একজন গাছ-বন্ধু বা ট্রি-হাগার-এর কাজ দুষমনের হাত থেকে গাছের প্রাণ বাঁচানো। কেউ গাছ কাটতে এলে সে গাছকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যাতে সে কাঠুরের করাতের হাত থেকে গাছটাকে বাঁচাতে পারে। গাছ-বন্ধুকে না কেটে গাছ কাটা যাবে না। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা আবাস্তব মনে হলেও এই ধরনের ঘটনা বিরল নয়। গাছ-কাটা সম্পর্কীয় না হলেও কয়েক বছর আগে এক অ্যামেরিকান তরুণী প্যালেস্তাইনে ইস্রায়েলী আগ্রাসন প্রতিহত করতে বুল-ডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। বুল-ডোজারের চালক তার ওপর দিয়েই সেই যন্ত্র-দৈত্য চালিয়ে দেয়। ট্রি-হাগারদের ক্ষেত্রেও এরকম সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কিন্তু, মজার কথা হলো ট্রি-হাগারদের নিয়ে তির্যক বা কটু মন্তব্যের কোনো অভাব নেই - এদের মাথায় স্ক্রু একটু ঢিলে আছে, তাই তাদের বাস্তব সম্বন্ধে ধারণা কম। অর্থাৎ বাস্তবমনা লোকেরা যেন বলতে চায় যে পৃথিবীতে গাছের তো কোন অভাব নেই তাই তাদের যথা ইচ্ছে কেটে ফেলে সেখানে মানুষের বসবাসের জায়গা করা, চাষ করার জমি তৈরি করা, কলকারখানা গড়ে তোলা ইত্যাদির অনেক বেশি প্রয়োজন গাছ বাঁচানোর চেয়ে।
মানুষের সভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে তাই-ই দেখতে পাওয়া যায়। বিশাল বিশাল বনভূমি, যা হাজার-হাজার বছর ধরে কত গাছপালা, কত জীবজন্তুকে আশ্রয় দিয়েছে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অ্যামাজন রেন ফরেস্টের আদিম বনভূমিতে এখন হয়েছে গরু চরানোর জায়গা, যাতে গরুর মাংস বিক্রি করে র্যাঞ্চারদের পকেট ভর্তি হয়। নেপালের তরাই অঞ্চলে পাহাড়ের গা গাছ কেটে কেটে একেবারে খালি। সমুদ্রের ধার ধরে গাছের সারি সব উধাও। সেখানে সার সার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্ট।
সারা পৃথিবীর উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ারমিং এখন একটি অতি পরিচিত শব্দবন্ধ হয়ে উঠেছে, এবং তার ফলে বর্তমানে কী হচ্ছে, ও ভবিষ্যতে আরও ভয়ানক কী হতে পারে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা, মিটিং, মিছিল, রাজনীতি ইত্যাদির কোন অভাব নেই। তার ফলেই সুইডেনের সতেরো বছরের কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ উষ্ণায়ন প্রতিরোধের প্রধান প্রবক্তা ও সক্রিয় কর্মী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এর বিপরীতে মত দেওয়ার লোকেরও কোন অভাব নেই। অ্যামেরিকা ও ব্রেজিলের প্রেসিডেন্টরা তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর তাদের পিছনে আছে জীবাশ্ম জ্বালানী শিল্প বা ফসিল ফুয়েল ইন্ডাস্ট্রি-র লোকজন, মানে কয়লা, জ্বালানী তেল বা ফুয়েল অয়েল, ন্যাচারাল গ্যাস ইত্যাদির শিল্পপতিরা।
উষ্ণায়নের ফলে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে স্থায়ী বরফের স্তর গলতে আরম্ভ করেছে, আর বাড়তে আরম্ভ করেছে সমুদ্রে জলের উচ্চতা। তার ফলে ইতিমধ্যেই কয়েকটি দ্বীপ পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। শুরু হয়েছে সারা পৃথিবী ব্যাপী দাবানলের প্রকোপ। যেমন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের এক বিরাট অঞ্চল জুড়ে দাবানল অপ্রতিহত ছিল প্রায় এক বছর ধরে। এ ছাড়াও সামুদ্রিক ঝড়, পাহাড়ে আচমকা ধ্বস, হড়পা বান, সুনামির প্রকোপ (যেমন মেরু অঞ্চলে সমুদ্রের ওপরে বিশালাকার তুষার ধসের জন্য যে সুনামি হয়) অনেক বেড়েছে। সম্প্রতি ভারতের উত্তরাখণ্ড প্রদেশের সুবিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চলে ধ্বস ও আচমকা বানের ফলে সারা অঞ্চল ধুয়ে-মুছে গেছে, সঙ্গে নিয়ে গেছে স্থানীয় সব লোকজনদের। প্রশ্ন হল– সামুদ্রিক ঝড়, দাবানল, সুনামি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগেও ছিল, তার সাথে পৃথিবী-ব্যাপী উষ্ণায়নের সম্পর্ক কী? কোন কোন ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক একেবারে প্রত্যক্ষ আর কোন ক্ষেত্রে, যেমন সুনামির ব্যাপারে তা পরোক্ষ। পরিবেশ-বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত সতর্কবাণী দিয়ে চলেছেন যে বাতাসের ও সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা একই সাথে বিপদ-সীমার বাইরে চলে যাওয়ার ফলে এইসব দুর্যোগের শক্তি ও মারণ-ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। যার পরিচয় আমরা পেতে শুরু করেছি। কিছুদিন আগে ভারতের পূর্বাঞ্চলে ‘আম-ফান’ নামের সাইক্লোনের নজিরবিহীন বিধ্বংসী ক্ষমতা এই পূর্বাভাষের পরিচায়ক।
বহু বছর ধরেই পরিবেশ-বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর উষ্ণায়নের প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ-বৃদ্ধি। কার্বন ডাই-অক্সাইড একটা গন্ধহীন গ্যাস, যাকে চোখে দেখা যায় না। সূর্যের বিকিরণের সঙ্গে যে তাপ পৃথিবীর বুকে এসে আছড়ে পড়ে তার অধিকাংশই প্রতিফলিত হয়ে মহাকাশে বিলীন হয়। কিন্তু কার্বন ডাই-অক্সাইডের একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। তা হল প্রতিফলিত তাপের বেশ কিছু পরিমাণ ধরে রাখা ও তা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর মাটির দিকে ছুঁড়ে দেওয়া। আর তার ফলে পৃথিবীর আবহাওয়া বা বাতাসের তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এই প্রক্রিয়া ‘গ্রীন-হাউস এফেক্ট’ বলে পরিচিত।
বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণ প্রধানত দুটো। এক-- নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা, ও দুই -- ফসিল ফুয়েল জ্বালানীর ব্যবহার ক্রমশ বেড়ে যাওয়া।
কার্বন ডাই-অক্সাইড মানুষ বা অন্য জীবের পক্ষে ক্ষতিকর, কিন্তু গাছপালা আবহাওয়া থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে আলোক-সংশ্লেষণ বা ফটো-সিনথেসিস প্রক্রিয়ায় নিজেদের খাদ্য তৈরি করে। এইভাবে গাছপালা আমাদের ‘কার্বন ডাই-অক্সাইড পয়সনিং’-এর হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে সেই শুষে নেওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে গাছরা যে খাবার তৈরি করে তার সাধারণ নাম কার্বোহাইড্রেট বা ‘সুগার’। যদিও মনে রাখা দরকার যে সুগার নানা ধরনের হয়। এদিকে কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে গাছের তৈরি সেই কার্বোহাইড্রেট আবার মানুষের ও জীব জগতের সবাইয়ের বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যিক। তাই আমরা গাছের তরি-তরকারি, ফল-মূল, পাতা, কাণ্ড খেয়ে আমাদের সেই প্রয়োজন মেটাই।
কার্বোহাইড্রেট-এর মধ্যে আছে কার্বন নামের এক পরমাণু বা অ্যাটম। আর তার ফলে গাছপালা, মানুষ ও জীবজগতের সবাইয়ের শরীরই কার্বন দিয়ে তৈরি, অথবা বলা যায় আমরা সবাই কার্বনের-খনি বা কার্বন-রিপোজিটরি। আর তাই প্রাগৈতিহাসিক যুগের জীবজন্তু, গাছপালা মাটির তলায় হাজার হাজার বছর চাপা পড়ে থাকার পর তার থেকে তৈরি হয় জীবাশ্ম জ্বালানী বা ফসিল ফুয়েল - কয়লা ও জ্বালানী তেল। আর এক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় মিথেন বা ন্যাচারাল গ্যাস, যা মাটির তলায় আটকে থাকে। এদের সবায়েরই প্রধান উপাদান কার্বন।
মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম উপাদান হচ্ছে জ্বালানী বা ফুয়েল, যার প্রয়োজন বড় বড় ফ্যাক্টরি থেকে পরিবহনের জন্য এয়ারপ্লেন থেকে ট্রেন, বাস ইত্যাদি চালানো। আবার বাড়িতে রান্না করা থেকে বাড়িঘর, অফিস-কাছারি উত্তপ্ত (বা ঠান্ডা) রাখার জন্যও প্রয়োজন জ্বালানী। আর সেই জ্বালানী অর্থাৎ কয়লা, জ্বালানী তেল ও ন্যাচারাল গ্যাস জ্বালানোর ফলে কার্বনের সাথে বাতাসের অক্সিজেন মিশে তৈরি হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, যা সারা পৃথিবীর উষ্ণায়নে সাহায্য করছে। অর্থাৎ যে গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড টেনে নিয়ে জীবজগৎ বাঁচিয়ে রেখেছে, তারই জীবাশ্ম থেকে তৈরি কয়লা, তেল, গ্যাস পুড়িয়ে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে, আর ফল হিসাবে সারা পৃথিবী প্রয়োজনের থেকে বেশি উষ্ণ হয়ে পড়ছে। একে বলে এক ‘ভিশিয়াস সাইকল’ বা ‘অত্যন্ত ক্ষতিকর ও দূষিত বৃত্ত’। সঙ্গের কার্টুনে এটা তুলে ধরা হয়েছে।
কী ভাবে এই ভয়ংকর চক্র থেকে বাঁচা যায়? একটা মস্ত বড় উপায় জীবাশ্ম জ্বালানী কম ব্যবহার করা। আর তার জন্য আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত – আমাদের চাহিদা কমানো। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম ফসল হিসাবে আমরা ‘সব কিছু’ পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই মানসিকতা থেকে সরে আসা কি সম্ভব? কিন্তু, তাহলে কি সভ্যতার অগ্রগতির গতি কমে যাবে? এর কোন সহজ উত্তর নেই। কিন্তু, কিছু প্রাথমিক উপায় আছে। (আর সাম্প্রতিক কোভিদ-১৯ জনিত যেরকম পরিবর্তন স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বিভিন্ন দেশকে করতে হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে কিছু 'বৈপ্লবিক' পরিবর্তন সম্ভব হলেও হতে পারে। কিন্তু আপাতত আমাদের আলোচনা থেকে কোভিদ-১৯ কে সরিয়ে রাখি।) ফসিল ফুয়েল জ্বালানোর অন্যতম কারণ তার থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। আর সেই বিদ্যুৎ যদি ফসিল ফুয়েল না জ্বালিয়ে উৎপাদন করা যায়, তাহলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়বে না, আর তার ফলে বলগা-ছাড়া উষ্ণায়ন কমবে ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা ও তার মারণ ক্ষমতাও কমবে। আর এর জন্যই বর্তমানে সূর্যের আলো, বায়ুর গতি ও জলের স্রোত কাজে লাগিয়ে তার থেকে সোলার, উইন্ড ও হাইড্রো-ইলেক্ট্রিসিটি উৎপাদন করার প্রক্রিয়া জোরদমে শুরু হয়েছে।
পৃথিবীর উষ্ণায়নের গতি কমানোর আর এক উপায় হল নতুন গাছ লাগানো যাতে তারা বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিতে পারে ও তার ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে বিকিরীত তাপ বা রিফ্লেকেটেড হিট-এর পরিমাণ কমে যায়। অনর্থক গাছ না কেটে ফেললেও একই লাভ হবে। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা ভাল যে বৃক্ষরোপণ ও অনাবশ্যক গাছ না কেটে ফেলে প্রকৃতি-বান্ধব হওয়ার ভাবনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এর সঙ্গে পৃথিবীর উষ্ণায়নের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া অপেক্ষাকৃত নতুন।
এই প্রসঙ্গে এবার একটা ব্যক্তিগত উদ্যোগ বা ‘পারসোনাল জার্নি-র কথা বলা প্রয়োজন। আমি সব দিক থেকেই যথার্থ একজন ট্রি-হাগার। গাছ বাঁচালে পরিবেশ বাঁচবে সেই দৃঢ় বিশ্বাস আমার আছে। আমার এই প্রচেষ্টার জন্য কটূক্তিও শুনতে হয় মাঝে মাঝে। “‘একা কুম্ভ রক্ষা করে নকল বুঁদির গড়’-এর মত তুমি একা এই বিপর্যয় ঠেকাতে পারবে?”--ইত্যাদি। কিন্তু আমি তাতে বিন্দুমাত্র দমে যাই নি। তবে ট্রি-হাগার হলে যে কোন সমস্যা হতে পারে সেই ব্যাপারটা এল বেশ একটু অভাবিত ভাবেই।
সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফোনে একটা টেক্সট মেসেজ পেলাম - রবার্ট সন্ধ্যেবেলায় আসতে চায়। ও এক সোলার এনার্জি সেলসম্যান। আমার সাথে আগে কথা হয়েছে। আমার বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল লাগানোর ব্যাপারে সে সবকিছু ফাইনাল করতে চায়।
ল্যাপটপ আর একটা ফোল্ডার হাতে নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে রবার্ট এসে হাজির। আমাকে কাস্টমার হিসাবে পেতে ওকে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। আমি প্রথম থেকেই সোলার এনার্জি নিয়ে প্রচণ্ড উত্সাহী। বিদ্যুতের জোগাড় করতে কত ফসিল ফুয়েল পোড়াতে হয়, কত কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ু-দূষণ করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং সৃষ্টি করে। আর সোলার প্যানেল থাকলে ‘ডার্টি’ ইলেকট্রিসিটির ব্যবহার অনেক কমিয়ে দেওয়া যায়। একেবারে শেষ হয়ে যায়। কমে যায় কত ‘কার্বন ফুটপ্রিন্ট’! আমার মত পরিবেশ-বান্ধবের আহ্লাদের আর শেষ নেই।
আমি এই সব ভাবছি আর মনে-মনে পুলকিত হচ্ছি, এমন সময় রবার্ট তার ল্যাপটপ স্ক্রীনের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানালো যে আমার বাড়ির দক্ষিণ দিকে বেশ কয়েকটা বিশাল লম্বা-লম্বা পাইন গাছ আছে। সেই গাছগুলো থাকার ফলে বাড়ির ছাদের ওপরে ছায়া পড়ছে, আর তার ফলে সৌর-বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশ কিছুটা কমে যাবে। ও আমার দিকে তাকিয়ে রইলো উত্তরের খোঁজে।
‘তুমি কি বলতে চাও যে আমার ওই গাছগুলো কেটে ফেলতে হবে?’
ও আমার ইকো-ফ্রেন্ডলিনেস সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল।
‘না, না, আমি সেরকম কিছু বলি নি। তবে ওগুলো না থাকলে তোমার সোলার ইলেক্ট্রিসিটির উত্পাদন বাড়বে।’
এ তো ভারী বিপদ। আমি সত্যি সত্যিই বেশ ধাঁধার মধ্যে পড়লাম। দেখে মনে হয় এই গাছগুলোর বয়স অনেক। কতো কতো বছর ধরে কতো পাখপাখালি, কাঠবিড়ালি এতে বাসা করেছে। কতো পুরনো দিনের সাক্ষী এই গাছগুলো। অকৃত্রিম পরিবেশের অংশ। আর আমি পরিবেশ-বান্ধব হয়ে এগুলোকে শেষ করার অনুমতি দেব! কী করি? তখনই মাথায় এসে গেল যে এত বড় বড় গাছ কাটার খরচ অনেক। সুতরাং খরচায় পোষাবে না। ব্যাস, সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। আমি ভারী খুশি।
রবার্ট যেন থট রিডিং করতে পারে। আমার মনের ভাব চট করে বুঝে নিয়ে বলল, ‘সোলার এনার্জি উত্পাদনের জন্য যদি গাছ কিছু কেটে ফেলতে হয় তাতে স্টেট থেকে ভর্তুকি পাওয়া যায়। সুতরাং তোমার গাছ কাটার খরচা নিয়ে চিন্তা বেশি করতে হবে না।’
ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান! আমি রবার্ট-এর কাছ থেকে একটু চিন্তা করার সময় চেয়ে নিয়ে ওকে বিদায় দিলাম। সেদিন রাতে ভালো ঘুম হয়নি।
অনেক কষ্টে ঘুম এল, আর আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম যে আমার বাড়ির চারদিকে ঘিরে রয়েছে এক ঘন জঙ্গল। আর সেখানে মস্ত মস্ত আর অদ্ভুতদর্শন ঘুমকাড়ানি নানান জন্তুজানোয়ার দাঁতে দাঁতে ঘিসঘিস আওয়াজ তুলে, লাল লাল চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে আর চাপা গলায় গর্জন করতে করতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। গাছ কাটবে? তুমি খালি পাখি আর কাঠবিড়ালীর কথা ভাবছো? আমরা আছি না? সবাই মিলে তোমায় একেবারে তুলোধোনা করে ছাড়ব। তখন পালাবে কোথায়? ঘামতে ঘামতে আমার ঘুমের একেবারে দফা গয়া।
কদিন বাদে আমার ছোট ছেলে বাড়িতে এসে মুশকিল আসান করল।
‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে যে তুমি ওই গাছগুলো কেটে ফেলার কথা চিন্তাও করতে পারলে? শ্যেম ওন ইয়্যু।’
আমার ছেলের বকাবকি আমার বৃক্ষবান্ধব ‘আমি’-কে ফিরিয়ে আনল। সত্যিই তো, এ আমি কী চিন্তা করছি! গাছ কাটব কোন আক্কেলে!
কিন্তু একটা চিন্তা আমি কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না - গাছ না হয় নাই কাটালাম। কিন্তু গাছগুলো কেটে ফেললে যে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন বেশ খানিকটা বাড়ত। তাতেও তো ‘ক্লীন এনার্জি’ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে আর কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমবে। আর তাতেও তো পরিবেশের উপকার হবে! তাহলে আমার কোন পথে যাওয়া ঠিক হবে? মনে এল বেশ কয়েক বছর আগে দেখা উইলিয়াম স্টাইরন লিখিত, অ্যালান পাকুলা পরিচালিত ও মেরিল স্ট্রিপ অভিনীত 'সোফি’স চয়েস' মুভিটার কথা যেখানে সোফি ইহুদি হয়েও পাকেচক্রে দুটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু সেই সৌভাগ্যেরও একদিন শেষ হয়। দুঃস্বপ্নের মতো মনে এল সেই অংশটার কথা, যেখানে নাত্সী সৈন্যরা এসেছে - সোফিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কাকে সে নাত্সী ঘাতকদের হাতে ছেড়ে দেবে চিরকালের জন্য - ছেলে না মেয়ে। আমার সামনেও একটা ‘চয়েস’ এসে হাজির। কোন পথে যাব?
অবশ্যই আমার মনের দ্বন্দ্ব সোফির ছেলে বাঁচবে না মেয়ে বাঁচবে ‘বাছাই-করার’ নির্মম দ্বন্দ্বের ধারে-কাছেও আসে না। তবে একটা উপলব্ধি মনে ছাপ রেখে গেল – জীবন একটা ‘ব্যালান্সিং অ্যাকট’, অনেকসময় যার পিছনে বৈজ্ঞানিক বা অবৈজ্ঞানিক কোন যুক্তিই খাটে না।
(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)