সকালে সুশান্ত অফিস চলে যাবার পর হঠাৎ করে অনেকখানি অবসর চলে আসে হাতে। এই সময়টাতে অবসরের সাথে অবসাদও থাকে খানিকটা। চা বানানো, একসাথে নাস্তা করা, নিজের হাতে লাঞ্চ তৈরি করে দেয়া, জুতায় কালি পলিশ করা—এইসব কাজ নাদিয়া নিজের হাতেই করে। কাজের লোকদের সুশান্তের কাছে ভিড়াটা ওর শাশুড়ির পছন্দ না। তাছাড়া সারাদিনের জন্য সুশান্ত অফিসে চলে গেলে বাড়িতে খুব একা লাগে নাদিয়ার। তাই সকাল বেলাটায় যতখানি সম্ভব বরের কাছাকাছি থাকতেই চেষ্টা করে সে।
তারপর সুশান্ত যখন ঘর থেকে বেরিয়ে বাই বলে, নাদিয়া মুখে কিচ্ছু বলে না। দরজার কাঠে গাল লাগিয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু। সিঁড়ি দিয়ে সুশান্ত নেমে যাবার পর নাদিয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বারান্দা থেকে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। যতক্ষণ গাড়িটা দেখা যায় ততক্ষণ তাকিয়ে থাকে লোহার রেলিংয়ে কপাল ঠেকিয়ে। এরপর আরো কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে থাকে। কান পেতে শোনে রাস্তায় গাড়ির হর্ন। ব্যস্ত রিক্সার টুংটাং শব্দ। দু’একটা কাকের ডাক। সবজিওয়ালা আর মুরগিওয়ালার হাঁকডাক।
আজ বৃহস্পতিবার। প্রতিদিনের মতো একই নিয়মে আজকেও সকালে সুশান্ত অফিস গেল। এখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে। বারান্দা থেকে সুশান্তের চলে যাওয়া দেখা শেষ হলে নাদিয়া ফিরে আসে বারান্দা-লাগোয়া শোবার ঘরে। রাতের বিছানায় ভালোবাসাবাসির পর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা চাদরটি তুলে নিল হাতে। চাদর ভাঁজ করতে গেলে টুপ্ করে মেঝেতে পড়ল থেঁতলানো বেলি ফুলের মালাগুলো। গতকাল সন্ধ্যায়ও যারা সতেজ সুঘ্রাণে সুরভিত করেছিল পুরোটা বেডরুম। বাসি মালাগুলো তুলে নাদিয়া ড্রেসিংটেবিলের উপর একটি সাদা ক্রিস্টালের বাটিতে রাখে। এখনো গন্ধ আছে বেলি ফুলের । নাদিয়ার মনের ভেতর যেমন এখনো লেগে আছে গতরাতের আদরের শিহরন। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় শাহবাগের ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়লে রাস্তার বাচ্চাগুলো দৌড়ে আসে দাঁড়িয়ে পড়া গাড়ির কাছে। গোলাপ ফুলের তোড়া আর বেলি ফুলের মালা ঝুলতে থাকে ওদের হাতে। “স্যার মালা নিবেন, আফার জন্য নেন স্যার…” সুশান্ত মাঝেমধ্যে মালা কিনে আনে নাদিয়ার জন্য। নাদিয়া ফুল খুব ভালোবাসে। মুখে কিছু না বললেও মিতভাষীর চোখের তারার মধ্যমণিটি উজ্জল হয়ে উঠে ভালোবাসার খুশিতে।
বেডরুমের পাশের এই বারান্দাটিতে নাদিয়ার লাগানো অনেকগুলো ফুল গাছের টব রয়েছে। সেগুলোতে রং-বেরঙের ফুল ফুটে থাকে সারা বছর। ভালোবাসার এই গাছগুলোর যত্ন-আত্তি করতে খুব ভালোবাসে নাদিয়া। গাছের চারা কিনে আনা, মাটি তৈরি করে গাছ লাগানো, সকাল বিকাল পানি দেয়া, গাছের পাতার তলায় পোকার আক্রমণ হলো কিনা তা অনুসন্ধান করা—সব কিছুই খুব যত্নের সাথে করে। বিয়ের বারো বছর পরেও নাদিয়া মা হয়নি। এই গাছগুলো ওর কাছে সন্তানের মতো।
সুশান্তর সাথে ওর বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিক পছন্দে। নাদিয়া তখন ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছে কেবল। রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছে। বান্ধবীরা সবাই ঠিক করে রেখেছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে একই সাবজেক্টে পড়বে। এমন সময় দূর সম্পর্কের এক মামা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল। ছেলের বাবা বিস্তর পয়সাওয়ালা। পুরানো ঢাকায় নিজেদের ব্যবসা, আবার কয়েকটি বাড়ি আছে। অর্থশীল শিল্পপতির একমাত্র পুত্র। ভবিষ্যতের জন্য কোনো চিন্তা নেই। শুধু একটাই অসামঞ্জস্যতা, নাদিয়ার তুলনায় ছেলের বয়স একটু বেশি। একটু বেশি মানে একটু বেশিই বেশি। আঠারো বছরের ব্যবধান। বিয়ের সময় নাদিয়া উনিশ আর সুশান্তর সাঁইত্রিশ। তবে স্বস্তির কথা এই যে সুশান্তকে দেখলে বয়স বুঝা যায় না।
বিয়েতে রাজি কি অরাজি সেটা পরিষ্কার করে উচ্চারণ করার আগেই একদিন খুব সাজগোজ করে মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেল নাদিয়ার। শ্বশুরবাড়িতে সবাই নতুন বৌকে ঘিরে অনেক উল্লাস করল। গান গাইল। ছন্দহীন এলোমেলো নাচল ছেলে বুড়ো হাত ধরাধরি করে। মেহেদীর গন্ধ। ভাঁজ ভাঙা শাড়ির খচখচ শব্দ। নাদিয়ার গা ভর্তি সোনার গহনারা দ্যুতি ছড়াতে থাকে সারা বাড়ি। পোলাও বিরিয়ানির বাদশাহী আমেজে মশগুল কেটে গেল কয়েকটি বছর। তারপর আস্তে আস্তে নাদিয়া প্রবেশ করে সত্যিকার বিবাহিত জীবনে। বরের কি লাগবে! শ্বশুর শাশুড়ির কি লাগবে! সকাল দুপুর কি কি রান্না হবে! কাজের লোকের দিকে চোখ রাখতে হবে যেন কাজে ফাঁকি না দেয়! এত্তোসব দায়িত্বের ভারে নুয়ে পড়তে থাকে মাত্র টিনেজ শেষ-করা সদ্য বিবাহিতা মেয়েটি। মধ্যাহ্নতাপে যেমন নেতিয়ে পড়ে সকালের সতেজ গাছগুলো।
—কিরে, এমন মন মরা থাকিস কেন তুই? আগে তো এমন ছিলি না।
—কই নাতো। মন মরা কই!
—হুম, টেলিফোনেই বুঝতে পারছি তোর মুড্ অফ। আজ সন্ধ্যায় পাবলিক লাইব্রেরিতে নতুন নাটক দেখাচ্ছে। আসবি?
—সন্ধ্যায়! মনটা লাফিয়ে উঠে বান্ধবীর কথা শুনে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ল আজ বৃহস্পতিবার। অফিসে কর্মচারীদের সাপ্তাহিক বেতন দিয়ে সুশান্ত বাড়ি ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে যায়। খুব টায়ার্ড থাকে। কোথাও যেতে চায় না। আর ওকে বাড়িতে রেখে বান্ধবীদের সাথে বাইরে থাকলে শাশুড়ি খুব খুশি হবে না। তাই মিথ্যে করে বলল, আজ সন্ধ্যায় বাসায় গেস্ট আসবে রে। আমি আজ পারব না। তোরা যা।
টেলিফোনটা রেখে খুব বেশিক্ষণ মন খারাপ করার সুযোগ পেল না যদিও। শাশুড়ি ডাকছেন। অলস পায়ে শাশুড়ির ঘরের দিকে যায় নাদিয়া। নিশ্চয়ই দুপুরের রান্নাবান্না কি হবে আজ তাই জানতে চাইবেন।
—মা, ডেকেছেন?
—না ডাকলে তো আর তোমার মুখ দেখা যায় না আজকাল, তাই ডেকেছি। একটা যদি ছেলে পুলে থাকত ঘরে, তার সাথেই তো কথা বলতাম আমি এই বুড়ো বয়সে।
নাদিয়া চুপ করে থাকে। বিয়ের এত বছর পরেও নাতিনাতনির মুখ দেখেননি এই কষ্টের কথা সারাক্ষণই জানান তিনি বিভিন্নভাবে। বোবার শত্রু নেই। নাদিয়াও অন্য দিকে তাকিয়ে মুখ বন্ধ করে থাকে এসব সময়।
—শোনো, আজ রাতে আমার ছোট বোন মিনু আসবে। সাথে মিনুর ছেলে আর ছেলের বৌও আসছে। আমি ওদেরকে রাতে খেতে বলেছি। তোমার হাতের চিতল মাছের কোফতাটা গতবার খুব পছন্দ করেছিল। ওটা করো আজ আবার।
—জি মা, করব। আর কি কি রান্না করব?
—তোমার যা ইচ্ছে, রান্না করো। সব কিছুই কি আমি বলে দিব নাকি? আমার বোন তার ছেলেকে নিয়ে আসবে। এটা মাথায় রেখো।
—আচ্ছা। মাথা নেড়ে নিজের ঘরে চলে আসে।
এবার কিছুক্ষণের জন্য নাদিয়ার একা থাকা। ঘন্টাখানেক পর রান্না ঘরে গেলেই হবে। নিজের ঘরে এসে ইজিচেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করল একটু। ভাবতে আজব লাগে, এই সংসারের প্রতি মানুষের এত মায়া জন্মায় কেন! টানটা আসলে কোথায়! কিসের জন্য মানুষ বেঁচে থাকে! বিয়ের আগের সেই প্রাণচঞ্চল দিনগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল গত একযুগে! ভাবতে ভাবতে চোখদুটো ঘুমে জড়িয়ে যায়। ঘুমের ভেতর ছোট্ট একটি স্বপ্নও দেখে ফেলল। খোলা আকাশের নিচে বিশাল এক মাঠে প্রকাণ্ড একটি গাছ। সবুজ পাতায় ভরে আছে পুরোটা গাছের আগাগোড়া। সেই গাছটিকে ঘিরে দৌড়াচ্ছে ছয় আর নয় বছরের দুটি বাচ্চা। নাদিয়া ও তার ছোট ভাইটি। তারা দৌড়ে দৌড়ে খেলছে। খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে অনেক দূর পর্যন্ত। গাছের ডালগুলো স্বপ্নের ভেতর নাদিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে শূন্যে ছুড়ে দিচ্ছে। আবার লুফে নিচ্ছে। বাস্তবে যে ভাইটিকে ছোটবেলায় খুব হিংসে করত সে। স্বপ্নে সেই ভাইটিকে খুব ভালোবাসছে ছোট্ট নাদিয়া। হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া ভাইয়ের জন্য কান্না করতে লাগল একটুপর।
স্বপ্নের কান্নার দোলে তন্দ্রা ভাঙল নাদিয়ার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল একঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। বারান্দায় এসে নিজের গাছগুলোকে একবার দেখে নিল। দোতলার গ্রিলের ফাঁকে নিচের উঠানে অলসভাবে চোখ বুলালো একবার। উঠোনের ঠিক মাঝখানে অনেক বছরের পুরোনো একটি সজনে গাছ। নাদিয়ার বিয়ের বছরে এই গাছটি ওর শ্বশুর লাগিয়েছিল নিজের হাতে। খুব প্রিয় এই গাছের সাথে নাদিয়া প্রায়ই কথা বলে। নিজের মনের কথা ফিসফিস করে গাছের কাছে বলে নিজেকে হালকা করেছে কতদিন! বন্ধুহীন এই পরিবারে, উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সজনে গাছটিকে পরম বন্ধু মনে হয় নাদিয়ার।
মায়ের ফোন পেয়ে সুশান্ত আজ অফিস থেকে আগেই বাড়ি ফিরেছে। গোসল করে ইস্ত্রি করা একটি ফতুয়া পরেছে। এখন মায়ের ঘরে বসে মায়ের সাথে গল্প করছে। গেস্টদের জন্য নাদিয়া অনেক কিছু রান্না করেছে আজ। পোলাও, রোস্ট, রেজালা, কাবাব, চিতলের কোফতা, পাবদার দোপেঁয়াজা, আরো অনেক আয়োজন। হালকা বেগুনি রঙের জমিনে সবুজ কাজ করা একটি তাঁতের শাড়ি পরে খোঁপায় লাগিয়েছে একগুচ্ছ তাজা রঙ্গন। নিজেকে গুছিয়ে রাখা ওর চিরকালের অভ্যাস। নতুন কেনা টেবিলক্লথ বিছিয়েছে আজ টেবিলে। বারান্দার টব থেকে তাজা ফুল কেটে এনে সাজিয়েছে ফুলদানিতে।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে মিনু খালা চলে আসলেন। ভীষণ আমুদে এই মিনু খালাকে নাদিয়ার খুব পছন্দ। যদিও মুখে বলেনি কোনোদিন, মনে মনে অনেকদিন ভেবেছে, মিনু খালা ওর শাশুড়ি হলে মন্দ হতো না।
মিনু খালা ঘরে পা দিয়েই নাদিয়াকে দেখে চিৎকার করে উঠলেন।
—আরে দিয়া, তুমি তো আরো সুন্দর হয়ে্ছ মা। কি সুন্দর মুখটি গো সোনা ময়নার।
বলেই একটি চুমু খান ওর কপালে। নাদিয়াকে তিনি আদর করে ডাকেন দিয়া।
ছেলের বৌকে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দিলেন। খালার ছেলেটি যেমন সুন্দর, বৌটিও তেমনি মিষ্টি। নাদিয়া তাকিয়ে দেখে দুজনকে। কি সুন্দর মানিয়েছে! মুখে কিছু বলতে পারে না। কি যেন এক দ্বিধা গলা আটকে ধরল। শুধু ভেজে রাখা স্প্রিং-রোলের প্লেটটি এগিয়ে দিল খালার দিকে।
কিছুক্ষণের ভেতর সন্ধ্যাটি মুখর হয়ে উঠল সবার প্রাণবন্ত হাসি কৌতুকে। নাদিয়ার খুব ভালো লাগতে থাকে। লক্ষ্য করল মিনু খালার হাতে দুটি নতুন বালা। ছেলে বিয়ের সময় মাকে বানিয়ে দিয়েছে। নাদিয়ার মনে হলো সেও যদি নিজের মাকে এমন দুটি বালা গড়িয়ে দিতে পারত!
—দিয়া তোমার শাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কি মিষ্টি রং, খুব মানিয়েছে তোমার গায়ে।
—থ্যাংক ইউ খালা।
নাদিয়ার গাল টিপে খালা বলেন, তুমি অবশ্য এমনিতেই খুব মিষ্টি। সব রংয়েই তোমাকে মানায়।
আড় চোখে নাদিয়া একবার তাকায় শাশুড়ি আর বরের দিকে। তাদের মুখের রেখার কোনো পরবর্তন হয় না। পোশাক বা সাজসজ্জা কিংবা অন্য কোনো কারণে নাদিয়ার দিকে বিশেষ করে তাকানোর কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না তারা অনেক বছর যাবত। ঘরের একেকটি পুরোনো আসবাবপত্রের মতোই মেয়েটি এখন ভীষণ সাদামাটা আর বিশেষত্বহীন এই সংসারে।
খাবার টেবিলে সবাই অনেকক্ষণ ধরে নাদিয়ার রান্নার প্রশংসা করল। মিনু খালার বৌমা নাদিয়ার হাতে রান্না করা কচি সজনে পাতার চচ্চড়িটি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছে। সবার এত্তো প্রশংসায় মুখ টিপে হাসে সুশান্ত। যেন সব কৃতিত্ব তারই। বলে, দেখতে হবে না কার বৌ!
হা হা হাসির রোল উঠল আবার ঘরে।
রাত বারোটার দিকে মিনু খালারা চলে গেলেন। সন্ধ্যা থেকে গমগম করতে থাকা বাড়িটিতে দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে নেমে আসে শুনশান নীরবতা। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতার ভেতর সবকিছু খুব ভারী অনুভূত হতে লাগল। নোংরা হাঁড়িপাতিলগুলো কাজের লোককে ধুতে দিয়ে নাদিয়া নিজের ঘরে চলে আসে। শাড়ি বদলে রাতের কাপড় পরে নিয়েছে। মুখে আর হাতে লোশন মাখতে মাখতে লক্ষ্য করল সুশান্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। হালকা নাক ডাকার শব্দও আসছে। সুশান্তের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে থাকে নাদিয়া। কেন যেন অচেনা লাগছে মুখটি। নাকি মানুষটিও অচেনা! নিজের বিয়ে করা স্বামী। এতগুলো বছর ধরে একসাথে সংসার সংসার খেলছে যে লোকটির সাথে, আচমকা এই মধ্যরাতে তাকে অজনবি মনে হচ্ছে কেন! সত্যি কতটুকু চেনে তারা একে অপরকে! চেনার প্রয়োজনও বোধ করেনি কখনো। শুধুই পাশাপাশি হেঁটে চলেছে দুজন যেন পথ চলতে হবে বলেই। আনন্দহীন। অর্থহীন। সুর ও সংগীত বিহীন। সম্পূর্ণ ভালোবাসাশূন্য দেনা-পাওনার চুক্তির মতো এক সামাজিক বন্ধন টেনে নিয়ে যাচ্ছে দুই মানব মানবীর পৃথক জীবন। আলাদা সত্ত্বা।
বাইরে চাঁদের আলোর ফিনকি ছুটেছে যেন। আজ পূর্ণিমা নাকি? নাদিয়া ভাবে। বারান্দায় গিয়ে গাছগুলোর পাশে একটু দাঁড়ায়। নিচে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সজনে গাছটার দিকে চোখ যায়। সাদা ফুলে ছেয়ে গিয়েছে গাছটা। জোছনার আলোয় অপার্থিব রূপ খেলে যাচ্ছে সজনের ফুলে। যেন উঠোনের মাটিতে বিছিয়ে আছে জোছনার জ্বলন্ত ফুল। দিনের বেলা গাছটার দিকে এমন করে চোখ যায়নি তো! নাদিয়ার কাছে চাঁদের আলোয় সজনের গাছটাকে এখন মানুষের মতো মনে হচ্ছে। একটি মেয়ে মানুষ। ফুল-ফল-ছায়া আর বিশুদ্ধ বাতাস দিয়ে চারপাশের সবাইকে পরিতৃপ্ত করে যাওয়া এক নারী বৃক্ষ। মধ্যরাতের নিঃশব্দতায় দরজা খুলে পা বাড়ায় নাদিয়া। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকা মানুষ নারী শান্ত পায়ে এগিয়ে যায় উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা নারী বৃক্ষটির কাছে। মমতায় জড়িয়ে ধরে থাকে গাছটিকে যেমন করে মানুষ শরীর মিলায় তার আত্মার সাথে।
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)