১
আজকে যখন ক্যানটিনে চা খেতে যাচ্ছি, তখনও জানি না কী অসৈরণ ঘটতে চলেছে। আসলে সকাল থেকেই বেশ ঘেঁটে আছি, মাথাটা টোস্টের ওপর আলগোছে পড়ে থাকা মার্মালেডের মতো থ্যাসথ্যাসে হয়ে আছে। ধনঞ্জয় ফোন করে ডাকল, “ক্যানটিনে চলে আয়, আমি পাঁচ মিনিটে... নীলুও আসছে।” ক্যানটিনটা আমাদের কাছে একটা নদীর মতো, রুজু রুজু ঠান্ডা হাওয়া, ছপ ছপ বৈঠা পড়ার শব্দ, অন্য নৌকা থেকে বন্ধু মাঝিরা আওয়াজ দেয় – কে যায় রে, ভাটি গান গাইয়া... নৌকা মানে টেবিল, এক একটা টেবিলে ভয়ানক ভিড়, অন্য টেবিলে একা সঙ্ঘমিত্রা। আমি সঙ্ঘমিত্রাকে চিনি, সঙ্ঘমিত্রা আমাকে চেনে না। প্রতিদিনের মতো চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমি সঙ্ঘমিত্রার দিকে তাকাই। আজ তার কামিজ নীল-নির্জন, গতকাল ছিল দ্বীপের নাম টিয়ারঙ, গত পরশু... নীলাঞ্জন শাসায়, কী রোজ হাঘরের মত তাকিয়ে থাকিস! সঙ্ঘমিত্রা কোনোদিন আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয় না, বোঝে না যত দিন যাচ্ছে সে আমার কাছে তত বেশি ঋণী হচ্ছে। আজকে সে তাকাল, সোজাসুজি আমার দিকে, অন্য কোনো বন্ধুদের দিকে নয়, অর্ধেক শেষ করা লেবু চায়ের কাপ নিজের টেবিলে ছেড়ে সে আমাদের টেবিলের দিকে হেঁটে এল। আমি নীলুকে বোঝাতে গেলাম যে এই আশ্চর্য ঘটনার জন্য আজকের সকালটাই দায়ী, আলাদা করে আমার কোনও দোষ নেই, কিন্তু তার আগেই সঙ্ঘমিত্রা আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
ঘটনাটার সূত্রপাত হয়েছিল যখন আমি অফিসে আসার জন্য বাড়ির বাইরে পা রেখেছিলাম। কোনো কোনো দিন সকাল সকাল আমার রক্তের মধ্যে আজন্ম লালিত মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ জেগে ওঠে এবং আমি অতিমাত্রায় পরিবেশ-সচেতন হয়ে পড়ি। কোথাও কোনো ঝামেলা নেই, কালিঘাটের পটের মতো নিখুঁত সকাল, আচমকা বিরক্তিকর বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় আর আমি অবধারিত ভাবে চোখের সামনে দেখতে পাই - একটা সোনালী-চুল, লাল-মুখ, ঘাড়ে-গর্দানে শুয়োরের বাচ্চার কদর্য থোবড়। আমি কোনোদিন সামনা-সামনি ফর্সা শুয়োর দেখিনি। শুনেছি বিদেশে অনেক শৌখিন মানুষ পেডিগ্রি বিচার করে ঘরের মধ্যেই শুয়োর পালেন, পোষেন, তাদের নাকে নাক ঠেকিয়ে সুন্টু-মুন্টু বলে আদর করেন, কোলে করে পার্কে বেড়াতে যান। আমাদের এই অঞ্চলে হাইওয়ের ধারে যে শুয়োরগুলো পায়ে পেটে নয়ানজুলির কাদা মেখে পালংক্ষেত চরে বেড়ায় তাদের গায়ের রঙ ধূসর, তাদের বাচ্চারা কারো পোষ্য হয় কিনা সেটা আমার নিশ্চিত করে জানা নেই। তবে এই গল্পে শুয়োরের গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স, ঘটনাক্রমে তার বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই।
ইন ফ্যাক্ট উচ্চ, নিম্ন, মধ্য কোনো বিত্তর সঙ্গে দূষণের আদৌ কোনও দূর দূর কা রিস্তা আছে কিনা না জেনেই আজ গাড়ির দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিয়েছিলাম এবং হাতের ছাতাটা খুলে হন হন করে শীতকালের বৃষ্টির ভিতর নেমে গিয়েছিলাম। আমার নৌটঙ্কি দেখে কাঁধের ব্যাগে টিফিন-কৌটোর মধ্যে গত সন্ধ্যায় রান্নার দিদির করে রেখে যাওয়া লুচি আর বেগুন ভাজা, বেগুন ভাজা আর লুচি দাঁত বার করে হেসে উঠেছিল। এখানে লুচি আর বেগুন ভাজা দু-দুবার বলার উদ্দেশ্য আমার টিফিন কৌটোয় লুচি বেগুন ভাজা ছাড়া সাধারণত আর কিছু থাকে না। ব্যাপারটা সকলেই জানে... আমি ও নিখিলেশ, অর্থাৎ নিখিলেশ ও আমি বললেই বোঝা যায় আমার বা নিখিলেশের আদৌ আর কোনও বন্ধু ছিল না, তবু বলে দিলাম যাতে পরে প্রশ্ন না ওঠে। যদিও নিষ্প্রাণ ও নমনীয় তবু আমি পরিষ্কার লুচির খ্যাঁক খ্যাঁক ও বেগুন ভাজার খিক খিক হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, শুনতে শুনতে আমার মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছিল, প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে আজ অব্দি মানুষের সমস্ত নাগরিক শয়তানির বিরুদ্ধে বিড় বিড় করে খিস্তি করতে করতে আমি বাসস্টপ পর্যন্ত, রাস্তায় এদিক ওদিক জমা জল সাবধানে পেরিয়ে গিয়েছিলাম।
একটার পর একটা ভিড়াক্রান্ত বাস এসে সামনে দাঁড়াচ্ছিল, চলে যাচ্ছিল, আমি উঠতে পারছিলাম না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাটিতে আমার পা ঢুকে যাচ্ছিল, যেমন স্বাভাবিক বৃক্ষদরদী মানুষদের হয়, সন্দেহ হচ্ছিল, আমার এই পাতি মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার পিছনে নিশ্চয় কোনও সুগভীর প্রবঞ্চনা আছে, পরিবেশ-সচেতনতা নেহাতই ভাণ, ব্রীজের ওপর ড্রাইভ করতে আমার ভয় করে, আশঙ্কা হয় রেলিং টপকে বেভ্ভুলে জলে নেবে যাব। জলকে আমি ভয় পাই, ছোটবেলায় বাবা জোর করে সাঁতার শিখিয়েছিল, রিসেন্টলি বাবা মারা যাবার পর থেকে জলের ভয়টা আবার বুকের ওপর চেপে বসেছে। এই ভয়ই আমার মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার আসল কারণ, পরিবেশ-টরিবেশ বেকার বাওয়াল। সে সময় একটা অলৌকিক রকমের খালি বাস এসে সামনে দাঁড়াতে আমি উঠে পড়েছিলাম। একজন আধবয়সী টুপি-পায়জামা নেমে যেতে বসার জায়গাও পেয়ে গিয়েছিলাম, আয়েস করে নিউজপেপার খুলেছিলাম।
প্রথমেই চোখে পড়েছিল একটি মৃত ফ্লেমিঙ্গোর ছবি। ক্যামেরায় রক্ত মাংস যিনি শিকার করেছেন তার নাম পড়ে কৃতার্থ হয়ে মূল খবরে ঢুকে জানতে পেরেছিলাম শব ব্যবচ্ছেদ করে ফ্লেমিঙ্গোটির পেটের মধ্যে থেকে আধ কিলো প্লাস্টিক এবং কাঁচের টুকরো উদ্ধার করা হয়েছে। চোখ তুলে দেখেছিলাম বৃষ্টি থামার পরে খাড়ির ধারে পাথরের ওপর গোলাপি রঙের একদঙ্গল আশ্চর্য ফ্লেমিঙ্গো ফুটে আছে। ওরা কি সমবেত হয়ে মৃত ফ্লেমিঙ্গোটির জন্য শোকপালন করছে? অনেক ধার্মিক লোককেই দেখেছি ব্রীজের ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্লাস্টিকের থলিতে পুজোর ফুলপাতা বিসর্জন দিতে। মানুষের মূর্খতার মতো প্লাস্টিকের থলিগুলো আদি অনন্তকাল ধরে নির্বিকার ভাবে ভেসে থাকে, নোনা জল তাদের গায়ে আঁচড়ও কাটতে পারে না। অনেক সময় হাঁসেরাই তাদের হাঁস বলে ভুল করে ঠোকরায়। অফিসেও দেখেছি যেসব প্লাস্টিক হাঁসেরা ক্যানটিনে একলা টেবিলে বসে চা খায়, তাদের পাখায় বা পালকে জল লাগে না। তারাও যেন পরিযায়ী পাখি, ক্যানটিনে ক’দিনের অতিথি, শীত গেলে চলে যাবে।
সঙ্ঘমিত্রা এমনই একটি পাখি... আমি নিশ্চিত আজ বাসে করে ব্রীজ পার না হলে সে আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াত না। সেই কবে এক পরিচিত পক্ষীপ্রেমী তার নাম বলে গিয়েছিল কানে কানে, তার স্পিসিস, জেনার, আদ্যোপান্ত, সে নিজে আমাকে বলেনি। তার সম্বন্ধে কে কী আলোচনা করছে তাতে সঙ্ঘমিত্রার কিছু যায় আসে না। সে গ্রীবার গরিমা নিয়ে অপলক চেয়ে থাকে, তার শূন্যদৃষ্টি মানুষের শরীর ফুঁড়ে চলে যায়, রঞ্জন রশ্মির মতো, সামনে টেবিলে কে বা কারা বন্ধু পরিবৃত হয়ে চা খেতে খেতে তাকে ঝাড়ি করছে নজর করে না। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ তাকে স্পর্শ করে না, আমার ব্যক্তিগত ধারণা সে কোনোদিন প্রণয়-যাপন করেনি, পাথর ডিঙিয়ে মরা নদীর চরে কারো হাত ধরে কখনও হাঁটেনি, দহনও দেখেনি জীবনে, আমার ধারণা। বরং ইউনিভার্সিটি থেকে যে সব ছেলেমেয়েরা আসে তাদের হাসিখুশি মুখ দেখলে মেঘলা দিনেও মন আলো হয়ে যায়। কম বয়সের একটা আলাদা তাজগি থাকে, লেবুর গন্ধের মতন টাটকা। এদের মধ্যে দু এক জন আমার সঙ্গে ল্যাবে কাজ করে, লক্ষ করে দেখেছি এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অধিকাংশই বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী, বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন, যৌনতা এদের কাছে ট্যাবু নয়, কন্ডোম কিনতে এরা লজ্জা পায় না কিন্তু সহজে সম্পর্কে পাততে চায় না, এড়িয়ে যায়। সঙ্ঘমিত্রা এদের দলে পড়ে না। সে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো, কলোনীর বাইরে একা একা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে।
কাঁকালে ধনার কনুইয়ের খোঁচা খেয়ে হুঁশ ফিরেছিল। সঙ্ঘমিত্রাকে সামনে দাঁড় করিয়ে আমার আজকের মধ্যবিত্ত সকাল নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়া একেবারেই উচিত হয়নি। আপাতত সঙ্ঘমিত্রা আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলল, “আপনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।”
আমি আতা-ক্যালানের মতো একবার পিছনে তাকিয়ে কনফার্ম করে নিলাম, কথাটা আমাকেই বলা হচ্ছে কিনা, তারপর তুত্লিয়ে বললাম, “আমার সঙ্গে?”
২
লোনাভেলার কাছে মালাওলি গ্রাম থেকে লোহাগড় কেল্লার চড়াই শুরু হয়, এক কিলোমিটারের ইজি ট্রেক, বেসিক্যালি বাচ্চা-কাচ্চাদের জন্য, শেষদিকে পাথরের সিঁড়ি, কেল্লার দরোজা পর্যন্ত। ট্রেক করার আসল সময় হল বর্ষা, যখন ওই সিঁড়ি ভেঙে মেঘে চড়া যায়। শীতের রোদে পশ্চিমঘাটের রঙ জ্বলে যায়, চোখে লাগে। অবশ্য যারা প্রথম পাহাড়ে চড়ছে তাদের জন্য শীতই ভালো, রিস্ক কম, সিঁড়ি থেকে শ্যাওলা মরে যায়। আমাদের নেচার সার্কেল থেকে বর্ষা শীত মিলিয়ে পশ্চিমঘাটে অন্তত গোটা দশেক ট্রেক অর্গানাইজ করা হয় প্রতি বছর। লোহাগড় ট্রেক-এ জয়েন করার জন্য একটা নোটিস পড়েছিল, তাতে আমার নাম ছিল আরো তিন চার জনের সঙ্গে, যারা যেতে চায় তাদের নাম ঠিকানা জমা করার জন্য। সঙ্ঘমিত্রাকে কে যেন চিনিয়ে দিয়েছিল, ওই ছেলেটা সায়ন্তন... ভাগ্যিস!
যদিও তারপর আমি দু-বার সঙ্ঘমিত্রার সঙ্গে একই টেবিলে বসে কফি খেয়েছি এবং আমি সঙ্ঘমিত্রার থেকে বছর দুয়েকের ছোট জানার পর সঙ্ঘমিত্রা অল্প হেসে আমায় বলেছে, তোমায় তবে তুমি করে বলব, তুমিও নাহয় আমাকে... আমার কেমন মনে হচ্ছিল আমার আর সঙ্ঘমিত্রার মাঝখানে একটা কাঁচের দেওয়াল আছে, এমনকি শব্দ দিয়েও আমি সঙ্ঘমিত্রাকে ছুঁতে পারছি না। শীতকাল বলে খুব বেশি ভিড় নেই, তাছাড়া আরো একটা রুট আছে কেল্লায় পৌঁছোবার, সেটা ছোট... লোহাগড়ওয়াড়ি থেকে। দলের বাকিরা এগিয়ে পিছিয়ে, একটা উঁচু পাথর সঙ্ঘমিত্রা আমার হাতে ভর দিয়ে উঠে এল, কিন্তু ছুঁল কি? আমার হাত ছাড়িয়ে নিল, সঙ্ঘমিত্রার আঙুল পালকের মতো হালকা, ছেড়ে দেবার পর স্মৃতি থাকে না। একটা সেগুন গাছ রোদ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ শীত শীত লাগছে। সঙ্ঘমিত্রা আমাকে ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। মাথার ওপর জড়ো করে বাঁধা চুলের নিচে আমি ওর ঘাড়ের কাছে এক গুচ্ছ কটা লোম দেখতে পাচ্ছিলাম।
“আর একটু নাহয় ছুঁয়ে থাকতে পারতে!”
মনে মনে বললাম, আমার জিভে সর, পোড়া ঠোঁটও অনড়। সাহস করে কয়েক পা এগোতে পারলেই ওই সুষমা ছুঁয়ে দিতে পারি। সত্যিই কি পারি?
সঙ্ঘমিত্রা ঘাড় ফিরিয়ে বলল, “কিছু বললে, সায়ন্তন?”
“না তো...”
বলেই আমি মনে মনে জিভ কাটলাম। সঙ্ঘমিত্রা কি মন পড়তে পারে? ওকে নিয়ে এ পর্যন্ত যা যা ভেবেছি সেগুলো কি সব সঙ্ঘমিত্রা জেনে ফেলেছে? সঙ্ঘমিত্রার চোখে চোখ রাখতে ভয় করছে, আমার শরীর জুড়ে তুমুল অন্যায়, পাছে ধরা পড়ে যাই, আমি দূরের পাওনা লেকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সঙ্ঘমিত্রা নরম গলায় বলল, “এসো, অন্যরা এগিয়ে গেছে।”
কেল্লার পেছনে অনেকটা খোলা ঘাসজমি, সেখানে বসে সবাই একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। নীলাঞ্জন সবার হাতে হাতে শুকনো টিফিন ধরিয়ে দিয়েছিল। একজন এক কলি গান গেয়ে উঠতেই, সবাই বলল, অন্তাক্ষরী হোক, যেমন হয়। সঙ্ঘমিত্রা দল ছেড়ে উঠে গিয়ে কেল্লার পাঁচিলের ধারে দাঁড়াল। কেন যে মেয়েটা সবার থেকে অলাদা হয়ে থাকে! আমার ইচ্ছা করছিল ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। নীলু বলল, “সায়ন্তন, তুই জয়তীদির টীমে।”
জয়তীদি বিশ্বন্যাকা, বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি শুরু করি... ইয়ে সাম কুছ আজীব থি... ইয়ে সাম... ম... ম...”, শালা খটখটে রোদে... ইয়ে সাম... সঙ্ঘমিত্রা বিপজ্জনকভাবে পাঁচিলের ওপর ঝুঁকে আছে... আমি কিছুতেই অন্তাক্ষরীতে মন দিতে পারছি না, নীলাঞ্জন ‘ম’ দিয়ে ধরল, মেরা কুছ সামান, তুমহারে পাশ পড়া হ্যায়...।
ট্রেক থেকে ফিরে সঙ্ঘমিত্রা বিলকুল বেপাত্তা হয়ে গেল। ক্যানটিনে আসে না, মোবাইলে কল করলে স্যুইচ অফ। গেল কোথায় মেয়েটা? আমি আঁতিপাঁতি করে ভাবতে লাগলাম সেদিন মুখ ফস্কে কিছু ভুলভাল বলে ফেলেছিলাম কিনা। আমার জন্য নয় নিশ্চয়ই। হয়তো কোনো কাজে শহরের বাইরে গেছে। তিন দিনের দিন সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফেরার সময় নীলু বলল, “কী দু-দিন ধরে মুখ হাঁড়ি করে ঘুরছিস!”
আমি বললাম, “দু-দিন নয়, তিন দিন।”
নীলু সংখ্যার ভুল-ভ্রান্তিতে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে বলল, “আজ বসি চল, একটু ঢুকু ঢুকু করলেই দেখবি মন ভালো হয়ে যাবে।”
অন্য সময় হলে দু-পেগ চড়াতে না চড়াতে ধনা হাত তুলে বলে, সে কি জানিত না, যত বড় রাজধানী, তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর...। নীলু ঘরের সাদা লাইট অফ করে দিয়ে হলুদ টেবিল ল্যাম্প জ্বালায়, ল্যাপটপে ইউ টিউব খুঁজে ফরিদা খানুমের ‘আজ যানে কী জিদ না করো...’ চালিয়ে দেয়। ঢেউয়ের ধাক্কায় আমার মাথা হালকা হতে হতে প্রায় নেই হয়ে যায়, মনে হয় এখন যদি কেউ ফুটোস্কোপ দিয়ে আমার মগজ পরীক্ষা করে, দেখবে ঘিলু নেই, মাছরাঙার রঙিন পালক দিয়ে ভর্তি। আজ সে সব কিছুই হল না। মাথার মধ্যে যেন কেউ থান ইঁট ভরে রেখেছে। নীলু একবার বলল, “কী রে, কী হল? একেবারে ভুম্বুল মেরে গেলি যে!”
আমি জবাব না দিয়ে জানলার বাইরে তাকালাম। ধনা বলল, “খুব কষ্ট হলে চলে যা, দেখা করে আয়, অ্যাড্রেস জানিস তো?”
নীলু বলল, “কাঁদছিস কেন খোকা? যাবি? ক্যাব বুক করে দেব?”
যদিও আমি কাঁদছিলাম না এবং ওয়ালেটেই সঙ্ঘমিত্রার অ্যাড্রেস লেখা চিরকুটটা ছিল, ট্রেকে যাবার সময় সঙ্ঘমিত্রা নিজেই দিয়েছিল, খাতা থেকে আলাদা করে টুকে রেখেছিলাম, কিন্তু বুকের ভেতর কষ্ট হচ্ছিল খুব। বললাম, “যাব? সাড়ে ন’টা বেজে গেছে...?”
৩
অ্যাড্রেস খুঁজে, ওয়াচম্যানের সন্ধানী দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে, সঙ্ঘমিত্রার অ্যাপার্টমেন্টের দরজার বেলে যখন আঙুল ছোঁয়ালাম ঘড়ির কাঁটা তখন দশ ছুঁই ছুঁই। দরজা খুলতে সঙ্ঘমিত্রার একটু দেরি হল, নাইটির ওপর একটা গাউন জড়িয়ে এসেছে, চোখ লাল, কান্নাকাটি করছিল নাকি? কার জন্য? আমি আমতা আমতা করে বললাম, “তিনদিন অফিস আসছ না!”
“তাই খবর নিতে এলে?”
পিছনে পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম খচ্চর ওয়াচম্যানটা আমার পিছু পিছু সিঁড়ির ল্যান্ডিং পর্যন্ত উঠে এসেছে। সঙ্ঘমিত্রা চাপা গলায় বলল, “ভেতরে এস।”
সঙ্ঘমিত্রা দরজা বন্ধ করে পেছন ফিরতেই আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম, ও ফিরে তাকাল। আমি ওর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম লিভিংরুমটা বেশ সাজানো গোছানো, সোফায় সুদৃশ্য তাকিয়া, সেন্টার টেবিলের ওপর ফ্লাওয়ার ভাসে ফুল, দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো পেন্টিং, বুক-কেসে রবীন্দ্রনাথ, দেশ-বিদেশের পুতুল। এমন মাত্রাতিরিক্ত সৌষ্ঠব যেন মানুষের জন্য নয়। মানুষের জন্য ভালবাসাই যথেষ্ট। অবশ্য ভালবাসা পাওয়া না পাওয়ায় মানুষের হাত থাকে না, কিন্তু এমন সরলরৈখিক জ্যামিতি দেখলে কার না লণ্ডভণ্ড করে দিতে ইচ্ছা হয়! আমি ওকে কাছে টেনে ঠোঁটে ঠোঁট রাখলাম, আমার ঠোঁট পুড়ে গেল। সঙ্ঘমিত্রার গায়ে বেশ জ্বর, সে আমাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল না, কাছেও টানল না, খালি বলল, “পাগলামি কোরো না সায়ন্তন, সরো।”
আমি গোঁয়ার বাচ্চার মতো ওকে কাছে টেনে ওর কন্ঠার রহস্যময় অন্ধকার থেকে এক বিঘৎ নিচে যেখানে চাঁদ লেগে থাকে চাঁদে সেখানে নাক ঘষতে ঘসতে বললাম, “না, সরবো না... তোমায় ভালবাসি... ভালবাসি... উঁ...”
সঙ্ঘমিত্রা ঠান্ডা গলায় বলল, “সত্যি? আমায় তুমি কতটুকু জান সায়ন্তন? কাউকে ভালো করে না জেনে চিনে কি ভালবাসা যায়?”
আমি ওর গাউনের বেল্টের ফাঁস খুলে কোমরে হাত রেখে বললাম, “চিনতে চাই, দাও না...”
আমি কি সঙ্ঘমিত্রাকে সত্যিই চিনতে চাইছিলাম নাকি আশিরনখর সুখ দিতে চাইছিলাম? সঙ্ঘমিত্রা বলল, “আমার কিন্তু একটা অসুখ আছে।”
আমি অবাক হলাম, “কী অসুখ?”
“জেনে কী করবে? কোনোদিন সারবে না এমন অসুখ।”
আমি একগুঁয়ে অবিশ্বাসীর মতো বললাম, “আমি ছুঁয়ে দিলেই তোমার সব অসুখ, সব জ্বর সেরে যাবে।”
সে বলল, “জ্বর নয়, তুমি যেখানে হাত রেখেছ, তার একটু নিচে আমার তলপেটে একটা সাদা দাগ আছে। দাগটা বাড়ছে... ডাক্তাররা বলেছে বাড়তে বাড়তে একদিন আমার সারা শরীর ঢেকে দেবে।”
সঙ্ঘমিত্রার শরীর থেকে উঠে আসা বাসি ভাপ থেকে আমি সামান্য সরে দাঁড়ালাম অথবা প্রতিবর্ত প্রক্রিয়ায়। সঙ্ঘমিত্রা বলল, “কী হল? ভয় পেলে?”
আমি বেকুবের বললাম, “নাহ্, ভয় পাব কেন?”
সঙ্ঘমিত্রা বলল, “আসলে ওই দাগটার জন্য আমার একবার বিয়ে ভেঙে গেছে। আমার হবু বর ওই দাগটা দেখে ভয় পেয়েছিল। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছিলাম... আমার সারা শরীর যখন সাদা হয়ে যাবে তখনও আমায় ভালবাসতে পারবে তো?”
তার মানে সঙ্ঘমিত্রা চিরকাল একলা ছিল না, সেও যূথবদ্ধ ছিল, তারো অনেক সঙ্গীসাথী ছিল। সঙ্ঘমিত্রার কী অসুখ, সেটা আদৌ সারবে কিনা... এই কথাগুলো আপাতত অবান্তর। যাকে সে তলপেটের দাগ দেখিয়েছিল তার জন্যে কি এখনও সে কৌটো ভরে ভালবাসা তুলে রাখেনি? ভবিষ্যতে কোনোদিন হয়তো আলমারি গুছোবার সময় কোনও গোপন তাক থেকে অসাবধানে কৌটোটা বেরিয়ে পড়বে। আমি নিষ্ঠুর গলায় বললাম, “তুমি তোমার হবু বরকে তলপেটের দাগ দেখিয়েছিলে? বিয়ের আগেই?”
সঙ্ঘমিত্রার গলায় কি শ্লেষ ফুটল? বলল, “হ্যাঁ দেখিয়েছিলাম, তোমার সঙ্গে আলাপ হবে জানলে হয়তো দেখাতাম না... ”
আমি বললাম, “ছিঃ...”
বলতে বলতেই আমার চোখের সামনে চাঁদ ঢেকে মেঘ উঠল, সামুদ্রিক ঝড়ের আছাড়ি-পিছাড়ি, ঢেউয়ে ঢেউয়ে বালির ওপর একটা অচেনা জলচরের মৃত শরীর ভেসে এল। হাড়মাস খুঁটে খাবার জন্য তার ওপর চক্রাকারে শকুন নামছিল। শকুনরা শিকারের ওপর হামেশা হেলিক্যাল ট্রাজেক্টারিতে হামলা করে কেন কে জানে? সমুদ্র-সারসরা নিরাসক্ত সন্যাসীদের মত একটু দূরে বসে তাদের উল্লাস দেখছিল। আমি ভুল পাখির বুকে উষ্ণতা খুঁজছিলাম, সঙ্ঘমিত্রার শরীর আদতে সাদা রঙের প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি, সে হোর্ডিঙের বিজ্ঞাপন-বালিকাদের মতো হেসে বলল, “ছিঃ বলছ কেন? সে’ও তো আমায় চিনতেই চেয়েছিল। তুমিও তাই... চেনার পর পাছে ভয় পাও তাই সাবধান করে দিলাম।”
এই ধাক্কাটার দরকার ছিল, আমি টাল সামলানোর জন্য দেওয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়ালাম, অ্যালকোহল এখনও মাথার দখল ছাড়েনি, নাকি আমার মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ! সঙ্ঘমিত্রা বলল, “কফি খাবে? বোসো, বানিয়ে আনি।”
আমি বললাম, “এর পরও কফি? আর কত তেঁতো গেলাবে?”
সঙ্ঘমিত্রা জবাব দিল না। আমি দরজা খুলে বেরোলাম, সিঁড়ির নিচে অন্ধকার ঠেলে নামতে গিয়ে আমার গোড়ালি মচকে গেল। আমি পা টেনে টেনে সঙ্ঘমিত্রার বিল্ডিং কম্পাউন্ড পার করে রাস্তায় নামলাম। হতচ্ছাড়া ওয়াচম্যানটা পেছন থেকে বলল, “গুড নাইট স্যর!”
৪
ডাক্তাররা যখন সঙ্ঘমিত্রার স্টম্যাক পাম্প করে হজম না হওয়া স্লিপিং পিল বার করছিল আমাদের ওটির বাইরে থুম্বু হয়ে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। আমার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে নীলু আর ধনা ক্যাব নিয়ে আমায় খুঁজতে বেরিয়েছিল। ওরা আমায় ক্রীক-ব্রীজের ওপর দেখতে পায়। আমি রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলাম, ওরা ভেবেছিল কেউ মাঝরাতে ছিপ ফেলে চিংড়ি মাছ ধরছে, দিনমানে অনেকেই ধরে, মাঝরাত বলে ওদের একটু সন্দেহ হয়েছিল, গাড়ি থামিয়ে কাছে আসতে আমায় চিনতে পারে। আমিও খেয়াল করিনি সঙ্ঘমিত্রার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এতদূর পৌঁছে গেছি। এমন বেভভুল রাস্তা আগে কোনোদিন চলিনি, পরেও কোনোদিন চলব না হয়তো। ধনা গায়ে নাড়া দিয়ে বলেছিল, “এই সায়ন, এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস? বাড়ি চল।”
আমি বাধ্য ছেলের মতো ওদের কথা মতো ক্যাবে গিয়ে বসেছিলাম। নীলু বলেছিল, “সঙ্ঘমিত্রার সঙ্গে কী কথা হল?”
সঙ্ঘমিত্রার নাম শুনে আমার হুঁস ফিরেছিল। আমি গাড়ির বাইরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
নীলু বলেছিল, “কোথায় আবার, তোকে তোর বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আমরা ফিরব।”
আমি ওর হাত চেপে ধরেছিলাম, “গাড়ি ঘোরাতে বল, সঙ্ঘমিত্রার বাড়ি যেতে হবে, এক্ষুণি!”
ধনা কিছু বলতে যাচ্ছিল, নীলু কী বুঝেছিল কে জানে? ওকে থামিয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে ইউ টার্ণ নিতে বলেছিল। সঙ্ঘমিত্রার বাড়ি পৌঁছে দেখেছিলাম ওয়াচম্যানটা গেটের পাশে বসে ঢুলছে। আমাদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুমে লাল চোখ খুলে তাকাল, আমাকে চিনতে পেরে বলল, “ফির আ গয়ে?”
ভাগ্যিস ফিরে এসেছিলাম, নীলু বলল, “ভাইয়া ম্যাচিস হোগা আপকে পাশ? সায়ন তুই ওপরে যা, আমরা এখানেই ওয়েট করি... তাড়াতাড়ি ফিরিস।”
কিন্তু পাঁচ মিনিট বেল বাজানোর পরেও যখন সঙ্ঘমিত্রা দরজা খুলল না, তখন বাধ্য হয়ে সবাইকেই যেতে হল, দরজা ভাঙার জন্য। আশপাশের লোকজন জমা হচ্ছিল। এই শহরের লোক অন্যের ব্যাপারে সহজে নাক গলায় না, কিন্তু বিপদে আপদে নিজে থেকে এগিয়ে আসে। দয়া-টাইপের একজনের কাঁধের ধাক্কায় দরজাটা ভেঙ্গে পড়তেই দেখলাম সঙ্ঘমিত্রা সোফার ওপর আড় হয়ে পড়ে আছে। দু একজন পুলিশে খবর দেওয়ার কথা বলছিল, কিন্তু তার শ্বাস-প্রশ্বাস চালু আছে দেখে দয়া দাবড়ানি দিয়ে বলল – আগে মেয়েটাকে লোকাল নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হোক, তারপর সে’সব ভাবা যাবে। আমরা ধরাধরি করে সঙ্ঘমিত্রাকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে গাড়িতে ঢোকালাম, ওয়াচম্যানটাও হাত লাগাল। দয়া আমদের সঙ্গে নার্সিংহোমে এল।
নার্সিংহোমের মালিক কাম ডাক্তার নার্সিংহোমের ওপর তলায় থাকেন। ডক্টর কেলকার বয়স্ক মানুষ, ঘুম ভেঙে উসকোখুসকো চুলে নেমে এসে পরিস্থিতি নিজের হাতে নিলেন, ভরসা দিলেন – বিষ এখনও রক্তে মেশেনি, মেয়েটা মনে হচ্ছে বেঁচে যাবে, দেরি হলে বিপদ বাড়ত। কাছাকাছি থেকে অন্য আর একজন ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে ওটিতে ঢুকলেন। আমরা ওটির বাইরে পেতে রাখা লোহার ঠান্ডা চেয়ারে পেছন ঠেকালাম। আমি সঙ্ঘমিত্রার কাছে কেন ফিরে এসেছিলাম নিজেই জানি না, শুধু মনে হয়েছিল ফিরে যাওয়া ভীষণ দরকার, নাহলে অনর্থ হয়ে যাবে। দয়া করিতকর্মা লোক, এত রাতেও কোথা থেকে চায়ের বন্দোবস্ত করে ফেলল। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল - সায়নদাদা, চায়ে পিও, সব ঠিক হো যায়েগা। এই সব সময় ঈশ্বর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, দয়াকে আমার মনে হচ্ছিল ছদ্মবেশী ঈশ্বর, ওর হাত থেকে চায়ের কাপ নেবার সময় আমি একটু বেশি সময় ওর আঙুল ছুঁয়ে থাকলাম, জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে?
দয়া হাসল, বলল, দাদা, ম্যায় এক মামুলী পেন্টার, হোর্ডিঙ্গের ছবি আঁকি। তখনই লক্ষ্য করলাম এই চওড়া কাঁধের লোকটার হাতের আঙুলগুলো আশ্চর্য রকমের লম্বা, আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, ওর হাতদুটো প্রায় হাঁটু ছুঁয়েছে। ওর দিকে চোখ তুলে তাকালাম, মিনতি করে বললাম, আমায় একটা পাখির ছবি এঁকে দেবে? যে পাখি উষ্ণতার খোঁজে ফিরে আসে, যে পাখির ডানায় রোদ লেগে থাকে। দেখলাম ওর দু-চোখে করুণা ঘনাল, বলল, আমি কি পারব? আমি শুধু ছাপা ছবি দেখে নকল করতে জানি। অনেক ছোটবেলায় যখন এই শহরে আসিনি, রত্নাগিরিতে থাকতাম, তখন নিজে নিজে আঁকতাম, পাখি, প্রজাপতি...। আমি বললাম, ঠিক পারবে, তুমি ওই মেয়েটাকে দেখে এঁকো, ওই যে ওটির মধ্যে পেটে প্লাস্টিক নিয়ে শুয়ে আছে। ওকে দেখে আমার পাখি মনে হয়, সত্যিকারের পাখি।
ভোর রাত্তিরে সঙ্ঘমিত্রাকে বেডে দিল, ডক্টর কেলকার বললেন, জ্ঞান ফিরেছে, তবে এখন ও ঘুমোবে। বিপদ কেটে গেছে, তবে এই সব কেসে ইনফেকশানের ভয় থেকেই যায়। কেউ রিলেটিভ থাকলে যেতে পারেন, তবে বেশি ভিড় না করাই ভালো। একজন আমার সঙ্গে আসুন, কিছু সই-সাবুদ করতে হবে। ধনা ডাক্তারের সঙ্গে গেল, নীলু আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, যা। দয়া হেসে বলল, যাইয়ে সায়নদাদা, আপকি পঞ্ছি আভি বাপিস নেহি যায়েগি। আমি গিয়ে সঙ্ঘমিত্রার বেডের পাশে একটা স্টুল টেনে বসলাম, ওর কপালে হাত রাখলাম। সঙ্ঘমিত্রা একবার চোখ খুলে আমার মুখের দিকে তাকাল তারপর পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। ওর বুকের নিয়মিত ওঠাপড়া দেখতে দেখতে আমার ইচ্ছা হল আমিও পাখি হয়ে যাই, চওড়া ডানার ফ্লেমিঙ্গো, এইটুকু তো শরীর, দুই ডানা দিয়ে আড়াল করে রাখি। আপাতত দুই হাতে ভর দিয়ে সঙ্ঘমিত্রার শরীরের ওপর ঝুঁকে রইলাম।
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)