ISSN 1563-8685




বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কাজী নজরুল ইসলাম

৯২৭ খ্রিস্টাব্দ, ২৮ ফেব্রুয়ারি। ঢাকার 'মুসলিম-সাহিত্য-সমাজ'-এর প্রথম বার্ষিক অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন। এই অধিবেশনে দাঁড়িয়ে কাজী নজরুল ইসলাম বললেন,

'আজ আমি এই মজলিসে আমার আনন্দ বার্তা ঘোষণা করছি। বহুকাল পরে কাল রাত্রে আমার ঘুম হয়েছে। আজ আমি দেখছি এখানে মুসলমানের নূতন অভিযান শুরু হয়েছে। আমি এই বার্তা চতুর্দিকে ঘোষণা করে বেড়াব।'১
এ আনন্দ সমাজমুক্তি আন্দোলনের কর্মী কাজী নজরুল ইসলামের। এ আবেগ মথিত হয়েছিল আকস্মিকভাবে — এমন নয়। এ ছিল ১৯১৭ সালে সৈন্য ব্যারাকে বসে লেখা আঠারো বছর বয়সী নজরুলের 'মুক্তি' কবিতার স্বপ্ন। তারপর ১৯২০-তে তাঁর যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত 'নবযুগ' পত্রিকার ভাবনার মধ্য ছিল সেই মুক্তির আকুতি। তা আরও স্পষ্ট হয়েছিল ১৯২২-এর ১১ আগস্ট, প্রতিবাদের নিশান উড়িয়ে প্রকাশ করা পত্রিকা 'ধূমকেতু'-তে। যার সম্পাদক ছিলেন কাজী নজরুল স্বয়ং। সেদিন সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দেশের আশু প্রয়োজন উপলব্ধি করে দেশবাসীকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন নতুন চেতনায়। যে চেতনার আর এক নাম মুক্তি। 'ধূমকেতু'র প্রথম সংখ্যাতেই পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে তিনি লিখেছিলেন,
'এ দেশের নাড়ীতে নাড়ীতে অস্থি-মজ্জায় যে পচন ধরেছে তাতে এর একেবারে ধ্বংস না হলে নতুন জাত গড়ে উঠবে না। দেশের যারা শত্রু, দেশের যা কিছু মিথ্যা, ভণ্ডামী, মেকী তা সব দূর করতে ধূমকেতু হবে আগুনের সম্মার্জনী। ... পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল কিছু নিয়ম কানুন, বাঁধন, শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।'২
সেদিন এই লেখা পড়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল মুসলমান রক্ষণশীল সমাজ। তা পড়ে 'ইসলাম দর্শন', 'মোসলেম জগৎ'-এর লেখকরা যে ভাষায় নজরুলকে আক্রমণ করেছিলেন তা সমস্ত শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। 'শয়তানের পূর্ণাবতার', 'বুনো বর্বর', 'অনাচারের জীবন্ত অপগ্রহ' ইত্যাদি কোনো শব্দই বাদ থাকেনি নজরুলের উদ্দেশে তাঁদের বিষোদগারে। নজরুল এ সমস্তই সহ্য করেছিলেন। আমরা জানি, এরপর ১৯২৫ সালে তিনি একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। যার নাম, 'দি লেবার পার্টি অব ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস'। তার মুখপত্র প্রকাশ করলেন 'লাঙল' নামে। কমিউনিস্ট আদর্শকে গ্রহণ করে তাকেই লড়াইয়ের মাধ্যম করতে চেয়েছিলেন। তাই ১৯২৭-এ যখন ঢাকার কিছু প্রগতিশীল চিন্তার মানুষজন 'মুসলিম-সাহিত্য-সমাজ' গড়ে তুললেন, নজরুলের আনন্দ বাঁধ ভেঙে প্লাবিত করল অধিবেশনে উপস্থিত নাগরিক সমাজকে। নজরুল এই অধিবেশনে গেয়ে শুনিয়েছিলেন তাঁর 'খোশ আমদেদ' রচনা।
'এল কি           অলখ-অবকাশ বেয়ে তরুণ হারুণ-আল-রশীদ।
এল কি           আল-বেরুনি হাফিজ খৈয়াম কায়েম গজ্জালি।। ...
খুশির             এ বুলবুলিস্তানে মিলেছে ফরহাদ ও শিরী।
লাল এ           লায়লি লোকে মজনুঁ হরদম চালায় পেয়ালি।।'
এ তথ্যও বিস্ময়ের নয় যে, এই কাব্যটি নজরুল রচনা করেছিলেন ওই দিন অধিবেশনের ঠিক প্রাকমুহূর্তে। পরে এই কাব্যটি 'জিঞ্জির' কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। উদ্যোক্তারা কাব্যটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে তা আবারও 'মুসলিম সাহিত্য-সমাজ'-এর মুখপত্র 'শিখা'-তে প্রথম সংখ্যার উদ্বোধনী বার্তায় প্রকাশ করেছিলেন।

২৮ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে নজরুল তাঁর 'খালেদ' কবিতাটি আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। নজরুলের এই দীর্ঘ কাব্যটি সেদিন সভাস্থলকে চমকে দিয়েছিল। কী আত্মপীড়ন, আত্মগ্লানি, অবদমিত ব্যথা নিয়ে যে নজরুল ছুটে বেড়িয়েছিলেন, ছাত্র-যুবদের জাগানোর কাজে মন-প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন, এই কবিতাটি থেকে তা উপলব্ধি করা যায়।

'খালেদ! খালেদ! সত্য বলিব, ঢাকিব না আজ কিছু,
সফেদ দেও আজ বিশ্ববিজয়ী, আমরা হটেছি পিছু! ...
টক্কর খেতে খেতে শেষে এই আসিয়া পড়েছি হেথা,
খালেদ! খালেদ! রি রি করে বুকে পরাধীনতার ব্যথা!
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে
বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা ও হাদিস চষে! ...
ভিতরের দিকে যত মারিয়াছি, বাহিরের দিকে তত
গুনতিতে মোরা বাড়িয়ে চলেছি গোরু ছাগলের মতো!
খালেদ! খালেদ! এই পশুদের চামড়া দিয়ে কি তবে
তোমার পায়ের দুশমন-মারা দুটো পয়জারও হবে? ...
খোদার হাবিব বলিয়া গেছেন আসিবেন ইসা ফের,
চাই নে মেহেদি, তুমি এসো বীর হাতে নিয়ে শমশের।'
কবিতাটি ১৯২ পংক্তির। নজরুলের জলদগম্ভীর কন্ঠস্বরে সভায় এই কবিতা আবৃত্তির পর কেমন পরিবেশ রচিত হয়েছিল আমরা তা সহজেই অনুমান করতে পারি। এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন মোহাম্মদ মঈনুদ্দীনের 'সওগাত' পত্রিকার জন্য। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়েছিল।

এই সভা থেকেই রচিত হয়েছিল 'বুদ্ধির-মুক্তি' আন্দোলন। এই 'শিখা' গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সংযোগ নজরুলের কতখানি ছিল তা জানা যায়নি, কিন্তু আত্মিক যোগ গড়ে যে উঠেছিল সমাজকে জাগানোর লক্ষ্যে, তা থেকে কখনও তিনি বিচ্ছিন্ন হননি। এই 'শিখা' গোষ্ঠী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন কাজী আবদুল ওদুদ।

'তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল 'মুসলিম-সাহিত্য-সমাজ', আর তাদের মন্ত্র ছিল 'বুদ্ধির-মুক্তি' (Emancipation of Intellect). এই মন্ত্র তাঁরা পেয়েছিলেন বহু জায়গা থেকে — কামাল আতাতুর্কের কাছ থেকে, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ ও জাঁ-ক্রিস্তফের লেখক রোমা রোঁলার কাছ থেকে, পারসীক কবি সাদীর কাছ থেকে, আর হজরত মোহাম্মদের কাছ থেকে। ... এই 'সাহিত্য সমাজ' পূর্ণ উদ্যমে কাজ করতে পেরেছিল তিন বৎসর — এর প্রথম ও দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে নজরুল যোগ দিয়েছিলেন। ... এই সমাজের বার্ষিক পত্র 'শিখা' পর পর পাঁচ বৎসর প্রকাশিত হয়। ... দশম বার্ষিক অধিবেশনে শরৎচন্দ্র এর সভাপতিত্ব করেন।' ৩
এই গোষ্ঠী বাংলার শিক্ষিত মুসলমান সমাজে কিছু প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সক্ষম হয়নি। মূলত তা মুসলিম যুবকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার জন্য ব্যাপকতা লাভ করতে পারেনি। এক সময় তা হারিয়েও যায়। ভারতীয় নবজাগরণের সূচনাকালে রামমোহন বিশেষত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রচেষ্টায় ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী চিন্তার যে সুর গাঁথা হয়েছিল তা এই গোষ্ঠী ভালোভাবে আত্মস্থ করতে পারেননি। নজরুল এই নবজাগরণের ধারায় কিভাবে বলিষ্ঠতা দেখাতে পারলেন, তাও তাঁরা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। সে যাই হোক, এই প্রচেষ্টা ইতিহাসে স্থান পেয়েছে এবং নতুন ভাবনার বীজ রোপণ করে গিয়েছে। যে কারণে সাম্প্রতিক কালের এক সাহিত্য আলোচক তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন,
'বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ভাবযোগী কাজী আবদুল ওদুদ যখন 'মুস্তাফা কামাল সম্বন্ধে কয়েকটি কথা' শীর্ষক প্রবন্ধ লিখে তরুণ মুসলিম সমাজে আলোড়ন তুলছেন, তার কাছাকাছি সময়ে নজরুল 'কামাল পাশা' শীর্ষক অভিনব কবিতা লিখে এবং ধূমকেতু'তে 'কামাল' শীর্ষক জ্বালাময়ী প্রবন্ধ লিখে জাগরণ সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছেন। অন্ধ শাস্ত্রানুগত্য ও জড়তার বুকে মুক্ত বুদ্ধির কষাঘাত হানার কারণে রক্ষণশীল সমাজের কতিপয় পুরোহিতদের দ্বারা কাজী ওদুদেরা যেমন আক্রান্ত হয়েছেন — 'কাফের', 'নাস্তিক' ইত্যাদি বলে গালি খেয়েছেন, তেমনি নজরুলও নিগৃহীত হয়েছেন — 'কাফের' অভিধা পেয়েছেন। নজরুল 'আমার কৈফিয়ত' কবিতায় তা উল্লেখও করেছেন।'৪
বর্তমানকালে ভারত, বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীতে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করে আক্রান্ত হচ্ছেন, জীবন বলিদান করছেন বহু তাত্ত্বিক, নব ভাবনার প্রবক্তারা। আমাদের এই তথাকথিত 'ধর্মনিরপেক্ষ', 'গণতান্ত্রিক' দেশ এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশে যুক্তি ও বুদ্ধির কথা, মুক্ত চিন্তার ভাবনা তুলে ধরতে গিয়ে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন অনেকে। কারণ ধর্মীয় মৌলবাদ আজ আগ্রাসী ভূমিকা পালন করতে উদ্যত হয়েছে। নজরুল নিজেও সেই আক্রমণকে মোকাবিলা করেছিলেন। যুগের পরিবর্তন ঘটছে, কিন্তু সমস্যার গভীরতা আজও সমানেই বিরাজ করছে, বরং কিছু ক্ষেত্রে আরও ব্যাপকতরভাবে। নজরুল এই গভীর-জটিল সমস্যার শেকড় ধরে টানতে গিয়ে সেদিন 'সওগাত' পত্রিকায় খুব আবেগের সঙ্গে কিছু আলোচনা করেছিলেন। জাতিকে সজাগ করার জন্যেই সেদিন লিখেছিলেন,
'বাংলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কিনা জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙাল এবং অতিমাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ 'কাফের' খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। ... কয়েকজন নোংরা হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখক ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে আমায় কিছুদিন হতে ইতর ভাষায় গালাগালি করছেন এবং কয়েকজন গোঁড়া 'হিন্দু-সভাওয়ালা' আমার নামে মিথ্যা কুৎসা রটনাও করে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু এঁদের আঙুল দিয়ে গোনা যায়। ... আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের এ-সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেবদেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্যে অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানি হয়েছে। তবু আমি জেনেশুনেই তা করেছি।'৫
জীবনভর নজরুলের এই প্রচেষ্টার যথার্থ মূল্য যদি বর্তমান যুগের লেখক, সমাজকর্মী, চিন্তাশীল নাগরিকরা দেওয়ার জন্যে এগিয়ে আসেন তবেই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন আজও গভীর ভিত্তি নিয়ে গড়ে উঠতে পারে। দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে আজকের আলোর পথযাত্রীদের। নজরুল তারই যথার্থ সূচনা করে দিয়ে গিয়েছেন ১৯২৭ সালে 'মুসলিম সাহিত্য-সমাজ'-এর সভায়।


তথ্যসূত্র :


১। 'বার্ষিক সম্মিলনের বিবরণ', শিখা সমগ্র, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সংকলিত ও সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৩, পৃষ্ঠা ১২৭

২। ধূমকেতুর পথ, কাজী নজরুল ইসলাম রচনা সমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ডিসেম্বর ২০০৫, পৃষ্ঠা ৪৩৮-৪৪০

৩। বাংলার জাগরণ, কাজী আবদুল ওদুদ, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ১৩৬৩, পৃষ্ঠা ১৯৬

৪। বুদ্ধির মুক্তি ও কবি নজরুল, নূরুল আমিন, নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকা, ত্রিশতম সংকলন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃষ্ঠা ৫৭

৫। কাজী নজরুল ইসলাম রচনা সমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০১-৫০৮



(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)