আবছা অন্ধকারে প্রথমে লোকটাকে দেখতে পান নি বঙ্কু বিহারি। যদিও ঘরের মধ্যে একটা নাইট ল্যাম্প জ্বলছে কিন্তু সে আলোয় আজকাল আর সব কিছু ভালভাবে ঠাহর হয় না।
বঙ্কু বিহারি প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই। স্ত্রী গত হয়েছেন অনেক আগেই। একমাত্র ছেলে তার পরিবার নিয়ে আমেরিকাবাসী। নাকতলার এই দু' কামরার ফ্ল্যাটে বঙ্কু একলাই থাকেন। সকাল সন্ধে মাধবী এসে সব কাজ করে দিয়ে যায়। বঙ্কুবাবু ‘অবসরের সাথী’ বলে একটা ক্লাবের মেম্বার। বিকেলের দিকে প্রতিদিন সেখানে হাজির হন। প্রায় জনা সাতেক মেম্বার আছে। সকলেই অবসরপ্রাপ্ত। বেশ জমাটি একটা আড্ডা চলে। নানা বিষয়ে কথা হয়।
বঙ্কুর ঘটনাবহুল কর্মজীবনের গল্পও চলে মাঝে মাঝে। জীবনের সব কিছু উল্টেপাল্টে নতুন করে নেড়েচেড়ে দেখতে ভালই লাগে। কখনও কখনও সংসারের অবহেলা অনাদরের পাঁচালিও পেড়ে বসেন তাঁরা। বঙ্কুর অবশ্য সে বালাই নেই। ছেলের ওপর অভিমান যে হয় না তা নয় কিন্তু বঙ্কু এ নিয়ে বিশেষ কথা বলতে চান না। হয়তো তাঁর মনে কোথাও একটা অপরাধবোধ কাজ করে। নিজের মা বাবাকে সেভাবে কোনদিন দেখাশোনা করেন নি। বাবা মারা যাওয়ার পর মা বেঁচে ছিল বহু বছর, ছাতনায় তাদের পৈতৃক ভিটেতে। সঙ্গে থাকত ছোট ভাই অলক। পড়াশোনায় খুব মন ছিল অলকের। স্কুলে খুব ভাল ফল হত তার। যদিও অর্থাভাবে পড়াশোনা বেশি দূর করে উঠতে পারে নি সে। বঙ্কু চাইলে ভাইটাকে কি পড়াতে পারতেন না? কিন্তু বঙ্কু কলকাতায় এসে ওকালতি পাশ করে প্র্যাকটিস শুরু করলেন। ছাতনার খবর আর রাখতেন না। নিজের কাজ আর বৌ ছেলে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে মা ভাইয়ের খবর রাখার সময় হত না তার। অলক মাঝে মাঝে আসত তাদের মনোহর পুকুর রোডের বাড়িতে। গ্রামের স্কুলে একটা মাস্টারি জুটিয়েছিল। সে এলেই বঙ্কু তার হাতে অল্প কিছু টাকা গুঁজে দিতেন যাতে তাড়াতাড়ি সে গ্রামে ফিরে যায়। বঙ্কু বিহারী সমাদ্দার ছিলেন নাম করা উকিল। ফৌজদারি মামলায় হাইকোর্টে তার সমতুল্য খুব কম উকিলই ছিল। কাজেই দুহাতে টাকা রোজগার করেছেন একটা সময়ে। তখন তিনি মনে করতেন সব মানুষের সব আচরণের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে টাকা। অলক যে বারবার এখানে আসে সে তো টাকার জন্যই। বেশ বিরক্ত হতেন এই ভেবে যে ওঁর মুখে রক্ত তুলে রোজগার করা পয়সার ওপর অলকের নজর আছে। এরপর মা মারা গেল। বঙ্কু সেই শেষ বার গেছিলেন ছাতনা। তারপর অলকও আর আসে নি কখনও। ইদানীং বঙ্কু বুঝতে পারেন টাকার জন্য নয় নিভাননীর চাপেই অলক বারবার তাঁর খোঁজ নিতে আসত। বড় ছেলের প্রতি নিভাননী চিরকালই দুর্বল ছিলেন। বঙ্কু তার অন্য মানে করেছিলেন।
আজকাল বঙ্কু যেন বুঝতে পারেন সংসারে ন্যায়-অন্যায় বিচার করার জন্য সমান্তরাল একটা আদালত চালু আছে। মানুষের আদালতে বিচার হলেও সেই সমান্তরাল আদালতে বিচারের শুনানী স্থগিত থাকে। বিচার জিনিসটা বড়ই আপেক্ষিক। ব্যবিলনের রাজা হামুরাবি প্রথম যে আইনের কোড লিখেছিলেন তার গোড়ার কথা ছিল রক্তের বদলে রক্ত। কেউ যদি অন্যের মেয়েকে খুন করত, আইন অনুযায়ী অপরাধীর মেয়েকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হত। অবশ্য বাড়ির পরিচারিকার মেয়েকে খুন করলে এই আইন একটু বদলে যেত। সেক্ষেত্রে জরিমানা দিলেই কাজ চলত। সাড়ে তিন হাজার বছর আগের সেই আইনি ব্যবস্থার ধারা বঙ্কুরা আজও বয়ে নিয়ে চলেছেন। সরাসরি না হলেও ঘুরপথে। বঙ্কু ভাবতে থাকেন, আইন বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে চোখ বাঁধা মূর্তি, হাতে যার ধরা আছে তুলাদণ্ড।
আচ্ছা আইনের চোখ বাঁধা কেন? উকিল হিসাবে বঙ্কু বিচারকের চোখে অনেক ধুলো দিয়েছেন। মানে পেশার খাতিরেই দিন কে রাত প্রমাণ করেছেন বহুবার। সে তো এক প্রকার বিচার ব্যবস্থার চোখে বেঁধে দেওয়াই হল।
অনেকদিন আগের একটা কেসের কথা। তখন সবে সবে নিজে কেস হ্যান্ডেল করতে শুরু করেছেন। একটা কেস এল, মক্কেল আঠাশ বছরের জোয়ান একটা ছেলে। খুনের মামলায় ধরা পড়েছে। মক্কেলের জামিনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। মক্কেলের বাবার চেহারা আর সাজপোশাক দেখে বোঝাই যায় শাঁসালো খদ্দের। গলায় মোটা সোনার চেন, ইয়া ভুঁড়ি, দশ আঙুলে দশটা আংটি।
—হক কথা বাবু, মক্কেল ছিল বটে শাঁসালো খদ্দের।
চমকে উঠলেন বঙ্কু। কে কথা বলছে? এদিক ওদিক তাকিয়ে হাল্কা আলোয় ঠাহর করতে চাইলেন কথাটার উৎস কোথায়? নিজের মনে হেসে উঠলেন বঙ্কু। নাহ, সত্যি এবার বয়স হচ্ছে।
—হি হি, এইটা বেশ ধরেছেন, বাবুর এবার বয়স হচ্ছে তাই ভুল শুনছেন....
—কে? কাঁপা গলায় বলে ওঠেন বঙ্কু।
—আজ্ঞে, এই অধমকে কি আপনি চিনতে পারবেন?
রীতিমতো ভয় পেয়ে যান বঙ্কু। একলা থাকেন, চোর ডাকাতের পাল্লায় পড়ে এবারে কি শেষে বেঘোরে প্রাণখানা হারাতে হবে। ছেলের কথা শুনে বস্টনে চলে গেলেই হত। অবসরের সাথীর টানে একা থেকে যাওয়ার মাশুল এবার গুনতে হবে মনে হচ্ছে। আবার বঙ্কু শুনতে পান, 'না গো বাবু, অত ভেবো নি। আমি চোরও নই, ডাকাতও নই'। বঙ্কু এবার সুইচ বোর্ডের দিকে এগিয়ে গিয়ে আলোর সুইচটা কাঁপা কাঁপা হাতে জ্বালানোর চেষ্টা করলেন। দু’ তিনবার সুইচ জ্বালা নেভা করলেও আলোটা জ্বলল না। হঠাৎ কোণের দিকে চোখ পড়ল বঙ্কুর। আধ অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখতে পেলেন। রোগা দড়ি-পাকানো চেহারা, মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল; লোকটার মুখটা কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না। লোকটা ওর চিন্তাগুলো কেমন করে বুঝতে পারছে সেটাও বঙ্কু বুঝে উঠতে পারলেন না। লোকটা বলে চলেছে, 'তখন সবে সবে নাম হচ্ছে আপনার। এমন একটা শাঁসালো খদ্দের পেয়ে আপনি ছাড়তে চাইলেন না। যদিও...'।
আশ্চর্য ব্যাপার, এই কেসটা নিয়ে বঙ্কুও তো এইমাত্র ভাবছিলেন। একটা সতেরো বছরের মেয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। বাড়ির লোক থানায় মিসিং ডায়েরি করেছিল। তারপর দিন দুই পর লাশ ভেসে ওঠে বিচালি ঘাটে। মেয়েটা বঙ্কুর মক্কেল, স্থানীয় নেতা শীতল মজুমদারের বাড়ি পরিচারিকার কাজ করত।
লোকটা বলে চলে—এই হল গে বিষয়, সেই লাশের ময়না তদন্ত হল। পয়সা দিয়ে রিপোর্ট লেখাইল খুনির বাপ। মাইয়ার বাপ কেঁদে পড়ল উকিলের পায়ে। ওপরতলা থেকে পচুর চাপ আসতি লাগল। খালি মাইয়ার বাপেরে বলে, কেস চেপে দে। পার্টি মালদার আছে তোর চিন্তা নেই দেখবি তোর খেতিপূরণ মিলে যাবে। মেয়ে তোর গেছে আর ফিরে আসবেক না। কিন্তুক বাপটা গোঁ ধরলে। টাকা নয় তার বিচার চাই। রক্তের বদলে রক্ত চাই। শীতল মজুমদারের ছেলে তার আদরের মেয়েকে খুন করেছে। তার খুনের বদলা চাই। ওই ছেলেকে ফাঁসিতে চড়াতেই হবে।
—তোর আস্পর্দা তো বড় কম নয়। আমার ঘরে ঢুকে পড়ে আমারই পুরোনো কেস নিয়ে এই অসময়ে বকবক করছিস? দাঁত খিঁচিয়ে বলে ওঠেন বঙ্কু, এবার বিরক্ত হয়। এই রাতদুপুরে ভারি ফ্যাসাদ তো!
হি হি করে হেসে ওঠে লোকটা—সেইটা হক কথা কইচ। আমার ভারি হিম্মত। তুমি মাইয়ার বাপের কেসটা নিলে না। কেনই বা নেবে? লোকের বাড়ি কাজ করে খাওয়া মেয়ের বাপ তো মালদার নয়। ঝিয়ের আবার জেবনের দাম আছে নাকি? বড় নোক বলে ওই পাষণ্ডটার হয়ে তুমি কেস লড়লে। মেয়েটার বাপরে বোঝাতে লাগলে টাকা নিয়ে কেস মিটিয়ে নিত।
বঙ্কুর গলা শুকিয়ে আসছে। যেন কাঠ হয়ে আসছে শরীর। কে এই লোকটা? ও কি করে এই কেসের এত খুঁটিনাটি কথা জানল? কবেকার তিরিশ বছর আগের ঘটনা এভাবে একজন অন্য মানুষের মুখে শুনতে হবে বঙ্কুর কল্পনারও অতীত। লোকটা গলায় যেন দোষারোপের বিষ ঢেলে দিচ্ছে। মেয়ের বাবার অভিযোগ সত্যি ছিল। বঙ্কু জানতেন সেটা। শীতল মজুমদারের ছেলে এই মেয়েটাকে ধর্ষণ করে মেরে নদীতে ফেলে দেয়। বঙ্কুর তুখোড় সওয়াল জবাব আর প্রমাণ লোপাটের কারণে কেসটা জিতে যায় শীতল। তারপর থেকে ফৌজদারি মামলায় বেশ নামডাকও হয় বঙ্কুর। শীতলের দৌলতে ঝাঁ চকচকে একটা চেম্বারও হাঁকিয়ে বসেন তিনি। হ্যাঁ, আইনের চোখে কাপড় বেঁধেছিলেন সেদিন।
একটা নয় এমন বহু মিথ্যা মামলা জিতেছেন তিনি। এবার চারপাশ থেকে শুধু অট্টহাসির আওয়াজ শুনতে পান বঙ্কু। বুকের ভেতর একটা ভীষণ চাপ অনুভূব করেন। যেন কেউ গলা টিপে ধরেছে তার। দম বন্ধ হয়ে আসছে বঙ্কুর। অচেনা মানুষটার মুখের ওপর থেকে অন্ধকারের চাদরটা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। এবার চিনতে পেরেছেন বঙ্কু। তিরিশ বছর আগে খুন হওয়া মেয়েটার বাবা না! আজ তার চোখে কোন কাকুতি মিনতি নেই, সুবিচারের আকুলতাও নেই; শুধু প্রতিহিংসায় চক চক করছে সে চোখ।
হঠাৎ করেই সে মুখের আদল বদলে গিয়ে যেন অলকের মুখ হয়ে যাচ্ছে। রুক্ষ এক মাথা চুল, কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ। অলক হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বঙ্কুর দিকে আর হি হি করে হাসছে তাঁকে দেখে। মুখ ক্রমাগত বদলাতে থাকে। মিথ্যা মামলায় হেরে যাওয়া মুখগুলো ভিড় করে আসছে বঙ্কুর চোখের সামনে। দম বন্ধ হয়ে আসে বঙ্কুর।
পুবের আকাশ ফরসা হয়ে এল। একটা দুটো গাড়ি চলাচলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞ বঙ্কু বিহারি সমাদ্দার নিজের ঘরের মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছেন। চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। ঘরের ছাদের দিকে নিবদ্ধ নিথর দৃষ্টি। গত রাতে খুন হয়েছেন তিনি। সমান্তরাল আদালতে শেষ বিচারের রায় ঘোষণা হয়ে গেল।
মামলার আসামী তাঁর নিজেরই ফেলে আসা অতীত।
(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)