এ এমন পরিচয়
চায়ে তিন চামচ চিনি মিশিয়েও মুখের তিতকুটে ভাবটা তাড়ানো গেলো না। চিনিতে সেটা যাবে না জানি। জ্বালাটা তো আসলে বুকে। সাদউল্লাহকে মনে মনে সাধ মিটিয়ে গালাগালি না করে বাস্তবে কয়েক ঘা দেয়া গেলে হয়ত মনের ঝাল কমতো। সেটা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি নিতান্তই ছাপোষা মানুষ। দৈনিক মেরুদণ্ড পত্রিকার রিপোর্টার থেকে বছর দেড়েক হলো মোটামুটি নাম করা এক পত্রিকায় সাহিত্য সহ-সম্পাদকের পদে নিযুক্ত হয়েছি। অবশ্যই ধরাধরির কারণে এ প্রাপ্তি। পদবী হিসেবে সহ সম্পাদক যতটা ধারালো শোনায়, বাস্তবে তার ভার ততটা না। অন্তত আমার ক্ষেত্রে একদমই না। আমার নিয়মিত কাজ প্রধান সম্পাদক, সাহিত্য পাতার সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের ফরমায়েশ মতো শুভানুধ্যায়ীদের লেখা সাহিত্য পাতার জন্য নির্বাচন করা এবং অনিয়মিত কাজ হলো পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপনের যোগান দেয়া। সাহিত্যের ছাত্র না হলেও সাহিত্য পাতার সম্পাদকের কাজে এখন পর্যন্ত খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি। কিন্তু বিজ্ঞাপনের কাজটা মাঝে মাঝেই ঝামেলার সৃষ্টি করে। অথচ এটার উপর ভর দিয়ে আমার চাকরি দাঁড়িয়ে।
আমার নাম নৈঃশব্দ্য নেহাল। এটা আসল নাম না। নতুন পত্রিকায় নিযুক্ত হবার আগে এই নামটা নিয়েছি। সাহিত্য করতে হলে একটা শৈল্পিক নামের দরকার আছে। আমার আসল নামটা সাহিত্যের সাথে ঠিক মানান সই না। বন্ধু-সহকর্মীরা নতুন নামটার প্রশংসা করে। আমারও খুব পছন্দ। এতকালের বেহুদা এক নামের ভার থেকে মুক্ত হয়ে একটু হালকাই লাগে। বর্তমান কর্মস্থলে নতুন নামেই পরিচিত। পুরান নামের বেইল নাই এখানে। কাজেই আব্দুল মাজেদ সরদার নাম ধরে এখানে কেউ আমার খোঁজে এলে নিশ্চিত পাবে না। ফেসবুক এখন সব মুশকিল আসানের বড় আব্বা। আমার বন্ধু-বান্ধবদের তাই নতুন নামটার সাথে পরিচিত হতে খুব একটা সময় লাগেনি।
সাহিত্য সবার রক্তে থাকে না। যথেষ্ট সাহিত্য পঠন পাঠনে, নিজস্ব কল্পনাকে বাস্তবসম্মতভাবে পরিবেশনার দক্ষতায় সাহিত্যকে বশে আনা সম্ভব। সাহিত্য পাঠে আমি নিবেদিত প্রাণ। যদিও অভিজ্ঞতা আর কল্পনা শক্তিতে দুর্বল। তবে ভালো ভালো লেখকের লেখা কম পড়িনা। একটা ডায়েরি আছে। পছন্দসই লাইনগুলো টুকে রাখি। ছোট্ট কোনো বিষয়কে বেশ করে ফেনিয়ে, একটা গল্পে দাঁড় করিয়ে, টুকে রাখা লাইনগুলো একটু এদিক ওদিক করে সুবিধা মতো ঢুকিয়ে দেই। যেহেতু এখন পর্যন্ত নামকরা কেউ হয়ে উঠতে পারিনি, তাই হয়ত লোকে খুব একটা মন দিয়ে আমার লেখা পড়ে না। আর তেমন বোদ্ধা পাঠকেরা আমার লেখা না পড়েই পত্রিকার সম্পাদক, সেটা বিবেচনায় নিয়ে বাহ্ বাহ্ করে। তারা পড়লে ধরা পড়ে যাবার খুবই সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু কিন্তু করেও সাহিত্য খারাপ করছি না আমিও। প্রায়শই গল্প লিখে থাকি। ফেসবুকে ভক্ত সংখ্যাও খুব কম নেই। যদিও তারা নিজস্ব একটা স্বার্থ মাথায় রেখেই আমি যা লিখি তাই নিয়ে মাতামাতি করে। আজকাল সাহিত্যচর্চাও দেবে আর নেবে-র মাধ্যম। ফেসবুক তার যোগানদাতা, আড়তখানা। ব্যাপারটা খুব যে খারাপ, সেটা ভাবিনা। দুনিয়াটাই গিভ এন্ড টেকের মানদণ্ডে চলমান। ফেসবুক দুনিয়ার বাইরের কিছু না।
নৈঃশব্দ্য নেহাল যে আমার আসল নাম না, সেটা পরিচয়ের প্রথম দিনেই ধরে ফেলেছিলেন কবি সাদউল্লাহ। কবিরা সাধারণত আলাভোলা হয়, আমার এ ধারণাটা কথোপকথন এগোতে এগোতে আর আস্ত থাকেনি। আসলে, সাদউল্লাহ প্রথমে একজন জাঁদরেল সরকারি আমলা, তারপর কবি। সরকারি আমলাদের বেশিরভাগই নাক উঁচু হয়। এটাও আমার ব্যক্তিগত ধারণা। সাদউল্লাহর আগে আর কোনো আমলার সাথে এতটা পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। কাজেই সাদউল্লাহ কেমন মানুষ তা জানার জন্য আরো ঘনিষ্ঠ হবার প্রয়োজন ছিল।
সাদউল্লাহর সাথে আমার পরিচয় সোশ্যাল মিডিয়া অর্থাৎ ফেসবুকে। ফেসবুক ফীডে আসা কবিতার লিংকে মন্তব্য সূত্রে তার সাথে পরিচয়। অচেনা কবির কবিতার কিছু লাইন বেশ মনে ধরায় আমি খানিক উচ্ছ্বাস দেখিয়ে মন্তব্য করে বসি। মিনিট খানেক পর দেখি, কবি স্বয়ং ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছেন। রিকুয়েস্টে সাড়া দেয়া মাত্রই, ইনবক্সের আলাপে ডেকে আমাকে জানানো হয় কবিতা ভালোবাসি বুঝেই নাকি ফ্রেন্ড করতে চাওয়া। আজকাল আর সত্যিকার কবিতার সমঝদার কোথায়! ইত্যাদি কথার ফাঁকেই দুম করে প্রশ্ন আসে, পিতৃপ্রদত্ত নামখানা জানতে পারি? ঠিক অনুরোধ নয়, খানিকটা হুকুমের আভাস ছিল সাদউল্লাহর প্রশ্নে। তিনি যে সরকারি আমলা এ তথ্য ততক্ষণে আমার মগজস্হ। নিজের তাগিদেই আব্দুল মাজেদ সরদার নামটা তাকে জানাতে দ্বিধা করি না। নামটা শব্দে প্রকাশ করা মাত্রই ওপাশ থেকে তিন মাত্রার হাসির টেক্সটের সাথে থাম্বসাপ ইমোজিন উড়ে আসে। এমনই একখানা নামের সম্ভাবনা নাকি তার মনে উঁকি দিয়েছিল। সেকথা পরের মন্তব্যে জানাতে ভোলেন না। বাজারে মোটামুটি নাম করেছে এমন পত্রিকার সাহিত্য পাতার সহ-সম্পাদক জেনে কবি সাহেব উৎফুল্লভাব প্রকাশে রাখঢাক করেন না। নিজে একজন উচ্চপদস্হ কর্মকর্তা হয়ে, আমার মতো এক সংবাদপত্রকর্মী বিষয়ে তার এতটা উচ্ছ্বাসের কারণ তখন বুঝিনি। প্রায় ত্রিশ মিনিট কথা হয়েছিল সেদিন আমাদের।
কবি সাদউল্লাহর সাথে পরিচয়ের দু'সপ্তাহ না কাটতেই একান্ত ফোন নাম্বারসহ কিছু ব্যক্তিগত তথ্যের আদান প্রদান পর্ব সেরে ফেলি আমরা। প্রথম প্রথম সাদউল্লাহকে স্যার সম্বোধন করলেও তার অনুরোধে কবি নামে ডাকতে শুরু করি। কবি ডাকে ভীষণ আহ্লাদিত হন তিনি। প্রথম কয়েকদিন একজন সচিব পর্যায়ের সিনিয়র বন্ধু পাওয়ার ভাগ্যে আপ্লুতই ছিলাম। যদিও মাশুল হিসেবে কবির গণ্ডা গণ্ডা কবিতা হজম করতে হতো। প্রাণ বাঁচাতে প্রায় তাকে বলতাম,
--কবি ভাই, নতুন কবিতা এভাবে পাঠককে আগেভাবে পড়িয়ে নিলে, বই কিনে কবিতা পড়বার তাগিদ উবে যাবে তো!
তার সোজা সাপ্টা তৈরি জবাব--নিজের পরিশ্রমটা ভক্ত পাঠকদের দেখাতে ভালো লাগে। কবিতার সাথে সাথে কবির পরিশ্রমের সাক্ষী থাকাও প্রয়োজন।
নানান সময়ে সাদউল্লাহর চেয়েও অখাদ্য কবিদের কবিতা ছাপাতে হয়েছে উপরঅলার নির্দেশে। এই প্রথম একজন প্রভাবশালী মানুষের সাথে সরাসরি সম্পর্ক তৈরী হলো। যথেষ্ট তেলপানি খরচ করে সম্পর্কটা টিঁকিয়ে রাখা চাই।
জগতে টিঁকে থাকতে হলে যত রকমের মানুষের দরকার আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ক্ষমতাবান মানুষ। সাদউল্লাহর কবিতা ছাপাবার বিনিময়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের আমদানি বাড়ানোটা আমার হিসেবের খাতায় বিশাল একটা যোগফলের সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হলো। সেই সাথে আমার নতুন লেখা উপন্যাস একটা নামকরা প্রকাশনী থেকে ছাপিয়ে দেবার আশ্বাস তো স্বপ্নে পাওয়া উপহার। বলতে লজ্জা নাই, আমি ছোট গল্প লিখতে লিখতে বন্ধুবান্ধবের প্রশংসায় একদিন উপন্যাস লেখায় হাত দিয়ে ফেলি, কিন্তু সেই উপন্যাস কেউ ছাপাবে তেমন দুঃসাহস করিনি। কবি সাদউল্লাহর সাথে পরিচয়ের পর সেই ভয়টা কেটে গেলো যখন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ে সাদউল্লাহ ঘোষণা করলেন বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে এই উপন্যাস দিয়ে। তিনি অগ্রসর প্রকাশনীকে বলে দিলে এক মাসের মধ্যে বাজারে দু হাজার কপি নেমে যাবে। পরবর্তী সংস্করণগুলোতে কত হাজার হবে সেটা তিনি এখনই বলতে চান না। কিন্তু আমার লোভী চোখের সামনে তখনই ঝকঝকে একটা গাড়ি, তকতকে একটা ফ্ল্যাট এবং সেই ফ্ল্যাটে প্রকাশকদের ভিড় ইত্যাদি ভেসে উঠতে থাকে।
নিজের দাপ্তরিক একটা ঝামেলায় কিছুদিন ফেসবুকে লগইন করা সম্ভব হয়নি। কবি সাদউল্লাহ একদিন ফোন করে কেন লাপাত্তা ইত্যাদি ইতং বিতং খুচরো আলাপের পর জানালেন আমাকে নাকি তার বিশেষ দরকার। আমার মতো সামান্য একজনকে তার বিশেষ প্রয়োজন শুনে এক ধরনের পুলক জাগে শরীরে।
জরুরি ভিত্তিতে ইনবক্সে ডেকে নিয়ে সাদউল্লাহ যা বলেন, সেটার সারসংক্ষেপ হলো, সম্প্রতি প্রকাশিত তার ‘কলারে চুমুর দাগ’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সমালোচনা লিখে আমার পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ঠিক অনুরোধ নয়, আবার স্পষ্ট হুকুমও না, তার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে কবি কথাগুলো জানিয়ে দেন। সাথে বলা হয় সেটা যেন কাভারে ছাপা হয়।
এইবার একটু বিপদে পড়লাম। আমাদের পত্রিকায় কবিতা যেমন তেমন ছাপানো হয় ঠিক, কিন্তু কবিতার আলোচনা যেনতেনভাবে ছাপানো চলে না। যে কোন গ্রন্থালোচনা প্রধান সম্পাদক নিজে যাচাই করে অনুমতি দেন। সাদউল্লাহর মতো কবিদের কবিতা ছাপানো যতটা সহজ, কাব্যগ্রন্থ আলোচনা তত সহজ নয়। একটা আলোচনায় কমপক্ষে হাজার দেড়েক শব্দ বরাদ্দ করতে হয়, অত শব্দের বরাদ্দ করা আলোচনা, তাও আবার কাভারে, প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। কাভারটা তো দেশের খ্যাতনামা কবি সাহিত্যিকদের জন্য রাখতে হয়। আমার মতো নৈঃশব্দ্য নেহালের বেইল নাই ওখানে।
তাছাড়া, তাছাড়া… গালি নিঃসৃত একদলা থু থু এসে জমা হয় মুখে... তুই এমন কী কবি যে তোর কাব্যগ্রন্থের আলোচনা ছাপাতে হবে দেশের প্রধান দৈনিকের সাহিত্য পাতায়? এমন সম্মানিত লোককে মনে মনে তুই তোকারি করার মধ্যে কেমন একটা তৃপ্তি ভর করলো। পরক্ষণেই চোখে ভাসতে লাগলো চকচকে গাড়িটা, ঝলমলে ফ্ল্যাট, প্রকাশকের ভিড়…..এবার কেমন অসহায় লাগলো। ‘তুমিও মানুষ আমিও মানুষ, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়।’ যেই লিখে থাকুন না কেন, এমন বিপদে পড়লে তার শিরদাঁড়া কতটা সোজা থাকতো জানা আছে।
জ্বালা হলো দেখি! কার খেয়েদেয়ে কাজ ছিল না মানুষ ফেলে শার্টের কলারে চুমুর দাগ বসিয়ে দিলো! সেসব সুলুকসন্ধানের জন্য আখাস্তা বইটা পড়াও লাগবে, যদিও হাতের নাগালে নাই ওটা। আগামি কাল তার লোক বইটা অফিসের ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে যাবে। বিরক্তিতে শরীরে কেমন জ্বর জ্বর ভাব চলে এলো। পারবো না এটাও বলা যায় না। গত মাসেই তার মাধ্যমে বড় দুটো বিজ্ঞাপন বাগিয়েছি। সম্পাদকের চোখে সমীহের ছায়া দেখেছি এর জন্য। তাছাড়া আমার প্রথম উপন্যাস ‘কিল হজমের যন্ত্রণা সমূহ’ প্রকাশের ব্যাপার তো আছেই।
কাজেই কবির এই আবদার যন্ত্রণা মনে হলেও আমাকে কোনো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের সাহিত্য পাতায় তেলাতেলি প্রবন্ধের উপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে। এখানে যে কোন সাহিত্যকর্মকে মৃদু তুলোধুনো করে তারপর ছাপানো হয়, এতে নাকি পাঠকের কাটতি বেশি হয়। কবি সাদউল্লাকে সেটা বলাতে তিনি খোলা মনে ‘কলারে চুমুর দাগ’ গ্রন্থের সমালোচনা লিখতে পারি এমন একটা অনুকুল ইঙ্গিতও দিয়ে দেন।
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে
বেশ খানিক যন্ত্রণা সহ্য করে, কবি সাদউল্লাহ শফীর ‘কলারে চুমুর দাগ’ নিয়ে অনেকটা খেটেখুটে অবশেষে একটা গঠনমূলক কাব্য সমালোচনা তৈরি করে ফেলি। প্রথম কাভারে কিছুতেই সম্ভব না বলে সম্পাদককে বুঝিয়ে পেছনের কাভারে একটা জায়গা বরাদ্দ করি। লেখাটা তৈরী করতে গিয়ে ঘাম ছুটে গিয়েছিল আমার। এদিক ওদিক থেকে বিস্তর টোকাটুকির চালান কম হয়নি লেখাতে। জবরদস্ত সমালোচনা বলা যায়। কবি পরিচিত ফেসবুক বন্ধু, উপরন্তু, একজন সরকারি আমলা বলে সমালোচনায় ছাড় দেয়া হয়নি একদম। বলা চলে নির্মোহ সমালোচনা। লেখাটা তৈরি করে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে চালান করে দেই সেকেন্ড কাভারে। অত্যন্ত খুশি মনে সে খবরটা টেক্সট মারফত জানিয়ে রাখি কবিকে। আগামি পরশু দেখা যাবে ‘কলারে চুমুর দাগ!’
সেদিন রাতে বাবার শরীর খারাপের খবর পেয়ে পরদিন ভোরেই আমাকে গ্রামের বাড়ি ছুটতে হয়। একদিনের ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেলেও, পাক্কা পাঁচদিন সেখানে কাটিয়ে আসতে হয়। বাবার বয়স হয়েছে, শরীরে নানা জটিলতা। তবে এ যাত্রা টিঁকে যাওয়ায় স্বস্তি নিয়ে ফিরে আসি কর্মস্থলে। বাবাকে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম ক’দিন, বাইরের পৃথিবীর খোঁজখবর নেয়া হয়নি।
ফিরে এসে প্রথমেই কবি সাদউল্লাহর প্রতিক্রিয়া জানতে ফোন দেই তাকে। রিং হয়ে গেলেও ওপাশ থেকে কেউ ফোন তুলে না। ফেসবুকে লগইন করি। কয়েকদিনের নানা নোটিফিকেশনের স্তূপ সরিয়ে কবির ওদিকে উঁকি দেই। সাদউল্লাহকে ফেসবুকে লগইন দেখে আশ্চর্যই লাগে। অনলাইনেই তো আছে লোকটা! তাহলে ফোন ধরেনি কেন? এমন আচরণের হেতু কী? আবারও ফোন দেই সাদউল্লাহর নাম্বারে। ফোনটা যথারীতি বেজে বেজে কেটে যায়। কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে বুঝতে পারি।
কারণ খুঁজে না পেলেও মনের ভেতর একটা অস্বস্তি জেগে থাকে। কোথায় গড়বড় হলো জানতেই হবে। অতএব বিস্তারিত জানতে চেয়ে সাদউল্লাহকে একটা ই-মেইল করার সিদ্ধান্ত নেই। মেইলটা লিখতে বসা মাত্রই প্রধান সম্পাদকের তলব আসে পিয়ন মারফত। মেইল পাঠিয়ে প্রধান সম্পাদকের দপ্তরে গিয়ে জানতে পারি, সামনের মাসে কে কয়টা বিজ্ঞাপন আনবে তার খসড়া আলোচনা চলছে। গত মাসে শাঁসালো দুটো বিজ্ঞাপন আনায় প্রধান সম্পাদক আমার উপর আস্থাশীল বলে আগামী মাসে আরো চারটা বিজ্ঞাপনের টার্গেট দেয়া হলো আমাকে। ঘোষণা শুনে আমি বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। এই উন্নতি আমার ভালো কাজের পুরস্কার, নাকি দ্বিগুণ কাজের শাস্তি? বেশি দায়িত্ব মানে বেশি উন্নতি। এইই তো হবার কথা। খুশি হওয়া উচিত আমার।
কিন্তু আমার কাজের উপর কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট বলে যে খুশির আলো বুকে নিয়ে মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে এলাম সেই খুশিটা দপ করে নিভে গেলো যখন এক সিনিয়র সহকর্মী পাশে এসে ফিসফিস করে জানালেন, সাদউল্লাহর কাছ থেকে লাখখানেক বাগিয়েছি কিনা। আরো জানা গেলো গত সপ্তাহেই সম্পাদক ব্যক্তিগত আলাপে জানিয়েছেন সাদউল্লাহর কাব্য আলোচনাটির বিনিময়ে তার কাছ থেকে দ্বিগুণ বিজ্ঞাপন সুবিধা নিতে হবে, আর সে কাজ উদ্ধারের দায়িত্ব আমারই।
কিছু কাজ জমে গেছে কদিনে, সেগুলো সারতে সারতে বেশ রাত হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে না খেয়ে শুয়ে পড়ি। ভাবনায় দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না। সাহিত্য পাতায় কেউ চাকরি করে এই গোলামির দেশে? সাহিত্যপাতায় কোন বিজ্ঞাপন থাকে না সত্যি, কিন্তু ছাপানো কবিতাগুলোর তলায় যে কত বিজ্ঞাপনের হাতছানি লুকিয়ে আছে সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ জানে না। চাকরির প্রথম দিকে সামান্য একটা দুটো বিজ্ঞাপন যোগাড়েই ঘাম ছুটে যেত। কারো উচ্চাশাও ছিল না তাই আমার উপর। ব্যাটা সাদউল্লাহর সুপারিশে পাওয়া বিরাট অংকের বিজ্ঞাপন দুটো খাঁই বাড়িয়ে দিয়েছে প্রধান সম্পাদকেরও।
কেন যে সাদউল্লাহর সাথে জুটতে গেলাম। এখন কোনদিক সামলাই। একদিকে সাদউল্লাহ অন্যদিকে প্রধান সম্পাদক। সাদউল্লাহ যে সমালোচনাটিকে সহজভাবে নিতে পারেনি সেটা এখন স্পষ্ট। তার মানে সমালোচনা নির্মোহ ছিলো। অথচ সহকর্মীরা ভাবছে আমি টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়েছি সাদউল্লাহর কাছে।
কিছুটা তো বিক্রি হয়েছি সত্যি। সেটা নগদ অর্থ নয়, ভবিষ্যতের হাতছানি এবং পত্রিকার বিজ্ঞাপন। এখন সাদউল্লাহর কাছ থেকে কী উত্তর আসবে জানা নাই, কিন্তু শুভ কিছু ঘটতে যাচ্ছে না সেটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিচ্ছে।
নিজের উপর নিদারুণ এক আক্রোশে দেয়ালে মাথা ঠুকে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটাতে ইচ্ছা করছে। খামোখাই ফাপড় নিতে গিয়ে কাব্য সমালোচনায় সাদউল্লাহর অন্যান্য কবিতার কলার ধরে টানাটানির কী প্রয়োজন ছিল! ‘কলারে চুমুর দাগ’-এ মৃদু লাঠি পেটাই তো যথেষ্ট ছিল। সাদউল্লাহর অন্য কাব্যগ্রন্থে নাক না গলালে পরিস্থিতি হয়ত এতটা জটিল হতো না। আসলে পরিস্থিতি কতটা জটিল সেটাও জানার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না। সাদউল্লাহ তার ব্যক্তিগত যে নাম্বার দিয়েছিলো, সেটায় ইতিমধ্যে পঞ্চাশের অধিক রিং করা হয়ে গেছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি তার নাগাল পেতে। শালা! প্রেম বাঁচাতে মরিয়া কোনো প্রেমিকও মনে হয় না এতবার রিং দেয় প্রেমিকার মান ভাঙাতে!
প্রায় নির্ঘুম একটা রাত পার করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরদিন কাজে আসতে হয়। সাহিত্য পাতার বেশ কিছু কাজ গোছানো বাকি পড়ে আছে। আজকে সেগুলো না দেখলেই না। আগামিকাল যাবে ওটা। কাজে হাত দেবার আগে ভারী কিছু খেতে হবে। রাতে খাওয়া হয়নি। শরীর মন কাহিল লাগছে। পিয়ন ফরিদকে ডেকে তিনটা পরোটা ভাজি আর ডিমের অর্ডার দিয়ে সাদউল্লাহ মেইলের উত্তর করেছে কিনা সেটা দেখে নেই চট করে আরেকবার। নাহ্ এখনও কোনো সাড়া শব্দ নাই। ঘাউড়া!
আয়েস করে খাওয়ার সময় নাই। দ্রুত মুখ চালিয়ে নাস্তা পর্ব শেষ করে ফরিদকে চায়ের কথা বলতে যাবো, সে মুহূর্তে জি মেইলে নতুন মেইল আসার বার্তা শুনে মন বললো, ওটা ঠিক সাদউল্লাহর মেইল। সত্যিই তাই! মেইলটা খোলার আগে বুকের ভেতর কেমন একটু ঢিপঢিপ করে! ধ্যাৎ ওসব মেলোড্রামায় পাত্তা দেয়ার কিস্যু নাই। শুভ খবরই আছে ওটাতে। আমার মায়ের কথা, শুভ চিন্তার মধ্যে থাকলে শুভই ঘটে। দেখা যাক কী শুভ বার্তা পাঠালেন কবি সাদউল্লাহ শফী।
প্রিয় আব্দুল মাজেদ সরদার,
আপনার নির্মোহ সমালোচনায় আমি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। এতটা সত্য আজকাল কেউ বলে না। আপনি কবিতার ক না বুঝেও কাব্যগ্রন্থের এমন জটিল ব্যবচ্ছেদ করেছেন তার নজির বিশ শতকে কয়েকটি থাকলেও একুশ শতকে আর কেউ দেখাতে পারেনি। আপনার এই উপহারের কথা আমি কখনো ভুলবো না।
যাই হোক, ব্যস্ত থাকায় জানানো হয়নি, অগ্রসর প্রকাশনী থেকে আপনার পাণ্ডুলিপি ফেরত এসেছে। আরেকটা কথা, আগামী মাস থেকে তিলোত্তমার বিজ্ঞাপনগুলো ডিসকনটিনিউ করবে। আমি জানি আপনি অন্য কোন জায়গা থেকে বিজ্ঞাপন পেয়ে যাবেন। কোন সাহায্য লাগলে জানাতে দ্বিধা করবেন না।
শুভকামনায়
সাদউল্লাহ শফী
কয়েক লাইনের মেইলটা এই নিয়ে পাঁচবার পড়লাম। লিখিত ভাবেও এমন ঠাটিয়ে চড় মারা সম্ভব!
নতুন এক অভিজ্ঞতায় শরীর মন গুলিয়ে ওঠে। মাত্রই পেটে যাওয়া নাস্তা বিবমিষাময় অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।
সাদউল্লাহ যে সুশীলতার ভেকধারী একজন অতি বদ, তাতে আর বিন্দু মাত্র সন্দেহ নাই আমার। এই প্রথম ব্যাটা আসল নামে সম্বোধন করেছে। সমালোচনার ঢিলের বদলা দিলো পাণ্ডুলিপি ফেরতের পাটকেল দিয়ে! তবে যে খুব বলা হয়েছিল, এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারা সৃষ্টি করবে? এত জলদি সেই ধারা শুকিয়ে গেলো! বিজ্ঞাপন অন্য সোর্স থেকে আনা সম্ভব হলে তোর পেছন চাটি নাকি রে ব্যাটা কবি নামের কলঙ্ক!
কিন্তু এভাবে ছেলেমানুষি রাগ প্রকাশে আসন্ন ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব না। কোমর ভাঙা সাপের মতো ফোঁস ফোঁসই সার। চোখের সামনে ভবিষ্যতের স্বপ্ন এভাবে মিসমার হতে দেখবো সেটা কে ভেবেছিল! মুখের ভেতরটা তিতকুটে স্বাদে ভরে যাচ্ছে ক্রমশ। মাথার ভেতরে দপদপ শুরু হয়েছে। তিতকুটে ভাবটা দূর করতে বেশি চিনির কড়া লিকারের এককাপ চায়ের প্রয়োজন এখন।
কে হারে কে জিতে খেলা হলে শেষ
কবি সাদউল্লাহর মুখোমুখি হয়ে, ভুল স্বীকার করে নেবার উদ্দেশ্যে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি কয়েকবার। কিন্তু আমাকে আর পাত্তাই দিচ্ছে না লোকটা। ফোনে মাত্র দুবার সংক্ষেপে কথা বলেছে। তারপর থেকে ফোনও ধরছে না আর। মেইলের জবাবও বন্ধ। অথচ অফিসে আমার করুণ অবস্থা। বই প্রকাশ দূরে থাক, চাকরিটা থাকে কিনা সন্দেহ। এই মাসের বিজ্ঞাপন টার্গেট মিস হয়ে গেলো। আগামী মাসও তাই হবে।
অনেক ভেবেচিন্তে চরম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সাদউল্লাহর সাথে যোগাযোগ চেষ্টা বন্ধ রেখে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে গেলাম।
***
ঠিক তেত্রিশ দিনের মাথায় কাঙ্খিত ফোনটা এলো সাদউল্লাহর কাছ থেকে। জানতাম আসবেই। এবার সাদউল্লাহ উল্টা আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলো, তাও গোপনে। একটা পাঁচ তারকা হোটেলে ডিনারের দাওয়াতও দিলো।
ব্যাপার কী? আমি জানতে চাইলাম।
উত্তরে সাদউল্লাহ বিনীত গলায় জানালো,
--সাহিত্যিকরা পরস্পরের ভাই ভাই। এখানে উঁচু নীচু অহংবোধ থাকা একদম অনুচিত।
আমি কিছুই জানি না ভান ধরে বলি, আমরা তো বরাবরই ভাইবেরাদর সাদউল্লাহ ভাই। আপনার জন্য সত্যি আমার গর্ব হয়। এত বড় পদে থেকে কেউ এমন কাব্য রচনা করতে পারেনি এই দেশে। আপনি এগিয়ে যাবেন।
সাদউল্লাহ প্রায় কঁকিয়ে ওঠে, আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের সাহিত্য করার কোনো উপায় নাই নেহাল ভাই।
এই প্রথম সাদুল্লাহর মুখে ‘ভাই’ শব্দটা ফুটলো। খিদের পেটে বাঘেও ঘাসে মুখ দেয়। পেটে হাত দিয়ে হেসে উঠতে ইচ্ছা হলো আমার। ফোনের ওপাশ থেকে চেহারা দেখা যায় না ভাগ্যিস।
--একটু মুখোমুখি বসতে হবে ভাই। জিনিসটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। এটা আমার আর আপনার মধ্যে থাকুক। আর কেউ যেন না জানে।
এবার আমার পিছলে যাবার পালা।
সময় নাই, ব্যস্ত আছি বলে কয়েকবার পিছলে যাবার পর, সাদউল্লাহ সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে বসলো। ব্যাপারটা গোপন রাখলে আমাকে সব রকমের সহায়তা দেয়া হবে। প্রতি মাসে একাধিক বিজ্ঞাপন, বই প্রকাশ, এমনকি আমার জন্য একটা মোটর সাইকেল কিনে দেয়ার প্রলোভন দেখাতেও ভুলে না ব্যাটা।
এতটা আশা করিনি। তবু প্রলোভনগুলো আমাকে আরো বাড়তি চাহিদার জন্য প্ররোচিত করে। এত কিছু দেবে যদি, সাথে কিছু নগদ নয় কেন? লাখ খানেক কামাই করার বদনাম তো কপালে সেঁটে গেছে। সত্যি সত্যি লাখ খানেক পেলে কেমন হয়।
কিন্তু আমি নিজের মুখে কিছুই চাইবো না। সাদউল্লাহর দপ্তরে আমার গ্রামের এক আত্মীয় চাকরি করে। তার কাছ থেকে সাদউল্লাহর কিছু দুর্নীতির তথ্য জেনেছি। কোটি কোটি টাকা কামাই করেছে লোকটা গত কয়েক বছরে। তার কাছ থেকে কিছু খসে গেলে তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। কিন্তু তা আমি নিজ থেকে চাইবো না। সাদউল্লাহ বলুক।
অতএব আমি,
--ভেবে দেখি, সময় করে জানাবো বলে ফোন রেখে দেই।
আমার আর সময় হয় না এক সপ্তাহেও। অধৈর্য সাদউল্লাহ আবারো ফোন করলো। করতেই হবে। ‘সম্বর আপন ক্রোধ কেন লবে প্রতিশোধ’ আওড়াবার মতো ভালো ছেলে আমি নই। নিজে তেমন শব্দ খরচ না করেই শোধ তুলছি। সাদউল্লাহ যেন নিজেই এগিয়ে আসে সেরকমই চাওয়া। ফোনটা পাবার পর বুঝলাম নীরব থাকার সুফল এসে গেছে।
সাদউল্লাহ এবার নগদ দু লাখ টাকা দিতে চাইলো আমার বইয়ের প্রচার ইত্যাদির খরচ বাবদ। আমি হেসে খুন হবার ভান ধরে বললাম,
--যেমন একটা বই, তার আবার প্রচার! আদৌ প্রকাশ হবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নাই।
আরেকটু জুড়ে দিলাম
--না ভাই, বই প্রকাশের ইচ্ছা মরে গেছে।
এবার সাদউল্লাহ মরিয়া হয়ে উঠলো, পাঁচ লাখে রফা হোক ভাই। আসেন, দুই ভাই একসাথে ডিনার করে ব্যাপারটা চুড়ান্ত করি।
--কোন ব্যাপার? বিস্মিত ভাবটা গলায় ভালোই ফুটিয়ে তুললাম।
--জেসিকা আপনাকে যেগুলো দিয়েছে তা আর কেউ যেন না দেখে, না জানে। আপনার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। অতীতের ভুল বোঝাবুঝি কেটে গেছে আমাদের। আপনি আমার সবচেয়ে বিশ্বাসী বন্ধু। আপনার কাছে লজ্জিত হতে অসুবিধা নাই। কিন্তু এই ঘটনা দশকান হলে আমার চুড়ান্ত সর্বনাশ হয়ে যাবে। সমাজে আমার মান সম্মান, এতকালের অর্জিত অবস্থান, সব ধুলোয় মিশে যাবে। আমার সংসার ভেঙ্গে যাবে। বুড়ো বয়সে এই কেলেঙ্কারি মাথায় নিতে পারবো না। আমি ভুল করে ফেলেছি। জেসিকা আমার কন্যার বয়সী। তবু মাথা ঠিক ছিল না আমার। ভুল করে ফেলেছি। চরম ভুল। আপনি, একমাত্র আপনিই বাঁচাতে পারেন। জেসিকা বলেছে আপনাদের বিয়ের কথা ফাইন্যাল। আপনি কখনো বলেননি আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে। আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি জেসিকা আপনার গার্লফ্রেন্ড হতে পারে। জানলে...আহ কী চরম ভুল করে বসলাম!
আমি কোন জবাব না দিয়ে চুপচাপ শুনে গেলাম। দীর্ঘ একটা শ্বাস বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে জানালাম, ঠিক আছে। আসেন বসি একদিন। আপনি আর আমি। আর কেউ না। জেসিকা আড়ালে থাকুক।
--তাই থাকুক। জেসিকার মুখোমুখি হতে চাই না আমি। আপনিই আমার ভরসা। আপনিই পারবেন এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে।
ভীষণ এক তৃপ্তিতে আমার সমস্ত শরীর মন চনমনিয়ে ওঠে। গত তিনটা মাস কবি সাদউল্লাহর কারণে যে পরিমাণ যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে, সহকর্মী বন্ধু শাহেদ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে শুধু চাকরি না, নিজেও হয়ত ভেসে যেতাম। ফোনটা রেখে সিনেমার খলনায়কের মতো অট্টহাসি দিয়ে উঠতে ইচ্ছে হলো। সাধ মিটিয়ে, আশপাশ কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে ভাবলাম, সাদউল্লাহ ঘুঘু দেখেছে এতদিন, ফাঁদ দেখলো এবার।
দিন যায় কথা থাকে
শাহেদ আমার সহকর্মী কম, বন্ধু বেশি। অফিসের অধিকাংশ লোকই যখন বিশ্বাস করে বসে আছে, আমি সাদউল্লাহ কাছ থেকে টাকা খেয়ে কাব্য সমালোচনা ছাপিয়েছি, একমাত্র শাহেদ সেটা ভিত্তিহীন বলে প্রতিবাদ করেছে। আমার পাশে থেকে কিভাবে চাকরিটা রক্ষা করা যায়, সাদউল্লাহকে জব্দ করা যায়, ইত্যাদিতে পরম সুহৃদের মতো পরামর্শ দিয়েছে। এক পর্যায়ে নিজেও জড়িয়েছে ব্যাপারটায়।
আমার বিমর্ষতা কাটানোর উদ্দেশ্যে শাহেদ একদিন প্রায় জোর করেই তার বাড়িতে নিয়ে যায়। উদ্দেশ্য দুই বন্ধু ইরফান খানের ‘ব্ল্যাকমেল’ মুভিটা দেখতে দেখতে সংকট মোকাবেলা নিয়ে বুদ্ধি পাকানো যাবে। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই যাওয়া আমার। এমন মন মেজাজ নিয়ে সিনেমা হজম হয় নাকি! ইরফানের মুভিটাই যে আমার মুশকিল আসানের পথ দেখাবে কে জানতো! ব্ল্যাকমেল দেখতে দেখতে শাহেদের মাথায় ফাঁদ পাতার বুদ্ধিটা ঘন হয়।
সত্যি, প্ল্যান মতো নিখুঁতভাবে শাহেদ কাজটা করেছে। জেসিকা নাম নিয়ে ফেসবুকে একটা আইডি খুলেছিল তেমন পরিচিত নয়, উঠতি এক মডেলের কিছু ছবিটবি দিয়ে। জেসিকা একজন প্রবল কাব্যানুরাগী। এমন একজন কাব্যপ্রেমীর পক্ষে কবি সাদউল্লাহর নাগাল পেতে খুব দেরি হয় না। দ্রুতই সাদউল্লাহর কাব্যের প্রেমে পড়ে যায় সে। ফেসবুক পোস্টে সাদউল্লাহর কবিতায় প্রবল অনুরাগ নিয়ে মন্তব্য শুরু হয় তার। সেসব উথলে ওঠা মন্তব্য পড়ে সাদউল্লাহ যথারীতি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালে জেসিকা গ্রহণ করে। তারপর থেকে সাদউল্লাহ ইনবক্সে প্রায়ই নক করতে থাকে। কোনো এক রহস্যময় কারণে সাদউল্লাহ ফোনালাপের চেয়ে ইনবক্সেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। ব্যাপারটা জেসিকার জন্য শাপে বর হয়।
দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ কাব্যসম্পর্ক গড়ে ওঠে এক সপ্তাহের মধ্যে। দ্বিতীয় সপ্তাহে সাদউল্লাহর একাকীত্ব ভেসে আসে জেসিকার দিকে। মাঝরাতেও মেসেজ বিনিময়ে ক্লান্তি দেখা যায় না ওদের। তৃতীয় সপ্তাহে এসে সাদউল্লাহ নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেনা। একবুক আবেগ আর কয়েক পেগ দ্রাক্ষারসের উচ্ছ্বাসে সে ইনবক্সে ভালোবাসা সোহাগের জোয়ার বইয়ে দেয়। জেসিকা সাড়া না দিলেও বাধা দেয় না তাতে। মোটামুটি কয়েকদিন সাদউল্লাহকে খেলিয়ে নিয়ে একদিন যখন সাদউল্লাহ তালজ্ঞান খুইয়ে ওকে একটা তারকা হোটেলে রাত্রি যাপনের আমন্ত্রণ জানায় জেসিকা তখন ঝলসে ওঠে। সপাটে জানিয়ে দেয় সাদউল্লাহর প্রতি সে সহানুভূতিশীল, তার নিঃসঙ্গতার সহমর্মী হলেও এমন অনৈতিক সম্পর্কে জড়াতে পারে না। তাকে যেন ক্ষমা করা হয়। তাছাড়া সে একজনের বাগদত্তা। তার পরিচয় দিতে দ্বিধা করলেও শেষে জানিয়ে দেয় সে হলো নেহাল। ব্যস, সাদউল্লাহ চেক এন্ড মেট! তার তখন শুধু প্রেম না, প্রাণপাখিও উড়ে যাবার দশা।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দেয়া শুরু করলাম পরের দিন থেকে। জেসিকা অর্থাৎ শাহেদের সাথে ইনবক্সে সাদউল্লাহর রগরগে কথোপকথনের স্ক্রীনশটগুলো একের পর এক তাকে মেইলে পাঠাতে থাকি। বদমাইশির অংশ হিসেবে ফোনটাও অফ করে রাখলাম। বাকিটুকু তো ইতিহাস হা হা হা…..
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)