Subscribe to Magazines



পরবাসে অরিন্দমের
লেখা


বই


Parabaas Bookstore



ISSN 1563-8685




পাখির চোখে রূপকথা


রূপকথা ট্রাভেলস—সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২০; সৃষ্টিসুখ; পৃষ্ঠা: ১৪৩; ISBN: 978-93-88887-95-3

একটা তুলো-ভরা টেডি পুতুল, যে তার অধুনা-পরিত্যক্ত প্রেমিকের উপহারস্বরূপ একদিন মেয়েটির ঘরে এসেছিল, - তার কাচের চোখের সামনে মেয়েটির নিজের হাতে বোনা জীবনের দোটানা খুলে যেতে থাকে, বা বলা যায় মেয়েটির বর্তমানে ক্রমাগত অতীতের ছায়া পড়ে, না-শুকোনো জলরং-এ যেভাবে একটু অন্য রং লাগলেই তা ছড়িয়ে যায় অনেকদূর। গোপন ক্যামেরার সামনে যেভাবে কখনো কখনো অজান্তেই উন্মোচিত হয়ে যায় আমাদের যাপন, সেইরকম (টেডি)।

শুধু যা সেই পুতুল দেখে না সেটুকু গল্পকার নিজের হাতে তুলে নেন... এবং শুধু সেটুকু কাজ সেরেই তিনি আবার মিলিয়ে যান। পাঠককে মেয়েটির আর টেডি পুতুলের হাতে ফেলে রেখে। পিকাসো ডোরা মারের আত্মাকে ধরতে গিয়ে শুধু প্রোফাইলের ওপর ভরসা না করে, মুখের অন্যদিকটাও মেলে ধরলেন। তারপর গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে এলেন ছবি থেকে। যেন কোনো কৈফিয়ত দেবার দায় স্রষ্টার না। এ যেন অনেকটা সেইরকম।

প্রেমে প্রতারিত হয়ে শহর ছেড়ে চলে যাওয়া এক যুবক, যে কোন মরীচিকার টানে সাত বছর পরে শহরে ফিরে আসে সে নিজেই জানে না (ক্যাকটাস বার)। কিংবা পজেসিভ বান্ধবী যে প্রেমিকের মন বাজিয়ে দেখতে আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসে, এবং এক তরুণ, অনভিজ্ঞ মন যে নিজেই ঠিক করে জানে না কাকে সে ভালবাসে, কার প্রতি চোরাটান (ল্যাটিচুড লঙ্গিচুড)।

যে যুবকের জীবন চাকরির আশায় বসে থেকে বয়ে গেছে, যার আশা তো নেই-ই, হতাশার বোধও নেই আর তেমন, এক শিশি ম্যাজিক চূরণ খেয়ে যার কাল সকালে ঘুম ভেঙে উঠলেও হয়, না উঠলেও হয়, সেই ছেলেটির কথা (সেলসম্যান)।

এমনই সব চরিত্রেরা ভিড় করে আসে সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের গল্প সংকলন রূপকথা ট্রাভেলস-এ। এর একটি গল্প ('রূপকথা ট্রাভেলস') দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন আগে। কিছু গল্প পরবাস এবং বম্বে ডাক আন্তর্জাল পত্রিকায়। দুটি গল্প এতাবৎ অপ্রকাশিত।

নাম গল্প ('রূপকথা ট্রাভেলস') অনুসারে চমৎকার প্রচ্ছদ এবং পরিপাটি মুদ্রণ। শুধু দুটি মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়ল যার একটি আঞ্চলিক বাগবিধির জন্য ছাড় পেলেও পেতে পারে। অন্যটি, "হটকারিতা", আশা করি পরবর্তী সংস্করণে শুধরে যাবে। কিন্তু, "এহো" নিতান্তই, "বাহ্য"। বহিরঙ্গের কথা। অন্তরঙ্গের রস আস্বাদন তাতে আটকায় না। তাই মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই।

চরিত্রগুলি মোটামুটি আমাদের চেনা পারিপার্শ্বিক থেকে উঠে আসা। মানে যাদের ঘোরাফেরার চৌহদ্দির অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা আমাদের চেনা। কখনো কলকাতার শহরতলী, কখনো আরব সাগরের থেকে উড়ে আসা জলকণায় ভেজা এক বন্দর। আমাদেরই ঘর দুয়ার, আমাদের রোজকার বাঁচা মরা।

একটু অচেনাও যারা, তারাও তাদের অসহায়, হৃতগৌরব বর্তমানের দৌলতে আমাদের ছাপোষা জীবনের অনেক কাছাকাছি। যেমন 'ন্যুড স্টাডি' গল্পে সেই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ শিল্পী।


কিন্তু সত্যিই কি আমরা পুরোপুরি চিনি তাদের?

সেই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধকে তার জীবনের শেষ ক’দিন সঙ্গ দেয় যে মেয়ে, বন্ধুর মত, সেবিকার মত... যে নিজেই নিজের পরিচয় দেয় কল্পনা বলে... শিল্পী তাকে নিজের সূর্যকরোজ্জ্বল দিনের গল্প বলতে থাকেন, না, বলা ভাল, তাকে উপলক্ষ্য করে নিজেই অতীত রোমন্থন করে যান... কখনো তাকে মডেল করে ছবি আঁকতে চান, কখনো সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে একা বসে থাকেন...নাকি ঠিক একা নয়। এক জরাজীর্ণ শিল্পী আর তার জরাজীর্ণ বাড়ির মধ্যেকার সম্পর্কটি এমন ভাবে প্রকাশ হয় গল্পের শেষে যে তাকে দিনের প্রখর আলোয় মনে নেওয়া না গেলেও, পাঠক অন্য একটা সম্ভাবনার আভাস ঠিক পেয়েই যান...যুক্তির নিরিখে কোনো তত্ত্বকে নস্যাৎ করতে গিয়েও থমকে যান, নিজেকেই বলে ওঠেন, তাই তো! এও তো হতে পারে।

'সেলসম্যান' গল্পেও সেই যুবক যে আজকাল স্টেশনে বসে থাকে, থেকে থেকে মজে যাওয়া সরস্বতী নদীর বুকে জাহাজী মেয়েমানুষদের গান শুনতে পায় সেও কোন এক সন্ধ্যায় এক না-চাকরির চুক্তির জন্য লিখে দিয়েছিল বাকী জীবন... গল্পের শেষের দিকে কে তাকে ওই জাদু চূরণ খেয়ে ঘুমিয়ে না পড়তে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে, তাকে খানিক চেনা যায়, খানিক যায় না।

গল্প সংকলনটির এই আলো আঁধারি আমাদের এই চেনা পৃথিবীর মধ্যেই যে আরেকটা মায়া পৃথিবী রয়েছে তার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে অর্থে একে এককথায় আরবান রূপকথার তকমা দিতে গিয়েও থমকে যেতে হয়... এ কী কেবলই রূপকথা? ...মনে হয় এখনই এর জঁর নির্ধারণ করার দরকার নেই, বলার, ভাবার, চরিত্রগুলির সাথে আরো কিছুক্ষণ পথচলা বাকি রয়ে গেছে, এখনও!

মানব মানবীর চিরন্তন সম্পর্কের টানাপোড়েনের এক ক্যালাইডোস্কোপ এই কয়েকটি গল্প। মনের গতি কখনোই সরলরৈখিক নয়... নিবিড় নিরীক্ষায় এখানে আপাত সরল রেখাও কাঁপা হাতের লেখার মত ভঙ্গুর, নেবুলার মত অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিরপরাধ গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্র শমীক এক প্রবঞ্চকের পাল্লায় পড়ে ফেঁসে যাচ্ছিল। ওপরওয়ালার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়... কিন্তু তার আগেরদিন লুকিয়ে দেখে ফেলা যে দৃশ্যটি তাকে মথিত করেছিল, সেটি সম্পর্কে শমীকের নিজেরই ধোঁয়াশা কাটতে চায় না। আশ্চর্য শব্দচয়ন এই অসম্ভব কঠিন চ্যালেঞ্জকে বহন করে নিয়ে গেছে কী সহজে-- "অসতর্ক মানুষের ঘাড়ে যেমন ভূত ভর করে সে মতিলালের শরীরে ভর করেছে। শমীক ভূত হয়ে গেছে। আসলে হয়তো উল্টোটাই, মতিলালই তাকে ভর করেছে। কিন্তু সে সঠিক বুঝল না। শুধু এটুকু বুঝল যে জ্যোৎস্নার নিচে মেয়েটির শরীরে সে আমূল প্রবিষ্ট হয়েছে। বেচারা মতিলাল! এখন সে আর সম্ভোগের আনন্দ পাবে না।"

যে গল্পটির কথা না বললে এই সংকলনটির কথা যা কিছু বলা সবই অপূর্ণ থেকে যাবে, সেটি হল এর নাম-গল্প--'রূপকথা ট্রাভেলস'। বস্তুত এই গল্পটা লিখে অনেকে কলমটি দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে আসার কথা ভাবতে পারেন। অন্তত আমি তাই ভাববো।

মায়া না মেঘমায়া নামের সেই নারী...যে বারবার কোথাও যাবার কথা বলে...সাড়া না দিলে নিজেই সরে যায়.....কখনো ভয় দেখায় ...অথচ ছেড়ে যায় না, বারবার জ্যোৎস্না হয়ে, লিলুয়া বাতাস হয়ে ফিরে আসে, ইট কাঠের শহরে সোডিয়াম ভেপারের হলদেটে আলোর নিচে ও কার হাত মুঠিতে জড়িয়ে হাঁটে...শেষ পর্যন্ত্ একদিন সে অলৌকিক সাদা ঘোড়ার পিঠে আকাশমার্গে সওয়ার। হয়তো চিরদিনের মত চলে যাবে এইবার। সেই ঘোড়ার হ্রেষা ছেলেবেলার রাংতা জড়ানো চিরুণীর রিনরিনে বাঁশিকে মনে করায়... তখনই মায়ার মুখটি একবার ভাল করে দেখার ইচ্ছে জাগে... "মুখখানি যেন কার মত, মুখখানি তবু কার মত!"

রূপকথা নয়, আসলে এ অরূপকথা।



(পরবাস-৭৮, ৮ই এপ্রিল, ২০২০)