Subscribe to Magazines




পরবাসে
সৌমেন ভট্টাচার্য-র

আরো লেখা


ISSN 1563-8685




বিশ্বস্ততা

কদিন রাতের কথা — একটু বেশি রাতের দিকেই হবে। গোটা পাড়া ঘুমিয়ে কাদা। দূঊঊরে কোথাও কুকুর ডাকছে একটানা, ডেকেই চলেছে। এ পাড়ার কুকুরগুলো তখনও সাড়া দেয়নি সেই ডাকে।

অনেকটা বেড়ালের মতো, প্রায় টুঁ শব্দটি না করে, পাকানো দড়ির মতো শরীরওয়ালা দুজন লোক দৌড়চ্ছিল পাড়ার বাইরে হাইওয়ের দিকে। গলায় মালা পরে দৌড়লে মালাটা যেভাবে অবাধ্য বাচ্চার মতো গলা ছেড়ে এধার ওধার ছুটে যেতে থাকে, সেভাবেই কালো একটা ব্যাগ লম্ফঝম্প করছিল তাদের মধ্যে একজনের কাঁধে। বাঁহাতে শক্ত করে ব্যাগ চেপে ধরে দৌড়চ্ছিল সে।

বড় রাস্তা দিয়ে না গিয়ে লোকদুটো বেছে নিয়েছিল সাপের মতো আঁকাবাঁকা একটা গলি যা বেয়ে মানুষজনের চোখ এড়িয়ে আরামসে পৌঁছে যাওয়া যায় পাড়া ছাড়িয়ে হাইওয়েতে। গলিটা ভালোই সরু আর আলোআঁধারিতে ভরা — আলো কম, অন্ধকার বেশি। দুপাশ থেকে সারসার বাড়ি চেপে ধরেছে গলিটাকে, যেন দু-পিস পাঁউরুটি একফালি শসা চেপে ধরেছে মাঝখানে। বাড়িগুলোর বেশিরভাগেরই পিছনদিক এই গলিতে। নেহাত দরকার না পড়লে রাতের দিকে সেখানে কারও পা পড়ে না বড় একটা। আর অত রাতে কেই বা যাবে সেখানে!

এরকম নির্জন আর অন্ধকার একটা গলিই দরকার ছিল লোক দুটোর।

একজায়গায় বেশ খানিকটা সোজা গেছে গলিটা — শ’খানেক ফুটতো হবেই। সোজা গিয়ে বাঁক নিয়েছে বাঁ হাতে। বাঁকের মুখ থেকে হাতকয়েক আগে লাইটপোস্ট — মরা আলো খানিকটা জায়গা জুড়ে। বাঁকের মুখ অবধি পৌঁছানোর আগেই ফুরিয়ে গেছে আলোটা। সেখানে আলো কম, অন্ধকার বেশি। সেখান থেকে বাঁহাতে বাঁক নিলেই এক চিলতে ফাঁকা জায়গা। বেশিরভাগ দিনই সদর দরজায় তালা মারা থাকে, এমন একখানা বাড়ির খিড়কি লাগোয়া জায়গাটা। তিনজন নাইটগার্ড তখন সবে তৈরি হয়েছে সেখানে বোতল-টোতল খুলে — রাতের আয়োজন ছোট করে। তিনজনের মধ্যে একজনের শরীরটা পালোয়ানের মতো আর তার হাতগুলো যেন কাঠের ধুমসো তক্তা। রাতে পাহারা দেওয়ার সময় বোতল না হলে তার আবার মাথায় আগুন চড়ে যায়। রোজ রাতে তারা অন্য এক জায়গায় বসে যাতে ব্যাপারটা জানাজানি না হয়। সেদিন সেখানেই বসেছিল, কেন কে জানে।

এক দৌড়ে বাঁক ঘুরেই একেবারে তিনজনের সামনে গিয়ে পড়ল লোকদুটো। সামনে গিয়ে পড়ল না বলে হুড়মুড়িয়ে তাদের ওপর গিয়ে পড়ল বললেই ঠিক হয়। আর একটু হলেই ভেঙে চৌচির হয়ে যেত বোতলটা। পড়ে গেলেও কালো ব্যাগটা কিন্তু কাছছাড়া হয়নি সেই লোকটার, যার কাঁধে ছিল সেটা। নিঝুম রাতে অত সরু একটা গলিতে আচমকাই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো দু-দুটো মানুষ গিয়ে পড়ল তিনজনের ওপর, অথচ হইহল্লা বা শব্দটব্দ হল না বিশেষ, যাতে কানে যায় আশপাশে বাড়ির কারও।

লোকদুটোকে খুব বেশিক্ষণ থাকতে হল না সেখানে। খানিকবাদে আস্তে আস্তে সরে পড়ল তারা, মানে সরে পড়তে হল।

লোক দুটো সেখান থেকে কেটে পড়ার কয়েক ঘন্টা পর, পরদিন সকালে একটু বেলার দিক করে — এই ন’টা নাগাদ — পুলিশ এল পাড়ার সবথেকে সুন্দর আর রংচঙে বাড়িতে, যার ছাদে রংবেরঙের ফুল গাছ আর শেডের তলায় দোলনা টাঙানো। সাংঘাতিক চুরি — কয়েক ভরি সোনা, লাখ দুয়েকের ওপর টাকা, দামি বিদেশি ডিজিটাল ক্যামেরা, দু-দুটো বিদেশি ঘড়ি, আরও কয়েকটা দামি জিনিস — সব হাওয়া। দোতলার বারান্দায় উঠে বাইরে থেকে ঘরের দরজার ছিটকিনি ভেঙে ঢুকেছিল চোর। তারপর আলমারি ভেঙে ...। বাড়ির লোক কিস্যু টের পায়নি সকালের আগে। তাদের অজ্ঞান করে দেওয়া হয়েছিল স্প্রে করে। আশপাশে বাড়ির লোকজনের কানেও যায়নি কিছু। ঠিকে ঝি সকালে কাজ করতে এলে জানাজানি হয় সব।

চুরির খবর পুলিশ অবধি যাওয়ার অনেক আগে, ভোর হয় হয়, এমন সময় গয়না আর ক্যামেরা সমেত কালো একটা ব্যাগ থানায় জমা দিতে যায় তিনজন লোক। তারা নিজেদের পরিচয় দেয় নাইটগার্ড বলে। শেষ রাতে যখন তারা টহল মারছে পাড়ার রাস্তায়, তখন পালোয়ানের মতো সেই নাইটগার্ড নাকি দূর থেকে একজন লোককে দেখতে পায় পাড়ার শেষ মাথায় চওড়া নর্দমার ওপর কালভার্টের পাশে, যেখান থেকে দু-পা গেলেই হাইওয়ে। লোকটা উবু হয়ে বসে করছিল কিছু একটা আধা অন্ধকারে। একটু কাছে গিয়ে পালোয়ান নাইটগার্ড যেই তার পরিচয় জিজ্ঞেস করেছে, অমনি লোকটা নাকি তড়াক করে উঠে সোজা দৌড় লাগায় হাইওয়ে ধরে। নাইটগার্ড তাকে তাড়া করেছিল কিছুদূর, কিন্তু নাগাল পায়নি। দৌড়নোর সময় লোকটার হাত থেকে পড়ে যায় ব্যাগটা। নাইটগার্ড কুড়িয়ে পায় সেটা কয়েক পা গিয়ে রাস্তার ধারে।

ব্যাগ থেকে অল্পকিছু সোনা আর একটা বিদেশি ডিজিটাল ক্যামেরা পায় পুলিশ। সুন্দর আর রংচঙে বাড়ির লোকজন চিনতে পারে সোনা আর ক্যামেরাটা। চুরি যাওয়া বাকি সোনা, লাখ দু’য়েক টাকা, দুটো ঘড়ি আর অন্যান্য দামী জিনিষগুলোর হদিশ পাওয়া যায় না কোথাও। তিনজন নাইটগার্ডকে হাল্কা বকুনি খেতে হয় পুলিশের কাছে, তাদের খবর না দিয়ে ব্যাগটা নিজেরা তুলে আনার জন্য। এরকম ব্যাগে আকছার বোম-টোম থাকে। পুলিশ জানতে চায়, উবু হয়ে বসে কিছু করছিল যে লোকটা, তাকে দেখতে কেমন। পালোয়ানের মতো নাইটগার্ড জানায়, অন্ধকারে তাকে পরিষ্কার দেখতে পায়নি সে।

আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনেক বেলা অবধি তিনজনকে বসিয়ে রাখা হয় থানায়। তারা থাকতে থাকতেই থানায় চুরির খবর আসে। তাদেরও নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িটায়, যেখানে চুরি হয়েছে।

এখনও অবধি যা জানা গেছে, বাকি মালের খবর নেই কোনও। চোরও ধরা পড়েনি। বাড়ির ঠিকে ঝি-কে তিনদফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে থানায় ডেকে। সে বেচারি ভয়ের চোটে কেঁদেকেটে একশা। নাইটগার্ড তিনজনকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাইওয়ের পাশে সেই কালভার্টের কাছে, যেখানে লোকটাকে উবু হয়ে বসে কিছু করতে দেখেছিল পালোয়ান নাইটগার্ড। কিন্তু নিটফল শূন্য। সবাই পুলিশকে দুষছে — শালারা কাজ না করে বসে খায়। পুলিশের বক্তব্য, নির্ঘাত বাইরের গ্যাং-এর কাজ। এলাকার কেউ হলে তারা ঠিক জেনে যেত।

ওদিকে সামান্য কিছুটা হলেও কমেছে সুন্দর আর রংচঙে বাড়ির মানুষগুলোর দুঃখ — সব জিনিস না হোক, অল্প কিছুটা হলেও তো পাওয়া গেছে ফেরত। আজকের বাজারে সেটাও কি কম? সেজন্য তিনজন নাইটগার্ডের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও কার্পণ্য করেনি তারা, বিশেষ করে সেই পালোয়ান নাইটগার্ডের কাছে। কিছুই তো পাওয়া যেত না সে সাহস করে না দৌড়লে।

পাড়ার লোকেরাও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

কেউ কেউ অবশ্যি প্রশ্ন তুলেছিল, তিন-তিনটে নাইট গার্ড থাকতে পাড়ায় এতবড় একটা চুরি হয় কী করে? তাহলে কী লাভ পয়সা দিয়ে তাদের পুষে?

এমনটাও বলে কয়েকজন, এতবড় একটা ব্যাপার ঘটে গেল। দু-পাঁচ মিনিটে তো আর হয়নি। তিন-তিনটে নাইটগার্ডের কেউ জানতে পারল না কিছু! তাহলে কীসের নাইটগার্ড?

তবে পাড়ার বেশিরভাগ মানুষের মত, এতবড় একটা পাড়া, মাকড়সার জালের মতো অলিগলি — তিনজন নাইটগার্ডে কী হয়! তাছাড়া, তারা তো পাহারা দেয় রাস্তায়। বাড়ির ভেতর নিঃশব্দে কিছু হলে তারা জানবে কী করে? আর তারা ছিল বলেই না অল্প হলেও ফেরত পাওয়া গেছে কিছু। চাইলেই তো তারা হাপিস করে দিত পারত যেটুকু যা ছিল কালো ব্যাগে।

এমনটাও তো বলতে শোনা যায় কাউকে কাউকে — যা দিনকাল পড়েছে, তাতে ব্যাঙ্কের লকারে না রেখে অতদামী জিনিসপত্র ঘরে রাখার দরকারটাই বা কী?

বেশিরভাগ মানুষের মতের সঙ্গে বাকিদের মত এঁটে ওঠেনি, বলাই বাহুল্য।

যা শোনা গেছে শেষ অবধি, পালোয়ানের মতো সেই নাইটগার্ড নাকি বলেছে, আরও দু’জনকে সে নিয়ে আসবে সামনের মাস থেকে রাতে পাহারা দিতে, যারা কাছেই একটা দোকানে কাজ করে। পাঁচজনে রাতভর পাড়াময় টহল দিলে নিশ্চয়ই আটকানো যাবে চুরিচামারি।

মাসকাবারি খরচা কিছুটা বাড়বে জেনেও রংচঙে বাড়ির ঘটনাটা মাথায় রেখে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে পাড়ার অনেকেই — দু-চারজন বাদে সবাই। তার কাছে পাড়ার লোকের একটাই দাবি, নতুন ছেলেগুলো যেন তাদের তিনজনের মতোই বিশ্বস্ত হয়।

(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)