১
বৃষ্টির মধ্যে জুঁই ফুল থাকে। বাবা ডেকে দেখিয়েছিল, জানলা দিয়ে। স্বপ্নে এখনও মাঝে মাঝে বাড়িটাকে দেখতে পায় তিতির, বড় বড় জানলার নিচে লম্বা টানা বারান্দা, সিঁড়ি দিয়ে নেমে পাঁচিলঘেরা উঠোন। উঠোনের একদিকে তুলসীমঞ্চ, অন্যদিকে পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে আয়েশ করে দাঁড়িয়ে থাকা একটা শিউলি গাছ। বাড়িটার সামনের পিচ রাস্তায় রিক্সা থামলেই দেখত সদর সরজার সামনে এক মুখ হাসি নিয়ে দাদাভাই দাঁড়িয়ে আছে। দাদাভাই কী করে যেন জানত, ঠিক ক’টার সময় ওরা এসে পৌঁছোবে! মায়ের কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে ছুট, ছুট! মা ডাকত, “তিতির, তিতির, পড়ে যাবি...”
কে কার কথা শোনে? দাদাভাই ঝুঁকে পড়ে তিতিরকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরত। তারপর তিতিরের কাঁধ ধরে একটু তফাতে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলত “দেখি দেখি, কত বড় হল আমার তিতির-রানি? ও মা, কী সুন্দর ফ্রক!”
তিতির বলত, “বাবা পয়লা বোশেখে কিনে দিয়েছে। একী দাদাভাই! তোমার সব চুল পেকে যাচ্ছে যে, আর তুলে দিতে পারব না কিন্তু।”
দাদাভাই হাসত, কোলে তুলে নিত তিতিরকে। ঠাম্মা পিছন থেকে বলত, “রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখো না ওদের। ভেতরে আসতে দাও।”
এক দিন বিকেলবেলা আকাশ কালো করে ঝড় উঠেছিল, সঙ্গে বড় বড় ফোঁটায় মুশলধার বৃষ্টি। বাবা আজীবন এক বৃষ্টি-পাগল মানুষ। বৃষ্টি এলেই জানলার ধারে গিয়ে মাকে আর তিতিরকে ডাকাডাকি, “রাণু এসো, দেখে যাও, তিতির দেখবি আয়... কত জুঁই ফুল।”
শান বাঁধানো উঠোনে বৃষ্টি পড়ছে, রাশি রাশি সাদা সাদা ফুল ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। তিতির জিজ্ঞেস করেছিল, “বাবা, জলের ফোঁটাগুলো কি আসলে জুঁই ফুলের কুঁড়ি? মাটিতে পড়ে ফুটে উঠছে।”
বাবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, বলেছিল, “একদম ঠিক বলেছিস, দেখছিস না কত পরাগ উড়ছে হাওয়ায়।”
গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টিকণা জানলার গ্রীলের মধ্যে দিয়ে এসে বাপ-বেটির চোখ মুখ নরম করে দিচ্ছিল। মা বলেছিল, “জানলাটা দিয়ে দাও। মেয়েটার সর্দির ধাত। এক্ষুণি নাক টানবে।”
তিতির দেখছিল টারম্যাকের ওপর আজ ঠিক ওইরকম বৃষ্টি হচ্ছে। সিঙ্গাপোরের বৃষ্টির কোনো সময়জ্ঞান নেই। চড়বড় করে আসে, আবার আচমকা ফুরিয়ে যায়। ফ্লাইটে বোর্ডিং হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু তার ডানা মেলার নাম নেই, বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে, হাপুসুটি ভেজা পাখির মত বসে আছে। তিতিরের অস্থির লাগছে। কখন পৌঁছোতে পারবে কে জানে? শমীক ওর দিকে নজর রাখছিল, হাতের ওপর মৃদু চাপ দিল। বাবা হাসপাতালে অ্যাডমিটেড - খবরটা পাবার পর থেকে তিতিরের মাথা কাজ করছিল না, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। ওর অবস্থা দেখে শমীক ওকে একা ছাড়েনি, বলেছিল, “চল আমিও তোমার সঙ্গে যাব।”
ফ্লাইটের টিকিট বুক করা, অল্প-স্বল্প যা প্যাকিং করার শমীকই করেছে। তিতির কোনো কাজে মন দিতে পারছিল না। কোনোমতে ই-মেলে একটা ছুটির অ্যাপ্লিকেশান পাঠিয়ে দিয়েছিল অফিসে। এয়ারক্রাফটের জানলা দিয়ে দেখল রানওয়ের ওপর দিয়ে আবার একঝাঁক বৃষ্টি উড়ে আসছে। হাসপাতালে বাবার কেবিনে কি জানলা আছে? জুন মাসের সেকেন্ড উইক, তিতিরের জন্মের শহরে মনসুন এসে পড়ার কথা। বাবা কি জেগে আছে এখন? বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছে খোলা জানলা দিয়ে? জানলা বন্ধ ঘরে বাবা থাকতে পারত না। বলত, দম আটকে আসছে। আর মা বলত, “বড় রাস্তার ওপর ফ্ল্যাট কিনেছ, ধুলো আসছে, জানলা বন্ধ করে দাও।”
বাবা আর মা দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। বাবা উত্তরে গেলে মা অবধারিতভাবে দক্ষিণে যাবে। প্রথম বৃষ্টির পর সোঁদা মাটির গন্ধ নেবার জন্য বাবা খোলা জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আর মার মুখ ভার হত, সারাদিন জল ঝরবে, কোথাও বেরনোর জো থাকবে না। মায়ের পছন্দ ছিল পলাশ ফোটা বসন্ত। কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরা শুরু হতে না হতেই বলত, শান্তিনিকেতনে যেতে ইচ্ছে করছে খুব, যাবে? বাবা বলত, তিতিরের পরীক্ষা সামনে...। মা মন খারাপ করে বসে থাকত। কী করে যে দু-জনে দু-জনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল কে জানে?
বাবা কোত্থেকে একদিন মাকে লেখা একটা চিঠি বার করেছিল, বিয়ের আগের... কোনো বই-টইয়ের মধ্যে গুঁজে রাখা ছিল হয়তো। সেটা পড়তে পড়তে তিতিরকে বলেছিল, দেখ তিতির, তোর জন্মের আগেই মাকে তোর কথা লিখেছিলাম, এই দেখ। তিতির ভাল বাংলা পড়তে পারে না, কোনোমতে বানান করে, ভেঙে ভেঙে পড়ে। বাবাই পড়ে শুনিয়েছিল, জানো রাণু, আমি ঠিক জানি, আমাদের প্রথম সন্তান হবে - মেয়ে। তোমায় তো আমি ছোটবেলায় দেখিনি। খুব দেখার ইচ্ছে করে। মেয়ের মুখে তোমার ছোটবেলা দেখব। ও যখন একটু বড় হবে, তুমি বিকেলবেলা দুই-বিনুনি করে ওর চুল বেঁধে দেবে। চোখে কাজল টেনে, কপালের কোণে কাজলের টিপ দিও একটা, যাতে কারো নজর না লাগে। আমি অফিস থেকে ফিরলে ও এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে মুখ তুলে তাকাবে। আর আমি হাঁ করে তোমাদের মিলিমিশি সুষমা গিলব। মা কোথা থেকে এসে চিঠিটা বাবার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। বলেছিল, “তোমার আক্কেল দেখে বলিহারি যাই! মেয়েকে কী সব পড়ে শোনাচ্ছ? ছি ছি!”
বাবা বোকার মত হেসেছিল, কী অপরাধ করে বকুনি খেল বুঝতে পারেনি। তিতির জানে, প্রথমবার মা ছেলেই চেয়েছিল। তিতিরের জন্মের পরেও চেয়েছিল তিতিরের একটা ভাই হোক, হয়নি। কী সব কমপ্লিকেশান ছিল। এমনিতেও বাবাকে নিয়ে মায়ের অভিযোগের অন্ত ছিল না। বাবা ছিল নিপাট সংসারী মানুষ, চাহিদা কম, ঝামেলা ঝঞ্ঝাট ছাড়া দিন কেটে গেলেই শান্তি! বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের মানুষজনের উপকার করে, ভালবেসে খুশি থাকত, উলটে কিছু পেলো কিনা অতশত খুঁটিয়ে দেখতে যেত না। মা খোঁটা দিত, বলত, “তোমার বন্ধুদের দেখো গিয়ে। তারাও তো তোমার মত এই শহরেরই থাকে। সবাই কেমন নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে, তুমিই শুধু...”
মা কি জানত না, শহর কাউকে ছাড়ে না, চুক্তিমাফিক গুনেগুনে পাওনা-গণ্ডা আদায় করে নেয়। একবার বাবা কোনোভাবে রাস্তা হারিয়ে একটা অন্ধগলির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, যে দিকেই যায় খাড়াই পাঁচিল, অন্ধকার, বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিল না। আসলে বাবা চিরকালই সোজা-সরল রাস্তায় চলতে অভ্যস্ত, শহরের অলিগলির সুলুক-সন্ধান রাখত না... সাংঘাতিক নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। তখন তিতির ফোর কি ফাইভ, পাশের ঘর থেকে শুনেছিল, বাবা মাকে কাঁপা গলায় বলছে, “তুমি যদি সমরেশের সঙ্গে যেতে চাও, তবে যাও, আমি আর কী বলব? শুধু তিতিরকে সঙ্গে নিয়ে যেও না। সমরেশটা বাউন্ডুলে, তিতিরের অযত্ন হবে, হয়তো বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেবে...”
মা বলেছিল, “আমি চলে গেলে তোমার বলার কিছু নেই?”
তিতির উঁকি দিয়ে দেখেছিল, মার চোখে জল, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সেদিন লিভিংরুমের জানলাটা খোলা ছিল, মা বোধহয় বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। বাইরে সন্ধে নামছিল, আকাশ-ভর্তি কেব্ল টিভির তার ডিঙিয়ে কবুতরদের বাসায় ফেরার সময়। তিতির সবে স্কুল থেকে ফিরেছিল, ইউনিফর্মও চেঞ্জ করেনি। বাবার কথা শুনে তিতির কেঁদে ফেলেছিল, ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছিল, “তুমি সমরেশ আঙ্কেলের সঙ্গে কোথায় যাবে মা?”
মা তিতিরকে বুকের মধ্যে নিয়েছিল, “কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে? আমি কোথাও যাব না।”
মা সত্যিই যায়নি শেষ পর্যন্ত। মা কি এখন নার্সিংহোমে বসে আছে... বাবার বেডের পাশে, বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে? বাবাকে যতই শক্ত কথা শোনাক, বকাবকি করুক, অধিকাংশ ব্যাপারে মা বাবার ওপরই নির্ভর করে। বাবার কিছু হয়ে গেলে সেই নির্ভরতার জায়গাটা সরে যাবে। সেটা মেনে নেওয়া সহজ নয়। এসব কী ভাবছে তিতির? বাবার কিচ্ছু হবে না। এয়ারক্র্যাফটটা গড়াতে শুরু করল। তিতির চোখ বুজল। গতকাল সন্ধেবেলা খবরটা পাবার পর থেকে দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনি। তার একটু ঘুম দরকার, যদি আসে...।
২
রাণু দেখল তিতির রিসেপশান কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে একটা অচেনা ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। ছেলেটার হাতে একটা স্ট্রলিব্যাগ। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হাসপাতালে চলে এসেছে তিতির। ট্যাক্সি থেকে নামতে নামতে মাকে ফোন করেছিল। পাস না দেখালে তিতিরকে ভিতরে ঢুকতে দেবে না। তাই রাণুকেই নিচে আসতে হল। অ্যাটেন্ডান্টদের পাত্তা নেই, পুরো ওয়ার্ডে দু-জন মাত্র নার্স, তারা হাতের কাজ সেরে করিডোরে চেয়ার টেনে বসে খোশ গল্প জুড়েছিল। তাদেরকে বলে এসেছে, তিন নম্বর কেবিনের পেশেন্টের দিকে নজর রাখতে। হাসপাতালে এলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, কেবিনের নম্বর হয়ে যায়। তিতিরের চোখমুখ বসে গেছে, মাথার চুল উস্কোখুস্কো। কাছে যেতেই, রাণুর হাত চেপে ধরল, হাতের তালু বরফের মত ঠাণ্ডা। রাণু বলল, “ওয়ার্ডে দিয়েছে। আপাতত ভয় নেই। তবে অবজার্ভেসানে রাখবে আরও দু-এক দিন।”
তিতির রাণুর সঙ্গে ওয়ার্ডে এল। স্ট্রলিব্যাগটা রিসেপশানের মেয়েটার জিম্মায় রেখে ছেলেটাও এল সঙ্গে সঙ্গে। কেবিনের দরজা ঠেলে ঢুকে তিতির দাঁড়িয়ে পড়ল। বোধি ঘুমোচ্ছে। ঘুমের ওষুধ দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। মাথার মধ্যে একটা হেমারেজ হয়েছিল। ডাক্তার বলেছে আপাতত অপরেশানের দরকার নেই। রাণুর মনে হল তিতির কান্না চাপার চেষ্টা করছে প্রাণপণে। এগিয়ে গিয়ে তিতিরের পিঠে হাত রাখল। বেডের পাশে একটা স্টুল রাখা ছিল। তিতির টলোমলো পায়ে গিয়ে বসে পড়ল। রাণুর মনে হল মেয়েটা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। এত দূর ট্র্যাভেল করে এসেছে, তার ওপর দুশ্চিন্তা। বাবার কপালে হাত ছোঁয়াল তিতির। বোধি একটু নড়ে উঠল, ঘুম ভাঙল না, জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চাটল। তিতির এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের মনেই বলল, “কেবিনে একটাও জানলা নেই?”
রাণু অবাক হল, বলল, “থাকলেই বা কী হত? বাইরে ধুলোবালি... এসি চলছে... খুলে রাখা যেত নাকি?”
তিতির বলল, “তবু... কাঁচের পাল্লা হলে বাইরেটা দেখা যেত অন্তত।”
ছেলেটা চুপ করে ছিল এতক্ষণ, ইতস্তত করে বলল, “তিতির, আমি রাতে ওনার কাছে থাকতে পারি। তোমরা বরং বাড়ি ফিরে যাও, রেস্ট করো।”
রাণু গতকাল সন্ধে থেকে হাসপাতালে, শরীর ভেঙে আসছে। কিন্তু ছেলেটাকে চেনে না, জানে না, কথাটা পছন্দ হল না রাণুর, মাথা নেড়ে বলল, “না না, আমি থাকব।”
তিতির বলল, “মা, তুমি কিন্তু এবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। শমীক ঠিক সামলে নিতে পারবে, ইমার্জেন্সি কিছু হলে নাহয় আমাদের ফোন করবে।”
রাণু বুঝল ছেলেটার ওপর তিতিরের ভরসা আছে। আপত্তি করল না আর। রাত হয়ে যাচ্ছিল, দু-জনে উঠল। নিচে নেমে রিসেপশান থেকে স্ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে রেডিও ক্যাব বুক করল তিতির। রাণু জিজ্ঞেস করল, “কিছু খেয়েছিস?”
ফ্লাইটে জোর করে মুখে কিছু গুঁজেছিল, তিতির ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ... ”
নিওন সাইনের শহরে রাত হয় না, ক্যাবের টিন্টেড কাঁচের মধ্যে দিয়ে তিতির ফেলে যাওয়া শহরের ঘরবাড়ি মানুষজন দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। নকল আলোর নিচে হাইরাইজের আনাচে কানাচে নীল প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে ছাওয়া ঘরগুলোকেও বেশ মায়াময় মনে হয়। ওই দমবন্ধ অন্ধকারের মধ্যেও মানুষ সাথী খুঁজে সংসার পাতে, হাসে, কাঁদে, ভালবাসে। রাত্তিরের দিকে অবশ্য ফুর্তিবাজ মাতালেরা মহল্লার দখল নিয়ে নেয়। তাদের হইহল্লায় দিনমানের খিদে আর ঘাম বেমালুম উধাও হয়ে যায়। তিতির মাস ছয়েক আগেই ঘুরে গেছে, অথচ সব কিছুই কেমন অচেনা লাগছে, এইখানে ফুট ওভারব্রীজটা কি নতুন তৈরি হয়েছে? আজকাল রাতারাতি শহরের ভোল পালটে যায়। এক পশলা বৃষ্টি এল। রাণু জিজ্ঞেস করল, “ছেলেটা কে?”
তিতির খেয়াল করেনি প্রথমে, তার মাথাটা এখনও ভোঁতা হয়ে আছে, ক্যাবের পুরোন এসি, অনাবশ্যক হর্ণ, জানলার কাঁচে বৃষ্টির লাব-ডুব শব্দর থেকে রাণুর কথা আলাদা করতে পারেনি, অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “কিছু বলছ?”
রাণু আবার জিজ্ঞেস করল, “ছেলেটা কে?”
তিতির মুখ না ফিরিয়েই জবাব দিল, “কে শমীক? বন্ধু... ”
রাণুর জানতে ইচ্ছে করছিল, কেমন বন্ধু? কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতে ভরসা পেল না। তিতির একনাগাড়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, চোখের পাতা ফেলছে না। বিদেশ-বিভুঁইয়ে বন্ধুরাই হাত বাড়িয়ে দেয়... কিন্তু ছেলেটা যেন তার থেকে বেশি কেউ। তিতির বরাবরই স্বাবলম্বী, বিদেশে গিয়ে পড়াশুনো, চাকরি খোঁজা সব একা একাই সামলেছে। রাণু আর বোধি শুধু দূর থেকে সাপোর্ট দিয়েছে। প্রায় রোজদিনই ফোনে কথা হয় তিতিরের সঙ্গে, কখনও কখনও স্কাইপেও, ছেলেটার কথা কখনও জানায়নি আগে। ড্রাইভার জানতে চাইল, সিগন্যাল থেকে বাঁ-দিকে বেঁকবে কিনা। মা মেয়ে দুজনেই যে যার মনের গহীনে ডুবে ছিল, খেয়াল করেনি বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে। আচমকা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রাণু বলে উঠল, “নেহি নেহি, সিধা লিজিয়ে...”
বাড়ি ফিরেই চান করতে ঢুকল তিতির। শাওয়ারের নিচে গিয়ে দাঁড়ালে যদি শান্তি লাগে খানিক, মাথা হালকা হয়! রাণু গিয়ে সোফার ওপর আড় হল, চোখ লেগে আসছে ক্লান্তিতে, তিতির বাথরুমের দরজা অল্প ফাঁক করে ডাক দিল, “মা...”
যথারীতি জামা নিতে ভুলে গেছে তিতির, বাইরের দেশে গিয়ে একা একা কী করে যে থাকে মেয়েটা! তিতিরের ঘরে ঢুকে রাণু দেখল ব্যাগটা বিছানার ওপর খোলা, তার মধ্যে লাট করা তিতিরের টপ, টি-শার্ট, জিনস, ঘরে পরার আলগা পোষাক, অন্তর্বাস... সঙ্গে দু-চারখানা অচেনা শার্ট, ট্রাউজার... সম্ভবত ওই ছেলেটার... কী যেন নাম বলছিল তিতির... শমীক।
চান করে বেরিয়ে তিতির টেরেসে টাওয়েল মেলতে গিয়েছিল। এই শহরের অধিকাংশ ফ্ল্যাটেই বিল্ডার বড়জোর একটা করে গরাদ-আঁটা ব্যালকনি দেয়। খুপরি খুপরি ঘরের আয়তন বাড়ানোর জন্য অনেকে আবার সেটা ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। এক চিলতে টেরেস দেখেই বাবা এই ফ্ল্যাটটা চট করে পছন্দ করে ফেলেছিল। তিতির দেখল শখ করে সেখানে ছোট্ট এক টুকরো বাগান করেছে বোধি। শুধু সাদা ফুলের গাছ... জুঁই, বেল, টগর, গন্ধরাজ। মোতিবেলের পাপড়ির ওপর কিছুক্ষণ আগের ঝরে পড়া বৃষ্টিবিন্দু লেগে আছে এখনও। তিতির মোহিত হয়ে দেখছিল, রাণু পাশে দাঁড়াল এসে। আজ রাতে আর রান্না-টান্না করবে না, ফল কেটে খেয়ে নেবে, তিতিরকেও তাই দেবে। তিতির জানে মা শমীকের কথা জিজ্ঞেস করার জন্য উসখুস করছে। সুযোগ পেলেই একরাশ প্রশ্নর ঝাঁপি খুলে বসবে। কিন্তু এই মুহূর্তে কথা বলতে একটুও ভাল লাগছে না তিতিরের।
রাত্তিরে শোবার সময় কথাটা আলগোছে ফেলল রাণু। মা মেয়ে একসঙ্গে শুয়েছিল, রাণু বলল, “বিয়ে-থার কথা কিছু ভাবছিস তিতির?”
অন্য সময় আশকথা পাশকথা বলে তিতির এড়িয়ে যেত। বলত, এত তাড়াতাড়ি? এখনও পৃথিবীটার যে কিছুই দেখা হয়নি মা। সামনের বছর কোম্পানি থেকে প্যারিস পাঠাবে, ক্লায়েন্ট সাইটে... উইকেন্ডে ল্যুভ্রেতে মাস্টারপিস ট্যুর নেব, একটু বড় ছুটি পেলে সিমোনি চলে যাব, স্কি-রিসর্টে... । আজ কিছু ভাল লাগছে না, বলল, “মা, খুব টায়ার্ড লাগছে... ”
রাণু থামল না, বলল, “ছেলেটা কি শুধুই বন্ধু, নাকি... ?”
তিতিরের রাগ হল খুব, বলল, “মা, শমীক আর আমি খুব ভাল বন্ধু, একচ্যুয়ালি উই শেয়ার এ কন্ডো, বাট নট থিঙ্কিং অভ ম্যারেজ রাইট নাও, ইজ দিস ইনাফ, ঘুমোতে দেবে এবার?”
রাণু উঠে বসল, আতঙ্কিত হয়ে বলল, “মানে, একসঙ্গে আছিস অথচ বিয়ে করবি না?”
তিতির জোর দিয়ে বলল, “না, করব না।”
রাণু অসহায় ভাবে বলল, “কিন্তু কেন?”
তিতিরের গলায় তীব্র শ্লেষ ফুটল, “যাতে যেদিন ইচ্ছে হবে ছেড়ে চলে যেতে পারি। তোমার মতন পায়ে পা না জড়িয়ে যায়... !”
কথাটা তিতির মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। এখন আর ফিরিয়ে নেবার উপায় নেই। তিতির উঠে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। সেই কান্নার সবটা হয়তো মাকে দুঃখ দেবার অপরাধে নয়, বাবার জন্য চেপে রাখা উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্তি পেতেও খানিকটা, কেঁদে তার নিজেকে অনেকটা হালকা লাগল। অন্যদিকে রাণু তিতিরের বুকের মধ্যে নিথর হয়ে বসে রইল।
৩
বোধি বলছিল, “জানিস তিতির, খুব মাথা ধরেছিল। যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল মাথার ওপর কেউ দশ কিলোর বাটখারা চাপিয়ে দিয়েছে। রদ্দিওলার কাছে দেখেছিস তো দশ কিলোর বাটখারা? আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে চুল ছিঁড়ছিলাম... আচমকা খুব হালকা লাগল। মনে হল শরীরটাকে ছেড়ে রেখে আমি ভেসে ভেসে ওপরে উঠে যাচ্ছি, সিলিং ফ্যানটা ফুল-স্পীডে ঘুরছিল, ভয় লাগল ধাক্কা না লেগে যায়!”
কাঁচাপাকা চুল ভর্তি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বোধি হাসছিল। হাসপাতালে পৌঁছোতে ওদের একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। তিতির ঘুম ভেঙে দেখেছিল আলো ফুটি ফুটি, মা পাশে নেই। কখন উঠে গেছে কে জানে? কিচেনে কাপ-প্লেটের শব্দ পেল, মা চা বানাচ্ছে। তিতির বাসি মুখেই উঠে গেল কিচেনে। পায়ের আওয়াজ পেয়ে রাণু ফিরে তাকাল, চোখ লাল, চোখের কোল টোপা কুলের মত ফুলে আছে, গত রাতে আদৌ ঘুমিয়েছে কিনা সন্দেহ! তিতিরের বড় মায়া হল। মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মা, সরি!”
রাণু চায়ের কাপ এগিয়ে দিল, “হয়েছে, হয়েছে, আর সোহাগ করতে হবে না। নে, চা খেয়ে তৈরি হয়ে নে...”
হাসপাতালে পৌঁছে দেখেছিল বাবা শমীকের সঙ্গে গল্প করছে, দুজনের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। বাবা বলছিল, “মনে হচ্ছিল আমি একটা ল্যাজঝোলা পাখি হয়ে গেছি। ছাদের কার্নিশে বসে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছি নিচে মানুষজন চলাফেরা করছে, মেজকা সাইকেল করে বাজারে যাচ্ছে, ডাক্তার জেঠু গম্ভীর মুখে রিক্সা থেকে নামছে, বাবা হাত বাড়িয়ে ডাক্তার জেঠুর থেকে পেটমোটা ফোলিও ব্যাগটা নিল...”
রাণু কিছু না ভেবেই বোকার মত বলল, “কে, দাদাভাই?”
মা বলল, “ঠিক আছে, তোমায় আর ব্যাখ্যান করতে হবে না, যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! মেয়েটাকে পর্যন্ত হুড়তে-পুড়তে আসতে হল।”
বাবা অনাবিল হাসল, বলল, “তিতির, এসে যখন পড়েছিস, ক’টা দিন থেকে যা, দু-জনে মিলে বৃষ্টিতে ভিজব।”
মা বলল, “হ্যাঁ, তারপর বুকে সর্দি বসুক, আর আমি দৌড়োদৌড়ি করে মরি!”
বাবা বলল, “আরে, ওই জন্যই তো আবার নেমে এলাম। পাখির চোখ দিয়ে নিচে চেয়ে দেখলাম, শরীরটা ডাকছে, মা যেমন বাচ্চাকে ডাকে, আয়, আয়... আরও একটা বর্ষা দেখব, ছাদে দাঁড়িয়ে দুহাতে বৃষ্টি মাখব... হ্যাঁ গো, গন্ধরাজের কুঁড়ি এসেছিল, ফুটে গেছে?”
মা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “কে জানে, দেখার সময় পাইনি...”
রাণু তিতিরের দিকে ফিরে বলল, “শমীক সারারাত সোফায় বসে কাটিয়েছে, ওকে বাড়ি নিয়ে যা, ওর বিশ্রাম দরকার। আমি আছি, তোরা আবার সন্ধেবেলা আসিস।”
তিতির বলল, “তুমিও তো মনে হয় সারারাত জেগে ছিলে... আমি থাকি বরং, ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে ফিরব।”
রাণু বলল, “শমীক বাড়ি চিনতে পারবে না, তুই সঙ্গে যা। আমার অসুবিধে হবে না। আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নেব, আজকে বিকেলের দিকে হয়তো রিলিজ দিয়ে দেবে।”
তিতির শমীকের দিকে তাকাল, বেচারার চোখ মুখ ক্লান্তিতে কালো হয়ে আছে। তাছাড়া নতুন জায়গায় ওর একটু হারিয়ে যাবার অভ্যেস আছে। একবার অফিস ট্যুরে হংকং গিয়ে কিছুতেই হোটেল খুঁজে পাচ্ছিল না। সেখান থেকে তিতিরকে ফোন করেছিল। তিতির বলল, “ঠিক আছে যাচ্ছি, ফোন করে দিও, কিছু আনতে হলে।”
রাণু বলল, “কিছু খেতে দিস ওকে, দুধ জ্বাল দেওয়া আছে, কফি বানিয়ে দিস।”
ঘরে ফিরে শমীককে ইনস্ট্যান্ট নুড্ল আর ওমলেট বানিয়ে দিল তিতির। তারপর পারকোলেটর থেকে দু-কাপ কফি ঢেলে ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসল। শমীকের খিদে পেয়েছিল, খাওয়া শেষ করে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “খুব ভালবাস না বাবাকে?”
তিতির বলল, “মানুষটাকে তো দেখলে, ভাল না বেসে পারা যায়?”
শমীক ঘাড় নাড়ল। তারও ভাল লেগেছে বোধিকে, নিরহংকার সহজ মনের মানুষ, তিতির বলল, “ভয় হচ্ছিল, পৌঁছে যদি দেখি বাবা আর নেই, ভাবলেই বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে...”
কফি খেতে খেতেই তিতির শমীককে টেরেসে টেনে আনল। তিতিরদের ফ্ল্যাটটা থার্ড ফ্লোরে। বিল্ডিঙ কম্পাউন্ডের ভেতরেই কটা রাধাচূড়া মাথা চাড়া দিয়েছে। এখনও অল্প-স্বল্প কাঁচা হলুদ লেগে আছে তাদের খোঁপায়। জিরিজিরি পাতার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টিধোয়া ঝকঝকে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। কাল অন্ধকারে দেখতে পায়নি, আজ দেখল বোধি একটা লেবু গাছও লাগিয়েছে টবে। লেবু ধরেনি এখনও কিন্তু দু-চারটে সাদা ফুল এসেছে। তিতির লেবুর পাতা কচলে শমীকের নাকের কাছে ধরল। শমীক খুশি হল, বলল, বাঃ! বলল বটে, তারপরেই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে হাই আড়াল করল। তিতির বলল, “তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও, আমি আসছি একটু পরে...”
প্যারাপেট ওয়ালের ওপর কফির কাপ নামিয়ে রেখে নিচে তাকাল তিতির। কম্পাউন্ডের দেওয়ালে উইকেট এঁকে বিল্ডিঙের ক’টা বাচ্চা হইচই করে আন্ডার-আর্ম ক্রিকেট খেলছে। একটা বাইসাইকেল দাঁড় করিয়ে রাখা পাশে, ছেলেগুলোর কারো হবে। তিতিরের দশ বছরের জন্মদিনে বাবা সাইকেল কিনে দিয়েছিল। মা সাইকেল নিয়ে কম্পাউন্ডের বাইরে বেরোতে দিত না, তিতির কম্পাউন্ডের ভেতরেই চক্কর কাটত। একটা বদ ওয়াচম্যান ছিল, তিতিরকে সাইকেল চালাতে দেখলেই বলত, “লাইসেন্স হ্যায় কেয়া?” মনে পড়তে হাসি পেল তিতিরের। সাইকেলটা কোথায় গেল, মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
বাড়িতে এলেই যত পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। ছুটি ফুরিয়ে গেলেও ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, ধ্যুর, থেকে যাই পার্মানেন্টলি। রোদ ঢেকে মেঘ উঠছে আবার, আরব সমুদ্র থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, বৃষ্টি আসবে। মাকে একটা ফোন করা দরকার, ডাক্তার কী বলল... তিতির ভেতরে এল। মায়ের মোবাইলে ফোন করে পেল না, আনঅ্যাভেলেবল দেখাচ্ছে। ওয়ার্ডের ল্যান্ডলাইন নম্বরটা নিয়ে আসতে ভুলে গেছে। দরকার হলে মা নিশ্চয়ই ফোন করবে। গতকাল আনপ্যাক করা হয়নি পুরো, ঘরে এসে দেখল আধখোলা ব্যাগটাকে বিছানার একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে শমীক ঘুমোতে শুয়েছে। তার চোখের পাতা অল্প অল্প কাঁপছে, মনে হয় স্বপ্ন দেখছে কোনো। শমীক কি স্বপ্নের মধ্যে কখনও তিতিরকে দেখে? কে জানে? বড্ড চাপা ছেলে, মুখে কিছু বলে না, বয়সে তিতিরের থেকে বছর দুয়েকের ছোট, কিন্তু ভীষণ কেয়ারিং, সব ঝড় ঝাপ্টা থেকে তিতিরকে আড়াল করে রাখতে চায়।
মাকে কাল বলল বটে, যেদিন ইচ্ছে হবে শমীককে ছেড়ে যাবে, কিন্তু সত্যিই কি পারবে? খুব ছোটবেলায় শমীকের মা মারা যান। বাবা মার্চেন্ট নেভিতে কাজ করতেন। অবরে-সবরে বাড়ি আসতেন, সঙ্গে অনেক গিফট, চকোলেট। শমীক ঠাকুমা ঠাকুরদার কাছে মানুষ। একমাত্র বাবা-মার অনুপস্থিতি ছাড়া বাকি সব কিছুই ঠিক ছিল। অথচ বন্ধুত্ব গাঢ় হবার পর তিতির দেখেছিল ওর মধ্যে একটা নিরাপত্তাবোধের অভাব আছে, নিতান্তই অযৌক্তিক কিন্তু একটা ডিপ রুটেড ফীলিং অভ ইনসিকিউরিটি... খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যায় না। শব্দ না করে কাবার্ড খুলল তিতির। একটা একটা করে জামাকাপড় তুলে কাবার্ডে ঢোকাচ্ছিল। আচমকা টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। শমীক চমকে উঠে বসে বলল, “কে?”
তিতির দেখল মায়ের ফোন। মা জানাল ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে, আজ বিকেলে বা কাল সকালে বাবাকে ছেড়ে দেবে। মায়ের গলায় খুশির ছোঁয়া পেল তিতির। ঘরে পরার পোষাকেই বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালে শিফট করতে হয়েছিল, বাবার ট্রাউজার, শার্ট আর চপ্পল নিয়ে যেতে বলল মা। ফোন রেখে তিতির দেখল শমীক মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
শমীক ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “কিছু না...”
তিতির শমীকের পাশে বসে পিঠে হাত রাখল, “দুঃস্বপ্ন দেখেছ কোনো?”
শমীক বলল, “দেখছিলাম আমরা সিঙ্গাপোরে, তুমি লাগেজ নিয়ে কোথাও যাচ্ছ, আমি জিজ্ঞেস করলাম – কবে ফিরবে? তুমি বললে – ফিরব না তো, আর ফিরব না...”
তিতির অবাক হল, “কী যে হাবিজাবি... ফিরব না মানে? কেন?”
শমীক বলল, “জানি না...”
তিতির দেখল শমীক ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, যেন ওর স্বপ্নে দেখা মুখের সঙ্গে তিতিরের সত্যিকারের মুখ মিলিয়ে দেখছে... দেখছে তিতির আদপে অমন কথা বলতে পারে কিনা। তিতিরের কষ্ট হল, শমীকের কাছে এসে অনুনয় করে বলল, “কেন এমন ছেলেমানুষি করছ বল তো?”
শমীক তিতিরকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজল, বলল, “ছেড়ে যেও না, প্লীজ...”
মেয়েদের বুকে আশ্রয় খোঁজা ছেলেদের স্বভাব, চিরাচরিত রীতি, নতুন কিছু নয়। এইভাবে কত রাখাল-বালক মেষপালনবৃত্তি ছেড়ে কর্ষকের জীবিকা নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। চারণভূমির উবড়-খাবড় সমতল করে, বীজ বুনে ফসল ফলিয়েছে, ঘর বেঁধেছে, গ্রাম পত্তন করেছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে মেয়েরাও পোয়াতি হয়েছে, ঘরের চাতালে পা ছড়িয়ে বসে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ভেড়ার লোমের শীতপোষাক সেলাই করেছে, তবু তিতির বলল, “যদি যাই...?”
শমীক রাগ করে তিতিরকে ছেড়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল। তিতির হাসল, শমীকের চিবুক ধরে টেনে তার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। শমীকের না-ধোয়া ঠোঁটে এখনও কটু-কষায় কফি বীন্সের স্বাদ লেগে আছে। তার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে তিতিরের ভাবল, শমীক একদম বাবার মত অভিমানী।
ঠিক সেই সময় খোলা জানলায় বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি এল। তিতির শমীককে হাত ধরে জানলার ধারে টেনে নিয়ে গেল, উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দিয়ে বলল, “দেখো, দেখো...”
শমীক বলল, “কী দেখব?”
“ফুল, ফুল... কত বৃষ্টিফুল...”
তিতিরের পাগলামি দেখে শমীক হাসল, তিতিরকে কাছে টানল। শমীকের কাঁধে মাথা রেখে বৃষ্টি দেখতে দেখতে তিতির নিজেই আদিগন্ত বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছিল। তার ইচ্ছা হচ্ছিল শমীকের পাটের মতো শক্ত চুল, খড়িওঠা না-কামানো নীল চিবুকের ওপর অঝোর ধারায় নেমে আসতে, তাকে আশিরনখর ভিজিয়ে দিতে। দামাল হাওয়ার ধাক্কায় খোলা জানলা দিয়ে জলের ছাট আসছিল। শমীক একবার কেঁপে উঠল। আর কিছু না, শুধু উষ্ণতা দেবার জন্য তাকে জড়িয়ে ধরতেই তিতির টের পেল ঘরের মধ্যে ম ম করছে অজস্র জুঁই ফুলের গন্ধ। শমীকও তিতিরের দিকে অবাক হয়ে তাকাল, সেও জুঁই ফুলের গন্ধ পেল কিনা কে জানে!
(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)