আজ রাতের ট্রেন বেশ লেট আছে। রূপমের বাবার ফোনে মেসেজ এসেছে, আজ আপ ক্রিয়াযোগ এক্সপ্রেস প্রায় আড়াই ঘন্টা লেটে আসবে। দশটা নাগাদ ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। এখন লেট হয়ে রাত বারোটা কুড়িতে সেই ট্রেন ছাড়বে। রূপমের অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে। সে পরীক্ষার পর বাবার সঙ্গে রাঁচি বেড়াতে যাচ্ছে। রাঁচিতে তার পিসিরা থাকেন। এবারে রূপম বাবাকে অনেকবার পুরুলিয়া নিয়ে যেতে বলেছিল, কারণ বেশ কয়েকবার রাঁচি ঘোরা হয়ে গেছে, তার। কিন্তু বাবা রাজি হননি। রূপম জানে তার বাবা বড় একগুঁয়ে। যেটা করবেন বলে ঠিক করেন, সেটা করবেনই। বাবার কাছে বায়না করে কোনোদিন লাভ হয়না। কলকাতা ছেড়ে কয়েকদিনের জন্য রাঁচিও রূপমের অবশ্য মন্দ লাগে না। রাঁচির ফলসগুলো খুব সুন্দর, আর পিসির রান্নার হাতটাও বেজায় ভালো। মোটামুটি খুশি মনেই সে তাই বেড়াতে যাচ্ছে। রূপম মায়ের কথা মতো রাতের খাবার খাওয়ার পর ক্যাব বুক করে নিল। সে এবারে ক্লাশ এইটের অ্যানুয়াল পরীক্ষা দিয়েছে। বোনের পরীক্ষা এখনও বাকি। তাই মা আর বোন তাদের সঙ্গে এখন যেতে পারছে না। মা বোনকে নিয়ে সপ্তাহখানেক পরে ওর পরীক্ষা হয়ে গেলে রাঁচি আসবে। রূপম আর তার বাবা পরিমল গুপ্ত যখন হাওড়া স্টেশানে এল, তখন রাত সাড়ে দশটা। রূপমরা উনিশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার জন্য নতুন বিল্ডিং এ ঢুকল।
ঢোকার মুখেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ধাক্কা লাগলো রূপমের। দোষটা অবশ্য তারই বেশি। সে আইআরসিটিসির খাবার স্টলটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে চলছিল। কত রকম যে খাবার বিক্রি হচ্ছে সেখানে! এখানেই তো দিব্যি রাতের খাবার খেতে পারতো তারা! কিন্তু, না। মা কিছুতেই শুনল না। বেরনোর আগে, "রাতের খাবার খেয়ে যা"---- বলে, জোর করে গোবদা গোবদা তিনটে রুটি আর গাদা খানেক বিশ্রি খেতে তরকারি খাইয়ে দিল। ইশ! বড় আফসোশ হল রূপমের। স্টলটাতে চিকেনেরও অনেক রকম প্রিপারেশান আছে। রূপম হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তেই, তার গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের মনে হয় খুব তাড়া। তাঁর হাতে একটা বেশ বড় আকারের ভিআইপির সুটকেস আর জলের বোতল। এই ধরনের বাক্সের মতো দেখতে সুটকেস এখন আর কেউ নেয় না। এখন ভিআইপির অনেক সুন্দর সুন্দর মডেলের ব্যাগ পাওয়া যায়, তবে বাবা বলেন, নিরাপত্তার দিক থেকে এমন শক্ত বাক্সই বেশি ভালো। উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক অনেকবার দুঃখ প্রকাশ করলেন। রূপমের দিকে কটমট করে চেয়ে, রূপমের বাবা বললেন,
“দোষটা কিন্তু ওরই। যেতে যেতে পথের মাঝখানে হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে চলছিল। ওই যে, সামনে খাবারের দোকানটা দেখেছে তো তাই। ওর আবার বাইরের খাবারের দিকে খুব ঝোঁক”। রূপম দেখল, ভদ্রলোকের পেছন থেকে একটা বাচ্চা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হিহি করে হাসছে। তার বড় রাগ হল। বাবাটা যেন কী! লোকটা বলল,
''তা নয়, ওরও দোষ নেই, আমিও তো দেখিনি। আরে এখন তো এমন হবেই। ওর এখন অল্প বয়স! আমার মেয়েও হোটেলের খাবার পেলে আর কিচ্ছু চায় না।'' কথা শেষ করে ভদ্রলোক দরাজ হাসলেন। তারপর মেয়েকে নিয়ে ওই খাবার দোকানেই ঢুকে গেলেন, রাতের ডিনার সারতে। রূপম গোল গোল চোখে তাকিয়ে দেখল।
ট্রেন বারোটা দশে স্টেশানে আসার আগেই ভদ্রলোকটির সঙ্গে বেশ আলাপ জমে গেল বাবার। রূপমরা দোতলার ওয়েটিং রুমে এসে বসেছিল, এখন অনেকটা সময় তাদের অপেক্ষা করতে হবে। এমন সময় ভদ্রলোক তাঁর মেয়েকে নিয়ে সেখানে এসে বসলেন। জানা গেল তাঁরাও যাচ্ছেন আপ ক্রিয়াযোগ এক্সপ্রসে। লোকটির নাম বীরেন মজুমদার। যাবেন ঝাড়খণ্ডের মুরি স্টেশান। রূপমরা রাঁচি যাবে। তার আগেই পথে পড়বে মুরি স্টেশান। মেয়ের পরীক্ষা হয়ে গেছে, তাই মেয়েকে নিয়ে উনি বেড়াতে যাচ্ছেন। পুরুলিয়া আর রাঁচি তাদের গন্তব্য। মুরি থেকে পুরুলিয়ার গ্রামগুলোতে সহজে ঢোকা যায় বলে, নেট থেকে হোটেল-এর ঘর বুকিং করেছেন। ঘর অবশ্য সহজেই পাওয়া যায় ওখানে।
মেয়েটার নাম বিন্তি। ও ক্লাশ ফাইভে পড়ে। রূপমের বোনের বয়সী। তাদেরও আশ্চর্যভাবে একই কামরায় বার্থ পড়েছে। ট্রেন আসতে ওরা সবাই ট্রেনে উঠে পড়ল।
এসি ফার্স্টক্লাশ কোচ। বাবা বীরেনবাবুর সঙ্গে গল্প শুরু করেছেন। তবে লোকটাকে রূপমের একটু সন্দেহ হচ্ছে। রূপম ছোট থেকেই গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে একেবারে চৌখশ হয়ে উঠেছে। তার বীরেন মজুমদারকে সন্দেহের কারণ, উনি কী করেন,পরিষ্কার করে বলছেন না একবারও। ওঁর সঙ্গে যে সুটকেসটা আছে, সেটা নিয়েও কেমন যেন একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। অতবড় জিনিসটাকে সঙ্গে নিয়ে বাথরুমে পর্যন্ত চলে গেলেন। ঘর থেকেই প্যানেলের আলো দেখে বাথরুম অকুপাইড কিনা বোঝা যায়। কারণ তখন ডিসপ্লে বোর্ডে লাল আলো জ্বলে। সবুজ আলো জ্বললে, তবেই ওয়াশরুমে যাওয়া দস্তুর। অথচ লোকটা লাল আলো জ্বলছে দেখেও, তার বিরাট বাক্সটা নিয়েই ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলেন। সবটাই রূপমের কেমন অদ্ভুত লেগেছে।সেও কিছুক্ষণ পরে, একবার ওয়াশরুম থেকে ঘুরে এসে, নিজের বার্থের বিছানায় গুছিয়ে বসল। বসতেই বাবা বললেন,
''জানিস! আমরা এবারে মুরি স্টেশানেই নামছি। রাঁচি দিন কয়েক পরেই না হয় যাব। তাছাড়া তুইও বারবার পুরুলিয়া যেতে চাইছিলি। কী বলিস? ভালো হবে না?'' বাবা রূপমের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। রূপম হাঁ করে চেয়ে থাকে। এমনটা যে বাবা বলতে পারে, সে ভাবতেই পারছে না। কে না কে, একজন একবার কোন অজ পাড়াগাঁতে যাবে, সেটা শুনে বাবা এমন হঠাৎ করে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টাচ্ছেন! রূপম অস্বস্তিভরা গলায় বলল,
''কিন্তু মুরিতে আমরা গিয়ে থাকব কোথায়? আমাদের তো কোনও হোটেলের বুকিংই নেই!'' বীরেনবাবু পাশ থেকে বললেন,
''ওখানে তো গ্রাম। ওদিকে অত ভীড় হয় না। বুকিং সব সময় পাওয়া যায়। তাছাড়া আমার একজন অফিসের সহকর্মীর জন্য আমার পাশের ঘরটা বুক করেছিলাম। তিনি হঠাৎই শুনলাম আসতে পারবেন না। ওই ঘরটা পাওয়া যাবে। তোমার বাবাকে বলেছি সে কথা। শুনে উনি যেতে রাজি হলেন। জায়গাটা ভালো লাগবে। ওখান থেকে মুরগুমা ড্যাম একদম কাছে। কাছাকাছি কয়েকটা আদিবাসীদের গ্রামও আছে। চিতোরপুর ও বেগুনকোদর গ্রামের নাম শুনেছ? নিয়ে যাব তোমাদের। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে যেতে পারবে। দেখবে, ওখানকার মানুষের জীবন কতটা কঠিন। তাছাড়া একটু ফাঁকা জায়গা, তাই শহরের মানুষের ভালো লাগে।''
রূপম চুপ করে থাকে। তার যেতে আপত্তি নেই। তবে সন্দেহ হচ্ছে লোকটাকে। বাবারও কী তাই? রূপমের বাবা সিআইডি ইন্সপেক্টর। ভবানী ভবনে বাবার অফিস, তবে নানা কাজে চরকির মতো চারদিকে ঘুরতে হয় বাবাকে। ডিপার্টমেন্টে বাবার খুব সুনাম। বাবাও নিশ্চয় কিছু অস্বাভাবিক দেখেছেন। বিছানায় আপার বার্থে রূপম আর লোয়ারে বাবা। উল্টো দিকের সিটে উপরে বীরেনবাবু ও নিচে তার মেয়ে। দরজা বন্ধ করা হয়েছে। ট্রেন স্বাভাবিক সময়ে ছাড়লে সকাল চারটের সময় মুরি স্টেশানে ঢুকত। এখন হয়ত সকাল ছটা সাতটা পার হয়ে যাবে। রূপমের কাছে, বাবার হাত ব্যাগটা আছে। সে নিজের দামী মোবাইলটা সাবধানে ওখানে তুলে রাখতে গিয়ে,ওদের টিকিটের প্রিন্ট আউটটা হাতে পেল। অবাক হয়ে রূপম দেখল, তাদের টিকিট হাওড়া টু মুরিই করা হয়েছে, রাঁচি নয়!
বিস্মিত রূপমের রাতে ভালো ঘুম হল না। অন্ধকার কোন এক অজানা স্টেশান আসতে, সে আবছা আলোয় দেখলো উল্টোদিকের আপার বার্থে বসে বীরেনবাবু তাঁর সুটকেসটা খুলেছেন। সে মাথাটা তুলে দেখতে পেল, সুটকেসে একটা অত্যাধুনিক রিভলভার রাখা আছে! যতদূর মনে হয় বিদেশি রিভলভার। কালশনিকভ নয়, ওটা সে ছবিতে দেখেছে, আকারে বেশ বড় হয়, তবে ভদ্রলোকের রিভলভারটাও আকারে যথেষ্ট বড় এবং সম্ভবত বেশ ভারি।
ভোরের নরম আলো মেখে ট্রেন মুরি স্টেশানে এসে দাঁড়াল। বীরেনবাবু আগেই গাড়ি ঠিক করে রেখেছেন। সেই নম্বরে ফোন করে ড্রাইভারকে স্টেশানে দাঁড়াতে বললেন। ওভারব্রীজ পেরিয়ে তারা স্টেশান থেকে রাস্তায় এল। গাড়ির চালক এগিয়ে এসে পরিচয় দিল। লোকটার নাম তপন মাহাতো। গাড়ি চলতে শুরু করল। দূরে সামান্য ঢেউ খেলানো পার্বত্য উপত্যকা চোখে পড়ছে। গ্রাম্য হাট পেরিয়ে গাড়ি একটা সরু নদীর উপর একটা সাঁকো পেরিয়ে গেল। তপনবাবু বললেন, এই নদীটা হলো সুবর্ণরেখার একটা শাখা নদী। এই সাঁকোর এপারটা পুরুলিয়ার মধ্যে পড়ে। ওপারটা ঝাড়খণ্ড। এটা হলো বর্ডার এলাকা। একদিকে বাংলা আর একদিকে ঝাড়খণ্ড। আপনাদের হোটেল সোনালীযেখানে আছে,সেই জায়গাটার নাম তুলিন। স্টেশান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে। ওটা অবশ্য পুরুলিয়ার মধ্যেই পড়ে।
গাড়ি হোটেল সোনালীর গেটের বাইরে এসে থামল। মামুলি একটা হোটেল। কোনো সাজসজ্জা নেই। একদম পিচ ঢালা রাস্তার গায়ে। এই রাস্তা সোজা বরাকর ও রাঁচির দিকে যাচ্ছে। নিচের তলায় অফিস ও একটা রেস্টুরেন্ট আছে। রেস্টুরেন্ট বহুদিন বন্ধ আছে। দিনের ও রাতের খাবার উল্টোদিকের ধাবাতে করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনও উপায়ও নেই। চারিদিক একেবারে শুনশান। একটা দোকান পর্যন্ত কাছাকাছি নেই।
সকালের ব্রেকফাস্ট খেয়ে একবারে উঠবে বলে, ওরা ধাবাতেই এসে বসল সবাই। ধাবাটাও একেবারে সাধাসিধা। ভেতরে কয়েকটা ঘর আছে। বাইরে একপাশে রান্নাঘর। তারই একপাশে চেয়ার পেতে খাবার ব্যবস্থা। কিছু চেয়ার রাস্তার গা বরাবর উঠোনে ছড়ান। শীতের রোদে পিঠ দিয়ে, সেই চেয়ারগুলোতেই ওরা বসে পড়ল। তাদের মাঝখানে একটা প্লাস্টিকের টেবিল দিয়ে গেল। গরম রুটির সঙ্গে কপি, গাজর, বিন, ছোট ছোট করে কাটা পনির আর ধনেপাতা দিয়ে একটা পাঁচমেশালি তরকারি সঙ্গে শশা আর মূলো দিয়ে স্যালাড। সবশেষে সঙ্গে এল এলাচ আর আদা দিয়ে ঘন দুধের চা। বেশ তৃপ্তি করে খাওয়া শেষ করল সবাই।
রূপমদের ঘরটা বীরেনবাবুদের ঘরের ঠিক উল্টোদিকে। তাদেরটা চারশো সাত, আর বীরেনবাবুদের চারশো আট। ঘরের সামনে অনেকটা খোলা আর বড় করিডর। করিডরে সিসিটিভি বসান আছে। রুম দুটোতেই এসি। ঘরে টিভি নেই। রূপমের তাতে অবশ্য অসুবিধা নেই, সে টিভি দেখতে পছন্দ করে না। গোয়েন্দা রহস্যের দুটো বই তার সঙ্গেই আছে। দুটো ঘরেই বেশ বড় বড় কাঁচের জানলা আছে। পর্দা সরাতে দেখা গেল, দূরে চাষের খেত। বাবা বললেন, সেখানে খেসারী বুনেছে কেউ। খেসারির বেগুনি রঙের ছোট ছোট ফুলে খেত ভরে আছে। হোটেলের বাউন্ডারি ওয়াল বেশ দূরে। মাঝখানে আছে কিছু বড় বড় গাছ। একটা সজনে গাছও চোখে পড়ল, তার ডালে অজস্র সাদা-কালো শালিক বসে কর্কশ স্বরে ঝগড়া করছে। একটা জাম আর দেবদারু গাছও আছে।
রূপম জানলা খুলে দিল। জানলা খুলতেই হঠাৎ একটা বিশ্রী পচা গন্ধ ধাক্কা মারল ওর নাকে। কীসের গন্ধ প্রথমটা বুঝতে পারল না, রূপম। তারপর চোখে পড়ল, সজনে গাছের নিচে, একটা বিশাল বড় পাথরের চৌবাচ্চা। সেটা আবর্জনাতে যেন উপচে পড়ছে। মনে হয় এখানে ময়লা নিতে মিউনিসিপ্যালিটির কোনও গাড়ি আসে না। হোটেল থেকে তাই এই নিজস্ব ব্যবস্থা করা হয়েছে, কিংবা হোটেল নিজস্ব গ্রীন ম্যানিওর তৈরি করছে।
কিন্তু এই ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধে তো একদম থাকা যাবে না! রূপম তাকিয়ে বাবাকে দেখতে পেল না। বেরিয়ে এসে দেখল, বাবা বীরেনবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। রূপম নিচের অফিসে গিয়ে অভিযোগ জানাতে, হোটেল থেকে একজন এসে, তাকে একটা রুম ফ্রেশনার দিয়ে চলে গেল। বলল, জানলাটা বন্ধ করেই থাকতে হবে। তবুও বাথরুমের স্কাইলাইট থেকে বিচ্ছিরি পচা গন্ধটা ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছিল। বাবা যে কেন এখানেই থাকতে চাইছেন, বুঝতে পারছে না রূপম। অথচ বাবা বেড়াতে এলে, হোটেলের ঘর নিয়ে এতটুকু কোনও অসুবিধা হলে, তুমুল ঝামেলা করেন প্রত্যেকবার।
একটু পরে রেডি হয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ল ওরা। বাবা কোথাও এলেই, প্রথমে ওখানকার থানায় যোগাযোগ করেন। কাছাকাছি কোটশিলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র আর কোটশিলা থানা। বাবা একবার ওখানে যাবেন বলতে, বীরেনবাবু বললেন,
''আপনি তাহলে যান, আমি একবার ততক্ষণে তাহলে বেগুনকোদরটা ঘুরে আসি। গুপ্তদা আসতে আসতে, ওটা আমাদের কভার হয়ে যাবে। তারপর রূপমের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাবে নাকি? ভূত দেখতে?'' রূপম অবাক হয়ে বলল,
''ভূত?''
''হ্যাঁ ভূত। ওখানে শুনেছি বিকেলের পর ভূতের দেখা পাওয়া যায়। ভূতের হাসিও শোনা যায়, হঠাৎ চোখের সামনে নাকি মানুষ অদৃশ্য হয়, এইসব নানারকম হয়। এই নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় কয়েকটা পোস্টও দেখেছিলাম। সত্যি মিথ্যে জানি না। যাবে?'' রূপম হাসল। বলল,
''চলুন, দেখে আসি। তবে এখন তো সকাল! এখন কি ভূত আসবে?'' তপনবাবু গাড়ি ঘুরিয়ে একটু পথ এগিয়ে গেল। এক থেকে দেড় কিলোমিটার পথ। একটা ফাঁকা মাঠের ভেতর রেল স্টেশান। বাঁধানো প্ল্যাটফর্মও নেই। একটা টিনের বোর্ডে লেখা আছে বেগুনকোদর। এখান থেকে আদ্রাগামী লোকাল কিছু ট্রেন যায়। দিনের ঝকঝকে আলোয় ভূতের ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হল, রূপমের। গম্ভীর গলায় বীরেনবাবু বললেন,
''ভূতের গল্প ছড়িয়ে পড়লে এক শ্রেণীর মানুষের সুবিধা হয়। জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছে, এ সব গল্প কিছু দুষ্টু লোকজন ছড়িয়েছে। যাতে নির্বিঘ্নে তারা তাদের অসাধু কাজগুলো করতে পারে।''
''কী ধরনের কাজ?''
''অপরাধমূলক কাজ নিশ্চয়। আমি সঠিক জানি না। তবে, অনুমান করছি। তোমরা একটু দাঁড়াও, আমি সামনের ওই দোকানে একটু কথা বলে আসছি।” রূপমদের দাঁড় করিয়ে বীরেন মজুমদার সামনের একটা ছোট গুমটি দোকানে গেলেন, কথা বলতে। রূপমের কৌতূহল হচ্ছিল। সে মোবাইলের ক্যামেরায় ফটো তুলতে তুলতে একটু এগিয়ে গেল। তার চোখে পড়ল বীরেনবাবুর হাতে কয়েকটা প্যাকেট। অনেকটা পাউডারের মতো দেখতে কিছু সাদা গুঁড়োর প্যাকেট তিনি দোকানদারকে দিচ্ছেন। দোকানদার বীরেনবাবুর কাছ থেকে প্যাকেটগুলো নিয়ে একটা চালের বস্তার মধ্যে রেখে দিল। বীরেনবাবু পিছন ফেরার আগেই রূপম অন্যদিকে ঘুরে ছবি তুলতে লাগল। সে এরইমধ্যে সাদাগুঁড়োর প্যাকেট হাতে বীরেনবাবুর কয়েকটা ফটো তুলে নিয়েছে তার ফোনে।
গাড়িতে উঠে বসেই, বীরেনবাবু রূপমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ''কী কী ছবি তুলেছ, আমাদের দেখাবে না?''
রূপম চমকে উঠল। পরক্ষণেই সে ওভারস্মার্ট।
''দেখাব। বাবা আসুক, দুজনকে একসঙ্গে।'' রূপমের মুখে হালকা হাসির রেশ।
গাড়ি নিয়ে আবার থানার সামনে আসার আগেই, বাবাকে রাস্তার উপর দেখতে পেল রূপম। বাবা ওঠার আগেই বীরেনবাবু একটা পান দোকানে নেমে পান কিনছিলেন। রূপম দেখতে পেল, ভদ্রলোক দোকানে ঢুকে একটা মোটা নোটের গোছা রাখলেন, পান মশলার বয়ামগুলোর উপরে। কম করে, হাজার তিরিশেক টাকা মনে হয়। ভদ্রলোকের এত টাকা এখানে এখন দেওয়ার অর্থ কী? রূপম গাড়িতে বসেই মোবাইলে পটাপট ছবি তুলে নিল। যদিও এত দূর থেকে ছবি পরিষ্কার হবে না। তবে খানিকটা বোঝা যাবে। বীরেনবাবুও তাকে সন্দেহ করছেন, যে সে ওঁর ছবি তুলেছে। রূপম ছবিগুলো মোবাইল থেকে তার বাবাকে চটপট মেইল করে দিল, তারপর বীরেনবাবুর যে ছবিগুলো তুলেছিল সেগুলো সব মুছে দিল ফোন থেকে। মুরগুমা ড্যাম আসার আগে, বীরেনবাবু রূপমের মোবাইলটা একবার দেখতে চাইলেন। রূপম ফোনটা এবার নিশ্চিন্তে দিয়ে দিল। সে আগেই ব্যবস্থা নিয়েছে। তার সেন্ট মেইলবক্স কি আর চেক করবেন! সুতরাং ভয় নেই।
এখন রূপমরা একটা গ্রামের ভেতর এসে ঢুকেছে। চারদিক ধূ ধূ করছে। রোদের তাপে শুকনো বালি উড়ছে। দূরে দূরে কেবল কয়েকটা তাল গাছের সারি। মেঠো রাস্তায় ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। চিতোরপুর গ্রামে বীরেনবাবু কী দেখতে ঢুকছেন? রূপম বুঝতে পারছে না। রুখু সুখু একটা গ্রাম। মানুষজন বেশিরভাগই কুরমালি ভাষায় কথা বলে। যানবাহন নেই। এটা মূলত আদিবাসীদের একটা গ্রাম। বেলা হয়েছে অনেক। রোদে চারদিক যেন পুড়ে যাচ্ছে। বীরেনবাবু কয়েকজনের বাড়ি গেলেন। কী সব কথা সারলেন। বিন্তি গাড়িতে বসে বসে ঢুলছে। তারাও গাড়িতেই থাকল। এত রোদে আর ঘোরাঘুরি করতে ভালোলাগছে না। রূপম বাবাকে ইশারায় প্রশ্ন করল কী ব্যাপার? বাবা একদম চুপচাপ। বাবাও কি কিছু সন্দেহ করছেন? তাই কি পিছু নিয়েছেন লোকটার? একটু পরে বীরেনবাবু ফিরে এলেন। তার হাতে একটা ঝোলা ব্যাগ। ব্যাগের মুখটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। রূপম কৌতূহলী হল। তবে ভেতরে কী আছে কিছু দেখা যাচ্ছে না। গাড়ি আবার হোটেলের দিকে চলতে শুরু করল।
বিকেলে এখানে কিছু কাজ নেই। রূপম এতক্ষণে নিশ্চিত তার বাবা কিছু একটা বুঝতে পেরেছেন। তবে খুলে কিছু বলছেন না। একটু আগে কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন। রূপম ঘরে তালা লাগিয়ে, বাইরে এসে দাঁড়াল। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ধাবার দিকে। তার কাছে টাকা আছে, খিদেও পেয়েছে। কিছু খাওয়া দরকার। ধাবার সামনেটা একেবারে ফাঁকা। রূপম একটা চেয়ার টেনে বসতেই, দেখতে পেল বিন্তিকে। ভেতরে বসে আছে এবং বিন্তি একা। রূপম অবাক হয়ে গেল। বিন্তি এখানে একা একা কী করছে? সে ভেতরে গিয়ে দেখলো, বিন্তি একটা প্লেটে চাউমিন নিয়ে খাচ্ছে।
''তোমার বাবা কোথায়?'' বলল রূপম।
''ঘরে শুয়ে আছেন। শরীর খুব খারাপ।''
''কী হয়েছে?''
''ঠান্ডা লেগেছে। জ্বর। তুমি চাউমিন খাবে?'' রূপম হাসল বলল,
''না এখন খাব না।'' যদিও তার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। সে বীরেনবাবুর অসুস্থ হওয়ার কথা বিশ্বাস করছে না। রূপমের কেমন অস্বাভাবিক লাগছে ব্যাপারটা। এক্ষুণি এক্ষুণি সুস্থ মানুষের একেবারে জ্বর চলে এল! সে ভাবল এক ছুটে উপরে গিয়ে দেখে নেবে, সত্যিই বীরেনবাবু ওখানে আছেন কিনা। কথাটা মনে হতেই রূপম উঠে দাঁড়াল। তারপর এক দৌড়ে উপরে উঠে এল। বীরেনবাবুর ঘরের দরজা খোলা। ঘরে বীরেনবাবু নেই, তার পরিবর্তে দুজন হোটেলের লোককে ঘরের ভেতর দেখতে পেল সে। রূপম নিঃশব্দে উঠে এসেছিল। লোকদুটো এতটুকু টের পায়নি। সে দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিল লোক দুটো সারা ঘরে তন্ন তন্ন করে কী যেন খুঁজে চলেছে। রূপম সামনে আসতেই লোকদুটো তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার কাছে চলে এল।
''এখানে কী করছিলেনআপনারা?''
''ঘরটা ক্লীন করছিলাম।''
''পাশেরটা, মানে আমাদের রুম ক্লীন করা হয়ে গেছে?''
''না এরপর হবে।''
''আপনার হাতে কী ওটা?''
“এই ঘরের বেডশীটটা পাল্টে দিলাম। আগেরটা নিয়ে যাচ্ছি।” রূপমের মনে হল, লোকটা কী যেন লুকাচ্ছে, বেডশীটের মধ্যে। সে লোকটাকে খুঁটিয়ে দেখে নিল একবার। লোকটা সামান্য পা টেনে হাঁটে। গায়ের রঙ কালো। দাঁতে গুটখার কালো কালো দাগ।চোখের দৃষ্টি বাঁকা। মানে লোকটা সামান্য ট্যারা। সে বলল,
''বেডশীটটা আমাকে দিন। ওটা পাল্টাতে হবে না। আমাদের সবে একবেলা হয়েছে এখানে।''
''স্যার পাল্টাতে বলেছিলেন। চাদরে চা পড়েছিল।''
''তাই? একটু দাঁড়ান। ওঁকে জিজ্ঞাসা করছি।''পাশের লোকটা চড়া গলায় বললো,
''অ্যাই দিয়ে দে। কাউকে ফোন করতে হবে না।'' রূপমের হাতে চাদরের পুঁটলিটা ধরিয়ে লোক দুটো সিঁড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি নেমে গেল। রূপম দলা পাকানো চাদরটা নাড়া দিতেই একটা ফটো লাগানো আইকার্ড পড়ে গেল মাটিতে। মাটি থেকে কার্ডটা তুলে সে দেখল, কার্ডটা সিবিআই অফিসার বীরেন মজুমদারের নামে। যিনি দিল্লীতে পোস্টেড। বাড়ি দিল্লির করোলবাগে।
রূপম ভাবতে লাগল, তবে কী বীরেনবাবু একজন সিবিআই অফিসার? বাবা জানেন কী? হোটেলের লোকজন হঠাৎ এখানে তার আইকার্ড চুরি করতে কেন এসেছিল? তার একটা বিষয়ে খটকা লাগছে তবুও। সেটা হল, ছবিটাতে বীরেনবাবুর মুখে মোটা গোঁফ আছে কিন্তু এই বীরেনবাবুর গোঁফ নেই। মুখটাও একটু অন্যরকম, একটু লম্বাটে ধরনের। আইকার্ডটা কি তবে জাল? এই বীরেনবাবু আসলে কে? পুলিশের লোক? নাকি কোনও বড় অপরাধী? যাইহোক না কেন, লোকটা গেল কোথায়? ওঁর মেয়ে মিথ্যে বলল কেন? বাবাও বা কোথায় গেলেন?
হঠাৎ নিচে অনেক লোকের একসঙ্গে ছোটাছুটি ও চিৎকার শুনতে পেল রূপম। সেইসঙ্গে পটকা ফাটার মতো আওয়াজ। এরপর দুম দুম করে দুটো বোমা পড়ার শব্দ। মুহূর্তে নিচটা ধোঁয়ায় ভরে গেল। নিচে নেমে একটুদূর থেকে রূপম দেখতে পেল, প্রায় পাঁচখানা পুলিশের গাড়ি নিচে হোটেলের বন্ধ রেস্টুরেন্টটাকে ঘিরে আছে। অগুনতি পুলিশ এসেছে। পুরো জায়গাটা পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। রূপম পুলিশদের মধ্যে সাদা পোশাক পরা তার বাবাকে দেখতে পেল। বাবা রূপমকে দেখতে পেয়েই বললেন,
''আগে বিন্তিকে নিয়ে এখনই আমাদের ঘরে গিয়ে বোস। এখানে পুলিশের গুলিতে দুজন ড্রাগ পাচারকারী মারা গেছেন।''
''কোথায়?''
''হোটেলের সামনের বন্ধ রেস্টুরেন্টের ভেতরে।''
''ওরা ওখানে কী করছিল বাবা?''
''তোর এতকিছু বুঝতে হবে না। ওখানে প্রচুর পরিমাণে নিষিদ্ধ হাসিস উদ্ধার হয়েছে। যার দাম বাজারে এখন প্রায় এক কোটি টাকা। একটু পরেই টিভিতে খবরে সব দেখাবে। এখানে মিডিয়াও চলে এসেছে। বিন্তিকে এতক্ষণ আমাদের গাড়িতে বসিয়ে রেখেছিলাম। ওকে নিয়ে তুই উপরে চলে যা। তুই বীরেনবাবুকে দেখেছিস?''
''না তো?''
''আচ্ছা, ঠিক আছে।''
বিন্তিকে নিয়ে উপরে তাদের চারশো সাত রুমে বসে আছে রূপম। তার ভেতরটা কৌতূহলে ফেটে যাচ্ছে। সে কি বাচ্চা নাকি বিন্তির মতো? তাকে স্পট থেকে একদম বাচ্চাদের মতো সরিয়ে দেওয়া হল! 'ড্রাগের নেশা সর্বনাশা' এই নামে সে রচনা পড়েছে স্কুলে। নার্কোটিভ কিছু প্ল্যান্টের নাম ও ছবি দিয়ে আইএসসি পরীক্ষার প্রজেক্ট করতে সে ক্লাশ টুয়েলভের দাদাদের দেখেছে। ছবিগুলো যখন নেট থেকে ডাউনলোড করছিল, তখন অর্কদার সঙ্গে ওই দোকানে রূপমও ছিল। ওরা এক ক্লাবে ফুটবল খেলে।
কিন্তু হাসিস কী জিনিষ? অবশ্য সেটাও সে এক মিনিটে গুগল সার্চ করে জেনে নিতে পারবে। তার কাছে স্মার্ট ফোন আছে। রূপম ফোন নিয়ে অযথা ঘাঁটাঘাঁটি করে না। সে লেখাপড়ায় ভালো। তার কেবল গোয়েন্দা গল্পের বই পড়ার নেশা। মোবাইলের নেশা নেই। মোবাইল ফোনে সে কেবল দরকারি কাজ করে। এই যেমন, এখন সে ইউকিপিডিয়া খুলে দেখল,
শন বা হেম্প গাছের ট্রাইকোম বা আঠালো রোম শুকিয়ে গুঁড়ো করে তৈরী হয় মারিজুয়ানা। তার সঙ্গে তামাক ও অন্যান্য কয়েকটি জিনিস মিশিয়ে তাকে মেশিনে চাপ দিয়ে জমাট করে টুকরো বা বড়ির আকারে নিয়ে আসা হয়। একে বলে হাসিস। এটি নার্ভের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি সাইকোঅ্যাকটিভ ড্রাগ। সমস্ত বিশ্বে এইজন্য ক্যানাবিস বা শন গাছের চাষ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এর ব্যবহার নার্ভ ও মস্তিষ্কের বিশেষ ক্ষতি করে এবং তৈরী করে ড্রাগের প্রতি আসক্তি। ক্ষতিকর রাসায়নিকের নাম টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল বা সংক্ষেপে টিএইচসি। ভারতে হাসিস উৎপাদন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এবং এখানে শন উৎপাদনও করা হয় না। হাসিস মূলতঃ বিদেশ থেকে উদ্দেশ্যোপ্রণোদিত ভাবে আমদানী করেন কিছু অসাধু মানুষ। তারপর নানা হাত ঘুরে তা এসে পৌঁছায় ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরে এলেন বীরেনবাবু ও রূপমের বাবা পরিমল গুপ্ত। বিস্মিত রূপমের দিকে তাকিয়ে, হাসলেন বীরেন মজুমদার।
''কী! খুব গোয়েন্দা গল্প পড়া হয় বুঝি? শেষ পর্যন্ত আমাকেই অপরাধী প্রমাণ করে দিতে দেখছি তুমি! তোমার মতো এমন ছেলে আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টে এলে অনেক উপকার হবে।'' রূপমের বাবাও হেসে উঠলেন। বললেন,
''আপনি আপনার পুরনো আইকার্ড দেখিয়ে আমার মনেও সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম যখন আমাকে হাওড়াতে আপনার আইকার্ডটা দেখিয়েছিলেন, তখনই দেখেছিলাম, ছবিটার সঙ্গে আপনার মুখের মিল নেই তেমন। আপনার আইকার্ডটা আপনার ঘর থেকে হোটেলের লোকদের সরাতে বলেছিলাম, একটু ভালো করে দেখব বলে। হোটেলের দুজন কর্মীকে আমিই আপনার ঘরে পাঠিয়েছিলাম। এদিকে ওখানে, মানে আপনার ঘরে চুপিচুপি ঢুকেও রূপমের জ্বালায় ওরা কাজটা হাসিল করতে পারেনি। তারপর আপনাকে দুপুর থেকে কোথাও খুঁজেও পাচ্ছিলাম না। মনে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। তবে আজ আপনি যা করলেন, একেবারে রুদ্ধশ্বাস সিনেমাকেও হার মানায়।'' বীরেনবাবু হাসতে হাসতে বললেন,
''রূপমবাবু আমাকে ড্রাগ পাচারকারী ভেবে, প্রমাণ রাখতে মোবাইলে ছবিও তুলে রেখেছিল। তারপর আমি দেখতে চাওয়ায়, ছবিটা ডিলিট করে দিয়েছিল। আমার মনে হয়, ছবিটা ও আপনাকেই কোনওভাবে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমি আজ আসলে মাছ ধরতে টোপ ফেলেছিলাম। তাই অপরাধীরা এসে ধরা দিল।'' তারপর রূপমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
''তুমি আমাকে যে সাদা গুঁড়ো দোকানদারকে দিতে দেখেছিলে, ওটা বডি পাউডার, কোনো ড্রাগ নয়। পানের দোকানে ইচ্ছা করে টাকার গোছা রেখে কথা বলছিলাম, এইটা বোঝাতে যে, আমার কাছে প্রচুর টাকা আছে। দোকানদারকে বলেছিলাম বন্দুক কিনতে চাই। আমার কাছে কিছু সোর্সের মাধ্যমে খবর ছিল, ওই লোকটা বেআইনি অস্ত্রের কারবার করে। গরীব গ্রামের মানুষকে লোভের টোপে গাঁথা সহজ। যাইহোক, সেইজন্য চিতোরপুর থেকে কম দামে কিছু অস্ত্রও কিনেছিলাম। যাতে আমাকে ওরা একজন অপরাধী ভাবে, সন্দেহ না করে। তুমি আমার হাতে একটা মুখ বন্ধ ব্যাগ দেখেছিলে না?
এদিকে, বেগুনকোদরে আমি জাল মাল ড্রাগ হিসাবে দিয়ে এসেছিলাম। এজেন্টের মাধ্যমে সেই খবর আখতারের কাছে চলে এসেছিল। আমার প্রধান উদ্দেশ্য হলো আখতারকে ধরা। আমি নিশ্চিত জানি আখতার এই অঞ্চলে থেকেই এখন ওর কারবার চালাচ্ছে। বেগুনকোদরে ভূতের ভয়ের গল্প ছড়িয়ে ড্রাগ পাচার করা হচ্ছে বলে, দিল্লীতে গোপনসূত্রের খবর ছিল। স্টেশানের টিকিট কাউন্টারের কাছের দোকানটাই নাকি মেইন স্পট। কিন্তু কারা ড্রাগ নেওয়া আনা করে, কারা সাপ্লায়ার এবং এইসবে যুক্ত তাদের ধরতে চেয়েছিলাম। হল না। লোকগুলো দুজনই সুইসাইড করল। আমার মনে হয়, হাসিস পাচারে আরও অনেক বড় বড় চক্র জড়িত। এমনকী বিদেশী শত্রুদেরও হাত থাকতে পারে। দেশের যুব শক্তি নষ্ট হলেই ওদের সুবিধা। এখনও কাজ সম্পূর্ণ হয়নি, কারণ আসল অপরাধী এখনও ধরা পড়েনি। তাকে ধরতেই এখানে এসেছিলাম। আখতারের একটা গল্প আছে। সব বলব তোমাকে, আগে একটু চা বল, একবার ফোন করে দেখ। সারাদিন কারুর কিছু খাওয়া হয়নি। চা আর দু প্লেট করে পনির পকোড়া বলে দাও, সবার জন্য।''
সোনালী হোটেলে ফোন করে খাবার অর্ডার করা যায় না। কিছুক্ষণ আগে রেস্টুরেন্টে পুলিশের ঝামেলা হয়ে গেছে, অবশ্য রেস্টুরেন্টে খাবারও পাওয়া যায় না। ওটা বন্ধই থাকে। অনেকদিন ধরেই বন্ধ হয়ে আছে। রেস্টুরেন্ট যার, হোটেলের সঙ্গে একসময় পার্টনারশিপ ব্যবসা ছিল তার। তিনি এখন আর রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করেন না। সারা দেশের পুলিশ তাকে খুঁজছে। রেস্টুরেন্টের সেই মালিকের নামই আখতার।
পুলিশ বহু আগে থেকেই সব খবর জানতো। সেইমতো কলকাতা থেকে সিআইডি অফিসার পরিমল গুপ্ত অর্থাৎ রূপমের বাবা এসেছেন। তিনি এসেই লোকাল থানায় খবর দিয়েছেন। থানা থেকে ফোর্স এসে রেস্টুরেন্টের ভেতর জোর করে ঢুকতে চায়। ভেতরে আগে থেকেই কয়েকজন মানুষ ছিল। তারা বাধা দেয়। গুলি ছোঁড়ে। পাল্টা গুলি চালায় পুলিশও। তারপর সব হঠাৎ চুপচাপ। ভেতর থেকে একটু পরে তারা হঠাৎ দুটো তাজা বোমা ছুঁড়ে মারে পুলিশের গাড়ির দিকে। সতর্ক থাকায়, বিপদ ঘটেনি। এরপর পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্স রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে পড়ে। সেখানে দুজন আততায়ীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। পাওয়া যায় হাসিসের অনেকগুলো প্যাকেট। বীরেন মজুমদারকে দিল্লী থেকে পাঠানো হয়েছে। তিনিও তার সঙ্গে এই টিমে কাজ করবেন জানানো হয়েছিল পরিমলবাবুকে। খবরটা রূপমের বাবা পরিমলবাবু জানতেন অনেক আগে থেকেই, পুরো অভিযানটাতে চরম গোপনীয়তা বজায় রাখতে বলা হয়েছিল, কারণ আখতার অত্যন্ত চতুর। ছদ্মবেশ ধরতে পারে যখন তখন। অতিরিক্ত সতর্কতা সেইজন্যই বেশি করে নেওয়া। তাই পরিমলবাবু বাড়িতেও কাউকে, কোথায় যাচ্ছেন, তা জানাননি। তবে, বীরেনবাবুর ফটোটা দেখার পর থেকে পরিমলবাবুরও সন্দেহ হয়েছিল। কারণ ছবির সঙ্গে মুখের একদম মিল নেই। এখন তিনি আশ্বস্ত। পুলিশকে রেস্টুরেন্টের ভেতর পথ দেখিয়ে তিনিই নিয়ে গেছেন। টাস্কফোর্সের পুরোভাগেও তিনিই ছিলেন। যেভাবে তিনি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এরপরে আর সন্দেহের অবকাশ থাকেনা। তবুও সাবধানের মার নেই। পরিমলবাবু দিল্লী সিবিআই অফিসে একটা মেইল করে দিয়েছেন সব জানিয়ে, সঙ্গে একটা ফটো। বীরেনবাবুর ফটো, যেটা রূপম দোকানের সামনে বেগুনকোদরে তুলেছিল।
হোটেলের আবাসিকদের খাবার আসে ধাবা থেকে। ধাবাতেই ফোন করা হল। ওরা রাতের খাবারও রুমে পাঠিয়ে দেবে বলল। এখন একটু পরেই চা আর স্ন্যাকস পাঠিয়ে দিচ্ছে, জানাল।
চা আসতে, চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে বীরেনবাবু গল্প শুরু করলেন। তার আগে বললেন,
''আজ রাতের ডিনারটা আমি হোস্টিং করব। প্লিজ আপনি কোনও বাধা দেবেন না। ইটস্ ফর মাই প্লেজার।'' কথা শেষ করে দরাজ গলায় হেসে উঠলেন বীরেনবাবু।
তিনি কয়েকটা বিস্কুটও বের করলেন কৌটো থেকে। চায়ের সঙ্গে ভালো লাগবে বলে খোসামোদ করতে লাগলেন ওদের সবাইকে খাওয়ার জন্য। হোম-মেড কুকিস। রূপম একটা বিস্কুট সবে হাতে নিয়েছে খাবে বলে, সঙ্গে সঙ্গে বাবার ইশারায় বিস্কুটটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল সে। রূপম এবার ভালো করে খেয়াল করল, বীরেনবাবু আর তার মেয়ে যে বিস্কুটগুলো খাচ্ছেন, তার উপরের ছাপ তাদের যেগুলো অফার করছেন, তার থেকে সামান্য আলাদা। রূপম কৌটো খুলে সেই বিস্কুটও একটা সাবধানে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল।
গল্প শুরু হল। আখতারের গল্প। অনেক বছর আগের কথা। আখতারের বয়স তখন সাত। তাদের বাড়ি ঝাড়খণ্ডের রাঁচি বরাকর রোডের কাছে। তার বাবা বিভিন্ন প্রদেশে লরি নিয়ে ট্রান্সপোর্টের কাজে ঘুরতেন। তার বাবার ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা ছিল। আখতার তার মাকে খুব ভালোবাসত। হঠাৎ একদিন সামান্য জ্বরে ভুগে তার মা মারা গেলেন। বাবা একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে চোর বদনাম পেলেন। আখতারের বাবা সৎ এবং খুব পরিশ্রমী ছিলেন। সমাজ তার দাম দিল না তাঁকে। আখতারের বাবার চুরির দায়ে দশ বছরের জন্য জেল হয়ে গেল।
তখন থেকে আখতারের মনে সমাজের প্রতি চরম বিদ্বেষ জমা হল। সে কুসঙ্গে মিশতে শুরু করল। এরপর সে থাকত ভাগলপুরে তার মামাবাড়িতে। ক্লাশ টেনের পর পড়াশুনো ছেড়ে দিল সে। একটা সূত্রে হাজির হল কলকাতায়। কালীকৃষ্ণ টেগোর স্ট্রিটের একটা পরিবহন সংস্থার কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করল সে। ধীরে ধীরে সে অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে গেল পুরোমাত্রায়। তোলাবাজি, মারদাঙ্গা কোনওটাতেই তার আপত্তি নেই। তার সঙ্গে সবসময় থাকে গুলি ভর্তি পিস্তল। কথায় কথায় সে গুলি চালিয়ে দেয়। মানুষ তাকে যমের মতো ভয় পায়। বাবার সঙ্গে তার আর কোনও যোগাযোগ নেই। সে শুনেছে জেলেই তার বাবার মৃত্যু হয়েছে। এখন আখতার বেপরোয়া কারণ তার কোনও পিছুটান নেই।
কিছু বছর আগের কথা। কয়েক বছর জেল খেটে জামিনে তখন সদ্য মুক্তি পেয়েছে আখতার। তার আগের দল ভেঙে গেছে। নতুন করে দল তৈরী না করলে চলবে না আখতারের। সোলাঙ্কি নামের আর্মেনিয়ান স্ট্রিটের একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে এই সূত্রে আলাপ হল আখতারের। সোলাঙ্কির সঙ্গে তার সাকরেদ মুন্নার যাদবপুরের ফ্ল্যাটে মিটিং করে আখতার। সেদিনই সোলাঙ্কির কাছে টাকা চায় আখতার। না হলে প্রাণে মেরে ফেলবে বলে। টাকা না দেওয়ায় গুলি চালায় সে, তারপর মুন্নাকে নিয়ে পালায় সেখান থেকে।
হাসপাতালে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে সোলাঙ্কি। পুলিশে খবর দেয়। সোলাঙ্কির বাড়ি ছিল কলকাতার হেয়ার স্ট্রিট থানা এলাকায়। প্রাথমিক কেস ফাইল হয় ওখানে। ঘটনাস্থল যাদবপুর বলে কেস স্থানান্তরিত হয় যাদবপুরে। একাধিক থানার ওয়ান্টেড আখতার। ফেরার হওয়ার পর সে একবারও নিজের মোবাইল ব্যবহার করেনি। পুলিশের একাধিক টিম বারবার দেশের বিভিন্ন কোণে হানা দিয়েছে আখতারের খোঁজে। লাভ হয়নি। শেষ মুহূর্তে পুলিশের সামনে থেকে গায়েব হয়ে গেছে সে। এরমধ্যেই ধরা পড়েছে আখতারের সাকরেদ মুন্নাও কিন্তু আখতার ধরা পড়েনি এখনও।
সে ছদ্মবেশ ধরতে পারে অসামান্য। একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারে। অসম্ভব বুদ্ধিমান। পুলিশ খবর পেয়েছে সে ড্রাগ পাচারের একটা বড় চক্র গড়ে তুলেছে ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের বর্ডার এলাকায়। টিম এসেছে এবারও। জাল ফেলা হয়েছে। এখন দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়! এইজন্যই এবারে সোনালীর মতো অখ্যাত এক হোটেলে পড়ে আছি, আমরা। সবই আখতারকে ধরার জন্য।
পরিমলবাবু বললেন ''আরও কথা হল, আখতারের রক্তের গ্রুপ হলো এবি নেগেটিভ। রেয়ার ব্লাড গ্রুপ। সে জেলে থাকার সময়, পুলিশ এটা জানতে পেরেছিল। লোকটা বড় অদ্ভুত। অনেকবার সোর্স বিভিন্ন ফোন নম্বর দিয়েছে আমাদের, যখনই ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে, প্রতিবার লোকটা কী করে যেন টের পেয়ে যায়। আমার মনে হয়, অনুমান করার একধরনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে তার।''
গল্পের মধ্যেই রাতের খাবার চলে এল। রুটি, ধনেপাতা, টমেটো আর পালংশাক দিয়ে তড়কা, কড়া করে পোনা মাছ ভাজা, স্যালাড আর মিষ্টি। খাওয়ার পর পরিমলবাবু বললেন,
''আজ রাতটা আমার ঘরেই আপনার মেয়েটা থাকুক। আপনি যেভাবে রেস্টুরেন্টে ওদের আজ অ্যাটাক করেছেন, যদি ওরা পাল্টা বদলা নেয়, আমার আপনার মেয়েটাকে নিয়েই দুশ্চিন্তা হচ্ছে।''
''ঠিকই বলেছেন। বিন্তি আপনাদের ঘরেই থাকুক আজ রাতে।''পরিমলবাবু বললেন,
''আপনার আপত্তি না থাকলে, আমরা সবাই এক ঘরেও আজ রাতে থাকতে পারি।''
''আরে না না। অতো ভয় করি না মশাই! তাহলে আর সিবিআইতে থাকতে পারতাম না!''
''তবুও আপনার বাড়ির ফোন নম্বরটা একবার দিন। যদি সমস্যা বুঝি ফোন করে খবর তো দিতে পারবো!''
বীরেনবাবু ফোন নম্বর দিলেন। তারপর সবাইকে গুডনাইট জানিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন। রূপম ঘরে এসে বাবাকে ডেকে নিল,
''একটু চাপা গলায় বলল, তখন আমাকে বিস্কুট খেতে বারণ করলে কেন?''
''লোকটা একটা অন্যরকম বিস্কুট খাচ্ছে, আর আমাদের আর একরকম খেতে দিচ্ছিলেন বলে কেন জানি না মনের ভেতর সন্দেহের কাঁটা খচখচ করে উঠেছিল। হয়তো আমারই ভুল। পরে আরও সন্দেহজনক কিছু কথা, বলব তোকে। একটু ভাবতে দে। আমারও সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।বড় ঘুমও পাচ্ছে।'' রূপম বলল,
''আমারও খুব ঘুম পাচ্ছে।'' বিন্তিও বড় একটা হাই তুলল।
পরদিন সকালে যে ঘটনাটা ঘটল, তার জন্য ওরা কেউ প্রস্তুত ছিল না। ওরা কেউ ভাবতেও পারেনি এমনটা হতে পারে। সকালে একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙল সবার। প্রায় বেলা নটা বাজে। বীরেনবাবুর ঘর বন্ধ। একটা আশ্চর্য ব্যাপার বিন্তির বীরেনবাবুর ব্যাপারে কোনও আগ্রহই নেই। ঘুম ভাঙতেও সে বাবার কাছে যাওয়ার জন্য কোনওরকম বায়না করছে না। পরিমলবাবু চা নিয়ে পাশের ঘরে বহুবার বেল বাজালেন, কোনও সাড়া নেই। হোটেলের কর্মচারীরা উপরে এলেন। বিশেষ চাবির সাহায্যে শেষে ঘর খোলা হল। ভেতরে বীভৎস কাণ্ড। সারা ঘর লণ্ডভণ্ড। ঘরে বীরেনবাবু নেই, কিন্তু তার বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ভয়ে বিস্ময়ে রূপমের গলা দিয়ে স্বর বের হল না। পরিমলবাবুও স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছেন। অথচ বিন্তির কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। একটু পরেই ঘটনাস্থলে পুলিশ চলে এল।
পরিমলবাবু তার ব্যাগ থেকে রক্ত পরীক্ষার কীট বের করেছেন। বিছানার চাদরে লেগে থাকা তাজা রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ। কী আশ্চর্য! এ কী করে হয়? এই ঘরে তবে কী আখতার এসেছিল রাতে? বিছানায় কী তারই রক্ত লেগে আছে? নাকি এই রেয়ার ব্লাড গ্রুপ বীরেনবাবুরও ছিল। কিন্তু কই, কাল তো তিনি কথা বলার সময় কিছু বললেন না এ ব্যাপারে? হঠাৎ কনস্টেবলের উত্তেজিত গলার চীৎকার পেয়ে সবাই সেখানে ছুটে গেল। বিছানা রাখার আলমারীর ভেতর পর্দায় মোড়া অবস্থায় আছে বীরেনবাবুর লাশ! তার বুকে গুলি লেগেছে। গভীর ক্ষত। শার্টে রক্ত লেগে আছে। পরিমলবাবু রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করলেন আবার। এবারও দেখা গেল রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ। পরিমলবাবুর মুখে চিন্তার ছাপ।
ঘর থেকে বেরিয়ে, তিনি দিল্লিতে ফোন করলেন। সিবিআই দফতর থেকে জানান হলো, বীরেন মজুমদারও গত পরশু দিল্লি থেকে ট্রেনে উঠেছেন। পরিমলবাবু হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। তাহলে কে ছিলেন তাদের সঙ্গে এই কয়েকদিন? বীরেনবাবু, নাকি, তার ছদ্মবেশে আখতার? পরিমলবাবু ছুটে গিয়ে লাশটা দেখতে শুরু করলেন ভালো করে। কপালের কাছ থেকে একটা ময়দার মোটা প্রলেপ হাত দিয়ে ঘষতেই উঠে গেল। মাথার চুলটা যে উইগ সেটা এবার বোঝা গেল। টানতেই উইগটাও খুলে গেল। আখতারের নাক খাড়া নয়। পরিমলবাবু মৃতের নাকের পাশে চাপ দিতে পাতলা একটা ছাঁচ বেরিয়ে এল। কৃত্রিম নাক! এখন পরিমলবাবুর সামনে পড়ে আছে আখতারের লাশ, আর এতে এখন এতটুকু সন্দেহ নেই কারুর। এর মানে হাসিস যা উদ্ধার হয়েছে সেগুলোও কি নকল? উত্তর পাওয়া গেল একটু পরেই।
একটু বেলা হতেই সদর থেকে নারকোটিভ কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের লোকজন এলেন। বললেন উদ্ধার হওয়া হাসিস সম্পূর্ণ জাল। ওটা হল তামাক আর চিটে গুড়ের মিশ্রণ। কখন আখতার আসল হাসিস পাচার করে দিয়েছে পরিমলবাবুর সামনে থেকেই। অফিসাররা গন্ধ শুঁকেই জানালেন হাসিসের মিশ্রণ আছে কুকিসের মধ্যেও, যা আগেরদিন আখতার তাদের খেতে দিয়েছিল।
কিন্তু বিন্তি যে, সে কে? তা এখনও জানা যায়নি। আখতারের নিজের কোনও সন্তান নেই। সবটাই পুলিশকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য একখানা সাজানো নাটক। বিন্তিকে পুলিশ অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দিল। পরে তদন্তের স্বার্থে ওকে ডাকা হতে পারে। এদিকে প্রধান অফিসার আসল বীরেন মজুমদার এখনও এলেন না। এখানে আর করার কিছু নেই। তিক্ত মেজাজে আবার ট্রেন ধরে কলকাতায় ফিরে যাচ্ছেন পরিমলবাবু। রূপমকে বললেন,
''তুইই প্রথম থেকে ঠিক সন্দেহ করেছিলি। ভাবতেই পারিনি লোকটা আইকার্ড পর্যন্ত জাল করেছে! কিন্তু, আসল বীরেন মজুমদার তাহলে গেল কোথায়? এখন শুধু একটাই ভরসা যে আখতার মারা গেছে। তবে, ওকে মারল কে? তা বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো ওদের নিজের দলের লোকেরাই মেরেছে।''
কথার মাঝখানে কে যেন বলে উঠল,
''সেদিন আখতারকে গুলিটা না করলে আখতারই সেই রাতে আপনাদের সবাইকে মেরে ফেলত। আগেই রাতের খাবারের সঙ্গে ও আপনাদের কড়া ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল। তাই পরেরদিন সবার ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হয়েছিল। তার আগে কুকিসের মধ্যে হাসিস খাইয়ে সে আপনাদের নার্ভ কন্ট্রোল নষ্ট করে দিতে চেয়েছিল।'' রূপম আর পরিমলবাবু তাকিয়ে দেখলেন,
আসল বীরেন মজুমদার তাদের কম্পার্টমেন্টের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। অবিকল আইকার্ডের সেই মুখ। মুখে গোঁফও আছে। আখতার খুব কৌশলে সচেতনভাবে তার মুখে গোঁফ রাখেনি। তার মুখে মেক আপ করার পরেও যে বীরেনবাবুর মুখের সঙ্গে পার্থক্য খানিকটা থেকে যাবে, সেটা সে জানত। যাতে গোঁফ না দেখে আমরা ভাবি, গোঁফের অভাবে খানিকটা অন্যরকম লাগছে, এই কারণে তার মুখে সে গোঁফ রাখেনি।
বীরেনবাবু বললেন,
''আমি রেস্টুরেন্টের গণ্ডগোলের সময় এসে পৌঁছেছিলাম। দূর থেকে পুরো ব্যাপারটা আঁচ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু তখন সামনে এলে আখতার আর সামনে আসত না, হাসিসও উদ্ধার হতো না। ঘটনার পর নকল বীরেন, মানে আখতার কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেছিল। সে এরমধ্যে হাসিস সরিয়ে ফেলেছিল, ঠিকই, কিন্তু পাচার করতে সময় পায়নি। তাই ওর দলের খুদে কর্মী বিন্তিকে একটা ব্যাগ দিয়ে ধাবায় বসিয়ে রেখেছিল হাসিস সমেত। ব্যাগের ভেতরেই ছিল কোটি টাকার হাসিস।
রাতে আপনারা শুয়ে পড়ার পর দরজার বাইরে আমি পাহারায় ছিলাম। আমি জানতাম রাতে হাসিস নিয়ে আখতার পালাতে চেষ্টা করবেই। গভীর রাতে, আখতার হাসিস সমেত একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ওর ঘর থেকে। ওর হাতে ছিল স্বয়ংক্রিয় একটা সাইলেন্সার লাগানো অত্যাধুনিক রাইফেল। অনেক দূরের জিনিষও গুলিবিদ্ধ করা যায় তার সাহায্যে। ও আপনাদের ঘরের দরজার লকের ছিদ্র দিয়ে রিভালভার তাক করেছিল। কিছু না করেই ও দিব্যি পালাতে পারত। কিন্তু না। আপনার জন্য ওর দুই সঙ্গী প্রাণ হারিয়েছে। আপনার উপর ওর মারাত্মক রাগ হয়েছিল। এসেই আপনি তড়িঘড়ি থানায়ও খবর দিয়েছিলেন, তার জন্যই পুলিশ এসে অসময়ে ওর সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। আপনি যে দরজার কাছে শুয়েছেন, তা আখতার রাতেই দেখে রেখেছিল। অবশ্য বিন্তি বা রূপমের গায়ে গুলি লাগলেও ওর কিছু আসে যায় না। ওরা ওর নিজের কেউ নয়।
আপনার মেইল পেয়ে দিল্লি থেকে সাবধান করে ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা মেইল পাঠানো হয়েছিল আপনাকে। আমার কাছেও তার একখানা কপি আছে। আপনি এখানে নেট কানেকশান ভালো না থাকায় সময় মতো তা পাননি। আখতার আপনাদের টার্গেট করেছিল সেই কলকাতা থেকে। যে আপ ক্রিয়াযোগ এক্সপ্রেসে আপনারা এসেছিলেন, তখন থেকে। তদন্ত গোপনে করা হবে ভেবে আপনিও বেশি জানাজানি করতে চাননি। নাহলে, দিল্লি থেকে এতদূর কলকাতায় আমি শুধু শুধু আসবই বা কেন! আমি তো দিল্লি থেকে রাঁচিতে নেমে ওখান থেকেই গাড়িতে তুলিনের হোটেলে চলে আসতে পারতাম। মাত্র ষাট কিলোমিটার রাস্তা, রাঁচি থেকে তুলিন। একথা যদি আপনি ডিপার্টমেন্টে তখন জানাতেন। তখনই সব সন্দেহের অবসান হয়ে যেত।
রাইফেল তাক করে আখতার যেই সবে ট্রিগারে আঙুল ছুঁয়েছে, তখনই আমার হাতের সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারও সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার করেছে। একদম পয়েন্ট জিরো রেঞ্জে পিঠ থেকে সোজা হার্টে গুলি লেগেছে ওর। ওকে বাঁচার কোনও চান্স দিলে আমি নিজেও বাঁচতাম না। ওর কাছ থেকে সবটা হাসিসই উদ্ধার হয়েছে। এই ড্রাগ নাহলে এ এদেশের কত ছেলে মেয়ের জীবন যে নষ্ট করে দিত তা কেউ জানে না।
কষ্ট হয় আখতারের মতো মানুষদের জন্য, যাদের দুর্ভাগ্য টেনে আনে শুধুই অন্ধকারের আবর্তে। ওদের কথা চলতে থাকে, এবং ট্রেন ছুটে চলে হাওড়ার দিকে।
(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)