ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে যে দুটি রাজনৈতিক সমস্যা ভারতবাসীকে আজও পিছুটানে বার বার বিব্রত করেছে, সেগুলি হল দেশভাগ এবং কাশ্মীর সমস্যা। দেশভাগের যন্ত্রণা ও গ্লানি নিয়ে বাংলা এবং অন্যান্য সাহিত্যেও অনেক সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলি এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু কাশ্মীর কেন্দ্রিক। স্বাধীনতার পর থেকেই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশ এবং প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান এই দুই যুযুধান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক এবং সমরনৈতিক সংগ্রাম বার বার সে অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে বিব্রত করেছে। আজও যার থেকে মুক্তি নেই। সম্প্রতি পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর বর্বরোচিত সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ ভারতের জনগণের মনে এক তীব্র ক্ষোভ এবং বেদনার জন্ম দিয়েছে। এই আবহের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখতে চেয়েছি, সেখানকার কথাসাহিত্যে কীভাবে রেখাপাত ঘটেছে নিত্যনৈমিত্তিক রাজনৈতিক অস্থিরতা। কী পর্যায়ে বারবার বিপন্ন করেছে সেখানকার জনজীবনকে। কাশ্মীর সমস্যার কোনো ঐতিহাসিক এবং কূটনৈতিক বিশ্লেষণ আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
কাশ্মীরি পণ্ডিত ও কাশ্মীরি মুসলমানদের লেখা সাম্প্রতিক কিছু ছোটোগল্পের আলোচনার সূত্রে আমরা দেখাতে চেষ্টা করব কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের বিপন্নতার স্বরূপকে।
মূল আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে কাশ্মীরের রাজনৈতিক অস্থিরতার ইতিহাসের এক সংক্ষিপ্ত রূপরেখা না দিলেও নয়। যদিও আমরা বলেছি রাজনৈতিক ইতিহাস আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। তবুও গল্পগুলি বোঝার সুবিধার্থে যেটুকু না বললেই নয়, আমরা কেবল তারই উল্লেখ করব।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পরবর্তীকালে দেশের সামনে যে সমস্যাটি খুব বাস্তব এবং আশু সমাধানের আবশ্যিক ছিল তা হল দেশীয় রাজ্যগুলির ভাগ্যনির্ধারণ। দেশীয় রাজ্যগুলি যখন ভারতীয় সংঘে যোগ দেবার অধিগ্রহণ পত্রে সই করেছিল, তখন শুধু তিনটি বিষয় ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রেই তারা সায়ত্ত্বশাসন পাবার অধিকারী ছিল। এই তিনটি বিষয় হল পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ। ফলে ১৯৪৭ এর অব্যবহিত পরবর্তীকালেই সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, পিভি মেনন রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলির ভাগ্যনির্ধারণের জন্য একটি পাকাপাকি বন্দোবস্ত করতে চাইলেন। অত্যন্ত দ্রুততায় এই কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হয়েছিল। (প্রায় দু-বছরের মধ্যে) পদ্ধতিটি খুব সরল, একরৈখিক ছিল এমন নয়। কেননা দেশীয় রাজন্যবর্গ প্রত্যেকেই খুব প্রসন্ন মনে এই অধিগ্রহণ পত্রে সই করেছিল এমন মনে করার কারণ নেই। গণতান্ত্রিক উপায়ে এদের বোঝানো ছাড়াও নিষ্কর রাজন্যভাতা সৃষ্টি, বিদেশে নানা অলঙ্কারিক পদে বসানোও হয়েছিল। এত কিছুর পরেও যারা ভারতীয় মিশনে যুক্ত হবার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছিল, তাদের জন্য নির্দ্বিধায় রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল। এরকম তিনটি দেশীয় রাজ্য ছিল জুনাগর, কাশ্মীর এবং হায়দ্রাবাদ। জুনাগরের ক্ষেত্রে ভারতকে রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছিল, কেননা সেখানকার মুসলিম শাসক মাউন্টব্যাটেনের অবিছিন্ন ভূখণ্ড নীতি না মেনে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। জুনাগরের সাধারণ মানুষ কিন্তু বিনা দ্বিধায় ভারতভুক্তির পক্ষে সওয়াল করে। ফলে বেগতিক বুঝে রাজা পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। ভারতীয় সেনা জুনাগর ঘিরে ফেলে ও সেখানকার শাসন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। ১৯৪৮ সালে জুনাগরে একটি গণভোটের আয়োজন করা হয় এবং প্রজারা একবাক্যে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকার বিষয়ে রায় দেয়। ফলে জুনাগরকে সৌরাষ্ট্র প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং জুনাগরের জন্য সৌরাষ্ট্র বিধানসভায় সাতটি আসন বরাদ্দ করা হয়।
কাশ্মীরের ভৌগোলিক অবস্থান যেহেতু জুনাগরের মতো ছিল না, সেই কারণে সেখানকার পরিস্থিতি ছিল আরও বেশি জটিল। পাক সীমান্তের লাগোয়া অবস্থানের কারনে পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের বাণিজ্যিক যোগাযোগও আগের থেকেই সুগম ছিল। মুসলিম অধ্যুষিত হবার কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক কাশ্মীর ছাড়া পাকিস্তানকে অসম্পূর্ণ মনে করতেন জিন্না এবং তাঁর অনুগামীরা। অন্যদিকে ভারতবর্ষের সেকুলার চরিত্রটিকে দৃঢ় করবার জন্য কাশ্মীরের ওপর ভারতের দাবিও ছিল উল্লেখযোগ্য। সেই সময় কাশ্মীর শাসন করতেন হিন্দু রাজা মহারাজ গুলাব সিংহ। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিলেন মুসলমান। তাঁর বংশধর মহারাজ হরি সিং সেখানকার এক ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণ ডোগরা গোষ্ঠীর সহায়তায় কাশ্মীর শাসন করতেন। শাসনকার্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ফলে ১৯৪৭ সালের পর থেকে ‘নিখিল জম্মু কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স’-এর এক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখে পড়েন মহারাজা হরি সিং। জম্মু কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সের থেকে বেরিয়ে জম্মু কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্স, পাকিস্তানে সংযুক্তির দাবি তুললেও, ন্যাশনাল কনফারেন্স, যার সঙ্গে শতকরা পঁচাত্তর ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমর্থন ছিল, তারা সে অঞ্চলের হিন্দু পণ্ডিতদের সঙ্গে নিয়ে এক ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন ডোগরা একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতায়। শেখ আবদুল্লাকে ডোগরা শাসনের বিরোধিতা করার জন্য গ্রেফতার হতে হল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর সঙ্গে শেখ আবদুল্লার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এর বহুপূর্বে, এবং আমৃত্যু সেই সম্পর্ক অটুট ছিল। যাই হোক, এদিকে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা এবং উপজাতি লোকেরা কাশ্মীরে ঢুকে ব্যাপক সন্ত্রাস শুরু করে এবং অত্যাচার চালায়। ফলে সেখানকার স্থানীয় হিন্দু রাজার পক্ষে এই সন্ত্রাসের প্রতিরোধ সম্ভব হল না। তিনি ভারতের সাহায্য চাইলেন। ভারত তাঁকে সাহায্য করতে চেয়েছিল এই শর্তে যে কাশ্মীরকে ভারতভুক্তির চুক্তিপত্রে সই করতে হবে। মহারাজা সেটাই করলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী শ্রীনগর বিমানবন্দরে অবতরণ করে পাকিস্তানি উগ্রবাদী ও উপজাতি সন্ত্রাসের মোকাবিলা করে। যদিও এই উগ্রবাদী ও উপজাতি সন্ত্রাসের পেছনে পাকিস্তানি সেনাবিহিনীর সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। ভারতীয় সেনা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে এক তৃতীয়াংশ কাশ্মীরকে দখলমুক্ত করে। বাকি অংশ যা দখলমুক্ত করা গেলনা তা রয়ে গেল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে। ইতিমধ্যে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শে নেহেরু বিষয়টি রাষ্ট্রসংঘে উত্থাপন করে বহুপাক্ষিক মীমাংসার জন্য। ভারতের পক্ষ থেকে কাশ্মীর সম্পর্কিত দাবি অনেক জোরালো ছিল এই কারণে যে মহারাজা চুক্তিপত্রে ভারতভুক্তির পক্ষে রায় দিয়েছে। দ্বিতীয়ত পাকিস্তান আগে ঘুরপথে পরে সরাসরি আক্রমণ চালায়। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সমাধানসূত্র রাষ্ট্রসংঘ দিতে পারে নি। পাকিস্তানকে সেনা সরিয়ে নিতে বলা হল। ভারতকে বলা হল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যেটুকু সেনা প্রয়োজন, সেটুকু রেখে বাকি সেনা প্রত্যাহার করতে। বলাবাহুল্য এটা স্থায়ী সমাধান নয়। শান্তিপূর্ণ রফাসূত্রের জন্য ১৯৪৮ এর এপ্রিলে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গড়ে রাষ্ট্রসংঘ। কমিটি কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য গণভোটের কথা বলে। কিন্তু সেই ভোট কোনো দিনই নেওয়া হয় নি। ভারত দাবি করে সমগ্র কাশ্মীর থেকে সমস্ত পাকিস্তানি সেনা ও উপজাতি সরে গেলে তবেই গণভোট সম্ভব। পাকিস্তানের যুক্তি হল আগে গণভোট হোক, তারপর পরিস্থিতি বুঝে সেনা প্রত্যাহার হবে। ফলে ষাটের দশক থেকে রাষ্ট্রসংঘও কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মাঝেমাঝেই দুই বিবদমান রাষ্ট্রের উত্তেজনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যার ফলশ্রুতিতে কখনো কার্গিল যুদ্ধ, কখনো বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ইত্যাদির জন্ম নেয়। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। উলুখাগড়ার প্রাণ বিসর্জন কোনো ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় না। কিন্তু সাম্প্রতিক কাশ্মীরি সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটে। গল্পের পাতায় খুঁজে নিতে ইচ্ছে হয় সেইসব মানুষদের, দুই বিবদমান রাষ্ট্র যাদের কাছ থেকে দেশ কেড়ে নিয়েছে। অদ্বয় চৌধুরী ও অভিষেক ঝা সম্পাদিত ‘কাশ্’ গ্রন্থটি এমনই বাইশটি ছোটোগল্পের অনুসৃজন যেখানে আমরা হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ছোটোগল্পকেই পেয়েছি। প্রবণতা ধরে এবার আমরা মূল আলোচনায় অগ্রসর হব।
‘রিফিউজিদের জলের মতো হতে হয়, যারা কেবল বইতেই থাকবে ... সামনে কোনো দেশ থাকে না ... দেশ থাকে পিছনে ... দেশ থাকে স্মৃতির গহ্বরে ... দেশ থাকে বৃষ্টিতে’। আসলে আমরা যেখানে লালিত হই, বর্ধিত হই, আমাদের পূর্বপুরুষ যেখানে তার শিকড় নামিয়ে দেয়, সেখান থেকে হঠাৎ কোনো রাষ্ট্রনৈতিক পরিস্থিতি যখন বাধ্য করে আমাদের ছিন্নমূল হতে, সেই বেদনা কোনো ভাষা, কোনো সাহিত্যই প্রকাশ করতে পারে না। শিকড়হীনতার যন্ত্রণা কেবলা তারাই বোঝে, যারা প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা লাভের পর এই উৎপাটনের সাক্ষী থেকেছে বাংলা, পাঞ্জাব এবং কাশ্মীর। পাঞ্জাব, বঙ্গদেশের উদ্বাস্তুরা বিগত ষাট সত্তর বছর ধরে থিতু হবার পরিসর পেয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরিরা? থিতু তারাই হয়েছে, যারা কাশ্মীরকে ছেড়ে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে এসেছে। আর যারা তা পারে নি? তাদের জওহর টানেল পেরিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে জম্মুতে। কোন রিফিউজি ক্যাম্পে অথবা ছোটো কামরার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।
সিদ্ধার্থ জিগু। (??) কথাশিল্পী ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের সিনেমা নির্মাতা। ‘পয়জন, নেক্টর’, বাংলায় ‘বিষ, অমৃত’ গল্পে তিনি দেখান রিফিউজি ক্যাম্পের দুঃসহ জীবন। বাবা মৃত্যুপথযাত্রী। তাঁর সেবায় ললিতের স্ত্রী এবং মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম। সেই সঙ্গে রাজ্যপালের প্রতিশ্রুতির বন্যা বক্তৃতা তাদের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। দু-হাজার টাকার অনুদানের বিনিময়ে এই অসহনীয় তাঁবুজীবন তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল! এমতাবস্থায় ললিতের মনে হয়, তাঁর পিতার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই হয়তো তার পরিবারের দু-জন মেয়েমানুষ মুক্তি পাবে। মৃত্যুপথযাত্রী বাবার বুকের ওপর ললিত তার মায়ের হাতটি রেখে স্ত্রীকে নিয়ে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসে। একটা ঢিবিতে বসে রাত কাটায় তাঁরা। স্ত্রী জিজ্ঞেস করে শেষ কবে তাঁর বাবা-মা-কে একসঙ্গে একে অপরকে ছুঁয়ে ঘুমোতে দেখেছে? উত্তর দিতে পারে না ললিত। এই রাত যেন দীর্ঘতম রাত। পরদিন সকালে ললিত দেখে তার মা তার বাবার ঘাড়ের ফোসকাগুলোর ওপর হাত রেখে ঘুমিয়ে আছেন। বহুদিন পর সেই ঘা গুলোকে যেন বিবর্ণ লাগে কিছুটা। আগামী দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে ললিত তাঁবুর বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় তারের জাল আকাশটাকে ফালা ফালা করে দিয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে মুক্তি খোঁজে। কিন্তু সেই মুক্তি ফালা ফালা করে কেটে যায়। তবুও তো আশা জাগে। যেমনি করে “আলোর বলয় তৈরি করে কিছু জোনাকি রাতের অন্ধকার ফুটো করে দিচ্ছিল কাছে-দূরে”।
শরণার্থী শিবিরের প্রাত্যহিক দিনযাপনের গ্লানি ধরা থাকে আতাউর মোটার ‘তারাবতী’ গল্পে। জম্মুতে বসবাসকারী এই লেখক আমাদের দেখান কীভাবে কুপওয়ারার এক পণ্ডিত পরিবারকে উঠে আসতে হয় স্বদেশ ছেড়ে জম্মুর গীতা ভবনে। শতাধিক কাশ্মীরি পরিবার একটাই বড় হল ঘরে কাটায়। শাড়ি, চাদরের বিভাজিকা। অস্থায়ী রান্নাঘরটার অবস্থা মৃত্যুপথযাত্রীর মতোই করুণ, এঁটো বাসন, কাঠকয়লা, পোড়া ধোঁয়া, বারোয়ারি উনুন আর অভুক্ত শিশুর সহাবস্থান। বারোয়ারি বাথরুমের সামনে লম্বা লাইন, শতাধিক জনগণের মাঝে গোপনীয়তা বলে কিছু আর থাকে না। উগ্রপন্থীদের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মারা যায়, তারাবতীর ছোটোছেলে রমেশ। ওদের কাছে পণ্ডিতরা সব সেনাবাহিনীর ‘মুখবির’ (দালাল)। সুতরাং কুপওয়ারা থেকে ওদের চলে আসতে হয় অন্যান্য পণ্ডিত পরিবারের মতোই। তারাবতীর আরেক ছেলে পুষ্করনাথের দুই সন্তান যখন উদ্বাস্তু শিবিরটিতে আশ্রয় নেয়, তখন ডিম্পি (পুষ্করের কন্যা) তার মাকে অদ্ভুত প্রশ্ন করত — “মা এখানে লোকজন কি শান্ত থাকতে শেখে নি? এত আওয়াজ এত চিৎকার? এদের কি জেহাদিদের ভয় নেই? আমরা বাড়ি কবে ফিরব? কবে থেকে আবার স্কুলে যাব?” তার এই জিজ্ঞাসা শুধু জিজ্ঞাসাই থেকে যায়। কেউ এর উত্তর জানে না।
কাশ্মীর নিয়ে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের একটা আবেগ কাজ করে। এই আবেগ শুধু হিন্দুর নয় অথবা মুসলমানের নয়, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেরই। সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাসবাদ কাশ্মীরি হিন্দুদের যেমন আতঙ্কিত করে, তুলনায় নগণ্য হলেও বহিরাগত মুসলিমরাও এই আতঙ্কের পরিবেশ থেকে রেহাই পায় না। পেটের দায়ে মূল ভূ-খণ্ড থেকে কাশ্মীরে জীবিকা অর্জনের জন্য কিছু শ্রমিক আশ্রয় নেয়। তাদের দিন কাটে আতঙ্ক আর অসহায়তার মধ্যে। মুহাম্মদ তাহির তাঁর ‘দ্য মাইগ্রান্ট’ (বাংলায় পরিযায়ী) গল্পে দেখান সেই চিত্র। জামাল নামে এক শ্রমিক বলে — ‘এইখানে দিনে দুপুরে মানুষ হাপিস হয়া যায়। .. সাবধানের মার নাই। মনে রাখিস এইটা তোর এক্ষনা (??) না, দিল্লি না এইটা কাশ্মীর। এইখানে সবকিছুই আলাদা”। জামাল নিজে মুসলমান। কিন্তু কাশ্মীরি নয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মধ্যে নিজেকে সে মানাতে পারে না। “জামাল জানে কাশ্মীরিদের নিজেদের মধ্যে যে এই নাড়ির টান, সেটা তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ-ধরনের সাবলীল বয়ে চলা খোশগল্প-আড্ডাবাজি দেখে প্রতিবার তার সে ধারণা আরও জোরদার হয়। তার কাছে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল, চারিদিকে এই অসম্ভব দমবন্ধ অন্ধকারের মাঝে কী অনায়াস এদের উদ্দাম জীবন উল্লাস! ... এই ছেলেপুলেদের ভিড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকলেও সে কিছুতেই মিশে যেতে পারবে না। ভিনদেশি সে। শ্রোতা। একজন সাক্ষ্যমাত্র। ... কাশ্মীরি জীবনের এই সব একান্ত নিজস্ব মেজাজগুলি কিছুতেই ছুঁয়ে উঠতে পারে না জামাল”।
প্রাত্যহিক দিনযাপনের সঙ্গে কাশ্মীরিদের জীবনে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে মোকাবিলা করাটাও একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। গুলি বারুদের শব্দ গন্ধে এদের দিন কাটে। ফলে প্রায় সব গল্পেই এই অস্থিরতার ছবি পাব। কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লড়াই এর ছবি পেয়েছি পূর্ব আলোচ্য গল্প ‘দ্যা মাইগ্রেন্ট’ (পরিযায়ী) এ। আর্মি এনকাউন্টারে দু-জন জঙ্গির মারা যাবার কথা আছে সেখানে। হুজাইফা (??) পণ্ডিতের একটি কারফিউ দিনের মৃত্যু (মূল গল্পটি কারফিউ) গল্পে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় যখন পাঁচ বছরের একটি ছোটো ছেলে নিজের চোখের সামনে তাঁর মাকে পুড়ে যেতে দেখে। গত রাতে শুতে যাবার আগে বাবা-মায়ের ঝামেলাঝাঁটি শুনেছিল সে। প্রাত্যহিক কাঁদুনি বলেই ভেবেছিল। প্রতি রাতে বাপ আড্ডা শেষে বাড়ি ফিরলে তার মা রোজই কাঁদে। কিন্তু সকাল বেলায় সেই অসহায়তা, সেই যন্ত্রণা, ধুঁকতে থাকা জ্বলতে থাকা রাগ — সে দেখেছিল মায়ের পুড়ে যাওয়া শরীরে। ক্রমাগত কেঁদে কেঁদে বাইরে বেরিয়ে এসে পড়েছিল। বছর তিরিশের আর্মি অফিসার ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে কী হয়েছে এর? বেমালুম মিথ্যে কথা বলে লোকটি। বলে ওর মা বাপের বাড়ি চলে গেছে বলে কাঁদছে ছেলেটি। সপাটে এক চড় কষায় আর্মি। লোকটির গালে। বাইরে বেরিয়েছিস কেন? শালা জানিস না কারফিউ চলছে?” নিজের বাবা হয়েও ঘেন্নার দলা ছুড়ে বাচ্চাটির দিকে। ‘আম্মি আম্মি’ বলে ফুপিয়ে ওঠে বাচ্চাটা। জোরে লাথি কষায় বাচ্চাটার দিকে “মাদারচোদ, -বাড়ি যা, নইলে তোকেও ওপরে তোর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেব। বাঞ্চোত শালা কুত্তা জঙ্গির বাচ্চা”। মা মরে, পুড়ে, ঝরে গেছে। বাবাটা ‘জান্তব আনন্দে চেয়ে দেখে কীভাবে বাচ্চাটা পেট চেপে আস্তে আস্তে উঠে বসে। কচি নাকের ফুটোয় এক চিড়িক রক্ত জমে আছে। ... চোখে জল জমে যায় আবার। বাচ্চাটা ফিরে যায় বাপের সঙ্গে।
উগ্রপন্থার বলি হওয়া আর এক করুণ কাহিনি আমাদের শোনাল সাব্রিনা ভাট। সাব্রিনা পেশাগতভাবে Free Press Kashmir এর সাংবাদিক। গল্পকারও বটে। তাঁর লেখা গল্পের জন্য তিনি ‘কাশ্মীর উপত্যকা কৃষ্টি আকাদেমি প্রতিশ্রুতিমান লেখক পুরস্কার’ পেয়েছেন ২০১৬ সালে। মূল গল্পের নাম ‘হার ডার্ক ওয়ার্ল্ড’। মূল গল্পটি উর্দুতে রচিত। উর্দু থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন হুজাইফা পণ্ডিত। বাংলায় অনুবাদ করেন অধীশা সরকার। বাংলায় এর নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘অশ্রুহীন’। কাশ্মীর উপত্যকায় এক কিশোরী ইনশা তার ছোটো বোন বিনিশকে বলেছিল অশ্রুর ইতিকথা। ইনশা ডাক্তারি পড়ছে। সে বোনকে বলে প্রকৃতি কত সুন্দর পরিকল্পনায় সাজায় আমাদের শরীরের কেমিক্যালগুলো। যখন আমরা কাঁদি, তখন আমাদের অশ্রু ফিল গুড হরমোন তৈরি করবে আমাদের শরীরে, যাতে আমাদের মনের ভার লাঘব হয়। দুই বোনের এই কথোপকথনের সময় হঠাৎ উগ্রপন্থীদের ফাটানো শেল জানালা দিয়ে ঢুকে রক্তাক্ত করে ইনশাকে। প্রানে বাঁচলেও চোখ দুটি বাঁচে না। কোনোদিন দেখতে পাবে না সে। এমনকি মনের ভার লাঘবের জন্য অশ্রুও বের হবে না সেই চোখদুটি থেকে। ইনশা সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে লড়াই করছিল। অশ্রুহীন দৃষ্টিহীন ইনশার আর মনের ভার লাঘবেরও কোনো পথ রইল না। হাসপাতালের বেডে শুয়ে ইনশা কতদিন চুপ করেছিল তা আর নিজেরও মনে নেই। অবশেষে একদিন সে তার মা’কে বলে ‘মা আমি কি আর ডাক্তার হতে পারব?’ সেই মুহূর্তে, ইনশার মায়ের চোখ দিয়ে লবণাক্ত অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল।
সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ টিকে থাকতে দেয় না সুস্থভাবে। দীর্ঘদিন যাবৎ কাশ্মীরে বসবাসকারী হিন্দু পরিবারও আতঙ্কিত হয়, মুক্তির জন্য কাশ্মীর ছেড়ে যেতে চায় কেউ। কেউ আবার যায় না। ‘ইনফর্মার’ দীপক বুডকির (??) লেখা। এখানে দেখানো হয় এক হিন্দু দম্পতির শেষ বয়সে এসে আতঙ্কে দিন যাপনের ছবি। উৎকন্ঠা ভয় নিয়ে সর্বক্ষণ কাটানো অরুন্ধতীর মনে পড়ে তাঁর যৌবনের সময়কার কথা। বয়স তখন তাঁর ১৮। বর্ডারের ওপার থেকে উপজাতিদের আক্রমণ, ধর্ষণ ইত্যাদির বর্ণনা শুনতে শুনতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের শিড়দাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বয়ে যেত। যুবতী মেয়েরা ইলেকট্রিক শক খেয়ে মরেছিল ধর্ষিতা হবার ভয়ে। সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনার সূত্রে বর্ডারের ওপার থেকে উপজাতিদের আক্রমনের প্রসঙ্গে মনে পড়ে।
গওহর গিলানি পেশায় একজন সাংবাদিক। কাশ্মীরি রাজনীতি বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি কাগজে লেখালেখি করেন। তাঁর লেখা একটি গল্প ‘সন্ত্রাসবাদী তানভীর সংক্রান্ত দু’চারটে কথা’। মূল গল্প ‘এ ফিউ ওয়ার্ডস কনসার্নিং তানভীর, দ্য টেররিস্ট’। কোনো প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র মুসলমান হবার কারণে বছর তিরিশের যুবক, তনভীরকে টেররিস্ট তকমা এঁটে দেওয়া হয়। অথচ কোনো সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে সে জড়িত নয়। গল্পের Narrative technique একটু অন্য ধরনের। প্রথম এক পাতায় পুরনো কাশ্মীরের অলি গলির সম্পর্কে দু চারটে কথা বলে তনভীর সম্পর্কে আসেন কথক। বলা হয় — ‘এখানে শিক্ষা ততটাই দূরের পথ যেখানে পৌঁছালে আপনি কারাকোরাম পর্যন্ত জয় করতে পারেন’। আর্মি এখানে এসে নাকাবন্দি, তদন্ত এসবের প্রয়োজন বোধ করে না। মাইকে ঘোষণা হয় ‘ইয়ে আজাদি কে জঙ্গ লড়নেমে হাম তৈয়ার হ্যায়। ... ইস লিয়ে .... একটা শব্দ বুউউম। ব্যাস, এ গলির মসজিদ লাগোয়া সাতটি বাড়ি খতম”। কথক তনভীর সম্পর্কে কিছু বলার আগে বলেন, তনভীর সম্পর্কে কয়েকটা গুরুত্বহীন কথা একটি সাদা কাগজে লিখে রেখেছিলেন, গল্পে ফুটনোট হিসেবে জুড়ে দেবেন বলে। কিন্তু কাগজটা আর খুঁজে পান না। ফলে স্মৃতি থেকে বলে যান। “... কাশ্মীর আর সন্ত্রাসবাদের ভেতর কোনটা মূল গল্প আর কোনটা ফুটনোট? কাশ্মীর গল্প হলে সন্ত্রাসবাদের ফুটনোটে কী লেখা হবে? সন্ত্রাসবাদ গল্প হলে কাশ্মীরকে ফুটনোট হিসেবে কীভাবে লেখা হবে? এরপর ১/২/৩/৪ করে তানভীর বিষয়ক একটি প্রস্তাবিত ফুটনোট দেন লেখক। যেখানে কোথাও ছেলেটি সম্পর্কে সন্ত্রাসবাদের কোনো নাম গন্ধ নেই। কাম্যুর ‘দ্য রেবেল’ উপন্যাস যার ব্যাগে থাকত যে মোহোসিন হামিদের লেখায় কাম্যুর লিখনশৈলীর প্রভাব নিয়ে সেমিনার পেপার লেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে, যে সদ্য ইউনিভারসিটিতে ঢোকা একটি মেয়েকে বই উপহার দেয় তার ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে সে কীভাবে সন্ত্রাসবাদী হতে পারে? যার ডায়েরির পাতা জুড়ে একটি লাইনই বারবার ঘুরে ফিরে আসে — “এরকমই এক অক্টোবরের বিকেলে একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যানেভাবে ঝরতে থাকা চিনার পাতাদের নিয়ে তুমি চলে যাও বারবার”। ডাউন শ্রীনগরের বাসিন্দা সেই তনভীর উধাও হয়ে যায় এক বিকেলে। ডাল লেকের ধারে ভিড়ে চুপসে পড়ে থাকতে দেখা যায় ‘দ্য রেবেল’। “কুপওয়ারাতে সেদিনের দুপুরে আর্মির একটা ট্রাকে গুলি চালিয়েছে কারা যেন”।
সাম্প্রদায়িকতা, সন্দেহ, অবিশ্বাস, হিংসা, রক্ত উপত্যকাকে পরিণত করেছে এক সাক্ষাৎ নরকে। মানুষে মানুষে বিশ্বাসই আজ তলানিতে। নইলে বিজয় আর রউফ — যারা কিনা ছেলেবেলা থেকে বেড়ে উঠেছে দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধুর মতো, যারা দু’জন দু’জনকে ছাড়া থাকতে পারত না, তারাই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জর্জরিত হয়। বন্ধুত্ব সরে যায়। আসে অবিশ্বাস। আর তার চাইতেও বড় প্রতিশোধ। সুশান্ত ধর জম্মুতে বসবাসকারী তরুণ লেখক। তার লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় এবং ওয়েবজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। তিনি আমাদের শোনান এই দুই বন্ধুর গল্প নাম ‘অ্যাভেঞ্জড’। বাংলায় ‘উশুল” অনুসৃজন (সৌরভ চট্টোপাধ্যায়)।
গল্পের কথক একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত। লেখক, নাম ব্যাধকাক। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে নির্বাসনে থাকাকালীন মারা যান। ৪৭ এর উপজাতি হামলায় বাবা মা’কে হারান। এই ব্যাধ কাকেরই প্রতিবেশী ছিলেন বিশ্বম্ভর নাথ। যার দুই ছেলে। বিজয় এবং রমেশ। বিশ্বম্ভরের স্ত্রী হলেন আশা। উগ্রপন্থীরা মেরে ফেলতে চেয়েছিল বিশ্বম্ভরকে। নেহাত বাড়ি ছিল না সে। রহমান বাড়ি ফিরতে দেয়নি বিশ্বম্ভরকে। উগ্রপন্থীরা তল্লাশির নামে বাড়ি তছনছ করে। শেষে বিশ্বম্ভরের এক ছেলে রমেশকে তুলে নিয়ে গিয়ে বন্দুকের বাঁট দিয়ে নাক-মুখ থেতলে হত্যা করে। মৃতদেহের উপর পেচ্ছাপ করে। সারা গায়ে সিগারেটের পোড়া দাগ। মৃতদেহ দাহ করার সময় রউফ আসে বিজয়কে ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য সমবেদনা জানাতে। কানে কানে বলে — ‘শোন্, এই সব লোক ন্যায়ের পথে, পরবর্দিগারের পথে। কারণ ছাড়া এরা খুন করে না। রমেশ নিশ্চয়ই কিছু করেছিল, এরা নির্দোষকে মারে না। এরা শুধু খোঁচড়দের মারে। কেঁদে লাভ নেই। আমি পরবর্দিগারকে ডাকব যেন সব ঠিক হয়ে যায়’। স্তম্ভিত হয়ে যায় বিজয়। প্রতিটি শব্দ যেন কানে গাঁথা হয়ে যায়। গ্রাম ছেড়ে দেয় বিজয়ের পরিবার। তাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। বাড়ি বিক্রির জন্য ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে। কয়েক বছর পর বিজয় জানতে পারে রউফের বাবাকে সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। বাড়ির অমত সত্ত্বেও বিজয় গোটা রাত পেরিয়ে সকালে গ্রামে পৌঁছে সোজা চলে যায় যেখানে শেষকৃত্য হচ্ছে। বিজয়কে দেখে জড়িয়ে ধরে রউফ। চিৎকার করে কেঁদে বলে ‘দেখ বিজয় দেখ, আমার বাবার সঙ্গে ওরা কী করেছে!’
বিজয় রউফকে জড়িয়ে ধরে। কাছে টেনে নেয়। কানে কানে বলে “এরা সবাই ভগবানের পথে, সত্যের পথে। নির্দোষকে এরা মারে না। তোর বাবা নিশ্চয়ই কিছু করেছিলেন। এরা কারণ ছাড়া খুন করে না। ওরা শুধু খোঁচড়দের মারে। আমি ভগবানকে ডাকব, সব ঠিক হয়ে যাবে”। বহু বছর ধরে রউফের বলা যে কথাগুলো বিজয়কে বহুবার কাঁদিয়েছে, সেই একই পরিস্থিতিতে একই কথা ফিরিয়ে দিতে পেরে বিজয় যেন মুক্তি পেতে চায় যন্ত্রণা থেকে। ভয়ে আর বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে মাটিতে বসে পড়ে রউফ। আর বিজয় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাড়ির পাশের পুকুরটিতে স্নান করে জম্মুগামী বাসে চেপে বসে।
সবই তো হল। আর গল্পের সংখ্যা বাড়িয়ে উদাহরণ টেনেই বা কি লাভ? এখন প্রশ্ন হল এর পর কোথায়? এর শেষ কোথায়? যে পথে রক্ত, বিপন্নতা, অবিশ্বাস সে পথের কী আজও শেষ নেই? সরকার গড়েছে বিজেপি। নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় দফায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের পিছনে সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে যাওয়া পুলওয়ামা কাণ্ড এবং তার প্রতিশোধ নিতে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক তাঁকে কতটা এগিয়ে নিয়ে গেছে তা তো রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ব্যাপার। আমাদের আলোচ্যও তা নয়। তবে সেনাবাহিনীর সাফল্যে দেশবাসী গর্বিত। এ গর্ব মোদীর জন্য না সেনাবাহিনীর জন্য সে প্রশ্ন উহ্যই থাক। কিন্তু আমাদের যে প্রশ্ন বারবার ভাবায় তা হল বিগত ২৮জুন ২০১৯ আনন্দবাজার পত্রিকার একটি সংবাদ শিরোনাম “কাশ্মীরে ‘ভয়’ অস্ত্র অমিতের”। রিপোর্টে জানানো হচ্ছে ‘ভয় হওয়া চাই। ভয় থাকা দরকার। বিশেষ করে যারা দেশের বিভাজন চায়, তাদের ভয় পাওয়াই উচিত’ আজ লোকসভায় দাঁড়িয়ে এই ভাষাতেই হুঁশিয়ারি দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বুঝিয়ে দিলেন কাশ্মীরে সন্ত্রাস দমন অভিযান এখনই থামবে না। বরং প্রয়োজনে দমননীতি বাড়ানো হবে। অমিত শাহের কথায় রোগকে সমূলে নাশ করতে হলে যদি কড়া ওষুধের প্রয়োজন হয়, তা হলে তা দিতে হয়। ভারতের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে কোনোরকম আপস না করাই একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। প্রতিটি সচেতন নাগরিকই একবাক্যে তা স্বীকার করবে। কিন্তু সেই দমননীতি যদি কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, জঙ্গিদের বর্বর উল্লাস আর সেই সঙ্গে দুই রাষ্ট্রশক্তির পেশিশক্তি যদি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে, তবে তা ভয়ের বই কি! অতি সম্প্রতি ২০১৯, জুলাই মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের নয়া রিপোর্টে সেই প্রশ্নকে আরও একবার জাগিয়ে তুলেছে। আনন্দবাজার পত্রিকার ৮ জুলাই ২০১৯ এ একটি সংবাদে জানানো হচ্ছে — ‘কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনের নয়া রিপোর্টের কড়া সমালোচনা করল ভারত। দিল্লির দাবি, এই রিপোর্ট ‘অসত্য’। রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে তৈরি হওয়া রিপোর্টের এমন তিক্ত সমালোচনা সাম্প্রতিক অতীতে হয়নি বলেই মনে করছেন কূটনীতিকেরা। ... মানবধিকার কমিশনের রিপোর্টে পাকিস্তানেরও সমালোচনা করা হয়েছে। তাদের দাবি গত বছরের রিপোর্টে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল, তা নিয়ে কোনো পদক্ষেপই করেনি পাকিস্তান”। দিল্লির বক্তব্য সীমান্ত পারে সন্ত্রাসে মদত দেবার প্রসঙ্গটি গুরুত্বই দেওয়া হয় নি। বিগত বছরে কাশ্মীরে যত সংখ্যক নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেটা বিগত দশ বছরে সর্বোচ্চ। অথচ ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং প্রশাসন শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য চেষ্টার অন্ত রাখে নি।
ক্রমাগত ঘটে চলা এই বাতাবরণ তৈরি করেছে ক্ষয়িষ্ণু এক আগামী প্রজন্মকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবদিক থেকে দাম দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ক্রমশ বাড়তে থাকে মনোরোগীয় সংখ্যা। শাহনাজ বাশির এর লেখা ‘নিউজ অফ ডেথ’ গল্পে দেখানো হয় সরকারী চাকুরিজীবি আবদুল রশিদ মালিককে। যে কিনা হন্যে হয়ে খবরের কাগজে খুঁজে চলে মৃত্যুর খবর। একটিও মৃত্যুর খবর না থাকা — এ তো মেনে নেওয়া যায় না। অবশেষে সহকর্মীর কাছ থেকে পাওয়া ‘ভ্যালি টাইম্স’ এ ছোটো করে এক মৃত্যুর খবর খুঁজে পায়। শিরোনামে ‘ইয়ুথ কিলড ইন মিশান উইথ আর্মি ট্রাক।’ ছোট্ট এই মৃত্যুর খবর তাঁর কাছে ‘সত্যিকারের মৃত্যু’র খবর হয়ে উঠতে পারে না পুরোপুরি। তবুও দিনের শেষে এতেই সে একরকম তৃপ্তি খুঁজে পায়। কী বুঝলাম আমরা? ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন?” অথবা ‘হৃদয়টা নষ্ট শশা আর পচা চালকুমড়োর মতো’ বীভৎস হয়ে গেছে?
বিলাল হান্ডুর ‘এ লেটার ফ্রম তিহার’ গল্পে নির্দোষ সাবির আলিকে ধরে নিয়ে যায় মিলিটারী। স্রেফ সন্দেহের বশে পাঁচ বছর জেল খাটতে হয়। মা বারণ করেছিলেন পই পই করে। দাড়ি না রাখতে। শোনেনি সে। আশাই ছেড়ে দিয়েছিল বাড়ির লোক। অবশেষে তিহার থেকে দিদিকে চিঠি লেখে ভাই সাবির আলি। অশ্রু আর বাধা মানে না; বাড়ি ফেরার পর শাহিনা দেখে ভাই নিজের মনে হাসছে, অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করছে। মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। “বিধ্বস্ত কাশ্মীর। মানসিক রোগ বাড়ছে। মায়েরা, যাদের ছেলেরা হারিয়ে গেছে, তারা আছে। আছে জেরাকেন্দ্র থেকে ছাড়া পাওয়া কিশোরের দল। অল্পবয়সি বিধবা বা বউ। ডাক্তার মার্সুরের ক্লিনিকটা একটা বিষণ্ণ কাশ্মীর”। গল্পটা পড়তে পড়তে মনে পড়ল কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গ সংবাদের একটি রিপোর্ট। ৬ জুলাই ২০১৯। ঐদিনের রিপোর্টের শিরোনামটি ছিল — কাশ্মীরে বাড়ছে মাদকে আসক্তি, দাবি রিপোর্টে’। খবরটি করেছেন সাবির ইবন ইউসুফ। খবরটিতে জানানো হচ্ছে — “মোটের ওপর রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত কাশ্মীরি সমাজে দ্রুত বাড়ছে মাদকাসক্তের হার। অন্তত শ্রীনগরের মহারাজা হরি সিং হাসপাতালের একদল চিকিৎসকের গবেষণায় তেমনই তথ্য উঠে এসেছে .... শ্রীনগর গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজের মানসিক চিকিৎসা বিভাগের প্রধান আরশাদের মতে ‘গত ৩০ বছর ধরে চলা অশান্তির ফলে উপত্যকার প্রায় সব পরিবার কোনও না কোনো ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন কাশ্মীরে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। সন্ত্রাস আর পাল্টা অভিযানের আবহে কার্যত বন্দির জীবনযাপন করছেন কাশ্মীরবাসী। মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ার পেছনে এটা বড় কারণ”।
জনসংযোগ বাড়িয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রেখে সমস্যার গভীরে পৌঁছানো সম্ভব। ভারতীয় সেনাবাহিনী সেই কাজ বহু বছর আগে থেকে যদিও করে আসছে। বর্তমানে সে দিকে আরো নজর দেওয়া আশু কর্তব্য। ‘ভয়’ অস্ত্র হয়তো উগ্রপন্থার প্রতিরোধ ঘটাবে। কিন্তু সামগ্রিক কাশ্মীর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ছাড়াও সামাজিক সমস্যার সমাধানে ভয় নয় ভালোবাসা প্রয়োজন। সুগত বসু বলেছেন আমাদের দেশ কাশ্মীরকে বস্তুগত নয় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখুক। তবে হয়তো মনের অসুখের কিছুটা হলেও নিরাময় সম্ভব।
গ্রন্থ ঋণ :
১। পলাশি থেকে পার্টিশান ও তারপর : শেখর বন্দোপাধ্যায়
২। আধুনিক ভারত : সুমিত সরকার।
৩। ‘কাশ’ : সম্পাদনা অদ্বয় চৌধুরী ও অভিষেক ঝা। বৈভাষিক প্রকাশনী।
(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)
অলংকরণঃ ??