Subscribe to Magazines





পরবাসে
রাহুল রায়ের

আরো লেখা

বই


ISSN 1563-8685




শেষের কবিতা

সেদিন সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট খেয়ে কাজে যাওয়ার আগে স্মার্ট ফোনটা খুলে বসেছি। তিনজনের জন্মদিনের নোটিশ এসেছে। দুজনকে ফেসবুকের মাধ্যমে অল্পই চেনা, আর তৃতীয়জন অতসী। ফেসবুকে গিয়ে দুজনকে ‘হ্যাপী বার্থডে’ উইশ করে দিলাম। কিন্তু অতসীকে শুকনো ‘মেনী হ্যাপী রিটার্নস ওন ইয়োর স্পেশাল ডে’ এইসব বলা আদৌ চলবে না। এমন কি ইংরেজিতে লেখা ও চলবে না। তাকে বাংলায় কবিতা লিখে জন্মদিনে ‘উইশ’ করতে হবে।

স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমার কবিতা লেখার বাতিক আছে। তার দু-একটা নমুনা আমি অতসীকে দিয়েছি, কারণ সে নিজেও কবিতা লিখত। তার মতে আমার লেখার হাত নাকি বেশ ভালো। তাই এতো বছর পর, এখন তার আবদার আমায় বাংলায় কবিতা লিখে জন্মদিনে ‘উইশ’ করতে হবে। এইভাবেই চলছে কয়েক বছর। গত বছর তার জন্মদিনে আমি কবিতা লেখার সময় পাই নি বলে বেশ নাকানি-চোবানি খেতে হয়েছিল চোখা ভাষায় – ‘হ্যাঁ, তুমি এখন বড় কবি হয়েছো, তাই আমার জন্য কবিতা লেখা হয়ে উঠছে না’, ইত্যাদি। আমার –‘না তা নয়, মানে সময় করে উঠতে পারি নি’-এ সব উত্তর আদৌ ধোপে টেঁকে নি।

আবার সে পথে হাঁটা! তাই অফিসে গিয়ে প্রথম কাজই হল আমার ল্যাপটপে বাংলা ফন্ট খুলে কবিতা লেখার তোড়জোড় করা। আজ কাজের চাপ একটু কম। তাই একটু সময় অন্য কাজে দিলে কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু, কবিতা লিখবো বললেই তো হাত থেকে কবিতা বেরোয় না। আমি তো কিছু রবি ঠাকুর নই যে বসলেই হাত দিয়ে হুড়-মুড় করে কবিতারা মার্চ করতে করতে বেরিয়ে আসবে! বেশ কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরের আকাশ, গাছ-পালার দিকে তাকিয়ে থেকে, মস্তিষ্কের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘোরাঘুরি করে, তিন কাপ চা খাওয়ার পর লিখলাম।

বন্ধু, অনেক না-পেয়ে হয়েছো তুমি কঠিন
এসো, কথায় চিঁড়ে নরম করি
জন্মদিনে কি-ই আর দিই বলো
এসো, ভালোবেসে তোমার দু-হাত ধরি
ভেসে যাই মনে মনে, ইয়ুরি গ্যাগারিন
হবে তুমি ভ্যালেন্টিনা তেরেশকোভা?
লায়লা হবে? মজনু আমি
আমি রবীন, তুমি ম্যারিয়ান
কিম্বা, তুমি গাছ হও, মহীরুহ, আমি হই ছায়া
স্কুল পালিয়ে তোমার কাছে লুকিয়ে চুমু পাওয়া।

ঝড় তুলবে, ফেসবুক আর হোয়াটস-অ্যাপ-এ?
নো বিগ ডীল, সবাই তোলে।

‘আমরা যাবো, যেখানে যাই নি কোন নেয়ে, সাহস করে’
এসো, তবে যাই সেখানে, অজানায়, তোমার জন্মদিনে।

নিজের সৃষ্টিতে নিজেই মজে গিয়ে, মনে মনে বা:-বা: বলে উঠলাম, আর চা খেয়ে ফেললাম আরো এক কাপ। এবার দেখি সে কি উত্তর দেয়। লিখতে পারে – কবিবর, তোমার কবিতায় আধুনিকতার কোয়ান্টাম জাম্পের পরশ পেয়ে আমি মুগ্ধ। ‘কবিবর’, ‘পরশ’! এ তো মান্ধাতা আমলের! ঠিক আছে, আপাততঃ চলবে। ও তো বলছে সবে নাকি আবার কবিতা লেখা শুরু করেছে। যদিও তার কোন উদাহরণ আজ পর্যন্ত পাইনি।

ফেসবুকে কবিতা-সহ উইশ-টা পাঠিয়ে দিয়ে এবার অধীর অপেক্ষা। কখন উত্তর আসে। এ ব্যাপারে তার হাত বেশ টানা। তুমি চিঠি পাঠাবে, আর উত্তর পাবে শিগগিরই। সে বান্দাই তিনি নন। অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধরো বন্ধু। কয়েক মাস আগে আমার ফেসবুক মেসেজের উত্তর পেতে দিন পনেরো লেগেছিল। কেন? কোন উত্তর নেই। পরে লিখল ‘চিঠি লেখায় আমার কেমন যেন আলসেমী লাগে।’ তবে চিঠি চাওয়া কেন! উত্তর নেই। চটে-মটে লিখেছি – ‘এটা এক ধরনের সেডিস্ট মনোভাব।’ খোঁচা খেয়ে ফল ফলেছে। সঙ্গে–সঙ্গে উত্তর। ‘সেডিস্ট, হা:, আমি সেডিস্ট! আর আমার সাথে প্রেম করতে করতে যখন অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘুরতে শুরু করলে তখন সেটা সেডিসম নয় কেন, মশাই? খালি মেয়েদের বেলাই সেডিসম। মেল শভিনিজম-এর একেবারে চুড়ান্ত।’ কি আর উত্তর দিই।

আমার অতসীর সাথে প্রেমে পড়ার মধ্যে বিশেষত্ব কিছু নেই। আমি বেশ ভালো ছাত্র ছিলাম। তাই ক্লাস টেন-এলেভেন থেকেই আমার প্রাইভেট টুইশনি করার ছাত্র-ছাত্রী পেতে কোন অসুবিধে হয় নি। তখন স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ি। মা-বাবার কাছ থেকে হাত-খরচা নিতে বেশ লজ্জা লাগে। ছাত্র-পড়িয়ে মাসের শেষে হাতে কিছু টাকা আসায় সেই লজ্জার আর কোন অবকাশ রইল না। নিজের সিগারেটের খরচা, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দু-একটা সিনেমা দেখা টুইশনির টাকা দিয়ে বেশ চলে যেত। তার সাথে জুটল প্রেম করার খরচ।

শোনা কথা যে অতসী তখন ক্লাস নাইনে কোনরকমে ঘসটাতে-ঘসটাতে এগোচ্ছে। ওর বাবা আমার বাবার খুব বন্ধু। তাই বাবার মাধ্যমে তিনি আমায় ধরে বসলেন- মেয়েকে একটু দেখিয়ে দিতে হবে। মাথাটা বোধহয় খুব খারাপ নয়। মোদ্দা কথা – গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করতে হবে। আমার যথেষ্ট আপত্তি থাকা সত্বেও বাবার বন্ধু বলে রাজী হয়েছিলাম।

অতসীর ইন্টারেস্ট কিন্তু পড়াশুনোর চেয়ে আমার ওপরেই এসে পড়ল। আমি দেখতে-শুনতে খারাপ নই। লেখাপড়ায় ভাল। কিছু অস্বাভাবিক নয়। অন্যদিকে অতসীর মাথায় ঘিলুর পরিমান কম থাকলেও দেখতে বেশ সুন্দর। আমি তখন হায়ার সেকণ্ডারি দেবো-দেবো, আর সে ক্লাস নাইন-এ পড়ে। শুরু হোল আমাদের প্রেম করা। টেবিলের তলায় ক্বচিৎ হাতে-হাত দেওয়া, পায়ের ওপর পা। অতসীদের বাড়িতে ওর ঠাকুমা থাকেন বলে ওইখানেই আমাদের শারীরিক আকর্ষণের ইতি। এর পরে অবশ্য লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েকটা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। সবসময় ভয় ছিল কেউ যদি দেখে ফেলে। সিনেমা দেখে ফিরে আসার পথে সবার চোখ এড়িয়ে রেস্তোরায় খাওয়া। আর সেখানেই, পর্দার ঘেরাটোপের মধ্যে একদিন সে দ্রুত আমার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়েছিল। দু-জনেই ঘেমে-নেয়ে একেবারে একাক্কার। এরপর দু-একবার লেকে বসে হাতে হাত দিতে দিতেই আমার হায়ার-সেকণ্ডারির গণ্ডি পেরিয়ে কলেজের জীবন শুরু। আর আমার পড়ানোর গুণ কি না জানি না, অতসী টেন থেকে ইলেভেন-এ উতরে গেছে, যদিও তিরটা বেরিয়ে গেছে প্রায় কান ঘেঁসে।

কলেজে ঢুকেই আমার জীবনে একটা মস্ত পরিবর্তন এল। বাড়ি থেকে ছাড়া পাওয়ার আনন্দ। তাই সকাল-সন্ধে লম্বা সময়ে বাসেতে ভিড়ের চাপে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে, ঘামে ভিজতে-ভিজতে কলেজ আর বাড়ি যাতায়াত করাটাও যেন ভীষণ থ্রিলিং লাগত। তারপর আছে এক ঘরে ছেলে-মেয়ে একসাথে বসে ক্লাস করা। আর ছিল কফি হাউস। সেখানে হাতের কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কাফকা-ক্যামু-সত্যজিত-কে ঘিরে আঁতলামি। হাতে-হাতে ঘুরছে সিগারেট। একটু পর দুরের একটা টেবিলে এসে বসলেন শক্তি আর সুনীল। খানিকক্ষণ পর সেখানে হাজির পূর্ণেন্দু পত্রী। এ এক অবর্ণনীয় রোমাঞ্চ।

এখানেই মণিকার সাথে এক অদ্ভুতভাবে আলাপ। একদিন এক্সিসটেনসিয়ালিসম, ক্যামু-র ‘ফল’, ইত্যাদি নিয়ে তুমুল তর্ক চলছে। আমার গলাটা বেশ একটু উঁচুতেই। এমন সময় পাশের টেবিল থেকে ঝকঝকে চেহারার একটা মেয়ে উঠে এসে আমাদের টেবিলে এসে বসল- ‘আমি মণিকা বিশ্বাস। জীয়গ্রাফি অনার্স। তোমাদের চেঁচানোর ঠেলায় বসা যাচ্ছে না।‘ তারপর, আমার দিকে একেবারে সোজা, খর-দৃষ্টি হেনে বলল- ‘তুমি কিন্তু ঠিক কথা বলছ না। আলব্যেয়র ক্যামু এক্সিসটেনসিয়ালিসম-এর প্রথম প্রবক্তা নন। তার আগে জাঁ পল-সাত্রে আছেন। আঁতলামি করতে গিয়ে ভুল ইনফরমেশন দিচ্ছ। ইয়ার্কি না কী!’

আমি তখন কোনরকমে পাশ কাটানোর পথ পাই না। কিন্তু সে মেয়ের তেজ কী! আমাকে সহজে ছাড়ান দেওয়া তার ধাতে নেই। এরপর সাত্রে, এক্সিসটেনসিয়াল ফিলসফি ইত্যাদি নিয়ে একটা লম্বা লেকচার দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। কিন্তু ততোক্ষণে কি একটা ঘটে গেছে। আমি একেবারে হেরে ভুত, তর্কে, মনের মধ্যেও।

পরে শুনেছি হৃদয়–ঘটিত অনুভবটা দু-পক্ষেরই। সুতরাং কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের দু-জনকে দেখা যেতে লাগল কলেজের সবুজ লনে, পোর্টিকোর বারান্দায়। আমার পাশে বসে মণিকা পোর্টিকোর মেঝেতে, বিশাল থামের মত দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে এক বিশেষ ভঙ্গিতে বসত। পা-দুটো উঁচু করে সামনে জড় করা আর তা ওপরে মাথাটা একটু হেলিয়ে শুইয়ে রাখা। এটা আমাদের বিশেষ সম্পর্কটা বেশ জোর গলায় সবায়ের কাছে জাহির করা। এ ব্যাপারে আমার আপত্তি ছিল, কিন্তু মনিকা আমার সব আপত্তি একেবারে নস্যাত করে দিল। এটাই ওর স্বভাব।

এদিকে আমি পড়লাম ভারী বিপদে, মণিকার সান্নিধ্য ভাল লাগে। তাকে দেখতে বেশ ভাল. কথাবার্তায়, চলাফেরায় স্মার্টনেস একবারে ঠিকরে পড়ছে। তাই একসাথে হাঁটলে সবাই আমাদের তাকিয়ে দেখে, নিজেদের মধ্যে চুপি-চুপি কি যেন বলে। তাতে মনে বেশ একটা আত্মভরীতার ভাব আসে। কিন্তু অতসীকে নিয়ে কি করি? আমার মনে অপরাধবোধ যে জন্মায় নি, তা নয়। কিন্তু আঁতলামির প্রতি আমার একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে। আর মণিকা, তার প্রখর ইন্টেলেকচুয়ালিসম দিয়ে আমার মনে একেবারে জাঁকিয়ে বসল। শীগগিরই অতসীর হাতের উষ্ণ ছোঁয়া, ভিজে ঠোঁটের স্বাদ মিলিয়ে গেল মণিকার জোরালো ব্যক্তিত্বের জোয়ারে।

এদিকে অতসী কয়েকবার বাড়িতে ফোন করে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। প্রতিবারই বাড়ির কাজের লোক বলেছে – দাদাবাবু কলেজ থেকে এখনো আসে নি। এলে বলে দেবো। আমায় যে বলে নি তা নয়। কিন্তু আমি কি উত্তর দিই! এই দোটানায় আমার আর তাকে ফোন করা হয়ে ওঠে নি। অতএব আমাদের যোগাযোগটা ক্ষীণ হতে-হতে বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

এদিকে মণিকা যেন খরস্রোতা নদী। সে দ্রুত এগিয়ে চলে আপন গতিতে। আর আমার মতো লোকের সাবধানে চলার মনোভাব তার কাছে যেন নুড়ি-পাথরের অল্প বাধার মতো। নদী একটু ঘূর্ণি তুলেই আবার নিজের পথে বেয়ে চলে। সেই স্বভাব অনুযায়ী বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মণিকা আমাকে ফেলে রেখে এগিয়ে গেল অনেকটা। আমার বদলে আর একজনকে সে খুঁজে নিল। সে আমার থেকেও স্মার্ট, আমার থেকেও বেশি তর্ক করতে দড়, আমার থেকেও বেশি জানে মৃণাল সেনের ওপরে ফ্রান্সয়া ত্রূফো আর রোসেলীনীর প্রভাব কতোটা। জানে সোরবোন ইউনিভার্সিটির তারিক আলী আর নকশালদের পদ্ধতির তফাৎ কোথায়।

এরপর কলেজ শেষ। আমি চাকরি নিয়ে চলে এসেছি উড়িষ্যায়। ভুবনেশ্বর থেকে বেশ খানিকটা দুরে প্রায় এক গণ্ডগ্রামে। ইচ্ছে করে নয়, কলেজ পাশ করার পর আর পড়তে ইচ্ছে করে নি। সুতরাং এই চাকরিটা ছাড়া তখন আর কিছু সামনে ছিল না। তাছাড়া মণিকার কাছে প্রত্যাখ্যানের জ্বালাটা তখনো মনের মধ্যে বেশ খচখচ করছিল। আর অন্যদিকে অতসীকে সরিয়ে দেওয়ার অপরাধবোধের জন্য মনটা ও ছিল বেশ ভারাক্রান্ত। কলকাতা শহরের নানা জায়গা, নানান পরিস্থিতি তখন আমায় মণিকা, অতসী এদের কথা মনে করিয়ে দিত। তাই মনটা যেন কলকাতা শহর থেকে দুরে যাওয়ার জন্য আনচান করছিল। সেই স্মৃতিগুলো থেকে অনেক দুরে গেলে হয়ত মনের অশান্তিটা কমবে – এই ছিল আমার আশা।

আমি যে জায়গায় থাকি সেখানে এমনিতেই লোকজন বেশ কম, আর বাঙ্গালী কাছে-পিঠে কেউ নেই। আমার কাজ একটা পাওয়ার প্ল্যান্টের সুপারভাইসারী করা। নামটা শুনতে গাল-ভরা হলেও আসলে আমার কাজ কুলি-কামিনদের দেখা-শোনা করা। সারাদিন কাজের পর খেয়ে-দেয়ে নিয়ে পোস্টে আসা এক সপ্তাহের পুরনো খবরের কাগজ, আর নানান বাংলা ম্যাগাজিন আর বই নিয়ে সময় কেটে যায়। ছোটবেলার পুরনো অভ্যেসে মাঝে-মাঝে কবিতা লিখতে বসি। তবে হাত থেকে বিশেষ কিছু বেরোয় না।

আমার জীবনে আর কোন নারী আসে নি। তবে এটা পিছনে ফেলে-আসা প্রেমের কথা ভেবে শরতবাবুর দেবদাসের মতো হয়ে ওঠার চেষ্টা, এমন মনে করার কোন কারণ নেই। এই পাণ্ডব-বর্জিত দেশে কোন পছন্দমতো মেয়ে-বন্ধু খুঁজে পাওয়া অলীক চিন্তা। আমার বাবা-মা আমার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এই প্রায় সভ্যতার-বাইরের জায়গায় কে আসবে। সুতরাং আমার কাছ থেকে সে ব্যাপারে কোন উৎসাহ না পেয়ে তারা হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

আমি ভেবেছিলাম বছর-খানেক এখানে থেকে, রেসুম্যেটা একটু ফাঁপিয়ে নিয়ে অন্য চাকরি নিয়ে আবার শহরে ফিরে যাব। কিন্তু এই নিঃসঙ্গতা, এই শান্ত, স্তব্ধ পরিবেশ অল্প-অল্প করে আমায় পেয়ে বসেছে। আমি এই নির্বান্ধব জীবনে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

কিন্তু,সময়ের এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে আমার সেই অভ্যস্ত জীবনেও পরিবর্তন এল। তবে কোন মানুষের কাছ থেকে নয়, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির কাছ থেকে। এখানে লোক-জনের অভাব কাটাতে এগিয়ে এল ইন্টারনেটের জাল। আর সেই জালের পাখায় ভর করে শীগগিরই যোগাযোগ হল কত হারিয়ে যাওয়া বন্ধু-বান্ধব, কতো আত্মীয়-স্বজনের সাথে। এখন ল্যাপ-টপ আর স্মার্ট ফোনে ই-মেল আর কিছুটা ফেস-বুক নিয়ে দিনের অনেকখানি সময় কাটে।

সেদিন একটা দুরভিসন্ধি মাথায় এল – দেখি অতসীকে ফেস-বুকে পাওয়া যায় কি না। সাধারনতঃ আমি এইভাবে কারোর সাথে বিশেষ যোগাযোগ করি না। তাছাড়া আমি নিশ্চিত জানি সে আমায় পাত্তা দেবে না। কারণ পুরনো রাগ সে ভুলে গেছে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। তবু চেষ্টা করতে অসুবিধে কোথায়। রামায়নে সেই হরিণের জল-খাওয়ার শব্দ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দেওয়া তির যদি লক্ষ্যভেদ করতে পারে, তাহলে আমার ইন্টারনেট-তির ঠিক জায়গায় হয়তো পৌঁছতে ও পারে। আর যদি সত্যিই তাই হয়, তখন কি করবো সে তখন ভাবা যাবে।

‘অতসী রায়’ টাইপ করতে তিনজনের নাম চলে এলো, আর তার মধ্যে অবশ্যই আছে আমার ভুতপূর্ব প্রেমিকা অতসী। প্রোফাইল পিকচারে স্বাভাবিক নিয়মে বয়স বেড়েছে বোঝা যাচ্ছে। এই সেই অতসী। সব তথ্য একেবারে মিলে যাচ্ছে। এখন সে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে থাকে স্বামীর সাথে।

প্রায় মরিয়া হয়েই একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট করে দিলাম। সে আমার সাথে যোগাযোগ না করতে চাইলে অবাক হওয়ার কিচ্ছু নেই। কিন্তু কি আশ্চর্য, পরের দিনই সে আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কনফার্ম করে দিলো। এতোগুলো বছরের পর অতসীর সাথে নতুন করে আমার ভারচুয়াল যোগাযোগ।

সে প্রথমেই বলে দিল যে সে অতীতের ঘটনা ও অপমান সে ভুলে যায় নি। এও জানাল যে সে তার স্বামীকে সব কথাই বলেছে। সুতরাং বুড়ো বয়সে লুকিয়ে প্রেম করার ব্যাপার আদৌ নয়। আরও লিখল যে সে আমার অতীতের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিশোধ অল্প-অল্প করে নেবে, চাইনীস ওয়াটার টর্চারের মত। আর আমায় তা সহ্য করতে হবে মুখ বুজে। আর যদি না পারি, তাহলে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক আবার সেই জায়গাই ফিরে যাবে।

এদিকে আমার তখন মরিয়া অবস্থা। জীবনের অনেকটা পথ হেঁটে আসার পর হঠাৎ আমার বিগত-যৌবন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে ঠেলে ফেলে দিই কী করে। সুতরাং আমার অতসীর শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় রইল না। অতএব, মাঝে-মাঝেই সে খোঁচা মারে – কি হল, আমায় ছেড়ে সেই মণিকা না কে যেন, তার পিছনে যে ছুটলে সেখানে কি পেলে? সে কি আমার চেয়েও বেশি সুন্দরী? তা, সে সুন্দরী তো তোমার মাথায় চাঁটি মেরে চলে গেল। ইত্যাদি। আমি চুপ করে সে সব খোঁচা হজম করি।

অতসীর প্রতিশোধ-পরায়ণতার আর এক রূপ হল আমার চিঠির জবাব দিতে দেরী করা। অতসীকে ফিরে পাওয়ার পর আমাদের এই ভারচুয়াল সম্পর্কটা আমার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিঠি পাঠিয়ে অধীর হয়ে অপেক্ষা করি কখন তার উত্তর পাব। বার-বারই ফোন খুলে দেখি সে কোন উত্তর দিল কী না। আমি বহুবার তাকে এ কথা বলেছি। সুতরাং আমার কষ্টটা সে ভাল করেই বোঝে। কিন্তু, এটাই তার প্রতিশোধের রূপ।

এবারে ও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। আমি কবিতা দিয়ে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে তীর্থের কাকের মতো বসে আছি। তার কোন পাত্তা নেই। দু-সপ্তাহ কাটতে চলল তবু সে চুপ-চাপ। শেষে আমি আর থাকতে না পেরে লিখলাম।

তুমি কি সেডিস্ট, না তুমি ম্যাসোকিস্ট?
আমি জ্বলছি মনে মনে,
তুমি ও কী জ্বলছো না আগুনে?
অতীতের অপরাধ, তা থাক-না অতীতেই
কি আর হবে ঘেঁটে পুরনো কাসুন্দি।

জানি, ভারচুয়াল কখনো হবে না বাস্তব
তবু, থাক না, এই দুর থেকে কাছে আসার ছেলেখেলা।

জানি, তুমি চাও প্রতিশোধ।
জর্জর করো আমায় আঘাতে-আঘাতে
হবো তোমার চলার পথে,পায়ের-তলার কার্পেট
হেঁটে যাবে ফুলিয়ে বুক, তবে এতোদিনে শোধ!
কিংবা দেবো পেতে মাথা?
কেটে নাও, তবু রাখো সাথে তোমার
সেই হবে সঙ্গ-সুখ।

কথা বলো, অতীতের স্মৃতি, কথা বলো।


এর দু-দিন বাদে একটা ই-মেল পেলাম, কে এক সুবীর রায়ের কাছ থেকে।

‘আপনি আমায় চিনবেন না। আমি অতসীর স্বামী। ওর কম্প্যুটার ঘেঁটে আপনার ই-মেল আই-ডি টা পেলাম।

সম্প্রতি আপনি অতসীকে যা লিখেছেন তা আমি দেখেছি, ও তার উত্তর দেওয়া প্রয়োজন বোধ করেছি বলে আপনাকে এই ই-মেল করা। অবশ্য এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কারণ মাস দেড়েক আগে অতসী তার জন্মদিনের কয়েকদিন পরে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আপনি জানেন কি না, জানিনা, ওর হার্ট নিয়ে সমস্যা ছিলই। সেটা খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেছে।

অতসী আপনার কথা, আপনাদের প্রেম, আপনার প্রত্যাখ্যান, বর্তমানের যোগাযোগ ইত্যাদি সব কথাই আমায় বলেছে। অল্প বয়সে এ রকম প্রেম-ট্রেম তো অনেকেরই থাকে। আমার ও ছিল। সুতরাং এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোন প্রশ্ন আমার মাথায় কোনদিন আসে নি। আমাদের সম্পর্কটা বেশ খোলামেলা। আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী।

এক অভাবনীয় সমস্যায় পড়েছি আমি। অতসী আর নেই। কিন্তু ওর ফেস বুক পেইজ বন্ধ করি কি করে? হয়তো উপায় আছে, আমি জানি না। এ এক নতুন পৃথিবী, শুধু ছবিতে বা মনে বেঁচে থাকা নয়, পৃথিবী-ছড়ানো জালে ভারচুয়াল বেঁচে থাকা। অবশ্যই আমি ওর মৃত্যুর খবর ফেসবুকে দিই নি। তাই এখনো নানান পোস্ট আসছে।

এ ছাড়াও আরও একটা ব্যাপার আছে। বেশ কিছুদিন থেকেই আমি লক্ষ্য করেছি ও কিছু লেখার চেষ্টা করছে। আগেই বলেছি আমাদের সম্পর্কটা বেশ খোলামেলা। তাই, আমার প্রশ্নের উত্তরে সে জবাব দিয়েছে আপনাকে উত্তর দেওয়ার জন্য সে কবিতা লেখা নতুন করে শুরু করেছে। না কী ছোটবেলায় লিখত। আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। ও চলে যাওয়ার পর সেই লেখার খাতা খুলে দেখি সত্যিই সে কবিতা লেখার অনেক চেষ্টা করেছে। আমি কবিতা খুব বুঝি না, কিন্তু কয়েকটি বেশ ভালোই মনে হয়েছে। খাতার একদম শেষের কবিতাটা আপনাকেই লেখা। যার জিনিষ তাকে দেওয়াই ভাল। তাই আপনাকে পাঠালাম।

কি দি-ই বলোতো তোমায়?
অল্প-যৌবনের ভুলিয়ে দেওয়া আবেগে
একদিন চেয়েছিলাম, দিতে সব কিছু
তুমি তখন মগ্ন অন্য গ্রহে।

সেই স্মৃতি আজ ধুলোয় বিবর্ণ
তবু, হয়তো রয়ে গেছে দু-একটা মনি-রত্ন, সুবর্ণ
তাই তোমার চিঠি, এখনো রক্তে আনে ক্ষণিক জোয়ার
জানলার ফাঁক দিয়ে, হঠাৎই বসন্ত।

তোমার কবিতা? ভারী তারা আধুনিক,
উজ্জ্বল। তবে মাঝে-মাঝে হারিয়ে ফেলি দিক
কথা-কাটা-কুটি খেলার গভীর জালে
হয়তো আমি না-বুঝ, কোনটা রাখি কোনটা ফেলে।

লেখোনা গো, একটা কবিতা, সহজ করে
জানি না কতোদিন আছি আর পৃথিবীতে
দাও না, সেই ছোট-বেলাকার ভুলে যাওয়া টান
ফিরে যাই সেই দিনে, স্নান ঘরে গান।

আপনি কী অস্ট্রেলিয়ায় আসেন কোন সময়? এলে জানাবেন। সিডনীর কাছাকাছি হলে হয়তো সময় করে আলাপ করা যাবে। ভাল থাকবেন।

সুবীর রায়

আমি ফেস-বুকে জন্মদিনের উইশ করা বন্ধ করে দিয়েছি।


(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)