Subscribe to Magazines



পরবাসে রঞ্জন ভট্টাচার্যের
আরো লেখা


ISSN 1563-8685




বৃত্তান্ত

‘দ্যাখ দ্যাখ — এটা দ্যাখ — হি হি — ‘ওর মামাদাদু না কে যেন দিয়েছে!’

— ‘উরে বাবা! এ তো বিরাট অ্যামাউন্ট! কে দিয়েছে বললি?’

— ‘মামাদাদু — দশটাকা দিয়েছে — হিহি—’

কথাগুলো উড়ে আসছিলো পাশের ঘর থেকে। শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সুধীন্দ্রনাথ। পাশের ঘরে হইহই করে কথা বলছে তার বারো বছরের নাতি সৌজন্য আর তার স্কুলের দুই বন্ধু। এই বন্ধু দুটিকে তিনি দেখেননি। এদের সম্পর্কে কিছু শোনেননিও কখনো। কিন্তু তাদের এই হাহাহিহি করা কথাগুলো বিশেষত তার নাতির মুখে — 'মামাদাদু দশটাকা দিয়েছে' — বলে হিহি করে হাসা শুনে সুধীন্দ্রনাথ যেন পাথর বনে গেলেন।

সুধীন্দ্রনাথ জানেন যে তার নাতির স্কুল থেকে সম্প্রতি যে বিরাট বন্যা হয়ে গেলো তার জন্য বন্যাত্রাণের সাহায্য চাওয়া হয়েছে স্টুডেন্টদের থেকে। সুধীন্দ্রনাথের নাতি তার বাবা মা এবং এই দাদুর থেকে এর জন্যে ইতিমধ্যেই পাঁচশো টাকা আদায় করেছে। সুধীন্দ্রনাথের মতে এই টাকাটি ক্লাস সেভেনের একটা ছেলের ডোনেশনের পক্ষে যথেষ্ট। এবং সেটা ওই স্কুলের নামডাক আভিজাত্যের হিসেবেই যথোপযুক্ত বলে তাঁর ধারণা।

এরপরে সেদিন ঘটলো একটি ঘটনা। হঠাৎ এসে হাজির হলেন অমিয়বাবু। অর্থাৎ অমিয় চক্রবর্তী। সৌজন্যের মা তিথির সম্পর্কে মামা। বিরানব্বই বছর বয়স। কিন্তু এখনো সতেজ সক্ষম। উনি বিয়ে-থা করেননি। থাকেন রাসবিহারীতে ডাক্তার ভা‌ইপোর কাছে। মাঝে মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ চলে আসেন তার এই ভাগ্নির বাড়িতে। সুধীন্দ্রনাথ এই অমিয় চক্রবর্তীকে বিশেষ শ্রদ্ধা করেন। কারণ ইনি এমন এক চাকরি করতেন যেখানে ইচ্ছে করলেই অনেক কিছু করতে পারতেন। কিন্তু এক ব্যতিক্রমী সততা আর নিষ্ঠা নিয়ে তিনি সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন। গত বিশবছর ধরে ইনি বাইরের জগতের খোঁজখবর বিশেষ রাখেন না। ওই ডাক্তার ভাইপোটি তাকে বিশেষ যত্নে রেখেছে। অমিয়বাবু এসেছিলেন ওই ডাক্তারের গাড়িতেই।

সৌজন্যের স্কুল, পড়াশোনা এইসবের কথায় কথায় কিভাবে যেন এই বন্যাত্রাণের কথা উঠেছিল। অমিয় চক্রবর্তী মশাই তাঁর মানিব্যাগ থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে সৌজন্যের হাতে দিয়ে বলেছিলেন — ‘এই নাও দাদুভাই। আমার তরফ থেকে। তোমার স্কুলের ফ্লাড-রিলিফে দিও।’ ঘটনাটা সুধীন্দ্রনাথের সামনেই ঘটেছিল। তিনি ভেবেছিলেন এ প্রসঙ্গে তাঁর নাতিকে কিছু বলবেন। কিন্তু রাত হয়ে গিয়েছিল বলে আর সে সুযোগ হয়নি। কারণ এর দুদিন বাদেই উপরের ঘটনাটা ঘটলো। সুধীন্দ্রনাথ তার নাতির বন্ধুরা চলে গেলে তাকে ডেকে পাঠালেন নিজের ঘরটিতে।

‘তোমার মামাদাদুর দেওয়া নোটটা নিয়ে এসো তো।’ — বললেন সুধীন্দ্রনাথ। সৌজন্য এক দৌড়ে অমিয় চক্রবর্তীর দেওয়া দশটাকার নোটটা নিয়ে এলো তার দাদুর সামনে।

সুধীন্দ্রনাথ বললেন — ‘এই নোটটা নিয়ে বাজারে গেলে কতো টাকার জিনিস পাওয়া যাবে বলতে পারো?’

সৌজন্য একটু থতমত খেয়ে নোটটাকে উল্টেপাল্টে দেখে বললো — ‘কেন? দশটাকা লেখা রয়েছে যে — তো দশটাকার জিনিস‌ই পাওয়া যাবে।’

সুধীন্দ্রনাথ সৌজন্যের হাত থেকে নোটটা নিয়ে বললেন — ‘সম্ভবত না।’ বলে নোটটাকে একটু আলোর দিকে তুলে বললেন — ‘কিচ্ছুটি মিলবে না দোকানে এই নোটটা দিয়ে।’ তারপর সৌজন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন — ‘মানে আজকের বাজারে নোটটা অচল।’

সৌজন্য তার দাদুর দিকে তাকিয়ে বেশ বিজ্ঞের মতো বললো — ‘আর দশটাকায় কি বা পাওয়া যাবে?’

‘একেবারে ঠিক কথা বলেছো। মাত্র দশটাকায় আজকালকার দিনে একটা সন্দেশ পাওয়া যায় কেবল।’ — মৃদু হেসে উত্তর দিলেন সুধীন্দ্রনাথ।

সৌজন্য একগাল হেসে বললো — ‘সেটাও কিন্তু ছোটো সাইজের।’

সুধীন্দ্রনাথ বললেন — ‘ঠিক ঠিক।' বলেই বললেন — ‘এবার তোমায় এই সাইজের ব্যাপারে একটা মজা দেখাচ্ছি দ্যাখো।’

এইকথা বলেই তিনি এখনকার একটা একশো টাকার নোট বার করে ওই পুরোনো দশটাকার নোটটার উপর রেখে বললেন —

‘এবারে দ্যাখো দেখি এই দশ টাকাটার নোটটা এই নতুন একশো টাকার নোটের থেকে কতোটা ছোটো।’

সৌজন্য অবাক হয়ে তাকালো ওই নোট দুটোর দিকে। সুধীন্দ্রনাথ বললেন — ‘দুটোই প্রায় একই সাইজের। তাই না?’

সৌজন্য কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই সুধীন্দ্রনাথ বলে উঠলেন — ‘এবারে তুমি কেমন অঙ্ক শিখেছো দেখি — বলো তো দুশো টাকার মধ্যে দশ টাকা আর তিরিশ হাজার টাকার মধ্যে দুশো টাকা, কোনটা বড়ো ফ্র্যাকশন?’

সৌজন্য খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বললো — ‘দাঁড়াও কষে বলছি।’

সুধীন্দ্রনাথ হেসে বললেন — ‘কষে দেখে নিয়ো প্রথমটাই বড়ো। দুশো টাকা ছিলো তাঁর সেই সময়ের বেতন আর তিরিশ হাজার টাকা আমার এখনকার পেনশন।’

সৌজন্য তার দাদু কি সূত্রে কোন কথা বলছেন তার হদিস খুঁজে না পেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে।

সুধীন্দ্রনাথ তাঁর নাতির চোখে চোখ রেখে বলে যেতে লাগলেন — ‘এবারে নোটটা ভালো করে হাতে নিয়ে দ্যাখো — কোনো ভাঁজ নেই, দাগ নেই, এতটুকু ময়লা নেই — দ্যাখো। বলো তো কেন?’

সৌজন্য কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে হতভম্বের মতো তাকিয়ে র‌ইলো তাঁর দিকে। সুধীন্দ্রনাথ এক‌ইভাবে তাঁর নাতির চোখে চোখ রেখে বলে থাকলেন — ‘যত্ন। দাদুভাই, যত্ন। খুব যত্ন করে রাখা ছিলো নোটটা।’

‘তোমার মায়ের জন্মের আগের কোনো কিছুকে কখনো হাতে নিয়ে দেখেছো এর আগে?’ — হঠাৎ তার দাদাইয়ের গলার স্বরের ভিন্ন মাত্রাটি বুঝতে অসুবিধে হোলো না সৌজন্যের। নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না জানালো সে।

সুধীন্দ্রনাথ বলে যেতে থাকলেন একদৃষ্টে সৌজন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে — ‘এই স্টিল গ্রে কালারের পালতোলা নৌকো মার্কা দশটাকার নোট বাজারে এসেছিলো উনিশশো সত্তর সাল নাগাদ — অর্থাৎ তোমার মায়ের জন্মের কিছু আগে — প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো জিনিসটা এখন তোমার হাতে — খুব হেলাফেলার জিনিস কি?’ সৌজন্য মুখ নীচু করে র‌ইলো।

‘এই টাকাটা যে সময় বাজারে চলতো সেই সময় এই টাকায় তোমার বাবার স্কুলের মাইনে হয়ে যেতো। সেই দিনের হিসেবে এ টাকাটাকে খুব অল্প বলা যায় কি?’

‘তাও দ্যাখো এটা কি হাস্যকর জিনিস বলে মনে হোলো তোমার কাছে — কেন জানো? — তুমি তো এটিকে ভালো করে ছুঁয়ে দ্যাখোনি — তাহলে বুঝতে কতোটা যত্ন আর ভালোবাসা লেগে আছে এর গায়ে — আর সেটাই তোমায় দিয়েছিলেন তোমার মামাদাদু — আজকের দিনের ললিপপ-কেনা-দশটাকা নয়।’ — খুব আস্তে আস্তে কথাগুলো বললেন সুধীন্দ্রনাথ।

‘যাকগে ওটা আমাকেই দিয়ে দাও — নয়তো ওই পালতোলা নৌকো-মার্কা কাগজটা কিন্তু খুব কষ্ট পাবে — আর সেটা আমি একদম চাই না।’ — বলে সৌজন্যের দিকে হাত বাড়ালেন সুধীন্দ্রনাথ।

সৌজন্য তার মুখটি নীচু করেই ওই নোটটা নিঃশব্দে এগিয়ে দিলো তার দাদুর দিকে।

সুধীন্দ্রনাথ নোটটি হাতে নিয়ে চমকে উঠলেন। দেখলেন নোটটির মাঝখানটা সদ্যভিজে। তিনি তাঁর ডান হাতের তেলোয় নাতির নীচু মুখটি তুলে ধরতেই দেখতে পেলেন তার চোখ দুটি জলে টলটল করছে কিভাবে। সুধীন্দ্রনাথ সেই চোখের জলে ভেজা মুখটা মুছিয়ে দিয়ে বললেন — ‘একটা গল্প শুনবে পিকাইভাই?’ সৌজন্য বড়ো বড়ো চোখে জিজ্ঞাসা করলো — ‘কিসের গল্প?’ সুধীন্দ্রনাথ বললেন — ‘মনে করো এই দশটাকার নোটটার মতো কোনো একটা সামান্য জিনিসের গল্প।’ সৌজন্য তার দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। সুধীন্দ্রনাথ তাঁর আদরের পিকাইভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন —

‘এ হোলো পুরাণ-মহাভারতের গল্প। তাই এখানে অনেক কিছুই আছে যা তোমার একেবারে আজগুবি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তবুও তা গল্প‌ই। এবার মন দিয়ে শোনো—’

‘সেই যুগে এক দারুণ ক্ষমতাবান ঋষি ছিলেন — তাঁর নাম ছিলো কশ্যপ। তিনি ঠিক করলেন এক বিরাট যজ্ঞ করবেন। তখন সেই মহাযজ্ঞের কাঠ আনার জন্য আদেশ করলেন অনেক মান্যগণ্যদের। এমনকি দেবরাজ ইন্দ্রকেও।’

এই পর্যন্ত বলে সুধীন্দ্রনাথ একটু থামলেন। তারপর সামনে রাখা সাদা রাইটিং প্যাডটা টেনে নিয়ে তার উপর বড়ো বড়ো করে একটি শব্দ লিখে সৌজন্যের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন — ‘কথাটা শিখে রাখো দাদুভাই।’

সৌজন্য প্যাডটা হাতে নিয়ে পড়ে বলল — ‘বালখিল্য! কথাটার মানে কি গো দাদু?’

‘মানে সহজভাবে বলা যেতে পারে — ছেলেমানুষী — childish — অর্থাৎ বাচ্চাদের মতো কোনো কাজ — খুব বোকামি করে করা।’ — বললেন সুধীন্দ্রনাথ।

সৌজন্য অবাক হয়ে তাকালো তার দাদুর দিকে। সুধীন্দ্রনাথ তার নাতির দিকে তাকিয়ে বললো — ‘আমি জানি তুমি মনে মনে কি ভাবছো — ভাবছো এই গল্পের মধ্যে এই কথাটা আবার এলো কোত্থেকে, তাই না? তাহলে শোনো,’ বলে সুধীন্দ্রনাথ মৌরির কৌটোটা খুলে এক চিমটে মৌরি মুখে ফেলে বলতে শুরু করলেন —

‘কয়েকটা মানুষ — সাইজে আমার এই বুড়ো আঙুলের মতো ছোট্ট। ভাবতে পারছো?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ জানি, গালিভার্স ট্র্যাভেলসে আছে, লিলিপুট’ — হইহই করে বলে উঠলো সৌজন্য।

‘ঠিক বলেছো। একেবারে ওইরকম — কিন্তু তোমার ওই গালিভারের গল্পের অনেক অনেক কাল আগে — আর পুরোপুরি অন্য ধরনের। তারা সবাই ঋষি — আমার বুড়ো আঙুলের সাইজের — তাঁদের নাম বালখিল্য ঋষি। বুঝলে?’ — সুধীন্দ্রনাথ বলে যান নিজস্ব স্টাইলে।

‘বালখিল্য ঋষি? — এতোটুক ছোটো?’ — অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো সৌজন্য।

‘অবশ্যই! তাঁরাও মহর্ষি কশ্যপের যজ্ঞের জ্বালানি নিয়ে আসছিলেন তাঁদের সাধ্যমত। সকলে মিলে একটা বড়ো বটপাতা ধরাধরি করে আনতে আনতে একটা ছোট্ট জলকাদার গর্তে পড়ে গেলেন।’

‘বটপাতা? জ্বালানির জন্যে?’ — চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করলো সৌজন্য।

‘হ্যাঁ দাদুভাই। যতটুকু তাঁরা বয়ে আনতে পারেন। মন থেকে ভালোবেসে। আর খুব যত্ন করে। এই দেওয়াটাই তো সবচেয়ে দামী। তাই না?’ — সৌজন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে খুব আস্তে আস্তে কথাগুলো বলেন সুধীন্দ্রনাথ।

সেই নিম্নস্বরের ভিতর যে ইঙ্গিতটা লুকিয়ে ছিলো তা বুঝতে এতটুকু ভুল হয়নি সৌজন্যের। তাই তার চোখে তক্ষুণি ভেসে উঠলো মামাদাদুর দেওয়া দশটাকার নোটটা। আর সঙ্গে সঙ্গেই চোখটা ঝাপসা হয়ে গেলো তার।

সুধীন্দ্রনাথ বলে যেতে লাগলেন — ‘বালখিল্য ঋষিদের ওই বটপাতা নিয়ে জলকাদায় হাবুডুবু খেতে দেখে দেবরাজ ইন্দ্র হো হো করে হেসে ফেললেন। বালখিল্য ঋষিরা ইন্দ্রের ওই হাসাহাসি দেখে ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন। এবং তখনই ঠিক করলেন ইন্দ্রের এই আচরণের উপযুক্ত উত্তর দেবেন কিভাবে। আর যেমনি ভাবা তেমনি কাজ।’

‘ওই ছোট্ট ছোট্ট ঋষিরা ইন্দ্রের সঙ্গে পেরে উঠতে পারে নাকি?’ — সুধীন্দ্রনাথকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো সৌজন্য।

‘সেটাই তো শোনো। তা সেই বালখিল্য ঋষিরা বসলেন তপস্যায়। সে এক ভয়ঙ্কর তপস্যা। উদ্দেশ্য — আরেক দেবরাজ ইন্দ্র সৃষ্টি করা। যে হবে বর্তমান ইন্দ্রের সমান ক্ষমতাবান। সে লড়াই করবে ওই দুর্বিনীত অহঙ্কারী ইন্দ্রের সাথে।’

‘ওই ছোট্ট ছোট্ট ঋষিদের এতো ক্ষমতা?’ — চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করলো সৌজন্য।

‘অবশ্যই। কারণ তাঁরা যে-সে ঋষি নন। তাঁরা কেবল বাতাস আর সূর্যের আলো গ্রহণ করে বেঁচে থাকেন যুগ যুগ ধরে। তাই তাঁদের তপস্যা যে ব্যর্থ হবে না তা বুঝতে পেরে এসে হাজির হলেন মহর্ষি কশ্যপ স্বয়ং। কারণ সত্যি সত্যিই যদি আরেকটি সমান ক্ষমতার ইন্দ্র সৃষ্টি হয় তাহলে তো বর্তমান ইন্দ্রের মহাবিপদ হয়ে দাঁড়াবে। কশ্যপমুনি বালখিল্য ঋষিদের বললেন — আপনারা যা ঘোর তপস্যা করছেন তার ফল তো পাবেনই। কিন্তু ভেবে দেখুন তো এতে করে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা যা করেছেন তাকে অমান্য করা হবে কি না। জগতে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা কিছু কিছু এক এবং অদ্বিতীয় সৃষ্টি করে রেখেছেন। দেবরাজ ইন্দ্র তেমন এক সৃষ্টি। অত‌এব দ্বিতীয় আরেকটি ইন্দ্রের আবির্ভাব ঘটানো কি উচিত কাজ হবে? বরং এক কাজ করা যাক। আপনাদের ইচ্ছায় এক মহাশক্তিমানের সৃষ্টি হোক তিনি পাখিদের মধ্যে ইন্দ্রের মতো সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী। এবং সেই ক্ষমতা এতটাই বিশাল যে দেবরাজ ইন্দ্রও সেই ক্ষমতাকে সমীহ করে চলবেন। এমনকি তিনি নিজে এসে আপনাদের ইচ্ছায় সৃষ্টি হ‌ওয়া প্রাণীটির সঙ্গে মাথা নত করে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইবেন।’

বালখিল্য ঋষিরা সব শুনে বললেন, ‘বেশ তবে তাই হোক।’ সুধীন্দ্রনাথ এমন অভিনয় করে কথাগুলো বলেন যেন মনে হয় চোখের সামনে সবকিছু ঘটছে। তাই সৌজন্য যেন হাঁ করে গিলছিলো কথাগুলো। সুধীন্দ্রনাথ হাত পা নেড়ে বলে যেতে লাগলেন, ‘অত‌এব সৃষ্টি হোলো পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এমনকি অন্য সমস্ত প্রাণীর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী এই বিশাল পাখি। নাম তার গরুড়।’

সৌজন্য কথাগুলো শুনে ঠোঁট ওল্টালো। সুধীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হোলো পিকাইভাই?’

‘এটা ঠিক হোলো না।’ — উত্তর দিলো সে।

‘কি ঠিক হোলো না?’

‘এটা তো ঠকানো হোলো ওই বালখিল্য ঋষিদের। কোথায় দেবরাজ ইন্দ্র আর কোথায় সবচেয়ে শক্তিশালী পাখি — এটা তো সেই যে তুমি শুনিয়েছিলে “নাকের বদলে নরুন” সেই গল্পটা হয়ে গেলো।’ — বেশ ভারিক্কি ভাবেই বললো সুধীন্দ্রনাথের বারো বছরের নাতি সৌজন্য।

শুনে হো হো করে হেসে ফেললেন সুধীন্দ্রনাথ। তারপর হাসতে হাসতেই বললেন, ‘তোমার কথা একদিক দিয়ে ঠিক নিশ্চয়ই কিন্তু আরেক দিক দিয়ে দেখলে বেঠিক। কারণ কি জানো? এই মহাভারতের কাহিনিগুলোয় কোনটা নাক আর কোনটা নরুন সেটা সবসময় কলম দিয়ে দেগে দেওয়া যায় না।’

সৌজন্য অবাক হয়ে তাকালো তার দাদুর দিকে। সুধীন্দ্রনাথ বললে, ‘হ্যাঁ দাদুভাই। এই মহাভারতের গল্পে অজস্র অভিশাপ আছে, যেখানে দেখা যায় সেই অভিশাপগুলো পরে আশীর্বাদের মতন হয়ে দাঁড়াবে। আবার কিছু কিছু আশীর্বাদ পরে অভিশাপের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাও দেখতে পাওয়া যায়। আসলে কি জানো জীবনে কোনটা ভালো কোনটা সঠিক এটা বুঝতে জীবনের অনেকটা সময় লাগে দাদুভাই। বড়ো হয়ে যদি কখনো মহাভারত পড়ো বা নাই পড়ো এ কথাটার মানে এমনি এমনিই বুঝতে পারবে।’

বারো বছরের সৌজন্য খুব মন দিয়ে শুনছিলো তার দাদাইয়ের কথাগুলো। সুধীন্দ্রনাথের মনে হোলো কথাগুলো একটু বেশি ভারী হয়ে যাচ্ছে। অত‌এব কথার রং বদলানো দরকার। তাই তিনি বলে উঠলেন, ‘এবারে মনে মনে ভাবো তো পিকাইভাই আমি যেমন যেমন বলে যাচ্ছি —

'একটা চারিদিক থেকে বন্ধ ঘর; কেবল একদিক দিয়েই ঢোকা যায়। সেই ঘরকে সব দিক থেকে ঘিরে রেখেছে আকাশছোঁয়া দাউদাউ আগুন, আর সেই ঘরের মধ্যে সাঁই সাঁই করে ঘুরছে মারাত্মক ধারালো আর প্রকাণ্ড একটা চক্র। আর এই চক্রের পিছনে আছে বিরাট বড়ো দুটো ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ যাদের হীরের মতো জ্বলজ্বলে চোখ, আকাশের বিদ্যুতের মতো চেরা জিভ। সাপ দুটো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘিরে রয়েছে একটা কলসিকে, আর সেই কলসীর মধ্যেই— ’ একটানা বলে সুধীন্দ্রনাথ যেন ইচ্ছে করেই একটু থামলেন।

সুধীন্দ্রনাথের বর্ণনাটি যেন হাঁ করে গিলছিলো সৌজন্য। ‘কি আছে? কি আছে ওই কলসীতে? হীরে? মোহর?’ — চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করলো সে।

সুধীন্দ্রনাথ মুখে আবার এক চিমটে মৌরি ফেলে চিবোতে চিবোতে পিঠটাকে চেয়ারে হেলিয়ে একটু আড়ামোড়া ভেঙে বললেন, ‘ধুস্। ওসব কিচ্ছু না।’

সৌজন্য এক‌ইভাবে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে? তাহলে?’

সুধীন্দ্রনাথ খুব ধীরে সুস্থে মৌরি চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘দেবতারা অসুরদের থেকে কিসে এগিয়ে জানো? দেবতাদের বাড়তি সুবিধেটা কি জানো?’

সৌজন্য হাত-পা ছুঁড়ে বলতে লাগলো, ‘না না, এখন অন্য কথায় গেলে হবে না, কি আছে ওই কলসীতে আগে বলো।’

‘সেটাই তো বলছি পিকাইভাই, কোনো অন্য কথা নয়।’ — আবার আগের মেজাজে বলতে শুরু করলেন সুধীন্দ্রনাথ।

‘দেবতা আর দানব, দুটিই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সৃষ্টি। সমান শক্তিশালী এরা। কিন্তু একটা কারণে দেবতারা দানবদের থেকে অনেক এগিয়ে। আর সেই কারণটা হোলো দেবতারা অমর। দানবেরা নয়। আর দেবতারা অমর হয়েছিল তার কারণ তারা অমৃত পান করতে পেরেছিল। যা অসুরেরা পায়নি।’

‘কিন্তু ওই কলসীর গল্পটা?’ — নাছোড়বান্দা সৌজন্যের প্রশ্ন।

‘ওই কলসীটাই তো আসল ব্যাপার, ওতেই তো ছিল অমৃত, যা ওইরকম সাংঘাতিক পাহারাদারীতে রাখা। ওই জায়গা থেকে অমৃতের ভাণ্ডারটি উদ্ধার করা কি যেমন তেমন ব্যাপার! বলো তো পিকাইভাই?’

‘তাহলে দেবতারা কি করে পেলেন ওই অমৃত? কোন দেবতা পারলেন ওটাকে নিয়ে আসতে?’

‘দূর দূর! কোন্ দেবতা পারবে এ কাজ করতে?’

‘তাহলে?’

‘কৌশল! কায়দা! অর্থাৎ সোজা পথে নয়। মন দিয়ে শোনো।’

সৌজন্য টান টান হয়ে বসলো তার দাদাইয়ের বলা এর পরের কথাগুলো শোনার জন্য। আর সুধীন্দ্রনাথও ফের শুরু করলেন বলতে, ‘এই অমৃত যিনি উদ্ধার করতে যাচ্ছেন তিনি তো যে সে কেউ হতে পারেন না, তারও তো কিছু আশ্চর্য ক্ষমতা থাকবেই, নয়তো তিনি সাহস‌ই পাবেন না, তাই না?’

সৌজন্য মাথা নেড়ে বললো, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’

‘কেউ অমৃত উদ্ধার করতে যাচ্ছে শুনেই তো দেবতাদের মধ্যে বিরাট হইচই শুরু হয়ে গেলো। দেবরাজ ইন্দ্র আদেশ দিলেন যেমন-তেমন করে তাঁকে আটকাতে। প্রথমেই তাঁকে বাধা দিলেন বিশ্বকর্মা। কিন্তু বিশ্বকর্মা তাঁর সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে গেলেন। একইভাবে বড়ো বড়ো দেবতারা, যক্ষেরা সবাই তাঁর ভয়ঙ্কর শক্তির সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে গেলো। তিনি এসে পৌঁছলেন সেই ঘরের সামনে যেখানে রাখা আছে ওই অমৃতের কলসী।’

‘কিন্তু সেই ঘরকে তো ঘিরে আছে আকাশছোঁয়া দাউদাউ আগুন। এবার তিনি ওই ঘরে ঢুকবেন কি করে?’ — সুধীন্দ্রনাথ এবার তাঁর নাতির অবাক হ‌ওয়া মুখটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘পিকাইভাই তোমরা তো হ্যারি পটার পড়ো, অ্যাভেঞ্জার্স দ্যাখো চোখ বড়ো বড়ো করে। সত্যি মিথ্যের প্রশ্ন তোলো না, এখানেও সেই কথাটা মনে করে যা বলছি শুনে যাও —’

‘ওই প্রকাণ্ড আগুনের শিখাগুলো দেখে তিনি তখুনি গেলেন বিশাল এক নদীর কাছে। নিজের মুখে শুষে নিলেন সেই নদীর জল। তারপর ফিরে এলেন ওই আগুনের শিখায় সামনে। এবার মুখ থেকে ছিটিয়ে দিলেন সেই নদীর সমস্ত জল। ধীরে ধীরে নিভে গেলো চারিদিকের আগুন। এইবার তিনি ওই ঘরে ঢুকলেন।’

‘ভেবে দ্যাখো ওই ঘরের মধ্যে কি আছে। আছে সেই বিরাট ধারালো চক্রটা, যার কাছে গেলেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে যে কোনো মহাশক্তিশালীর দেহ। এবার তিনি তাঁর শরীরটাকে তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতায় খুব ছোটো করে ঢুকে গেলেন ওই চক্রের কাঠের কাঠামোর ভিতরে। এতে তাঁর শরীরে কোনো আঘাত লাগলো না।

‘এইভাবে ঢুকে পড়লেন তো কৌশল করে, কিন্তু এবারে সামনে কি দেখলেন বলো তো? দেখলেন সেই প্রকাণ্ড সাপ দুটোকে। যারা তাদের ভয়ঙ্কর ফণাদুটো তুলে পাহারা দিচ্ছে অমৃতের কলসীটাকে। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি একটা প্রচণ্ড ধুলোর ঝড় সৃষ্টি করে অন্ধ করে দিলেন তাদের ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে। তারপর তাঁর প্রবল শক্তিতে দু-টুকরো করে কেটে ফেললেন তাদের শরীর।

‘এরপর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অমৃতের কলসীটাকে তুলে নিয়ে ওই প্রকাণ্ড চক্রটাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে দু-টুকরো করে আকাশ পথে উড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি।’

‘এইবার আকাশপথে যখন তিনি অমৃতের কলসীটা নিয়ে চলেছেন হুহু করে, তখন দেবরাজ ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতারা ভাবলেন, এ তো ভয়ঙ্কর বিপদ হয়ে গেলো। এইভাবে অমৃতভাণ্ড লুট হয়ে গেলো — একে তো যেকোনো ভাবে থামাতেই হবে।' অত‌এব ওই আকাশপথেই শুরু হোলো এক ভীষণ যুদ্ধ। সমস্ত দেবসেনারা যখন তাঁর কাছে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর দিকে ছুঁড়ে দিলেন তার সর্বশেষ এবং সর্বশক্তিশালী অস্ত্রটি। সেটি হোলো দধীচিমুনির হাড় থেকে তৈরি যা সব কিছুকে চোখের নিমেষে ছাই করে দিতে পারে সেই বজ্র।’

এই পর্যন্ত বলে সুধীন্দ্রনাথ একটু থামলেন। আসলে সুধীন্দ্রনাথ তো শুধু বলে যান না, রীতিমতো হাত-পা নেড়ে গলার স্বর উঠিয়ে নামিয়ে একেবারে অভিনয় করে দেখান তাঁর প্রিয় নাতির কাছে। আর এই নাতিটিও এইভাবে না বললে শোনেই না কোনো গল্প তার দাদাইয়ের থেকে।

সৌজন্য সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করলো, ‘তারপর? তারপর?’

‘তিনি তখন ওই বজ্রের আঘাতটি শরীরে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, 'আমি তোমার আর দধীচিমুনির আর ওই বজ্রের সম্মান রাখার জন্যে আমার শরীর থেকে একটা পালক ফেলে দিলাম দ্যাখো। এই বজ্রের আঘাতে আমার সামান্য যন্ত্রণাও হচ্ছে না সেটা বুঝতেই পারছো।'

সৌজন্য বলে উঠলো, ‘উরেব্বাস!’

দেবরাজ ইন্দ্র তো এই ব্যাপার দেখে থ হয়ে গেলেন। তিনি তখন ইন্দ্রকে বললেন, 'আমি যে-কোনো প্রাণীর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, যে-কোনো দেব-দানব যক্ষের চেয়ে আমার ক্ষমতা অনেক বেশি, গোটা পৃথিবীটাকে ব‌ইবার এমনকি গোটা স্বর্গ মর্ত্য পাতাল একসাথে ধরে রাখার সামর্থ্য আমার আছে, আমার চেয়ে শক্তিশালী ত্রিভুবনে কেউ নেই জানবে।'

দেবরাজ ইন্দ্র তখন বুদ্ধি করে বললেন, 'তোমার সব কথাই একেবারে সত্যি। তাই তোমার অমৃতের প্রয়োজন কিসের? তোমার থেকে যারা এটা পাবে তারা তো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে আমাদের উৎপাত করবে। তার চেয়ে তুমি আমায় এটা দিয়ে দাও। আর তোমার সঙ্গে আমার বরাবরের বন্ধুত্ব অটুট হোক।'

এর উত্তরে তিনি বললেন, ‘দেবরাজ ইন্দ্র! জেনে রাখুন এই অমৃত পান করে অমরত্ব পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই আমার। তাই এই অমৃতের একটা ফোঁটাও আমি স্পর্শ করবো না। কিন্তু এটা আমি নিয়ে যাচ্ছি শুধুমাত্র আমার মায়ের মুক্তিপণ হিসাবে। এটা যেখানে গিয়ে রাখবো, আপনি পারলে এটাকে সেখান থেকে নিয়ে চলে যাবেন।’

এত কাণ্ড করে তিনি ওই অমৃতের পাত্রটিকে নিয়ে এসে রাখলেন যেখানে, সেখানেই নাগেদের রাজ্যে নাগেদের‌ই হাতে বন্দী রয়েছেন তাঁর মা বিনতা। ‘অমৃতের ভাণ্ড এনে দিয়েছি। এই মুহূর্তে তোমাদের শর্তমতো আমার মাকে ছেড়ে দাও। আর তোমরা স্নান করে পবিত্র হয়ে এসে এই অমৃত গ্রহণ করো।’ — নাগলোকের সাপেদের উদ্দেশ্যে বললেন তিনি।

‘ব্যস। এখানেই হয়ে গেলো আসল খেলা। সেই কথা শুনে আর সাপেরা স্নান করে এসে দ্যাখে, ভ্যানিস!’ — বলে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন সুধীন্দ্রনাথ।

‘মানে?’ — চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করল সৌজন্য।

‘তিনি তো তাঁর মাকে মুক্ত করে চলে গেলেন, সাপেরা গেলো স্নান করতে, আর সেই ফাঁকে দেবরাজ ইন্দ্র সেখান থেকে অমৃতের ভাণ্ড নিয়ে সোজা স্বর্গলোকে একেবারে চম্পট!’ — হাসতে হাসতেই বললেন সুধীন্দ্রনাথ।

‘তখন অমৃত না পেয়ে সাপেরা কি করলো?’ — জিজ্ঞেস করলো সৌজন্য।

‘সাপেরা তখন পাগলের মতো জিভ বার করে চাটতে লাগলো সেই জায়গাটাকে যেখানে অমৃতের কলসীটা রাখা ছিল, যদি কিছু অমৃতের ছিটেফোঁটা পাওয়া যায়, এইভাবে চাটতে চাটতে তাদের জিভ চিরে দু ফাঁক হয়ে গেলো, এইভাবে ঠকে গিয়ে সাপেদের নিজেদের বলতে পড়ে র‌ইলো জগতের সবার উপর আক্রোশ আর হিংস্রতা। কিন্তু তাদের অমর হ‌ওয়া আর হোলো না, আর দেবতারা অন্যের ক্ষমতা আর কৃতিত্বে আনা সেই অমৃত পান করে অমর হয়ে গেলেন চিরকালের মতো।’ — এতটা বলে সুধীন্দ্রনাথ একটু থামলেন।

তারপর তাঁর নাতির মুখের দিকে আস্তে করে বললেন, ‘তাহলে দেখলে তো, একটা সামান্য ঘটনা ...ওই বালখিল্য ঋষিদের ব্যাপারে ... কোথাকার জিনিস কোথায় নিয়ে গেলো। তাই বলছি পিকাইভাই, কাউকে অবহেলা কোরো না — বাইরে থেকে যতো তুচ্ছ, নগণ্যই মনে হোক না কেন —’

সৌজন্যের চোখে সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠলো সেই দশটাকার নোট আর ওই মামাদাদুর মুখটা।

সুধীন্দ্রনাথ বললেন, ‘মনে করে বলো দেখি গল্পের একেবারে শুরুতে কি ঘটনা বলেছিলাম?’

সৌজন্য কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো, ‘যজ্ঞ — যজ্ঞ করছেন মহর্ষি কশ্যপ; আর সেই জন্য কাঠ আনতে বললেন সব্বাইকে, আর তখন —’

সৌজন্যকে থামিয়ে সুধীন্দ্রনাথ বলে উঠলেন, ‘দারুণ! দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তি তোমার। বলো তো এরপর কি হোলো?’

‘এরপর ওই বালখিল্য ঋষিরা গাছের পাতা বয়ে আনতে গিয়ে পড়ে গেলেন।’ — বললো সৌজন্য।

‘ঠিক। একেবারে ঠিক। আর সেই নিয়েই দেবরাজ ইন্দ্রের হাসাহাসি, যার ফলে বালখিল্য মুনিদের অপমান, তাই ইন্দ্রকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় ইন্দ্র সৃষ্টির জন্যে তপস্যা করতে বসা, ব্যাপারটা ইন্দ্রের পক্ষে খুব বিপদজনক হয়ে যাচ্ছে বলে বালখিল্য মুনিদের সামনে কশ্যপ ঋষির আবির্ভাব, এবং ওই বালখিল্য মুনিদের দেবরাজ ইন্দ্রের বদলে পক্ষীরাজ গরুড়কে পাওয়ার আশীর্বাদ দান, ঘটনাগুলো পরপর মনে করতে পারছো তো পিকাইভাই?’ —

সৌজন্য মাথা নেড়ে বললো, ‘হ্যাঁ। কিন্তু তারপর তো তুমি এটার আর কিছু বললে না দাদাই । অন্য গল্পে চলে গেলে।’

‘ঠিক বলেছো। আমি অমৃত উদ্ধারের গল্পে চলে গেলাম। এইবার ওই গল্প কিভাবে বালখিল্য মুনিদের গল্পের সঙ্গে জুড়ে গেলো দ্যাখো। কশ্যপমুনি কেবল আশীর্বাদ দিয়ে চলে গেলেন তা নয়, কিংবা বালখিল্যমুনিদের তোমার ভাষায় “নাকের বদলে নরুন” ধরিয়ে দিয়ে গেলেন, তাও নয়, বালখিল্য মুনিদের অপমানের ব্যথাটা ওনার নিজের বুকে বিঁধেছিল, তাই ওই মহাশক্তিধর পক্ষীরাজ জন্মালো তার নিজের পুত্র হয়ে।’

‘মায়ের নাম বিনতা বলে তার মায়ের দিক থেকে নাম হোলো বৈনতেয়। আর বাবার নাম কশ্যপ বলে সেই দিক থেকে তার নাম হোলো কাশ্যপী। আর একটি গুরুতর ভার বহন করেছিলেন বলে তার নাম হয়েছিলো গরুড়।’ — বলে চলছিলেন পিকাইয়ের দাদু সুধীন্দ্রনাথ।

এতো কাণ্ড করে অমৃত উদ্ধার করে আনলেন যে মহাশক্তিমান শুধুমাত্র তাঁর মাকে নাগেদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ানোর জন্য, তিনিই ওই গরুড়। বিনতা আর কশ্যপের পুত্র। ইন্দ্রের চেয়েও শক্তিশালী। পক্ষীশ্রেষ্ঠ। ভগবান বিষ্ণুর বাহন — ওই অতিক্ষুদ্র বালখিল্য মুনিদের তপস্যায় যার জন্ম।

'উরিব্বাস!' — চোখ বড়ো বড়ো করে বললো সৌজন্য।

‘তাহলে দ্যাখো পিকাইভাই, একটা ছোট্ট ঘটনা থেকে ওই বালখিল্য মুনি, গরুড় আর অমৃত উদ্ধারের এতো বড়ো বৃত্তান্ত।’

'বৃত্তান্ত মানে? বৃত্ত মানে তো সার্কেল!' — ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো সে।

এবার হো হো করে হেসে উঠলেন সুধীন্দ্রনাথ, ‘ঠিক বলেছো। বৃত্ত মানে সার্কেল; তা দ্যাখো পিকাইভাই ঘটনাগুলো কেমন সার্কেলের আর্কের মতো ঘুরে এসে শেষ হোলো কিনা। তাই এই রকমের ঘটনা গাঁথা গল্পকে বলা হয় বৃত্তান্ত। আরো বড়ো হয়ে ব্যাকরণ পড়ে জানবে বৃত্তান্ত মানে বৃত্ত অন্ত হয় যেভাবে। খেয়াল করে দ্যাখো পিকাইভাই ঘটনাগুলো কেমন সার্কেলের আর্কের মতো ঘুরে এসে শেষ হোলো কিনা--’

‘এবার রাত হয়ে যাচ্ছে পিকাইভাই, শুতে যাও।’ — বলে সুধীন্দ্রনাথ তার আদরের নাতির পিঠটাকে চাপড়ে দিলেন।

সৌজন্য এবার তার দাদাইয়ের মুখের দিকে খুব গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে বললো —

‘দাদাই, ওই দশটাকার নোটটাকে খুব ভালো করে রেখে দিতে হবে।’

‘কেন বলো তো?’ — জিজ্ঞেস করলেন সুধীন্দ্রনাথ।

‘ওই দশটাকার নোটটা নিয়ে পরে একটা বৃত্তান্ত হবে দেখো।’

সুধীন্দ্রনাথ একটু অবাক হয়েই তাকালেন তার নাতিটির মুখের দিকে। দেখলেন সেই ছোট্ট মুখে বড়ো বড়ো চোখ দুটি যেন গভীর প্রত্যয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।


গতকাল রাতের ওই ঘটনাটার পর থেকে সবকিছুই যেন হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল সুধীন্দ্রনাথের জীবনে, সেই জন্য অনেকটা ভাঙা মনেই ডেকেছিলেন তার নাতিটিকে, কথা বলেছিলেন আর গল্প শুনিয়েছিলেন সেই মন খারাপটা সঙ্গে নিয়েই, কিন্তু সবশেষে তার নাতির থেকে এই কথাটা শুনে -- কিচ্ছুটি মুখে না বলে দুহাতে নাতির ওই ছোট্ট মুখটা তুলে ধরলেন সুধীন্দ্রনাথ।

আর দেখতে পেলেন একটি বৃত্তান্তকে, তখনই — ওই বড়ো বড়ো চোখ দুটির মধ্যে।



(পরবাস-৭৭, ১০ জানুয়ারি ২০২০)