবসাদ। ক্ষোভও ছিল কিছু। কিন্তু হীনমন্যতা এ তাবৎ ছিল না। কলকাতার অফিসে ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করা কলিগ ছিল সুধার। তারা তাদের নানাবিধ সমস্যা আলোচনা করত অফিসে। সুধা শুনত এবং বাড়ি ফিরত। কিন্তু তার কোন দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ছিল না সুধার ওপর। অথচ এই কদিনেই পূর্ণা আর দোলনাকে দেখে নিজেকে বড় বেশি নিঃস্ব মনে হচ্ছে সুধার। তার মত দেউলে বোধ হয় দুটো নেই এই পৃথিবীতে। কিচ্ছু দেয় নি তাকে ভগবান। এমনকি দোলনার ছেলেকে দেখেও নিজেকে ওয়ার্থলেস লাগে সুধার। একে তো ঐটুকু ছেলে বাবাকে পায় না। তার ওপর স্কুল থেকে ফিরে ডে কেয়ারে থাকে। দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনে আনে। ভেজা জামাকাপড়ও মেলে মাঝেমাঝে। সেখানে সুধা বাবামায়ের ওপর যারপরনাই নির্ভরশীল। রবিবার বেলা অবধি ঘুমোয় সুধা, মা বাজারে যায়। মরমে মরে যায়, তবুও ঘুমিয়েই তো থাকে সুধা। চাকরিটুকু ছাড়া কিছুই তো করে না সে।

বর্ষাতেও বাবা এতটা ভাল থাকবে আশা করে নি সুধা। আগেভাগে কলকাতার পালমনোলজিস্টের থেকে পুণের ডাক্তারের রেফারেন্স নিয়েই এসেছিল। পুণেতে বর্ষায় তাপমাত্রা বেশ কম। বাবা গলায় মাফলার জড়িয়ে রাখছে। কিন্তু কাশছে না, হাঁপাচ্ছে না, এটাই যথেষ্ট।

অফিস থেকে ফিরে ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়েছিল সুধা। ঘর থেকে বাবা মাকে টিভি দেখতে দেখে ভাল লাগছে। টিভি দেখার মধ্যেই মায়ের সঙ্গে বাবা কথা বলছে। মাঝে মাঝেই সুধা একটা বাচ্চা না থাকার অভাব বোধ করে আজকাল। তিন বছর নেহাৎ কম সময় ছিল না। কিন্তু ভবিতব্য। বিয়ের বছর দেড়েকের মাথায় সুধা পিরিয়ড মিস করেছিল। বাড়িতেই পরীক্ষা করে প্রেগ্ন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ এসেও ছিল। কিন্তু সুধার আনন্দের জোয়ার তার বর বিপুলকে ভাসায় নি। উপরন্তু সুধাকে অবাক করে দিয়ে বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেছিল বিপুল।

‘বিছানায় ঠান্ডা, এদিকে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে। ডিসগাসটিং। তাছাড়া আই ডোন্ট থিংক আই অ্যাম ফিন্যানশিয়ালি রেডি ...’ বিপুলের অজুহাত সুধাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। ডাক্তারের কাছেও যায় নি। তারপর যেদিন অফিস থেকে ফিরে বিছানা রক্তে ভেসে গেল ... বিপুল আশ্বস্ত হল। মিস ক্যারেজ ...

শহর বদলে, দূরত্বেও ভোলা যায় না কিছুই।

‘হাত মুখ ধুয়ে আয় না রে। পূর্ণা তোর জন্য চিলি চিকেন আর ফ্রায়েড রাইস দিয়ে গেছে। অফিস থেকে ফিরেই বানিয়েছে। আমাদের তিনজনেরই হয়ে যাবে।’

‘প্রায় রোজই অফিস থেকে ফিরলে বলছ দোলনার সঙ্গে কথা হলো, পূর্ণার সঙ্গে কথা হলো। ওদের সঙ্গে এত কিসের কথা তোমার? কতটুকু চেনো তুমি ওদের যে এত কথা বলো। কই আমি তো বলি না। আসলে তো ওদের ইন্টারেস্ট আমার সম্পর্কে। আজ দেখছি খাবারও পাঠিয়েছে। এই বাটি চালাচালি, কথা চালাচালি আমার একদম পছন্দ নয় মা।’

এমনিতেই পুরোনো কথার বিষে সুতীব্র ব্যথায় কাতরাচ্ছিল সুধা। মায়ের কথায় নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে ঝাঁঝিয়ে উঠল।

‘বিকেলের রুটি তরকারি তো করি নি। ভাতে ভাত বসিয়ে দিচ্ছি। খাব না আমরা কেউ পূর্ণার খাবার।’ সিরিয়াল ছেড়ে ভাত বসানোর জন্য উঠে পড়ে সুধার মা।

‘না থাক। খাবারের ওপর তো রাগ নেই। নষ্ট করেও লাভ নেই। অনেক খাবার। খেয়ে নেব। কিন্তু এরপর থেকে ...’

সুধার মা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

পূর্ণা আর দোলনার জীবন দেখে ভেতরে কষ্ট হয় মা। হীনমন্যতায় ভুগি। ওদের যে অনেক কিছু আছে। আমি যে ভিখারি। তোমার চোখে এখন ভ’রে ওঠা জল দেখছি মা আমি। সেই সহিসের মত পাথরচোখ এখন তোমার। তুমি শুনলে বকবে, ভাববে মেয়ে আমার পাগল হয়ে যাচ্ছে দিনকেদিন। এসব বলে কাউকে সুখী করা যায় না মা। সুখী হওয়াও নয়।

এই শহরের মাটি পাথুরে, স্পন্দন কম। তবুও পরেরদিন বিকেলে অফিসে বসে আকাশ দেখে চনমন করে ওঠে সুধা। বৃষ্টি থেমেছে সবেমাত্র। আকাশে ছড়ানো ছেটানো পাতলা মেঘের সর। সমতল মাথার সহ্যাদ্রি পর্বত যেন ভেজা সবুজ মখমল জড়িয়ে বসে আছে। এ পাহাড়ও যে সুধাকে টানে তা নয়। কিন্তু পাহাড়ের মাথায় এক টুকরো গোলাকার মেঘ যেন বিয়ের কনে, ঠোঁটও ফুটেছে। কপালে কমজোরি রোদের সিঁথিমৌর। সেই ছবি অপরূপ আপন। পুণেতে আসা ইস্তক আঁকার সরঞ্জামের কার্টনটা খোলাই হয় নি। আজ খুলবে সুধা। কলকাতাতেও অবশ্য রঙতুলি ছোঁয়া হতো না। তবে আজ তেমন ক্লান্ত নয় সে। আঁকবেই আজ। একমাত্র প্যাশনই মানুষকে এভাবে নিঃসাড়ে চাঙ্গা করতে পারে।

ফ্ল্যাটে ঢুকতেই একটা হালকা পারফিউমের গন্ধ পায় সুধা। কেউ এসেছিল নিশ্চয়ই।

‘কাছেই নাকি একটা কালীবাড়ি আছে। আজ মঙ্গলবার তো। দোলনা পুজো দিতে গেছিল। প্রসাদ দিতে এসেছিল। তোকে খুঁজছিল। তুই রাগ করবি দেখে অপেক্ষা করতে বলি নি। বললেই বসত। খাবি প্রসাদের সন্দেশ?’

মায়ের কথায় আর রাগ দেখাল না সুধা। উত্তরও দিল না। কিন্তু তুলি প্যালেট ধরার ইচ্ছেটাই মরে গেল। পূর্ণা আর দোলনার এই অনাবশ্যক সখ্যতা পাতানোর ব্যাপারটা ভালই লাগছে না সুধার। মেলামেশা হলেই নিজের নিঃস্বতায় সঙ্কোচ আর কুণ্ঠাই বাড়বে। এই বয়সে কি আর বন্ধুতা হয়। বাঙালি বলেই এই কৌতূহল। এক ফ্লোরে তিনটে বাঙালি পরিবার না হলেই ভাল হতো। প্রথম আলাপে চায়ের নেমতন্ন করেই ভুল হয়েছে। কিন্তু সেটা নেহাৎই বলতে হয় বলা। কে বোঝাবে দোলনা, পূর্ণাকে ! টিপিক্যাল মিডল ক্লাস মেনট্যালিটি।

বিচ্ছিন্ন থাকার জন্যই তো নতুন শহরে আসা। এরকম পরিস্থিতি হবে কে জানত। অথচ পরিস্থিতি এমনিতে তো ভালই। সুধার মা, বাবারও ওদের সঙ্গে মিশতে ইচ্ছে করে। শুধু সুধারই বিরক্তি।

দেখতে দেখতে শুক্রবার এসে গেল। অফিস থেকে বেরিয়ে অটো নিল না সুধা। মা বাবার পছন্দের কিছু সবজি কিনে হেঁটেই ফিরবে। উইক এন্ডটায় রান্না করার ইচ্ছে আছে। অফিসের বেশ কিছু পেন্ডিং কাজও সারবে। বাকি সময় ঘুম।

‘দোলনার ছেলে কাল রাতে ওর বন্ধুর বাড়িতে থাকবে। আমাদেরই নিচের ফ্ল্যাটে রে। নাইট আউট না কি একটা বলল। পূর্ণা এসেছিল আজ। বলছিল। পূর্ণার বরও কাল থাকবে না। ট্যুরে গেছে। কাল তো শনিবার, ওদেরও ছুটি। দোলনার ছেলে, পূর্ণার বর কেউই থাকবে না। তাই তোকে কাল সন্ধ্যায় ডেকেছে। পূর্ণার ফ্যাটে তোর সঙ্গে আড্ডা দেবে ওরা।’

বাড়ি ফিরে চা বানিয়েছিল সুধা। মা বাবার সঙ্গে বসেই চা খাচ্ছিল। কাপটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছিল সুধার।

‘তুমি কি বললে? নিশ্চয়ই বলেছ যে আমি যাব?’ মাকে দাবড়ে ওঠে সুধা।

‘না রে বাবা। আমি বলেই দিয়েছি তোর অফিসের কাজ শেষ হয় না। সেগুলো তুই শনি, রবিবার করিস। তুই হয়ত পারবি না।’ সুধার মা মেয়েকে বিরত করার চেষ্টা করে।

‘মেয়ে দুটো খারাপ নয় রে। ওরা তো চাকরি, সংসার সব করেই একটু গল্প করার জন্য তোকে ডাকছে। তোকে তো অত কিছু করতে হয় না। একবার গিয়েই দেখ না। তারপর না হয় …’ কথাগুলো সুধার বাবা নিরুত্তাপ যোগ করে।

তুমি তো ব্যথাহরা বাবা। শেষে তুমিও! তুমিই তো বারবার ফোনে বলতে বিপুলের সঙ্গে ইতি টানতে, তোমাদের কাছে চলে আসতে। তুমি বেঁচে থাকতে অমন নরকে আমাকে থাকতে দেবে না। আর আজ তুমিই মনে করিয়ে দিলে যে আমার সংসার নেই। এমনিতেই মনে হচ্ছে হুটোপাটিতে পুণেতে চলে আসাটা ঠিক হয় নি। ঘাড়ে চেপে এসেছে দীনহীন অতীত। আমি নতুন করে কাউকে আর সেসব জানাতে চাই না। এই বয়সেও তোমাদের সঙ্গে থাকি। ভাল জামাই, নাতিনাতনির সুখ কিছুই দিতে পারি নি। কেন যে আমার নাম রেখেছিলে সুধা? হতাশার বিষ ছাড়া তো কিছুই দিতে পারি নি তোমাদের। আমি যাব কাল সন্ধ্যেবেলা। তোমাদের এটুকু ইচ্ছেপূরণ করবই।

মনস্থির করতে করতে চায়ে এতটাই শীতল চুমুক দেয় সুধা, পাশে বসে বাবাও টের পায় না মেয়ের স্তিমিত লাভা।

পাশের ফ্ল্যাটের ডোর বেলই তো বাজাতে হবে। কিন্তু সুধার মনে হচ্ছে যেন দীর্ঘ পথ পেরোতে হবে। নিজেকে এতটুকু গোছাল না। ঘরের পোশাকেই শনিবার সন্ধ্যেবেলা পূর্ণার ফ্ল্যাটের ডোর বেল বাজাল সুধা।

‘আরে এসো এসো।’ দরজা খুলল দোলনা। ‘পূর্ণা কিচেনে তাই আমিই খুললাম।’

নিরাসক্তিতে পূর্ণার হলঘরের সোফায় বসল সুধা। ফুলকারি ল্যাম্প শেডের চিকরি কাটা আলোয় বেশ আড্ডার আবহ তৈরি হয়েছে। ধুলোহীন নিখুঁত সাজানো জিনিসপত্রের মাঝে মাঝেও নরম আলো জ্বলছে। সুধা এর আগে এই হলঘরকে এভাবে দেখে নি। নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতে বেরোতে পূর্ণার ফ্ল্যাটের দরজা খোলা থাকলে যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই। দীর্ঘশ্বাস সন্তর্পণে ফেলে সুধা। সুখী না হলে কি আর ঘর সাজাতে ইচ্ছে করে? অফিসে যাওয়ার সময় পূর্ণার লাঞ্চ ব্যাগ বয়ে নিয়ে যায় পূর্ণার বর। ভাবা যায়! দোলনাও তো ভালই আছে ছেলেকে নিয়ে। বরও নিশ্চয়ই ছুটিছাটায় আসা যাওয়া করে। আজকের দিনে দূরত্বটা কোন সমস্যাই নয়।

সুধার ভাবনারা বেশি দূর এগোতে পারে না। দোলনা কথা শুরু করে।

‘মাসিমা বলছিলেন তুমি চিংড়ি ভালবাসো। আমি চিংড়ি পকোড়া বানিয়ে এনেছি। পূর্ণা কিচেনে গরম করছে। পূর্ণা বানিয়েছে কষা মাংস আর রুটি। কষা মাংসটা খুব ভাল বানায় পূর্ণা।’

দোলনা কথা বলতে বলতে পূর্ণা কিচেন থেকে এসে বসে।

‘যখনই যাই তোমাদের ফ্ল্যাটে তুমি থাকো না। মাসিমার সঙ্গে কথা বলে আসি। অনেকদিন থেকেই তোমার সঙ্গে একটু বসার ইচ্ছে ছিল আমার আর দোলনার। আমরা ফাঁক পেলেই বসি। তবে আমার বর থাকে বলে দোলনার ফ্ল্যাটেই বসা হয়। আমার বর ট্যুরে, তাই আজ আমার ফ্ল্যাটে। দোলনা খুব ভাল কী বোর্ড বাজায় জানো। আর আমি এক দু লাইন গাইবার চেষ্টা করি। দোলনার কী বোর্ড দিয়ে আমার হেঁড়ে গলা ম্যানেজ হয়ে যায়।’

‘না গো। পূর্ণার কথা শুনো না। পূর্ণা দারুন গান গায়। তুমিও কি গান গাও নাকি সুধা?’ দোলনা জানতে চায়।

‘না না আমি এসব কিছুই পারি না। ঐ অফিস টুকুই যা যাই। তোমরা কত গুণী।’

‘আমরা কিন্তু একটা কথা জানি। তুমি অসাধারণ আঁকো। না বলবে না। মাসিমা বলেছেন আমাদের।’ পূর্ণার কথায় ভাল লাগলেও হাসে না সুধা। মা আরও কি কি বলেছে কে জানে ! বিপুলের কথা … ডিভোর্সের কথা… বাড়িতে কাজ না করার কথা … তটস্থ হয়ে ওঠে সুধা।

সত্যি বড় সুস্বাদু চিংড়ি পকোড়াগুলো। সুধা পরপর চারটে খেয়ে ফেলে থামে। কি জানি হাভাতে ভাবছে হয়ত ওরা। পূর্ণা আর দোলনা ওয়াইন অফার করে। জীবনে প্রথমবার সুধা ওয়াইনে চুমুক দেয়। অফিস পার্টিতে কোনদিন খায় নি। কিন্তু হঠাৎ করেই সুধার ভেতরের বাধা শিথিল হতে থাকে। যতটা কেজো থাকার ইচ্ছে ছিল, ততটা থাকতে পারছে না আন্তরিকতায়।

এটা আন্তরিকতা না ওদের ওপরচালাকি? ওরা কি সুধার থেকে কথা বের করতে চায়? সুধার সন্দেহটা দানা বাঁধতে চায়, পারে না। প্রায় দু ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। দোলনা, পূর্ণার আতিথেয়তা উষ্ণ, অথচ বাড়াবাড়ি নেই। সুধা সোফায় আধশোয়া হয়ে পড়েছে হালকা নেশায়। সামান্য ওয়াইনই পেটে গেছে। কিন্তু প্রথমবার। এক নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। সন্ধেটাও বড় ন্যাওটা হয়ে উঠেছে। ভাল লাগছে, হালকা লাগছে সুধার।

পূর্ণার মুখশ্রী কি আগেও এতটাই সুন্দর ছিল! শ্যাম রঙ ওর সম্পদ। এলো চুলে ক্লাচার লাগানো, ঢিলে সালোয়ার কামিজ। কামিজের অলিভ সবুজে কি নরম দেখাচ্ছে ওকে! সত্যিই ও পূর্ণা। দোলনাও কম কিছু নয়। মুখচ্ছবি পূর্ণার মত না হলেও মায়া চোখ, হলদে স্নিগ্ধ ফর্সারঙ। সংসার, সন্তান, চাকরি, বর নিয়ে সেও তো পূর্ণাই।

ডিনারের আগে হাত ধুতে টয়লেটে যায় সুধা। অনধিকার কৌতূহলে টয়লেট বিনে তাকায়। একটা ডাবল ব্যান্ডের পজিটিভ প্রেগন্যান্সি কিট দেখতে পায়। পূর্ণা নিশ্চয়ই প্রেগন্যান্ট। সুধা খুশি হয়। কিন্তু পূর্ণাকে শুভেচ্ছা জানানো যাবে না। পূর্ণা কিছুই বলে নি। সুধার এটা দেখার কথাও নয়। বাচ্চাটা বড় হলে পূর্ণার সাজানো হল ঘরের দফারফা হবে। মনে মনে হাসে সুধা।

সুধা টয়লেট থেকে বেরিয়ে হলঘরের দিকে যেতে যেতেই পূর্ণার গান শুনতে পায়। পূর্ণার গানেও যে পূর্ণ উৎসর্গ। এতটা আশা করে নি সুধা। গ্রামের প্রান্তের সেই বট গাছটায় পূর্ণা নিশ্চিত ঘুরে ঘুরে সুখী হবার সুতো বেঁধেছে। গিঁট বাঁধতে পেরেছে। সুধা আজ অবধি পারে নি। প্রথম ফাঁসের পরেই অফিসে মিটিঙ ডাকত ইম্যানুয়েল।

“পাগলা মনটারে তুই বাঁধ”... প্রবাসে বিপিওতে চাকরি ক’রে, ওয়াইনে, হুইস্কিতে অভ্যস্ত হয়ে এমন অতুল প্রসাদী গান! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সুধা।

আর তখনই সুধাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে ইম্যানুয়েলের মেসেজ এল। সামনের সপ্তাহে পুণের অফিসে আসছে ইম্যানুয়েল। সুধার নতুন ক্যানভাস দেখতে চায়।

তখনও রাতের খাওয়া বাকি। পূর্ণা আর দোলনা অনেক গল্প করার মুডেই আছে। সুধাও বেশ খোশ মেজাজেই আড্ডার মৌতাত নিচ্ছিল। কিন্তু ইম্যানুয়েলের এমন অপ্রত্যাশিত মেসেজে যে লেলিহান তোলপাড় হচ্ছে তা দমিয়ে সুধাকে এখন নির্লিপ্ত বসে থাকতে হবে। এ জীবনে কোন কিছুই যেন সুধার উপভোগের জন্য নয়।

পূর্ণার ফ্ল্যাটে ডিনার সেরে মা, বাবাকে বলে হনুমান মন্দিরটার সিঁড়িতে গিয়ে বসল সুধা। বৃষ্টি থেমেছে। ভিজে হাওয়ায় ঝিঁঝিঁ ডাকের ঝিমধরা প্রশান্তি। এসময় একটু বৃষ্টি হলে ভাল হত। ভেসে যেত, ধুয়ে যেত জমাখরচ, স্মৃতিভার। কটকটে জ্যোৎস্নাটা বেখাপ্পা লাগছে। মোটের ওপর দেখা যাচ্ছে সব। হনুমান মন্দিরের আলো নিভে গেছে। কিন্তু বিকীর্ণ জ্যোৎস্নায় হনুমানজির মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সুধা। সুধা দেখতে চাইছিল না। হনুমানজির দিকে পিঠ ফিরিয়েই বসল। কখনো কখনো অস্পষ্টতা জরুরি হয়ে পড়ে।

“পাগলা মনটারে তুই বাঁধ” … গানটা শেষ করে কি বলছিল পূর্ণা ওগুলো! ঠিক শুনেছিল তো সুধা?

হাউ হাউ করে কেঁদেছিল খানিকটা। সুধা প্রথমবার এসেছে পূর্ণার ফ্ল্যাটে। তার সামনে ওভাবে কাঁদা! দোলনা ইশারায় চুপ করতে বলেছিল পূর্ণাকে। দেখেছিল সুধা। দোলনার ইশারাতেই পূর্ণা যেন ফেটে পড়েছিল রাগে।

‘কাল কি জন্য কোথায় যাব আমরা দোলনা ডার্লিং? কি হবে চেপে? পুরো জীবনটাই যখন চাপ। সুধাকে বলাই যায়।’

‘পূর্ণার নেশাটা মনে হয় বেশি হয়ে গেছে।’ পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে দোলনা।

‘আই অ্যাম নট ড্রাঙ্ক। হে ইউ সুধা। লিসন। মাই হাবি ইজ ইমপোটেন্ট। নপুংসক বোঝ? নপুংসক। আজ অবধি একটা চুমুও দেয় নি আমায়। লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছিল ওরা। বৌভাতের দুদিন পর আমার সো কল্ড বর হাত জোড় করে বলেছিল “প্লিজ কাউকে বোল না এ কথা। আমাকে ছেড়ে যেও না। তোমার কোন অভাব রাখব না।“ এই কথাটা দারুণ বলেছিল জানো সুধা। কোন অভাব রাখবে না। রাখেও নি অবশ্য। আমার বাবা মায়ের চিকিৎসা, ভাইয়ের হায়ার স্টাডিজের খরচের অনেকটাই দিয়েছে আমার বর। আমার নামে পুণেতে একটা ফ্ল্যাটও বুক করেছে আমার বর। আমার বাবার আর্থিক অবস্থা তত ভাল নয়। দেখে শুনেই এনেছিল আমাকে। উই হ্যাভ স্ট্রাক আ ডিল।’ প্রতিবার আগ্নেয় জ্বালায় পূর্ণা উচ্চারণ করছিল বর শব্দটা।

‘কিন্তু আমিও তো মানুষ। আমারও তো অভাব আছে। আমারও একটা সম্পর্ক হয়েছে। সেক্স হয়েছে। আই হ্যাভ বিকাম প্রেগন্যান্ট। দোলনার সঙ্গে কাল অ্যাবরশান করাতে যাব। আর এই দোলনা। শুধু ডিভোর্সটা এড়িয়ে যাবে বলে নতুন চাকরি নিয়ে পুণেতে এসেছে। অফিস থেকে ফিরে টেরাসে ঘোরে ফোন হাতে। অ্যাজ ইফ ওর বর ফোন করেছে। ছেলের সামনে অভিনয়। কি বুঝলে সুধা। উই পিপল আর অল ভেরি হ্যাপি।’

পূর্ণা আবার গান ধরতে গেছিল ছলছল চোখে। দোলনা জাপটে ধরেছিল পূর্ণাকে।

‘হে সুধা। উই পিপল আর অল ভেরি হ্যাপি।’ তারস্বরে বলেই যাচ্ছিল পূর্ণা আর খ্যাকখ্যাক করে হাসছিল।

একেই কি বলে পিশাচের হাসি? সুধা ভাবছিল। কয়েক ঘণ্টার আলাপচারিতায় এমন উদ্গিরণ! কতটা বিলাপে হিতৈষী চেনা যায়! সুধা ভেবেই যাচ্ছিল। সুধারও পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল। পূর্ণার পাশে শুয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করছিল। বলে উঠতে পারে নি।

মোবাইলে ইম্যানুয়েলের মেসেজটা আরেকবার পড়ল সুধা।

কামিং টু পুণে। শ্যাল ক্যাচ আপ উইথ ইওর নিউ ক্যানভাসেস।

কোন ফাঁকে এক তোল্লাই হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে সুধার দেউলেপনা। ঠিক এই কারণেই হনুমানজিকে দেখতে চাইছিল না সুধা। আজ হনুমানজি সাক্ষাৎ বরাভয় হয়েছেন। ইম্যানুয়েল অতি সাধারণ মেসেজ করেছে। কিন্তু সুধার কাছে অভাবনীয়, অমূল্য। ইম্যানুয়েল আজ আবার পাথর চোখ সহিস। লাল সুতো নিয়ে মানতের পাক খাওয়া আর ইম্যানুয়েলের মেসেজ .....এসবে ভ’রে আছে সুধা।



(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)