Subscribe to Magazines






পরবাসে
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তীর

আরো লেখা



ISSN 1563-8685




মোহিতদাদুর হাতবাক্স

বুকাইয়ের দাদুর খুব অসুখ। তার মায়ের এইজন্য খুব মন খারাপ, কিন্তু তবুও মা দাদুকে দেখতে যেতে পারছে না, কারণ দুই মামা মাকে অবিশ্বাস করেছেন। এখন সেই অবিশ্বাসের কালো ছায়ায় তাদের সম্পর্ক একদম তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। মামাদের একমাত্র বোন বুকাইয়ের মা, সেই বোনকেই সন্দেহ করছেন মামারা।

দাদুর কাছে বেশ কিছু অ্যান্টিক গয়না ছিল, তার মধ্যে ছিল চুনীর লকেট, পান্না বসানো সোনার গলার হার, এমনকী বাদশাহী আমলের সোনার বেশ কয়েকটা মোহর, সেগুলো এতদিন দিদার স্মৃতি বলে দাদু কখনও ব্যাঙ্কের লকারে রাখতে দেননি। রাখতেন তাঁর বিছানার নীচে একটা লোহার সিন্দুকে, কিন্তু মামারা বলছেন এখন নাকি সেগুলো আর ওখানে নেই।

গয়নাগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ দাদু এক বছর ধরে কোথাও যাননি। বাড়িতে বিশ্বাসী কাজের লোক বিরাজদা ছাড়া তেমন কেউ আসেনি। অবশ্য বুকাই মায়ের সঙ্গে কয়েকবার মামা বাড়ি গেছিল। মামাদের সন্দেহ দাদুই গোপনে তাঁর একমাত্র মেয়েকে সেই সব গয়না দিয়েছেন।

মা মামাদের দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন, বাবা তাকে কোনো গয়না দিয়ে যাননি, আর দিলেও সেগুলো মা নেবে না। দাদুর হাঁপানী আছে। বয়সজনিত কারণে সেই টান বেড়ে গেছে। দাদু এমনিতে খুবই কর্মঠ ছিলেন, তাঁর ছিল নানা রকম জিনিস বানানোর নেশা। তার মধ্যে প্রধান হল মোমের শৌখিন জিনিস বানানো। দাদু একবার নৈনিতাল বেড়াতে গিয়ে মোমের অনেকরকম জিনিস কিনে এনেছিলেন। তারপর থেকেই তাঁর শখ চেপেছিল মোমবাতি বানানোর। আরও একটা দাদুর প্রিয় জিনিস ছিল গাছপালা। দাদু গাছপালা খুব ভালোবাসতেন এবং তিনি চিনতেনও অনেক ধরনের গাছ।

গতকাল গভীর রাতে বুকাইয়ের দাদু মারা গেছেন। খুব ভোরে বুকাইয়ের মামারা এসে তার মাকে নিয়ে গেছেন। বুকাই, বুড়ান, পম্পা, আর শান্ত এখন বাড়িতে একা। বুকাইয়ের বাবা কর্মসূত্রে থাকেন বরাকর। বুকাই আর বুড়ান দুই ভাইবোন মায়ের সঙ্গে তাদের জেঠুদের বাড়িতে বরানগরে থাকে। বরানগরের বাড়ি সবসময় জমজমাট, কারণ সমবয়স্ক চার চারটে ছেলেমেয়ে সেখানে থাকে। জেঠুর ছেলে শান্ত, বুকাইয়ের চেয়ে বছর দেড়েকের বড় কিন্তু রোগা টিংটিংয়ে শান্তকে বুকাই দাদা বলে পাত্তাই দেয় না, ডাকেও নাম ধরে। তাতে শান্ত যতই রাগ করুক না কেন, বুকাই তাতে কর্ণপাত করে না। পম্পা দিদিকে ওরা সবাই ডাকে পিদিদি বলে। বাড়ির চার ছেলেমেয়ের মধ্যে পম্পাই সবার বড়। সে পড়াশুনোয় বেশ ভালো। তবে সে শুধুই পড়ার বই পড়ে না, স্কুলের বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে গল্পের বইও খুব পড়ে। বুকাইও গল্পের বইয়ের পোকা। বুকাইয়ের খুব স্মৃতিশক্তি। বাড়ির সকলে ওকে বলে জীবন্ত ডিকশনারি।

পম্পাদিদি আর শান্তর বাবা মা, অর্থাৎ বুকাইয়ের জেঠু ও জেঠিমা কয়েকদিনের জন্য চিকিৎসা করাতে দক্ষিণ ভারত গেছেন। এমন সময় আকস্মিকভাবে বুকাইয়ের দাদুর মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছাল। বুকাইয়ের মা কাঁদতে কাঁদতে মামাবাড়ি চলে গেলেন। বাড়িতে থাকল কেবল চার কিশোর কিশোরী।

বুকাই দেয়ালে ঝোলানো দাদুর ফটোটার দিকে তাকাল। দাদুর জন্য ওর বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। বুকাইয়ের দাদু বেশ সুপুরুষ ছিলেন। এই ছবিটা দাদুর অল্প বয়সের ছবি। ছবিতে দাদু ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা। হাতে একটা বেতের শৌখিন লাঠি। ডান হাতের অনামিকায় একটা কমল হিরে বসানো আংটি। আজ যেন দাদুর ছবিটা আশ্চর্য উজ্জ্বল মনে হল বুকাইয়ের। সে লাফ দিয়ে উঠে বসল। বলে উঠল,

'আইডিয়া! এবার দাদুর কাছেই হারিয়ে যাওয়া সব গয়নার খোঁজ পাওয়া যাবে!'

বুকাইয়ের দাদুর নাম মোহিত কুমার ঘোষাল। দাদুর বাবা প্রতাপ ঘোষাল স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের বাগেরহাট হাইকোর্টের সরকার পক্ষের উকিল ছিলেন। তখন বিভিন্ন কেসের সুবাদে দু হাতে আয় করেছেন। খুলনা জেলার সোনার গাঁওতে বহু বিষয়সম্পত্তি এবং বিরাট বাড়ি ছিল তাঁর। বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি ধীরেসুস্থে নিজের সেখানকার সম্পত্তি বেচে দেন। তারপর কলকাতায় কাশীপুর অঞ্চলে একটা বাড়ি কেনেন। লোকে বলে তার বাড়িতে নাকি ভরি ভরি সোনার গয়না ছিল। দেশ বিভাগ অনেকের বহু ক্ষতি করলেও প্রতাপ ঘোষালের বিশেষ কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।

মোহিত ঘোষাল তাঁর বাবার কাছ থেকে পাকা বিষয়ী বুদ্ধির কিছুটা অংশ পেয়েছেন। কলকাতা হাইকোর্টের উকিল হয়ে নিজের জীবন শুরু করেন তিনি। বাংলাদেশে তাঁদের বাড়ির ভিত খুঁড়ে দাদু নবাবী আমলের কিছু সোনার মুদ্রা পেয়েছিলেন, আর পান্না বসানো হারটা ছিল দিদার ঠাকুমার। মোহিত ঘোষালের দুই ছেলে বিজন ও সুজন এবং একটিমাত্র মেয়ে মায়া। তিনি বুকাইয়ের মা মায়াকে বড়ো ভালোবাসতেন।

কলকাতার বাসিন্দা হলেও দাদু কখনও কলকাতাকে আপন বলে মেনে নিতে পারেননি। বলতেন, 'ধুলো ধোঁয়ার এই বিষাক্ত শহরে কি মানুষে থাকে!' তবে তাঁর মেয়ের বরানগরের বাড়িটা তাঁর খুব প্রিয় ছিল, কারণ কাছেই আছে গঙ্গা। কুঠীঘাটের ওপারেই বেলুড়মঠ। দাদু বুকাইদের বাড়িতে, এই সিঁথিতে এলেই বেলুড় মঠেও যেতেন। বর্ষায় জল জমলেও তিনি প্রতি বছর শ্রাবণ পূর্ণিমায় গঙ্গাস্নান করতে বুকাইদের সিঁথির বাড়িতে আসতেন। ইদানীং দাদু একটা ফোন ব্যবহার করছিলেন। সেখান থেকে বুকাইয়ের ফোনে মাঝে মধ্যেই দাদু ঠাকুর দেবতার ছবি, কিংবা সকালে গুডমর্নিং মেসেজ পাঠাতেন।

দাদুর শরীর ভালো যাচ্ছিল না। মা তাদের কাশীপুরের বাড়িতে গেলেই দাদু প্রায়ই বলতেন,

'মায়া এবার তোদের প্রতিবেশী হব খুব শিগগীর।'

কথাটা মা বুঝতেন না। দাদু-ই বুঝিয়ে বলতেন।

'ওরে বুঝলি না? আমার গঙ্গালাভের কথা বলছি রে!'

দাদুর মাঝে মাঝেই শ্বাসকষ্ট হত খুব, যাকে চলতি কথায় টান বলে। মাঝে মাঝে দাদু বাসক পাতা শুকিয়ে চুরুট বানিয়ে খেতেন। বলতেন তাতে নাকি কিছুটা আরাম হয়। কাশীপুরের বাড়িতে বড় বড় কয়েকটা বাসকের ঝাড় ছিল। আর ছিল অদ্ভুত দেখতে একটা গাছ। নাম হল নোয়াড় গাছ। গাছের পাতার যৌগিক পত্রবিন্যাস। শীতকালে গাছ ন্যাড়া হয়ে পাতা পড়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে নতুন পাতাও গজাতে থাকে। খুব ছোট ছোট গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল ফোটে গাছে তখন। তারপর গাছের ডালে এবং কাণ্ডের গায়ে থোকা থোকা হয়ে ফল ধরে। ছোট ছোট কুলের মত দেখতে ফিকে সবুজ সেই ফল প্রচণ্ড টক। দাদু বলতেন শিলাকুল গাছ। এই গাছের পাতার অনেক গুণ, আগেকার দিনে হাম বা পক্স হলে এই পাতা দিয়ে গ্রামে জলছড়া দেওয়া হত। দাদু বলতেন নোয়াড় পাতার হাওয়া নাকি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। পাকা ফল সেদ্ধ করে জল ফেলে, চটকে ক্কাথ বানিয়ে চিনি আর মশলা দিয়ে একটা জ্যামের মত চাটনি তৈরি করতেন দিদা। দাদুর খুব প্রিয় ছিল ওটা। দিদা মারা যাওয়ার পর অত ঝামেলার শিলাকুলের চাটনি আর কেউ করত না। ঝাঁকড়া গাছটা উঠোন বরাবর ছায়া দেয় বলে, দাদুকে না বলেই গাছটা মামারা কেটে ফেলেন। দাদু খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। বলেছিলেন,

'ওরে গণ্ডমূর্খের দল! পুবদিকে এই গাছ বাড়িতে রোগ আপদ ঢুকতে দেয় না। তা না জেনেই সেই গাছ তোরা কেটে ফেললি?'

শেষের দিকে দাদু সবসময় খুব মনমরা হয়ে থাকতেন। দিদা মারা যাওয়ার পর প্রায়ই বুকাইদের বাড়িতে গঙ্গা দেখতে আসতে চাইতেন। মামারা দাদুকে এখানে পাঠাতে চাইতেন না। একবার মা গাড়ি ঠিক করে দাদুকে আনবে বলে গেছিল, কিন্তু মামারা তবুও দাদুকে ছাড়েননি। সেই থেকে মা বহুদিন অভিমানে কাশীপুরের বাড়িতে নিজেও যেমন যায়নি, তার ছেলে মেয়েদেরও পাঠায়নি।


বুকাই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। সে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে উপরে উঠতে লাগল। শান্তকে ডাকতে হবে, এক্ষুণি। শান্ত ঘরে শুয়েছিল। এত ভোরে ওর ওঠার কথা নয়। বাড়িতে খুব ভোরে লোকজন আসায় উঠে এসেছিল, আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছে। বুকাই মশারির ভেতর ঢুকে ডাকল, 'এই শান্ত দাদা!'

দাদা ডাক শুনেই শান্ত গোল গোল চোখ করে উঠে বসেছে। এই বাড়িতে একমাত্র বুকাইয়ের কাছেই দাদা ডাক শুনতে পায় সে। শান্ত উঠে বসতেই, বুকাই ওর মাথায় চাঁটি মেরে বলল,

'তাড়াতাড়ি নীচে মায়ের ঘরে আয়! আমরা দাদুর প্ল্যানচেট করব! তুই কি ইন্টারেস্টেড?'

শান্ত ভয় পাওয়া গলায় বলল,

'এখনই করবি? কিন্তু সকালবেলায় কি প্ল্যানচেট হয় নাকি?'

'কেন হবে না? দাদু আমাকে প্রায় রোজই ফোনে ঠাকুরের ছবি পাঠান। কালকে রাতেও কয়েকটা পাঠিয়েছেন। তারপর হঠাৎ করেই----। এখন ডাকলে দাদু তাড়াতাড়ি আমার কাছে চলে আসবেন, কারণ দাদুর আত্মা এখনও বেশিদূরে চলে যেতে পারেনি।'

পম্পা-ই কেবল কয়েকবার বাধা দিল। বলল,

'শোন, প্ল্যানচেট কিন্তু খুব ভয়ানক জিনিস! যদি অন্য কোনো আত্মা চলে আসে? দেন ইট ইউল বি ভেরি ডেনজারাস! মেনি থিং ক্যান হ্যাপেন।'

বুড়ান বলল, 'কিচ্ছু হবে না। আমার প্ল্যানচেট দেখার খু-উ-ব ইচ্ছে। চল তাড়াতাড়ি শুরু করি।' শান্ত বলল,

'আগে বল, কী কী লাগে?' শান্তর প্রশ্নের উত্তর দিল বুকাই।

'বেশি কিছু না। দাদুর ফটো। একটা মোমবাতি। একটা গোল টেবিল। আর চারটে চেয়ার। চারজন চারটে দিক কভার করবে। সবাই হাত ধরে থাকবি আর দাদুকে ভাববি। ঘরটা একদম অন্ধকার করতে হবে।'

ঝড়ের বেগে কাজ শুরু হয়ে গেল। দাদুর ছবিটা দেওয়াল থেকে নামানো হল। ছবি নিয়ে নীচে ছুটে এল সে। মায়ের ঘরে একটা গোল টি-টেবিল আছে। এখন ওটাই ওদের প্ল্যানচেট টেবিল হবে। ডাইনিং রুম থেকে চারখানা চেয়ার এনে জড়ো করা হল। ঘরের জানলাগুলো সব বন্ধ করা হয়েছে। একটু পরেই নটা নাগাদ রান্না করতে মালতী-মাসি আসবে, তাই তার আগেই প্ল্যানচেট শেষ করে দিতে হবে। সকাল সাড়ে ছটার আগেই সব কিছু গোছানো হয়ে গেল। টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানলার কাচে কাপড় গুঁজে দেয়া হয়েছে। পম্পা বলল,

'সবাইকে হাত ধরে বসতে হবে। খবরদার! কেউ হাত ছাড়বি না। হাত ছাড়লেই চক্রের ভেতর অজানা খারাপ শক্তি ঢুকে পড়বে। দাদুকে আমরা সবাই দেখেছি। দাদুর কথা ভাবতে হবে চোখ বুজে। নে নে শুরু কর--'

ওর মোবাইলে নোটপ্যাড খুলে রেখেছে বুকাই। দাদু মোবাইলে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। যদি কিছু বলতে চান নোটপ্যাডেই লিখবেন।


মায়া চোখ বুজে বসে আছে। তার দু চোখ জলে ভাসছে। বাবার মৃত্যুর চেয়েও তার অবাক লাগছে, দাদাদের ব্যবহারে। বাবার মারা যাবার পরেও বিষয়ের চিন্তাই তাদের কাছে প্রধান হয়ে উঠেছে। বড়দা রাস্তাতেই বলেছে,

'বাবা তোকে কি কিছু দিয়ে গেছেন? মানে বাড়ির দলিল বা এই জাতীয় কিছু?'

মায়া আর ভাবতে পারে না। কাশীপুরের বাড়িতে সে এরপরে আর কখনও আসবে না। আগেই দাদারা গয়নার খোঁজ করেছে, আর আজ দলিল! এমন স্বার্থপর তার সহোদরেরা? মায়ার মন ছটফট করতে থাকে বাবার জন্য।

রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। ততক্ষণে উঠোনে সাদা চাদরে ঢাকা বাবার মৃতদেহ শোয়ানো আছে উত্তর দিকে মুখ করে। মায়া এসে বাবার পায়ে মাথা রাখল। বাবার পা দুটো ঠান্ডা, শক্ত কাঠের মত। শরীরে রাইগর মরটিস শুরু হয়েছে।

মায়াকে দেখে, দুই বউদি বলল,

'ডাক্তার এসে জানানোর পরেই, তোমার দাদারা শুধু তোমার কথাই বলছে। যত তাড়াতাড়ি পেরেছে তোমাকে আনতে ছুটেছে তারা। ফোনে বললে কষ্ট পাবে, তাই ফোন করেনি কেউ। শত হোক তুমি তাদের একমাত্র বোন! আমাদের সবার প্রিয়!'

পাশের রামকৃষ্ণ মিশন মঠে যাতায়াত ছিল তার বাবার। খবর পেয়ে দুজন ব্রহ্মচারী ও একজন সাধু এসেছেন। গীতাপাঠ করছেন তাঁরা।

''অজো নিত্যঃ শ্বাশ্বতোহয়ং পুরাণো

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।''

মায়ার মনে পড়ে যাচ্ছে কত কথা। গত বছর শ্রাবণ মাসে বাবা শেষবার এসেছিল তার কাছে। একটা চন্দন কাঠের হাতবাক্সে বাবা তাঁর জপের মালাটা রাখতেন। যাবার সময় সেই বাক্সটা দিয়ে গেছিলেন তাকে। বলেছিলেন,

'এটা এখন থেকে তোর কাছেই থাক। তুই এটাতে গয়না রাখিস। বেশ ভারী। আসল চন্দন কাঠ। এখনও অপূর্ব সুগন্ধ! এটা তোর আলমারিতেই রাখিস।'

এরপর কিছুদিন পরে মায়া কাশীপুরের বাড়িতে গেলে বলেছিলেন,

'আমি মারা গেলে দাহ করার পর সেদিনই আমার ছবিটা দেয়াল থেকে নামিয়ে এনে নীচের ঘরের তাকে রেখে, সামনে এটা জ্বেলে দিস।' মায়া দেখেছিল একটা বিরাট প্রায় আধ হাত লম্বা রঙিন মোমবাতি বাবা তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন। বাবা বলেছিলেন,

''আগে এটা জ্বালাবি না। আমি মারা গেলে, তবে জ্বালাবি, আর দেখবি, এই মোম যেন সবটা শেষ হয়। এতে আমার আত্মা শান্তি পাবে।''

মায়া জানত বাবা একটু জেদি আর খেয়ালি, ওঁর শরীর ভালো ছিল না। তাই আর তর্ক না করে মোমটা নিয়েছিল সে। তারপর আলমারিতে সাবধানে চন্দনকাঠের বাক্সের পাশে রেখে দিয়েছিল।

বাবা কেন বলেছিলেন এই কথা? বাবার কি মনে হয়েছিল, সে-ও দাদাদের মত বাবাকে ভুলে যাবে? ছবির সামনে মোমবাতিটা জ্বেলে দেবার কথা তাই কি বলে দিয়েছিলেন? মায়ার দু চোখ বেয়ে হু হু করে জল পড়তে লাগল।

বুকাইরা চারজন হাত ধরাধরি করে বসেছে। ঘরের ভেতর গভীর অন্ধকার সামান্য কেটেছে মোমের আলোয়। দেওয়ালে বড় বড় ছায়া, ফ্যানের হাওয়ায় সেই ছায়াগুলো কাঁপছে, তাতেই ভৌতিক এক রকম আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। একমনে বুকাই বলছে,

'দাদু এসো! আমি তোমাকে ভয় করছি না। আমি জানতে চাই প্ল্যানচেট কি সত্যি? না সবটাই বুজরুকি? তুমি শুধু এইটুকু বলে যাও!'

ক্রমে তার শরীরটা ভার হয়ে আসতে লাগল ওর। যেন মনে হল কেউ কাঁধের উপর দু হাতের ভার রেখেছে। হঠাৎ কাঁপতে কাঁপতে মোমবাতিটা নিভে গেল। মুহূর্তের মধ্যে যেন অন্ধকার গিলে নিল ঘরটাকে। একটা অন্যরকম গন্ধ নাকে আসছে। দাদুর গায়ের গন্ধ? ঠিক যেন বাসক পাতা পোড়া গন্ধে ভরে উঠেছে ঘরটা। শান্ত আর বুড়ান বুকাইয়ের দুপাশে বসেছে। ওরা দুজনে ওর দুহাত ধরে ছিল, এবার ভয়ে একেবারে চেপে ধরল।

আরুষি আর অঙ্গনা দোতলায় তাদের শ্বশুরের ঘরে উঠে এসেছে। নীচে হলঘরে তাদের ননদ মায়া বসে আছে। ওকে এখন যে করে হোক নীচে বসিয়ে রাখতে হবে। হাতের কাজ তাড়াতাড়িই সারতে হবে। অঙ্গনা এ বাড়ির বড়ো বউ। আরুষি ছোটো বউ। অঙ্গনার চেহারা একটু ভারী। সে ছোটাছুটি করতে পারে না। অল্পতেই হাঁপিয়ে যায়। সে যেন একটু দ্বিধাগ্রস্ত। একটা খারাপ লাগা আচ্ছন্ন করে রেখেছে তার চেতনা।

আরুষি নীচু হয়ে খাটের তলাটা দেখে নিল। তারপর আলমারি চাবি ঘুরিয়ে খুলে ফেলল। উফ! কোথায় কী? দলিলেও সই করল না বদমাশ বুড়ো। এখন মায়া রাজি না হলে এ বাড়িটা বিক্রিও করা যাবে না। এখন মেয়েরাও বাপের সম্পত্তির সমান ভাগীদার। তাহলে মায়ের সেই চুনীর লকেট আর পান্নার বসানো হার কোথায় গেল? আর সেই বাদশাহী মোহরগুলো? প্রায় আটখানা মোহরের গল্প বহুবার শুনে এসেছে শাশুড়ির মুখে। কোথায় রেখেছে সেগুলো? খাটের নীচের ওই লোহার সিন্দুকটাতে? কিন্তু সেখানে তো কিছু নেই? আগেই দেখা হয়েছে। তবে?

খাটের তলায় বসানো আছে একটা বিরাট ভারী লোহার বাক্সের মত দেখতে সিন্দুক। আরুষি অঙ্গনাকে দেখালো বাক্সটা। এবার এটার চাবি যে কোথায় আছে? দুজনেই ভাবতে থাকে। খাটের নীচে, তোষকের নীচে, আলমারিতে সর্বত্র খুঁজে খুঁজে জিভ বেরিয়ে এসেছে ওদের। বুড়ো মরেও শান্তি দিল না। ছেলেরা এত করে বলল,

''বাবা বাড়িটা আমাদের দুজনকে লিখে দাও!'' বুড়ো দিলই না। আদরের মেয়ের জন্য তার এত মায়া!‌''

অঙ্গনা বালিশের নীচ থেকে একটা লোহার বিরাট চাবি বের করেছে। এই চাবিটাই বোধহয়!

চাবি ঘুরিয়ে বিশাল বাক্সটা খুলে ফেলেছে দুজনে। বাক্সের ভেতর দুটো ছোট ছোট গয়নার বাক্স। একটা বাক্স খুলতে বেরিয়ে এল দু'জোড়া সোনার সাদামাঠা কানের দুল। একটা চিরকুটে লেখা দুই বউকে দিলাম। আরুষি চোখ বড় বড় করে বলল,

'মাত্র একজোড়া দুল!'

অঙ্গনা অন্য বাক্সটা খুলল। তাতে ছোট ছোট গোল গোল কীসের যেন বীজ রাখা। আরুষি আর অঙ্গনা বুঝতেই পারল না ওগুলো কী? নীচ থেকে মায়াকে ডেকে আনল ওরা। মায়া সেগুলো দেখেই বলল,

'ওমা! এ তো শিলাকুল ফলের বীজ! বাবা দেখছি যত্ন করে রেখে দিয়েছেন! দিদি কয়েকটা বীজ আমাকে দিও। বাবা এই গাছটা খুব ভালোবাসতেন। আমি আমার ওখানেই লাগাবো গাছটা।'

রাগে আরুষি বীজগুলো ঘরময় ছড়িয়ে ফেলল। আর কিচ্ছু নেই কোথাও। দুই বউ একেবারে হতভম্ভ।

মায়া বেরিয়ে যেতেই বালিশের তলা থেকে শ্বশুরের ফোনটা বের করেছে আরুষি। অঙ্গনাও তাতে উঁকি মেরেছে। আরুষি চাপা গলায় বলল, 'দেখছি ফোনে একটা ভিডিও রেকর্ড করেছেন বাবা। আমি চালাচ্ছি দাঁড়াও।'

সে ভিডিও চালানোর জন্য কয়েকবার ক্লিক করল। কিন্তু ভিডিওটা কিছুতেই খুলল না। সে আশ্চর্য হয়ে বলল,

'ভিডিও খুলছে না। মরার আগেই তাহলে ভিডিও করে রেখেছে বুড়ো। কী মতলব কে জানে! হয়তো আমরা ওঁকে বাড়ি বিক্রির জন্য চাপ দিয়েছি, সে কথা বলে গেছেন।'

অঙ্গনা হাত বাড়াল।

'আমাকে একবার দাও দেখি।' ফোনটা খুলেই হোয়াটস্অ্যাপ খুলেছে সে।

'আরে দেখেছো! বাবা বুকাইকে রোজ মেসেজ পাঠাতেন, আর কাউকে না। কিন্তু কেন?'

'আরে নিজের মেয়েকেই পাঠাতে চাইতেন। মেয়ে তো এইসব করেই না, তাই নাতিকেই দিতেন। গয়নাগাঁটিও দিয়েছেন মনে হয় মেয়েকে। মেয়ে কি আর তা স্বীকার করবে?'

অঙ্গনা অন্যমনস্কভাবে ভিডিওটা আবার খুলতে চাইল।

'অ্যাই! অ্যাই! আরুষি! দেখো ভিডিওটা বুকাইকে পাঠানো হয়ে গেল হঠাৎ! এ মা! বুকাইয়ের কাছে চলে গেল যে! আমি সেন্ড করিনি, কীভাবে গেল?'

আরুষি আর অঙ্গনা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল মোহিত ঘোষালের ফোনের দিকে। ফোনটা অস্বাভাবিক আচরণ করছে। কেন? এর ব্যাখ্যা ওদের কাছে নেই।

অন্ধকার ঘরে ওরা চারজন টেবিল ঘিরে বসেছিল। ঘরের ভেতর এক অদ্ভুত শীতল বাতাস বইছে, আর তাতে ওরা যেন জমে গেছে একেবারে। নড়াচড়াও করতে পারছে না যেন। হঠাৎ বুকাইয়ের ফোনটা টুং করে উঠল। নোটিফিকেশন টোন। হোয়াটস্অ্যাপে একটা ভিডিও এসেছে। ভিডিওটা পাঠিয়েছেন বুকাইয়ের দাদু!

এবার পিদিদিও ভয় পেয়েছে। ছুটে গিয়ে আলো জ্বেলে দিল ও।

'এ্যাই! তোরা আর এ সব করিস না। যা যা উঠে পড়। ওই ভিডিওটা একবার চালা দেখি।'

ভিডিওতে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দাদু ভিডিও ঠিকমত করতেই পারেনি। তবে দাদুর কথা শোনা যাচ্ছে। কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

''প্রিয় দাদুভাই ও দাদিমা!! একটু আগে আমার ছেলেরা আর দুই বউমা আমার কাছে এসেছিল। ওরা এই বাড়িটা ওদের নামে করে দিতে বলছিল বারবার। আমি রাজি হইনি। সব বাড়িরই একটা ইতিহাস থাকে। আমি চাই তোমরাও সেই ইতিহাসকে বহন করে নিয়ে চলবে। আমার বড় ছেলের সন্তান হয়নি। ছোট ছেলেরও না। তুমি আর দাদিমা হলে আমার একমাত্র নাতি নাতনি। তাই তোমাদের বলে গেলাম। এই বাড়ি যেন এমনই থাকে, বিক্রি না হয়। পারলে বাড়ির পুবদিকে নোয়াড় গাছটা আবার লাগিয়ে দিও। আমার লোহার সিন্দুকে ওই গাছের কিছু বীজ রেখে গেলাম। মানুষ গাছের মূল্য বোঝে না। তাদের কাছে এইসব বীজ মূল্যহীন হলেও, তোমরা যেন তা মনে করো না। তোমার মাকে একটা চন্দন কাঠের বাক্স দিয়েছি। তার নীচে একটা ছোট ছিদ্র আছে। তাতে একটা বিশেষ ধরনের চাবি ছয়বার ঘোরালে তবেই সেটার ভেতরের একটা খোপ খুলবে। আগে কিছু বলিনি। জানতাম বললে মায়া কিছুই নিতে চাইবে না।

এই বাক্স আমি একজন বিশেষ কারিগরকে দিয়ে তৈরি করিয়েছিলাম। বাক্সের চাবিটাও খুবই ছোট। তোমাদের মাকে আমি একটা মোম আগে থেকেই দিয়ে রেখেছি। চাবিটা আছে তার ভেতরে। তোমার মাকে আমার ফটোর সামনে মোম জ্বেলে দিতে বলেছিলাম, যাতে সে ওই চাবিটা খুঁজে পায়। বাক্সে দাদিমায়ের জন্য চুনীর লকেট, তোমাদের মায়ের জন্য পান্না বসানো সোনার সাতনরী হার, তোমার জন্য কমল হিরের আংটিটা রইল, আর তোমাদের বাবার জন্য বাদশাহী আমলের একটা মোহর রেখে গেলাম। বাকি মোহরগুলো আমি সবই মিউজিয়ামে জমা করেছিলাম। একটাই নিজের কাছে রেখেছিলাম এতদিন। আমার ব্যাঙ্কে যা টাকা আছে তা আমার তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে সমান ভাগ হবে। তোমারা সকলে আমার আশীর্বাদ নিও।''

বুকাই প্ল্যানচেট সত্যি না মিথ্যে বিচার করতে চেয়েছিল, এবার সে বুঝল, তা খুব কঠিন। সত্যিই কি দাদু এসেছিলেন? নাকি একমনে দাদুর কথা ভাবতে গিয়ে তাদের সকলের কিছু বিশেষ অনুভূতি হয়েছিল? সে তা জানে না। কিছু কিছু রহস্য পৃথিবীর বুকে সব সময় থাকে, যার বিচার সাধারণ বুদ্ধিতে করা যায় না। তবে এখন বুকাইয়ের প্রথম কাজ হল, দাদুর প্রিয় নোয়াড় গাছটা খুব তাড়াতাড়ি ওখানে লাগানো।




(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)