ওয়েলকাম টু টাইমমেশিন। সময়ের জাঁতাকলে আপনাকে স্বাগত। আজ আমরা যাব স্কটল্যান্ডের শহর ডামফ্রিসে। সেখানে একটা ছোট্ট হোটেলের সামনে কাতারে কাতারে ভিড় করেছে সাধারণ মানুষ। পুলিশ বলছে জমায়েতটা প্রায় আট হাজারের। লোকগুলো চিৎকার করে কিছু একটা দাবী জানাচ্ছে। মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলো মূহুর্মূহু আকাশের দিকে উঠছে। সামনের সারির একজন হঠাৎই পথের ধারে ছড়ানো নুড়ি পাথর তুলে হোটেলের একটা জানলা তাক করে ছুঁড়ে দিল। মুহূর্তে উত্তেজিত জনতার পক্ষ থেকে শুরু হল পাথর বৃষ্টি। কিন্তু কেন এই আক্রমণ? কি তাদের দাবী? চলুন একটু দেখে আসি....
১৮২৯ সাল, ফেব্রুয়ারী মাস, সময় রাত নটা।
স্কটল্যান্ডের ডামফ্রিস শহরের একটা ঘুপচি হোটেলের দোতলার ঘর। ঘরের কোণে রাখা টেবিল-চেয়ারটাতে রাতের খাবার খাওয়ার তোড়জোড় করছিল উইলিয়াম। খাবার বলতে শক্ত হয়ে যাওয়া একপাউন্ড রুটি, দুটুকরো ছিবড়ে মাংস সহযোগে একবাটি ট্যালটেলে ঝোল আর একবোতল সস্তা মদ। তিনদিন পরে পাওয়া এই খাবারটুকুই ওর কাছে এখন অমৃত। অবশ্য এর চেয়ে বেশি কিছু কেনার সামর্থ্যও আজ আর তার নেই। ঝোলে ভেজানো রুটির প্রথম টুকরোটা সবে মুখে তুলতে যাচ্ছিল, তখনই রাস্তা থেকে একটা বড়সড় আকারের পাথর উড়ে এসে পড়ল ঘরের জানলায়। ঝনঝন করে কাচ ভেঙে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। কোনোরকমে টেবিলের আড়ালে বসে পড়ে নিজেকে রক্ষা করল সে। এতক্ষণ মোটা কাচের আস্তরণ ভেদ করে যে শব্দ ঘরে প্রবেশ করতে পারছিল না এবার সেই শব্দের ঢেউ উইলিয়ামের কানে আছড়ে পড়ল। সন্তর্পণে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল উইলিয়াম। মুহূর্তে তার শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়াল স্রোত বয়ে গেল। হোটেলের বাইরে থিকথিক করছে শুধু কালো কালো মাথা। সবার চোখ এই জানলাটার দিকে। উত্তেজিত হয়ে লোকগুলো চিৎকার করছে সমানে। এই প্রচণ্ড ঠান্ডার রাতে এতোগুলো মানুষ কী উদ্দেশ্যে এখানে জড়ো হয়েছে তা ঠাওর করতে ঠিক একমিনিটও সময় লাগল না ওর। ভয়ের চোটে এই ঠান্ডাতেও ঘামতে লাগল সে। ঠিক সেই সময়ই দরজায় উপর্যুপরি ধাক্কা দিতে লাগল কেউ। তবে কী লোকগুলো ইতিমধ্যে হোটেলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে? দেওয়ালের কোণে ঝোলানো ওভারকোটটা গায়ে চাপিয়ে নিল উইলিয়াম। যা থাকে কপালে ভেবে ঘরের দরজাটা খুলতেই, হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে এলো হোটেলের মালিক।
--আপনি তো মশাই ডেঞ্জারাস লোক। ঘর দেওয়ার সময় কেন যে আপনাকে চিনতে পারলাম না! তাহলে আর এসব ঝামেলায় পড়তে হতো না। যাক, যেটা বলতে এলাম। বাইরের পরিস্থিতি নিশ্চয়ই দেখেছেন। এ..হে..হে..ঘরটায় কী অবস্থা করেছেন মশাই!
ভদ্রলোকের এহেন অনুতাপের কারণ, কথা বলতে বলতে তার দৃষ্টি পড়েছে ঘরের মেঝেতে ছড়ানো কাচের টুকরোগুলোতে। উইলিয়াম কোনোমতে ভদ্রলোককে বোঝাতে লাগল--দেখুন, ইয়ে আমি কিন্তু আইনের চোখে...
--ওসব আইন-ফাইন অন্য জায়গায় দেখাবেন মশাই। আমার হোটেলে আমি কোনো ঝামেলা চাই না। আপনি এক্ষুনি ঘর ছাড়ুন। হোটেলের পেছনদিকে একটা ঘোরানো সিঁড়ি আছে। সেটা দিয়ে নিচে নেমে গেলে একটা গলি পাবেন। গলিপথ ধরে সোজা এগিয়ে যান। আমি পুলিশে খবর দিয়েছি। তারাই এসে এদিকের পরিস্থিতি সামলাক।
নিজের মনেই গজ গজ করতে করতে ভদ্রলোক নিচে নেমে গেল। ততক্ষণে আশপাশ থেকে বেশ কিছু নেশাতুর চোখ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতে শুরু করেছে। আর বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেল না উইলিয়াম। ঘরের কোণে পড়ে থাকা খাবারের থালাটার দিকে করুণ চোখে একবার চেয়েই পেছনের সিঁড়ির দিকে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল সে।
গলিপথ যেখানে শেষ হয়েছে সেটা একটা চওড়া সড়ক। এই শহরে আগে কখনো না আসাতে শহরের রাস্তাগুলো একদমই চেনা নয় উইলিয়ামের। এতো রাতে কোনদিকে, কার কাছে গেলে একটু নিরাপদ আশ্রয় জুটবে, তা জানা নেই। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে আজ। রাস্তার মাঝে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে যে কোন সময়ে কারো চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। বলা যায় না, ঐ লোকগুলো এদিক পানে যদি চলে আসে! চওড়া রাস্তাটার উল্টো দিকেই একটা পার্কের মতো খোলা জায়গা দেখা যাচ্ছে। উপায়ান্তর না পেয়ে সেখানেই যাওয়া মনস্থ করল সে।
ওক, উইলো, জুনিপারের মতো বিভিন্ন গাছ দিয়ে জায়গাটা ঘেরা। ঐ তো, ওক গাছটার নিচে একটা কাঠের বেঞ্চ। আজ রাতে ঐ বেঞ্চটাই ঠিকানা হোক তবে। শনশন করে বয়ে চলা ঠান্ডা হাওয়া চামড়ায় যেন সূচ ফোটাচ্ছে। খিদেটা মাঝে মাঝে চাগাড় দিয়ে শীত ভাবটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওভারকোট দিয়ে পুরো শরীরটা মুড়ে জবুথবু হয়ে বসল ও।
একটানা বসে থাকতে থাকতে একটু পরেই চোখটা বন্ধ হয়ে এসেছিল। তখনই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই বিস্ফোরিত চোখদুটো। ধড়মড়িয়ে সোজা হয়ে বসল উইলিয়াম। গত একমাস ধরে এই চোখদুটো বড্ড জ্বালাতন করছে ওকে। অথচ সে ঘটনা কবেই তো চুকেবুকে গেছে। আর শুধু যে ঐ একজনের সঙ্গেই এমনটা হয়েছিল তা তো নয়, তবুও বারবার ঐ একজনের কথাই যে কেন মনে পড়ে! জেরার সময় উইলিয়ামের সবচেয়ে কাছের বন্ধু আর সব কাজের দোসরও একই কথা বলেছিল পুলিশকে। যদিও পুলিশ সেকথা বিশ্বাস করেছিল বলে মনে হয়না।
বন্ধুর কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। বন্ধুর শেষ পরিণতি অমন ভয়াবহ হওয়ার জন্য ও নিজেই কি দায়ী নয়? কিন্তু ঐ পরিস্থিতিতে নিজেকে বাঁচাতে আর কীই বা করার ছিল ওর? এই জোৎস্না ধোয়া রাতে, এই জনহীন প্রান্তরে বসে কেবলই পুরনো দিনগুলো মনে পড়তে লাগলো। খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়। এখনও ভীষণ টাটকা সে স্মৃতি....
তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল ইউনিয়ন ক্যানালে কাজ করতে গিয়ে। গোল মুখ, সাধারণ চেহারা, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলের ছেলেটার মধ্যে কিছু একটা ছিল যা প্রথম দিন থেকেই উইলিয়ামকে আকর্ষণ করেছিল। আকর্ষণ আরো বেড়েছিল যখন ও জানতে পেরেছিল সদ্য পরিচিত ছেলেটার নামও উইলিয়াম। দুই উইলিয়ামের বন্ধুত্ব গাঢ় হতে বেশি সময় লাগেনি। ওদের দুজনের স্ত্রী হেলেন আর মার্গারেটও পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠেছিল।
উফ্! হেলেন… সেই পিশাচিনী… সুখের দিনগুলোতে কত হাসাহাসি, গল্প, প্রাণের কথা... অথচ আজ এই দুঃসময়ে! জীবনের সমস্ত বৈভবের সঙ্গেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল সে। অথচ ওর আগের বর মিস্টার লোগ ছিল একজন অতি সাধারণ মানুষ। সস্তার লজ্ ভাড়া দিয়ে কোনোক্রমে দিন গুজরান করাটাই যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। সেই লোকটার বৌ হিসেবে কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য পেতে মার্গারেট? হ্যাঁ, অবশ্য ঐ ভাঙাচোরা লজটা সত্যিই খুব লাকি ছিল। ওখান থেকেই তো শুরু হয়েছিল ওদের ব্যবসাটা। সেই যে রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার, কি যেন নাম ছিল লোকটার? ও হ্যাঁ, ডোনাল্ড। একটা বেতো বুড়ো। ...খিকখিক করে আপনমনে হাসলো উইলিয়াম। তারপর আবার ডুবে গেল নিজের ভাবনার জগতে। কতদিন ধরে ঘোরাচ্ছিল লোকটা ভাড়ার জন্য। কি না “পেনশন পাইনি এখনও”। আরে, লোকটা পেনশন পায়নি তো উইলিয়াম কি করবে? সেই তো ভাড়ার টাকাটা না দিয়েই মরে গেলো লোকটা। চার পাউন্ড কি মুখের কথা? ডেডবডিটা ছাড়া তখন হাতে আর ছিলই বা কি? তাও ভাগ্যিস বুদ্ধিটা দিয়েছিল উইলিয়াম, মানে উইলিয়াম বার্ক।
রাতারাতি ডেডবডিটা কফিন থেকে সরিয়ে ফেলেছিল ওরা। গাছের ছাল দিয়ে কফিন ভর্তি করে সেটাকে কবরে রেখে এসেছিল। তারপর ডেডবডিটা একটা ব্যারেলে ভরে নিয়ে গেছিল এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটিতে। ওহ্, সেদিন কী ভয়টাই না করছিল! শুধু মনে হচ্ছিল, যদি কেউ সন্দেহ করে? যদি লোক জানাজানি হয়ে যায়? ভয়ের চোটে উইলিয়ামের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছিল। ভাগ্যিস বার্ক সঙ্গে ছিল! সেই সেদিন সমানে সাহস জোগাচ্ছিল। ইউনিভার্সিটির ভেতরে ঢুকে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে ঠিকঠাক লোকের খোঁজ করা সবই করছিল বার্ক। উইলিয়াম শুধু পাশে পাশে ছিল এই যা। যদিও ড: নক্সের সঙ্গে দেখা করার পরে এই ভয় পাওয়াটাকে নিজের ছেলেমানুষি বলে মনে হচ্ছিল উইলিয়ামের। ড: নক্সের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন তিনি একটা ডেডবডি পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। সেদিন মোট সাত পাউন্ড দশ সেন্ট পাওয়া গেছিল। কড়কড়ে চার পাউন্ড পাঁচ সেন্ট হাতে পাওয়ার পর উইলিয়াম প্রথম মুখ খুলেছিল--টাকা রোজগার এতো সহজ! বার্ক উত্তর দিয়েছিল--ইয়েস মাই ফ্রেন্ড। তবে এটা তো কাকতালীয় ব্যাপার ছিল। কিন্তু তুমি যদি এই সহজ পথ ধরে আরো এগিয়ে যেতে চাও তবে তোমার সঙ্গে তোমার এই বন্ধু অবশ্যই আছে। স্ফূর্তি খেলছিল বার্কের গলায়--
--পাগল নাকি? রোজ রোজ ডেডবডি পাব কোথায়?--শেষ কথাগুলো ফিসফিস করে বলল উইলিয়াম।
--যাতে পাওয়া যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
--কিরকম?--
--সব কথা এই রাস্তাতেই সারবে? ঘরে চলো, একটু আমোদ আহ্লাদের ব্যবস্থা করা যাক আগে। বিশেষ করে, পকেটে যখন সদ্য এতোগুলো পাউন্ডের আগমন ঘটল।
ঘরে ফেরার পর ভাজা মাংসের টুকরো সহযোগে মদিরার পাত্রে চুমুক দিতে দিতে বার্ক যে প্রস্তাব দিয়েছিল তাতে চমকে উঠেছিল উইলিয়াম। সেটা লক্ষ্য করে বার্ক বলেছিল--কি হলো? অমন চমকালে কেন? আজ যখন ড: রবার্ট নক্সের কাছে বডিটা নিয়ে গেছিলাম আমরা তখন নক্সের চোখের দিকে তাকিয়েছিলে তুমি?
--ঐ কানা ডাক্তারের চোখে তুমি আবার কি জাদু দেখলে?
--উঁহু, উঁহু, ওভাবে বোলো না। উনি আমাদের খরিদ্দার। আর কে না জানে খরিদ্দারই স্বয়ং ঈশ্বর। তাছাড়া ডাক্তার হিসেবে দেশবিদেশে ওঁর যা পসার তাতে এভাবে ওঁকে হ্যাটা করাটা কি তোমার ঠিক হচ্ছে? বলা তো যায়না ভবিষ্যতে কখনও ওঁর কাছেই তোমাকে চিকিৎসার জন্য…
--তুমি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছ?
--একদমই না। বন্ধু হিসেবে জাস্ট একটা পরামর্শ দিচ্ছিলাম। তাও মজার ছলে।--মুচকি হাসলো বার্ক।
--কিন্তু ওঁর একটা চোখ অমন হলো কিকরে বলো তো? কেমন বীভৎস দেখতে লাগে ওঁকে।
--শুনেছি ছোটবেলায় স্মল পক্সে আক্রান্ত হয়েই ওঁর চোখটা নষ্ট হয়ে গেছে। ওসব কথা বাদ দাও। আমরা মূল প্রশ্নটা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।... বাঁ হাতটা নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল বার্ক।
--না… সেভাবে তো… তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ বলোতো?
--আমি আজ নক্সের চোখে লোভ দেখেছি। এভাবে লাশ কেনাবেচায় লোকটা অভ্যস্ত। তাছাড়া একটা কথা তুমি ভাবো, সরকারি ভাবে বেওয়ারিশ লাশ কাটাকুটি করার অনুমতি পাওয়া যথেষ্ট কঠিন কাজ। সরকার নিজেই যেখানে লাশ জোগান দিতে অপারগ, সেখানে ডাক্তারদের আর উপায় কি? ছাত্রদের পড়াশোনা তো আর থামিয়ে দেওয়া যায় না! বরং ভাবো না, আমরা খানিক দেশসেবা করছি।
--দেশসেবা?
--হুম, কিছু অপ্রয়োজনীয় লোক, যারা আজ বাদে কাল এমনিই মরবে, তাদের সরিয়ে দেওয়া এমন কিছু অন্যায় কাজ নয়। উল্টে ডাক্তারির ছাত্রদের কত উপকার হবে ভাবো তো! আজ যখন আমরা ফিরে আসছিলাম তখন ড: নক্সের এক ছাত্র বলল শুনেছ, “প্রয়োজনে আপনাদের সাথে আবার দেখা হলে খুশি হব,”--এর মানেটা কি তোমাকে আলাদা করে বোঝাতে হবে, হেয়ার?
--সবই বুঝলাম। কিন্তু তাবলে খুন?
--উঁহু, বললাম না দেশসেবা। ঠিক আছে, তুমি বরং আজ রাতটা ভেবে দেখ।
না সারারাত ধরে ভাবতে হয়নি উইলিয়াম হেয়ারকে। মাত্র ঘন্টা খানেক পরই প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে সহমত হয়েছিল সে। তারপর?...হ্যাঁ তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল সেই সোনার সময়। কে যেন ছিল ওদের প্রথম শিকার? উমম্...মনে পড়েছে। জোসেফ, হ্যাঁ জোসেফ তো ছিল লোকটার নাম। একটা ময়দা কল চালাত জোসেফ। সেও ভাড়া থাকত উইলিয়ামের বাড়িতে। ঠিক একবছর আগে এইরকম এক শীতের রাতে ঘটেছিল ঘটনাটা। সেদিন সন্ধ্যার পরে জোসেফকে ঘরে ডেকে এনেছিল উইলিয়াম। শীতের রাতে জমে উঠেছিল হুইস্কি আড্ডা। খানেক পরে বার্কও এসে উপস্থিত হয়েছিল। পরিকল্পনা মাফিক জোসেফের প্রতিটা পেগে বেশি বেশি করে হুইস্কি ঢালছিল উইলিয়াম। কিছুক্ষণ পরে জোসেফ যখন নেশার ঘোরে ঢুলতে শুরু করেছিল তখনই হঠাৎ বার্ক একটা বালিশ চেপে ধরেছিল জোসেফের মুখে। হাতে দুটো ছুঁড়ে ছটফটিয়ে কিছু ধরতে চাইছিল জোসেফ। ওর ল্যাগবেগে হাতদুটো চেপে ধরে নিজের শক্তসমর্থ শরীরের পুরো ভারটা জোসেফের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল উইলিয়াম। একটু পরেই জোসেফের সমস্ত ছটফটানি থেমে গেছিল। পরদিন হাতে এসেছিল পাক্কা দশ পাউন্ড। এবার দুজনের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হয়েছিল পাউন্ড। এরপর... একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে উইলিয়ামকে। কিছু মনে করার চেষ্টা করছে উইলিয়াম। আসলে সে এখন ভাবছে জোসেফের পরের শিকার কে ছিল? কিন্তু এই সামান্য কথাটা কিছুতেই মনে পড়ছে না ওর। সব মুখগুলো একটার উপর একটা উঠে গিয়ে কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে ওর এই দুটো হাত দিয়ে হত্যা তো কিছু কম হয়নি! জোসেফের কেসটা প্রথম বলে নাকি জোসেফ ওর ভাড়াটে ছিল বলেই হয়তো তার কথা মনে রয়ে গেছে। কিন্তু বাকি যারা ছিল... চোখ কুঁচকে ভাবল উইলিয়াম। হুঁ, আবছা আবছা মনে পড়ছে যেন... একজন ছিল সেই পেনশন ভোগী খিটখিটে মহিলা... সেই ভবঘুরে পাগলটা... একজন চামড়ার ফেরিওয়ালি... এক রাতের জন্য ওদের আস্তাবলে ঘুমিয়ে ছিল যে মহিলা... পরে তার খোঁজ নিতে আসা সেই তরুণী কন্যা... বার্কের স্ত্রী মার্গারেটের সেই দূর সম্পর্কের আত্মীয়া... সেই প্রতিবেশিনী... ইফি...জেমস..মেরি ...প্যাটারসন না হালডেন?...নাকি হসলার? দূরছাই, কারোরই নাম, ধাম, মুখ কিছুই তো ঠিকঠাক মনে পড়ছে না। সবকিছু ছাপিয়ে বারবার শুধু সেই বোবা ছেলেটার চাউনিটাই চোখের সামনে ভাসছে। একটু আগে ঘুমের ঘোরেও এই ছেলেটার চোখদুটো ওকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। ছেলেটার বয়স তখন কতো হবে? বড়োজোর বারো কি তেরো। ঠাকুমার সঙ্গে ভাড়া থাকত উইলিয়ামের বাড়িতেই। ওর ঠাকুমাকে যখন শোয়ার ঘরে বালিশ চাপা দিয়ে মারছিল ওরা দুজন, তখনও ছেলেটা নিষ্পাপ মুখে রান্নাঘরে উনুনের পাশটাতে চুপটি করে বসে ছিল। ওকে যখন শোয়ার ঘরে তুলে নিয়ে গেল বার্ক, তখনও হয়তো কিছুই বোঝেনি বেচারা। বালিশটা ওর মুখে চেপে ধরার পরেই কেমন হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে । ছেলেটার চোখদুটো কেমন বিস্ফোরিত হয়ে যাচ্ছিল... উফ্, ঐ যে আবার। আবার সেই দৃষ্টি... চোখ বন্ধ করে মাথাটা জোরে জোরে দুদিকে নাড়ল উইলিয়াম। যেন জোর করে দৃশ্যটা সামনে থেকে তাড়াতে চাইল ও। আগে তবু মাঝে মাঝে এই দৃশ্যটা মনে পড়ত ওর। কিন্তু বার্কের মৃত্যুর পরে থেকেই আরো বেশি করে এটা জ্বালাচ্ছে ওকে।
বার্কের মৃত্যু।..ওহ্.. সেটাও যে কী ভয়াবহ! বার্ককে ফাঁসি দিল ওরা। তাতেও শান্তি হলনা। ওর চামড়া ছাড়িয়ে নোটবই বানাল। সেটা নাকি মিউজিয়ামে রাখবে ওরা। বার্কের দেহটাকেও দান করল ইউনিভার্সিটিকে। একদিক থেকে ভালোই হল। বার্ক তো চেয়েছিল ছাত্রদের উপকার করতে। এখন নিজের হাড়গোড় দিয়ে উপকার করবে হবু ডাক্তারদের। হি...হি, কেমন মজা! দুলে দুলে হাসতে লাগল উইলিয়াম। একটু পরেই আবার ভীষণ গম্ভীর মুখে ভাবতে লাগল... পুলিশের কথায় তখন রাজসাক্ষী হতে রাজি না হলেই বোধহয় ভালো হতো। পুলিশ তো সরাসরি কোনো প্রমাণ পায়নি ওদের বিরুদ্ধে। কেন যে তখন মুখ খুলতে গেল ও! সেই তো ওরা টাকাগুলো সব নিয়ে নিল। বাড়ি, বন্ধু, স্ত্রী সেসব কিছুও কোথায় যে হারিয়ে গেল! আসলে পুলিশ ধরে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করছিল তখন ঘাবড়ে গেছিল উইলিয়াম। খুব ভয় করছিল ওর। এই যেমন এখন করছে... উফ্ আবার সেই চোখদুটো ...হা ঈশ্বর, এই দৃষ্টির সামনে থেকে তুমি আমায় রক্ষা করো।--আকাশের দিকে তাকাল উইলিয়াম। সেখানে ধীরে ধীরে আলো ফুটতে শুরু করছে। তটস্থ হয়ে লাফিয়ে উঠল ও। হনহন করে হাঁটতে লাগলো পার্কের বাইরে যাওয়ার পথ ধরে। কেউ দেখে ফেলার আগেই এই শহর ছেড়ে ওকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। ও জানে, সাধারণ মানুষের কাছে এখন ওর শরীরের প্রতিটা অঙ্গের ভীষণরকম চাহিদা। ত্রস্ত, কিছুটা অবিন্যস্ত পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে উইলিয়াম।
চলুন, আমরাও এবার ফিরে যাই। একবছর আগের সেই ক্রুর, নিষ্ঠুর, অর্থপিশাচ শয়তান উইলিয়াম হেয়ারের সঙ্গে আজকের এই অর্ধোন্মাদ, খ্যাপাটে লোকটার মিল খুঁজতে চাওয়া বৃথা। ওকে বরং আমরা হারিয়ে যেতে দিই সময়ের গর্ভে।
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)