The Prophet—Khalil Gibran; Publisher: Fingerprint Classics, NewDelhi; Reprint 2017; ISBN: 978 81 7234 354 5
এতটা বয়স পেরিয়ে এসে মনে হয়, সত্যিই তো, এমন কতো ভালো বই এখনও পড়া হয়ে উঠলো না এ’জীবনে, যার পাঠ বিনা জীবনটাই কিনা বৃথা!
*
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে, ঊনিশশ’ ত্রিশের দশকে ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছর বয়সী এক আরবী-চিত্রকর ঘুরে বেড়াতেন নিউ ইয়র্ক শহরের পথে পথে, পকেটে দারুর বোতল। দরিদ্র, অনাথ। তাঁর মায়ের মতো দিদিও দর্জি ছিলেন। তিনিই ভাইয়ের সাহারা। এর এক দশক আগেই এই যুবকের বিপ্লবী কিছু লিখন তাঁর স্বদেশ লেবাননে ব্যান্ করেছে সাম্রাজ্যবাদী অটোমান সরকার। আটলান্টিকের দুই পারেই ততদিনে এই যুবক খলিলের চিত্র-প্রদর্শনীর অনুষ্ঠান হয়ে গেছে। এমন এক ‘অভাজন’ পেল প্রভুর অহৈতুকী কৃপা। লিখলেন-আঁকলেন যুগান্তকারী দ্য প্রফেট গ্রন্থ—এক ‘কাব্য-উপন্যাস’! এতাবৎ অন্তত অর্ধশতাধিক ভাষায় যার অনুবাদ হয়েছে; আজও যা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা অধিক বিক্রীত গ্রন্থের মর্যাদা পায়। আর, এক কবি হিসেবে? শেক্সপীয়র ও রুমি ছাড়া আর কারো কাব্য/নাটক ‘দ্য প্রফেট’-এর চেয়ে বেশি পঠিত হয়নি সারা বিশ্বজুড়ে।
*
ভাগ্যিস সির্ফ্ ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’ ছাড়াও কোনো অ-সাধারণ গ্রন্থের ‘পরিচিতি’-ও পরবাস-সম্পাদকমশায় এলাউ করেন এখানে ছাপতে, নৈলে এ’হেন কলোসাল কাব্যের ‘সমালোচনা’ করবার ক্ষ্যাম্তা বা ইচ্ছা কোনোটাই নাই এই কলমচির; শুধু মোহগ্রস্তের মতো এক ঝরনার কলতানপূর্ণ কাব্যোপন্যাসের রূপবর্ণনা—ভাষায়-রেখায় যা মূর্ত। হ্যাঁ, এ’গ্রন্থের চিত্রনও জিব্রান-সাহেব-ই (১৮৮৩-১৯৩১ খৃ.) খোদ করে গেছেন—যিনি বড় চিত্রি না বড় কবি—বিতর্ক আছে তা নিয়ে।
*
‘Love’, ‘Marriage’, ‘Children’, ‘Giving’… এমন এমন ছাব্বিশটি কাব্যাধ্যায়ে নিষিক্ত ইঙ্গভাষায় লিখিত এই উপন্যাস—যে-ভাষা খলিল আমেরিকা আসবার পরে শেখেন, এবং শেখেন অতি আয়াসে, কারণ আবাল্য অতি মেধাবী ও শিল্পীমনের ছাত্র ছিলেন খলিল। এ’ কাব্যের নায়ক আল মুস্তাফা বিদেশি আরফালিস শহরে বারো বৎসর কাটিয়ে যখন দেশে ফেরার জন্য জাহাজে উঠতে যাবেন, সে-দেশের মানুষজন তাঁকে জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। ছাব্বিশটি অধ্যায় জুড়ে প্রেম-বিবাহ-আহার-বিহার থেকে শাস্তি-প্রার্থনা-আনন্দ-সৌন্দর্য-ধর্ম....কী নিয়ে নয়... রয়েছে অপূর্ব কাব্যরসে জারানো কাহিনী... যেমন—
“Who knows but that which seems omitted today, waits for tomorrow/ Even your body knows its heritage and its rightful need and will not be deceived/ And your body is the harp of your soul,/ And it is yours to bring forth sweet music from it or confused sounds….” [Chapter 23: Pleasure]. আবার, মজার কথা হলো, খলিল জিব্রানের এই The Prophet এক শ্রেষ্ঠ ‘spiritual novel’-এর স্বীকৃতি পেলেও এখানে কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কই গাওয়া হয়েছে, ঈশ্বরের সঙ্গে নয়, যেটা ওঁর এই Prophet trilogy-র তৃতীয়গ্রন্থ The Death of the Prophet-এর মূল উপজীব্য [আমি পড়িনি]।
*
Prophet কে? অভিধান বলেন, যিনি সত্যদ্রষ্টা, যাঁর মধ্য দিয়ে সর্বশক্তিমান নিজের ইচ্ছা নিজের বক্তব্য নিজের আদেশ প্রকাশ করেন, তিনিই Prophet. এই Prophet তো তাহলে কেবল ইসলামেই মাত্র আবির্ভূত হতে পারেন তা নয়, তিনি তো সর্বদেশে-কালে-ধর্মে ছিলেন আছেন থাকবেন। তিনি আছেন বিশ্বাসীর মনের গহনে। প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই দেখি তায় সকলখানে! কিন্তু Prophet এর আগে ‘The’ বসিয়ে কবি যেন সেই মহান "সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম"-কেই বোঝান, যদিও কাব্যের কোথাও তা প্রাঞ্জল করা হয়নি, পাঠকের উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ’বই তাই কোনো বিশেষ ধর্মের জন্যে নয়, এ’বই মানুষের; এতে বর্ণিত দর্শন তাই ‘জিব্রানবাদ’ (Gibranism) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আশ্চর্য নয় তাই যে উনি দীর্ঘ এগারো বৎসর ধরে এ’মহাগ্রন্থ লিখেছেন এঁকেছেন কেটেছেন মুছেছেন ফের লিখেছেন—নিখুঁত করেছেন, নিবিষ্ট হয়েছেন এতে। প্রথম প্রকাশ ১৯২৩-এ’, যখন কবির বয়স চল্লিশ মাত্র, প্রয়াণের আট বছর আগে। এটাও তাই আশ্চর্যের নয় যে আজ এক প্রধান শিখ ধর্মগুরু যেমন জিব্রানের মানবতাবাদ নিয়ে মাতামাতি করেন, তেমনই সালমা হায়েকের মত অতিবিখ্যাত হলিউডী নায়িকা তাঁর উপরে এক অসামান্য ছায়াছবি বানান।
মহান শিল্প, আসলে, দেশ-কাল-ধর্মের ঊর্ধ্বে—কথাটা কি মিথ্যা?
পুনঃ খলিল জিব্রান কিন্তু একজন মুসলমান ছিলেন না, তিনি ছিলেন ইস্টার্ন ক্যাথলিক কৃশ্চান!
চিরসখা হে—কিশোর ঘোষাল; নিজ প্রকাশন; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৭; ISBN 978-1-63535-787-5
একটি ভরোসাতেই এই গ্রন্থের সমালোচনা লিখতে সাহসী হয়েছি।
গুণিজনে বলে গেছেন যে ‘শ্রীমদ্ভগবতগীতা’-কে পূর্ণরূপে জানা যায় না, কেউ জানতে পারেনি, জানা সম্ভবও নয়। তাই এই অপার সমুদ্রে ডুবে মরলেও মরণ সার্থক, তরে গেলে তো কথাই নেই।
আকৈশোর বামপন্থী শিক্ষায় গীতাকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে ভাবতে শিখে এসেছিল এক পশ্চাদপক্ক; মানহাট্টান প্রজেক্টের উপরে জাঙ্গক্-সাহেবের লেখায় রবার্ট ওপেনহাইমারের ‘দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ্যুগপদুত্থিতা...’-শ্লোক আউড়ানোর গল্প পড়ে প্রথম গীতার কাব্যমূল্যের দিকে আকৃষ্ট হয়, পরে ঘরে রাখা গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষের টীকা, বা ‘গীতার গান্ধীভাষ্যে’র পৃষ্ঠা উল্টিয়ে এর মূলভাবের প্রতি।
বর্তমান গ্রন্থের মধ্যবয়সী লেখক পেশায় একজন কৃতবিদ্য এঞ্জিনিয়র তথা আজকের বঙ্গসাহিত্যের এক প্রতিনিধিস্থানীয় লেখক। এঁর অবস্থাও তথৈবচ। পরিপক্ক বয়সে এসে উনি শ্রীমদ্ভভগবতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন, ও টীকা-ব্যতিরেক এক নির্মেদ ভাষান্তর করেছেন এই মহাগ্রন্থের যার জুড়ি চট করে খুঁজে পাই না। কোনো টীকা নয়, ভাষ্য নয়, ভাগবতে ঠিক যে-কথা বলা আছে, বঙ্গভাষী পাঠকের হাতে তার ঠিক ঠিক ভাষান্তর তুলে দাও, বুঝে নিতে দাও তাঁকে—এ-ই হলো লেখকের প্রয়াস, এবং এতে সফল তিনি, তাঁর সৎ প্রয়াসকে দিই সাধুবাদ। সওয়া শ’ পৃষ্ঠার মধ্যে শ্রীমদ্ভগবতের আঠেরোটি অধ্যায়ের সাতশত শ্লোকের নির্মেদ নির্ভার বঙ্গানুবাদ আগে পাইনি হাতে।
*
শ্রীমদ্ভগবতগীতাঃ
অধ্যায় | শীর্ষনাম | শ্লোকসংখ্যা |
প্রথম | অর্জুনবিষাদ যোগ | ৪৬ |
দ্বিতীয় | সাংখ্যযোগ | ৭২ |
তৃতীয় | কর্মযোগ | ৪৩ |
চতুর্থ | জ্ঞানযোগ | ৪২ |
পঞ্চম | সন্ন্যাসযোগ | ২৯ |
ষষ্ঠ | ধ্যানযোগ | ৪৭ |
সপ্তম | জ্ঞানবিজ্ঞান যোগ | ৩০ |
অষ্টম | অক্ষরব্রহ্ম যোগ | ২৮ |
নবম | রাজযোগ | ৩৪ |
দশম | বিভূতিবিস্তার যোগ | ৪২ |
একাদশ | বিশ্বরূপদর্শন যোগ | ৫৫ |
দ্বাদশ | ভক্তিযোগ | ২০ |
ত্রয়োদশ | ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগ যোগ | ৩৫ |
চতুর্দশ | গুণত্রয়বিভাগ যোগ | ২৭ |
পঞ্চদশ | পুরুষোত্তম যোগ | ২০ |
ষোড়শ | দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগ যোগ | ২৪ |
সপ্তদশ | শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগ যোগ | ২৮ |
অষ্টাদশ | মোক্ষসন্ন্যাস যোগ | ৭৮ |
মোট ৭০০ শ্লোক |
সওয়া শ’ পৃষ্ঠার মধ্যে এই সাতশত শ্লোকের মূল বক্তব্যটা জানতে পারা যাবে এই গ্রন্থে।
*
এই রকম জেনে কী লাভ? এ-ই কি শ্রীমদ্ভগবত-কে জানবার পদ্ধতি?
পরমকরুণাময়ের পায়ে সম্পূর্ণ সমর্থনের সপক্ষে অষ্টাদশতম অধ্যায়ে [অন্তিম অধ্যায়] শ্রীগীতা গেয়েছেন, “তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত....” ইত্যাদি [শ্লোকঃ ৬২], কিশোরবাবু যার প্রাঞ্জল অনুবাদ করেন, “হে ভরতকুলশ্রেষ্ঠ অর্জুন, জীবনের সর্ব বিষয়ে তাঁর শরণাগত হও, তাঁর অনুগ্রহে পরম শান্তি ও শাশ্বত পরম ব্রহ্মপদ লাভ করবে।” আবার আরেক ধর্মগ্রন্থে পড়ি, “ওহে বিশ্বাসী, এসো, সমর্পণের [ইসলামের] মার্গে। শয়তানের পথে যেও না; সে তোমার ঘোষিত শত্রু।” [আল বাকারা, ২:২০৮]
আবার, নিউ টেস্টামেন্টে রয়েছে, “Submit yourself, then to God. Resist the devil, and he will flee from you.” [James 4:7 ]
এই এই রকম পাঠ বড়ই আকর্ষণীয় নয় কি? এমন করে পড়তেও তো ‘bare text’-এর প্রয়োজন হয়, যাতে কিশোরবাবুর বর্তমান অনুবাদটি সহায়ক।
*
‘বিশ্বরূপদর্শন’-কে [একাদশ অধ্যায়] গীতার শ্রেষ্ঠ অংশ বলা হয়, যেখানে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের প্রকৃত রূপ প্রত্যক্ষ করে স-বিকল্প থেকে নির্বিকল্প সমাধিস্তরে প্রবেশ করেন। অনবদ্য এর তেত্রিশতম শ্লোকঃ “তস্মাত্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব....” ইত্যাদি। ... ‘তোমার বিপক্ষের যোদ্ধারা আমার হাতে আগেই মারা গিয়েছে, হে সব্যসাচী, এখন তুমি শুধু উপলক্ষ হও’। এখানে সম্বোধনের প্রথমায় অনুবাদক ‘সব্যসাচি’ লিখলে পারতেন, মূলে যেখানে ‘সব্যসাচিন্’ রয়েছে।
এহ বাহ্য। ছোট্ট পরিসরে মহাগ্রন্থের সুখপাঠ্য অনুবাদ করেছেন লেখক, সাধুবাদ প্রাপ্য তাঁর—এই অনুভূতিটাই ধরা থাক্।
*
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে সাত অক্ষৌহিণী নারায়ণী সেনা নয়, ‘চিরসখা’ কৃষ্ণকে সপক্ষে পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন গুড়াকেশ অর্জুন। তিনিই পিতা, তিনিই মাতা, তিনিই বন্ধু, তিনিই সখা। চিরসখা! তাই এই বইয়ের নামকরণ ভালো লেগেছে, ময়ূরপুচ্ছধারী প্রচ্ছদবিন্যাসও ।
*
এতাবৎ অসংখ্য টীকা লেখা হয়েছে গীতার, কিন্তু তা সত্ত্বেও গীতা তেমনই থেকে গেছে, আদিরূপে। তার ভাব ফুরিয়ে যায়নি। মহাকবি তুলসীদাসজী তাই গেয়েছেন, “সব জানত প্রভু প্রভুতা সোঈ। তদপি কহেঁ বিনু রহা ন কোঈ।।”—গীতার বিষয়ে যদি কেউ কিছু বলেন তাহলে বাস্তবে তিনি তাঁর নিজেরই পরিচয় দেন।
সবশেষ এই কথাটি মানতে হবে।
ভারতের মুক্তিসংগ্রাম ও বাংলার মুসলমান--সৌম্য বসু; যৌথ পরিবেশকঃ ‘এডুকেশন ফোরাম’+‘দেশ প্রকাশন’; প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০১৮; ISBN নং নাই
আজকের ভারতে অসহিষ্ণুতার রাজনীতির জমানায় এটি একখানি মাথায় করে রাখার মতো বই!
তিন বছর আগে, চৌষট্টি সংখ্যায় এই গোত্রের আরেকখানি বই পড়ে মন ভরে ছিল, সেটির প্রেক্ষাপট অবিশ্যি ছিল ভারত জুড়ে, এটির কিন্তু অনেক প্রাণের কাছে, বাংলার।
*
বৌদ্ধ-হিন্দুর বঙ্গদেশে দ্বাদশ শতকে ইসলামের আগমন, আসলে, কিন্তু ঘটেছিল বখতিয়ার খিলজীর তলোয়ারে নয়, শাহ্ জালালের সুফি প্রেমবাণীতে। চিনির মতো মিষ্টি বচন ছিল বলে লোকমুখে যাঁর উপাধিই হয়ে গিয়েছিল ‘গঞ্জশক্কর’ সেই শেখ ফরিদ-সাহেব আরেক আদি ইসলামী প্রেমপুরুষ, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পঞ্জাব থেকে যাঁর আগমনে পূত হয়েছিল বঙ্গদেশ--সে-পদধুলি ছড়ানো বাঙলার ঘাসে ঘাসে মাঠে বাটে। মূলত অ-যোদ্ধা, পেলব কৃষিজীবী বঙ্গবাসীর কাছে তাই শান্তি-সাম্য-প্রেমভাব নিয়েই ইসলামের আগমন-আকর্ষণ-বিকাশ, প্রবল রাজশক্তি হিসেবে নয়। বস্তুত, এর দীর্ঘ ছয় শত বৎসর পরে অষ্টাদশ শতাব্দীতে শরীয়তুল্লাহ্-দুদুমিঞার ফরায়েজী আন্দোলনের আগে গোঁড়া ইসলামী ধর্মসংস্কারের পথে হাঁটেইনি বঙ্গদেশ। ঊনিশ-শ’ চল্লিশের দশকে এসে তাই, মূলত উত্তরভারতীয় জমিদারদের পার্টি ‘মুসলিম লীগ’, কী করে এ’হেন বাঙালি-মুসলমানকে কবজা করে নিয়ে ভারতভাগে সামিল করতে পেরেছিল তাকে—মস্ত বড় এক প্রহেলিকা সেটা। বর্তমান কেতাবে তরুণ লেখক বড্ড মুন্সীয়ানায় তুলে ধরেছেন সে গল্প।
*
তবু এটা তো ঐতিহাসিক সত্য হয়ে লেখা রয়ে গেছে বটেই যে বঙ্গের অবিসংবাদী নেতা ফজলুল হক সাহেবকে দিয়েই লীগের ব্যারিস্টার মহম্মদ আলী জিন্নাহ্ ‘পাকিস্তান-প্রস্তাব’ উত্থাপন করিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন (লাহৌর, ১৯৪০)। কিন্তু সে-গুজরাটীর ফাঁদ চিনে নিতে সিংহহৃদয় বঙ্গবীরের বেশি দেরি হয় নি, এবং শীঘ্রই হক-সাহেব হয়ে পড়লেন প্রবল জিন্নাহ্-বিরোধী, এবং দেশবিভাজনের বিপক্ষে। কারণ, মূলত কৃষিজীবী বঙ্গীয় মুসলমানের সঙ্গে যে জমিদারি-দল লীগের স্বার্থ এক হতে পারে না, সেটা অনুধাবন করতে ভুল হয়নি তাঁর; গড়লেন নিজের ‘প্রজা-কৃষক পার্টি’। তবু, ফজলুল হক, আশরাফউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী (ত্রিপুরা) বা আচার্য রেজাউল করিমের মেলবন্ধনী বাণী নয়, ইসলামের নাম নিয়ে নিজামুদ্দীন-সুরাবর্দী-আক্রম খাঁনের বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘পাকিস্তান’ আন্দোলনেই সিংহভাগ বঙ্গীয় মুসলমান মজেছিল সেদিন—এটাই ইতিহাসের ট্রাজেডি। চারশত পৃষ্ঠার এই পৃথুলা গ্রন্থের সাতটি বিস্তৃত অধ্যায় জুড়ে অতি মুন্সীয়ানায় এই প্রক্রিয়া দেখিয়েছেন তরুণ লেখক।
*
প্রথম অধ্যায় ‘সলতে পাকানোর পর্ব’ থেকেই পাঠসুখ শুরু, শুরু লেখকের সোজা-সাপটা হক কথা বলবার। সোজা-সাপটা, তা বলে যুক্তি-বহির্ভূত নয় মোটেই। যেমন, বঙ্গদেশে ‘সাম্যের ধর্ম’ ইসলামে যে ঊনবিংশ শতক থেকেই খানদানী উর্দুভাষী পশ্চিমা ‘আশরাফ’-গণ বাংলাভাষী গ্রাম্য মুসলমানকে (‘আতরাফ’) হেয় চোখে দেখত সে-সত্য পষ্টাপষ্টি বলা। ছেচল্লিশের কলকাতা-কিলিং এর কাতিল-প্রাইমার হোসেন শহীদ সুরাবর্দীর উচ্চশিক্ষিত বংশ পাঁচপুরুষ মেদিনীপুরবাসী হলেও নিজেদের ‘বাঙালী’ বলে পরিচয় দিতেন না। ষষ্ঠ অধ্যায়ে [‘পাকিস্তান’] পরতে পরতে এই হোসেন সুরাবর্দী-ইস্পাহানীদের নাঙ্গা করে দিতেও ছাড়েননি লেখক, যেমন ‘হিন্দু মহাসভা’ ও ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’-কে। বারেবারে ঘুরে-ফিরে এসেছে নৌশর আলি, আবদুর রহমান ফিরদৌসি বা গোলাম কাদের চৌধুরীর মতো জাতীয়তাবাদী বাঙালি মুসলমানদের বীরত্বগাথা, যাঁরা লীগের কাছে ‘কওমী গদ্দার’ গালি শুনেও নিজেদের সঠিক বিশ্বাসে অটল থেকেছেন, যাঁদের ভবিষ্যবাণী ফলে যেতে বেশিদিন লাগেনি--সিকি-শতাব্দী কাটতে-না-কাটতে পশ্চিমী মুসলমানের হাতে বাঙালি মুসলমানের জাতিসংহার সংঘটিত হয়েছে (১৯৭১)। ধর্মের ভিত্তিতে যে ভারতবর্ষভাগ অন্যায়--সেটা এর চেয়ে বেশি আর কী ভাবে প্রমাণ হতে পারত? এতে তাই আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে উপমহাদেশের অপরপ্রান্তে সিন্ধুর জনপ্রিয় নেতা গুলাম মুর্তাজা সৈয়দ-ও ধর্মভিত্তিক দেশভাগের অসারতার কথা বলেছিলেন পঞ্চাশের দশকেই, যদিও আমাদের হক-সাহেবের মতো তিনিও ‘পাকিস্তান প্রস্তাবের’ অন্যতম এক উত্থাপক ছিলেন (১৯৪৩ খৃ.); সিন্ধু আইনসভায়।
আর কম্যুনিস্ট পার্টি? ১৯৪৭-এ বঙ্গীয় আইনসভায় জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে তিন কম্যুনিস্ট সদস্যও যে দেশভাগের পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন, নেহরু-প্যাটেলদের দোষী করবার সময়ে তাঁরা সেটা ভুলে যান কী করে?
সব মিলিয়ে, বুঁদ হয়ে পড়া যায় এমন প্রাঞ্জল ও গুছিয়ে লেখা এই ইতিহাসগ্রন্থ, যদিও সাংবাদিক-লেখক পেশাদার ইতিহাসবেত্তা নন। তাতে কী?
প্রতি অধ্যায়ের শেষে শেষে যে বিপুল গ্রন্থসূত্র দেওয়া রয়েছে, আরও-পাঠের জন্যে বড়ই কাজের তা; লেখকের অসম্ভব পরিশ্রমও প্রমাণ করে।
নবীন লেখকের কলমের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি।
রবীন্দ্রনাথঃ জীবন ও কর্মকাণ্ড—শান্তনু বসু; অভিযান পাবলিশার্স; কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০১৮; ISBN: 978-93-87575-02-8
আশি বৎসরের সুদীর্ঘ এক জীবন!
বাংলা শিল্প-সঙ্গীত-সাহিত্যের কোন্ ধারায় না তাঁর অবাধ বিচরণ?
উপরন্তু, তিনি একাধারে এক শিক্ষাশাস্ত্রী, কৃষি-উদ্যোগী, গ্রামোন্নয়নের পুরোধা, ভাষা-ভাবুক, চিত্রকর, নিরাকারী ঈশ্বরোপাসক...। এক প্রেমিক স্বামী, স্নেহশীল পিতা, দুখী-সংসারী অথচ রসে টৈটুম্বুর মন! দুইটি (বা, তিনটি) স্বাধীনরাষ্ট্রের জাতীয়-সঙ্গীতকার... তিনিই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় কিনা তা নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে, কিন্তু ‘বাঙালি’ হিসেবে তার ঊর্ধ্বে।
কেবল বাংলাভাষাতেই তাঁর উপরে গোটা সত্তর ছোটবড় মান্য জীবনীগ্রন্থ/তথ্যচিত্র রয়েছে--পূর্ণ জীবন ব্যেপে, বা আংশিক ছেয়ে; তার কোনটি আকরগ্রন্থ (প্রভাতকুমার মুখো.), কোনোটি বা অনেক পরে লেখা হলেও পূর্ণতর ও শ্রেষ্ঠ-স্বীকৃত (প্রশান্তকুমার পাল)। এমন এক মহামানবের জীবনকে শ’তিনেক পৃষ্ঠার পরিসরে ধরিয়ে ফেলবার প্রয়াস সামান্য নয় মোটেই, বিশেষত তা যদি কোনো পেশাদার লিখিয়ে না হয়ে সঙ্গীতশিল্পীর দ্বারা হয়ে থাকে। লেখকের ইমেইল-ঠিকানাতেই পরিচয় রয়েছে ‘musicallysantanu’, বইয়ের গোড়ায় যাঁর ‘আত্মকথন’ অংশটি বেশি বড় হয়ে পড়লেও বড্ড সৎ লেখা---সমর্পণ। ভাইটি রে, তোর এই ভাবটা না থাকলে এতো বড় সম্মুদ্দুরে নেবে তুই হাবুডুবু খেতি তো! তা যে খাননি লেখক সেখানেই তাঁর জয়, সেখানেই এই বই দশে নয়।
*
গোড়াতেই দুই পৃষ্ঠার সুপাঠ্য এক উপক্রমণিকায় [‘বড়ো জীবন, ছোট জীবনী’] অধ্যা. সৌরীন ভট্টাচার্য এই কৃশ-কিন্তু-পুষ্ট জীবনীগ্রন্থের সম্পর্কে বলেছেন, ভালোই বলেছেন: ‘এতো বড়ো একটা ঘের ধরতে গেলে দৃষ্টিকে অনেকটা উঁচুতে তুলে নিতে হয়। .....কিন্তু অনেক অনেক বই আর বহু বহু তথ্যের অরণ্যে হারিয়ে গেলে চলবে কেমন করে? তাই প্রয়োজন পড়ে সার কথাতে। আবার এ-ও দেখতে হয় যাতে জীবনের নানা বাঁকের চেহারা হাতছাড়া না হয়ে যায়।’ ঠিক। ঠিক কথা। এই বাক্য শিরোধার্য করে জীবনীগ্রন্থটি হাতে নিই।
*
‘প্রভু আমার প্রিয় আমার পরম ধন হে।প্রথম অধ্যায়ের আগেই এক পৃষ্ঠাজুড়ে এই মর্মবাণী দিয়ে পুস্তকের শুরু দেখে অভিভূত হয়ে পাঠারম্ভ করি। ক্রমে ক্রমে ‘ঠাকুর পরিবারের পরিচিতি’, দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ হয়ে কবির জন্মকুণ্ডলী, শিশুবেলা হয়ে নোবেল-বিশ্বভারতী হয়ে ৭৬তম অধ্যায়ে ‘চিরশান্তির পথে’। লেখার গতিতে ফিকশন-পাঠ বলে মনে হয়েছে, রোকেনি কোথাও। এইটিই বড় মুন্সীয়ানা হে! এবং কবিজীবনের কোনো ‘বাঁক’ ছেড়ে যায়নি---প্রভাত-প্রশান্তকুমারের জীবনী খুলে খুলে মিলিয়ে নিই।
চিরপথের সঙ্গী আমার চিরজীবন হে’ [#]
*
তবু নিম্নোক্ত এই এই বিষয়ের প্রতি লেখক-প্রকাশক যদি একটু দৃষ্টি দেন, পরবর্তী সংস্করণটি আরও উপযোগী হয়ে উঠতে পারে।
পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫ ১৮৭৭ সালে রানি ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষে রাজত্ব করতে এলেন। [??]
[বস্তুত, ১৯১১-র দিল্লি দরবারে পঞ্চম জর্জের পূর্বে কোনো ইংরেজ সম্রাট/সম্রাজ্ঞী-ই ভারতবর্ষে পা রাখেন নি। ১৮৭৭-এ যেটা হয়েছিল সেটা হলো ভিক্টোরিয়াকে সরাসরি ‘ভারতসম্রাজ্ঞী’ বলে ঘোষণা করা, যদিও এর প্রায় বিশ বছর আগে ‘সিপাহী বিদ্রোহের’ পরে পরেই কোম্পানির শাসন অবসান করে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট শাসনভার নেয়। ]
‘দ্বারকানাথের’ উপরে অধ্যায়টিতে লেখক আজকের আম-বাঙালির মতো অযথাই একটু বেশি নালেঝোলে হয়েছেন। দ্বারকানাথ মোটেই অসামান্য সাফল্যের সঙ্গে [পৃ. ৩৬ ] জাহাজ-খনি-ব্যাঙ্কিং ব্যবসা করেননি; শুরু অবশ্যই করেছিলেন কিন্তু প্রতিটিই স্বল্পস্থায়ী ছিল এবং শেষরক্ষে হয়নি।
৮৬ রবির ‘প্রথম প্রেম’ মারাঠী-কন্যে আনা তড়খড় মোটেই রবির চাইতে ‘ছ বছরের ছোট’ ছিলেন না, ছিলেন বছর তিনেকের জ্যেষ্ঠ, বিলাতফেরত যে ‘নলিনী’-র নিকট তরুণ রবির ইং আদবকায়দার পাঠ নেওয়া।
[#] প্রথম অধ্যায়/ছবির উক্ত ক্যাপশনটি ছাড়া অন্য অন্য অনেকগুলির ক্যাপশন যে অপ্রযুক্ত মনে হয়েছে সেটাও জানিয়ে রাখি। যেমন, পৃ. ৯৩ ‘প্রাণে খুশির তুফান…..’ [লণ্ডনে রবি], বা ‘নাহি ক্ষয় নাহি শেষ….’ [পৃ.১২৩] ইত্যাদি।
১৩২ ১৯০৫ নাগাদ, শান্তনু শুরু করছেন ‘স্বদেশ ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ’ উপ-অধ্যায়ঃ “ইংরেজ রাজত্বের মধ্যে….স্বাধীনতার জন্য লড়াই চলেছে সর্বত্র”।
আরেকবার পড়ে দেখুন না বাক্যটি। ঠিক?
১৯০৫-এ? সর্বত্র স্বাধীনতার লড়াই?
১৪০ কবির বন্ধু প্রখ্যাত ইংরেজ শিল্পীর নামটি স্যর উইলিয়ম রদেনস্টাইন, জানতাম। নিদেন ‘রথেনস্টাইন’, কিন্তু বারবার ‘রটেনস্টাইন’ লেখাটা বোধহয় ঠিক হয়নি।
সারা বই জুড়ে অনেক অনেক সাদাকালো ছবি ছাপা হয়েছে, যেগুলির বেশিরভাগই ধ্যাবড়ানো, সুমুদ্রিত নয়। কয়েকটি স্থানে তো ছবির স্থান ছাড়া রয়েছে কিন্তু ছবি নেই। [পৃ. ৭৪, ৮৭, ৯৯ ] সম্পাদনার এলাকাড়ি।
গ্রন্থশেষের তিনখানি ‘পরিশিষ্ট’-ই বিশেষ কাজের। খেটে করা।
বইখানি যে কোনো রবীন্দ্র-পাঠকের বিশেষ প্রয়োজনে আসবে বলে মনে করি।
(পরবাস-৭৭, ১০ জানুয়ারি ২০২০)