Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines




পরবাসে
শান্তনু সরকারের

লেখা


ISSN 1563-8685




লা দোলচে ভিতা

অনেক দিন আগের কথা। এক সুন্দর সকালে, সাত দিনের পুরনো তেলে ভাজা গরম কচুরি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে সবে নিজের চেয়ারে বসেছি গবেষনার চেষ্টায়, এমন সময় ডাক এলো—আমার ফোন আছে। তখন ল্যান্ডলাইনের যুগ, ও প্রান্ত থেকে চেনা গলা, "দাদা কাল থেকে চেষ্টা করছি তোমায় ধরতে, আজ ম্যাটিনি শোতে 'লা দোলচে ভিতা', আসবে?" না বলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, স্যার কে কোনো উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে বললাম—কাল বসব স্যার, আজ একটা জরুরী কাজ আছে। তারপর সাইকেল নিয়ে সোজা খড়গপুর স্টেশন, হাওড়া লোকালটা এখনি ছাড়বে।

হাওড়া স্টেশনে নেমে দেখি হাতে আর সময় নেই। একটা ফাঁকা ট্যাক্সি ধরে বললাম "নন্দন—তাড়াতাড়ি।" ট্যাক্সি চালক একজন মধ্যবয়স্ক, কয়েক দিনের না কামানো দাড়ি, ক্লান্ত কিন্তু হাসিমুখে জানতে চাইলেন “ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল?” সম্মতি দেখে বললেন, "আজ শুনলাম ইতালিয়ান বই?" অবাক চোখে বললাম হ্যাঁ, "লা দোলচে ভিতা।" “বইটা কি নিযে দাদা?” বললাম “ঠিক জানিনা, ফেলিনির ছবি।” মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সেদিন কোলকাতাকে রেহাই দিয়েছিলো, রাস্তায় তাই কোনো মিছিল ছিলো না। নন্দনে নেমে পুরো ভাড়া দিতে পকেট হাতড়াচ্ছি, চালক বললেন "আরে যা দিয়েছেন ঠিক আছে, বই শুরু হয়ে যাবে, যান!" এখন মনে হয় সে সময় অনেকেই বোধ হয় আর একটু বেশি বেঁচে থাকতেন।

লা দোলচে ভিতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর পরবর্তী সময়ের সামাজিক মুল্যাহীনতার, ভোগবাদের উত্থান, এবং সামাজিক সম্পর্কের নতুন মূল্যায়নের ছবি। ছবির নামের অর্থ “the sweet life”, অবশ্যই শ্লেষাত্মক। ছবিতে প্রতিরাত্রে রোমের হোটেলে বা অর্থবান প্রভাবশালীদের প্রাসাদে চলে প্রমোদের ঢালাও আযোজন। অর্থই ক্ষমতা, অর্থেই আনন্দ, তাই অর্থেই মোক্ষলাভ। কিন্তু আমার আনন্দ যতক্ষন আর পাঁচজন না জানতে পারছে, ততক্ষন আর কিসের মোক্ষলাভ? তাই রোমের বিত্তবানদের প্রতিরাতের হুল্লোড়ের খবর সবাইকে জানানোর দায়িত্ব পড়ে এক পেজ থ্রী সাংবাদিক, মার্চেল্লোর (নাম ভুমিকায় অনবদ্য মার্চেল্লো মাস্ত্রোয়ানি) ওপর। মার্চেল্লো কেচ্ছা আর পরচর্চার গন্ধ শুঁকে বেড়ায় প্রতি রাতে, আর তার পরিবার নিজের অজান্তেই একসময় পেজ থ্রীর খবর হয়ে ওঠে। প্রভাবশালীদের প্রতিরাতের পার্টিতে নিরন্তর আনন্দ খোঁজার চেষ্টার দৃশ্যগুলো ছিল তীব্র শ্লেষ আর ব্যাঙ্গে ভরা। যে সময় আমার “লা দোলচে ভিতা” প্রথম দেখা, তখন রোম, অর্থ, আর পার্টি কোনোটার সম্বন্ধে সম্যক ধারনা ছিল না। পুরো সিনেমা দু ঘন্টার বেশি, সকালের অম্বল, হাওড়া লোকাল, দুপুরের গরম, আর নন্দনের ঠান্ডায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অনেকখন।

সে সময়, ভারতের দক্ষিনে যখন আইটি বূমের প্রস্তুতি চলেছে, আমাদের কলেজের দাদারা তখন প্রায়শই ক্লাস কামাই করে ধুতি গুটিযে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুন্ডপাত করতেন আর সন্ধ্যাবেলায় এক ছিলিম “মার্ক্সবাদ মেড ইজি”, একটু “গ্রেট ডিক্টেটর”, আর একপ্রস্থ “কলকাতা ৭১” নিয়ে বসতেন। তাই আইটি বূমের খবর পেলেও, তার শব্দ আমাদের কানে আসেনি তখনো। তারপর একদিন `আইটি’র ঢেউ এসে পড়ল প্রবল হয়ে, আর সে ঢেউএর টানে ভেসে গেল আমার পাশের দক্ষিনী `ভাইটি’। তা দেখে আইটির “খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে” একসময় আমিও ভেসে পড়লাম বাংলার বাইরে। আইটির তখনকার সাফল্যের মুল কারণ ছিল টাকা আর ডলারের অসাম্য, মেধার প্রয়োজন প্রায় ছিলনা বললেই চলে। আমার টাকা একসময় যখন ডলার হলো, তখন মোক্ষলাভের আশায় অপরিহার্য্য হয়ে উঠল সন্ধ্যের পার্টি, প্রতি সপ্তাহান্তে। সে সমাগমে কেউবা দীর্ঘদিনের স্থায়ীত্বে সর্বজ্ঞ, কেউ নতুন স্থায়ীত্বের আশ্বাসে উদ্বেল, আবার কেউ অস্থায়ী কর্মবীর। র্পার্টিগুলোয় অর্থহীন মজা আর বৈচিত্র খোঁজার চেষ্টা করতে করতে আবার মনে পড়ে গিয়েছিলো “লা দোলচে ভিতা”।

“লা দোলচে ভিতা”র যে দৃশ্য বহুচর্চিত, সেটি এক সন্ধ্যের ঘটনা। এক হলিউড খ্যাত অভিনেত্রী সিলভিয়া (নাম ভুমিকায় sensuous অনিটা একবার্গ) রোমে এসেছে এবং মার্চেল্লোর দায়িত্ব কিছু এক্সক্লুসিভ চাটনী খবর বের করা। পার্টি যখন মধ্যরাত পেরিয়ে, দুজনে বেরিয়ে পড়ে রোমের রাস্তায়; সিলভিয়া বৈচিত্রের খোঁজে, আর মার্চেল্লো চাটনীর আশায়। মার্চেল্লোকে অবাক করে সিলভিয়া হঠাৎ ট্রেভি ফাউন্টেনে নেমে পড়ে। বেচারা মার্চেল্লোর আর কোনো গতি থাকেনা জলে নামা ছাড়া। তৈরী হয় এক অদ্ভুত করুণ, হাস্যকর দৃশ্য। “লা দোলচে ভিতা”র অনেক পরে হিচকক “দ্য বার্ড” করেছিলেন। সে ছবির নায়িকাও এক সংবাদপত্রের মালিকের মেয়ে, রোমে বেড়াতে গিয়ে বৈচিত্রের খোঁজে সে জামাকাপড় খুলে লাফিয়ে পড়েছিল ট্রেভি ফাউন্টেনে, খবরে আসার আশায়। টাকা যখন উপচে পড়ে, খবরে আসার আর খবরে থাকার বাসনা তখন প্রবল আকার ধারন করে। তাই মধ্য যৌবনে কেউ ফোয়ারার জলে ঝাঁপ দেয় আর কেউবা বিগত যৌবনে আফ্রিকার রুগ্ন শিশু কোলে তুলে নেয়।

এবার যখন রোমে এলাম, ঠিক করে রেখেছিলাম যে ট্রেভি ফাউন্টেন দেখতেই হবে। কন্ফারেন্সের শেষ দিনটায় দোকান বন্ধ বন্ধ ভাব, সেদিন কন্ফারেন্স কাটিয়ে সকালে সোজা চলে এলাম রোমা টার্মিনি-—রোমের বাস, মেট্রো, আর দুরপাল্লার ট্রেনের মিলনস্থল, অনেকটা আমাদের এসপ্ল্যানেড আর হাওড়াকে এক করলে যেমন হয় তেমন। শহরের বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি ভ্যাটিকান সিটি যাওয়ারও বাস ছাড়ে এখান থেকে। দেশীয় চেহারার অনেকে ট্যুরিস্ট বাসে রোম ঘোরার নানারকম টিকিট বিক্রী করছে। এদের একজন আমার কাছে অদ্ভুত ইংরেজী টানে “হ জ ব র ল” ন্যাড়ার মতন হাসিহাসিমুখে রোম হাফ ডে, ফুল ডে ঘোরার টিকিট বিক্রীর চেষ্টা শুরু করতে, কি মনে হলো, সোজা বাংলায় প্রশ্ন করলাম, “ট্রেভি ফাউন্টেন কিভাবে যাব বলতে পারেন?” একগাল হেসে বললেন, “আপনে বাঙালী, আগে কইবেন তো ! সোZআ অইখানে গিয়া ৮ টাকার (ইউরো) টিকিট কাটেন, চব্বিশ ঘন্টার মইধ্যে েZখানে খুশী, Zাতে খুশী Zাইতে পারবেন।" ধন্যবাদ জানিয়ে টিকিট ঘরের দিকে এগোতে আবার ডাকলেন “এই ম্যাপটা রাখেন, সব ট্যুরিস্ট স্পটের খবর আছে।"

রোমের দর্শনীয় যায়গাগুলো প্রধানত তিন রকম, ফাউন্টেন, চার্চ, আর মিউজিয়াম। প্রায় ৮০০ মতন চার্চ, আর ১০০ বেশী ফাউন্টেন রোমের নানা জায়গায় ছড়িয়ে—সেখানে ধর্ম, স্থাপত্য, আর শিল্পের অপরুপ মেলবন্ধন। সোনার কেল্লার মন্দার বোসের “যেখানে পাত পেড়েছে সেখানে একটা কেল্লা গুঁজে রেখেছে” মার্কা, মন্দিরের প্রাদুর্ভাব রোমে কোথাও নেই। চার্চের কথায় আবার ফেরা যাক “লা দোলচে ভিতা”য়। ছবির শুরুর দৃশ্যটি বিতর্কিত এবংবহুআলোচিত। আমরা দেখি হেলিকপ্টারে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একটি যিশুখৃষ্টের পুর্নাবয়ব মুর্তি আর তা দেখে বহুতল বাড়ির ছাদের সুইমিং পুলে বিকিনি পরিহিতা যুবতীরা উচ্ছসিত। দৃশ্যটি অবশ্যই সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীকী, কিন্তু এই দৃশ্যের কারণে ছবিটির ওপর ভ্যটিকানের অশিক্ষিত সন্ত্রাসবাদী কোপ নেমে এসেছিল, ধর্ম অবমাননার দায়ে।

সারাদিন ঘোরার পর গাইড বই খুঁজে দিনের শেষ গন্তব্য স্থল ট্রেভি ফাউন্টেনের বাসে উঠলাম। প্রায় সন্ধ্যে নেমে এসেছে, অফিসফেরতা যাত্রীদের ভীড় বাড়ছে, বাসের ঠেসাঠেসি মনে করিয়ে দিচ্ছে “গড়িয়াহাটার মোড়”। যাত্রীরা ক্লান্ত, কিন্তু বিরক্ত নয়। হঠাৎ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের খোঁচায়, বাইরে তাকিয়ে দেখি বাস স্টপ “লার্গো দি তোরে আর্জেন্তিনা”—ম্যাপের সাথে মিলছেনা তো! শুকনো মুখে এক অফিসফেরতা ইতালীয়কে জিগ্যেস করলাম এ বাস কি ট্রেভি ফাউন্টেন যাবে? হেসে ঘাড় নাড়তে আমার মুখের অবস্থা যা হলো, দেখে তিনি ইতালীয় ইংরেজীতে জানালেন এখানেও একটা ফাউন্টেন আছে, ট্রেভির থেকে কোনো অংশে কম যায় না—নাম পিয়াজা (যার অর্থ সরু গলি-রাস্তার শেষে বড় উন্মুক্ত চাতাল, যার মাঝখানে সাধারনত সুদৃশ্য ফোয়ারা) নাভোনা। বাস থেকে নেমে আমায় গলির মুখে ছেড়ে দিয়ে বললেন নাক বরাবর সোজা চলে যান। গলির শেষেই পিয়াজা নাভোনা। ভদ্রতাবশত জানতে চাইলাম এখানেই থাকেন? হেসে উত্তর দিলেন “না না, আরো তিনটে স্টপ পরে। এ গলিটা জানা না থাকলে খুঁজে পাবেননা, তাই নামলাম। এনজয় রোম !”

পিয়াজা নাভোনা তৈরী হয়েছিল প্রথম শতাব্দীতে, তার চারটি ফোয়ারর স্থাপত্য (সময়কাল ১৫শ শতাব্দী) দেখলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। সে তুলনায় ট্রেভি ফাউন্টেন তো “সেদিনের ছোকরা”। উইকিপিডিয়া অনুযায়ী ট্রেভির এত জনপ্রিয়তার পেছনে নাকি সেই “লা দোলচে ভিতা”।

পরের দিন, প্রায় মধ্যরাতে দেশে ফেরার পালা। তাই সকাল সকাল আবার বেরিয়ে পড়লাম ট্রেভির খোঁজে। বার্বেরিনি মেট্রো স্টেশন থেকে দীর্ঘ পথ। চওড়া রাস্তা ক্রমশ যত সরু হতে লাগল, পাশাপাশি হাঁটতে থাকা সহযাত্রীরা আরো কাছাকাছি—ঘেষাঘেষি, শেষে তা নলিনী সরকার স্ট্রীটের অষ্টমীর জনস্রোতের আকার নিল। রাস্তার দুধার দিয়ে সুভ্যেনীয়ের আর পিৎজেরিয়ার পসরা, যাকেই জিজ্ঞাসা করি “ট্রেভি কোথায়”, সেই হেসে বলে “অই হোতায়”! অবশেষে, গলির শেষে, ট্রেভির দেখা মিলল। কোথায় যেন পড়েছিলাম পথের যাত্রাটাই আসল, শেষটা নয়।

লোহার রড দিয়ে ঘেরা ভাস্কর্য, ফোয়ারায় জল নেই একফোঁটাও। মেরামতির কাজ চলছে। কাঠের পাটাতন আর লোহার রড দিয়ে নড়বড়ে সাঁকো, আর তার একপ্রান্তে লাঠি হাতে বাঁশি মুখে ভীড় সামলাচ্ছেন নিরাপত্তারক্ষিকা।

মহম্মদ আলি পার্কের দর্শনার্থী সামলানো সেচ্ছাসেবকের ঢংএ বলতে লাগলেন “এপাশ দিয়ে ঢুকে ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে যান, বেশীক্ষন দাঁড়ালেই বিপদ—এ সাঁকো অত ভার সইতে পারবে না।" খৃষ্টপুর্ব উনিশে এই ট্রেভির ঠিক কোথায় এক যুবতী জলের উৎস দেখিয়েছিল (যেখানে আজ ট্রেভি ফোয়ারা) সেটা দেখার আর ইচ্ছে হল না। কোথায় সে লাস্যময়ী অনিটা, হায় মার্চেল্লো!

দিল্লী বিমানবন্দরে যাত্রাশেষের অনন্ত অপেক্ষা, সকাল থেকে। দীর্ঘ যাত্রাপথের, তৃতীয় শ্রেণীতে ভ্রমনের ক্লান্তি। আমাদের এক প্রাক্তন মন্ত্রীমশাই বিমানে তৃতীয় শ্রেণীতে ভ্রমন করে টুইটারে লিখেছিলেন `ক্যাটল ক্লাস’। তাতে মহা শোরগোল; রাজা, উজীর, মিত্রপক্ষ, শত্রুপক্ষ সবাই রে রে করে ছুটে আসায় তিনি নাকেখৎ দিয়ে বলেছিলেন যে সাদা মনে একটু ঠাট্টা করছেন, এ নেটিভরা সামান্য ইংরেজী রসিকতাও বোঝেনা। দিল্লী বিমানবন্দরের নিরাপদ আরামে চোখ বুঁজে আসতে মনে এল রোম মেট্রোর সেই কিশোরী পকেটমার, যে আনাড়ী হাতে যে আমার ব্যাগ থেকে টাকার বদলে পাসপোর্ট নিয়ে ফেলেছিল। হাতসাফাইতে হাত পাকেনি বোধহয়, তাই ধরা পড়ে যায়। যদি পাসপোর্ট নিয়ে যেত, তখন কি দেশে ফেরা হত? রোমা টার্মিনির সামনে যে বাংলাদেশী “ইমিগ্র্যান্ট”দের দেখেছিলাম তাদের কারোর কি বৈধ পাসপোর্ট রয়েছে? আধো ঘুমে আনাড়ী চিন্তা, দেশে যদি নাই ফেরা হত, তখন আমি কি পারতাম হাসিমুখে “রোম হাফ ডে, ফুল ডে” টিকিট বিক্রীর কাজ করতে? সে কাজ কি এখনকার থেকে খুব বেশী কষ্টকর হত?

“লা দোলচে ভিতা”য় মার্চেল্লো যখন সারা রাতের ক্লান্তি নিয়ে সকালে হোটেলে ফিরেছিল, আলাপ হয়েছিল এক উচ্ছল কিশোরী পরিচারিকার সাথে, অনেকের মত সেও “ইমিগ্র্যান্ট”, রোমে এসেছে কাজের খোঁজে, চোখে তার ঘর বাঁধার স্বপ্ন। মার্চেল্লোর টাইপরাইটারে তখন বড়লোকেদের ঘর ভাঙ্গার মুখোরোচক কাহিনী। লা দোলচে ভিতার শেষ অঙ্কটি অনবদ্য। সারা রাতের বেলেল্লাপনার পর সবাই যখন ক্লান্ত শরীরে জলের ধারে, ও পারে তখন সেই উচ্ছসিত কিশোরী। হাত পা নেড়ে সে মার্চেল্লোকে জানাতে চায় তার ঘর বাঁধার খবর। সে আওয়াজ চাপা পড়ে যায় এ পারের সবার অবিরাম অর্থহীন কোলাহলে। শোনার খানিক ব্যর্থ চেষ্টার পর ক্লান্ত মার্চেল্লো ফিরে যায় বাকি সবার সঙ্গে।

বিমানবন্দরে অবিরাম যাত্রীদের যাওয়া আসা। সবার মাঝে একা শুয়ে বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘরে ফেরার ডাক এল। সঙ্গের ব্যাগে ঠাসা রোমের রাস্তায় কেনা নানান প্রতীকী, দেশের অনেকের জন্য। এখন এ ব্যাগের ভার অসহ্য বোধ হচ্ছে। দিল্লী থেকে আবার দীর্ঘ পথ, জেটক্লান্ত আধো ঘুম একসময় ভাঙল যাত্রা শেষের খবরে। মুঠোফোন জেগে উঠতেই অপরিচিত নম্বর থেকে ভাঙ্গা হিন্দীতে একটা আধচেনা গলা। “আপ আ গয়ে সার?” অবাক হয়ে একই রকম ভাঙ্গা হিন্দীতে প্রশ্ন করলাম “এয়ারপোর্ট পিক আপ-এর কথা তো তোমার অফিসে জানাতেই ভুলে গেছি, জানলে কিভাবে”? ইন্সটিটিউটের ড্রাইভার জানাল যে ছেড়ে আসার সময় আমি তাকে আজ, এখন, ফেরার কথা বলেছিলাম। আজ রবিবার, কাজের তেমন চাপ নেই তাই একবার ফোনে চেষ্টা করে দেখছিল আমি এসেছি কিনা!

সহজে কোথাও কোনো কিছুই বদলায় না, আমার অনুপস্থিতি তো শুধু কয়েক দিনের। তবু ফিরে এসে মনে হয় কিছুই কি বদলায়নি? কথা বলার জন্যই জিজ্ঞাসা করলাম “সব কিছু ঠিকঠাক আছে?” ড্রাইভার হেসে উত্তর দিল যে কয়েক দিন হল ভীষণ গরম পড়েছে, এবার বোধহয় বৃষ্টি হবে। “আপকা সফর ক্যায়্সা থা?” যত্ন করে মালপত্র নামিয়ে দেওয়ার পর হেসে বললাম, পরে আবার যখন যাব, ফেরার দিনটা এমন করে মনে রেখো।।



(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)