(একে চন্দ্র, দু’য়ে পক্ষ। সমুদ্র মন্থনেও দুই দল, এ ধরেছে শেষনাগের মাথা তো ও মুড়ো। এদিকে বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় সব লণ্ডভণ্ড। উঠল গরল, উঠল অমৃত। ভাই–ভাই ঠাঁই–ঠাঁই হল। আজও সেই দায় বয়ে চলেছি আমরা। এটি তারই এক আখ্যান, এক বাঙাল কিশোরের চোখে। এর ইতিহাস হওয়ার দায় নেই।)
বাঙালের আত্মীয়স্বজন, জিভের আড়, জিভের স্বাদ ইত্যাদি
কৈশোরে গড়ের মাঠে (তখন মনুমেন্ট ময়দান নয়, গড়ের মাঠই বলা হত) ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়ে মাউন্টেড পুলিশের তাড়া খেয়ে (ঘোড়সওয়ার পুলিশ) গ্যালারিতে বসার পর টের পেলাম—এটা ঘটিদের, থুড়ি মোহনবাগান সাপোর্টারদের এলাকা। মুখে কুলুপ এঁটে ওদের কথোপকথন শুনতে গিয়ে জানলাম—খেলার মাঠে বাঙালদের কোড নেম ‘জার্মান’! কেন? কে জানে! আরও শুনলাম যে বাঙালরা উদ্বাস্তু হয়ে দলে দলে ঘটিবাটি, মাদুর-শীতলপাটি, টিনের বাক্স-প্যাঁটরা, ছেঁড়া কাঁথা সব নিয়ে দলে দলে শ্যালদা স্টেশনে নেমে প্ল্যাটফর্মেই সংসার পেতে বসে। তারপর সেখানকার সাউথ স্টেশন থেকে লোক্যাল ধরে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, গড়িয়া। আবার মাঝেরহাট ব্রিজ পেরিয়ে বেহালার দিকে। এভাবেই এরা গোটা কোলকাতাকে চারদিক থেকে ঘিরে দমবন্ধ করে দেয়। শহর ভরে যায় আবর্জনায়, আর এদের জন্যেই আমাদের কল্লোলিনী কোলকাতা তিলোত্তমা হতে পারেনি।
হক কথা; কিন্তু জার্মান অভিধা কেন জুটলো? জিগাইতে সাহস হয় নাই। হয়ত অন্যরকম কথ্যভাষার স্বাদ সেই সময়ে ‘আমরা-ওরা’ হওয়ার কারক। আমাদের পরিবারকেই ফিরে দেখি।
দেশ স্বাধীন হয়েছে এক দশক হল। বাঙাল পরিবারটি বর্ডার পেরিয়ে এই দাদুর দস্তানায় মাথা গুজেছে মাত্র বছর পাঁচেক আগে। ফলে অধিকাংশ সদস্যেরই জিভের আড় ভাঙ্গেনি। এক কাকাকে জিজ্ঞেস করা হল ম্যাট্রিক তো হল, এবার কলেজে কী পড়বি?
--আই এচ ছি পড়বাম।
নাঃ, ক্যালকেশিয়ান হতে সময় লাগবে। নদীর এপার থেকে ওপার ‘বানাইল্যা হাওয়ার মাঝে’ মুখ খুইল্যা হাঁক কইর্যা কথা বলা ছেড়ে দিয়ে ছোট করে খুলে ঠোঁট গোল করে একটু নীচু গ্রামে কথা বলতে হবে।
নিজেদের দ্যাশের কথা কইতে গেলে নামের যে বিকৃতিগুলো সহজ অভ্যাসে বলা হত তা তাদের লিখিত নামের সঙ্গে মিলিয়ে উচ্চারণ করতে হবে। যেমন, ময়মনসিং জেলার বিশিষ্ট গ্রাম কায়স্থপল্লীকে ‘কায়েতপাগলি’, ‘কাপ্যাওলি’ এসব বলা যাবে না। গুইছ্যাডা না বলে বলতে হবে গুচিহাটা। একইভাবে, সত্যজিৎ সুকুমারের পৈতৃক গ্রাম মসূয়াকে ‘মৌস্যা’ বলা নৈব নৈব চ। এবং বাংলা ব্যাকরণে ক্রিয়াপদের ‘অপিনিহিতি’ (বাঙাল) রূপের কথা ভুলে ব্যবহার করতে হবে ‘অভিশ্রুতি’ (ঘটি) রূপ।
ক্রিয়াপদ (সাধু) অপিনিহিতি (বাঙাল) অভিশ্রুতি (চলিত বা ঘটি)
রাখিয়া রাইখ্যা রেখে
বাঁধিয়া বাইন্ধা বেঁধে
কাঁদিয়া কাইন্দা কেঁদে
কিন্তু নিজেদের ঘরে ডাকাডাকিতে নামের অপিনিহিতি রূপই মর্যাদা পেত। তাই মণি হত মইণ্যা, ননী নইন্যা বা লইন্যা, রঞ্জন অনায়াসে হয়ে যেত রঞ্জইন্যা!
এই দুঃখেই কবি গাহিয়াছেন--ইচ্ছা করে পরাণডারে গামছা দিয়া বান্ধি। আইরণ বাইরন কইলজাডারে মশলা দিয়া রান্ধি।।
বাঙালের বিপদ পদে পদে। বাজারে গেলে ইচামাছ বা কাইখ্যা মাছ বললে দোকানি হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। বলতে হবে চিংড়ি, বলতে হবে বকমাছ; সুবর্ণখইড়ক্যা নয়—সোনাখড়কে; বজুরি নয় কুচোমাছ, ইলশা নয় ইলিশ, রৌ নয় রুইমাছ, কাতল নয় কাতলা, আইর নয় আড়মাছ, ঘুইঙ্গা বা গুলশা নয়, দুটোকেই ট্যাংরা বলতে হবে। বেলে ও ল্যাটামাছকে বাইল্যাড়া ও ল্যাডা বলা নয়। কত বলব!
নিরিমিষ কিছু কিনতে গেলেও সেই সমস্যা। হেলঞ্চা নয়, হিঞ্চে শাক। নাইল্যাপাতা নয়, পাটপাতা। কাঢলের আলি নয়, কাঁঠালবীচি, শিমুরালি নয়, শিমবীচি, ভ্যারাইল নয় থোড়। বেগুনকে বাইগন বলা নিয়ে বহুকথিত পিজের বাদ দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু আজকের প্রজন্ম কি পঞ্চাশের দশকের এই ‘ব্যবহৃত হতে হতে শুয়োরের মাংস হয়ে’ যাওয়া পিজের সঙ্গে পরিচিত? তাই কিন্তু কিন্তু করেও জুড়ে দিলাম।
বাঙাল--বাইগন কত কইর্যা?
দোকানি-- বাইগন? বেগুন বলতে পার না?
--ক্যান, বাইগন কী দোষ করল?
--ভাল শোনায় না, তাই।
--তাইলে ক্যান, ‘প্রিয়তমা’ কইলেই পার।
ঘটির ঘটি দীনবন্ধু মিত্র তাঁর বিখ্যাত ‘সধবার একাদশী’ নাটকে বাঙালের ক্যাল্কেশিয়ান হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা নিয়ে নির্মম পরিহাস করেছেন। বাঙাল চরিত্রটি ধনীর মোসাহেবি করতে গিয়ে সখেদে বলছে—কত চেষ্টা করলাম। সাহেববারির বিস্কুট খাইলাম, মদ খাইলাম, মাগিবারি গেলাম, বৌ বাইগ্যদরিরে বেশ্যার পায়ে হাত দিয়া দিদি ডাকাইলাম--তবু কইলকাত্তাই হইতে পারলাম না।
এই সুযোগে আমি বাঙাল একটু ‘বদলা’ নিয়ে নিই।
দীনবন্ধু ও বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে এই গল্পটি ভবানীপুরের এক বয়োজ্যেষ্ঠ খানদানি ঘটি ভদ্রলোকের মুখে শোনা। উনি আবার শুনেছেন তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতৃদেবের মুখে।
বঙ্কিমচন্দ্রের স্ত্রীর নাম নাকি রজনী। উনি ডাকসাইটে সুন্দরী। একদিন দুই বন্ধু কাঁঠালিপাড়ায় বঙ্কিমের বাড়ির ছাদে রাত্তিরের খাওয়াদাওয়া সেরে পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছেন। আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ। রসিক দীনবন্ধু, বঙ্কিমের পেয়ারের ‘দীনে’, চিমটি কেটে বললেন—আহা, কী সুন্দর রজনী, তায় আবার চন্দ্র এসে জুটেছে।‘
বঙ্কিম সঙ্গে সঙ্গে বললেন—তা আর বলতে! একেবারে ‘দিনের’ মুখে হেগে দিয়েছে!
অথচ দেশভাগের আগে বাঙালদেরও র্যাগিং করার সু্যোগ ছিল । কায়েতপাগলি বা কায়স্থপল্লী নামক বর্ধিষ্ণু জনপদের বাসিন্দা জনৈক ক্ষেত্রমোহন পেটের ধান্দায় দক্ষিণ কোলকাতার গড়িয়াহাটের কাছে অধুনা বন্ধ হয়ে যাওয়া আলেয়া সিনেমায় টর্চ হাতে সীট দেখানোর চাকরি করতেন ও মার্কেটের পেছনে একটি মেসের ছাতের ঘরে থাকতেন। তাঁর গাঁয়ের স্কুলের সতীর্থ জনৈক রায়মহাশয় তখন কলকাতার কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা অধ্যয়নরত। মাসের প্রথমে উনি জনাকয়েক উচ্চিংড়ে বন্ধু জুটিয়ে হাজির হতেন সেই মেসবাড়িতে। রাস্তা থেকেই হাঁক পাড়তেন – ওরে ক্ষ্যাতরা, ক্ষ্যাতরা ঘরে আছস নি?
ক্ষেত্রমোহন শশব্যস্ত হয়ে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি ভেঙে নীচে এসে হাত জোড় করে বলতেন—চুপ! চুপ! মাইনে পেয়ে গেছি। কী খাবি বল।
আবার পুজোপার্বণে গ্রামের বাড়িতে গিয়েও রক্ষে নেই। রায়মহাশয়ের পিতৃদেব গ্রাম সম্পর্কে জ্যাঠামশায়। বিজয়ার দিন তাঁকে প্রণাম করতে গেলে বিটলে বুড়ো চোখ ইচ্ছে করে চোখ কুঁচকে বলবেন--তুমি ক্যাডা? ঠিক চিনলাম না তো!
--আজ্ঞে আমি অমুকের ছেলে।
--অ! তা কী নাম?
--(ঘটি উচ্চারণে) খেত্রো।
--কী কইল্যা? জোরে কও।
--খেৎ-রো—ও!
--বাবা, তুমার কী শরীর খারাপ হইছে? কইলাকাতার বাসায় প্যাট ভইর্যা খাও না?
অল্পদিনেই আমরা ছোটদের দল জেনে গেলাম যে বেশ কিছু আত্মীয় আমাদের মত উদ্বাস্তু হয়ে এপারে এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোলকাতার আশেপাশে সম্মানের সঙ্গে মাথা গোঁজার জায়গা করে নিয়েছেন। কাউকেই সীমান্তে রিলিফ ক্যাম্পে ঠাঁই নেওয়ার দুর্ভোগ পোহাতে হয় নি।
বাবা-কাকাদের মুখে শুনি তাঁদের তিন পিসিমার কথা। বড় পিসিমা আলিপুরদুয়ারের দাম পরিবারে; ধনপিসিমা ওপারের দেশের বাড়িতে। আর ছোটপিসিমা বেলঘরিয়ার কাছে নিমতায়। উনি আমাদের নিমঠাকুমা, পদবী অদ্ভুত—‘বীর’। সেই পরিবারের মেয়ে আমাদের লক্ষ্মীপিসি সরিষা রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশুনো, নাচগানে কৃতিত্ব অর্জন করে পাশের একটি মেয়েদের স্কুলে হেডমিস্ট্রেস হলেন। আমাদের বাড়ির মা-কাকিমা-পিসিরা কেউ চাকরি করেন না। কেউ কলেজের মুখ দেখেন নি। তাই হয়ত লক্ষ্মীপিসির গল্প বলতে গিয়ে শেষপাতে সবাই একটা হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলত; হয়ত নিজেদের অজান্তে। তারপরই শুরু হত অবধারিত পিএনপিসি। --জান ঠাকুরঝি? নিজে নিজে বিয়া ঠিক করছে। হেইজনও অন্য স্কুলে হেডমাস্টার। কিন্তু নাম অইল ‘রিপুদমন রায়’!
হাসির হররা!
কিন্তু হাসির রেশ বেশি দিন রইল না। খবর এল ওদের একমাত্র ছেলে উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় হয়েছে। আমাদের ঘরে কেউ প্রথম দ্বিতীয় নেই। সেই ছেলে ভবিষ্যতের খ্যাতনামা সাংবাদিক ও কলামনিস্ট গৌতম রায়।
ঢাকুরিয়ায় বাবাদের তুতোবোন--পারুলপিসি ও ঝুনুপিসি। হালতু যাদবপুরের দিকে আমাদের মন্টুকাকু; কালো পাথরে কোঁদা শালপ্রাংশু মহাভুজ! মা-বাবা তিনভাই তিনবোনের দায়িত্ব সামলাতে মার্চেন্ট নেভিতে কাজ নিয়েছেন। শিবপুরে আছেন নন্দীপিসেমশায়, পুলিসে কাজ করেন।
হরিণঘাটায় আছেন আর এক দাদু--বাবাদের ধনকাকা। গলায় তুলসী মালা, মুখে একগাল অজাতশত্রু হাসি। দেখলে কে বলবে উনি তিরিশের দশকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা চার বিষয়ে স্টার নিয়ে পাশ করেছিলেন! তারপর ময়মনসিং থেকে এসে কোলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হলেন।
দিব্যি চলছিল।
কিন্তু ১৯২০ সালে নাগপুর অধিবেশনে ন্যাশনাল কংগ্রেস অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব পাশ করল। চৌরিচৌরার ঘটনার পর গান্ধিজী একটু দ্বিধাগ্রস্ত, গণ-আন্দোলনের জোয়ার যে ‘সবিনয়-অবজ্ঞা’র রাজপথ ছেড়ে সন্ত্রাসবাদ ও ব্যক্তিহিংসার গলিপথে চলে যেতে যায়! এই যৌবন-জলতরঙ্গ রোধিবে কে? হরে মুরারে!
তা আমাদের ধনদাদু নীলমণি রায় একটু দেশের দশের কথা ভাবতেন, চলে গেলেন নাগপুর অধিবেশনে। সেখানে তখন ‘স্বরাজী’ অর্থাৎ মতিলাল নেহেরু ও চিত্তরঞ্জন দাশের বোলবোলাও। স্বয়ং চিত্তরঞ্জনের মুখে শুনলেন অমৃতবাণীঃ এডুকেশন ক্যান ওয়েট, বাট স্বরাজ ক্যান নট!
ব্যস, নীলমণি রায়কে আর পায় কে! সোজা নাগপুর থেকে হাওড়ায় নেমে শ্যালদা গিয়ে পূর্ববাংলার ট্রেন ধরে ফিরে এলেন দ্যাশের বাড়িতে। বইখাতা বিছানাপত্তর পড়ে রইল বিদ্যাসাগর লেনের হোস্টেলে। বাবরি চুল মাথায় পড়াশুনা ছেড়ে ঘরে ফেরা নব্যযুবক, পুলিশের নজর পড়ল। সেসব দিনে ময়মনসিং জেলায় অনুশীলন পার্টির প্রভাব খুব; নীরদ সি চৌধুরির ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ বইয়ে এর কিছু উল্লেখ আছে। ত্রৈলোক্য মহারাজ মাঝে মাঝে ওঁদের বাড়ি আসতেন। কিছু আর্থিক সাহায্য, কিছু পত্রিকা নেওয়া এসব হত। নীলমণি রায় কেস খেলেন, তবে উকিল জ্যেঠুর যোগাযোগে বাড়ি ফিরে এলেন ও বাকি জীবন বড়ভাইয়ের সঙ্গে কীর্তন গেয়ে, ফুটবল খেলে এবং বৈঠকখানায় ঢালাবিছানায় গড়িয়ে বাকি জীবন কাটালেন।
বিধির বিধানে তখনই লেখা হয়ে গেল যে অর্ধশতাব্দী পরে কোলকাতায় রায়পরিবারের বড়তরফের নাতিদের মধ্যে সেই একই প্রহসন অভিনীত হবে। চেয়ারম্যান মাও যে বলেছেন—এই শিক্ষাব্যবস্থায় যে যত পড়ে, সে তত মূর্খ হয়।
তবে উনি বোধহয় ওঁর জ্যেঠিমা, মানে আমাদের বড়মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। ওঁর মা ছিলেন কড়াপ গাঁয়ের মেয়ে। বড়মার খুব চোপা ছিল। নিজের জায়ের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হত একই ধুয়ো ধরে—আরে আমার কড়াপের খড়াপ রে!
তুলসীমালাধারী পরম বৈষ্ণব নীলমণি রায়ের গলায় চিনি কিছু কম পড়েছিল।
নীলমণি বাঙাল জিভে হলেন লনী, তারপর ‘লইন্যা’!
বড়মা সুখময়ী ফুট কাটলেন—হগলে গান গায় মধুরস বাণী, লইন্যায় গান গায় ভেড়ার চেঁচানি।
নীলমণি নির্বিকার। কীর্তন চলতে থাকল আরও বছর দুই। এমন সময় একটা ঘটনা ঘটল। সকালে ঘন দুধের বাটিতে আম দিয়ে নীলমণি জলখাবার সেরে বৈঠকখানার ঢালা বিছানায় গড়াচ্ছেন। চোখ জুড়ে এসেছিল, কুঁই কুঁই আওয়াজে চোখে মেলে দেখলেন সদ্য চোখফোটা একটি পাটকিলে সাদা কুকুর ছানা তাঁর মুখের কাছে এসে লেজ নাড়ছে। মনটা একধরনের ভালোলাগায় ভরে উঠল। উনি চোখ বুঁজে হুঁ হুঁ করে সুর ভেজে অক্রুর পালার গান ধরলেন—নিরানন্দ হইল পুরী-ই-ই-ই!
আর তখনই ঘটল ব্যাপারটা; ওই ই-ই-ই গিটকিরির সময় সারমেয় সন্তানটি লাফিয়ে ওঁর জিভ চেটে দিল। হা-কৃষ্ণ হা-কৃষ্ণ বলে উনি লাফিয়ে উঠে গোবরের ছোঁয়া লাগিয়ে গঙ্গাজল দিয়ে জিভ শুদ্ধ করলেন। ওঁকে সারাজীবন আর কীর্তন গাইতে শোনা যায় নি।
ঠাকুমার এক বোন ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রী; তিনি দুইকন্যা নিয়ে আমাদের বাড়িতে দেখা করতে এলে ওঁর কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরার ধরন অন্তঃপুরের আলোচনার বিষয় হয়। আর তাঁর এক মেয়ের আঙুলে একটা তারের আঙটি মত। জানা গেল উনি সেতার বাজান, এবং ওটাকে মেজরাপ বলে। রান্নাঘরের গসিপ থেকে উনিও নিস্তার পেলেন না। সেতার বাজাইলে বুঝি সারাক্ষণ আঙ্গুলে পইর্যা থাকতে হয়! যত ভইগল্যাম।
ব্রাইট স্ট্রিটে একটি দোতলা বাড়িতে বড় বড় ঘর। চওড়া বারান্দা। করিডরে দেওয়াল থেকে ঝোলে হরিণের সিঙওলা মাথা। বাড়ির নীচে গাড়িবারান্দায় গাড়ি; ঠাকুর-চাকর-ঝি পরিবৃত সম্পন্ন সংসার। না, এঁরা উদ্বাস্তু ন’ন। এই বাড়ির মালিক আমার দাদুর প্রায় সমবয়সী মামা মোক্ষদা প্রসাদ ঘোষ ইংরেজ আমল থেকেই অবিভক্ত বাঙলার ভেটারিনারি জেনারেল। শেষ বয়সে গলায় ক্যান্সার নিয়ে আমাদের বাড়িতে শেষ দেখা করতে এলেন। আমার মাকে বারণ করে বললেন—কেউ যেন দোক্তা দিয়ে পান না খায়, পানের বাটা ফেলে দাও।
আমরা বাচ্চারা গলার ওপর মৌমাছির চাকের মত কিছু দেখে প্রণাম না করেই ছাদে পালিয়ে গেলাম।
আরেকটি গাড়ি কখনও সখনও আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়াত। হাসিমুখে নেমে আসতেন এক সুদর্শন পুরুষ, নিখিলরঞ্জন রায়। ঠাকুমার খুড়তুতো ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়, তিনি তখন হিন্দুস্থান ইন্সিওরেন্সের (তখনও লাইফ ইন্সিওরেন্স নাম হয় নি) বড়কর্তা। খানিকক্ষণের জন্যে আমাদের বদ্ধ তিনকামরার ঠাসাঠাসি ফ্ল্যাটে বয়ে যেত হাসিঠাট্টা-খোশগল্পের মুক্ত হাওয়া। কিন্তু এঁর বড়দা বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ ডঃ নীহাররঞ্জন রায় নিজের ছেলের বিয়ের চিঠি বাড়ির ড্রাইভারের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়ায় ঠাকুমা বললেন—নীহার আইজ এত বড় হইছে যে নিজে আইতে পারল না?
বাঙালের গোঁ!
এইখানে একটা কথা বলে রাখি। ঘটনাচক্রে এই শতকের প্রথম দশকে ই-টিভির বাংলা ক্যুইজ প্রোগ্রামে অংশ নিতে হায়দ্রাবাদের রামোজি রাও স্টুডিওতে গিয়ে দেখি পালা পড়েছে রিটায়ার্ড ব্যাংক অফিসার ও ক্যুইজ মাস্টার জনৈক রায়মশায়ের সঙ্গে। উনি নীহাররঞ্জনের ভাইপো এবং নিখিলরঞ্জনের বড় ছেলে। দারুণ খেলছিলেন, কিন্তু কপাল খারাপ। ফাইনালে একটা কঠিন ‘আনপ্লেয়েবল বল’ এল, বাম্পার নয় বীমার।
প্রশ্নটা ছিল বার্বি ডলের আবিষ্কর্তা কে? উত্তর আমিও জানি না। তবে আমার প্রশ্নটি সহজ ছিল--হনুমানের মায়ের নাম কী?
ফলে আমি বাই ডিফল্ট কয়েক লাখ টাকা জিতে গেলাম। স্বর্গ থেকে সরযূবালা হাততালি দিলেন।
এত সব আত্মীয়স্বজন আমাদের বাড়িতে দেখা করতে এলে বাচ্চাদের পোয়াবারো। তখন কড়েয়া রোডের কে সি মাইতি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে রসগোল্লা আসে, সিঙাড়া আসে। আর আসে জিলিপি এবং বিশেষ দিনে ‘লাল দই’। তাতে বাচ্চাদের শেয়ার থাকা অবধারিত। কিছুদিন পরে বাড়ির অন্দরমহলে একটি ‘গুল্প’ চালু হল, মিষ্টির দোকানে ওই লাল দই জমাতে দোকানদার কেঁচো কেটে তার কয়েক ফোঁটা রস ফেলে, তাতে নাকি দুধ কেটে দই হওয়ার প্রক্রিয়া সহজ হয়।
আমাদের জিভে শ্বেতাঙ্গী রসগোল্লার স্বাদ ম্যাড়মেড়ে, পছন্দ শ্যামাঙ্গী পান্তুয়া বা লেডিকেনি। আর সিঙাড়ার সঙ্গে জিলিপি। যদি কখনও সখনও চমচম জোটে, আর ল্যাংচা? কিন্তু বাচ্চাদের জন্যে কোনটা ভাল সেটা তো বড়রা ঠিক করে দেয়। ফলে রঙিন মিষ্টি নয়, লজেন্স (আমরা বলতাম লেবেঞ্চুষ) মানা, দাঁত খারাপ হবে। সার্কাস বিস্কিট নয়, খেতে হবে একঘেয়ে ব্রিটানিয়া থিন অ্যারারুট। কোন কাকা সদয় হলে এক আনা নিয়ে ছুট লাগাতাম মমতাজ স্টোর্স আর কিনে ফেলতাম ছোট ছোট হাতি ঘোড়া বিস্কুট, ফুটো করা তামার পয়সা দিয়ে টকঝাল ত্রিফলা লজেন্স। দোকানে চোখে পড়ত সরু কাঁচের একটা নলের মধ্যে রঙিন ছোট ছোট লজেন্সের গুলি। যারা খেয়েছে তারা বলল ওই কাঁচ ভেঙে লজেন্সের গুলি চুষলে শেষে একটা মৌরির দানা পাওয়া যায়।
বেকবাগান ও আমির আলি এভেনিউয়ের মোড়ের মিঠাই নামের অসাধারণ দোকানটি তখনও জন্মায় নি।
ও হো, আত্মীয়স্বজনের কথাই যখন উঠলো তখন দু’জনের কথা না বললেই নয়।
একজন সম্পর্কে জ্যাঠামশায়, আমাদের বলা হল চিনি জ্যাঠামশায় বলে ডাকতে। কিন্তু পরিবারে সবাই বলত ‘প্রিন্স অফ জারুইতলা’। এবার একটু পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে হচ্ছে।
জারুইতলা হল ময়মনসিংহের এক বর্ধিষ্ণু জনপদ। সতীশচন্দ্রের এক বোনের বিয়ে হল সেখানকার ভূস্বামী জ্ঞানদাস মশাইয়ের পরিবারে। পরিবারটির আয়ের মুখ্য স্রোত হল সুদের কারবার। কিন্তু ১৯৩৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক–প্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা ক্ষমতায় এলে চাষীদের সুদ মাপ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ইউনিয়ন বোর্ডকে ক্ষমতা দেওয়া হল সালিশী বোর্ড গঠন করে চাষীদের আবেদন ও মহাজনের বক্তব্য শুনে ফয়সালা করতে। আমার দাদু উকিল সতীশচন্দ্র সালিশী বোর্ডের সেক্রেটারি হয়ে অনেক কেসের নিরপেক্ষ ফয়সালা করে প্রজাদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেন এবং সরকারবাহাদুরের থেকে একটি জমকালো ট্যাঁকঘড়ি উপহার পেলেন। কিন্তু বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনে বসে বিচার করতে গিয়ে উনি নিজের ভগ্নীপতি দাস পরিবারের খাতকদের কয়েকহাজার টাকা ঋণ মাপ করে দিলেন। দাস পরিবার এটা আশা করেন নি। ফলে দুই পরিবারের মধ্যে মুখ দেখাদেখি কিছুদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে রইল।
সেই পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র ধ্রুববাবু বা আমাদের চিনিজ্যেঠা ছিলেন আলালের ঘরের দুলাল। অতীব সুদর্শন এই ভদ্রলোকের পরনে কাঁচি ধুতি, গিলেকরা পাঞ্জাবি, পায়ে চকচকে পাম্পশু আর মুখে অল্প অল্প হাসি। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি উনি হাজির হলেন কোলকাতায়, পার্কসার্কাসে আমাদের দাদুর দস্তানায়। বাড়ির উলটো দিকে দত্তদের দোতলা বাড়ির গ্যারেজের উপর একটি ম্যাজেনাইন ফ্লোর। তাতে দাঁড়ালে মাথা ঠেকে যায় ছাদে। সেখানে আমার অবিবাহিত কাকারা, বিশেষ করে যাঁরা তখনও স্কুল-কলেজের গণ্ডী পেরোন নি, মাটিতে সতরঞ্চি বিছিয়ে পাশে কেরোসিন কাঠের বইয়ের তাক নিয়ে দিব্যি থাকেন। জ্যাঠামশায় জায়গা নিলেন সেই ব্যাচেলর্স ডেনে। আমরা বলতান—নয়া বাড়ি।
জানলাম উনি দেশভাগের অনেক আগেই এম এ পাশ করেছেন। দেশে জমি-জিরেত-পুকুর ছিল। কাজেই গ্রাসাচ্ছাদনের চিন্তা ছিল না। জীবন বয়ে চলত সরল রেখায়—মৎস্য মারিব, খাইব সুখে, লয়ে।
এখন চাকরি খুঁজতে এখানে ঠাঁই নিয়েছেন। কয়েক মাস হয়ে গেল, উনি নড়েন না, আর চাকরি নিয়ে তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। ওঁর ছিল চায়ের নেশা। মাঝেমধ্যেই আমাদের বলতেন মূল বাড়ির রান্নাঘরে গিয়ে ভাইবৌদের কাছে চায়ের আবদার পৌঁছে দিতে। নিজেই কিনে আনতেন দার্জিলিং চা। আমরা বখশিস পেতাম পিপারমেন্ট লজেন্স। আর বড়ভাইবউ—চা-আসক্ত আমার মা—ভীষণ খুশি। কারণ ওই চা’য়ের অনেক দাম। আমাদের বাড়িতে এতগুলো মুখ, কেনা হত শস্তা চা।
টানাটানির সংসার, বাড়ির কর্তা বিপন্ন বোধ করতে লাগলেন।
একদিন ওনাকে বিদায় নিতে হল। পরে জেনেছি উনি পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাটে শিক্ষক হয়ে একজন সমবয়েসি শিক্ষিকাকে বিয়ে করে বেশি বয়সে সুখের সংসারের স্বাদ পেয়েছিলেন।
এক শরতের বিকেল। আমি ও নীচের তলার তোতামামু, নবাব আলি ও আরও ক’জন গলিতে চার আনার রবারের বল দিয়ে ক্রিকেট খেলছি। গলির মুখের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বলে অফব্রেক করানোর গ্রিপ নিয়ে দাঁড়িয়েছি কি কানের পাশে মৃদু ফিসফিস-–খোকা, উকিল সতীশচন্দ্র রায়ের বাড়ি কোথায় বলতে পার?
তাকিয়ে দেখি, ঘেমো চেহারায় এক যুবক, পরনে ধুতি, মলিন শার্ট, বগলে গোটানো নারকোল দড়ি দিয়ে বাঁধা এক বিছানা ও একটি টিনের তোরঙ্গ। আমি একটু অবাক। আমার দাদুর নামই বটে। কিন্তু তিনি নিয়মিত বাজারে যান, হিসেব লেখেন, সন্ধ্যেবেলা পার্কে বেড়াতে নইলে ঘোষাল বাড়িতে ভাগবত পাঠ শুনতে যান। তাঁকে এখানে কেউ উকিল তো বলে না! আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে পকেট থেকে একটি চিরকুট বের করে বলল--এই যে ঠিকানাটা--১/সি, সার্কাস মার্কেট প্লেস।
আরে, এটাই তো আমাদের বাড়ি। উপরে নিয়ে যেতেই সবাই স্তুম্ভিত। জানলাম উনি দাদুর ময়মনসিংহে ওকালতির দিনের মুহুরি সুরেন্দ্র সাহা মশায়ের ছেলে কালিদাস সাহা। ওপার থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কোলকাতায় এসেছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে এই আশায়, সম্বল বাবার হাতে লেখা চিঠি ও চিরকুট।
আমাদের বাড়ির কেউ কেউ মুরুব্বির চালে বলল—যাদবপুরে বা শিবপুরে মেকানিক্যালে কত নম্বর পেলে ভর্তি হওয়া যায় খবর রাখ? এবছরের কাট অফ ৬৩০। এর চেয়ে কেমিক্যালে কি সিভিলে চান্স পাওয়া সোজা। কালিদাসদাও ঠাঁই পেল সেই নয়াবাড়ির ব্যাচেলর্স আড্ডায়। এক সপ্তাহ পেরোল না, কালিদাসদা মিষ্টির বাক্স নিয়ে আমার দাদু ও ঠাকুমাকে প্রণাম করে টিনের বাক্স ও দড়ি বাঁধা বিছানা নিয়ে বিদায় নিল। চান্স পেয়েছে মেক্যানিক্যালে, শিবপুর যদুপুর-–দু’জায়গাতেই। ভর্তি হয়েছে যাদবপুরে, থাকবে হোস্টেলে।
বিয়েবাড়িতে ও অন্য কোন উৎসবে আসতেন একজন। ফর্সা মিতবাক যুবক। নীলরঙা হাতাগোটানো ফুলশার্ট ও বকলস লাগানো প্যান্ট। উজ্বল একজোড়া চোখ। কিন্তু অদ্ভুত লাগতো মাথার কদমছাঁট চুল, একেবারে জুতোর বুরুশের মত।
ওকে দেখা মাত্র ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন বাড়ির কর্তা সতীশচন্দ্র। গিন্নিকে চোটপাট করতেন—হে কেন আইসে, আইজকের কামকাজের দিনে?
সরযূবালা ঝামটা দিয়ে উঠতেন--আপনের শ্যালক, আপনে জিগান গিয়া।
অসহায় সতীশ সবাইকে নীচুগলায় নির্দেশ দিতেন-–সবাই হ্যারে চৌক্ষে চৌক্ষে রাখ। জিনিসপত্র সামলাও।
যাকে নিয়ে সবার মাথাব্যথা, সে কিন্তু নির্বিকার। এক কোণে চুপটি করে বসে আছে, খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছে। খাবার ডাক পড়লে উঠে গিয়ে পংক্তিভোজনে বসে মাথা নীচু করে খেয়ে হাত ধুয়ে পান চেয়ে নিচ্ছে। একসময় সবার অলক্ষে বিদায় হলে আধঘন্টার মধ্যে দেখা গেল আমন্ত্রিত অভ্যাগতদের মধ্যে কারও আংটি, কারও দামী ঝর্ণাকলম, কারও মানিব্যাগ গায়েব।
বড় হয়ে জেনেছি, উনি আমার ঠাকুমার কোন তুতো ভাই। পেশা ও নেশা পকেটমারি। এলাহাবাদ-লখনৌ লাইনে সব পেশাদার পকেটমারের গুরুঠাকুর। কয়েকবার জেলের ঘানি টানার অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর খোদার কী খোদকারি, উনি অবিভক্ত বাংলায় ম্যাট্রিকে চার বিষয়ে স্টার ও জলপানি পেয়েছিলেন।
এবার আমার পিসিমাদের কথা।
ঢাকুরিয়া থেকে আসতেন দুই পিসিমা ও পিসেমশায় যাঁদের পদবি ছিল মজুমদার, বাঙাল উচ্চারণে মন্দার!
দুর্গোপুজো শেষ, বিজয়াদশমীর বিসর্জন সবে শুরু। বিকেল পাঁচটা নাগাদ অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সময় দূর থেকে কোথাও অবাঙালী পাড়ায় রাবণ জ্বলছে, বাজি পুড়ছে। তার দূরাগত গুরুগুরু ধ্বনি মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ঘড়ি ধরে দরজায় কড়া নড়ে উঠত। বাচ্চারা টের পেতাম পিসিমা-পিসেমশায়রা এসেছেন! দরজা খুলতেই ধোপদুরস্ত ধুতিপাঞ্জাবি পরা বিপুলবপু পিসেমশায়ের হাঁকডাক ও হাসিতে বাড়ি সরগরম। পাড়াপড়শিরাও টের পেত।
বাচ্চারা খুশি, এবার রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসবে থরে থরে দুধের লাড়ু যা তৈরি হয়েছে বিশাল পিতলের কড়াইয়ে পালা করে মা-কাকিমা-ঠাকুমাদের হাতের নাড়ায় দুধ শুকিয়ে খোয়া ক্ষীর বানিয়ে এবং পাথরের খাদায় (বাটিতে) নরুণ দিয়ে সজত্নে ফুল পাখি মাছ তোলা ছাঁচে চেপে চেপে। এ নাকি ময়মনসিং জেলার বিশিষ্ট মিষ্টি! যা হারিয়ে গেল আমার মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে। আর থাকবে নারকোল নাড়ু ও তক্তি (বরফি)।
ষাট বছর পেরিয়ে গেছে।
আজ আমাদের সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। এখন আমরা ভাই-ভাই ঠাঁই ঠাঁই। একে অন্যের বাড়ি যাবার আগে দস্তুরমত ফোন করে অ্যাপো নিয়ে তবে দেখা করি, সবাই ব্যস্ত যে! আগে যেমন বিনা খবরে যে যার বাড়িতে যেতুম, সেই অধিকারবোধটাই হারিয়ে গেছে বোধহয়।
আমাদের পিসতুতো দাদাদের ডাক নাম ছিল ময়না ও বুলবুল। দাদু সতীশচন্দ্র মুখ বেঁকিয়ে বললেন – পক্ষীর নামে মাইনষের নাম? এতে মাইনষের অসম্মান হয়। আমি আমার ছেলেমেয়েদের কত সুন্দর নাম রাখছি। সলিলকুমার, বিজন, বিনয়, শৈবাল ---, আর শিশিরকণা, নীহারকণা, সবিতা, মনীষা।
কথাটা আমার মনে ধরল। কিন্তু ছোটপিসি মুখ ঝামরে উঠল—হ্যাঁঃ, সে তো ভাল নাম। তোমাদের রাখা ডাকনামগুলো আরও অখাদ্য। দাদাদের নাম কী করে বীণা, মীরা, মণি এইসব রাখলে?
দাদু রণে ভঙ্গ দিয়ে ইসলামপুরি কাঁসার জামবাটি ভরে দেওয়া গরম দুধ ও রুটি খাওয়ায় মন দিলেন।
বড়পিসিমা ও পিসেমশায়ের পরিবার আমাদের অভিন্ন অঙ্গ, তিনটে ঘরের একটায় দুটো তক্তপোষ ও মেজেতে বিছানা করে দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে ওঁদের সংসার। আমার থেকে ছ’বছরের বড় দাদা পড়ে ক্লাস এইটে। আমাকে পড়ায় পাড়ার লাইব্রেরি বা বন্ধুদের থেকে ধার করে আনা স্বপনকুমারের বিশ্বচক্র সিরিজ ও বাজপাখি সিরিজের রোমহর্ষক ডিটেক্টিভ উপন্যাস। পাতলা পাতলা ছোট সাইজের পেপারব্যাক, দাম চার আনা। কভারের ছবি থেকে চোখ ফেরানো দায়।
একটার কভারে আঁকা—টেবিলে মুখ থুবড়ে একজন সুবেশ ভদ্রলোক, মুখ থেকে রক্তের ধারা বেরিয়ে টেবিলে জমাট বেঁধেছে। আর কালো ফেল্ট হ্যাট, ওভারকোট পরা এক মূর্তির হাতের পিস্তল থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
বইগুলোর নাম এ’রকমঃ জীবন-মৃত্যু, বিকেল ছ’টার শো’তে, নীল সমুদ্রে বাজপাখি।
আমি জানলাম কোলকাতায় রসা রোড, বেণ্টিঙ্ক স্ট্রিট, হ্যারিসন রোড, পার্ক স্ট্রিট ও ক্যামাক স্ট্রিট নামের রাস্তা আছে। আরও জানলাম দীপক চ্যাটার্জি বলে এক গোয়েন্দা আছেন, তিনি ও তাঁর সহকারী রতনলাল যে কোন রহস্য ভেদ করতে পারেন। কোন গুণ্ডা তাঁদের সঙ্গে পেরে ওঠে না। এরপর এল শশধর দত্তের মোহন সিরিজ—দস্যু মোহন, মোহন ও রমা, আবার মোহন, রমাহারা মোহন। এগুলোর দাম একটাকা করে।
তারপরে এল সুন্দরবনের আর্জান সর্দার, ভোম্বল সর্দার, শুকতারা ও কালো ভ্রমর।
আমি আর থই পাই নে, অন্য এক দুনিয়ায় পৌঁছে যাই। পিসেমশায় অসুস্থ, অফিস ফেরত বাড়ি এসে ছানা খান, বেদানা খান। কিন্তু অনেক সময় শুয়ে বসে কাটান। আমাকে ডেকে একদিন বীজমন্ত্র দিলেন।
বড় হয়ে দূরে দূরে চাকরি করবি, মাঝে মাঝে বেড়াতে আসবি। তখন দেখবি কত খাতির। আর যদি এইখানেই আঠা হয়ে থাকিস, তোর মূল্য যাবে কমে। তুই রঞ্জন থেকে হবি ‘রঞ্জইন্যা’! রোজ ফাইফরমাইশ খাটতে হবে। পিসিমা আমার মায়ের বাড়া। অনায়াস অধিকারে গাল টিপে ধরে মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে চুরি করে মুখে পোরা গুড়ের ড্যালা নর্দমায় ফেলে দেন! ওরে, কৃমি হইব যে, দাঁতে পোকা অইব। আমি চোখের জলে মার সামনে বলি--কথা দিলাম বড় হয়ে চাকরি করার সময় প্রথম মাসের মাইনে থেকে এক সের গুড় কিনব, আর কিনব মোহন সিরিজের চল্লিশটা বই। দেইখ্যা নিও।
মা হেসে ফেলে।
কিন্তু কেউ কথা রাখে নি, আমিও না।
মেজপিসে থাকতেন জামশেদপুরের স্ট্রেট মাইল রোডে; তাঁর বাড়িতে ছিল সবার জন্যে অবারিত দ্বার। বাবা-কাকারা বেকার হলেই চাকরি খুঁজতে গিয়ে উঠত মেজদাদাবাবুর বাড়িতে। একান্নবর্তী পরিবারে কুড়ি জনের হেঁসেল ঠেলে শরীর খারাপ হলে ফণিডাক্তার বললেন জলবায়ু বদলানো দরকার। কোথায় যাওয়া যায়? মোল্লার দৌড় মসজিদ, সেই জামশেদপুর। এক কাকা বর্ণনা করলেন—মেজদাদাবাবুর বাড়ি হল নন্দনকানন। সেখানের বাগানের গাছে গাছে বুলবুলি দোয়েল শিস দেয়, টিয়ের ঝাঁক উড়ে বেড়ায়, বাগানের পেয়ারা আর পেঁপের স্বাদ?
ওদের একমাত্র ছেলে, আমাদের দাদামণি, কোলকাতায় এল মামাবাড়িতে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পড়বে বলে। দাদামণি নিপাট ভালমানুষ, কিন্তু আমাদের বাড়ির হিসেবে বেশ শৌখিন মেজাজের। পড়ায় বিশেষ মন নেই। মন পড়ে থাকে ‘মুঘল-এ-আজম’ ফিল্মে পৃথ্বীরাজ কাপুরের আকবর বাদশার অভিনয়ে। বাড়িতে নকল করে দেখায়—‘লে যাও ফাটক মেঁ’।
বাড়ির সামনে ধাঙড়বাজারের তিনদিবসের রাতভোর ক্ল্যাসিক্যাল প্রোগ্রামে উনি সিজন টিকিট কেটে হাজির। আমাদের সে সামর্থ্য নেই। ঘর থেকেই মাঝরাতে ঘুমচোখে শুনতে পাই কত্থক নর্তকীর নূপুরনিক্কণ, তবলায় ধা-ধা-তেরেকেটে, থুন-না, কত্তা ধাগে! আর কখনও সেতারের মীড় ও দ্রুতলয়ে ঝালা।
মামিমারা পরের দিন খাবার বেড়ে দেবার সময় মুখ টিপে নিরীহ স্বরে জিগাইলেন—কী গো ভাইগ্না, কাইল রসুনকুমারীর নাইচ দেখতে গেছলা?
--কী যে কন মাইমা! রসুন না, রওশনকুমারী। দারুণ কত্থক নাচে। আর সঙ্গে বনারস ঘরানার পণ্ডিত সামতাপ্রসাদের তবলা! স্বর্গীয় জিনিস।
কথা ছড়িয়ে গেল। বাড়ির কর্তা দাদু সতীশচন্দ্র ডেকে পাঠালেন। জানতে চাইলেন লেখাপড়া ছেড়ে সারারাত এইসব যাত্রাপালা শুনে কার কী উদ্ধার হচ্ছে?
--দাদু, সামতাপ্রসাদ যখন তবলায় চাঁটি মারে—
দাদু হতাশ হয়ে পরের দিনই চিঠি লিখে মেজজামাইকে বললেন—ছেলেকে জামশেদপুরে ফেরত নিয়ে যাও, এখানে বখে যাচ্ছে।
দাদামণির কলেজ আর হয় নি। কিন্তু ওঁর ছোট ছেলে এখন প্রফেশনাল তবলাবাজিয়ে, এটাই ওর সংসারযাত্রার সম্বল।
তবে ক্লাসিক্যাল সংগীতের রসগ্রহণে অক্ষম সতীশচন্দ্র নিজের ছেলেকে বললেন—যম-জামাই-ভাগনা, তিন নয় আপনা।
আমাকে শেখালেন—ভাগিনা গো ভাগিনা, তোমার বাপের ডরে হাগি না।
(ক্রমশ)
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)