Subscribe to Magazines



পরবাসে শতরূপা মুখার্জীর
লেখা


ISSN 1563-8685




দিদুনের চাবি

চাবির গোছা বস্তুটির ওপর বরাবরই ভীষণ লোভ মহালয়ার।ছোটবেলা থেকেই দিদুনের আঁচলে বাঁধা চাবির গোছাখানি ওর শিশুমনকে আকৃষ্ট করে এসেছে। ওর রাশভারী দিদুন, কপালে চওড়া করে আঁকা সিঁদুর, জরিপার লাল শাড়ি পড়ে যখন ওই চাবির গোছাখানি থেকে সন্তর্পনে নির্দিষ্ট চাবিটি বেছে তার শোবার ঘরের মেহগনি কাঠের আলমারিটির দরজা খুলতেন মহালয়া দুচোখে অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতো আলমারির অন্দরমহলের দিকে। থরে থরে পাট করে সাজিয়ে রাখা সুগন্ধি জামাকাপড়ের নিচ থেকে দিদুন হাত বাড়িয়ে বের করে আনতেন তার কোনো আরাধ্য বস্তু। হয়ত বা রেশমের কাজ করা নরম বটুয়া টি।মেজকাকীদিদা নতুন সেলাই শিখে যেটা দিদুন কে বানিয়ে দিয়েছিল, মহালয়া জানত দিদুন তার মধ্যে রেখে দেন রোজকার সংসার খরচের টাকা। সেখান থেকে টাকা বের করে তাদের বাজার সরকার আর বাড়ির চব্বিশ ঘণ্টার কাজের লোক হরিদাস কাকা র হাতে দিতেন দিদুন। দাদু তো কবে থেকেই বিছানা নিয়েছেন, শেষ বার স্ট্রোকের পর থেকেই হাঁটাচলা বন্ধ একদম। হরিদাস কাকা দাদুকে ধরে ধরে বিছানা থেকে উঠিয়ে প্রাত্যহিক কাজকর্ম করিয়ে বারান্দার আরামকেদারাটিতে বসিয়ে দেয় রোজ। স্নানের আগে অবধি দাদু ওখানেই বসে খবরের কাগজ পড়েন। দাদু বসে থাকতে থাকতেই মহালয়া স্কুলের জন্য তৈরি হতে থাকে। দিদুন এর হাতের ঘি দিয়ে মাখা বড় বড় ভাতের গোল্লা গল্লাধঃকরণ করে টিফিন বাকসোটি ব্যাগ এ গুঁজে হরিদাস কাকার হাত ধরে রওনা দেয়ে স্কুল গাড়িটির উদ্দেশ্যে। খুব ছোটবেলায় গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট এ বাবা মা দুজনেই একসাথে হারিয়েছে মহালয়া। তারপর থেকে দাদু দিদুনের তত্বাবধানেই মহালয়ার দিন কেটে যাচ্ছে। তাবলে ভেবোনা মহালয়ার জীবন খুব দুঃখের। আহারে মা বাপ হারা ছোট মেয়েটিকে ভালোবাসার কেউ নেই এমনটি ধরে নিলে খুবই ভুল ভাববে তুমি। দিদুন ওকে সেই পাঁচ বছর বয়েস থেকেই যেমন পক্ষিমাতার মতন বুকে জড়িয়ে রেখে বড়ো করেছেন তেমনটি করে খুব কম মানুষই বড়ো হয়। দাদু ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে। উত্তর কলকাতার এই পুরনো দিনের কড়িকাঠওয়ালা গোটা বাড়িটাই তাই কঠোর এক অনুশাসন আর নিয়মানুবর্তিতা দিয়ে বাঁধা যেন।।সকাল ছটায় দিদুনের ভারী গলার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে মহালয়ার। ওই মিষ্টি ভারী গলার মামনি ডাকটা যে কি প্রিয় মহালয়ার তা সে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। সেই সাত সকালে দিদুনের স্নান সারা। পুজোর ঘরে যাওয়ার আগে মহালয়াকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে যান উনি প্রতিদিন। এরপরের দায়িত্ব প্রতিমা মাসীর হাতে। দুধের গ্লাস হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই বড়ো বড়ো কান ঝুলিয়ে ঝুপ্পুস ছুটতে ছুটতে আসবে মহালয়ার কাছে। ঝুপ্পুসকে কেউ নেড়ি কুকুর বললে মহালয়ার রাগ হয় ভীষণ। ঝুপ্পুসের মত সাহসী বুদ্ধিমান আর তেজী কুকুর তোমরা খুঁজে বের করো দেখি এ পাড়ায় একটাও। গতবছর পুজোর সময় পাড়ার পুজো মণ্ডপ থেকে প্রতিমা মাসীর হারিয়ে যাওয়া নতুন চটি কে উদ্ধার করে এনে দিয়েছিল শুনি? মহালয়ার হাত থেকে ব্রেকফাস্ট এর দুটো মেরি বিস্কিট ঝুপ্পুসের রোজ এর খাতায় লেখা। থাবা চাটতে চাটতে ঝুপ্পুস এর প্রস্থান এর সাথে সাথে পাশের মনজিতদের বাড়ির পোষা মেনিটার আগমন। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে মহালয়া তার দুধের গ্লাস থেকে সাবধানে খানিকটা দুধ ঢেলে দেয় বারান্দার পাশের কাকেদের জল খাওয়ার বাটিটায়। মেনিও অস্বাভাবিক তৎপরতার সঙ্গে বাটিটা চেটেপুটে সাফ করে লেজ গুটিয়ে দৌড় মারে। সকালের এই ব্রেকফাস্ট পর্বটুকু দিদুনের অগোচরেই সারতে হয় মহালয়াকে। পশুপাখির গায়ের গন্ধ দিদুন এর মোটেই পছন্দ নয়। নইলে মেনি আর ঝুপ্পুস ছাড়াও মহালয়ার আরো কজন উরুক্কু বন্ধুও আছে। বিস্কুটের শেষ টুকরোগুলো নিয়ে যাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়ার আর শেষ নেই। আজ আর ওদের জন্য অপেক্ষা করল না মহালয়া। দেরি হয়ে যাচ্ছে। অতএব দিদুন পুজোর ঘর থেকে আসতে আসতে মহালয়া নিজের পড়ার টেবিলএ পৌঁছে যায় বইপত্র সহযোগে। তারপর শুরু হয় একটা গোটা দিনের ব্যস্ততা।

এরকমই এক ব্যস্ত দিনে হঠাৎ করে মহালয়া দের বাড়িতে শোনা গেলো প্রবল শোরগোল। হরিদাসকাকাকে বটুয়া থেকে বাজারের টাকা বের করে দেওয়ার পরে আনমনে দিদুন নাকি চাবির গোছাটাকে পাশের টেবিল এর ওপর রেখে প্রতিমা মাসীকে রান্নাঘরে কিছু বলতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখা গেলো গোছা নেই। বেমালুম উধাও। মুহূর্তে যুদ্ধকালীন তৎপরতার সাথে গোটা বাড়িতে সন্ধানকার্য শুরু হয়ে গেলো।

দিদুনএর অবস্থা এরমধ্যে সবচাইতে খারাপ। চাবির গোছাটি দিদুনএর প্রাণ। ওর মধ্যে বাড়ির সব প্রয়োজনীয় চাবি, আলমারি, ড্রয়ার ছাড়াও দাদুর ভারী লোহার সিন্দুকের চাবিটাও আছে। দাদুকে জানানো হয়নি কিছুই, পাছে আতঙ্কে আরো শরীর খারাপ হয়। মহালয়ার স্কুল যাওয়া হলনা সেদিন। পাকা গোয়েন্দার মত নিজের টিম নিয়ে তদন্তে নেমে পড়লো মহালয়া। টিম মানে ঝুপ্পুস, মেনি সে আর হরিদাস কাকা। হরিদাস কাকার থেকে খবর পাওয়া গেলো ঝাড়ুদার নিতাই তিনদিন ধরে কাজে আসছে না। বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ বলে গতকাল থেকে একটা নতুন ছেলেকে বাথরুম সাফা করার কাজে লাগানো হয়েছে। আজও সে এসেছিল। দিদুনেরে ঘরের লাগোয়া বাথরুমটা ও পরিষ্কার করে গেছে। কাল থেকে নিতাই কাজে আসবে জানিয়েছে। অতএব এই ছেলেটিকে আর পাওয়া যাবে না। মহালয়া কুইক মার্চ করে ওর টিম নিয়ে চলল সাফাই পট্টির দিকে। সামনে হরিদাস কাকা, তারপর ঝুপ্পুস, আর মহালয়ার পেছনে ল্যাজ নাড়াতে নাড়াতে মনোজিতদের মেনি। অনেক খোঁজ পাত্তার পর কিষানদের বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেলো। আধো অন্ধকার টালির ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। দরজায় ঠকঠক করতে করতেই মহালয়া খেয়াল করলো দ্রুতবেগে পেছন থেকে কেউ ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে সরু গলিটার ভেতরে। ঘেউ করে সামান্য আওয়াজ বের করে ঝুপ্পুসও দিল দে দৌড়। ওর পেছনে হরিদাস কাকা মেনি আর মহালয়া। খানিক দূরে কিষান এর হাত কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঝুপ্পুস। আর কামড়ানো হাতের মুঠোয় দিদুনএর চাবির গোছাটা চকচক করছে। জয় ঝুপ্পুসের জয়। অজান্তেই বেরিয়ে এলো মহালয়ার মুখ থেকে।

এই ঘটনার পর কেটে গ্যাছে কুড়িটা বছর। সেই বছর বারোর মহালয়া এখন বত্রিশ বছরের ডক্টর মহালয়া চ্যাটার্জী। এমডি সাইকিয়াট্রি। দাদু দিদুন এর ওই প্রায় হেরিটেজ বাড়ির একতলার একটা বিশাল ঘরেই ওর চেম্বার। চেম্বার এর দরজার ওপরেই দাদু দিদুন এর হাসিমুখের দুখানি ছবি ঝোলানো। দিদুন এর ওই ঝকঝকে হাসিমুখ দেখেই মহালয়ার সারা দিনের ব্যস্ততা শুরু হয়। তারপর রোগী আর ওষুধ। ওষুধ আর কাউন্সেলিং। এই করেই ঘুরতে থাকে ঘড়ির কাঁটা। চেম্বার আর রোগী সামলে মহালয়া এখনও সংসার জীবনে প্রবেশ করার সময় করে উঠতে পারেনি। কাজ কি কম! পাড়ার যাবতীয় নেড়ি আর মেনিদের দেখভালের দায়িত্বও তো ওরই। তাদের ওষুধ, ভ্যাকসিনেশন খাওয়া দাওয়া মহালয়া না দেখলে আর দেখবে কে? আর মহালয়ার দেখাশোনা? দিদুন মনে হয় সে দায়িত্ব প্রতিমা মাসীকে এমন করে পইপই করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন যে আজ ষাট বছর বয়সেও প্রতিমা মাসীই মহালয়ার গার্জিয়ান। মহালয়ার দায়িত্ব প্রতিমা মাসী আর কারোর ওপরে ছেড়েই নিশ্চিন্ত নন। মহালয়াও তাই নিশ্চিন্ত একদম। হরিদাস কাকাকে তার ছেলেরা এসে দেশে নিয়ে গ্যাছে।তার জায়গা এ বহাল হয়েছে নিধিরাম। সে এখন এই বাড়ির বাজার সরকার। আর দিদুন এর সেই চাবির গোছাখানি? সে এখন মহালয়ার সম্পত্তি। আর এই ডিজিটাল মানির যুগেও মহালয়া ওই চাবির গুচ্ছ থেকে সন্তর্পনে ঠিক দিদুন এর মতই ঠিক চাবিটি বেছে বের করে সেই কালো মেহগনি কাঠের আলমারি খুলে নিধিরামকে রোজএর বাজারের টাকা বের করে দেয়। এতেই মহালয়ার চরম আনন্দ। ওই চাবির গোছার প্রতিটি চাবিতে এখনও লেগে আছে দিদুন এর হাতের স্পর্শ। দিদুনএর গায়ের গন্ধ। শুধু একটাই দুঃখ, শাড়ি পড়াটা তো ভালো করে রপ্তই হলো না এখনও। ওই চকচকে চাবির গুচ্ছখানি আঁচলে বেঁধে, সে আঁচল পিঠে ঝামরে দিদুনের মত সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ানো!! সে আর হলো কই এ জীবনে।



(পরবাস-৭৮, ৮ই এপ্রিল, ২০২০)