পম্পা কাছেই একটা সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ে। এই স্কুলে ছাত্র ছাত্রীরা প্রায় সবাই খুব নিম্নবিত্ত ঘরের। এখানে পড়ার চেয়ে ওই দুপুরের খাওয়ার জন্যই ভিড়টা বেশি হয়।
পম্পার বাবা, সন্তুর নির্দিষ্ট কোন বাঁধাধরা আয়ের ব্যবস্থা নেই। মায়েরও তাই। মা এক বাড়ীতে বাসন মাজার কাজ যদিও করে, তবে তাই দিয়ে আর কতটুকু হয়। বাকিটা নানাভাবে এটা সেটা উদয়াস্ত করে সংসারটায় জোড়াতালি দিতে হয়। তাও শতচ্ছিন্ন সংসারের একপাশের পর্দা টানতে গেলে আর এক পাশ হাঁ হাঁ করে।
সেদিন সকালে উঠে পিছন দিকের পুকুর ধারে উঁচু ইঁটের গাদাটার উপরে বসে উদাস ভাবে তাকিয়ে আছে সন্তু। খালি গায়ে, লুঙ্গিটাকে গুটিয়ে উঁচু করে পরে বসে তাকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু কিছু দেখছে কি না কে জানে। মাছরাঙা পাখিটা হঠাৎ ছোঁ মেরে একটা মাছ মুখে নিয়ে উড়ে গিয়ে পাশের বাঁশ গাছটার নীচু একটা কঞ্চিতে গিয়ে বসল। আপন মনে ও সেদিকে দেখছে ঠিকই, কিন্তু কিছুই যেন রেখাপাত করছে না সাদা কাগজের মত ফাঁকা মনটায়। সকালের উঠন্ত রোদটা কালো পিঠে পড়ে চকচক করছে জায়গাটা।
আসলে সন্তুর আজকে কোন কাজ নেই, তাই ভাবছে কোথায়, কোনদিকে যাবে আজ।কোথায় গেলে কিছু কাজ হতে পারে। রোজ তো আর কিছু কাজ থাকে না। আর সকাল থেকে যদি কোন দিন কাজ না থাকে, মেজাজটা কেমন যেন খিঁচড়ে থাকে। পুকুরে ঢিল পড়লে যেমন ঢেউটা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে, ওর মনটাও যেন সেরকম ছড়িয়ে পড়ছে, এক জায়গায় বসছে না।
পম্পা খিড়কি দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, বাবা পিছন ফিরে বসে আছে। ও চুপিচুপি গিয়ে বাবাকে চমকে দেবে ব'লে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে গিয়ে পিছন থেকে বাবার চোখ দুটো টিপে ধরল। চমকে উঠেই সন্তু বুঝে ফেলল, এটা মেয়ের কাজ। মেয়ের কাছে নিজের মনকে প্রকাশ না করতে চেয়ে, মজা করতে চাইল। হেসে বলল, কে রে?
মেয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, কে বলো তো?
সন্তু না বোঝার ভান করে রইল। মেয়ে চোখ ছেড়ে মুখটা সামনে এনে বাবার গলাটা জড়িয়ে ধরল এক মুখ হাসি নিয়ে।
গরীবের সংসারে এইটুকই আনন্দ। একমাত্র মেয়ে। মেয়ের মুখের হাসি যাতে এতটুকুও আঘাত না পায়, স্বামী স্ত্রীতে মিলে তাই চেষ্টা করে। মেয়েরও এখনও সাংসারিক জ্বালাযন্ত্রণা বোঝার বয়স হয় নি। সে আপন বিশাল সাম্রাজ্য নিয়ে আপনার আনন্দে থাকে। তার সাম্রাজ্যে কোন কিছুরই অভাব নেই। পুরানো বিবর্ণ একটা পুতুল, কিছু ছোট ছোট খেলনা হাঁড়িকুড়ি, একটা প্লাস্টিকের বল এইরকম আরও কিছু টুকিটাকি নিয়েই তার সংসার।
বাবার গলা জড়িয়ে ধরে, যেন বিরাট কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে এই ভাবে পম্পা বলে, এ বাবা তোমার মাথার চুল পেকে গেছে, তুমি বুড়ো হয়ে গেছ।
সন্তুও সমান তালে আশ্চর্যের মত বলে, তাই নাকি মা? জানি না তো।
পর মুহূর্তেই মেয়ে বলে, বাবা একটা জিনিস কিনে দেবে?
কথাটায় সন্তু একটু ছোট্ট করে ধাক্কা খেল, তবু মুখে তা' না প্রকাশ করে বলল, নিশ্চয়ই দেব। আমার রানি-মা চেয়েছে আর আমি দেব না?
কিন্তু যার দিন গুজরানের পয়সার জন্য, চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে তার পক্ষে এই ধাক্কা বা ভয়টা যে কী, তা একমাত্র সে- ই বুঝতে পারে। কী জানি কী চেয়ে বসবে, তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব কি না; যদি অসম্ভব হয় তাহলে মেয়ের মনে বা মুখে তার কি ছাপ পড়বে, সেটা ভেবেই সে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে।
তবু মুখে বলে, কী চাই বল মা।
পম্পা বলে, একটা চটি কিনে দেবে? আমার চটিটা কাল ছিঁড়ে গেছে।
পম্পা চটি পরে স্কুলে যায়। গতকাল স্কুলে যাওয়ার সময় ওর চটিটা ছিঁড়ে গেছে। ও চটিটা হাতে করে স্কুলে গেছে আবার এসেছেও।
--তাই নাকি। দেখি কেমন ছিঁড়েছে?
পম্পা দৌড়োয় বাড়ির ভিতরে। সন্তু ভাবে চটিটা ছিঁড়েছে অনেকদিনই, সেটা ও জানে। এর আগে বার দুয়েক সেলাই করা হয়েছে।
পম্পা চটিটা হাতে করে আনে। সন্তু দেখে দু-তিনবার ছেঁড়া সেলাই করা চটির পুরানো সেলাইয়ের জায়গাটাই আবার ছিঁড়েছে। সন্তু দেখে বলে, ইস, কী সেলাই করেছে। ব্যাটা আজকাল সব এমন হয়েছে না; পয়সা দিচ্ছি, ভাল করে সেলাই কর, তা নয়। এই ক'দিনেই আবার ছিঁড়ে গেল।
মনে মনে সন্তু জানে, মুচি সেলাই করার সময় বলেছিল, বাবু, এটা আর চলবে না। আপনি নতুন কিনে নেন। আমি করে দিচ্ছি কিন্তু বেশিদিন চলবে না।
তবু মুচির অসাক্ষাতে তার ঘাড়েই সমস্ত দোষটা দিয়ে নিজের অপারগতার দায়টা মনে মনে মুক্ত হতে চায়।
মুখে বলে, দাঁড়াও, কাল নিয়ে গিয়ে বলছি ওকে।বলব, খুব ভাল করে যদি সেলাই না করে দেয়, ওকে একটা পয়সাও দেব না।
পরদিন মুচির কাছে চটিটা নিয়ে যেতে, সে দেখেই চিনতে পারে। বলে, আমি আপনাকে বলেছিলাম, এ চটিতে সেলাই থাকবে না। আপনি নতুন নিয়ে নিন। এতে আমি আর সেলাই করব না।
সে জোর করতেও মুচি আর সেলাই করতে চাইল না।
সন্তু ছেঁড়া চটিটা নিয়ে বাড়ি ঢুকতেই পম্পা ছুটে আসে, বাবা এনেছ চটি?
--না, মা মুচি আসে নি। ওর জ্বর না কী হয়েছে। দেখছি আর দু-এক দিন।
এইটুকু মেয়েকে অহেতুক মিথ্যা বলতে তার জিভ জড়িয়ে আসে, তালু শুকনো হয়ে যায়। নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী লাগে। সে বাজারে খোঁজ করে এসেছে, এক জোড়া চটির দাম, কম করে ত্রিশ চল্লিশের নীচে হবে না। কিন্তু এখন যা টানাটানি চলছে তাতে এক সঙ্গে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বের করে এক জোড়া চটি কেনার মত বিলাসিতার সামর্থ্য নেই। মেয়েকে এটা বলেই বা কী করে।
মেয়ে রোজ স্কুলে যায় খালি পায়ে আর যেতে যেতে তাকায় বন্ধুদের পায়ের দিকে। সবারই, ভাল হোক আর মন্দই হোক চটি আছে। তার নেই। বন্ধুরা যখন বলে, পম্পা তোর চটি নেই কেন? পম্পা কোনদিন বলে, চটি পরে আসতে ভুলে গেছি। আবার কোনদিন বলে, মা যে কোথায় রেখেছে স্কুলে আসার সময় দেখতে পাই নি।
সেদিন, পম্পা স্কুল থেকে আসার সময় কিসে লেগে পা কেটে গেল খানিকটা। সন্তু, মেয়ের রক্ত দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারল না। মেয়ের পায়ে ওষুধ দিতে দিতে কেঁদে ফেলেছে। নিজের অপদার্থতায় নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল মনে মনে।
পম্পা হঠাৎ বাবাকে কেঁদে উঠতে দেখে নিজের যন্ত্রণা ভুলে বাবার চোখ মুছে দিতে যায়। বলে,
--বাবা, কাঁদছ কেন? দেখ আমি হাসছি। আমার কিচ্ছু লাগে নি।
শুনে সন্তু লজ্জা পেয়ে চোখ মুছে ওর সাথে হাসতে শুরু করে। বলে, মা আর এক মাস অপেক্ষা কর। এর মধ্যে যদি মুচি না আসে, আমি সুন্দর নতুন চটি এনে দেব তোমার জন্য। বাপ-মেয়ের হাসিতে ঘর ভরে ওঠে।
সন্তু স্থির করে, রোজ যে দুটাকা ও নিজের টিফিনের জন্য বরাদ্দ রাখে, তার থেকে যদি এক টাকা করে রোজ বাঁচায়, তাহলে এক মাসে প্রায় পুরো টাকাই জমে যাবে।
পরদিন থেকে কাউকে কিছু না বলে, নিজের টিফিন অর্ধেক করে দেয়। আর প্রতিদিনই একটা করে টাকা একটা ছোট ঘটে জমাতে থাকে।
এক মাস পরে দোকান থেকে সুন্দর একটা চটি কিনে সন্ধ্যাবেলা ও যখন ঘরে ঢোকে, পম্পা তখন ঘরের ভিতর খেলছিল। সন্তু ঘরে ঢুকে আদর করে ডাকে, পম্পি মা, কই গো, কোথায় গেলে। দেখ, তোমার জন্যে কি এনেছি।
পম্পা খেলা ফেলে দৌড়ে এসে বলে, কই, কী এনেছ বাবা?
সন্তু, মেয়ের হাতে নতুন প্যাকেটটা দিল।
মেয়ে, প্যাকেটটা হাতে নিয়ে, আর তর সইল না।সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেটটা খুলে চটি দেখে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে। দৌড়ে এসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বাবাকে চুমু খেয়ে ভরিয়ে দেয়। দৌড়ে যায় মায়ের কাছে চটিটা দেখানোর জন্য।
মা ব্যাপারটা বুঝে হাসি টিপে মিছিমিছি বলে, ভারি তো একটা চটি এনে দিয়েছে, তার জন্য এত আদর--
মেয়ে বলে, তোমাকে দেখতে হবে না। আমার বাবা আমাকে এনে দিয়েছে ব্যস।
বলতে বলতে চটিটা চেপে ধরে সেটাকেই চুমু খেতে খেতে ঘরের ভিতরে দৌড়োয়।
রাত্রে শুতে গিয়ে সন্তু দেখে বিছানায় পম্পি গভীর ঘুমে মগ্ন আর মাথায় বালিশের পাশে নতুন চটিজোড়া রয়েছে। আর তার একটি ছোট্ট নরম হাত চটি জোড়া জড়িয়ে রেখেছে। মুখে তার পবিত্র আনন্দের স্মিত হাসির ছাপ।
এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি আর আনন্দের শিহরণ খেলে যায় তার মুখে। মনটা ভরে ওঠে।সারা মাসের উপবাসের পরে পূজা শেষে ব্রতীর যে ব্রতপালনের তৃপ্তি হয়, সেই আনন্দের ধারায় স্নান করে সন্তু। তার দু-চোখ দিয়ে নিঃশব্দে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে।
ওদিকে পম্পা তখন পাড়ি দিচ্ছে নতুন চটি পায়ে হাল্লা কিংবা শুণ্ডির রূপকথার দেশে।
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)