Subscribe to Magazines



পরবাসে অনন্যা দাশের
আরো লেখা


বই


ISSN 1563-8685




রুমি যে অন্য রকম

বিকেলে মা আর বাবা যখন বসে চা খাচ্ছিলেন তখন হঠাৎ রুমি কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এল।

মা ঘাবড়ে গিয়ে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে ছুটে এলেন, “কী হয়েছে রুমি কাঁদছ কেন? কোথাও লেগেছে নাকি?” এই সব জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।

রুমি মনের দুঃখে প্রায় ভেঙ্গে পড়ে বলল, “এষা আর সৌরা আমাকে ওদের সঙ্গে খেলতে নিচ্ছে না!”

মা-বাবাতে চোখাচোখি হল, তারপর মা বললেন, “কী হল আবার?”

রুমি বলল, “আমরা পুতুল নিয়ে খেলছিলাম। আমার খুব যে ভালো লাগছিল তা নয় কিন্তু তাও খেলছিলাম ওদের সঙ্গে। তারপর এষাদের বাড়ির পিছনে যে টবগুলো রাখা আছে সেটার একটাতে আমি একটা পোকা দেখতে পেলাম! কী সুন্দর দেখতে জানো মা, সবুজ গা আর তাতে অরেঞ্জ রঙের ছোপ ছোপ। আমার খুব ভালো লাগল পোকাটাকে। হাতে নিয়ে দেখে আবার যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিয়ে যখন আবার খেলতে গেলাম তখন ওরা ভয়ে দুড়দাড় করে ভিতরে পালিয়ে গেল! এষা তো ওয়াক তুলছিল! আমি বললাম আমি হাত ধুয়ে নিচ্ছি কিন্তু ওরা আমার কোন কথা শুনল না!” বলে আবার সে কান্না জুড়ে দিল।

মা বাবা আর কী করবেন ওকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।

রুমির ওটাই একটা সমস্যা। সে বড্ড পোকামাকড় ভালবাসে। অনেক ছোটবেলা থেকেই সে অনেক রকম পোকা চেনে। দাদুর একটা বই ছিল পোকামাকড় নিয়ে সেটার ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে মা ওকে খাওয়াতেন কারণ সেটাই ছিল ওর খুব পছন্দের বই। রুমি হাঁ করে ছবি দেখত তাই অনেক পোকামাকড় চেনা হয়ে গিয়েছিল ওর খুব ছোটবেলা থেকেই। তারপর একটু বড় হতেই পোকামাকড় দেখতে পেলেই কাছে গিয়ে দেখত সে। ভয় পেত না মোটেই। শুঁয়োপোকা, প্রজাপতি, গুট পোকা, আরশোলা, মাকড়সা, পিঁপড়ে, কেঁচো, কেন্নো সবই তার খুব পছন্দের! তারা সবাই যেন ওর বন্ধু। সেবার কালীপুজোর পরদিন বারান্দায় এক গাদা শ্যামাপোকার মৃতদেহ দেখে রুমির সেকি কান্না! আগে রুমিরা বাবার কাজের জন্যে একদম ছোট একটা জায়গায় থাকত, সেটাকে গ্রামই বলা যায় প্রায়। অনেক খোলা জায়গা ছিল সেখানে আর তাই রুমির পোকামাকড় বন্ধুদেরও অভাব ছিল না। কিছুদিন হল বাবা বড়ো শহরে বদলি হয়েছেন তাই ওরা সবাই বাবার সঙ্গে শহরে এসেছে। এখানে এসেই সমস্যাটা শুরু হয়েছে। রুমির ওই পোকামাকড় প্রীতির জন্যে সবাই ওকে এখানে প্রচণ্ড খেপায়। মন খারাপ হয়ে যায় রুমির। ওর ক্লাসের মেয়েগুলো আর পাড়ার বন্ধু মেয়েরা সব সেজেগুজে পুতুল নিয়ে খেলে। রুমির সে সবে আগ্রহ নেই মোটেই। তাই স্কুলেও ওর বন্ধু হচ্ছে না কেউ। এষা আর সৌরা হয়েছিল তাও ওই কমলা রঙের ছোপ ছোপ পোকার ঘটনাটার পর ওরাও আর রুমির সঙ্গে খেলবে বলে মনে হয় না। মা বাবা বুঝিয়েশুঝিয়ে শান্ত করাতে রুমি নতুন দেখা পোকাটার ছবি আঁকতে চলে গেল। সে বেশ ভালই আঁকে আর নতুন কোন পোকা দেখলেই সেটার ছবি এঁকে রাখে। পরে সেটা দেখে কী নাম এই সব খুঁজতে সুবিধা হয়।

পরদিন রুমি বেশ খুশি হয়ে স্কুল থেকে ফিরতে মা জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার আজ রুমি রানিকে ভারি খুশি দেখাচ্ছে যে!”

রুমি খিলখিল করে হেসে বলল, “জানো মা, আজ না ক্লাসে খুব মজা হয়েছে। একটা ইয়া বড় মথ ক্লাসে ঢুকে গিয়েছিল আর মেয়েগুলোর কী ভয় সেটাকে দেখে! টিচারও ভয়ে জুজু। আমার তো কী হাসি পাচ্ছিল ওদের কাণ্ড দেখে! মথরা নকটারনাল মানে রাতে জাগে তো তাই সে বেশি নড়চড়াও করছিল না তাও সবাই ভয় পাচ্ছিল। চৈতির তো প্রায় ভির্মি খাওয়ার জোগাড়! আমি ওকে বললাম, ‘হ্যাঁরে তুই বড় না মথটা বড়? ওকে অত ভয় পাওয়ার কী আছে?’ তারপর আমি মথটাকে আলতো করে হাতে করে তুলে নিয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে উড়িয়ে দিলাম। আশাকরি বেচারা ঠিক আছে!”

রুমির মা শুনে কী বলবেন ভেবে পেলেন না। এমনিতেও তিনি সবার কাছে রুমির ওই অদ্ভুত ব্যবহারের জন্যে নালিশ শুনে শুনে হয়রান। সুনন্দা জেঠিমা তো সেদিন বলেই বসলেন, “ছেলেরা কখনও কখনও পোকামাকড় নিয়ে খেলা করে শুনেছি কিন্তু মেয়েরা যে ওই সব ঘাঁটে তা তো কস্মিনকালেও শুনিনি বাপু! মেয়েকে সামলাও সুমি! কোনদিন বিষাক্ত পোকার কামড় খেয়ে হাসপাতালে না নিয়ে যেতে হয় ওকে!”

ওদের ক্লাস টিচারও খুব একটা খুশি নন রুমির ওপর। ওনাকে মথ থেকে রক্ষা করেছে রুমি তাও। আসলে সে মাঝেসাঝে এটা সেটা পোকামাকড় ক্লাসে নিয়ে চলে যায় তাতে ওনার ঘোর আপত্তি।

বাবা অবশ্য বলেন, “তুই মন খারাপ করিস না রুমি! আসলে সাধারণের চেয়ে আলাদা হলেই লোকের চোখে লাগে। তুই ঘাবড়াস না তুই নির্ঘাৎ বড় হয়ে এন্টমোলজিস্ট হবি!”

রুমির মুখ আনন্দে ঝলমল করে ওঠে, সে বলে, “হ্যাঁ বাবা! আমি বড় হয়ে এন্টমোলজিস্টই হতে চাই!” মানে পোকা বিশারদ!

তা বড় হয়ে কী হবে সে তো অনেক বছর পরের কথা। স্কুলের সাইন্স ফেয়ারের জন্যে রুমি নিজের আঁকা পোকাদের ছবি নিয়ে যেতে টিচার ওকে সরাসরি না করে দিলেন, বললেন, “না ওই সব পোকামাকড়দের ঠিকুজিকুলুজি নিয়ে কারো কোন উৎসাহ নেই। তুমি যদি কোন ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রির এক্সপেরিমেন্ট করতে চাও তো করতে পারো, ওই সব পোকামাকড় নিয়ে প্রোজেক্ট হবে না।”

রুমি মুষড়ে পড়ল। সেদিন বাড়ি ফেরার সময় স্কুল বাস থেকে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে। আঁকার ফাইলটা হাত থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। ব্যাগটা অন্য দিকে গিয়ে পড়ল। বাস অবশ্য দাঁড়াল না, হুস করে চলে গেল। রুমির পা-টা ছড়ে গেছে। ওর কান্না পাচ্ছিল। এদিকে এষা আর সৌরা ওর ওপর রেগে আছে তাই ওরা কোন রকম সাহায্য না করেই পালিয়ে গেল। রুমি আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে ব্যাগটা তুলল। ততক্ষণে দাদুর বয়সী এক ভদ্রলোক এসে ওর আঁকার ফাইলটা তুলে নিয়ে দেখতে শুরু করেছেন। রুমি দেখে উনি এগিয়ে এসে বললেন, “আহারে, বেশি লাগেনি তো?”

রুমি বলল, “হাঁটুটা একটু ছড়ে গেছে তা বাড়ি গিয়ে ডেটল লাগিয়ে নিলেই হবে।”

“এই ফাইলটা তোমার?”

“হ্যাঁ, ওটা বাড়িতেই থাকে সাইন্স প্রোজেক্টের জন্যে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। বড়সড় বলে ব্যাগে আঁটছিল না!”

“ও! আর আঁকাগুলো?”

“ওগুলোও আমার!”

“তুমি বুঝি পোকামাকড়দের ছবি আঁকতে ভালবাসো?”

“হ্যাঁ, যখন নতুন কোন পোকা দেখি তখন এঁকে রাখি, পরে ভুলে যাই যদি, তাই!”

উনি পাতা উলটে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ একটা পাতায় এসে রুমি দেখল ভদ্রলোকের চোখ গোল হয়ে গেছে। উনি বললেন, “আচ্ছা, এই পোকাটাকে কোথায় দেখেছ তুমি?”

“ও ওটা তো এষাদের বাগানের একটা টবে বসেছিল!”

“আর এটা?”

“এটা ছোটমাসিদের বাড়ির ছাদে!”

“আচ্ছা তোমার এই ফাইলটা আমি একদিনের জন্যে নিয়ে যেতে পারি? কালকেই ফেরত দিয়ে দেব, প্রমিস! তোমার বাড়িতেই পৌঁছে দেবো, কেমন? তোমার বাড়ি কোনটা?”

“ওইখানে ওই গোলাপি বাড়িটার তিনতলায়।”

“ঠিক আছে। ও কিন্তু তোমার নামটাই তো জানা হল না!”

“রুমেলা ঘোষ! সবাই আমাকে রুমি বলে ডাকে।”

“আচ্ছা, আর আমি হলাম চিত্তরঞ্জন সেন, তোমার সেনদাদু। কালকে দেখা হবে কেমন?” বলে উনি ফাইলটা নিয়ে হনহন করে চলে গেলেন।

রুমি বাড়ি ফিরে পায়ে ডেটল লাগাতে লাগাতে মাকে বলল, “টিচার তো সাইন্স প্রোজেক্টের জন্যে আমার আঁকা নিলেন না কিন্তু সেনদাদু ফাইলটা নিয়ে গেলেন!”

মা আশ্চর্য হয়ে বললেন, “সেনদাদু আবার কে?”

“তা তো জানি না কিন্তু ফাইলটা নিয়ে গেলেন। পোকা কোথায় দেখেছি জিজ্ঞেস করছিলেন। কালকে দিয়ে যাবেন বললেন।”

পরদিন বিকেলবেলা সেনদাদু ঠিক হাজির হলেন ওদের বাড়িতে। মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় করে বললেন, “রুমির আঁকাটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল তাও একেবারে শিওর হতে ওর ফাইলটা বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। ওর দেখা দুটো পোকা খুব বিরল প্রজাতির। অনেকেই ধরে নিয়েছিল সেই পোকা আর এই পৃথিবীতে নেই! ডাইনোসরের মতন হাওয়া হয়ে গেছে মনে করা হচ্ছিল, কিন্তু না ওরা আছে! কম হলেও আছে! এটা যে কত বড় একটা ব্যাপার তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না!” আনন্দে বলে উঠলেন তিনি।

xxxxxx

জেনিভার কনফারেন্সের টক-টাকে ঝালিয়ে নিতে নিতে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যেতে চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠল প্রোফেসার রুমেলা ঘোষের। সেনদাদুর কথা মনে পড়লেই চোখ ভিজে যায়। সেনদাদুই যে বিখ্যাত এন্টমোলজিস্ট চিত্তরঞ্জন সেন সেটা জানতে পেরে খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। সত্যি বলতে কী আজ উনি যে জায়গায় এসে পৌঁছেছেন সব দাদুর জন্যেই। সেই বিরল প্রজাতির পোকা খুঁজে পাওয়ার পর কাগজে নামটাম বেরিয়ে যে হইচই হয়েছিল সেখান থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ওনাকে। তারপর সারাটা পথ অনেকদিন দাদু ছিলেন সঙ্গে। টিচার আর ক্লাসের মেয়েরা ওনার পোকা ঘাঁটার শখ পছন্দ করে না শুনে সেনদাদু শুধু বলেছিলেন, “ওদের কথাতে কান দিও না, তুমি তোমার মতন থাকবে। ওদের জন্যে নিজেকে বদলাবার দরকার নেই। তুমি তোমার পথ বেছে নিয়েছ, ওরা এখনও বাছতে পারেনি!”



(পরবাস-৭৮, ৮ই এপ্রিল, ২০২০)