ISSN 1563-8685




উত্তরাধিকার

চামচের ডগায় একফোঁটা কাই তুলে একবার জিভে ঠেকিয়েই মাথা নাড়লো মনোবীণা। হয় নি। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। প্রসূনবাবুর হয়তো ভালো লাগতেও পারে, কিন্তু রান্না হিসেবে খুব ভালো বলা চলে না।

এই রিমেমব্রেন ক্লাউড টুল ব্যবহার করে রান্না করার ব্যাপারটা মনোবীণার পছন্দ নয়। টেকনোলজি হিসেবে রিমেমব্রেন ক্লাউড টুল এখনো হামাগুড়ি দিচ্ছে, এর ভিত্তিতে বড় স্মৃতিগুলোকে সংরক্ষিত রাখা যায় বটে, কিন্তু কোনো শিল্পকে পুনর্নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন। রান্না তো নয়ই।

ক্লোনিং এর পরে রিমেমব্রেন ক্লাউড এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় টেকনোলজি। ইন্টারনেট খুললেই এর ওপরে অজস্র আলোচনা।মূলত মানুষের বিবর্ণ হয়ে যাওয়া স্মৃতি পুনরুদ্ধার। পদ্ধতিটা হলো রিমেমব্রেন নামের একটা যন্ত্র মাথায় পরে স্মৃতিচারণ করতে হবে। যন্ত্রটি সেই স্মৃতি এবং ব্রেনের বিদ্যুৎ-তরঙ্গ রেকর্ড করবে। অনেকটা আগেকার দিনের এফ-এমআরআই এর মতন। এরপর এই মুখে-বলা-স্মৃতি আর বিদ্যুৎ-তরঙ্গে পড়ে নেওয়া মনের গভীরে ছিটকে ছেতরে পড়ে থাকা দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিগুলোর টুকরো নিয়ে একটা ঝাপসা স্মৃতি তৈরি হয়। এরপর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভিত্তিক কিছু সফটওয়ের অ্যালগরিথম (যা অনেকটা সেই পুরনো লাই-ডিটেকশন টেকনিকের মতো কাজ করে) এই ঝাপসা স্মৃতিকে করে তোলে অনেকটা ঝকঝকে — যার নাম “বিটা-স্মৃতি”।এরপর এই স্মৃতিটা যাচাই করা হয় “পেশেন্ট”এর নিকট আত্মীয় বা বন্ধুদের কিম্বা সমকালীন অন্যান্য লোকেদের স্মৃতি নিয়ে। তাদেরও মাথায় চাপানো হয় ওই রিমেমব্রেন। তারপর যাচাইপর্বের শেষে একটা নতুন স্মৃতি তৈরি হয়, যার নাম “আলফা স্মৃতি”। এটাকে তারপর তুলে দেওয়া হয় রিমেমব্রেন ক্লাউডে।ধরে নেওয়া হয় এটা অনেকাংশেই বাস্তবানুগ।

তবে এই টেকনোলজিতে এখনো কিছু গোলমাল আছে। দেখা গেছে যে এই “আলফা স্মৃতি” ভিসুয়াল অর্থাৎ দৃশ্য এবং ইভেন্ট অর্থাৎ ঘটনার ক্ষেত্রে খুবই নির্ভরযোগ্য। কিন্তু অন্যান্য ইন্দ্রিয়ভিত্তিক স্মৃতির ক্ষেত্রে (অর্থাৎ স্বাদ-সুর-গন্ধ ইত্যাদি) এটা খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ এইসব স্মৃতিতে সচরাচর মিশে থাকে একধরনের জোরালো আবেগ। মায়ের কণ্ঠে ছেলেবেলায় শোনা গানকে যেমন অধিকাংশ লোকই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গান বলে মনে করেন, ঠাকমার মতো আলুর দম তো আর কেউ বানাতেই পারে না —এই ধরনের —যাকে বলে “স্ট্রে ইমোশন” বা উড়ো আবেগ এসে আলফাস্মৃতিকে এলোমেলো করে দেয়। একে ঠেকাবার জন্যে “ড্যাম্পিং অ্যালগরিথম” এসেছে কিছু, কিন্তু সেগুলো যে খুব ভালো কাজ করে এমন বলা যায় না।

ঠিক এই কারণেই মনোবীণা এই স্মৃতির ভিত্তিতে রান্না করার পক্ষপাতী নয়। কিন্তু সেকথা প্রসূনবাবু শুনলে তো!! এই রিমেমব্রেন ক্লাউড এখন প্রসূনবাবুর সাম্প্রতিকতম অবসেশন। আর এর ঠেলায় মনোবীণা একেবারে হিমসিম।

মনোবীণা মাইক্রো-কসমস কোম্পানীর অ্যান্ড্রোফর্ম কম্প্যানিয়ন রোবট জেনারেশন-টু। প্রসূনবাবুর সঙ্গে আছে আজ চার বছর হলো। এর মধ্যে মনোবীণার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। বার তিনেক সফটওয়ার আপগ্রেড হয়েছে, তাছাড়া কিছু নতুন ক্ষমতাবৃদ্ধিও হয়েছে। বছর দুয়েক আগে প্রসূনবাবু বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ায় বেসিক নার্সিং এবং ডাক্তারির মডিউলটা মনোরমার মধ্যে ইন্সটল করা হয়। তাছাড়া রান্নার একটা মডিউলও লোড করা হয়েছে — কারণ তেল-ঝাল-ছাড়া বাঙালী রান্না করার লোক কলকাতা শহরে আর পাওয়া যায় না। শেষ আপগ্রেড হলো এই রিমেমব্রেন ইউসেজ ট্রেনিং— প্রসূনবাবুর আবদারে। এটা অবশ্য বিনা পয়সায় হয়েছে — মাইক্রো-কসমস কোম্পানীকে বলামাত্র তারা নিজের গরজেই ট্রায়াল হিসেবে করে দিয়ে গেছে। শুধু রিমেমব্রেন মেশিনটা কিনতে হয়েছে।

রিমেমব্রেনের কথা পড়বার পর থেকেই প্রসূনবাবুর খেয়াল চেপেছে নিজের সব স্মৃতিকে ক্লাউডে তুলে দেবেন। ছেলের জন্যে, নাতি-নাতনির জন্যে। বারবার বলেন, “এ আমার উত্তরাধিকার”। কিন্তু এর হ্যাপা তো কম নয়। একেক সিটিংয়ে প্রায় তিনঘণ্টা লাগে — স্থির বসে থাকতে হয়, স্পষ্ট কথা বলতে হয়, জিব জড়িয়ে এলে চলবে না। তারপর দৌড়োও কোন বন্ধু বা আত্মীয়র কাছে — তাদের স্মৃতি রেকর্ড করতে। তারপর ওই সফটওয়ের চালিয়ে স্মৃতি সাফ করে ক্লাউডে তোলা। এগুলো সবই মনোবীণাকেই করতে হয়। প্রসূনবাবুর ওপরও অনেকটা চাপ পড়ে।

সেই রিমেমব্রেন ক্লাউড থেকে ওনার পিসির হাতের কইমাছের হরগৌরী আজকে রাঁধছিলো মনোবীনা ওনার ছেলের জন্যে। যেটা বিলকুল ফ্লপ হয়েছে। অন্তত মনোবীণার মতে।

ছেলে এখন এখানে। দশদিন হয়ে গেলো। এই নিয়ে গত ছ’মাসে এই তৃতীয়বার আগমন প্রশান্তর। প্রসূনবাবুর শরীর গত একবছরে খুবই ভেঙে গেছে — একরকম শয্যাশায়ীই বলা চলে। তাই এই ঘনঘন আসা। প্রশান্ত বাবা বলতে একেবারে অন্ধ। তার ওপর বিদেশী বিয়ে করেছে, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি বলে একটা অপরাধবোধ তার মধ্যে কাজ করে। যদিও স্যুজান খুবই ভালো মেয়ে, শ্বশুরকে খুবই যত্ন করে, রোজ এক বা তার বেশীবারও ইমেজ-ভিজিট করে খোঁজ নেয়। তবুও...প্রশান্তর মনে একটা খচখচ লেগেই থাকে।

একটা কাঁসার থালায় ভাত-ডাল-সব্জি আর পাশে আলাদা প্লেটে কইমাছের হরগৌরী নিয়ে প্রসূনবাবুর ঘরে ঢুকলো মনোবীণা। প্রসূনবাবু আজকাল চান প্রশান্ত ওর সামনেই বসে দুপুরের খাওয়াটা খাক। সব রান্না হবে ওনার ছেলেবেলা বা যৌবনের স্টাইলে, পরিবেশন হবে কাঁসার বাসনে। ওই কাঁসার থালা-বাটি-গেলাস তো তাই নতুন করে জোগাড় করতে হয়েছে। প্রশান্ত আপত্তি করেছিলো এই অহেতুক হুজ্জুতির। বলেছিলো “বাবা – আমি তো অনেক ছেলেবেলা থেকেই স্টিলের প্লেটে খেতাম, তারপর কাঁচের প্লেটে। এই কাঁসার থালা তো আমার মনেই পড়ে না!” প্রসূনবাবু শোনেন নি। মৃদু হেসে বলেছিলেন “এ আমার উত্তরাধিকার রে!”

খেতে খেতে টুকটাক কথা হচ্ছিলো। প্রসূনবাবু আজ অনেকটা ভালো আছেন, কথা বলতে পারছেন অনেকটাই। একথা সেকথার পরে বললেন “হ্যাঁ রে — একবার আমাকে দার্জিলিং নিয়ে যাবি?”

বিষম খেলো প্রশান্ত। আমতা আমতা করে বললো “দার্জিলিং! বাবা — তোমার শরীর...”

“কিছু হবে না। একটু চিকিৎসা, ব্যবস্থা এসব করতে হবে — সে মনো করে নেবে। তুই একবার বউমা আর বাচ্চাদুটোকে ডেকে আন। সবাই মিলে যাবো।”

“বাবা...”

“ওরে, এও আমার উত্তরাধিকার। ওই দার্জিলিংএ আমি গেছি ছেলেবেলায়, বিয়ের পরে হানিমুনে, তারপর তোকে নিয়ে বারতিনেক। সেই সব স্মৃতি আছে যে। একবার সবাই মিলে চল বাবা! ওই ম্যলে বসে নাতি-নাতনিদের গল্প বলবো সেইসব দিনের। জানি, ওরা বোর হবে। তবুও ওদের আমার চোখ দিয়ে দার্জিলিং দেখাবো। তারপর আমার স্মৃতি যখন ওরা দেখবে মেমারি ক্লাউডে, বুঝতে পারবে। ওরে, উত্তরাধিকার কি শুধু সম্পত্তির? আসল উত্তরাধিকার তো ওই স্মৃতির, ওই সব মুহূর্তের। নিবি না সেগুলো? ওগুলোর মধ্যে দিয়ে আমি বেঁচে থাকবো যে!”

প্রশান্ত অসহায়ভাবে মনোবীণার দিকে তাকালো। বাবার কথা ফেলা শক্ত — কিন্তু এ অতি অবুঝ আবদার। বিস্তর প্রস্তুতি লাগবে, খরচার কথা বাদ দিলেও। তাছাড়া মনোবীণার মেমারিতে মেডিক্যাল মডিউলটা আপগ্রেড করতে হবে — কারণ বিদেশে বিভূঁইয়ে এমারজেন্সি সামলানোর মেডিক্যাল দক্ষতা আগের মডিউলে আছে কিনা কে জানে।

“বাবা — এ নিয়ে পরে কথা বলবো। এক্ষুনি তো হবে না — আকাশ আর ঊষার স্কুল ছুটিও তো কয়েকমাস বাদে। তখন ভাবা যাবে অখন।”

“তাই কর। তবে বেশী দেরী করিস না। আমার শরীরের অবস্থা তো দেখছিস। ওদের দুজনকে এই উত্তরাধিকার দিয়ে যাওয়া আমার শেষ ইচ্ছে। মনে রাখিস সেটা।”

“ঠিক আছে বাবা। আমি তো পরশুদিন ফিরছি। তারপর সব ব্যবস্থা করেছি। তুমি চিন্তা কোরো না।”

প্রশান্তর অবশ্য পরশুদিন ফেরা হলো না। প্রসূনবাবুর শরীর আবার খারাপ হলো পরদিনই, তাই আরো কিছু দিন থাকতে হলো। সেই সঙ্গে কিভাবে বাবার ইচ্ছে পালন করবেন, তার প্ল্যান করে ফেললো প্রশান্ত।


****


ছ’মাস পরের কথা। প্রশান্তরা এসেছে সপরিবারে। বাবাকে নিয়ে যাবে দার্জিলিং। যেরকম কথা হয়েছিলো।

প্রশান্ত যা ব্যবস্থা করেছে তাতে মাথা ঘুরে যায়। কলকাতা থেকে একটা আস্ত ফ্লোটক্র্যাফট চার্টার করেছে সাতদিনের জন্যে — কলকাতা থেকে দার্জিলিং হয়ে আবার কলকাতা। এটা সাধরণ ফ্লাইটের থেকে আলাদা — অনেকটা হভারক্রাফট ধরনের একটা প্লেন। হাই-অল্টিচুডে যেতে হয় না বলে ক্রিটিক্যাল পেশেন্টদেরও এতে নিয়ে ট্র্যাভেল করা যায়। ফ্লোটক্র্যাফটের ভেতরটা একটা ছোট হাসপাতালের মতো করে সাজানো — চিকিৎসার সব সরঞ্জাম আছে তাতে। মনোবীণার সিস্টেমে একটা বাড়তি মেডিক্যাল মডিউল লোড করা ছাড়া মাইক্রো-কসমস কোম্পানীর সাপোর্ট ক্লাউডে কানেক্ট করে দেওয়া হয়েছে — যেকোনো সাহায্য একেবারে হাতের মুঠোয়। ফ্লোটক্র্যাফটের প্লেন ওঁদের সবাইকে ম্যলে ছেড়ে দিয়ে পাশের একটা চায়ের বাগানে অপেক্ষা করবে — ডাকলে আবার চলে আসবে। এর থেকে নামা বা এতে ওঠার জন্যে আছে স্পেশাল এয়ার-লিফট — তাতে চেয়ার বসিয়ে প্রসূনবাবু নেমে আসতে পারবেন। রাতে প্রসূনবাবু আর মনোবীণা ওই ফ্লোটক্র্যাফটেই থাকবেন, বাকিরা সবাই থাকবে দার্জিলিঙের সবসেরা হোটেল মে-ফেয়ার-এ।

প্রসূনবাবু সত্যিই খুব উপভোগ করলেন এই বেড়ানোটা। সত্যিই বোধহয় উনি এটাকে সম্পত্তি-সমর্পণ গোছের কিছু বলেই মনে করছেন — তাই বোধহয় মনের জোরে একটুও অসুস্থ হলেন না। নাথ ম্যুলের দোকানের ফার্স্ট ফ্লাশ চা ওয়াইন গ্লাসে নিয়ে তাতে চুমুক দিতে দিতে গল্প বলতেন আকাশ আর ঊষাকে। পুরনো দিনের সব গল্প। হ্যাপি-ভ্যালি চা-বাগানের গল্প — যেখানে ছোট্ট প্রশান্তকে নিয়ে চা-বাগান ট্যুর করবার শেষে প্রশান্ত হারিয়ে গিয়েছিলো; তারপর খোঁজ-খোঁজ-খোঁজ — শেষে পাওয়া গেলো দারোয়ানের ঘরে। কিম্বা তাগদার সেই জঙ্গলের মধ্যের বাংলো, যেখানে উনি আর প্রশান্তর মা (তখনো প্রশান্ত হয় নি আর কি) — তারপর সে কি ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি; জানলা থরথর করে কাঁপছে, উনি ভূতের গল্প বলছেন আর প্রশান্তর মা ভয় পেতে পেতে শেষে কি ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। কিম্বা সেই বিয়ের পরে কেভেন্টার্সের ছাতে প্রশান্তর মাকে প্রথম সসেজ আর বেকন খাওয়ানো। আকাশ তো বিশ্বাসই করতে পারে না। “দিদা তার আগে খেতো না? রিয়েলি? ইউ গট্টা বি কিডিং!” আর প্রসূনবাবু তখন শোনান ওনার ছেলেবেলার “নিষিদ্ধ মাংসের” কথা — এন্টালি মার্কেটের রয়াল পিগেরির “এন্টালি সসেজ” বা ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের কালমানের দোকান থেকে আনা সবসেরা হাঙ্গারিয়ান পর্ক সসেজের গল্প; যা ওঁদের বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকতো না — বাইরের উঠোনে স্টোভে ভাজা হতো। প্রশান্ত আর স্যুজান একপাশে বসে শোনে এই গল্পকথা। স্যুজানের কাছেও এগুলো নতুন, তাই অবাক হয়ে এক অন্য জগতের কথা শোনে। প্রশান্ত থেকে থেকে দু-ফোঁড় সেলাই বসায় এই স্মৃতি-স্বপ্নের নকশী-কাঁথায়। আর মনোবীণা কড়া নজর রাখে প্রসূনবাবুর ওপর — মাঝে মাঝেই মেডিক্যাল চেকআপ করে। শুধু ব্লাডপ্রেশার-ব্লাডসুগার নয়, রিমেমব্রেন পরিয়ে ক্লাউডে কানেক্ট করে দেখে নেয় প্রসূনবাবুর ব্রেনেও বাড়তি চাপ পড়ছে কিনা।

এভাবেই রোদে পিঠ রেখে গল্প করে, সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখে, গ্লেনারিতে খেয়ে (এটা অবশ্য প্রসূনবাবুকে বাদ দিয়ে; কিন্তু তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে দিয়েছিলেন কি কি খেতে হবে — যথা শেপার্ডস পাই অথবা হ্যাম-পূর্ণ অমলেট কিম্বা চায়ের সঙ্গে টা হিসেবে কিইশ) আর অক্সফোর্ডের বইয়ের দোকানে পুরনো বই কিনে (“ওজনের পরোয়া নেই; ফেরার সময় তোমরা তো তিনজন!” — প্রশান্ত) কাটলো পাঁচদিন। এর মধ্যে আকাশ আর ঊষা একদিন বেড়িয়ে এসেছে তাগদা আর লামহাট্টা টী এস্টেট, একদিন দার্জিলিংএর জু (যেখানে নাকি প্রসূনবাবুর মতে বালক প্রশান্ত শ্বেতচিতা দেখে প্যান্টে হিসি করে দিয়েছিলো; প্রশান্ত দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে এ কথা) আর দুয়েকটা এদিক সেদিক। তারপর নটেগাছ মুড়োবার পালা।

কলকাতায় ফিরে স্যুজান ফিরে গেলো আকাশ-ঊষাকে নিয়ে। সে বরাবর এবাড়িতে অত্যন্ত আদর পেয়ে এসেছে — অন্য সংস্কৃতির মেয়ে হয়েও তার প্রসূনবাবুর প্রতি একটা জোরালো টান আছে। আর পাঁচজনের কথা শুনে সে একসময় শাড়ি-সালোয়ার পরতো, প্রসূনবাবুকে প্রণামও করা শুরু করেছিলো — প্রসূনবাবু বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন নিজের ইচ্ছেয় পরবে — লোকের কথায় নয়। আর প্রণামের কোন দরকার নেই। এবার কিন্তু যাবার আগে প্রণাম করলো স্যুজান, ছেলেমেয়েদের দিয়েও করালো — আর প্রসূনবাবুও বাধা দিলেন না। বাঙালি নয় বলেই হয়তো যাবার সময় স্যুজান বেশী সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ে না কোনোবারই। এবার কিন্তু যদিও বরাবরের মতো হাসি মুখেই গেলো, কিন্তু কোথাও যেন একটু অশ্রুজলের ভেজাল মিশেছিলো ওই নির্মল হাসিতে। প্রশান্ত থেকে গেলো — কদিন বাদে যাবে।

কদিনটা কিন্তু মাসখানেক লম্বা হয়ে গেলো। ফিরে এসেই প্রসূনবাবু অসুস্থ হয়ে পড়লেন — আর একসপ্তাহ মাত্র ছিলেন। সব কাজ মিটিয়ে ফিরে যেতে যেতে প্রশান্তর একমাস লেগে গেলো। স্যুজান ফিরে আসতে ছেয়েছিলো — প্রশান্তই বারণ করলো। ওই শেষের দিনের স্মৃতিই থাক ওদের কাছে।


***


একমাস পরের কথা। প্রশান্তর আমেরিকা ফিরে যাবার একদিন আগে।

মাইক্রো-কসমসের অফিসে তাদের রিজিওন্যাল ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো প্রশান্তর। মনোবীণাকে ফেরত দেবার ফরম্যালিটি ইত্যাদি। সহজ তো নয় — প্রশান্তবাবুদের কনফিডেন্সিয়াল ইনফরমেশন যা আছে ওর মেমারিতে, তাকে ডিলিট করতে হবে। ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস নিয়ে লম্বা প্রসিডিওর। সময় লাগে। সব শেষ হবার পর প্রশান্ত বললো---

“জানেন তো প্রবীরবাবু, মনোবীণা আমাদের পরিবারের এতোটাই অংশ হয়ে গেছে যে ওকে হারানো আমার পিতৃবিয়োগের থেকে কম নয়। ওকে কোনভাবেই নিয়ে যাওয়া যায় না, তাই না? “

“না স্যার, যায় না। বিদেশে নিয়ে যাওয়া যায় না। তাছাড়া রোবট তো কিছু স্পেসিফিক কাজেই ব্যবহার হয় —কম্প্যানিয়ন ফর সিনিয়ার সিটিজেন, হেলথকেয়ার ইত্যাদি। এমনিতে তো কাউকে দেওয়া আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ।”

‘হ্যাঁ, জানি সবই। তবে...ওয়েল। আমি আপনাদের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যেভাবে আপনারা আমার বাবার ব্যাপারটায় সাহায্য করেছেন।”

“কি বলছেন আপনি! আমরাই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ — এই ধরণের এক্সপেরিমেন্টে রাজি হবার জন্যে। আমরা আর কি করেছি বলুন — খরচাটা দিয়েছি, ক্লোনিং করেছি আর ক্লোনিং-এর সঙ্গে মেমারি-ক্লাউডের লিমিটেড অ্যাকসেস কানেক্টিভিটি করেছি। বি-২৭১ মানে মনোবীণা স্পটে থাকায় ডাটা কালেক্ট করা এবং কন্ট্রোল করা খুব সুবিধে হলো। এটা কিন্তু একটা যুগান্তকারী এক্সপেরিমেন্ট। আমরা স্মৃতিকে শুধু কম্প্যুটারে নয়, রক্তে-মাংসে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। ভাবতে পারছেন এর কি মানে?”

“তবুও — আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ। দার্জিলিংএ কাটানো ওই শেষ কটা দিন আমার চিরদিন মনে থাকবে।”

“ইউ আর ওয়েলকাম। যাবার আগে একবার আপনার বাবাকে দেখে যাবেন নাকি? সিস্টেম রিসেট করে ক্লোন ডিসম্যানটেল করবার আগে?”

“না থাক।”

দেখতে না চাইলেও দেখা হয়েই গেলো। যেতে যেতে প্রশান্তর চোখে পড়লো একটা কাঁচের দরজা ঘেরা ঘরে হুইলচেয়ারে বসে আছেন প্রসূনবাবু। পাশে মনোবীণা। কি কথা বলছে ওরা?

জানা হলো না প্রশান্তের। শুধু একটা খাঁ খাঁ নিঃশ্বাস পাঁজর কাঁপিয়ে বেরিয়ে এসে হাওয়ায় মিশে গেলো।

***


(এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো একটি গল্পঃ 'ডঃ বোস-এর শেষ রাত্রি')




(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)