কাজেই আমরা জানতাম আমাদের তানজানিয়া ভ্রমণ হবে বিপদসঙ্কুল। মুম্বাইতে ঝেঁপে বৃষ্টির মধ্যে টার্মিনাল বদল করে মস্ত লাইনে দাঁড়িয়ে পরে জানতে পারলাম কেনিয়া এয়ারলাইনস-এর উড়ান দু ঘন্টা পিছিয়ে গেছে। বুক দুরু দুরু করে উঠল। নাইরোবি থেকে কিলিমানজারো যাওয়ার উড়ান ফস্কে যাবে না তো? বোর্ডিং পাস হাতে পেয়ে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। কানেকটিং উড়ানেরও পাস দিয়েছে। আর একই এয়ারলাইনস-এর উড়ান। ছোটোখাটো এয়ারলাইনসগুলোতে আপ্যায়ন একটু কম, কিন্তু ওরা আপনাকে জ্বালাবেও কম। চাট্টি খেতে দিল। খাওয়া শেষ করেই ঘুম দিলাম। সকালে ঘুম ভাঙলে সামনের স্ক্রিনে দেখলাম সাগরের ওপর দিয়ে যাত্রা প্রায় শেষ, জানালা দিয়ে তলায় পেঁজা পেঁজা মেঘ আর আফ্রিকার ভূখণ্ডের আভাস দেখা যাচ্ছে। স্ক্রিন বলছে বহু নিচে একটা বন্দরের মত যেটা ঠাহর হচ্ছে সেটা বেনগাজি।
কফি খেতে খেতে তলায় মানচিত্রের মত পড়ে থাকা আফ্রিকা দেখছিলাম। তুলোর বলের মত মেঘ সারা আকাশে। তার তলে দেখা যাচ্ছে বাড়িঘর, রাস্তা। রাস্তা না নদী? কে জানে। প্রথম তো ভেবেছিলাম বিরাট একটা জলা জমির ওপর দিয়ে যাচ্ছি। পরে বুঝলাম খণ্ড খণ্ড মেঘগুলোর ছায়া পড়ে আছে। একটু দেরি করেছে বিমান। অর্থাৎ আমাদের হাতে মিনিট পঁয়তাল্লিশ আছে পরের উড়ান ধরার জন্যে। রাণওয়েতে নামার অনন্তকাল পরে টার্মিনাল। হাতে আছে আটত্রিশ মিনিট।
মিনিট পাঁচেক পরে লম্বা করিডরের শেষে একটি বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে আমাদের উড়ানের নম্বর। বাতিল হয়ে গেছে! সেই অচিন বিমানবন্দরের অকূল পাথার সাঁতরিয়ে কেনিয়া এয়ারলাইনস-এর ডেস্কের বয়া খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু সেই খড়কুটো আঁকড়ে ধরার জন্যে সেখানে জমা হয়েছে এক আকুল ভিড়। কেউ দেরি করার ফলে আদ্দিস আবাবা-র উড়ান মিস করেছে, কেউ টিকিট বদলাতে চায়, কাউকে ঢোকার সময় ইমিগ্রেশন ছাপ মারেনি বলে পড়েছে মহা আতান্তরে, দু জন আমাদের মতই জানতে চায় কিলিমাঞ্জারো যাত্রীদের কী রয়েছে কপালে। শাদা, কালো বাদামী --উদ্বেলিত এক জনতা। কেনিয়ানদের যেটা দেখলাম ভালো আমাদের মতই ওরা লাইন ফাইনের ধার ধারে না। আধঘন্টাটাক পরে অবশেষে সামনে পৌঁছতে পারলাম। দুই তরুণী মনোযোগ দিয়ে তাদের মনিটরের দিকে তাকিয়ে। আমাদের হুড়মুড় করে করা প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা স্মিতহাস্য করে শুদু বললেন : ওয়েট। চমৎকৃত হয়ে গেলাম। আমাদের রাজনীতিকদের এঁদের কাছে শিক্ষানবিশি করতে পাঠানো উচিত।
অপেক্ষা করলাম ঝাড়া তিনঘণ্টা। টারপর সহযাত্রীদের কাছে জানলাম সাড়ে চারটে নাগাদ আমাদের একটা বিমান নিয়ে যাবে। কোন এক প্রাইভেট এয়ারলাইনস-এর ছোট্ট মিনিবাসের মত একটা প্লেন। তার মাথার অপরের জিনিষ রাখার খোপ এতই ছোট যে প্রায় সবাইকেই হাতের ব্যাগ নিচে অথবা পাশের সীটে রাখতে হল। ভাগ্য ভাল খুব অল্প যাত্রী। আরেকটা ভাল হল এটা অনেক নিচু দিয়ে ওড়ে। ফলে কিলিমানজারো-কে দেখতে পেলাম বাঁদিকে, যদিও ওপর থেকে একটু ছোট দেখতে লাগছিল আর তার কোমর পর্যন্ত ছিল মেঘের ঘেরাটোপে। বিভূতিভূষণের উদ্দেশ্যে প্রণাম ঠুকতে ঠুকতেই প্লেন নামল কিলিমানজারোয়।
বাস এয়ারোব্রিজ এসবের ভণিতা নেই। আধ কিলোমিটার হেঁটে টার্মিনালের প্রবেশপথ। তার ডান পাশে হাত শুদ্ধ করার ব্যবস্থা। তার পরে একজন দস্তানা পরিহিত হাতে আলগোছে আমাদের পীতজ্বরের কাগজ পরীক্ষা করলেন। তারপর ইমিগ্রেশন।
বাইরে তখনও আলো রয়েছে। আমাদের নাম লেখা কার্ড নিয়ে ডেভিড দাঁড়িয়ে ছিল। আরুশা যেতে সে বলল সময় লাগবে মিনিট চল্লিশেক। পথে আমরা একটা স্থানীয় সিম কার্ড নেবার জন্যে দাঁড়ালাম। এলাম আরুশা-র ভেনাস হোটেলে। রাতের খাওয়া খেতে গিয়ে দেখলাম খাদ্য ও পানীয় দুই-ই সস্তা।
সন্ধে বেলা-র আস্তানা টুইগা রিসর্ট। এখানে যে রীতি দেখলাম চালু -- যাওয়া মাত্র একটি থালায় আপনাকে এনে দেওয়া হবে একটি ধূমায়িত তোয়ালে। আপনি আলগোছে সেটি দিয়ে হাতমুখ মুছে ট্রে-র ওপরে রাখা হালকা পানীয় স্পর্শ করে প্রবিষ্ট হবেন। আপনার ব্যাগ যদি আপনি ভুলেও নিজে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন চাদ্দিকে হাঁ হাঁ করে উঠবে সবাই। হোটেল চত্বর বেশ বড়, গাছে ঢাকা। সুইমিং পুলে পাতা পড়ে আছে, পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। বিরাট একটা আয়ত লন ঘিরে সারি সারি কটেজ। লনে দেখলাম বেশ কিছু তাঁবু। কিন্তু খারাপ ব্যাপার হল ইফ্রাইম-কে এখানে থাকতে দেবে না। পরের দিন সক্কাল সক্কাল চলে আসবে আশ্বাস দিয়ে সে হাসিমুখে বিদায় নিল।
আমরা উঠেছি অনেক সকালে। মনে চাপা উত্তেজনা। আজ অবশেষে আমরা সেরেংগেটি যাব। সায়েন্স সিটিতে দেখা সেই সেরেংগেটি। পাঁচিলের ঠিক বাইরের নারকোল গাছে একটা ধনেশ পাখি ডেকেই চলেছে। স্নান করে জলখাবার খাওয়া শেষ হতেই ইফ্রাইম হাজির হল। যেতে হবে ঘন্টা চারেকের রাস্তা। সে রাস্তা গেছে গোরোংগোরো আগ্নেয়গিরি ধ্বসে যে বিশাল ক্রেটার তৈরি হয়েছে তার পাশ দিয়ে। সুতরাং আপনি সেখানে যান বা না যান সেখানের প্রবেশমূল্য একশো সত্তর ডলার দিয়ে তবে আপনি ঢুকতে পারবেন। মিনিট কুড়ি গিয়ে একটা ভিউপয়েন্ট। নিচে ছড়ানো ক্রেটার। সেখানে যথারীতি সেলফি তোলার ভিড়। কিন্তু ছুরির মত হাওয়া দিচ্ছে। কাজেই ভিড় পাতলা হচ্ছে তাড়াতাড়ি।
লাল ধুলো ওড়ানো পথ ধরে আমরা চললাম প্রথমে খানিক পাহাড়ি রাস্তায়। গোরোংগোরো ক্রেটার থেকে যে মাসাইদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে তাদের ছোট ছোট গ্রাম। তারা গরু চরাচ্ছে। বা জাল বুনছে, বা ট্যুরিস্টদের কাছে অল্পস্বল্প কিছু বেচার চেষ্টা করছে। ইফ্রাইম সতর্ক করে দিল। বলল ছবি তুললেই কিন্তু সব ছেঁকে ধরে পয়সা চাইবে। বেচারাদের রুজি বলতে এখন প্রায় এই শুধু রয়েছে। একটা গ্রামের সামনে দেখলাম ভরদুপুরে গোল হয়ে নাচ দেখাচ্ছে কয়েকজন। তিন চারটে গাড়ি রয়েছে ট্যুরিস্টদের। মাসাই গ্রাম ভ্রমণ এবং আদিবাসী জীবনযাপনের টুকরো অবলোকন করা আজকাল খুব চালু হয়েছে। আমাদের একটু অস্বস্তি হয় — কি জানি কবে না লোকে বাঙাল বলে আমাদের দেখতে আসে। এখন তো আমরাও প্রায় সংরক্ষিত জীব।
এরপর আমরা পেরোলাম এক তেপান্তরের মাঠ। সেরেঙ্গেটি মানে নাকি মাসাই ভাষায় অনন্ত মাঠ। না জানি কখন এসে পৌঁছলাম প্রবেশপথে। গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ। ইফ্রাইম বলল সময় লাগবে, আমরা যেন খেয়ে নিই। কার্ডবোর্ডের বাক্সে করে প্রচুর খাবার প্যাক করে দিয়েছিল। তার এক ভগ্নাংশ আমরা খেতে পারলাম। হরেক কিসিমের লোক। সবাই লাঞ্চবক্স সাবাড়ের কাজে ব্যস্ত।
এরপর তিনদিন আমরা এই বিলাসিতায় থাকলাম। সারা দিনের রুটিন হল সকালে গোগ্রাসে ছোট হাজরি সেরে নিয়ে ইফ্রাইম-র সঙ্গে বেরিয়ে পড়া। তারপর সারাদিন বন জঙ্গল চষে সন্ধে নামলে ক্যাম্প-এ ফিরে আসা। কোনদিকে যাওয়া সে সম্পূর্ণ ইফ্রাইম এর হাতে। হাতিদের দল, চিতার দল, লেপার্ডের দল, সিংহ-এর দল, হাতিদের হাতাহাতি, সিংহ-দের ভালবাসাবাসি, জিরাফের জলপান, -- সবই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিল ইফ্রাইম। অনেক ট্যুরিস্ট দেখে অভ্যস্ত সেরেংগেটি। খুবই অবহেলার সঙ্গে এরা আমাদের লম্বা দেখত। চমক এল তৃতীয় দিন। ক্যাম্প থেকে বেরোবার আধঘন্টাটাক পরে ইফ্রাইম হঠাৎ সাঁ করে কতগুলো গাছের দিকে ধেয়ে গেল। আর একটিমাত্র গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চালকও ইফ্রাইম-এর চেনা। সদ্য মারা এক হরিণ নিয়ে গাছে উঠছে এক চিতা। তাকে তাড়া করেছে গোটা পাঁচেক হায়না। একটা লাফিয়ে উঠে তার লেজের ডগাটুকু পেল। সড়াৎ করে নেমে এসে চিতা পাশের গাছে উঠে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু হায়নারাও থানা দিয়ে বসে। তারপর একফাঁকে সে তড়িৎ গতিতে নেমে এসে লম্বা লম্বা লাফ মেরে উধাও হয়ে গেল। ইফ্রাইম তো হেসে খুন। এমন মহা নিষ্ক্রমণ নাকি সে কখনও দেখেনি।
গোরোংগোরো সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহল খুব বেশি। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মধ্যে গোটা জীবজগৎ একটা? তা ঠিক নয়। অনেকদিন আগেই ফুটিফাটা হয়ে গেছে সে। পড়ে রয়েছে বিশাল এক গহ্বর। এর কাছাকাছি যে রিসর্টে আমাদের থাকার ব্যবস্থা সেও অতীব কায়দার। তবে এখানে কটেজগুলো পাকা। রিসেপশন পেরিয়ে বার। তারপর একটা বড় ঢাকা বারান্দা। সামনে সুইমিং পুল দেখলাম ভর বিকেলেও পূর্ণ। প্রচুর শ্রাইক আর সানবার্ড সারা রিসর্টের চত্বর জুড়ে। এখানে আবার রাতের খাবার বুফে নয়। টেবিলে বসার সঙ্গে সঙ্গে একজন কোলে ন্যাপকিন বিছিয়ে দিল, একজন টেবিলটা গুছিয়ে দিল, একজন প্রথম পদ এনে দিল। আমি তো মুখে তুলছিলাম না। খেতে শুরু করলে কেউ নিশ্চয় ছি ছি নিজে খাচ্ছেন বলে কাঁটা চামচ ছিনিয়ে নিয়ে খাইয়ে দেবে।পরে বুঝলাম না, অতটা নয়। খানিকটা বোধহয় ঔপনিবেশিক ইতিহাস খানিকটা বকশিস এর কারনে। টিপস দেওয়া সব জায়গাতে প্রায় বাধ্যতামূলক। এঁরা মাইনেও খুব বেশি পান বলে মনে হয় না। কাজেই যথোপযুক্ত টিপস না দেবারও কোন প্রশ্ন নেই।
ঢালু রাস্তা ধরে কোটরে নামতে নামতে ইফ্রাইম জানাল মাসাই-রা আগে এখানে দিব্যি ছিল। তারা জানত ওটা সিংহ, সিংহ জানত এটা মাসাই, কেউ কাউকে অকারণে বিরক্ত করত না।মাসাই-রা যে গরু চরাত তাদের গলার ঘন্টা-র আওয়াজের অনুকরণেই নাকি এখানকার নাম ধ্বন্যাত্মকভাবে হয়ে গেছে গোরোংগোরো। কিন্তু পরিবেশ বাঁচাতে তাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে বাইরে আর গোটা দুনিয়া থেকে সায়েবসুবোরা জিপের ধোঁয়া উড়িয়ে সেই সংরক্ষিত বন ঘুরে যাচ্ছে।
(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)