ধাম্! ধাম্!! ধাম্!!
আরে! এত জোরে দরজা পেটাচ্ছে যেন ভেঙেই ফেলবে! কলিং বেল বাজছে না নাকি!
বলতে না বলতে বেল বেজে উঠল। বাজতেই থাকল পাগলা ঘন্টির মত। হড়বড় করে বাথরুম থেকে বেরিয়েছেন, জামাটুকু তো পড়তে দেবে! আগুন লাগল না তো বিল্ডিং এ!
প্রায় উড়ে এসে দরজা খুললেন দীপংকরবাবু। বেল টিপে ধরে থাকা হাতের উদ্বেগ তাঁর হাত পায়েও সঞ্চারিত হয়ে গেছে ততক্ষণে।
দরজা খুলে চেনা মুখ দেখে নিশ্চিন্ত হবার বদলে আরো ভয় পেয়ে গেলেন তিনি।
"কী ব্যাপার কানাই? তুমি এরকম..."
কথা শেষ করতে পারেন না তিনি। অঝোরে কেঁদে ফেলে মাটিতে থপ্ করে বসে পড়েছে কানাই তাঁকে দেখে। কানাই তাঁর একতলার প্রতিবেশী ড. অনিন্দ্য বসুর পুরোনো রাতদিনের কেয়ারটেকার, তিনি আর দোতলার ভটচাজদা ঠাট্টা করে ওকে 'ডাক্তারের ম্যান ফ্রাইডে' বলেন। ওকে তিনি আজ অবধি কখনো এরকম বিচলিত হতে দেখেননি।
কানাইয়ের ফোঁপানো জড়ানো কথা থেকে যা বুঝলেন তাতে তিনিও অবশ্য যারপরনাই বিচলিত হয়ে পড়লেন। ঘরের চটি পায়েই ছুটে একতলায় গেলেন তিনি, কানাইয়ের সঙ্গে ফ্ল্যাটের একটেরে চেম্বারটায় ঢুকে যা দেখলেন তাতে মাথাটা ঘুরেই গেছিল বটে। নেহাৎ শক্ত মানুষ, তাই নিজেকে সামলে ইতিকর্তব্য স্থির করতেও বেশি সময় নিলেন না। তবে লোকাল থানায় ফোন করার সময়ে তাঁরও কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল উত্তেজনা আর আতঙ্কে।
ঘন্টাখানেক পরে একটা ছোটখাটো ভীড় জমেছিল বাড়িটার সামনে। ডাক্তারবাবু অনেকদিনের বাসিন্দা এ পাড়ায়, পসারও মন্দ নয়। পুলিশের জীপের পিছনের গাড়িটায় সাদা চাদর ঢাকা স্ট্রেচারটা তোলার সময়ে তাদের অনেকেই হাত কপালে ঠেকাল। গুনগুন চাপা কথাও শোনা গেল কিছু, কতই বা বয়েস হয়েছিল! দিনকাল বড় খারাপ। চেম্বারে কী-ই বা থাকত যে গুণ্ডা এসে..আহা রে, বেশ যত্ন করে দেখত কিন্তু ছোকরা..
একতলার আদ্ধেকটা গ্যারেজ, বাকি আদ্ধেক ডাক্তারের ফ্ল্যাট। একটা মাস্টার বেডরুম, একটা গেস্টরুম যাতে পার্টিশন করে চেম্বার আর কানাইয়ের ঘর। চেম্বারের এন্ট্রি লাগোয়া গ্রিল ঘেরা বারান্দা দিয়ে। এদিকের মেইন দরজা খুলে বসার ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম ইত্যাদি। পুরো জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছিল পুলিশের দল, ছবি তুলছিল তাদের একজন।
চেম্বারটা ইন্সপেক্টর রজত জানা নিজে দেখছিল। আপাতদৃষ্টিতে একটাও জিনিস এদিক ওদিক হয়নি। ডাক্তারের চেম্বার যেমন হয়, একটা বড় টেবিল, তাতে প্যাড, পেন, ওষুধের স্যাম্পল, ব্লাডপ্রেশার মাপার যন্ত্র, ওপাশে গদি আঁটা রিভলভিং চেয়ার, এদিকে এমনি চেয়ার একটা, একপাশে এক সেট সোফা, সেন্টার টেবিলে ম্যাগাজিন কিছু।
সময় নিয়ে সব খুঁটিয়ে দেখে রজত। পেনটা ঢাকা খোলা। ঢাকাটা নিচে পড়ে। এছাড়া অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ে না। প্রথম যখন ঢুকেছিল রজত, তখনো অবশ্য সব স্বাভাবিক লেগেছিল। শুধু তখন ডাক্তার বসু ওই চেয়ারে বসে ছিলেন। ঘাড় পিছনে হেলানো, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে, দাঁতের চাপে জিভ কেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে গড়িয়ে পড়েছে চিবুক অবধি।
ডাক্তার নয়, ডাক্তারের মৃতদেহ। গলায় দাগড়া দাগড়া লাল-কালো টিপে ধরার দাগ। মানুষের বদলে মুরগির গলা মনে হচ্ছিল, এমন থেঁতলে গেছিল জায়গাটা।
তিনতলার প্রতিবেশীটি, যিনি থানায় ফোন করেছিলেন, বসার ঘরের সোফায় জবুথবু হয়ে বসে ছিলেন৷ কানাই নামের কাজের লোকটিও একপাশে একটা টুলে বসে ছিল। রজত দুজনের উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, "কেউ চেম্বারের কিছু নাড়াচাড়া করেনি তো?"
"না না, একদম কেউ ঢোকেইনি ও ঘরে। আমি তো দেখেই সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছি, কিচ্ছু ছুঁইনি। এসে, দরজা টেনে দিয়ে ঠায় এইখেনে বসে আছি, আপনিই প্রথম এসে ঢুকলেন তো তারপর।"
রজতের সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে কানাইও ঢক ঢক করে মাথা নাড়ায়।
"না বাবু, আমি হাত দেব কী! দাদা চা খান সাড়ে এগারোটায় তাই নিয়ে ঢুকছি, অমনি জিজ্ঞেস করব মাছ ভাজা খাবেন দুপুরে না ঝোল করব, দরজা খুলে দেখি এই দশা! দেখেই তো হাত পা কাঁপতে লেগেছে আমার, কোনোরকমে হাতের কাপ রেখে এক দৌড়ে উপ্রে, তাই দোতলায় তো তালা সব বেরিয়ে গেছেন, তিনতলায় গিয়ে এই দাদাবাবুকে ডাকি..."
"দাদাবাবু" মাথা নেড়ে সায় দেন এ কথার। সামনের টেবিলে একধার করে বসানো কাপ-ডিশ, তাতে সর পড়ে যাওয়া চা, তার পাশে নিচে টুলে রাখা লাল টেলিফোন নীরবে দুজনের কথার সাক্ষী দেয়।
"স্যার, অল ডান। আমরা কি যাব?"
"হয়ে গেছে? এগোন তাহলে, আমিও আসছি।"
নিঃশ্বাস ফেলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয় রজত। বাইরের লোকই মনে হচ্ছে। কিন্তু মোটিভের জায়গায় ধোঁয়াশা। পেপারওয়ার্ক করতে হবে এবার।
"শোনো তুমি বাড়ি ছেড়ে একদম যাবে না। তোমার দেশের ঠিকানা আধার কার্ড ছবি টিপছাপ সব নিয়ে নিয়েছি মনে রেখো, পালালেই ধরে ফেলব কিন্তু।"
"না বাবু, না বাবু, যাবনা কোথাও।"
বেরিয়ে এসে বাইকে স্টার্ট দিয়েও ভ্রূকুটি যায় না রজতের। ডাক্তারের চোখ দুটো কিছুতেই ভুলতে পারছে না ও, এত নিখাদ আতঙ্ক — আর গলাটা?! তার মত সাত বছর ধরে নিয়মিত খুন জখম দেখা পুলিশেরও নার্ভে চাপ পড়ে গেছিল গলাটার ওই দৃশ্যত দুমড়ে মুচড়ে পিষে যাওয়া দশা দেখে।
কিসের জন্য এই দাম চোকাতে হল ডাক্তারকে? কে হতে পারে এই অসমশক্তিধর আততায়ী?
জ্ঞানটা ঠিক করে ফিরতে যা দেরি। পরক্ষণেই যেভাবে ছটফট করে উঠল রোগী, একপাশে বসে থাকা সিস্টার হাঁকপাঁক করে ছুটে এল, সেই সঙ্গে তার চীৎকারে পাশের ঘর থেকেও ছুটে এল আরেক সিস্টার। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। বিশাল লম্বা-চাওড়া পেটানো চেহারার লোকটির গায়ের জোর অমানুষিক, সিস্টাররা এসে পৌঁছনোর আগেই এক ঝটকায় দুদিক থেকে আটকে রাখা স্ট্র্যাপগুলো ছিঁড়ে ফেলে সে নিজের দুই হাত তুলে ধরেছে চোখের সামনে।
এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্তচুপ। তারপর “হাআআআআআআআ” করে একটা জান্তব চীৎকার সারা ফ্লোর কাঁপিয়ে আছড়ে পড়ল বাতাসে। সেই ভয়ানক চেঁচানির ধাক্কায় হাসপাতালের ফ্যাকাশে সাদা দেওয়ালগুলো অবধি যেন কেঁপে উঠল, আশপাশের ঘরগুলোয়, বড় হলের সারি সারি লোহার খাটে একা, বা বেড শেয়ার করে শুয়ে থাকা মলিন পোশাকের লোকগুলো যারা জেগে ছিল তারা আঁতকে উঠল, যারা ঘুমিয়ে ছিল তাদের ঘুম গেল ভেঙে।
টহল দেওয়া শেষ করে ডাক্তার অনিন্দ্য বসু সদ্য স্টাফ রুমে গিয়ে গায়ের সাদা কোটটা খুলতে যাচ্ছিলেন। চীৎকারটা সেখানেও ধাক্কা দিল এসে। এতই হিংস্র, এতই বিক্ষুব্ধ সে আওয়াজ যে ঐটুকুতেই স্থানু হয়ে গেলেন ছড়িয়েছিটিয়ে বসা দাঁড়ানো ডাক্তারেরা। ডাক্তার বসু আন্দাজ করতে পেরেছিলেন কার গলা, ঝট করে কোটটা গলিয়ে সেই স্পেশাল কেবিনের দিকে দৌড় মারলেন তিনি। পিছনে পিছনে আরো দুই জুনিয়র ডাক্তার।
প্রতাপের জ্ঞান ফিরলে যে এমনই কিছু একটা হবে তা আশা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু ঘরের দরজা পেরিয়েই যা দেখলেন তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না অনিন্দ্য। খাটের সামনে যেন তুফান চলছে, একটা ছ’ ফুট লম্বা বিশাল দানব তাণ্ডব করছে সেখানে। পরনে ওটির সবুজ দড়ি বাঁধা পোশাক, কাটা মুরগির মত ধড়ফড় করছে তার মাথা, হাত, পা, ছিটকে ছিটকে পড়ছে পাশের টেবিলের ওষুধপত্র, খাবার জল, স্ট্যান্ডে লাগানো ড্রিপের সরঞ্জাম। একজন সিস্টার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছেন, কপালে লাল হয়ে আলুর মত ফোলা, অজ্ঞান সম্ভবত, আরেকজন ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে বলির পাঁঠার মত কাঁপছেন।
এক পলকে দৃশ্যটা দেখে নিয়েই পকেট থেকে ফোন বার করে ইমার্জেন্সি সিকিউরিটি নাম্বারে ফোন লাগালেন অনিন্দ্য। পিছনে আসা জুনিয়র রোহন আর ঈশানী ততক্ষণে “গার্ড গার্ড! হেল্প!” করে বিশাল শোরগোল তুলে ফেলেছে, তাতে আরো কয়েকজন নার্স ঝাড়ুদার ওয়ার্ড বয় গোছের কর্মী জড়ো হয়ে গেছে কেবিনের সামনে। তাদের ঠেলেঠুলে অচিরেই এসে হাজির হল দুই ষণ্ডা গার্ড। কিন্তু তারপরেও, এই এতজন মিলেও, সে লোকটাকে পাকড়াও করে শোয়াতে প্রায় কালঘাম ছুটে গেল সবার। ততক্ষণে সব তছনছ হয়ে গেছে ঘরের।
কড়া ডোজের ঘুমের ইঞ্জেকশনটা মনের জোরে হাত স্টেডি রেখে পুশ করলেন অনিন্দ্য। উঠে যখন সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, কপাল থেকে গড়িয়ে নামছে ঘামের ফোঁটা। ভারী শরীরটা নেতিয়ে পড়ার পর তবে তাঁর নিজের শ্বাস স্বাভাবিক হল। ওয়ার্ড বয়-রা মাটিতে পড়ে থাকা নার্সকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে যাবার পর সবাই ঘর ছাড়ল একে একে। শুধু দরজার পাশে সারাক্ষণ যার বসে থাকার কথা, সেই সাদা পোশাকের পুলিশটি গুটি গুটি পায়ে আবার তার টুলে গিয়ে বসল। মোক্ষম মুহূর্তেই সে বেচারার পিসাব পেয়ে গেছিল, তবে চীৎকার শুনে ছুটে আসার পর সেও অগ্রণী হাত লাগিয়েছিল অবস্থা আয়ত্তে আনার, চোখের নিচের গভীর কালশিটেটাই তার প্রমাণ।
বেরোনোর আগে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে রোগীর বিছানার পাশে গেলেন অনিন্দ্য। অঘোরে ঘুমোচ্ছে এখন সে, রোদে পোড়া তামাটে মুখ, নাক মুখ বেশ কাটা কাটাই বলা যায়, ভ্রূর উপরে একটা গভীর ক্ষত চুলের গোড়া অবধি চলে গেছে কপাল বেয়ে।
প্রতাপ কুমার সিং। গতকাল রাত্রে হাসপাতালের খাতায় এই নামই লেখা হয়েছিল। যদিও ওর পরিচিতরা কেউ এই নামে চিনবে না ওকে। পুলিশের খাতায় লেখা আছে পরতাব। পেটো পরতাব। পাইকপাড়া অঞ্চলের অন্যতম ত্রাস। ভ্রূর উপরের ক্ষতটা ছুরি নিয়ে মারামারির চিহ্ন। এরকম আরো অজস্র ক্ষত আছে সারা গায়ে, আজই দেখেছেন।
এখন চার ঘন্টা মত নিশ্চিন্ত। থানা থেকে ফোন এসেছিল এইমাত্র, খবর দিয়েছে কনস্টেবলটি নিশ্চয়, ওসি আসবেন একটু পরে হ্যান্ডকাফ নিয়ে, জানিয়েছেন। যত তাড়াতাড়ি হয় একে রিলিজ করে নিয়ে যেতে বলতে হবে, তবে মিনিমাম সেরে ওঠা অবধি তো রাখতেই হবে!
সামান্য ঝুঁকে, হাতের নতুন বাঁধনগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন একবার অনিন্দ্য। পাথরের মত মজবুত হাতের গোছ, কনুই থেকে সুন্দর ডৌলে কবজি অবধি উঠে এসেছে যেন ভাস্কর্য এক।
তার পর ফাঁকা। কিছু নেই।
না, ভুল বলা হল। ব্যান্ডেজ আছে। রক্তের ছোপ লাগা সাদা ঢেলার মত দুটো ব্যান্ডেজ দুই হাতে।
ভোর থেকে ওটি করে দুটো হাতের পাতাই পুরো বাদ দিয়ে দিতে হয়েছে। গ্যাংগ্রীন সেট করে গেছিল।
তিনদিন পরে সুপার মৈত্রেয়ীদির ঘরে বসে ছিলেন অনিন্দ্য। ওসি সুরজিৎবাবুও ছিলেন সঙ্গে।
“আর কিছু নোট করার মত আছে কি ডাক্তারবাবু?”
“ন্নন...নাহ! এমনি তো সব প্যারামিটার ঠিকই আছে বললাম, হেলথ স্ট্রং তো, রিকভারি ভালোই হচ্ছে। তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে।”
“কিন্তু নুলো হয়ে।”
একটু নড়েচড়ে বসে অনিন্দ্য, গলার স্বরে অল্প ক্লান্তি মেশে।
“হ্যাঁ, ওটা তো বললামই আপনাকে। কিচ্ছু করার ছিল না। দিন বারো আগে যখন ঐ বেলগাছিয়ার বস্তিতে মারপিট বোমাবাজিটা হয়েছিল বললেন, তখনই চোট পেয়েছিল নির্ঘাৎ। তখনই যদি আসত...হয়তো...”
“এদের সে বোধ থাকলে তো হয়েই গেছিল ডাক্তারবাবু! সেদিন রামাইয়ার হাতে বেধড়ক মার খেয়ে, হেরে যাচ্ছে বুঝতে পেরে পালিয়ে গেছিল স্রেফ। গা ঢাকা দিয়েছে গিয়ে পার্ক সার্কাসের বস্তিতে বন্ধুর বাড়ি। আরে আমাদের কাছে সব খবর থাকে, যাবি কোথায়! কদিন সময় লেগে গেল খুঁজে বার করতে, কিন্তু ঠিক তো ধরা পড়ল! আমরা যখন হানা দিলাম সেদিন, মাল ধুম জ্বরে কোঁকাচ্ছে। হাতে ঘা ভর্তি মাছি থিকথিক করছে, দুর্গন্ধে বমি এসে যায়...”
“আর ৪৮ ঘন্টা অমনভাবে পড়ে থাকলেই মারা যেত শিওর। আপনারা তুলে আনলেন বলে প্রাণে বেঁচে গেল অন্তত।”
মৈত্রেয়ীদি এতক্ষণে মুখ খোলেন, “ডিসচার্জ তো তাহলে আপনিই নেবেন?”
“হ্যাঁ, সে তো বটেই। কবে ছাড়ছেন ডাক্তারবাবু?”
অনিন্দ্য একটু ইতস্তত করে। আজ বললেও হয়, বাকিটা জেল হাসপাতাল দেখে নিতে পারবে। অবশ্য জেলে যায় যদি শেষ অবধি।
“আরেকটা দিন একটু দেখে নিই, জানেন। কাল দুপুরে নিয়ে যান। জেলে যাবে, না জামিন? সেইমত ওষুধ দিয়ে দেব সঙ্গে আর কী।”
মুখ টিপে হাসেন সুরজিৎবাবু।
“সব তো আপনাদের বলতে পারব না, তবে যা বুঝছি ইনি এখন আউট অফ ফেভার। রামাইয়া এদিকের উঠতি হিরো, বুঝলেন। কাজেই, একে হাজতে ঘানি ঘোরাতেই যেতে হবে...ও না, সে তো পারবে না আবার!”
নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে ওঠেন ওসি।
একজন নার্স এবং সেই পুলিশের লোকটি পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে সতর্ক ভাবে। প্রতাপের দুই হাতই কনুইয়ের কাছে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকানো বেডের রেলিং এ। সতর্কতার খাতিরে একটা পা-ও। তবু, বেডের পাশে দাঁড়িয়ে প্রেশার মাপার সময়ে নিজের রক্ত চলাচলের গতি বেড়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছিলেন অনিন্দ্য। ঠায় তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে যে চোখজোড়া, বাঘের হলুদ চোখের নির্মম করাল দৃষ্টির সঙ্গেই একমাত্র তার তুলনা চলে।
“এই ডাগদার? এই কুত্তি, বল না! এই ডাগদারটা তো?”
হুংকারে নার্সটি তো বটেই, অনিন্দ্যরও হাত কেঁপে ওঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নার্সটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, ভয়ে মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
বেচারী। এরকম একটা জানোয়ারের কাছে ডিউটি করা যে কত চাপের তা না বোঝার মত হৃদয়হীন ডাক্তার অনিন্দ্য বসু নন।
প্রতাপের চোখে চোখ রেখে খুব ঠান্ডা গলায় তিনি বলেন, “এখানে একটাও বাজে শব্দ উচ্চারণ করলে, নার্সদের সঙ্গে অসভ্যতা করলে, এমন ইঞ্জেকশন দেব জীবনে আর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোবে না। কী জানতে চাও, আমাকে বলো।”
সটান শুয়ে থাকা শরীরটা একটুও কাঁপে না, কিন্তু ভারী মুখের পেশিতে হিল্লোল খেলে যায় কেমন। চোখের পাতা পড়ে না, বরং আগুন ধক ধক করে লাফিয়ে উঠতে থাকে সে চাহনি থেকে।
“কোন বাঞ্চোৎ আমার হাত নুলো করে দিয়েছে? কার কথায়?”
ঘাড় শক্ত হয়ে ওঠে অনিন্দ্যর। সেও চোখের পাতা না ফেলে, চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দেয়,
“তোমার হাত আমি কেটে বাদ দিয়েছি। হাত না কাটলে জানে মারা যেতে সে হুঁশ আছে? রক্ত বিষিয়ে গেছিল পুরো।”
“ঝুট!!!!”
চীৎকারটা যত জোরে হল, পরের কথাগুলো ততটাই আস্তে বেরোলো।
“ও দারোগার বাচ্চার সঙ্গে রামাইয়া সাঁট করেছে আমি জানি। টাকা খেয়ে, ওকে তুলবে বলে আমার হাত কাটা করিয়ে দিল হারামিরা। আমি জানি।”
“চুপ! মুখ খারাপ করতে বারণ করেছি তোমায় এখানে।”
“তুই চুপ বে হারামজাদা! টাকা খেয়ে আমার সর্বনাশ করলি, তোকে আমি ছাড়ব ভেবেছিস?”
ধৈর্য ফুরিয়ে আসছিল অনিন্দ্যর। উত্তরটা একটু স্বভাববিরুদ্ধ রুক্ষ হল।
“বেশ তো, ছাড়তে হবে না। যা পারিস করে নিস, আগে তো জেলের ঠেলা সামলা!”
চুপ করে গেল লোকটা। জব্দ হয়েছে এবার। বাকি কাজ সেরে, নার্সের হাতের কাগজে সই করে বেরোতে যাচ্ছিলেন অনিন্দ্য, দোরগোড়ায় পা-টা থেমে গেল পিছন থেকে ভেসে আসা হিসহিসে সুরে বলা কথাগুলোয়।
“হাত কেটেছিস, মাথা নয়। আজ হোক, দশ বছর পরেই হোক, তোর লাশটা আমিই ফেলব, দেখে নিস!”
এর দু ঘন্টা পরে পুলিশের গাড়িতে ওঠা অবধি প্রতাপ আর একটা কথাও বলেনি।
সুরজিৎবাবুর আন্দাজ অভ্রান্ত ছিল। প্রতাপকে এবার আর কেউ জামিনে ছাড়াতে এল না, কেস কোর্টে উঠল। কয়েকমাস ধরে মামলা চলাকালীনই তার দল ভেঙে গেল, রামাইয়া বকলমে প্রোমোটার হয়ে বসল, এমন কি যিনি তার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক আশ্রয় ছিলেন, সেই নেতাটিও মন কষাকষির জেরে দলবদলে অন্য কোন জেলার দায়িত্ব নিয়ে কলকাতা ছাড়লেন। এর মধ্যে কোনটা কার্য কোনটা কারণ বলা মুশকিল। মোটমাট একগাদা ধারায় জড়িয়ে প্রতাপের শেষ অবধি ছ বছর জেল হয়ে গেল।
কলকাতার জেলেই থাকার কথা তার। সেইমত দমদমে নিয়েও যাওয়া হয়েছিল কোর্ট থেকে। চুপচাপ ওখানে কাটিয়েই বেরিয়ে আসতে পারত হয়তো, কিন্তু বাদ সাধল ঐ কাটা হাত জোড়া।
একসঙ্গে লাইন দিয়ে খাবার সময়ে প্রথম প্রথম প্যাঁটপ্যাঁট করে চেয়ে থাকা, তারপর নিজেদের মধ্যে ফিসফিসানি, এর ওর গা ঠেলে দেখানো, হাসাহাসি, হতে হতে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল খুব শিগগিরই। প্রতাপের চেনা কেউ থাকলে, বা ও যদি কথাবার্তা বলে দুচারটে দোস্ত বানিয়ে নিতে পারত, হয়তো এগুলো সহজ হয়ে আসত। তার বদলে একটা হুমদো চেহারার লোক রোজ মুখ বুজে ঘাড় হেঁট করে কারো দিকে না তাকিয়ে গটগট করে আসছে, নুলো দিয়ে বাটি ধরে কসরৎ করে খাচ্ছে, কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে জবাবও দিচ্ছে না, এবং খাওয়া কোনো মতে শেষ হলেই উঠে চলে যাচ্ছে, এগুলো, বাকি খুনে গুণ্ডা মস্তানদের কাছে ‘অহঙ্কার’ ছাড়া আর কী-ই বামনে হতে পারত!
সেদিনও প্রতাপ সবে এসে ওর নির্দিষ্ট জায়গায় বসতে যাবে, হুট করে দৌড়ে এসে বকাই সেখানে বসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দূরের জটলাগুলো থেকে ভেসে এল সি টি, হাসির হররা, হাততালি।
প্রতাপ এই প্রথম চোখ তুলে তাকাল বকাইয়ের দিকে। একটা কম বয়েসী ফচকে মুখ, মুখে ব্রণ, চুলে পনিটেল।
“ওয়েব্বে! শুভো দিষ্টি করছিস না কিরে!”
পঞ্চার গলায় কথাটা ভেসে আসতেই, নববধূর মত লজ্জা পাবার ভান করে বকাই গালে হাত দিয়ে। সারাঘর জুড়ে তুমুল হাসির শোরগোল ওঠে।
প্রতাপের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, নিঃশ্বাসের গতি বাড়ে। মুখ ফিরিয়ে অন্য কোথাও বসার জায়গা খোঁজে সে।
“আরে নুলো কাত্তিকের তোকে পছন্দ হল না যে! মুখ ফিরিয়ে পালাচ্ছে!”
ঝটকায় মুখ ফিরিয়ে গর্জে ওঠে প্রতাপ, “পরতাব পালায় না বেজন্মার দল। মুখ সামলে কথা না বললে…”
এক সেকেন্ডে ঘরের বাতাস থমথমে হয়ে ওঠে। এক দুজন করে যারা উঠে এসে ওকে ঘিরে দাঁড়ায়, তাদের চোখমুখ দাঁড়ানোর ভঙ্গি বলে দেয় এরা সবাই পুরোনো পাপী, জেল খেটেখেটে গায়ে চড়া পড়েই যায়নি শুধু, সব ঘাঁৎঘোতও জানা থাকার ঔদ্ধত্য ফেটে বেরোচ্ছিল তাদের মধ্যে। হাজার মস্তানি করলেও জেলকে এতকাল কাঁচকলা দেখিয়ে এসেছে প্রতাপ, এরকম বন্দী দশায় ঘেরাও হয়ে কিছুটা বেকুব বোধ করছিল সে।
মারটা আচমকাই শুরু হয়েছিল। নাকে ঘুষি, পিঠে লাথি সব একসঙ্গে। আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিতেই হাত তুলে মুখ আড়াল করেছিল সে, কাটা জায়গায় তীব্র ব্যথায় চমকে উঠে দেখল একটা কালো হাত সাঁ করে সরে গেল। হাতের মালিক বকাই তার ব্রণ মুখ নিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসছিল ওর চমকানো দেখে। সাপের মত সে আবার হাত চালালো ওর চোখের সামনে, প্রতাপ বিস্ফারিত চোখে দেখল আঙুলের ভাঁজে লুকোনো ব্লেডের ঝলক। তারপরই পিঠে একাধিক লাথি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে যেতে ঐ বকাইকেই গলা জাপটে ধরে নিজেকে সামলাল প্রতাপ।
তারপরের চরম হুড়োহুড়ি, প্রতাপের মুখে পিঠে পায়ে বন্যার মত মার আছড়ে পড়া, অকথ্য গালাগালির চীৎকার — এসবের মধ্যে বকাইয়ের কোঁকানোর আওয়াজ আর কারো কানে যায়নি। আওয়াজ শুনে অ্যালার্ম বেজে ওঠার পর পুলিশেরা দৌড়ে এসে যখন অচৈতন্য প্রতাপকে ধরে তুলল, তখন বকাইয়ের আর্তনাদে কান পাতা দায়।
দুজনকেই হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল, প্রতাপের সর্বাঙ্গে কালশিটে আর কাটা দাগ; বকাইয়ের কাঁধের হাড় ডিসলোকেট হয়ে গেছিল দুই হাতের পেষণে।
বহরমপুর জেলের ভারী দরজাটা যখন জীপের জন্য খুলে যাচ্ছে, সারারাস্তা ঝিমিয়ে বসে থেকে বন্দীটা তখনো মাথা উঁচিয়ে, চোখ খুলে একটু দেখছিল। কিন্তু নামার পর, এখানকার কন্সটেবলদের পিছু পিছু পা টেনে টেনে চলে যাবার সময়ে একটু তাকিয়েও দেখল না আশপাশ। এরকম দুহাতকাটা অপরাধী আগে দেখেনি বিশ্বেশ্বর, কী যেন আছে লোকটার মধ্যে, প্রতিবন্ধী, চোখে চোখ রাখে না, চুপচাপ — তবু গা শিউরে ওঠে কেমন লোকটাকে দেখলে। যাকগে, মরুকগে, ওর কাজ শেষ! কাগজপত্রগুলো ঠিক করে গুছিয়ে নিয়ে লাফ মেরে জীপে উঠে পড়ল হাবিলদার বিশ্বেশ্বর জানা।
মাথা নিচু রাখলেও, প্রতাপের চোখ কিন্তু সবই দেখে নিচ্ছিল। চৌকো উঠোন, এক পাশে ফুলগাছ কিছু। অফিসঘর। জলের পাইপ। বেসিন। ছোট্ট সবজিক্ষেত? তাই হবে। কুঠুরিগুলোর দিকে যাচ্ছে না কেন ওরা? ও আচ্ছা, এদিকের প্যাসেজ পেরোলে আরো কুঠুরি আছে।
এগুলো সম্ভবত পুরোনো স্ট্রাকচার। মোটা মোটা দেওয়ালের গাঁথনি, নিচু ছাত। দিনের বেলাতেও প্রায় অন্ধকার। খালি, প্রায় সবই।
একদম শেষের দিকে একটা কুঠুরির দরজা খুলে লোকগুলো ওকে ঢুকতে বলল। পা ঘষে ঘষে ঢুকল প্রতাপ, কিছুই প্রায় চোখে পড়ে না, এমন অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ার আগেও নাকে ধক করে ধাক্কা মারল একটা গন্ধ। ভেজা, ছাতাপড়া, নোংরা মাটির গন্ধের সঙ্গে, ধূপধুনোর গন্ধ, মাছের আঁশের গন্ধ এসব মেশালে যেমন হয়। গা গুলিয়ে উঠল ওর। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, পিছনের দরজায় তালা দিয়ে চলে গেছে ওরা।
কিসের তাড়সে ও প্রায় ছুটে গিয়ে পিছনদিকের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। কই, যেমন ভেবেছিল তেমন পুরোনো পাথর মাটির নোংরা দেওয়াল তো নয়! দিব্যি পরিষ্কার চুনকাম করা সাদা সমান দেওয়াল। গন্ধের তীব্রতাও এখানে যেন একটু হলেও কম।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই টের পায় প্রতাপ, জ্বর আসছে আবার। গলা শুকিয়ে কাঠ, শীত করছে, চোখের সামনে দেওয়ালগুলো কাঁপছে যেন। আস্তে আস্তে দেওয়ালে ভর রেখে মাটিতে বসে পড়ে সে, অবসন্ন শরীরটা হেলিয়ে দেয় পিছনে।
ঘুমিয়েই পড়েছিল। রাত্রের খাবার নিয়ে এসে ডাকল পুলিশটা।
বসে বসেই ঘষে ঘষে এগিয়ে এল প্রতাপ, আর উঠে দাঁড়ানোর মত জোর নেই। অনেকটা জল দিয়েছে, আহ... ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে ঝুঁকে পড়ে কানাতোলা সানকির দ্রব্যটায় মন দেয় সে।
“চুঃ চুঃ...”
উপুড় হয়ে ঝুঁকে, থালায় মুখ নামিয়ে সরাসরি খাওয়ার ভঙ্গিমাটা দেখলে কুকুর মনে হতেই পারে, ওর নিজেরও প্রতিবার নিজেকে কুত্তাই লাগে। তাই বলে শালা খানকির বাচ্চা পুলিশটার এত স্পর্ধা...?
ঝট করে মাথা তোলে প্রতাপ, মুখে নাকে লপসি মাখা, চোখে আগুন।
একি!
কেউ নেই তো প্যাসেজে!
কিন্তু ও যে স্পষ্ট শুনল?
আবার সেই গন্ধটা নাকে ফিরে আসে। তারপর এক অনৈসর্গিক তীক্ষ্ণ, খসখসে গলায় তারস্বর চীৎকারে উচ্চারণ হয়,
“ওরে আয়! ওরে আয়! আয় রে আমার জীয়নকাঠি! আমি যে তোর অপেক্ষায় বসে আছি বাপ্!”
কী ভয়ানক লালসা মেশানো গলা, কী সাংঘাতিক দাপট সেই আহ্বানে। প্রতাপের মত কঠিন লোকেরও অন্তরাত্মা আভূমি কেঁপে উঠল শুনে।
“ওরে, এলি? এলি? চেয়ে দ্যাখ আমার দিকে! তোর জন্যই তো পরাণডা ধরে রাখা এদ্দিন!”
আবার সেই বন্ধ কুঠুরি কেঁপে ওঠে হুকুমের হুংকারে।
প্রতাপ এইবারে দেখতে পায়, প্যাসেজের ওপারে, গরাদের পিছনের অন্ধকারে একজোড়া চোখ, অঙ্গারের মত জ্বলছে যেন! আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার শিরা ওঠা কঙ্কালসার হাত যা গরাদ আঁকড়ে ধরে আছে, তার সাদা পাকানো কাঁধ অবধি ঝুলে পড়া চুল, ঢালু টাক পড়া কপাল, বাঁকা মোটা নাক। প্রতাপের চোখে চোখে পড়তেই, একটা প্রবল উল্লাসের ক্রূর হাসি ফুটে ওঠে সেই জীবন্ত প্রেতাত্মার মুখে।
“কে তুমি? কী চাও?”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল প্রতাপের মুখ দিয়ে।
নিচু স্বরে, প্রশ্ন ফিরে এল তার দিকে।
“তুই কী চাস? বল। যা চাইবি, তাই পেয়ে যাবি মনে রাখিস।”
“মানে!”
“কী চাই রে তোর, বল না! বল, বল?”
প্রতাপের ধন্ধ লাগে। কী চাইবে? জেল থেকে মুক্তি? টাকা পয়সা? আগের মত অবাধ ক্ষমতায় বিচরণ? নাকি...
নিজের হাতের দিকে অজান্তেই চোখ চলে যায় তার।
প্রতিশোধের বাসনাটা হু হু করে ওঠে মনের মধ্যে।
“তাই তো! তাই-ই তো! পাবি। দিতে পারি কিন্তু!”
প্রতাপের সব হিসেব গুলিয়ে যায়। অধীর আগ্রহে সেও এবার গরাদে মুখ ঠেকিয়ে ফেলে।
“তুমি পারো? পারবে ঠিক করে দিতে?”
“ঠিক হবে না। কিন্তু তুই যা চাইছিস তা হবে। নে ধর!”
ম্যাজিকের মত মুখ থেকে কী একটা বার করে লোকটা। ঘষষষষষ্ করে আওয়াজ টেনে সেটা গড়িয়ে আসে প্যাসেজ পার করে।
আঁকুপাঁকু দুই নুলোয় সেটা ধরে প্রতাপ, ভিতরে নিয়ে আসে খুব সাবধানে।
একটা পাথর। ম্যাড়মেড়ে লাল, মসৃণ, ডিমের মত শেপ।
“ওটা খেয়ে ফ্যাল!”
জলদগম্ভীর গলায় হুকুম আসে।
“পাথর...খাব?”
হা হা করে হেসে ওঠে লোকটা।
“পাথর নয়। ও একরকম বীজ। সব প্রাণ বীজ থেকে শুরু হয় তা জানিস? মদ্দলোকে মেয়েমানুষের পেটে বীজ ফেললে তবে বাচ্চা গজায়, জানিস?”
প্রতাপের গা শিরশির করে ভয়ে।
“খেয়ে ফ্যাল! পুলিশগুলো এসে পড়বে এক্ষুণি! খা বলছি!”
সম্মোহিতের মত জল দিয়ে জিনিসটা খেয়েই নেয় প্রতাপ। কিসের বীজ? জানা হল না।
রাতের টহল দিল যখন সান্ত্রী তখন দুই কয়েদীই অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
পরদিন প্রতাপের ঘুম ভাঙল লোকজনের কথায়। প্যাসেজে বেশ কিছু পুলিশ। একজন সাদা কোট পরা লোক, সম্ভবত ডাক্তার।
“নাহ! কিছু করার নেই, নিয়ে যাও।”
সাদা কোট পরা লোকটা চলে গেল। আরো কয়েকজন পুলিশ গেল তার পিছু পিছু, সামনেটা খালি হল এতক্ষণে।
উলটোদিকের কুঠুরির দরজা খোলা। মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে লোকটা, সাদা চুলগুলো এলিয়ে আছে, সম্পূর্ণ উলঙ্গ। জেলের জামাগুলো একপাশে জড়ো করা।
“কী হল?”
কাছে দাঁড়ানো পুলিশটাকে জিজ্ঞাসা করল প্রতাপ।
“মরেছে আপদটা। ভুগছিল তো।”
“কিসে মরল?”
“সে কে জানে! বুড়ো হয়েছিল, ভুগছিল, তারপর অত অনাচার!”
“অনাচার?”
এবার প্রতাপের দিকে ভালো করে তাকায় পুলিশটা। একে আগে দেখেনি প্রতাপ।
“অ! বাইরের মাল! তাই ভাবি দিগেন মহান্তকে আবার কে না চেনে! বড় ঝাড়ফুঁক ওয়ালা তান্ত্রিক ছিল তো মালটা, কত কী অখাদ্য কুখাদ্য খেত সাধনার নামে তার ঠিক নেই। তেমনি মেয়েখেকো ছিল, সব সমস্যার সমাধানে ঢ্যামনাটার কুমারী মেয়ে লাগত। গেঁয়ো লোকগুলোরও বলিহারি, নিজের বাড়ির মেয়েগুলোকে দিয়েও যেত!”
“তারপর? জেল হল কেন?”
“একটা একদম কচি মেয়েকে...সামলাতে পারেনি, মরেই গেল। সেই সময়েই কলকাতার একদল বাবুরা এসব কুসংস্কার বিরোধী প্রচারে এসেছিল, তাদের কাছে ধরা পড়ে গেল। তাইতে...তবু বুড়োমানুষ বলে ফাঁসি হল না তো!”
অন্য পুলিশগুলো ফিরে এসেছে। একটা চালি মত জিনিস নিয়ে। ধরাধরি করে ওরা বডিটা ওতে চাপাল, সাদা কাপড় চাপা দিল গায়ে।
প্রতাপ দেখছিল। কথাগুলো শুনে অবধি ওর গা ঘিনঘিন করছিল। কিন্তু কাল রাত্রের কথোপকথন মনে করলে গায়ে কাঁটাও দিচ্ছিল। লোকটা শুধুই ফেরেব্বাবাজ বদমাশ ছিল কি?
হবে, সত্যি? ও যা চায়, হবে?
বিকেলের দিকে এক মরণপণ আর্তনাদে কেঁপে উঠল জেল চত্বর। যেন কোনো মানুষের গা থেকে জীবন্ত ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। আওয়াজের উৎস খুঁজে দৌড়ে এসে পুলিশেরা দেখেছিল, প্রতাপ মাটিতে পড়ে মৃগীরোগীর মত হাত পা খিঁচোচ্ছে, অজ্ঞান, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে।
তার আধঘন্টা আগেই, দিগেন মহান্তর শরীরটা চুল্লিতে ঢোকানো হয়েছিল।
সব মিটিয়ে থানার গাড়ি বেরিয়ে গেছে। রজত-ও যাবার জন্য তৈরি হয়ে, ওর বাইকের সামনেটায় দাঁড়িয়ে জল খাচ্ছিল বোতল থেকে। দূর থেকে প্রতাপের লম্বা চেহারা ওর দিকেই এগিয়ে আসছে দেখতে পেল। আবার কী চায় এ?
“আপনি এখনো যাননি স্যার?”
“এই যাব। তুমি এখনো এখানে কেন? বাড়ি চলে যাও!”
“হ্যাঁ স্যার। আপনাদের অনেক মেহেরবানি স্যার, ছুটে গেলাম তাড়াতাড়ি।”
নুলো দুটো জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, মুখ কৃতজ্ঞতায় কাঁচুমাচু। রজতের একটু মায়া-ই হয় এইবার। সদ্য জেল থেকে বেরিয়ে এরকম হুজ্জুতিতে ফেঁসে যাওয়া নেহাৎ খারাপ কপালেরই লক্ষণ!
তবে ছাড়া পাওয়াতে রজতদের কোনো কৃতিত্ব নেই, বলতে কী, খোঁজখবর করে, অ্যাপয়েন্টমেন্টের খাতা থেকে ঠিকানা নিয়ে প্রতাপ সিংকে তুলে আনার সময়েই তারা বুঝেছিল এ কেস ধোপে দাঁড়াবে না। তবু, যদি-ই কোনো সহকারীর খোঁজ পাওয়া যায়, টাকা দিয়ে বাড়ির চাকরটা বা আর কেউ… তাই নিয়ে আসা।
কোর্টে দাঁড়িয়ে প্রতাপের বারবার কসম খেয়ে বলা যে সে কিছু জানে না এর, এই ডাগদারবাবু তার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন, খুব যত্ন করেছিলেন সে যখন আগেরবার হসপিটালে ছিল, তাই ছাড়া পেয়ে খোঁজ করে এর কাছেই গেছিল সে, যদি কিছু নকলি হাত ব্যবস্থা করে দিতে পারেন — বোঝেনই তো, খেটে খেতে হবে…
হাঁউমাউ করে এমন প্রশস্তি করল ডাক্তারের, এত অভিসম্পাত দিল না-দেখা খুনীকে যে নিশ্চয় ও বেরিয়ে যাওয়ার পর ঢুকল, এতবার জড়ো করল কাটা হাতদুটো সবার চোখের সামনে যে বেকসুর খালাস দিতে একবিন্দুও ভাবতে হল না কাউকে। “অজ্ঞাত পরিচয় খুনী” বলে কেস ক্লোজ হল আপাতত।
“যাক, তুমি কাল হসপিটালেই যেও। আরো অনেক ডাক্তার আছেন ওখানে, ওঁরা বলে দেবেন।”
কথাটা ছুঁড়ে দিয়ে পিছন ঘুরে বাইকের দিকে পা বাড়িয়ে ছিল রজত, ব্যাপারটা তখনই ঘটল। পড়ে থাকা একটা ব্যান্ডেজ না কীসের কৌটোয় পা পড়ল তার, হড়কে একদম মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছিল রাস্তায়। পিছন থেকে দুটো বলিষ্ঠ হাত ধরে ফেলল, কানের কাছে শুনল ঘষা, ভারী, ধারালো গলা,
“দেখে স্যার! দেখে চলুন!”
রজত সোজা হয়ে টাল সামলে পিছন ফেরার আগেই তাকে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেছে লোকটা। গেটের কাছাকাছি গিয়ে একবার ফিরে তাকাল প্রতাপ, রজতের সঙ্গে চোখাচুখি হতেই একটা ধূর্ত বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল তার মুখে, তারপরই গেট পেরোনোর জন্য আরো জোরে পা চালাল সে।
পাথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল রজত। সারা গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে তার, কপালে সারিসারি ঘামের ফোঁটা ফুটে উঠেছে। ওর দশ হাতের মধ্যে এখনো অন্য কোনো লোক নেই হলফ করে বলতে পারে খানিক আগে যখন হোঁচট খেল তখনও প্রতাপ ছাড়া আর কেউ ছিল না। পড়তে পড়তে চোখের কোণে ও প্রতাপেরই কালো পাঞ্জাবিঢাকা হাত এগিয়ে আসতে দেখেছিল।
অথচ, ওর পেটের উপর ও স্পষ্ট অনুভব করেছিল দুটো হাত, হাতের পাঞ্জা, দু হাতের দশটা আঙুল।
পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি ও?
রাস্তার ভিড়ে লম্বাচওড়া কালো পাঞ্জাবিটা এখনো দেখা যাচ্ছে না ঐ? স্প্রিন্ট টানার মত দৌড়ল রজত। কী করে যেন টের পেল কালো পাঞ্জাবি, সেও দুম করে বাঁদিকে ছুট মারল।
ভিড়, ধাক্কাধাক্কি। রজতের সঙ্গে দূরত্ব কমে আসছে বুঝেই হয়তো মরণ পণ রাস্তা পার করতে গেছিল প্রতাপ।
দুদ্দাড় করে ছুটে আসা মিনিবাস দুটোর একটা স্পীড বাড়িয়ে প্রায় উড়ে চলে যাওয়া, অন্যটার মর্মান্তিক ব্রেক কষার ক্যাঁচ্চচ্চচ্ আওয়াজ, লোকজনের হইহই।
রজত বড় বড় পা ফেলে সেদিকে গেল। ওর মন বলছিল, ভাল কিছু দেখবে না।
মাথাটা ফেটে ঘিলু গড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। নিথর দৃষ্টি। পেটো পরতাবের ইহলোকের খেল খতম।
পরক্ষণেই, ঘিরে দাঁড়ানো জনতার প্রত্যেকের মতই তুমুল আঁতকে উঠল রজত। চোখের সামনে ধড়ফড় করে উঠল প্রতাপের মাথা থ্যাঁতলানো শরীরটা, চোখের সামনে তা যেন ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে আবার জোড়া লাগল।
পুলিশ আর সাধারণ মানুষের নার্ভের তফাত থাকেই। প্রাথমিক শকটা সামলে পায়ে পায়ে প্রতাপের বডিটার দিকে এগিয়ে গেল রজত। যা দেখছে, তা এতই অবিশ্বাস্য যে সে উবু হয়ে বসে পড়তে বাধ্য হল পাশে। হতভম্ব হয়ে, ঝুঁকে পড়ে সে দেখছিল তার সামনে রক্ত ঘিলু মাখামাখি রাস্তায় পড়ে আছে যে মৃতদেহটা তার হাত আর নুলো নয়, তার শরীর শুকনো দড়ি পাকানো, তার কপাল ঢালু টাক পড়া আর কাঁধ অবধি লম্বা সাদা চুল।
এবং তার চোখ খোলা।
সে চোখের মণি নড়ে উঠল এবার।
ঐ, ঐ, আবার নড়ল। রজতের চোখে সটান চোখ রাখল ওটা।
গা হিম করা হাসিটা কানে ধাক্কা দিতে আঁতকে উঠেছিল রজত, বন্দুকের গুলির মত কিছু একটা লোকটার মুখ থেকে ছুটে এসে তার হাঁ মুখে ঢুকে গেল।
এত আচমকা, কিছু বোঝার আগেই রজত ঢোঁক গিলে ফেলেছে। লিচুর বিচির মত সাইজের কিছু একটা হড়হড়ে শক্ত জিনিস গলা দিয়ে নেমে যাচ্ছে টের পেলেও আটকাতে পারল না সে। মাথা ঘুরে পাশে ঢলে পড়তে পড়তে দেখল বডিটা আবার ছিটকে ছিটকে উঠছে।
কয়েকটা মাত্র সেকেন্ড। তারপর সব স্থির। রজত উঠে বসল আস্তে আস্তে। কেউ একজন কাঁধ ধরে ওকে উঠে বসতে সাপোর্ট দিল। আরো অনেক লোক ততক্ষণে এক পা দুপা করে এগিয়ে এসেছে। গোল করে ঘিরে ধরেছে বডিটাকে।
তাদের মাঝে, রজতের সামনে নিথর নিস্পন্দ পড়ে আছে মৃতদেহটা, লম্বা ছ ফুট পেটানো শরীর, কপালে কাটা দাগ এবং দুহাত কাটা, প্রতাপ সিং।
(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)