সমুদ্রের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা লাভ আ্যাট ফার্স্ট সাইট। সমুদ্রের ঢেউগুলোর সামনে দাঁড়ালে নিজের দুঃখ, কষ্ট, সমস্যাগুলোকে একটা বিন্দুর মতো মনে হয়। ভাষাহীন নীরব প্রেম। যে জায়গাটা আমাকে প্রথম সমুদ্রকে ভালবাসতে শিখিয়েছিল সেটা তালসারি। আসলে নির্জনতার সঙ্গে প্রেমের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। আর তালসারির নির্জনতা "সময়ের সমুদ্রে আমার এক মুহূর্ত সময় নেই" থেকে নিজের চিন্তাভাবনাগুলোকে ছুঁয়ে দেখার অবকাশের মত। সোজা কথায় নিজেকে ভালোবাসার অবকাশ।
তালসারি নামটা শুনে বেশ কৌতূহল হয়েছিল। তাল গাছের সারির সঙ্গে সমুদ্রের লুকোচুরি খেলা এখানে। উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলার এই গ্রাম এখনো প্রকৃতির খুব কাছের। শহুরে ব্যস্ততা ও কোলাহলহীন। ‘দীপুদার দীঘা’ বা পুরীর সমুদ্র সৈকতের ভিড়ের সাক্ষী এখনো হয়নি তালসারির সমুদ্রতট। ধর্মতলা থেকে বাসে চড়ে দীঘা। সেখান থেকে টোটো, অটো বা ট্রেকারে চড়ে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরেই তালসারি। ট্রেনে করে উড়িষ্যার বালেশ্বরে নেমেও খুব সহজেই পৌঁছোনো যায় এখানে।
বিকেল পাঁচটার সময় যখন তালসারি পৌঁছলাম সূয্যিমামার তখন বিদায়ের পালা শুরু হয়ে গেছে। সময়টা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ হলেও শীতের লেশমাত্র নেই। আকাশে গোধূলি বেলার রঙের খেলা। তাই ঝটপট ফ্রেশ হয়ে আকাশ আর সূর্যের রংমিলান্তি দেখতে চললাম। সে এক মনোরম দৃশ্য। সমুদ্রের জলে সূর্যের চিকচিক করা আলো মুক্তোর মত স্বচ্ছ, সুন্দর। আর তার সাক্ষী আকাশের সীমানা। সমুদ্রতটে ভিড় সেভাবে নেই বললেই চলে। প্রকৃতির এই আলিঙ্গনে সারাদিনের ক্লান্তি উধাও। খিদে বেপাত্তা। আস্তে আস্তে সময়ের চোখ রাঙানিতে সূর্য ডুবলো। এসব লেন্সবন্দী করে উড়িষ্যা সরকারের পান্থ নিবাসে যখন ফিরলাম, ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে সাতটা ছুঁই ছুঁই।
সবুরে মেওয়া ফলে। আর পরদিন সকালে সূর্যোদয়ের স্বাদ ভাষায় বর্ণনা করা বেশ কষ্টকর। এক কথায় অতুলনীয়। সূর্য, আকাশ আর সমুদ্রের ত্রিকোণ প্রেম মিলে প্রকৃতির ক্যানভাসে সুচারু শিল্পের ছোঁয়া। সূর্যোদয় দেখার জন্য পান্থনিবাস থেকে পায়ে হেঁটে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলাম। আসমানি রঙের মেলা ফ্রেমবন্দি করে ফিরতে গিয়ে দেখি আর হেঁটে ফেরার উপায় নেই! জোয়ারের ফলে সমুদ্রের জল এগিয়ে চলে এসেছে পান্থনিবাস পর্যন্ত। স্থানীয় লোকজনের থেকে জানতে পারলাম রোজই এমনটা হয়। বেলা বাড়লে ভাঁটা। নোনাজল তখন ফিরে যায় তার প্রকৃত উৎসের কাছে। এই জল পেরোনোর জন্য ব্যবস্থা থাকে নৌকোর। খুব সামান্য অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় মাঝিরা পারাপার করে দেয়। প্রকৃতি হয়তো বোঝে জীবন ও জীবিকা ঠিক কতটা একে অপরের পরিপূরক। নৌকায় চেপে বেশ কিছুটা এসে বাকিটা নোনাজল পায়ে মেখে হেঁটে ফিরলাম। বালির উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখি একা একা হাঁটতে হচ্ছে না। অজস্র লাল কাঁকড়া এদিক-ওদিক বালি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। প্রকৃতি বোধহয় এরকমই। একাকিত্বের সুযোগ দেয় না।
প্রকৃতির ছোঁয়া পেয়ে যখন আবার বিচিত্রপুর ঘাটে ফিরে এলাম পেটের ভিতর বেশ চনচনে খিদে তার অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে। তালসারি, বিচিত্রপুর এসে সী-ফুড খেয়ে দেখব না এমন অপরাধের ভাগিদার আমি হতে চাইনি। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলে স্বাদ-কোরকগুলো বোধহয় বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। রসনা তৃপ্ত করে যখন পান্থনিবাসে ফিরে এলাম হোটেলের অগোছালো ঘরটা বলছে এবার বিদায়ের পালা। পরদিন সকালের ফেরার বাসের টিকিট বলছে আবার নিয়মানুবর্তিতা আর শৃংখলাবদ্ধ জীবন যাপনের ডাক এসেছে। আজকের এই পরিস্থিতিতে তালসারির অভিজ্ঞতা লিখতে লিখতে যখন স্মৃতিপটে ছবিগুলো ভেসে উঠছিল একটা কথাই মনে হচ্ছিল, তালসারি যেন প্রকৃতির সেল্ফ আইসোলেশন ফ্রম্ দিজ ক্রুএল ওয়ার্ল্ড।
(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)