Subscribe to Magazines



পরবাসে অনন্যা দাশের
আরো লেখা


বই


ISSN 1563-8685




শেষ ভালো যার

আমার মা-বাবা দুজনেই প্রমিত বিশ্বাসের বিরাট বড়ো ফ্যান! কেন এত ফ্যান তা ঠিক জানি না। হয়তো সে আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয় বলেই। কেমন করে জানি লতায় পাতায় আমার বাবার পিসতুতো ভাই হয় সে। সিরিয়ালে অভিনয় করে বেশ কিছুটা নাম করে ফেলেছে। ‘শুকনো পাতার শব্দ’ সিরিয়ালে অভিনয়ের জন্যে কী একটা পুরস্কারও পেয়েছে। আমি অবশ্য ওই সব সিরিয়াল দেখিনি। ওগুলো দিনেরবেলা যখন হয় তখন আমার স্কুল থাকে। তাছাড়া সিরিয়াল দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না। একবার ওকে দাদাগিরিতে দেখেছিলাম, তখন বেশি দূর এগোতে পারেনি আর আরেকবার বড়োজেঠুর বাড়িতে এসেছিল আমার জ্যাঠতুতো দিদি রুম্পির বিয়েতে। তবে বাড়িতে বলা অবশ্য ভুল হবে, যে ভাড়া বাড়িতে বিয়ে হচ্ছিল সেখানে। সেদিন ওখানে এমন ভাব করছিল যেন লোকজনের বরকে ছেড়ে ওকেই বেশি পাত্তা দেওয়া উচিত! সেই থেকেই আমার ওকে পছন্দ নয়! নিজেকে কী যেন মনে করে! যত্তসব!

তা আমার তাকে ভালো লাগে কী লাগে না তাতে তো কিছু যায় আসে না। আসল কথা হল মা-বাবার ওকে ভালো লাগে। তাই সে যখন আমাদের বাড়িতে আসবে বলল তখন আমাদের বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। বাবা প্রথমেই ঠিক করে ফেললেন যে আমাদের ছোট ফ্ল্যাটে ওকে আনাটা মোটেই ঠিক হবে না তাই চটপট আমাদের আবাসনের কমিউনিটি হলটা বুক করে ফেললেন। সেখানে ১৫০জন লোক ধরে! আমি তো হাঁ! আজ অবধি কখনও কোন অনুষ্ঠানের জন্যে আমরা ওটাকে ভাড়া করিনি!

বাবা বললেন, “বাহ, আমাদের আত্মীয় বন্ধুদের ডাকতে হবে না? প্রমিত বিশ্বাস আমাদের এখানে আসল আর আমরা তাদের বললাম না শুনলে তারা কোনদিন আমাকে ক্ষমা করবে না!”

সেই হল শুরু। ক্রমে নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ১২০তে গিয়ে ঠেকল! অত লোক কী খাবে তাই কেটারিংযের লোকজনকে বলা হল। বিশাল মেনু। প্রমিত বিশ্বাসও খাবে যে! তাও মেনু রোজই বদল হয়। শেষমেশ ওরা বলল আর মেনু বদলানো চলবে না তাহলে ওরা খাবার আনতে পারবে না!

হলঘরটাকে সাজানো নিয়েও বিশাল ঝামেলা। আবাসনের পিন্টুদা আর মিন্টিদিরা এর ওর জন্মদিন-টন্মদিনে অল্প খরচে হলঘরটা সাজিয়ে দেয়। ওরাই সাজিয়ে দেবে বলেছিল কিন্তু মা-বাবার সেটা পছন্দ হল না। ওরা নাকি সেই রকম স্ট্যান্ডার্ডের সাজাতে পারে না তাই অনেক টাকা দিয়ে কাদের সব আনা হল। কথা হল যে দুপুরের ফাংশান তো তাই তারা আগেরদিন রাতে এসে হলঘরটাকে সাজিয়ে দিয়ে যাবে। পিন্টুদা আর মিন্টিদি অবশ্য সেইসব শুনে মোটাই খুশি হল না। আমি অবশ্য ওদের রাগ কমানোর জন্যে ওদের বাড়ি গিয়ে ওদের দুজনকে দুটো বড়ো ক্যাডবেরি চকোলেট দিয়ে এলাম। বলেও এলাম, “আরে তোমরা কিছু মনে কোরো না, মা-বাবা দুজনেরই মাথাটা গেছে! আমারই কোন কথা শুনছে না তো তোমরা কোন খেতের মুলো?”

ওই রকম হিন্দি বাংলা মেশানো কথা শুনে ওরা দুজনেই হেসে ফেলল।

যত দিনটা এগিয়ে আসছিল তত ওদের টেনশান বাড়ছিল। মা বেশ কয়েকটা নতুন শাড়ি কিনে ফেললেন অথচ কোনটা পরবেন ঠিক করতে পারছিলেন না! বাবার নতুন পাজামা-পাঞ্জাবী হল। আমাকেও বলা হচ্ছিল নতুন জামা কিনতে কিন্তু আমি কোনরকমে মামার দেওয়া জামাটা তো নতুনই রয়েছে বলে বাঁচলাম। রোজ ফোন করে করে আপডেট নেওয়া চলে। সত্যি বলতে কী আমি ব্যাপারটায় খুবই বিরক্ত হয়ে পড়ছিলাম। বাড়িতে আর কোন কথা নেই! শুধু প্রমিত বিশ্বাস আর প্রমিত বিশ্বাস!

আমি রেগে মেগে আমার বন্ধু সাত্যকিকে বললাম, “উফ আমি আর পারছি না রে! ভাবছি শুক্রবার থেকে তোদের ওখানে গিয়ে থাকব!”

সাত্যকি আঁতকে উঠে বলল, “পাগল! তুই এখানে এসে থাক আর কাকু-কাকিমা আমাকে পুলিশে দিক আর কি! না বাবা, আমি ওসবের মধ্যে নেই! তুই বরং প্রমিত বিশ্বাসের সঙ্গে ছবি তুলে রাখিস তাহলে ওঁরা খুশি হবেন!”

আমি মুখ ভেচকালাম। ওর সঙ্গে ছবি তোলার আমার কোন শখ নেই!

যাই হোক ক্রমে শুক্রবার এসে পড়ল। প্রমিত বিশ্বাস আসার আগের দিন। বিকেলবেলা ওই সব প্রোফেশানাল সাজাবার লোকজন এসে হলটাকে সাজিয়ে দিয়ে গেল। খুবই সুন্দর কিন্তু তাও আমার ঠিক পছন্দ হল না। বড্ড পার্ফেক্ট যেন, কোন খুঁত নেই। কিন্তু কেমন যেন প্রাণহীন, হোটেলের লবির মতন! প্রমিত বিশ্বাসের জন্যে এতটা করার কী দরকার ছিল? তা আমার কথা শোনার মতন অবশ্য কেউ ছিল না।

লোকগুলো সাজিয়ে চলে যাওয়ার পর হলঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল যাতে কেউ ঢুকে সাজসজ্জা নষ্ট না করে দিতে পারে। পরদিন দুপুর এগারোটা নাগাদ প্রমিত বিশ্বাস দা গ্রেটের আসার কথা। মা বাবা সারারাত ঘুমোতে পারলেন না। খুব টেনশান করছিলেন। বার বার চেক করছিলেন সব কিছু ঠিকঠাক মতন হয়েছে কিনা। আমি অবশ্য দিব্যি ঘুমোলাম। আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে অনেক বড়ো ব্যাপার লাগে!

পরদিন সকাল নটা নাগাদ ফোনটা এলো। প্রমিত বিশ্বাসের সেক্রেটারি মনোজ সোম ফোন করে বললেন, “প্রমিত স্যারের শুটিংয়ের ডেটগুলোতে একটু বদল হয়েছে তাই আজকে আর উনি আপনাদের ওখানে যেতে পারবেন না। কিছু মনে করবেন না প্লিজ। উনি নেক্সট যখন অ্যাভেলেবেল হবেন সেই ডেটটা আমি আপনাদের জানিয়ে দেব, কেমন?”

বাবা তো শুনে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। প্রথমে মুখ দিয়ে কোন কথাই বেরচ্ছিল না তারপর বেশ কষ্ট করে বললেন, “একটু আগে বললে সুবিধা হত, আমরা যে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম!”

ম্যানেজার লোকটা খেঁকিয়ে উঠল, “আগে জানলে তো বলব! আপনাদের কোন ধারণা নেই সেলিব্রিটিদের কতখানি খাটতে হয়!”

লোকটা কী সব বলেই চলল। তার কথা শেষ হতে বাবা হতাশভাবে ফোনটা ছেড়ে দিলেন। মা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, জিগ্যেস করলেন, “কী হল?”

বাবা ক্লান্ত স্বরে বললেন, “সবাইকে ফোন করে বলতে হবে যে প্রমিত বিশ্বাস আসছে না!”

সেটাতে অবশ্য কোন অসুবিধা হল না। মা-বাবা তো দুঃখে মর্মাহত কিন্তু আমি আনন্দের সঙ্গে সবাইকে ফোন করে করে বলে দিলাম প্রমিত বিশ্বাসের না আসতে পারার কথাটা।

হঠাৎ আমার মনে পড়ল, “বাবা ক্যাটারিং থেকে তো খাবার নিয়ে চলে আসবে! ১০০ জনের খাবার নিয়ে আমরা কী করব? সবাইকে তো আসতে বারণ করে দিলাম!”

মার তো মাথায় হাত। তবে আমার মাথায় কিন্তু ফন্দি গিজগিজ। বললাম, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া আছে, আমি চেষ্টা করব?”

দুজনেই এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি অন্য কোন গ্রহ থেকে এসেছি। যাই হোক, না বললেন না। না বলার অবকাশও নেই, অত খাবার নষ্ট হওয়াটা তো খুব বাজে ব্যাপার হবে!

আমি সাত্যকিকে ফোন করলাম, “হ্যালো সাত্যকি? গুড নিউজ! প্রমিত বিশ্বাস আসছে না! তবে অন্য একটা ব্যাপারে তোর একটু সাহায্য লাগবে রে!”

ব্যস তারপর আর কী, সাত্যকির মাসি যে অনাথাশ্রমটা চালান সেখান থেকে সব বাচ্চারা চলে এল আমাদের আবাসনের হলে। সুন্দর করে সাজানো হলে খুব আনন্দ করে খেল ওরা, খুব মজা করল। ওদের সঙ্গে আসা দিদিমণিরা মা, বাবা আর আমাকে প্রচুর আশীর্বাদ করে গেলেন। আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল। বাবা-মাও পরে বলেছিলেন যে আমি বুদ্ধিটা দারুণ করেছিলাম।

আমি এখন অনেক লোকের চোখেই হিরো হয়ে গেছি। সাত্যকির কাছে তো বটেই। তবে আরেকটা জিনিস হয়েছে, আমাদের বাড়িতে প্রমিত বিশ্বাসের অভিনয় করা সিরিয়াল আর এখন কেউ দেখে না!



(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)