এই ছোট্ট জীবনে দাদার মতো মানুষ আর দেখেনি ঝিংকু।
যেমন হাতের গুলতির টিপ, তেমন পায়ের জোর। একবার ছুটতে শুরু করলে দাদাকে ধরে কার সাধ্যি!
আর ছুটতে দাদাকে প্রায়ই হয়। রামর যেই বাড়ি এসে হাঁক দ্যায় — “ভজা....... !” মুহূর্তের মধ্যে একলাফে উঠোন পেরিয়ে বাবুদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে ছুটতে ছুটতে স্কুলবাড়ির সামনে দিয়ে দাদা উধাও হয়ে যায়।
ঝিংকু ছোটোছোটো পায়ে খানিকদূর এসে দরজার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে, চিন্তা কোলে তুলে নিয়ে আসে ওকে। রামর চীৎকার করতে থাকে — “আসুক আজ হারামজাদা ....... পিটিয়ে সোজা লা করেসি তু হামার নাম ভী ..... রুজ রুজ ই হাংগামা... আজ কিসকো বাগ্ সে আম তো কাল কিধারসে কেলা চুরাকে… বদনাম করকে ছোড়া ই শূয়ার কি ওউলাদ নে…।” গজগজ করতে করতে স্নানে চলে যায় রামর। থালায় ভাত বেড়ে রাখে চিন্তা। ঝিংকুকে কলতলায় নিয়ে গিয়ে দু’ মগ জল ঢেলে, নিজেদের খাবারও নিয়ে আসে। খেয়ে-দেয়ে, একটা ঘুম দিয়ে রামর বেরিয়ে যায়। যাবার সময় চিন্তাকে বলে যায় — “আজ উসকো খানা মৎ দেনা... কুছ নেহি শুন্ না হ্যায় মুঝে... তুর জন্যে উ শালাকো...।” চিন্তা জবাব দ্যায় না।
ঝিংকু জানে বাবা এখন খেলার মাঠে ঘাস কাটতে যাবে। এই বিরাট বড়ো কলেজটায় অনেক ছেলেমেয়ে পড়তে আসে, তারা এখানেই থাকে। বই খাতা নিয়ে সকাল দুপুর কলেজে যায়, আর বিকেলে পড়া শেষ হলে মাঠে যায় খেলতে। তাদের খেলার মাঠ জল দিয়ে ঘাস ছেঁটে ঠিক করে রাখে রামর আর রামরের মতো আরো কয়েকজন, যারা সবাই এই উঠোন-ঘেরা বাড়িটার চারপাশের ঘরগুলোতে থাকে।
এই কলেজে যারা পড়ায়, সেই বাবুদের বড় বড় বাড়িগুলোর পাশেও খেলার মাঠ আছে। রামর সেখানেও যায় মাঠ তৈরী করতে। বাবুরা খেলে, ছেলে মেয়েরাও খেলে — একটা বড় লাঠির মাথায় একটা গোল জাল লাগানো, সেটা দিয়ে বলকে মারে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে ঝিংকু। দাদা বলেছে ওই খেলার নাম নাকি ‘টিনিস’। ঝিংকুর খুব টিনিস খেলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু দাদা বলে — “ধূর, বাজে খেলা! কি হবে ওটা শিখে? .... তার চেয়ে গুলতি ছুঁড়তে শেখ্, কাজে লাগবে। আম খাসতো খুব, তুলতে তো পারিস্ না। আমি তো আর একটু বড় হলেই এখান থেকে চলে যাবো — তখন কে তুলে দেবে তোকে?” ঝিংকু তাড়াতাড়ি দাদার হাত ধরে বলে — “আমি গুলতিই শিখবো, তোমার কাছে, তুমি কোথাও যাবে না বলো?”
কিন্তু দাদা তো আজ এখনো বাড়ি এলো না! তবে কি দাদা চলে গেলো এখান থেকে? ঝিংকু ভয়ে ভয়ে চিন্তাকে আস্তে করে ঠ্যালা দ্যায় — “মা, দাদা কোথায়?” চিন্তা আধঘুমে ধমক দ্যায় — “যাবে কুথায়? প্যাটে টান্ পড়লেই আসবেক্। তুই ঘুমা এখন।” ঝিংকুর কিন্তু ঘুম আসে না। ও শুয়ে শুয়ে ভাবে — দাদার কি খিদে পায়নি এখনো? .....আচ্ছা, দাদা লুকিয়ে লুকিয়ে ফল পাড়ে কেন? ঝিংকু একবার জিগেস করেছিলো। দাদা বলেছিলো ‘ও তুই বড়ো হলে বুঝবি’... ঝিংকু কবে বড়ো হবে? ও যদি বড়ো হতো, তাহলে আজ ছুট্টে দাদাকে ধরে ফেলতো আর দাদার সঙ্গে যেতো। ভাবতে ভাবতে ঝিংকুর চোখ দুটো যখন ঢুলে এসেছে, ঠিক তখনই ভজার ঘামে ভেজা ক্লান্ত মুখটা দরজার ফাঁকে উঁকি মারে। ঝিংকু লাফিয়ে ওঠে — “দাদা!” চিন্তা উঠে বসে — “কই? কোথায় সে বদমাশ? হাড়মাস কালি করে দিলি হারামজাদা ..... যে চুলায় গ্যাছিলি স্যাখানেই মরতে পারলি নে? ..... ভাত গেলার সময় বাড়ি, না?” কান ধরে সপাটে দুটো চড় বসায় চিন্তা ভজার গালে। ভজা কিন্তু এখন আর পালায় না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খায়।
খেয়েদেয়ে ভজা এসে চুপ করে শুয়ে পড়ে ঝিংকুর পাশে। একটু বাদেই চিন্তার নাক ডাকতে শুরু করে — তিনবাড়ি বাসন মেজে আর কাপড় কেচে এসে, ঘরের কাজ সেরে, সে-ও ক্লান্ত। ভজা ইশারা করে ঝিংকুকে। দু’জনে পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসে। আস্তে আস্তে উঠোনটা পেরিয়ে এসে খালি পায়ে ছুট্ ছুট্.....!
এক্কেবারে বড় গাছতলা পেরিয়ে দম নেয় দু’জনে। হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে তাকিয়ে দ্যাখে ভজা। হঠাৎ আঙুলের ইশারা করে ঝিংকুকে — “ঐ দ্যাখ্, এই গাছের আম কটা পেকেছে....”
ঝিংকু ভয় পায়, বলে — “বাবা জানলে কিন্তু.....।”
ভজা বলে — “ও কিস্যু করতে পারবে না আমার.....এই গুলতি দেখছিস্? সবার মাথায় সুপুরি গজিয়ে দিতে পারি, জানিস্? দিই না, তাই! ও কি আমার বাবা না কি? ও তো বিহারী, তোর বাবা! ....... আমার বাবাটা মরে গেলো, আমার মাটা আবার বিয়ে করলো তাই..... দাঁড়া না, আরেকটু বড়ো হই — ওর মাথায় সুপুরি বানিয়ে দিয়ে আমি এমন দূরে পালিয়ে যাবো যে কেউ ধরতেই পারবে না।”
ঝিংকু ভালো বুঝতে পারে না। ঝিংকুর মা যদি ভজার মা হয় তাহলে বাবার বেলায় আবার অন্য ব্যাপার কেন? আমের আঁটিটা চুষতে চুষতে ঝিংকু ভাবে, এটাও বোধহয় ও আরেকটু বড়ো হলে তবে বুঝবে।
রোদ কমে আসছে। এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে বাবুদের বাড়ির সামনের রাস্তায় চলে আসে দুজনে। ধর-বাবুদের বাড়ির সামনের দরজাটা খোলা, ভেতরে টেবিলের ওপর সেই চকচকে জিনিসটা। ভজা একবার তাকিয়ে দেখে। তারপর গুলতিটা ঝিংকুর হাতে দিয়ে বলে — “তুই হোথা পুকুরপাড়ে নিম গাছের তলায় গিয়ে বোস্, আমি আসছি এখুনি।” ঝিংকু কিন্তু নড়তে চায় না। ভজা একটা ধমক দ্যায় — “যা বলছি কর্, নাহলে তোকে আর কোনোদিন আম পেড়ে দেবো না।” একবার কাঁচুমাচু মুখে দাদার দিকে তাকায় ঝিংকু, ভজার কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই। অগত্যা একটু একটু করে পা বাড়ায় সে, কি আর করা!
ওর খুব খুব ইচ্ছে করছিলো যে দাদা ওকে নিয়ে চলুক সঙ্গে, বলুক “ঝিংকু, তুই তো এখন বড় হয়ে গেছিস, এই কাজটা করতো...” কিন্তু দাদা সেসব কিছুই করলো না।
বসে বসে ক্লান্ত হয়ে ঝিংকু যখন উঠে পড়বে ভাবছে, তখন দেখে দূর থেকে দাদা ছুটতে ছুটতে আসছে। কাছে এসে হাঁপাতে থাকে ভজা — সারা গায়ে ঘাম ঝরছে, পেটের কাছে জামাটা ফোলা। “ওটা কি দাদা?” — ঝিংকু জিগেস করে। সে কথার উত্তর না দিয়ে ভজা বলে — “শীগ্রি চল্ এখান থেকে, স্কুলের মাঠে জানলার নীচে গিয়ে বসি।.... বাড়ি গিয়ে বলবি যে আজ সারাদুপুর আমরা জানলার নীচে বসে স্কুলের পড়া শিখেছি!”
কিন্তু জানলার নীচে বসে কি আর পড়া সব শোনা যায়? কালো বোর্ডে যে দিদিমণি কি লিখছে সে তো ঝিংকু দেখতেই পাচ্ছে না! উসখুশ করতে করতে ঝিংকু আবার জিগেস করে — “জামার ভেতরে কি, দাদা?” ভজা জামাটা একটু তুলে ধরতেই ঝিংকুর চোখ গোল হয়ে গেলো — “ধরবাবু...।” “চুপ!” ভজা মুখ চেপে ধরলো ঝিংকুর।
সন্ধ্যের একটু পরে, মুরগীর খাঁচায় জিনিসটা লুকিয়ে রেখে ঘরে ঢোকে দুজনে। ঢুকতেই সামনে চিন্তা, ঝাঁপিয়ে পড়লো ভজার ওপরে — “আবার বার হয়েছিস্ ঘর থ্যাকে......এ্যাতো মারি তবু কুনো লাজলজ্জা নাই গো এটার শরীলে.... আবার ঝিংকুরে সাথে, কেন? ওটারেও চোর বানাবি তোর মতো?.....কার বাগানে গিসলি হারামজাদা বল্....”
দাদার হেনস্থা দেখতে দেখতে ঝিংকু হঠাৎ বলে ওঠে — “বাগানে না মা, আজ স্কুলের মাঠে জানলার নীচে বসে পড়া শুনেছি!”
“এবারে সেলেটটা নিয়ে নিজেরা একটু লিখতে বসো — নমিতাদিদি A, B, C, D লেখা বই দিয়ে গেছে ক’দিন হল?” বলে দুজনকে টেনে ঘরে বসিয়ে চিন্তা মুড়ি আনতে যায় ।
মুড়ি চিবোতে চিবোতে একমনে ঝিংকু তাকিয়ে থাকে বইটার দিকে। দাদা দেখে দেখে লেখার চেষ্টা করছে — আমের মতো দেখতে, ওটা কি? ভজা গম্ভীর মুখে বলে — “বোকা, এটা আম নয়.....D!”
ঠিক তখুনি উঠোনের দরজা দিয়ে রামর ঢুকলো, সঙ্গে ধরবাবু। ঘরের সামনের ছোট্ট একফালি বারান্দায় রাখা উনুনে চিন্তা রুটি করছিলো, মাথার ঘোমটা টেনে উঠে দাঁড়ালো। রামর চিন্তাকে বললো — “ভজা কই?”
চিন্তা ভয়ে ভয়ে বললো — “ঘরে পড়ছে..... কি হয়েছে?”
রামর ঘরে ঢুকে কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে ভজাকে এক ধাক্কা দিলো..... “বাবুর ঘরে ঢুকে....তুর এতো বড়ো সাহস....চুর্....”
টাল সামলাতে না পেরে ধরবাবুর পায়ের কাছে এসে পড়লো ভজা।
দেখতে দেখতে উঠোনে ভীড় জমে গেলো। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দাদাকে দেখছে, কেউ বলছে না যে ‘তোমরা ভজাকে মেরো না’। এরা কেউ ভজার বন্ধু না, ভজার সঙ্গে কেউ মেশে না। ঝিংকুর খুব কষ্ট হচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে দাদার কাছে যদি গুলতিটা থাকতো তাহলে দাদা সবাইকে মজা দেখিয়ে দিতো; কিন্তু সেটাও রয়ে গেছে ঝিংকুর পকেটে!
দাদা খালি কাঁদতে কাঁদতে বলে যাচ্ছে — “আমি কিছু চুরি করি নাই গো বাবু, সত্যি বলছি!”
ব্যাপার দেখে গৌরাঙ্গ এগিয়ে এলো। কলেজের অফিসের বেয়ারা সে। পার্টি-পলিটিক্স করে, ভারভারিক্কী চেহারা। ধরবাবুর কাছে গিয়ে বললো — “কি ব্যাপার, স্যার?”
ধরবাবু বল্লেন — “গৌরাঙ্গ! তুমিও এখানে থাকো বুঝি? আচ্ছা।...... আরে আজ দুপুরে, আমার বাড়ির সামনের দরজাটা খোলা ছিল একটু, থাকে না বড় একটা, আজই.... তা দশমিনিট হবে বোধহয়, টেবিলের ওপর থেকে ব্রাশের ক্যান্ডেল স্ট্যান্ডটা উধাও। সামনের বাড়ির সেনবাবুর মেয়ে দেখেছে ওকে ঘরে ঢুকতে, ছুটে পালাতেও দেখেছে। .....আরে এইটুকু একটা ছেলের জন্যে বাগানে একটা ফলমূল রাখার উপায় নেই! এবারে ঘরেদোরে ঢুকলে তো একটা স্টেপ নিতে হবে..... কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর এইসব কি ব্যাপার বলো দেখি!”
গৌরাঙ্গ ভজাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে — “নিয়েছিস্ তুই?” ভজা আবার কেঁদে ওঠে — “না গো, মাইরি... মা কালীর দিব্ব্যি.....”
গৌরাঙ্গ দলের দুজন ছেলেকে ডেকে বললো — “ঘরে খুঁজে দ্যাখ্, চৌকির তলা-টলা.....” সারাঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিন্তু জিনিসটা পাওয়া গেলো না।
গৌরাঙ্গ বললো — “মুরগীর খাঁচাটা দ্যাখ্ তো একবার......এইটুকু সময়ে আর কোথায় সরাবে?”
খাঁচার খড় সরাতেই বেরিয়ে পড়লো চকচকে জিনিসটা।
ধরবাবু বলে উঠলেন — “এই তো! আবার বলে ‘নিইনি’!”
গৌরাঙ্গর মধ্যস্থতায় পুলিশ অবধি গড়ালো না ব্যাপারটা। রামর বাড়ি এসে চিন্তাকে বললো — “বহুত বরস হো গ্যয়া ইধার কামমে, ইসিলিয়ে বাঁচ্ গ্যয়া আজ ..... লেকিন উ শালাকো হমী......”
রামর আর চিন্তা পালা করে মারতে মারতে একটা লাঠি ভেঙে ফেললো, তবু ভজার মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটাও বার হলো না। “ঠ্যাঁটা ক্যামন দেখ..... শয়তানের বাসা..... মুখ বন্ধ করে পড়ে আছে যেন.....” ইত্যাদি বলতে বলতে প্রতিবেশীরা আস্তে আস্তে যার যার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
রাতে খেতে বসে রামর চিন্তাকে বললো — “কাল হামি দেহাত যাব, উ শালাকো ছোড়কে আউঙ্গা। আভি দো দিন কলেজ বন্ধ্ হ্যায়, ইসকে বাদ এতোয়ার (রবিবার)..... আনেযানে মে দো দিন, তিসরে দিন শাম তক্ ম্যায় আ যাউঙ্গা।”
চিন্তা অবাক হয়ে বললো — “দেহাত? তুমার গাঁয়ে?.....উখানে কি করবে ডজা? কারে চিনে ও হোথায়?.....” রামর কিন্তু অটল — “চিনে না তো চিনে লিবে.....হমার ভাইকে সাথ্ ক্ষেতি করবে.....খাটবে পিটবে তব রোটি পাবে.....মুফতকা খানা বহুত হোগ্যয়া....ইধার রাখনেসে ঝিংকু ভী বিগড় যায়গা....একদিন হমকো নোকরি সে নিকাল দিয়া তো?”
চিন্তা তবু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে, কান্নাকাটি করে — কিন্তু বৃথা। রামর হাতমুখ ধুয়ে শুতে চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায় যে চিন্তা যেন ভজাকে পরদিন ভোর সাতটাতে তৈরী করে রাখে।
সকালে উঠে ঝিংকু দেখে বাবা ব্যাগ কাঁধে বেরোনোর জন্যে রেডি হয়ে গেছে। মা চোখ মুছতে মুছতে একটা কাগজে ক’টা রুটি বেঁধে দিচ্ছে — রাস্তার খাবার। বাবা হাঁক দিলো — “ভজা!” পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে নেমে এলো ভজা। পরিষ্কার জামা-প্যান্ট পরা, কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগে কয়েকটা জামা, পায়ে হাওয়াই চটি। দাদাকে যেন কেমন অন্যরকম দেখতে লাগছে।
রামর চিন্তার হাতে কটা টাকা দিয়ে কি বলছে..... গৌরাঙ্গকেও ডেকে আনলো রামর।
ঝিংকু এই ফাঁকে গুলতিটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে ভজার পাশে এসে দাঁড়ালো। ওর স্থির বিশ্বাস যে এটার অভাবেই কাল দাদার এতো হেনস্থা হয়েছে!
দাদার জামাটা টেনে ধরে আস্তে করে গুলতিটা বাড়িয়ে দিলো ঝিংকু। ভজা একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো, বললো — “ওটা তুই রেখে দে।”
ভীষণ অবাক হয়ে গেলো ঝিংকু। এই মহার্ঘ্য সম্পত্তি, যেটা দাদা ঝিংকুকে ভালো করে ছুঁতেও দিতো না এতদিন, সেটা দাদা ওকে দিয়ে দিচ্ছে? সত্যি?
ঝিংকু এবার ফিসফিস করে বললো — “দাদা, বাবা হোথায় কথা কইছে.....তুমি উধার দিয়ে ছুটে পাইলে যাও....ধরতে পারবেনি....”
— “না রে, কোথায় যাবো? টেরেন্ ধরতে হবে তো!” বলে ভজা বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে দাঁড়ালো ।
রামর কথা শেষ করে দরজার দিকে এগোলো। চিন্তা ঝিংকুকে কোলে নিয়ে পিছু পিছু এসে দরজা ধরে দাঁড়ালো। রামর আর ভজা পাশাপাশি, জীবনে বোধহয় এই প্রথম, একসাথে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় এসে পড়লো। ঝিংকু তখনো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দাদার হাওয়াই চটি পরা রোগা পা-দুটোর দিকে, ভাবছে ‘এই দাদা দৌড় দিলো বলে.....’
কিন্তু নাঃ, ভজা কিন্তু দৌড় দিলো না। রামর এর পিছনে পিছনে পা ফেলে আস্তে আস্তে রাস্তার বাঁক পেরিয়ে দূরে হারিয়ে গেলো ভজার ছোট্টো রোগা শরীরটা। চিন্তা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছে। ঝিংকু কিন্তু কাঁদতে পারছে না। শুধু ঝিংকুর বুকের ভেতর ওর চেনা পৃথিবীটার ভাঙচুরের শব্দ খুব জোরে জোরে বেজে উঠছে।
(পরবাস-৭৭, ১০ জানুয়ারি ২০২০)