গ্রোসারি স্টোর থেকে বাইরে বেরিয়েই চমকে উঠল সুকন্যা। আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘের স্তূপ, তার সঙ্গে গুরুগুরু গর্জন। যে কোনো মুহূর্তে ঝরঝর করে ঝরে পড়বে বৃষ্টির বারিধারা। অন্যসময় হলে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠত, "মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে।" কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে একটুও গান এল না, গ্রোসারি কার্ট নিয়ে পড়িমরি করে ছুটল ও গাড়ির দিকে। না না, আষাঢ়স্য দিবসে ভিজতে ভয় নেই ওর একটুও, উদ্বেগের কারণটি অন্য।
ঝড়ের গতিতে গাড়ির ট্রাঙ্কে মালপত্র তুলে, শপিং কার্ট যথাস্থানে রেখে গাড়ি স্টার্ট করল সুকন্যা। বৃষ্টি শুরুর আগে বাড়ি পৌঁছতেই হবে ওকে। বাড়ি মানে এপার্টমেন্ট, যেখানে গত তিন বছর ভাড়া আছে ও। বছর তিনেক আগে একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ পেয়ে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দিয়েছিল বরাবরের মেধাবী ছাত্রী সুকন্যা। তারপর থেকে নিউ জার্সির এই শহরটিই তার ঠিকানা। গবেষণা ছাড়াও একটি কলেজে পার্টটাইম পড়ায়। কর্মস্থলের কাছেই একটি এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স-এ বাড়ি ভাড়া করেছে। জায়গাটা ছোট হলেও তার একার পক্ষে যথেষ্ট। সর্বোপরি ভাড়াটা ন্যায্য ও যাতায়াতের সময় বাঁচে। তাই এইখানেই আছে ও।
সবই ঠিক, শুধু বাড়ির সামনের ইয়ার্ডটুকু পাশের এপার্টমেন্টের সাথে শেয়ার করতে হয়। এ ব্যাপারে প্রথম দিকে একটু মন খুঁতখুঁত করত সুকন্যার। দেশে তাদের বিরাট বনেদী বাগানবাড়ি। বাগানে ভাইবোনদের সাথে খেলা, রবীন্দ্রজয়ন্তীতে মঞ্চ বেঁধে ঘরোয়া অনুষ্ঠান, এইসব করা মেয়ে সে। আর এই বিদেশ বিভুঁইএ নিজের মতো করে একটু উঠোনে বসারও উপায় নেই! তবে নিজের গবেষণা আর অধ্যাপনার কাজে উদয়াস্ত ব্যস্ততার পর আর কতটুকুই বা সময় পায় যে বাইরে ঘুরবে! তাই ও নিয়ে আর আক্ষেপ নেই। তাছাড়া পাশের বাড়ির মিসেস লম্বার্ট-এর সঙ্গে ভালোই আলাপ জমিয়ে নিয়েছে ও। উঠোনে মিসেস লম্বার্টের ফুলের টবগুলি দেখেই আপাতত বাগানের শখ মেটায় সুকন্যা।
বেশ চলছিল, হঠাৎ সব বদলে গেল মার্চের মাঝামাঝি থেকে। রে রে করে ধেয়ে এলো করোনার দাপট! অফিস-কাছারি, স্কুল কলেজ, দোকানপাট সব বন্ধ। শুরু হলো মৃত্যুমিছিল। জনজীবন স্তব্ধ, গৃহবন্দী মানুষ। এত ব্যস্ত শহরটা কয়েকদিনেই ঝিমিয়ে পড়ল। ভার্চুয়াল লেখাপড়া শুরু হলেও তা কোনোভাবেই মুখোমুখি শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপূরক নয়। সুকন্যার ল্যাব-এর কাজ তো প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। সবসময় একটা আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা। একা থাকে বলে উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনাগুলো যেন আরো গিলে খেতে আসে।
নাঃ, ঘরবন্দী থাকলেও মনটাকে বন্দী করে রাখা যাবে না কিছুতেই! ছবি আঁকা, গান গাওয়া ছাড়াও নিজেকে ব্যস্ত রাখতে আরো নতুন নতুন শখের সন্ধানে নিযুক্ত হলো সুকন্যা। হঠাৎ একদিন ওর মনে হলো বাড়িতে বড়ি তৈরি করলে কেমন হয়, যেমনটি ঠাম্মি করত!
বাঙালির রসনার এক অতি আদরের উপকরণ বড়ি, আর সুকন্যার কাছে তো ওটা চিরকালই এক ভীষণ দুর্বলতা! কিছু না থাকলে শুধু গরম গরম মুসুরির ডাল আর বড়ি ভাজা দিয়েই পুরো ভাত খেয়ে নিতে পারে সে। শুধু খাওয়াই নয়, সুকন্যার কাছে বড়ির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে ওর ঠাম্মির ভালোবাসা। চোখ বুজলেই ও দেখতে পায় ধোয়া পাটভাঙা কাপড় পরে পরম যত্নে শিল-নোড়ায় মিহি করে বিউলির ডাল বেটে, চাল কুমড়ো কুরে, মশলা গুঁড়িয়ে কতক্ষণ ধরে অক্লান্ত ভাবে বড়ির উপকরণ ফেটাচ্ছে ঠাম্মি! তারপর সেই ডালবাটা মুক্তো দানার মতো একটি একটি করে তেল মাখানো বড় বড় কাঁসার থালায় সাজিয়ে তুলত ঠাম্মি। এরপর রোদে বড়ি শুকোনোর পালা। ছোটবেলায় কতদিন যে গরমের ছুটিতে ছাদে বসে ঠাম্মির বড়ি পাহারা দিয়েছে সুকন্যা তার ইয়ত্তা নেই! পাহারা দেওয়া মানে কড়া নজরদারি। পাখিগুলো যেন একদম না মুখ দেয়। তার থেকে বড় কথা ঈশান কোণে মেঘ জমলেই ছুট্টে তুলে নিতে হবে বড়ি। এক বিন্দু জল লাগলেই গন্ধ হয়ে যাবে বড়িতে, তখন সব পরিশ্রম বৃথা!
আর ঠিক এই কারণেই উর্দ্ধশ্বাসে গাড়ি চালাচ্ছে সুকন্যা। কমন ইয়ার্ডে থালায় করে বড়ি শুকোতে দিয়ে এসেছে ও। এক ফোঁটা বৃষ্টির জল লাগলেই সব শেষ! কিন্তু সকালে উঠে তো ও ওয়েদার সাইট দেখেছিল, পরিষ্কার লেখা ছিল ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা সন্ধ্যের পর! এখন সবে বেলা সাড়ে তিনটে। তাহলে কি চেঞ্জ হয়ে গেল ফোরকাস্ট? সত্যি বাবা, আজকাল এই গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর জন্য এত উন্নত প্রযুক্তির দেশেও আবহাওয়ার পূর্বাভাস মেলে না! কি কুক্ষণেই যে বড়ি দেওয়ার শখ হয়েছিল ওর, নিজের ওপর রাগ হলো সুকন্যার।
কিন্তু দোষটা ওর একার নয়, ওই ইথান জোরাজুরি না করলে এত বড় দায়িত্বটা ও এদেশে নিত না। ইথান সুকন্যার কলিগ। বছরখানেক হলো কাজের বাইরেও ইথানের সাথে বেশ একটা অনুরাগের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওর। ইথানের বাবা মা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এসে এখানে অভিবাসন নিয়েছিলেন ওর জন্মের আগে। তারপর থেকে ওরা পাকাপাকিভাবে এদেশেই রয়ে গেছেন। জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক হলেও নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে খুবই গর্বিত ইথান। নিজের পরিবারের অনেক গল্পই বলে ও সুকন্যাকে। সেই সঙ্গে ভারতীয় রীতিনীতি ও আদবকায়দা নিয়েও ওর আগ্রহ অপরিসীম। বাঙালি রান্নার একনিষ্ঠ ভক্ত ইথান। লাঞ্চ-এ অনেক দিনই সুকন্যার টিফিন বাক্সর বাঙালি খাবারে ভাগ বসিয়েছে ও। রান্নাবান্না প্রসঙ্গেই একদিন ওকে ঠাম্মির বড়ি দেওয়ার গল্প শুনিয়েছিল সুকন্যা। ঠাম্মি কেমন কিশোরী নাতনিটির চিবুক নাড়িয়ে আদর করে বলেছিল, "দিদিভাই, এই তোমায় শিখিয়ে দিলাম মুক্তোবড়ি দেওয়া। বড় হয়ে আমার নাতজামাইকে এমন মুক্তোবড়ি দিয়ে শুক্ত করে খাইও কিন্তু"
ব্যাস, আর যায় কোথায়! একথা শুনেই ইথান রীতিমতো উঠেপড়ে লাগল ওর পিছনে, “স্যু, ইয়ু মাস্ট গিভ ইট এ ট্রাই অ্যাট লিস্ট ফর দ্য লাভ অফ ইয়োর গ্র্যান্ডমা।” এদিকে শীত কাটিয়ে রূপে রঙে জেগে উঠল নিউ জার্সির প্রকৃতি। নীল আকাশ, ঝলমলে রোদ, উষ্ণ দীর্ঘতর দিন, গাছভরা গোলাপি চেরি-ব্লসম সব জানান দিল "বসন্ত এসে গেছে।" সুকন্যা ভেবে দেখল এই তো উপযুক্ত সময় বড়ি তৈরির। এমনিতেই ঘরবন্দী, উঠোনে বড়ি শুকোতে পারবে ও নিজেই আর এই উপলক্ষ্যে অনেকটা সময়ও কাটবে। এখানকার ইন্ডিয়ান স্টোর-এর বড়িগুলো মুখে তোলা যায় না, না আছে নুন না কোনো স্বাদ! ঠাম্মির রেসিপি মতো বানালে অন্তত তার থেকে ভালো হবে বলেই ওর বিশ্বাস।
সুতরাং যা ভাবা তাই কাজ। কয়েক দিন আগে সুকন্যা ডাল ভিজিয়ে রাখল সারারাত। পরদিন সকালে মিক্সিতে ভেজানো ডাল বেটে, নুন মশলা গুঁড়িয়ে বড়ির উপকরণ প্রস্তুত করল নিজের সাধ্যমতো। তারপর তিনটি ধবধবে সাদা ডিনার প্লেটে তেল মাখিয়ে মুক্তো দানার মতো একটি একটি করে সাজাল বড়ি। প্রতিদিন উঠোনে বড়ির থালাগুলি বার করে রোদ খাওয়ায় দিনের বেলা। একটি নেটের দুপাট্টা দিয়ে থালাগুলো ঢেকেও দেয় যাতে পশুপাখি মুখ না দিতে পারে। ভালোই শুকোচ্ছিল ওর বড়ি। ইথানকে ফেসটাইমে ড্রাই পালস বল-এর প্রোগ্রেসও দেখিয়েছে সুকন্যা। দেখেই খুশিতে ডগমগ হয়েছে ও। “প্লীজ সেভ সাম ফর মি, ডোন্ট ইট-এম অল ইয়োরসেলফ…” কাতর মিনতি ওর।
“সরি ইথান, তোমার কপালে আমার হাতে গড়া বড়ি নেই, ডিয়ার,” মনে মনে একথা ভেবে গাড়ির স্টিয়ারিংটা আরো শক্ত করে চেপে ধরল সুকন্যা। কি যে আফসোস হচ্ছে ওর এই মুহূর্তে, কেন যে বেরোবার আগে বড়ির থালাগুলো ঘরে ঢুকিয়ে রাখল না! আসলে তখন ভেবেছিল, ও তো গ্রোসারি সেরে ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই ফিরে আসবে। ততক্ষণ আর একটু কড়কড়ে রোদে থাকুক থালাগুলো। এদেশে কেউ কারোর জিনিসে হাত দেয় না বাইরে পড়ে থাকলেও। তখন কি আর ও জানত যে ওয়েদার গড এমনভাবে ভোল বদলাবে হঠাৎ!
নিজের পাড়ায় ঢুকতে ডান দিকে বাঁক নিতেই গুঁড়ি গুঁড়ি শুরু হলো বৃষ্টি। নাঃ, শেষরক্ষা হলো না আজ। পার্কিং লট-এ গাড়ি থামিয়ে জিনিসপত্র হাতে ধরে যখন বাড়ির দিকে এগোলো সুকন্যা তখন রীতিমতো জোরে পড়ছে জল। পরাজিত সৈনিকের মতো নিজের এপার্টমেন্টের দিকে হাঁটতে শুরু করল ও। চোখে একটু জলও এল মনে হয়, তবে চোখের জল বৃষ্টির জলের সাথে মিশে একসাথে ঝরে পড়ল।
কিন্তু একি! বাড়ির কাছাকাছি এসে অবাক হয়ে গেল সুকন্যা। কই উঠোনে ওর বড়ির থালাগুলো নেই তো! এখানেই তো রেখে গিয়েছিল তিনটে থালা, গেল কোথায়? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, পেল না খুঁজে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে রইল ও। হঠাৎ দেখল হাতে একটা ছাতা নিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালেন মিসেস লম্বার্ট। স্মিত হেসে বললেন, "তুমি নিশ্চয় তোমার খাবারের থালাগুলো খুঁজছো। চিন্তা নেই, ওগুলো আমি যত্ন করে তুলে রেখেছি।" তারপর একটু উদ্বেগের স্বরে যোগ করলেন, “ইস তুমি একদম ভিজে গেছ। ভিতরে যাও। জামাকাপড় ছেড়ে, চুল মুছে শুকনো হয়ে নাও আগে। তারপর আমার বাড়িতে এসে তোমার খাবারের থালাগুলো নিয়ে যেও। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”
হতবাক হয়ে গেল সুকন্যা। তার বড়ি নষ্ট হয়নি, মিসেস লম্বার্ট বাঁচিয়েছেন ওদের! বিস্ময়ে মুখ দিয়ে ধন্যবাদটুকুও সেই মুহূর্তে বেরোল না ওর, মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে মিসেস লম্বার্টের কথামতো চাবি খুলে নিজের ঘরে ঢুকল।
জিনিসপত্র রেখে ফ্রেশ হতে হতে পুরো সময়টুকুই নিজের প্রৌঢ়া প্রতিবেশিনীর কথাই চিন্তা করল সুকন্যা। মৌখিক চেনা পরিচয় থাকলেও ওনার সঙ্গে বেশি কথাবার্তার সুযোগ কোনদিন হয়নি। সুকন্যার কর্মব্যস্ত জীবনে পাড়া প্রতিবেশী কারোর সঙ্গেই বেশি সামাজিকতা করার সুযোগ নেই। উইকেন্ডগুলো যদি বা একটু সময় ঘরে থাকে, তাও হাজারটা কাজ বাড়ির। তাছাড়া উইকেন্ডে বা অন্যান্য ছুটিছাটায় মিসেস লম্বার্ট সাধারণত এখানে থাকেন না, ছেলেমেয়েদের কাছে যান। তাই হাই-হ্যালো টুকু ছাড়া আর বেশি দূর এগোয়নি ওনার সাথে কথাবার্তা। আর এই কোভিড-এর পর প্রায় মাসতিনেক তো সেটুকুও বন্ধ। বয়স্ক মানুষ হওয়ায় ওনার সংক্রমণের ঝুঁকিটাও বেশি, তাই হয়তো পুরোপুরি গৃহবন্দী ছিলেন উনি। এই ক-মাস ওনাকে একবারও দেখেনি সুকন্যা। তবুও আজ এতবড় উপকার করলেন মিসেস লম্বার্ট।
আধ ঘন্টা পর ফ্রেশ হয়ে মুখে মাস্ক লাগিয়ে ও হাতে সেদিনই কেনা একটি স্যানিটাইজার এর নতুন বোতল নিয়ে যখন মিসেস লম্বার্টের দরজার বেল টিপল সুকন্যা তখন বৃষ্টিটাও একটু ধরেছে। উনি তাড়াতাড়ি এসে দরজা খুললেন, ওনার মুখেও মাস্ক। দরজায় দাঁড়িয়েই কথাবার্তা হলো, সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং-এর জন্য ঘরে ঢোকার উপায় নেই। সুকন্যা বলল, "মিসেস লম্বার্ট, আমি বলে বোঝাতে পারব না আজ আপনি আমার কতখানি উপকার করেছেন! এর জন্য কোন ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়।" উত্তরে সত্তরোর্ধ প্রৌঢ়া যা বললেন শুনে মন আর্দ্র হলো সুকন্যার।
"স্যু, ডিয়ার, গত তিন মাস আমার জীবনটা প্রায় থেমে গেছে। বাইরে বেরোতে পারি না, এমনকি নিজের সন্তান আর নাতিনাতনিদের সাথেও দেখা করতে পারি না। ওরা আমার একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দরজার বাইরে রেখে যায়। জীবনসায়াহ্নে এই বন্দিদশা যে কতটা মানসিক কষ্টের তা মনে হয় ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তবু মেনে চলতে হবে এই নিয়ম, তা না হলে সবার বিপদ। আর এই গৃহবন্দী দশায় আমার একমাত্র সঙ্গী এই উঠোনের দিকের জানলাটা। জানলার পাশের চেয়ারটায় বসে আমি ঘন্টার পার ঘন্টা কাটাই, বাইরের পৃথিবীটা দেখি। ওখানে বসেই আমি কিছুদিন আগে দেখলাম তুমি কয়েকটি থালা করে কিছু একটা উঠোনে রাখলে। দেখে মনে হলো খাবার জিনিস। তারপর গত কয়েকদিন রোজই দেখি তুমি থালাগুলো রোদে এনে রাখো আর সূর্য ডোবার সময় ঘরে নিয়ে যাও। তখন আমি বুঝলাম যে ওই খাবার নিশ্চই রোদে শুকনো করার দরকার হয়। আজও তুমি ফুডপ্লেটগুলো বাইরে এনে রেখেছিলে। কিন্তু যখন দেখলাম বৃষ্টি আসছে আর তবুও তুমি ওগুলো ঘরে ঢোকালে না তখন বুঝলাম নিশ্চয়ই অন্য কোনো বিশেষ কাজে আটকে পড়েছো তুমি। আমার মনে হলো বৃষ্টির জল লাগলে প্লেটের জিনিসগুলো সব নষ্ট হয়ে যাবে।"
ঠিক বলেছেন মিসেস লম্বার্ট! এক ফোঁটা জল পড়লেই সব স্পয়েল হয়ে যেত ওগুলো। আকুলভাবে জানায় সুকন্যা।
"আমারও তাই মনে হয়েছিল। সেই জন্যেই বৃষ্টি শুরুর আগে তাড়াতাড়ি করে মাস্ক আর গ্লাভস পরে তোমার প্লেটগুলো আমার ঘরের ভিতর এনে রাখলাম। তারপর জানলা দিয়ে তোমায় গ্রোসারি ব্যাগস হাতে ফিরতে দেখে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হলো। তখন দরজা খুলে তোমায় জানালাম তোমার জিনিস আমার হেফাজতে সুরক্ষিত। আশা করি তুমি কিছু মনে করোনি ডিয়ার?"
“মনে করব কী, আপনি আমায় বাঁচিয়েছেন! প্লেটের ওই খাবারগুলো আমার ঠাম্মির ভালোবাসা, তাঁর আশীর্বাদ!” এই কথা বলে মিসেস লম্বার্টকে তার বড়ি দেওয়ার ইতিহাস শোনায় সুকন্যা। বলে তার ঠাম্মি আর নেই, কিন্তু তাঁর মনের ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে চেয়েছিল সুকন্যা। মিসেস লম্বার্ট অবাক হয়ে শুনলেন সব কথা, বললেন স্যু এখন থেকে তোমার গ্র্যান্ডমা-র ট্র্যাডিশন এগিয়ে নিয়ে যাবে তুমি। তাই হয় যুগে যুগে, গ্রান্ডমা-রা তাঁদের নাতিনাতনির মাধ্যমেই বেঁচে থাকেন।
সুকন্যা বলল, "মিসেস লম্বার্ট, সেদিনও বড়ি খেতে পেতাম আমার ঠাম্মির জন্য। আর আজ ও বড়ি খেতে পাব তোমার আন্তরিকতার জন্য। তুমি আমার নিজের গ্রান্ডমা-র চেয়ে কিছু কম নও।”
কথাটা শুনে আনন্দে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল প্রৌঢ়ার, সুকন্যাকে একটা ‘এয়ার হাগ’ দিলেন দূর থেকে।
মহানন্দে বড়ির থালাগুলো ঘরে ফেরত নিয়ে যাওয়ার আগে নতুন স্যানিটাইজার-এর বোতলটা মিসেস লম্বার্টের কফি টেবিলের ওপর রেখে জানাল সুকন্যা, দোকানে এর নতুন স্টক এসেছে, সে আজ দু-বোতল কিনেছে। একটা রেখে গেল। অন্য কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দরকার হলে মিসেস লম্বার্ট যেন অবশ্যই ওকে জানায়। “আমি এখন থেকে তোমার সবচেয়ে নিকট আত্মীয়।” বেশ প্রত্যয়ের সাথে ঘোষণা করল সুকন্যা।
মাস্কের ভিতর থেকেই প্রাণভরে হেসে উঠল দুজনে।
(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)