সকাল ছটা নাগাদ যে দলটা এই মফস্বল শহরের পার্কে হনহন করে হাঁটে তারা মোটামুটি বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর। মধ্যবিত্ত কথাটার ভেতর অনেকগুলো স্তর আছে, এরা সকলেই তার কোনো একটায়। আধঘণ্টা হাঁটার পর বেঞ্চিতে বসে আড্ডা চলে প্রায় সাতটা অবধি তারপর যে যার বাড়ি। এই বয়সে বলাই বাহুল্য বাড়িতে এদের অবস্থা অনেকটা পুরোনো আসবাবপত্রের মতো।
তাতে কী হয়েছে! আড্ডা কিন্তু রোজ জমে যায়। সেদিন শুরু হল এভাবে-–“আরে আজকাল ছেলে-ছোকরাগুলো যেভাবে মোটরসাইকেল চালায়... এই তো হাইওয়েতে ছেলেটা সোজা ধাক্কা মারল গাছে। পেছনে ট্রাকটা তাকে বাঁচাতে গিয়ে মারল লাইট-পোস্টে। তিনঘণ্টা রাস্তা বন্ধ ছিল...”
“তা ছেলেটার কী হল?”
“বেঁচে গেছে, কিন্তু ট্রাকের খালাসিটা গেছে বোধহয়..”
হাইওয়ে আর ট্রাকের দুর্ঘটনা শুনলেই কুঞ্জমোহনের স্মৃতিতে কীরকম যেন একটা সুড়সুড়ি লাগে। কুঞ্জবাবু শুরু করলেন, “ওঃ, সেবার যা হয়েছিল! তখন বর্ষাকাল, সকাল থেকে বৃষ্টি। হাইওয়ের দিকে যাচ্ছিলাম ...”
একজন বললেন, “এই আবার শুরু হল...”। কয়েকজন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আসলে এই নিয়ে কুঞ্জমোহনের গল্পটা বার চারেক শোনা হয়ে গেছে সকলের।
“হ্যাঁ, যাচ্ছিল একটা মাছভর্তি লরি কোলকাতার দিকে, এমন সময় ভীষণ শব্দ হল একটা ... দেখি লরি উল্টে গেছে! আর সে কী বলব, যারা আশেপাশে ছিল সবাই ছুটল। আমিও। সে এক আজব দৃশ্য! লরি শুয়ে আছে পাশ ফিরে। একটা চাকা তখনও ঘুরছে। আর গোটা কয়েক মাছের ঝুড়ি মাটিতে আছড়ে পড়েছে। সে কী বলব, রুই, কাতলা, পার্শে, মাগুর, কই সব রাস্তায়। যে যা পারছে তুলছে। খবর চলে গেছে চারিদিকে, লোকজন ছুটে আসছে...
“আমি তো আজেবাজে জিনিস নেব না ... হুঁ হুঁ... সোজা দু-দুটো ইলিশ তুললাম। তা এক কিলোর বেশিই হবে এক-একটা। কী করে নেব ... ছাতাটা বন্ধ করে তার ভেতর ভরে নিলাম। জোরে বৃষ্টি এসেছে, আরে ভিজলে কী আর যায় আসে ...
“হ্যাঁ, যাবার আগে চার-চারটে পার্শে পোনা পাঞ্জাবীর পকেটে চালান করলাম...
“বাড়িতে গিয়ে গিন্নীকে বললাম – দেখো কী এনেছি... ইলিশ-ভাপা, ইলিশের ঝাল আর কালোজিরে দিয়ে স্রেফ একটা ঝোল; বাঁচলে ভাজা কোরো... আর পার্শেটা কড়া করে ভেজে রাখো, কাল হবে। ব্যাপার দেখে গিন্নী যা খুশি না কী বলব ... বলে কী করে এমন জিনিস আনলে গো!!”
একজন চোখ সরু করে বললেন, “কতবার এই একই গল্প শোনাবেন? অন্যকিছু তো বলতে পারেন...”
আর একজন বললেন “বাড়িতে তো ফ্রীজ নেই আপনার ...”
থতমত খেয়ে কুঞ্জ বললেন “না, তবে ছেলে কিনেছে একটা; ওর বাড়িতে আছে ...”
“অত মাছ পচে যায় নি? গল্পটা কিন্তু পচে গেছে, রোজরোজ পচা মাছ খেলে অসুখে পড়ে যাব মশায়--” নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন, সঙ্গে আরও কয়েক জন।
কুঞ্জবাবু মাথা নিচু করে বসে রইলেন। আড্ডা শেষ হয়ে গেছে কিছুক্ষণ, কুঞ্জবাবু ওঠেননি। আজকে এদের প্রতিক্রিয়াটা বড় আঁতে লেগেছে। পাশে ধীরেন সাহা, ইনি কুঞ্জবাবুর অনেক দিনের চেনা। বললেন “কুঞ্জ, তুমি এ গল্পটাই বারবার কেন বলতে যাও বলো তো, দেখলে তো কী ঠাট্টাটাই না করে গেল ওরা ...”
কুঞ্জবাবু ফুল-না-হওয়া রাধাচূড়া গাছটার দিকে খানিক চেয়ে থেকে বললেন, “আমার যে আর কোনো গল্প বলার নেই ভাই। যা মনে পড়ে তা সব অভাব-অনটনের ছবি। এখনো তাই-ই চলছে। ছেলেটা ভালো চাকরি পেয়ে বিয়ে করে আলাদা হয়ে চলে গেল--যাক, ও ভালো থাকলেই ভালো। পরিবারকে কোনোদিন তো তেমন কিছু দিতে পারিনি... ওই একটা দিনই ঘরে যা একটু খুশি আনতে পেরেছিলাম। তাই বারবার ওই মাছের দিনটাই মনে পড়ে ভাই, ওটাই বুক থেকে বেরিয়ে আসে আর আমিও বোকার মতো বলে ফেলি ...”
(এই সংখ্যায় অচিন্ত্য দাসের আরো একটি গল্পঃ 'কিউপিড')
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)