পদ্ম ঝিলের পারে; —অতনু দত্ত; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৮; ঋতুযান; পরিবেশক: আনন্দ প্রকাশন; প্রচ্ছদ -- সোমাদ্রি সাহা; পৃষ্ঠা: ৬৪; ISBN: 978-935291-431-9
কিছুদিন আগেই অতনু দত্ত-র প্রথম কাব্যগ্রন্থ “পরিযায়ী মন” পড়া শেষ করার পর জানলাম, ওনার প্রথম গল্পের বইটিও “ঋতুযান” থেকে একই সাথে প্রকাশিত হয়েছে। সেদিনই অনলাইনে খুঁজতে শুরু করি, আর সৌভাগ্যক্রমে পেয়েও যাই।
নামেই রহস্যঘন এ বইয়ের প্রচ্ছদে কাদামাটির ওপর এক চটি সহ পা, অন্ধকার ঝোপঝাড় মাড়িয়ে কেউ যেন হেঁটে যাচ্ছে।
অতনু-র কবিতা পড়ে এসেছি এতদিন, আজ তাঁর লেখা গল্প পড়তে গিয়ে শুরুতেই চোখ আটকে যায় “কথায় কথায়”, যেখানে লেখালেখি জীবনে অভিভাবক স্বরূপ শ্রী দেবব্রত সান্যাল সহ অগণিত বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীদের সকল ঋণ স্বীকারের সাথে তিনি বলেন, পরিবারের প্রিয় মানুষদের ভাগের মূল্যবান সময় চুরি করে তাঁর এই সাহিত্য চর্চা। অসম্ভব ভালোলাগে এই সৎ উচ্চারণ।
দু'টি মাত্র বড় গল্প নিয়ে এই কৃশতনু বইটি। প্রথম গল্পের “বুধন” চরিত্রটি আমার খুব প্রিয়। এক অবহেলিত মানুষের কথা যেন। বইয়ের পেছন মলাটেও তাকে নিয়ে লেখা হয়, “অদ্ভুত জীবন বুধনের। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে, এক সুস্থ সবল কর্মঠ মানুষ স্বেচ্ছায় নিল নির্বাসন, বদলে গেল এক জুবু থুবু উদ্দেশ্যহীন শরীরে।”
বনেদী চক্রবর্তী বাড়ির কর্তাবাবু ও গিন্নি মা-র কাছেই বুধনের ছেলেবেলা, বড়বেলা। গিন্নি মা তাঁর মায়েরই মতন। বাড়ির বড় ছেলে ও বুধন সমবয়সী হওয়াতে ছায়াসঙ্গী হতে সময় লাগে না। প্রায় একই সময়ে তাদের বিবাহ ও সন্তান। যদিও বুধন জানতে পারে তাঁর স্ত্রী এক মৃত পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। এরপর সম্পর্কের ক্রিসক্রস - স্ত্রী-র অন্য সম্পর্ক, আবিরের মধ্যে দেখতে পাওয়া স্ত্রী সুন্দরীর মুখ, ও আবিরের মন জুড়ে আরেকটি মানুষের বাস, কুহেলি।
Listen to your inner soul, সে কখনও মিথ্যে বলে না। বুধনের ভয় হয়, ভয় হয় গিন্নি মা-রও। কোথাও তারা এক ভুল করেছে। কি সেই ভুল – কি সে পাপ, জানতে গিয়ে তরতর করে এগিয়ে যায় গল্প। এতে লেখা বর্ণনাগুলো এত নিখুঁত যে পড়তে গিয়ে মনে হবে, সামনে থেকেই দেখছি। যেমন, “খানিক পরে একটা হিন্ডালিয়ামের বহু পুরনো টেরাব্যাঁকা থালায় দুটো শুকনো রুটি আর একটু আলু কুমড়োর তরকারি বৌমা তার সামনে ঠক করে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। বুধন পরম যত্নে থালাটা তুলে খেতে শুরু করে। রুটিটা ছিঁড়তে গেলে ভেঙ্গে যায়।”
আরও এক জায়গায়…
“বুধন শতরঞ্চি পেতে আয়েশ করে বসে এক এক করে ছিপগুলো আলাদা আলাদা করে সাজায়। দুটো হাতছিপে কেঁচো গুঁজে সুতো ছাড়িয়ে টিপ করে দূরে ছুড়ে মারে। ফাতনাটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরলে আস্তে করে জলে গোঁজা ডান্ডার মাঝে ছিপটাকে রাখে।”…
সমাজের ছোট বড় প্রতিচ্ছবিকে তুলে ধরে এ গল্প। কি নেই এতে! দুটো মানুষের মনকেমনের কাহিনী, গঞ্জনা বঞ্চনা শুনে বুধনের দিনযাপন ও বারবার স্বপ্নে আসা সেই জলপরী, শেষটায় যে তাকে তলিয়ে নিয়ে যায় ঝিলের অনেক অনেক গভীরে।
“জলের নীচে আলগা হওয়া নাইলনের শক্ত সুতো জড়িয়ে যায় বুধনের দুই পায়ে। চেষ্টা করে বুধন নিজেকে ছাড়ানোর, পারে না, উলটে আরও জড়িয়ে যায়। মরিয়া হয়ে ভেসে ওঠার চেষ্টা করে সে। আর বোঝে সুতোটা তাকে নিয়ে চলেছে ঝিলের গভীরে। আরও গভীরে।”
কিছু গল্পের রেশ কাটতে সময় লাগে, এ গল্প পড়ার পর আমারও ঠিক এমনটাই হয়। চরিত্রগুলো মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করে ও এক অদ্ভুত ভালোলাগা নিয়ে আমিও হাত ধরি দ্বিতীয় গল্পটার।
এ বইয়ের দ্বিতীয় গল্প “ভালুকবনির বিভীষিকা”। পড়তে গিয়ে একবারও মনে হয়নি এটি লেখকের প্রথম প্রকাশিত গল্পের বই। শুরুতেই আভাস দিচ্ছিল কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
মস্ত ঝড় বাদলার রাতে শেখরের মোটর সাইকেল খারাপ হয়ে যাওয়া, ও এক অপরিচিতর সাথে আলাপ - স্বল্প আলোয় যার শীর্ণকায় ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হচ্ছিল সবে…এভাবেই দুটো চরিত্র ধীরে ধীরে প্রবেশ করছিল পাঠক মনের অন্তঃপুরে। অন্ধকার রাতে তাদের কথোপকথন, ও মানুষটির পেশীবহুল চেহারার সাথে বেমানান গলা, শেখরকে মুহূর্তের মধ্যে সন্দেহে ফেলে। এরপর বৃষ্টি বাড়ে, সাথে প্রচণ্ড গর্জনে বাজ পড়ার শব্দ। অগত্যা বাঁকা-র প্রস্তাবে শেখরকে রাজি হতে হয়, যে আজকের রাতটা ওদের বাড়িতেই কাটাবে। এই অংশটায় এসে যখন অনেক প্রশ্ন জমে, ঠিক তখনই পাঠককে সটান মেরে বসিয়ে দেয় গল্পটা। ভাবতে বাধ্য করে, কি হবে এবার! কে এই বাঁকা? অন্ধকার ঘন জঙ্গল, যেখানে কোনও জনবসতি নেই সেখানে বাঁকা কোথায় নিয়ে যাবে শেখরকে?
বাঁকা ওর স্ত্রীর সাথে আলাপ করিয়ে দেয়, যদিও শেখরের তাকে অন্যরকম লাগে। কথাবার্তাতে কোথাও তাকে আদিবাসী বলে মনে হয় না। এরপর সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। বাড়িতে বাবা মা আছেন, অথচ কোথাও তাদের দেখা যায় না। সর্বোপরি কালো বিদ্ঘুটে বাঁকার হাসি ও আদ্যপ্রান্ত মুখ ঢাকা ওর স্ত্রী-র মন্তব্য “ইনিও শেখর!” সেই রাতের অন্ধকারকে গাঢ় করে আরো।
এরপর রুদ্ধশ্বাসে গল্প এগোয়। পর্দায় এমন হলে চোখ বন্ধ করতে হত, ভয়ে। কিন্তু শেষটা জানার আগ্রহে দেখি, ... না, আর বেশি বলা উচিত হবে না। একটা জমজমাট সিনেমা হলে যদি কোনও দিন এ গল্পের স্ক্রীনিং হয়, তবে দর্শক এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভৌতিক কাহিনীতে একাত্ম হবেন সহজেই।
ভিন্ন দুই গল্পের সমাহারে “পদ্ম ঝিলের পারে” পাঠক মন জয় করতে যথেষ্ট। পৃষ্ঠার মান, ফন্ট সাইজ ও টানটান লেখনী, সবেতেই প্রশংসা রাখে এ বইটি। প্রচ্ছদ নির্মাণ, অলঙ্করণ, গ্রাফিক্স ও অক্ষর বিন্যাসে শিল্পী সোমাদ্রি সাহা-র তুলির মুন্সীয়ানাও এতে স্পষ্ট। বইটি উৎসর্গ করা হয় ঝাড়গ্রাম-কে।
শেষে, পাঠক হিসেবে শুধু এটুকু বলা যায়, আরও অনেকের হাতে পৌঁছে যাক “পদ্ম ঝিলের পারে”। সার্থক এ গল্প-দ্বয়, সার্থক এ গল্পের সাথে কাটানো আমার সকল সময়।
(পরবাস-৭৮, ৮ই এপ্রিল, ২০২০)