Subscribe to Magazines




পরবাসে পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর
আরো লেখা




ISSN 1563-8685




একটি নিখুঁত হত্যা

গোয়েন্দা গল্প পড়বার নেশাটা অধীর বাগচীর ছোটবেলা থেকেই, রহস্যর গন্ধ পেলেই নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতেন অধীর। অ্যাডগার অ্যালান পো, কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি থেকে শরদিন্দু, সত্যজিৎ, নীহাররঞ্জন, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নারায়ণ সান্যাল কিছুই বাদ রাখেননি। তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব লাইব্রেরি, যেখানে ঠাঁই পেয়েছে শুধুমাত্র ডিটেকটিভ গল্প, উপন্যাস। বিদেশ থেকে নিয়মিত আনিয়েছেন রহস্য সংক্রান্ত ম্যাগাজিন। তার দ্বিতল বাড়ির একতলাটির বৈঠকখানা বাদে, সম্পূর্ণটাই লাইব্রেরির জন্য ব্যবহার করেন। বৈঠকখানাতেও বইয়ের অভাব নেই। সংসারে তিনি এবং তার স্ত্রী নন্দিতা ছাড়া কেউ নেই। একমাত্র পুত্র অনিন্দ্য চাকরিসূত্রে কানাডা নিবাসী।

অধীর বাগচীর সঙ্গে আমার পরিচয় ট্রেনের কামরায়, নিত্যযাত্রী হিসেবে সোদপুর থেকে শিয়ালদহ এই পথটুকু আঠেরো বছর ধরে এক কামরায় যাতায়াত করতে করতে কবে একসময় সহযাত্রীর গণ্ডি টপকে আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছি তা নিজেরাই জানি না। অধীর বাগচী বয়সে আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় হবেন, আমি ডাকি অধীরদা বলে, উনিও সৌজন্যবশত আমাকে অতনুদা বলেই ডাকেন। বহু উপরোধেও ওনার ডাক বদল করা যায়নি। আমরা দুজনেই যেহেতু খেলা দেখতে, নাটক দেখতে ভালবাসি, সেহেতু মেলামেশাটা ট্রেনের পরিধির বাইরে ছড়িয়ে পড়তেও সময় নেয়নি। কিন্তু আমাদের সবথেকে বড় নেশা হল দাবা আর গোয়েন্দা কাহিনী। অধীরদাকে গোয়েন্দা কাহিনীর এনসাইক্লোপিডিয়া বললেই সঙ্গত হয়।

ভদ্রলোক গত কুড়ি বছর ধরে কাজ করছেন কলকাতার একটি বিখ্যাত টিম্বার মার্চেন্ট অফিসে, তার আগে এই কোম্পানীর অধীনেই জঙ্গল ইজারা নিয়ে গাছ কাটা ও সরবরাহর কাজে সুদীর্ঘ ষোল বছর চষে ফেলেছেন উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে। অধীরদা বলেন ওখানকার আদিবাসীদের সঙ্গে যেভাবে মিশেছেন, যা অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেছেন তা অতুলনীয়। যখন মুডে থাকেন, তখন টুকরো টুকরো সেইসব গল্পে একেবারে মাতিয়ে দেন অধীরদা। কীভাবে একবার বুনো হাতির পাল্লায় পড়ে আসামের জঙ্গলে একটা গাছের ওপর সারারাত বসে প্রাণ রক্ষা করেছিলেন, বা মিজোরামের জঙ্গলে একটা লেপার্ডের সঙ্গে শুধুমাত্র গাছের ডাল হাতে লড়াই করেছিলেন সেসব রোমহর্ষক ঘটনা শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দেয়। একবার তো নাগাল্যান্ডে বড় বাঘের মারীর একবারে কাছে চলে গিয়েছিলেন, তখনও বাঘটা হরিণের সেই মারীতে ভোজন সারছে, অধীরদার ভাষায় সেটা যমের দুয়ার থেকে ফিরে আসার সমতুল্য।

গত রবিবার সন্ধ্যায় দাবার আসরে পরপর তিনটে ডেড গেমের একঘেয়েমিতে বিরক্ত হয়েই বোধহয় অধীরদা বললেন, চলুন অতনুদা ডাবলিন থেকে আসা রহস্য জার্নাল, ‘দ্য ইনভেস্টিগেটর’-এর একটা ইন্টারেস্টিং গল্প আপনাকে পড়ে শোনাই। আমি তো একপায়ে খাড়া, বললাম চলুন সেই ভালো। ঘটনার সূত্রপাত ইংল্যান্ডের কান্ট্রিসাইড সাসেক্সে। গত অগস্ট মাসের ২০ তারিখে সাসেক্সের ব্রাইটনের বাসিন্দা রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক গ্রাহাম ডিক্সনকে তার বসার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, ভদ্রলোক স্ত্রীর মৃত্যুর পর একাই বসবাস করতেন। সেদিন সকালে ডিক্সনের লন্ডনস্থিত সলিসিটর ফার্ম জেমস ম্যাকফারসন & কোং-এর তরুণ কর্মচারি নীল মর্গ্যান কিছু জরুরি কাগজপত্রে ডিক্সনকে সই করাবার জন্য সকাল ১০টা নাগাদ তার বাড়িতে আসেন, আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। ডিক্সনের বাড়িটি একটা কাঠা দশেকের সুসজ্জিত বাগানের একদম মধ্যিখানে অবস্থিত। বাগানের নিয়মিত যত্ন নেওয়া হয়, বাড়ির সামনের লনের ঘাস সুন্দর করে ছাঁটা। বোঝা যায় ডিক্সনের অবসরের অনেকটাই কেটে যায় তার বাগান চর্চায়। মর্গ্যান বাগানের গেট খুলে একটা নুড়ি পাথর বিছানো রাস্তা দিয়ে লন পেরিয়ে পৌঁছে যান বাড়ির বারান্দার সিঁড়িতে যার তিনধাপ পেরোলেই একটি বারান্দা, যেখানে রাখা রয়েছে দুটি বেতের চেয়ার আর একটা টেবিল। এই ধরনের বাড়িকে ইংল্যান্ডে কটেজ নামে অভিহিত করা হয়। যাইহোক মর্গ্যান প্রথমে কটেজের বেল বাজান, কিন্তু কিছুক্ষণ ধরে বেল বাজানোর পরে উত্তর না পেয়ে ডিক্সনের নাম ধরে ডাকাডাকি করেন, তাতেও সাড়া না পেয়ে পকেট থেকে মোবাইল বার করে ডিক্সনের মোবাইল এবং ল্যান্ড লাইন দুটো নম্বরেই ক্রমান্বয়ে ফোন করতে থাকেন, ফোন বাজতেই থাকে কেউ সাড়া দেয় না।

এই ধরনের কান্ট্রিসাইডে প্রতিবেশিদের থেকে ডিক্সনের কোন খবর পাওয়া যাবে, এটা ভাবাটা একটু বাড়াবাড়ি। মর্গ্যান প্রথমে কিছুক্ষণ বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করে, যদি গ্রাহাম ডিক্সন আশেপাশে কোথাও গিয়ে থাকেন। যদিও তার একটা সন্দেহ হচ্ছিল, সেক্ষেত্রে মোবাইল কেন বেজে যাবে! মিনিট চল্লিশেক অপেক্ষা করে মর্গ্যান তার অফিসে ফোন করে বিস্তারিত জানায়। অফিস থেকে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেওয়া হয়, পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে বাড়িতে ঢুকে দ্যাখে ডিক্সন সোফায় এলিয়ে পড়ে রয়েছেন, মৃত। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, যেটা ইয়েল লক সিস্টেমের দরজা বাইরে থেকে টেনে দিয়েও করা সম্ভব। বসার ঘরের ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকলে সেটা বাড়ির ভেতর দিকে একটি করিডরে পড়েছে। এই করিডরের ডানদিকে কিচেন, তারপর খানিকটা খোলা জায়গা। বাঁদিকে দুটো বেডরুম, দেখে মনে হয় যার একটা অব্যবহৃতই থাকে। ডিক্সনের শোওয়ার ঘরে বিছানা দেখে মনে হয় না তিনি সেখানে শুয়েছিলেন, শোওয়ার ঘরের একটি জানালা খোলা ছিল, যেখান থেকে সুন্দর বাগান চোখে পড়ে। করিডর গিয়ে শেষ হয়েছে খিড়কির দরজায়, যেটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। ডিক্সনের মৃত্যুর কারণ সাপের কামড়, তার বাম গোড়ালির ওপর সাপে কামড়ানোর দাগ পাওয়া যায়। পুলিশের অনুমান বাগানের দিকে খোলা জানলা দিয়ে সাপ ঢুকেছিল, এইসব জায়গায় সাপে কামড়ের মৃত্যু কম হলেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। পুলিশ ধারণা করলো ডিক্সন সম্ভবত সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন, কারণ তার পাশেই সোফাতে সেদিনের আধখোলা সংবাদপত্র পড়েছিল এবং মৃত্যু কখন তার পদতলে উপস্থিত হয়েছে তার কিছুই টের পাননি। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বিষক্রিয়ায় মৃত্যুকেই সমর্থন করলো। কিন্তু ঘটনার গতিপথ বদলে গেলো চোদ্দ দিন বাদে আসা ভিসেরা রিপোর্টে, সেখানে একটা অদ্ভুত তথ্য পাওয়া গেল যে-সাপের বিষে ডিক্সনের মৃত্যু হয়েছিল, তা এক ধরনের বোড়া জাতীয় সাপের বিষ যা প্রধানত ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া যায় এবং চীন ও থাইল্যান্ডেও কিছু কিছু পাওয়া যায়। সাসেক্সের কান্ট্রিসাইডে এরকম সাপের অবস্থানের কথা জানা যায় না। মৃত্যুর সময় বলা হল ১৯শে অগস্ট বিকেল ৩-৪ এর মধ্যে। নড়েচড়ে বসল ব্রিটিশ পুলিশ, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অভিজ্ঞ ইনসপেকটর মাইক ব্রিয়ারলি (ক্রিকেট অধিনায়ক নন) শুক্রবার ৫ই সেপ্টেম্বর তদন্ত ভার গ্রহণ করলেন।

মাইক প্রথমে তদন্তকারি অফিসারের প্রাথমিক অনুসন্ধান রিপোর্ট এবং পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট খুঁটিয়ে পড়লেন। সেরকম কোনো উল্লেখযোগ্য সূত্র খুঁজে পেলেন না। কোনো হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি, পুলিশ ফটোগ্রাফারের ছবিগুলো থেকে কিছু পেলেন না, কোথাও গল্পের মতন সিগারেটের টুকরো বা ছেঁড়া জামার বোতাম কিচ্ছু পাওয়া যায়নি। মাইক তারপর প্রতিবেশিদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, সকলেই বললেন ডিক্সন অতি সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন, সকলের সঙ্গেই সদ্ভাব বজায় রাখতেন, তবে খুব একটা মিশুকে ছিলেন না। ১৯ শে অগস্ট কেউ ডিক্সনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল কিনা, সে বিষয়ে প্রতিবেশিরা কিছু জানাতে পারলেন না। তবে একজন মধ্য তিরিশের মহিলা প্রায় প্রতি উইকএন্ডে আসতেন, এছাড়া তার এক ভাইপো আসতেন মাঝে মাঝেই, ডিক্সন নিঃসন্তান ছিলেন এবং সাসেক্সের কটেজে বাস করছেন বছরখানেকের কিছু বেশি সময় তার রিটায়ারমেন্টের পর থেকে, তার আগে থাকতেন নর্থ লন্ডনের এক ভাড়া করা ফ্ল্যাটে, যা তার স্কুলের কাছেই। সেইসময় সাসেক্সে আসতেন ছুটিছাটায়। সাসেক্সে আসার মাসখানেকের মধ্যেই ভদ্রলোকের পত্নী বিয়োগ হয়, মৃত্যুর কারণ হাই সুগার, তারপর থেকে ভদ্রলোক এখানে একাই থাকতেন। এতসব বিস্তারিত যদিও প্রতিবেশিরা জানাতে পারেননি, মাইক নিজস্ব সূত্র দিয়ে খোঁজখবর নিয়েছিলেন। ভাইপোর সন্ধান পাওয়া গেল, মি: রজার ডিক্সন, নর্থ লন্ডনের এই বাসিন্দা রীতিমতন ধনকুবের হীরক ব্যাবসায়ি। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রাহাম ডিক্সনের মৃত্যু হয়েছিল বিকেল ৩-৪-এর মধ্যে আর সেইসময় রজার তার অফিসেই একটা মিটিংএ ব্যস্ত ছিলেন, কয়েক ডজন সাক্ষী আছে, এছাড়া যদি এটিকে হত্যাকাণ্ড ধরে নেওয়া হয়, তাতে রজারের হত্যাকারি হওয়ার কোনো মোটিভ নেই। যদিও গ্রাহাম তার কটেজটি ভাইপোকেই দিয়ে গেছেন, কিন্তু ধনকুবের রজারের কাছে তা নস্যি, এইজন্য তার কাকাকে হত্যার কারণ অসঙ্গত মনে হয়। আর কাকা ভাইপোর সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ছিল, সপ্তাহান্তে তাদের ফোনে কথা হত এবং রজার জানালেন একমাস অন্তরই তিনি কাকার খোঁজ নিয়ে আসতেন এবং কাকাও তার কাছে লন্ডনে আসতেন। মধ্য তিরিশের মহিলার খবরও রজারের কাছে পাওয়া গেলো। মহিলার স্বামী মারা গেছেন, নাম জুলিয়া শেলডন, তিনি আদতে মধ্য চল্লিশের, দেখলে অনেক কম মনে হয়। উনি লন্ডনের একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্সে চাকরি করেন, সেখানেই গ্রাহামের সঙ্গে বছর পাঁচেক আগে তার পরিচয় এবং প্রেম, তখনও মিসেস ডিক্সন বেঁচে। কিন্তু তারা কখনও বিয়ে করবার কথা চিন্তা করেননি। ভদ্রমহিলা নাকি এইসব ঝামেলায় আর জড়াতে চাননি। প্রতি সপ্তাহান্ত তিনি সাসেক্সে গ্রাহামের সঙ্গে কাটিয়ে আসতেন, গত সপ্তাহেও গেছিলেন এবং গ্রাহামের আচরণে কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেননি, গ্রাহামের কোন শত্রু থাকার কথাও তিনি শোনেননি। গ্রাহামের মৃত্যুকালে জুলিয়া ডিউটিতে ছিলেন, সার্ভিস বুক তাই বলছে এবং সহকর্মীরা একই সাক্ষী দিচ্ছেন। ভদ্রমহিলা কিন্তু গ্রাহামের মৃত্যুতে প্রভূত উপকৃত হয়েছেন। একটা মোটা টাকা তার নামে উইল করা আছে, যদিও তিনি বলছেন তার কিছুই তিনি নাকি জানতেন না। মাইকের সেটা অস্বাভাবিক মনে হল। ষাটের কোঠা পেরোনো গ্রাহাম তার কুড়ি বছরের ছোট প্রেমিকাকে কিছু আভাস দেননি সেটা বেশ অস্বাভাবিক। তবু জুলিয়া এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বা পরোক্ষে মদত দিয়েছেন তার প্রমাণ নেই, মহিলা যেভাবে ভেঙে পড়েছেন তাতে খুব উঁচুদরের অভিনেত্রী না হলে উনি সত্যিই শোকার্ত। মাইক যদিও এইসব কান্নাকাটিতে গলবার লোক নন। তবুও তার মনে হয়েছিল হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার মত নার্ভ ভদ্রমহিলার নেই। রজারও তার কাকার প্রাণ নেওয়ার মতন কোনো শত্রুর খবর জানেন না, নীল মর্গ্যান যে কাগজপত্র সই করাতে এসেছিলেন, সে সম্বন্ধেও রজারের সম্যক ধারণা আছে, সেটা শেয়ার সংক্রান্ত বিনিয়োগের কাগজপত্র। গ্রাহাম অর্থনৈতিক বিষয়ে সবসময় ভাইপোর সঙ্গে আলোচনা করতেন। মাইক মনে মনে বললেন কেউ তো নিশ্চয়ই সেদিন গ্রাহাম ডিক্সনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, নয়তো যে সাপের বাসস্থান সাসেক্স নয় সে কোন ভোজবাজিতে এসে ডিক্সনকে কামড়ায়! মাইক ঠিক করলেন সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখবেন। সহকারী রবার্টসনকে ডেকে নির্দেশ দিলেন ২৪ ঘন্টা সাদা পোশাকের পুলিশ যাতে রজার এবং জুলিয়ার ওপরে নজর রাখে এবং এই দুজনের গত এক মাসের কল লিস্ট যেন খতিয়ে দেখা হয়। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আমার টেবিলে যেন রিপোর্ট পৌঁছে যায়, আর নীতির ধার ধেরো না রবার্টসন। রজার আর জুলিয়ার অফিসের ফোন, বাড়ির ফোন, মোবাইল সব ট্যাপ করে ফেল। শনি রবি স্কুল বন্ধ, সোমবার আমি লন্ডনের যে স্কুলে গ্রাহাম ডিক্সন চাকরি করতো সেখানে ঢুঁ মারতে চাই আর তার আগে রজার আর জুলিয়ার সব গতিবিধি যেন আমার নখদর্পণে থাকে।

সোমবার সকালে রবার্টসনের রিপোর্ট পেয়ে বিড়বিড় করে উঠলেন মাইক, “আবার সেই, উফ”। জুলিয়া শেলডন তলে তলে কাকা ভাইপো দুজনের সঙ্গেই প্রেম চালিয়ে যাচ্ছিলেন, রজার তার থেকে বয়সে বড় জুলিয়ার রূপে পাগল, এবং জুলিয়াকে বিয়ে করবার জন্য মরিয়া, কিন্তু গ্রাহামের জন্য সেটা পারছিলেন না। একটা চক্ষুলজ্জা কাজ করছিল, আর জুলিয়া রজারকে না ফেরালেও গ্রাহামের উপস্থিতিতে রজারকে বিয়ে করতে চাননি। পাঁচ বছর আগে যখন গ্রাহামের সঙ্গে তার পরিচয় হয় তখন তিনি সদ্য ডিভোর্সী, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত, সেই সময় গ্রাহাম তাকে সঙ্গ দেন এবং জুলিয়ার একমাত্র মেয়ের হস্টেলে থেকে পড়ার সব খরচও বহন করতেন। রজার আগে জুলিয়াকে চিনতেন না, মিসেস ডিক্সনের মৃত্যুর পর যখন জুলিয়া উইকএন্ডে সাসেক্সে আসতেন তখন একদিন সেখানে রজার উপস্থিত হলে তাদের আলাপ হয়। সেটা প্রায় ৯-১০ মাস আগের ঘটনা। বহু নারীসঙ্গ করা রজার প্রথম দর্শনেই জুলিয়ার প্রেমে পড়ে যান এবং কিছুদিন বাদেই বিয়ের প্রস্তাব দেন। শুক্র থেকে রবি জুলিয়া আর রজারের মধ্যে একাধিক বার ফোনে কথা হয়েছে, ফোন কল রেকর্ড থেকেই বেশিরভাগ তথ্য হাতে চলে এসেছে। গত একমাসের কল লিস্ট বলছে দুজনের মধ্যে নিয়মিত দীর্ঘ সময় ধরে ফোনালাপ চলে এবং নিয়মিত তাদের দেখাসাক্ষাৎ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই, কিন্তু এই তিনদিন তারা পরস্পরের সঙ্গে দেখা করেননি। মাইক মনে মনে ভাবে এটা কী এক ধরনের সতর্কতা? রবার্টসন এবার একটা টেপ চালু করে যেখানে গতকাল রাতে রজার জুলিয়াকে ফোনে বলছে পথের কাঁটা তো সরে গেছে আর অপেক্ষা কিসের? জুলিয়া উত্তরে বলছে এখন সবে গ্রাহাম মারা গেছেন এখনই এইসব ভালো দেখায় না, একটু সবুর করো ডার্লিং। রবার্টসন বললো অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বার করি স্যার? একটু স্পেশাল জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বেরিয়ে পড়বে। মাইক রবার্টসনকে থামালো, আমি ভাবছি চন্দ্রবোড়া। রবার্টসন মনে মনে ভাবে শালা পাগল নাকি! মাইক রবার্টসনের মনের ভাব বোধহয় বুঝতে পারে, বলে দাঁড়াও আজ স্কুলটা ঘুরে আসি। রবার্টসন মনে মনে বলে তুমি চাঁদ ওখানেই ভর্তি হয়ে যেও এদিকে আর এসো না। মুখে বললো হ্যাঁ স্যার সবটাই খতিয়ে দেখা উচিত।

মাইক এরপর গেলেন লন্ডনের সেই স্কুলে, যেখানে গ্রাহাম শিক্ষকতা করতেন। সেখানে জানা গেল বছর পঁচিশেক আগে উর্মিলা সরকার নামে একজন ভারতীয় শিক্ষিকা আত্মহত্যা করেন, মহিলা সন্তানসম্ভবা ছিলেন এবং সন্দেহের তীর ছিল গ্রাহাম ডিক্সনের দিকে, কারণ গ্রাহামের সঙ্গে উর্মিলার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। গ্রাহাম স্বীকার করে তার সঙ্গে উর্মিলার প্রেম ছিল কিন্তু সে সন্তানসম্ভবা ছিল তা তার জানা ছিল না। তিনি তো উর্মিলাকে বিয়ে করবেনই ভেবেছিলেন, সন্তানসম্ভবা জানলে তখনই বিয়ে করতেন। উর্মিলা কেন আত্মহত্যা করেছে সে বলতে পারবে না, শেষের দিকে নাকি উর্মিলা ডিপ্রেসনে ভুগছিলেন এবং গ্রাহামের সঙ্গেও দেখা করতে চাইতেন না। উর্মিলার বাবা, মা এবং দুই ভাই সেকথা মানতে চায়নি, তারা বলেন গ্রাহাম বিয়ে করতে অস্বীকার করায় উর্মিলা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, কারণ ভারতীয় সমাজে কুমারী মা খুব লজ্জার ব্যাপার। স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রথমে গ্রাহামকে সাসপেন্ড করলেও পরে কোর্টের রায়ে সে চাকরি ফিরে পায়। উর্মিলা কোনো সুইসাইড নোট জাতীয় কিছু লিখে যাননি, এছাড়াও এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যাতে মনে হয় গ্রাহাম এই আত্মহত্যার জন্য দায়ি। বছরখানেকের কিছু বেশি আগে গ্রাহাম চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

স্কুলের প্রবীণ প্রিন্সিপাল যিনি সেইসময় ছিলেন একজন নবীন শিক্ষক, মনে হল না তিনি গ্রাহামের মৃত্যুতে অখুশি হয়েছেন। পরিষ্কার বললেন তিনি মনে করেন উর্মিলার মৃত্যুর জন্য গ্রাহামই দায়ি এবং সাপের কামড়ে তার মৃত্যুতে তিনি বিন্দুমাত্র দু:খিত নন। মাইক নিজেও মনে মনে বিড়বিড় করে ওঠেন শালা আপদ বিদায় হয়েছে, পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে নেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিন্সিপালকে বলেন কর্তব্য বড় বালাই স্যার, কিছুই না অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে একটা রুটিন এনক্যোয়ারি। যদি অফিসে বলে দেন উর্মিলা দেবীর ঠিকানাটা দিতে, তবে উপকৃত হই। স্পষ্টতই বিরক্ত প্রিন্সিপাল ফোন তুলে নির্দেশ দিয়ে দিলেন।

রবার্টসনকে সঙ্গে নিয়ে মাইক সরকারদের লন্ডনের পুরোনো ঠিকানাতে গিয়ে দেখলেন সরকাররা এখনও সেখানেই বাস করছেন। সেদিনের কিশোর দুই সরকার ভাই অভিজিৎ এবং অভিষেক বর্তমানে চল্লিশোর্ধ যুবক। বাড়ির নিচেই তাদের মেডিসিন শপ অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই দুই ভাইকে পাওয়া গেল। দোকানের একজন কর্মচারিকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে মাইককে নিয়ে দুই ভাই বাড়িতে এল। অভিজিৎ, অভিষেকের বাবা মা দুজনেই জীবিত। মাইক আন্দাজ করল দুজনের বয়স আশি ছুঁইছুঁই হওয়া উচিত, সেই তুলনায় শরীর স্বাস্থ্য বেশ ভালো। বিশেষ করে মি: সরকার একদম টানটান চেহারার শক্তপোক্ত মানুষ। অভিজিৎ বললেন, বলুন অফিসার আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? মাইক তখন গ্রাহামের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে জানালেন যে এটা একটা রুটিন এনক্যোয়ারি, যেহেতু আপনার দিদি উর্মিলা দেবীর আত্মহত্যার ব্যাপারে গ্রাহামের নাম জড়িয়েছিল—-

মাঝপথেই মাইককে থামিয়ে দিলেন অভিজিৎ। বললেন সেহেতু ১৯ শে অগস্ট গ্রাহামের মৃত্যুর দিনে আমাদের কোনো অ্যালিবাই আছে কিনা সেটাই আপনি জানতে চান তো? না, নেই। কারণ আমাদের জানা ছিল না গ্রাহাম ডিক্সনকে সেদিন সাপে কামড়াবে আর অ্যালিবাই তৈরির জন্য আমরা দু’ভাই সিনেমার টিকিট কেটে তার ছেঁড়া টুকরো আপনার জন্য রেখে দেব। প্রসঙ্গক্রমে আপনাকে জানিয়ে রাখি কাকতালীয় ভাবে ১৯শে অগস্ট আমাদের দিদির মৃত্যু দিন, ওদিন আমরা দোকান খুলি না, বাড়িতেই চারজন মিলে স্মরণসভার আয়োজন করি। এইসব ভারতীয় রীতি আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন না অফিসার, আর গ্রাহামের মৃত্যুতে আমাদের বিন্দুমাত্র দু:খ নেই বরং রীতিমতন উল্লসিত। আপনিই প্রথম সুখবরটা দিলেন, তাই মা আপনাকে মিষ্টিমুখ না করিয়ে ছাড়বে না। আমরা বাঙালি ভারতীয় তো তাই বাঙলার বিখ্যাত মিষ্টি রসগোল্লা না খেয়ে যাবেন না। আর তো কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারব না অফিসার, পারলেও করতাম না বুঝেছেন নিশ্চয়ই। একটা জানোয়ার উচিত শাস্তি পেয়েছে। অ্যালিবাই নিয়ে যদি চাপাচাপি করেন তো বলব আমরা চারজনই আমাদের চারজনের অ্যালিবাই, সেটা আপনি মানতেও পারেন, নাও পারেন। নিন রসগোল্লা এসে গেছে, মিষ্টিমুখ করুন। মাইক দ্বিধা সত্ত্বেও আরো কথাবার্তা চালিয়ে যাবার জন্য মিষ্টি মুখে দিল, মনে মনে তারিফ করল এ বস্তু জীবনে চাখেনি। কফিও নিয়ে এলেন মিসেস সরকার। সেইসময় অভিষেক বলে উঠল, দাদা ভালো কথা সেদিন তুমি মায়ের রুটিন চেক আপের ব্যাপারে বিকেলে ড: মরিসকে ফোন করেছিলে না, পরে আমিও তো কথা বললাম আর সেটা ল্যান্ডলাইন থেকেই করেছিলে। এমনিতে মনে থাকার কথা নয় কিন্তু সেদিন দিদির স্মরণসভার পরে পরেই ফোনটা করেছিলে বলে মনে পড়ল। অভিজিৎ বলল হ্যাঁ মনে পড়েছে আর ফোনটা করেছিলাম ড: মরিসের মোবাইলেই। সুতরাং মি: মাইক ব্রিয়ারলি আপনি অফ স্টাম্পের বাইরের এই বলটা না ছেড়ে মরিসের মোবাইল চেক করতে পারেন, খোঁচা লাগলেও লেগে যেতে পারে। মনে হচ্ছে সময়টা ৩-৪ এর মধ্যেই হবে। একটু এদিক ওদিক হলেও সাসেক্স থেকে উড়ে এসে তো আর আমাদের পক্ষে ল্যান্ডলাইন থেকে মরিসের মোবাইলে ফোন করে অ্যালিবাই তৈরি রাখা সম্ভব নয়। দ্রুততম ট্রেনেও সাসেক্সের ব্রাইটন স্টেশন থেকে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে আসতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে, সম্ভবত গ্রাহামের কটেজ প্ল্যাটফর্মে অবস্থিত নয়, সুতরাং আরো সময় লাগার কথা। সরকার ভাইদের সপ্রতিভতায় রীতিমতন বিব্রত বোধ করতে থাকেন মাইক। মাইক বললেন তাহলে উঠি, রসগোল্লার জন্য অনেক ধন্যবাদ আর একটা কথা, অভিজিৎ, অভিষেক আপনারা কি ব্যবসার কারণে বা অন্য কোনো কারণে মাঝে মাঝেই সাসেক্স যান? সরকার ভাইরা জানালো তারা সাসেক্স আগে গেলেও নিয়মিত যাওয়ার প্রশ্ন নেই, সেখানে তাদের ব্যবসায়িক যোগাযোগ নেই। সারাক্ষণ একটাও কথা বলেননি সিনিয়র সরকার, এবার তিনি বললেন অফিসার আমার ছেলেদের কথায় কিছু মনে করবেন না, ওদের মানসিক অবস্থা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন। মাথা নেড়ে ড: মরিসের মোবাইল নম্বর লিখে নিয়ে উঠে পড়ে মাইক, জানিয়ে যায় প্রয়োজনে আবার আসবে। ফেরার সময় গাড়িতে রবার্টসন বলল, স্যার আমার ধারণা সরকার ভাইরা সত্যি কথাই বলছেন, ওনাদের অ্যালিবাই অত্যন্ত জোরালো। মাইক বলল আমারও তাই মনে হয়, তবু ড: মরিসের সঙ্গে কথা বলে একবার অ্যালিবাইটা চেক করা দরকার, আমি জানি রজারকে বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ করবার জন্য তোমার হাত নিশপিশ করছে, তবু একটু অপেক্ষা করো। রবার্টসন একমুখ হেসে মাথা নাড়ল, মনে মনে বলল শালা হারামি।

মরিসের সঙ্গে ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে পরের দিন বিকেলে তার চেম্বারে পৌঁছে গেল মাইক আর রবার্টসন। ডাক্তার সব শুনে বললেন যদিও সপ্তাহ তিনেক আগের ঘটনা তবু মনে আছে কারণ অভিজিৎ বাবু দু’দিন আগে ১৯ শে অগস্ট মাকে রুটিন চেক আপ করাবার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেন, সেদিন সন্ধ্যার সময় ওনাদের আসার কথা ছিল, কিন্তু অভিজিৎ বিকেলে ফোন করে জানান সেদিন তাদের দিদির মৃত্যুদিবস বলে আসতে পারবেন না, তার বদলে তারা ২১ তারিখ একই সময় অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে চান। মরিস সম্মতি দিলে তিনি বলেন তার ভাই অভিষেক কথা বলবেন, অভিষেক লাইন ধরে জিজ্ঞাসা করেন এই দু’দিন তার মা একই ওষুধ খাবেন নাকি? মরিস তাকে হ্যাঁ বললে লাইন কেটে দেন। কল লিস্ট দেখে মরিস জানালেন অভিজিৎ তাকে ফোন করেছিলেন বিকেল তিনটে নাগাদ। মিসেস সরকার মরিসের নিয়মিত পেশেন্ট, তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী। প্রায় বছর পাঁচেক প্রতি মাসে মরিস তাকে চেক আপ করেন এবং অভিজিৎ ও অভিষেককে ভালো ভাবেই চেনেন। মাইক প্রশ্ন করলেন আচ্ছা ডাক্তার, অভিষেকই কী সবসময় তার মায়ের ওষুধের বিষয়টা আপনার থেকে বুঝে নেন? মরিস জানালেন, সেরকম কোনো ব্যাপার নেই, সরকার ভাইরা দুজনেই সুবিধামতন ওষুধের ব্যাপারটা বুঝে নেন, যে ভাই যেদিন মাকে নিয়ে আসেন, তিনিই বুঝে নেন। ডাক্তার ভালো ভাবে মনে করে দেখুন ফোনে কোনো শব্দ পেয়েছিলেন? জিজ্ঞাসা করলেন মাইক, মরিস না বললেন। মরিসকে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে পড়লো মাইক, আর কিছু জানার নেই। মগজে টরে-টক্কাটা মাইকের দ্রুত হচ্ছে, কী যেন একটা সন্দেহ, ধরা যাচ্ছে না! জুলিয়ার শোকার্ত হবার নাটকটা বেশ জোরদার ছিল বলেই মনে হচ্ছে। রজারকে বিয়ে করলে প্রচুর বৈভবের মালিক হতে পারেন, কিন্তু গ্রাহামের সম্পতিও ছাড়তে চাননি। আর রজার কি শুধু জুলিয়াকেই চায়? না আরো কিছু আছে! মাইক ভাবল এই শালার চাকরিটাই ছেড়ে দেবে, এই সবেতেই সন্দেহ করার বাতিক দেখেই তো ওর বউ লিলি ওকে বুড়ো ছুঁচো বলে ডাকে। যদিও লিলি কেন ওকে বুড়ো ছুঁচো বলে তা জিজ্ঞাসা করবার সাহস মাইকের কোনোদিনই হবে না, আর ছুঁচোরা বুড়ো হলে সন্দেহপ্রবণ হয় কিনা সেই বিষয়েও মাইকের স্পষ্ট ধারণা নেই।

মাইক, রবার্টসনকে নির্দেশ দিলেন যাতে রজার আর জুলিয়ার ওপর ২৪ ঘন্টা নজর রাখা হয়, তবে সেটা যেন তারা কোনোমতেই বুঝতে না পারে। রবার্টসন বলল স্যার, রজারের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট চেক করা দরকার। মাইক বললেন করতে পার, তবে মনে হয় না রজার খুনীকে চেকে পেমেন্ট করবেন।

তার থেকে তুমি সরকার অ্যান্ড সরকার মেডিকেয়ারের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্টটা চেক করো। রবার্টসন তিন ঘন্টা বাদে নিজের টিপ্পনি সহ যখন তার টেবিলে রিপোর্ট ফেলে দিল তখন মাইকের আবার বিড়বিড়ানি শুরু হল। (a +b) না (a-b) square? ওষুধ ব্যাবসার কতটুকুই বা জানি! রবার্টসনকে বলল পরপর ওষুধ কোম্পানিগুলোকে ফোন লাগাতে, শুরু হল কয়েক ঘন্টার ম্যারাথন ফোনালাপ। পুরোপুরি সন্তুষ্ট হবার পর এক কাপ কফির কথা বলে শরীরটা চেয়ারে হেলিয়ে দিল মাইক আর কানের কাছে কে যেন গুনগুন করতে লাগলো বুড়ো ছুঁচো, বুড়ো ছুঁচো। না চাকরিটা ছেড়েই দেবে মাইক, বরং অবসর নিয়ে কবিতা লিখবে। কবি হতে খুব শখ মাইকের, যদিও এখনও একটাও লিখে উঠতে পারেনি, তবে হয়ে যাবে, অন্ত্যমিল নিয়ে তো আজকাল খুবই চিন্তা করছে, গতকালই ভাবছিল লিলিকে লিখবে,

তুমি আমার চাঁদ,
পেতেছ মরণ ফাঁদ,
নদীতে দেব বাঁধ।

বেশ ভালোই হচ্ছে মনে হল, তবে সাহসে কুলোলো না বলে আর লেখা হল না। যাক কবিতা এখন থাক, চলো মন পানসি ভাসাও। আবার সরকার বাড়ি। পরের দিন সকালে রবার্টসনকে সঙ্গে নিয়ে যখন সরকার ভিলায় বেল বাজালেন মাইক তখন ঘড়ির কাঁটা সাতটা ছুঁই ছুঁই। দরজা খুললেন মিসেস সরকার, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একটু চেয়ে থেকে বললেন ছেলেরা এখনও ঘুমোচ্ছে, আপনারা বসুন আমি ডেকে দিচ্ছি। মিনিট দশেক বাদে ঘরে ঢুকল অভিজিৎ আর অভিষেক। রীতিমতন বিরক্ত, বলল অফিসার আপনাকে আগের দিনই বলেছি আর কোনো সাহায্য করতে পারব না, ড: মরিসের কাছ থেকে নিশ্চয়ই আমাদের অ্যালিবাই যাচাই করেছেন আপনি। মাইক বলল আপনারা বসুন। হ্যাঁ, অ্যালিবাই যাচাই করেছি, খুবই সুদৃঢ় অ্যালিবাই।

আর এটাও বুঝেছি অফ স্টাম্পের বাইরের বল সব সময় ছেড়েই দেওয়া ভালো। নয়তো খোঁচা লেগে যেতেই পারে। অভিষেক বললেন হেঁয়ালি রাখুন অফিসার, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আপনার প্রলাপ শোনার ইচ্ছা আমাদের নেই।

মাইক বললেন বেশ তবে হেঁয়ালি থাকুক। বলছিলাম একটা টেপ রেকর্ডার কি আপনাদের কাছে হবে? মানে যেটা আপনারা ১৯ শে অগস্ট ব্যবহার করেছিলেন ড: মরিসকে ফোন করতে। তবে রবার্টসনের সুবিধা হত আপনাদের স্টেটমেন্ট রেকর্ড করতে, নাকি বলো রবার্টসন তোমারটাতেই কাজ চালাবে? আর সরকার বাবুরা সাপগুলো কি এই বাড়িতেই রাখেন? চন্দ্রবোড়া কিন্তু খুব বিপজ্জনক সাপ, যদিও আপনারা দক্ষ সাপুড়ে। অভিজিৎ গর্জে উঠলেন, অফিসার এটা আপনার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড নয়, আমাদের বৈঠকখানা, আপনার প্রলাপ শুনতে আমরা বাধ্য নই। মাইক বলল আমি কতটা প্রলাপ বকছি সেটা এখনই পরিষ্কার হয়ে যাবে। শুরুটা আমিই করছি, ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন আর শেষটা না হয় আপনারা করবেন। আচ্ছা অভিজিৎ বাবু - অভিষেক বাবু, ১৯শে অগস্ট ডাক্তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আর সেটা বাতিল সবই তো অ্যালিবাই তৈরির অঙ্গ তাই না? কথোপকথনটা এই ধরনের ফোন কলে যা হবে সেভাবেই টেপ করেছিলেন, সঠিক পস্ দিয়ে এটা করা তো কঠিন নয়। ব্যস্ত ডাক্তারের উত্তর যে সংক্ষিপ্ত হ্যাঁ, না এর বেশি কিছু হবে না সে হিসেবে আপনাদের ভুল হয়নি। দুজনের অ্যালিবাই যাতে স্পষ্ট হয় সেইজন্যই মায়ের একই ওষুধ চলবে কিনা জানবার অছিলায় অভিষেকও তার গলাটা শুনিয়ে রাখেন, যাতে আপনাদের দীর্ঘ দিনের পরিচিত ডাক্তার সহজেই দুটো গলা শনাক্ত করতে পারেন এবং প্রয়োজনে পুলিশকে জানাতে পারেন। নয়তো এই সামান্য কথাটা তো অভিজিৎ নিজেই জানতে পারতেন, ভাইকে ফোন দিতেন না। কেন বলুন তো এই অ্যালিবাই তৈরির চেষ্টা? আপনাদের বাবা যখন মরিসের মোবাইলে ফোন করে টেপটা চালু করছেন তখন আপনারা গ্রাহাম ডিক্সনকে তার পাপের চরম শাস্তি দিচ্ছেন। চন্দ্রবোড়া সাপ কেন ব্যবহার করেছিলেন সেই ব্যাখ্যা আপনারাই দিতে পারবেন। সরকার অ্যান্ড সরকার মেডিকেয়ারের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট চেক করে জানতে পারি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি থেকে আপনারা নিয়মিত পেমেন্ট পান, হিসেব মতন ১২টা কোম্পানি থেকে, তারমধ্যে সাতটা থেকে প্রায় প্রতি মাসে। পেমেন্টের পরিমাণ খুব খারাপ নয়। আমরা ওয়াকিবহাল মহল থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছি সাধারণত মেডিসিন শপগুলো ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে ওষুধ তোলে এবং তাদের পেমেন্ট করে বা তাদের থেকে ইনসেনটিভ পায়, প্রোডাক্ট ডিসপ্লের জন্যও টাকা পায়। সরাসরি মেডিসিন কোম্পানির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিরল, কিন্তু আপনাদের ব্যবসা সরাসরি ওষুধ কোম্পানিগুলোর সাথে এবং আপনারা পেমেন্ট পাচ্ছেন, করছেন না। তখন এই কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি আপনারা লাইসেন্স প্রাপ্ত সাপের বিষ সরবরাহকারী এবং হার্টের ওষুধের ক্ষেত্রে সাপের বিষ ভীষণ প্রয়োজনীয় উপাদান, বিশেষ করে চন্দ্রবোড়া সাপের বিষ, কারণ এই সাপের বিষ রক্ত জমাট বাঁধা বন্ধ করতে সবচেয়ে কার্যকরী। ১৮ই অগস্ট আপনারা হ্যামিলটন মেডিসিন, ইভান্স হার্টলি আর জ্যাকসন অ্যান্ড অ্যান্ডারসন নামক তিনটি কোম্পানিকে সাপের বিষ সরবরাহ করেন, এর মধ্যে প্রথম দুটো কোম্পানির অর্ডারের তালিকায় চন্দ্রবোড়া সাপের বিষ থাকলেও আপনারা জানিয়ে দেন সেদিন ব্যাপক চাহিদা থাকায় আপনারা ঐ বিষ সরবরাহ করতে পারছেন না। আদতে সেদিন আপনারা কোথাও চন্দ্রবোড়ার বিষ সরবরাহ করেননি। বোধহয় আপনাদের সংগ্রহে এই ভয়ঙ্কর সাপ একটির বেশি নেই, এই সাপ আপনাদের স্বদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আপনারা চেয়েছিলেন ১৯ তারিখ আপনাদের সাপের বিষের থলি পরিপূর্ণ থাকুক। একদমে কথাগুলো বলে থামলেন মাইক। আবার কটা লাইন মাথায় আসছে, ভাবলেন লিলিকে একটা এসএমএস করবেন, টুকটুক করে টাইপ করে লিখে ফেললেন,

তুমি আমার চন্দ্রবোড়া
আমি তোমার পাগলা ওঝা
চড়ব মোরা টাট্টু ঘোড়া।

তারপর কী ভেবে ডিলিট করে ফেললেন। ঝুঁকির ব্যাপারটা দক্ষ গোয়েন্দার সব সময় বিবেচনা করা উচিত। চন্দ্রবোড়ার উপমাটা লিলি কীভাবে গ্রহণ করবে নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। ফোন থেকে মুখ তুলে নির্বাক সরকার ভাইদের দিকে তাকালেন মাইক, ঘরে তখন বাস্তবিক শ্মশানের নিস্তব্ধতা।

অভিজিতই নীরবতা ভেঙ্গে অভিষেককে বললেন আর গোপন করে কিছু লাভ নেই, আর কেনই বা গোপন করব! অভিজিৎ শুরু করেন, শুনুন অফিসার, তারপর বলতে থাকেন কীকরে ২৫ বছর আগেই তাদের দিদির মৃত্যুর দিনেই তারা গ্রাহামকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন, প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দিদির মৃত্যুর শোধ নেওয়ার জন্য। ওরা অপেক্ষা করেছেন কবে গ্রাহাম চাকরি থেকে অবসর নেবে। তার কারণ, গ্রাহামের সাসেক্সের কটেজের খবর সরকাররা জানতেন এবং আন্দাজ করেছিলেন চাকরি থেকে অবসর নিলে লন্ডনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটের ব্যয় বহন না করে কান্ট্রিসাইডে নিজস্ব কটেজে গিয়ে বাস করা অনেক বাস্তবসম্মত হবে গ্রাহামের কাছে আর জনবহুল লন্ডনের থেকে নির্জন ব্রাইটনের কটেজে গ্রাহামকে মারা অনেক সোজা হবে। স্কুলের যোগসূত্র এতদিন বাদে তাহলে পুলিশের মাথায় আসবে না, কোনোভাবে গ্রাহামের মৃত্যুকে দুর্ঘটনার রূপ দিতে পারলে তার সঙ্গে তাদের দিদির পঁচিশ বছর আগের আত্মহত্যার যোগসূত্রর কথা চিন্তা করা অকল্পনীয় হবে। সেদিনের ঘটনার প্রায় চব্বিশ বছর বাদে গ্রাহাম চাকরি থেকে অবসর নেয়, তারপরেও কেটে গেছে এক বছর। এই পঁচিশ বছর ধরে গ্রাহামের প্রতিটি পদক্ষেপের খোঁজ রেখেছে সরকার ভাইরা, চরম আঘাত হানবার জন্য। একবছরের কিছু বেশি সময় ধরে সাসেক্সে পাকাপাকি বাস করতে থাকে গ্রাহাম, গ্রাহামের স্ত্রীর মৃত্যু অভিজিৎ অভিষেককে আরো সুবিধে করে দেয়, স্বামীর পাপের সাজা স্ত্রীকেও দেওয়ার পরিকল্পনা অভিজিৎ অভিষেকের ছিল না। সরকার ভাইরা ঠিক করে উর্মিলার মৃত্যুদিনেই গ্রাহাম নামক নরপশুকে চরম শাস্তি দেবে। সেইমতন অভিজিৎ ১৯শে অগস্ট উর্মিলার মৃত্যুদিবসের সকালে একটি ক্যুরিয়ার কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে টেলিফোন ডিরেক্টরি দেখে গ্রাহামকে ফোন করে জানতে চায় তিনি দুপুরে বাড়ি থাকবেন কিনা, তার নামে একটা ক্যুরিয়ার ডেলিভারি করবার আছে। এর আগে দু’ভাই গ্রাহামের কটেজের আশেপাশে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখে এসেছিলেন, ঝুঁকির সম্ভাবনা কতটা। সেটাও ক্যুরিয়র বয়ের ছদ্মবেশেই। তারপর সেদিন দুপুরে একটা চন্দ্রবোড়া সাপ থলেতে ভরে আর দুই ভাইএর দুটো রিভলবার সঙ্গে নিয়ে একটা ব্যাকপ্যাকে ভরে, দুপুর বারোটার কিছু আগে নাগাদ ট্যাক্সি ধরে সাসেক্সের উদ্দেশ্যে রওনা দেন অভিজিৎ। সরকার ভাইদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স আছে কিন্তু তারা রেল স্টেশনে মেটাল ডিটেক্টরে চেকিংএ তাদের রিভলবার বহনের কথা ঘোষণা করতে চাননি। তার ঘন্টা দেড়েক পরে অভিষেক লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশন থেকে ট্রেনে করে যাত্রা করেন সাসেক্সের ব্রাইটন স্টেশনের উদ্দশ্যে। ব্রাইটনে পৌঁছে অভিজিৎ ট্যাক্সি ছেড়ে দেন। পায়ে হেঁটে পৌঁছে যান গ্রাহামের কটেজে, অভিষেক আলাদা ভাবে ব্রাইটন স্টেশনে নেমে হেঁটে পৌঁছোন গ্রাহামের কটেজে। পুরো যাত্রাপথে তারা নিজেদের একসাথে শনাক্ত করবার সুযোগ দেননি। যদিও ব্রাইটনে প্রচুর ভারতীয়কে দেখা যায় আর তাদের সাজপোষাক ছিল সাধারণ, যাতে কেউ খেয়াল না করে। দিনটা ছিল মঙ্গলবার, প্রতিবেশিরা সিংহভাগই অফিসে, রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা। অভিজিতই দরজার বেল টেপে, অভিষেক গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল গ্রাহামের দৃষ্টিসীমার বাইরে, যাতে দুজনকে দেখে গ্রাহামের কিছু মনে না হয়। তার আগে নিজের রিভলবার সে পকেটে নিয়ে নিয়েছে। গ্রাহাম কিছু সন্দেহ করেনি। ব্যাকপ্যাক থেকে পার্সেলের বদলে অভিজিৎ বার করে রিভলবার, ধাক্কা দিয়ে গ্রাহামকে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়, অভিষেকও এবার এসে যোগ দেয়।

জোড়া রিভলবারের সামনে গ্রাহামকে কাবু করতে বেগ পেতে হয়নি। বসার ঘরের সোফায় গ্রাহামকে বসিয়ে চন্দ্রবোড়া থলি থেকে বার করে অভিজিৎ, এই সাপের বিষে মানুষ অমানুষিক যন্ত্রণা পেয়ে মারা যায়, চন্দ্রবোড়ার কামড়ে রক্তজমাট বাঁধা বন্ধ হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে দীর্ঘ যন্ত্রণার পর মানুষের মৃত্যু হয়। সেইসময়টা সরকার ভাইরা চেয়েছিল গ্রাহামকে হত্যার কারণটা বলবার জন্য। চন্দ্রবোড়ার কামড় খেয়ে বেঁচে যাওয়ার নিদর্শন একেবারেই নেই, আর চন্দ্রবোড়া অত্যন্ত অসহিষ্ণু সাপ, অন্য সাপের মতন মানুষকে না এড়িয়ে চলে মানুষকে সহজেই আক্রমণ করে। অন্য সাপের ক্ষেত্রে এতটা নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই। এইসব কারণেই এই সাপকে বেছে নিয়েছিল সরকাররা। দিদির যন্ত্রণার মৃত্যুর সুদে আসলে শোধ তোলার জন্যই এই পরিকল্পনা। সেইদিনও সাপটি অভিজিতদের হতাশ করেনি, অভিজিতের প্রশিক্ষিত হাতে উত্যক্ত হয়ে গ্রাহামের পায়ের ওপর মরণ দংশন করে, সেইভাবেই অভিজিত সাপটিকে মুক্ত করে যাতে প্রথম সুযোগেই সাপটি যাকে সামনে পায় তাকেই কামড়ায়। বাস্তবে কাজটা হয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে।

বিস্মিত গ্রাহামকে তারপর তারা নিজেদের পরিচয় দেয় এবং কেন তার এই মৃত্যুদণ্ড তার বর্ণনা দেয়। আতঙ্কিত গ্রাহাম চীৎকার করতেও পারেনি, আর করলেও বন্ধ দরজার পরে বাগান পেরিয়ে সে চীৎকার কারও কানে পৌঁছোতো না, এখানে কোনো বাড়িই গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে নেই। অভিজিত অভিষেক গ্রাহামের মৃত্যু নিজেদের চোখে দেখে নিশ্চিন্ত হয়েই একইভাবে লন্ডনে ফিরে আসে, সাপটা গ্রাহামকে কামড়ানোর পরেই থলি বন্দী করেছিল অভিজিত। অভিষেক গ্রাহামের বেড রুমের জানলা খুলে দেয়, যাতে সহজেই মনে হয় বাগান থেকে জানলা দিয়ে সাপ ঢুকেছে। দুই ভাই তারপর সমস্ত হাতের ছাপ যত্ন করে তুলে ফেলতেও ভোলেনি। অভিজিত, অভিষেকের বাবা অসিত সরকার আজ থেকে বাহান্ন বছর আগে ভারতবর্ষের বঙ্গ দেশের মেদিনীপুর থেকে ইংল্যান্ডে আসেন, তিনি ছোটবেলা থেকেই সাপ ধরতে ওস্তাদ, সাপের বিষ সরবরাহর ব্যবসাও তার হাতে তৈরি, ছেলেরা শিক্ষা পেয়েছেন বাবার কাছে।

অভিষেক মাইকের উদ্দেশ্যে বলে, অফিসার আপনি আপনার কর্তব্য করুন, আমরা আমাদেরটা করেছি এবং তাতে আমরা বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই। পঁচিশ বছর বাদে আমাদের বৃদ্ধ মাতা পিতা আজ শান্তি পেয়েছেন। আমাদের দিদির আত্মা পরলোকে মুক্তি লাভ করেছে। মাইক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, না এই রহস্যটা ভেদ করে আনন্দ হচ্ছে না, চাকরিটা ছেড়েই দেবেন। কবিতার একটা লাইন আসতে আসতেও ধরা দিল না, দুজন অফিসারকে পাহারায় রেখে রবার্টসনকে নিয়ে চললেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পথে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্টের ব্যবস্থা করতে। বৃদ্ধ সরকার দম্পতিকে বিদায় জানানোর সাহস পাননি মাইক, ওনারা কিন্তু একদম ধীর স্থির, যেন একটা প্রশান্তি সারা মুখে লেগে আছে। গাড়িতে রবার্টসন জিজ্ঞাসা করলো স্যার কী দেখে সন্দেহ করলেন এত বছর আগের একটা আত্মহত্যার কারণে সরকার ভাইরা প্রতিশোধ নিতে পারে? মাইক বললেন আসলে কয়েকটা খোঁচা যাকে বলে খচখচানি। রজার আর জুলিয়ার সম্পর্ক জানার পর সন্দেহের তীর স্বভাবতই পড়ে এই দুজনের ওপর, মনে হয়েছিল আড়াল থেকে এরাই কলকাঠি নেড়েছে নিজেদের জন্য নিখুঁত অ্যালিবাই সাজিয়ে রেখে। কিন্তু চন্দ্রবোড়া সাপকে মৃত্যুর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা রজারের পক্ষে খুবই মুশকিল। ভাড়াটে খুনীরা এই ধরনের কৌশল প্রয়োগ করে না। দ্বিতীয় খোঁচা ১৯শে অগস্ট উর্মিলার মৃত্যুদিবসে গ্রাহামের খুন হওয়া। হ্যাঁ, মানছি ব্যাপারটা কাকতালীয় হওয়া অসম্ভব নয়; তবে কাকতালীয় ঘটনা সহজে ঘটেও না। তৃতীয় খোঁচা সরকারদের মা এর জন্য বেছে বেছে ১৯শে অগস্টই ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ও বাতিল করা। যেদিন তারা ব্যবসা বন্ধ রেখে উর্মিলাকে সারা পরিবার একসাথে স্মরণ করে, সেদিন তারা একটা রুটিন চেকআপ করাতে চাইবে কেন আর করলেও সেটা বাতিল করবার সময় ডাক্তারকে কারণটা শোনাবে কেন! যদি না তারা চায় ডাক্তার তাদের ফোনের কথা বিশেষ করে স্মরণ রাখে। আরও আছে, তোমার স্মরণ থাকবে অভিজিত প্রায় নিখুঁত ভাবে ব্রাইটন থেকে লন্ডনে ফেরার সময়ের কথা বলেছিল, ‘প্রায় ঘন্টাখানেক’ আর ব্রাইটন স্টেশন থেকে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশন দ্রুততম ট্রেনে আসতে সময় লাগে ৫০ মিনিট। আমার প্রশ্নের উত্তরে অভিজিৎ জানায় সাসেক্সে তাদের কোনো ব্যবসায়িক যোগাযোগ নেই এবং সেখানে তারা নিয়মিত যান না, তবে অনায়াসে সেখানকার যাতায়াতের সময় বলেন কীকরে! রবার্টসন বলল, ঠিক খেয়াল করিনি স্যার। মাইক বিড়বিড় করে উঠল, স্বাভাবিক কেউই করে না আর তাই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড মাইক ব্রিয়ারলির কদর করে। রবার্টসন মনে মনে বলল শালা সাক্ষাৎ শয়তান। মাইক বলতে থাকে, তারপর তুমি যখনই সরকার অ্যান্ড সরকার মেডিকেয়ারের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট থেকে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি থেকে তাদের নিয়মিত পেমেন্ট পাওয়ার কথা উল্লেখ করো, সেটা আমাকে কৌতূহলী করে তোলে এবং আমি ওষুধ কোম্পানিগুলোতে ফোন করে সরকারদের সাপের বিষ সরবরাহের ব্যবসার কথা জানতে পারি। দুয়ে দুয়ে চার করতে তো আর সময় লাগে না। একটানা বক্তৃতা দিয়ে থামেন মাইক ব্রিয়ারলি। ততক্ষণে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এসে গেছে।

গল্প শেষে অধীরদা জিজ্ঞাসা করলেন, কী বুঝলেন বলুন তো অতনুদা? আমি বললাম গ্রাহাম ডিক্সনকে উর্মিলার ভাইরা উচিত শাস্তি দিয়েছে, তার প্রতি আমার কোনো সহানুভূতি নেই, আর আইন তো গ্রাহামকে শাস্তি দিতে পারেনি, পারলে হয়তো অভিজিৎ, অভিষেকরা এই হত্যার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলত না।

অধীরদা বললেন ঠিকই, তবে আপনি আসল পয়েন্টটাই বললেন না। আমি বললাম সেটা কী? অধীরদা বললেন আসল পয়েন্ট হচ্ছে চন্দ্রবোড়া সাপ, ঐ একটি মারাত্মক ভুলেই সরকারেরা ধরা পড়ে গেল, আর একটু মাথা খাটিয়ে ইংল্যান্ডের কান্ট্রিসাইডে পাওয়া যায় এরকম কোনো বিষাক্ত সাপ ব্যবহার করলে পুলিশ বিন্দু বিসর্গ সন্দেহ করতে পারত না। কেঁচো খুড়তে কেউটের মতন ২৫ বছর আগের এক স্কুল শিক্ষয়িত্রীর আত্মহত্যার খবরের খোঁজই পড়ত না। আসলে সাপের বিষের ব্যবসায় যুক্ত সরকারদের পক্ষে সব দেশের সাপ আমদানির নিশ্চয়ই লাইসেন্স ছিল, ব্যবসার খাতিরে সেটা তাদের করতেই হত। সেখানেই তারা সাপ নির্বাচনের ভুলটা করে ফেললেন, প্রতিহিংসায় পাগল হয়ে গ্রাহাম ডিক্সনকে বেশি যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য চন্দ্রবোড়া সাপকেই বেছে নিলেন। বুঝলেন অতনুদা, এইসব খুঁত রেখে কাজ করে বলেই হত্যাকারীরা ধরা পড়ে। আমি বললাম সে তো হবেই, নিখুঁত হত্যা বলে আজ অবধি কিছু হয়নি, অপরাধী সূত্র রাখবেই এবং ধরা পড়বেই, যদিও এক্ষেত্রে হত্যাকারীদের আমার অপরাধী বলতে আপত্তি আছে। অধীরদা শান্ত ভাবে বললেন এটা কে বলেছে যে একটি নিখুঁত হত্যা সম্ভব নয়? আমি বললাম আমি যা ইচ্ছে বাজি ধরতে রাজি আছি, ওটা সম্ভব নয়। অধীরদার মুখে একটা বিচিত্র হাসি খেলে গেল, বললেন অতনুদা এই বাজি ফেলাটা অনেকসময় প্রাণঘাতী হয়ে যেতে পারে, নয় কি? ওসব যা ইচ্ছে বাজি না ফেলাই ভালো। আমার কেমন রোখ চেপে গেল, বললাম আলবাৎ বাজি ধরব, আমি মানছি আপনি গোয়েন্দা গল্পের পোকা, কিন্তু তার মানে আপনি নিখুঁত হত্যার আষাঢ়ে গল্প শোনাবেন আর আমি সেটা মেনে নেব তা কক্ষণও হবে না। অধীরদা বললেন, বেশ আমি আপনাকে কোনো আষাঢ়ে গল্প শোনাব না, যেটা শোনাব সেটা নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কাহিনী। তার আগে আপনাকে একটা জিনিস দেখাই, বলে উনি বইএর আলমারি থেকে একটা চ্যাপ্টা ছোট বিঘত দেড়েক সাইজের কাঠের বাক্স বার করলেন, ডালাটা খোলার পরে দেখলাম এক ধরনের শুকনো পাতার মধ্যে সারি সারি হলদেটে কাঠির মতন গাছের ডাল যার মুখগুলো একটু ছুঁচোলো ধরনের। অধীরদা বললেন অতনুদা একটু হাতটা বাড়ান, আমি বাঁ হাতটা বাড়িয়ে ধরলাম, উনি বাক্স থেকে একটা কাঠি তুলে নিয়ে কনুই এর ওপর দিকে যেখানে সাধারণত ইনজেকশন দেওয়া হয় সেখানে ফুটিয়ে দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের জন্য একটা বিদ্যুৎ শিহরণ আমার ধমনী বেয়ে ব্রহ্মতালুতে আঘাত করল, আর মুখ দিয়ে একটা তীব্র যন্ত্রণার শব্দ বেরোতে গিয়েও বের হতে পারল না, তারপর যন্ত্রণাটা কমে গিয়ে একটা ঝিমঝিম ভাব শুরু হল। অধীরদা বললেন মাফ করবেন অতনুদা আপনাকে একটু ব্যথা দিয়ে ফেললাম, এটা না করলে আপনাকে নিখুঁত হত্যাটা সঠিক বোঝাতে পারতাম না।

অতনুদা, আপনি আর এক ঘন্টার মধ্যেই মারা যাবেন আর নিজের জীবন বাজি রেখেই বুঝতে বুঝতে চোখ বুজবেন যে একটি নিখুঁত হত্যা খুবই সম্ভবপর, আর কোনো গল্পের গোয়েন্দার পক্ষেই তার সমাধান করা সম্ভব নয়। এই কারণেই আপনাকে বলছিলাম বাজি ফেলাটা অনেকসময় প্রাণঘাতী হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আপনি আমার কথাটা ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন, সেটা যে ভালো করেননি তা জীবন দিয়েই বুঝতে পারবেন। আপনি চিৎকার করতে চাইলেও আপনার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোবে না, আপনার নার্ভ কাজ করবে না, এই সোফা ছেড়ে ওঠাও আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। তার চেয়ে বসে বসে আমার গল্পটা শুনুন আর এই গল্প শেষ হতে হতে আপনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন, গল্প নয় সত্যি, তবে সেটা বলবার জন্য আপনি বেঁচে থাকবেন না এই যা। আমি বলতে চাইলাম অনেক কিছু কিন্তু মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোলো না। অধীরদা বললেন আপনি কষ্ট করবেন না, আমি সবকিছু জলের মতন বুঝিয়ে দিচ্ছি। এই যে হলদেটে কাঠিগুলো দেখছেন, এগুলোর ব্যবহার জানে একমাত্র নাগাল্যান্ডের কোনিয়াক উপজাতির লোকেরা। ওরা এই কাঠিকে বলে মরণ কাঠি। এই কাঠিগুলো অত্যন্ত হালকা তাই লোহার শলাকার মুখে বেঁধে এর ব্যবহার করতে হয়, নয়তো হাওয়াতে লক্ষ্য স্থির রাখা যায় না, তীর ধনুক অথবা বর্ষা দুটোর মাথাতে বেঁধেই এটাকে ব্যবহার করা যায়।

এর ফলাতে আলাদা করে কোনো বিষ মাখাতে হয় না, বনের অভ্যন্তরে যেখানে সূর্যের আলো সরাসরি প্রবেশ করে না একমাত্র সেখানেই এই ধরনের কাঁটাঝোপ দেখতে পাওয়া যায়, জঙ্গলের পশু পাখিরা তাদের সহজাত অনুভূতি থেকে এই মরণ কাঠি ঝোপের থেকে দূরে থাকে, আর এর ব্যবহার কোনিয়াক উপজাতির লোকেরা ছাড়া বাইরের সভ্য পৃথিবীর কেউ জানে না, এক অধীর বাগচী বাদে, যদি অবশ্য এখনও আপনি আমাকে সভ্য মানুষ ভাবেন। এই সেই কোনিয়াক উপজাতি যারা হেড হান্টার হিসেবে কুখ্যাত, গত শতাব্দীর আটের দশক অবধি এদের মধ্যে হেড হান্টিং প্রচলিত ছিল। সভ্য সমাজ সেকথা জানে, জানে না তাদের মরণ কাঠির কথা। আপনি হয়তো জানেন আমি বহুদিন এইসব উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে বাস করেছি আর এরা আমাকে নিজেদের লোক মনে করে এই গুপ্ত বিদ্যা শিখিয়েছে। অতি কতিপয় মানুষ কোনিয়াকদের আস্থাভাজন হতে পেরেছে আর তার মধ্যেও মরণ কাঠির খোঁজ জানে কেবল অধীর বাগচী। এই বিষ রক্তের সংস্পর্শে এলে শিকার স্থাণুবৎ হয়ে যায়, তার ডাকবার বা নড়াচড়ার ক্ষমতা লোপ পায় এবং ঘন্টাখানেকের মধ্যে অবধারিত মৃত্যু। আর সেই শিকারের মাংস অনায়াসে রান্না করে খাওয়া যায়, বিষের কোনো প্রভাব মৃত্যুর পরে শরীরে পাওয়া যায় না, আপনার শরীরেও পাওয়া যাবে না, আপনার বাঁ হাতের ছোট্ট ফুটোটি কেউ লক্ষ্য করবে না, মনে হবে হঠাৎ করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় আপনার মৃত্যু হয়েছে, আর যেখানে গত বছরই আপনি অ্যনজিওগ্রাফি করিয়েছেন, সেটাও আমার পক্ষে যাবে। আমাকে কেউ সন্দেহ করবে না, আপনাকে হত্যা করবার জন্য আমার কোনো মোটিভ আইনের চোখে নেই, কে না জানে সব হত্যার পিছনে একটা মোটিভ থাকতেই হবে। এক্ষেত্রেও আছে, একটি নিখুঁত হত্যা সম্ভব সেটা প্রমাণ করা আর আপনি অধীর বাগচীকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, সেটা সে পছন্দ করে না, তবে এই মোটিভ জানলেন কেবল আপনি; যা আপনার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই চিরতরে মুছে যাবে। সবাই সাক্ষী আছে আপনি আমার পরম সুহৃদ, আমার স্ত্রী নন্দিতা যে এখন ওপরের ঘরে সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত, সেও সাক্ষ্য দেবে আমরা দুজনে নিয়মিত আড্ডা দিই, দাবা খেলি, আজও খেলছিলাম। আর আপনার হঠাৎ করে মৃত্যু হয়, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কথাটা ডাক্তার বলবেন। আপনার স্ত্রী পুত্রও তো আমাদের সখ্যতার কথা জানে, জানে ট্রেনের অসংখ্য সহযাত্রীরাও। গুডবাই অতনুদা, চেকমেট। ভালো থাকবেন আর আপনি কখনও অধীর বাগচীকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না। অধীরদার মুখের ক্রূর ছায়াটা ক্রমশ ঝাপসা হতে থাকে, আমার চোখের সামনে থেকে মুছে যেতে থাকে পৃথিবী, আমি মারা যাচ্ছি, নিশ্চিত ভাবেই মারা যাচ্ছি। হঠাৎ টের পাই আমাকে কেউ ধাক্কা মারছে, বহু দূর থেকে একটা ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে অতনুদা উঠুন। কার গলা! অধীরদারই তো। চোখ মেলে দেখি আমি লাইব্রেরির সোফায় আধশোয়া, গলাটা শুকিয়ে কাঠ। অধীরদা বললেন আপনি ডিক্সনের হত্যা কাহিনী শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, আমি তাই একফাঁকে নন্দিতাকে দু কাপ কফির জন্য বলে এলাম। আপনি কি একটু জল খাবেন? আমি বললাম হ্যাঁ, জলের বোতলটা অধীরদার হাত থেকে নিয়ে চোঁ চোঁ করে নি:শেষ করে ফেললাম আর বিস্মিত নেত্রে চেয়ে রইলাম অধীরদার দিকে, উনি বললেন কিছু বলবেন মনে হচ্ছে? কিছু হয়েছে নাকি, স্বপ্ন টপ্ন দেখেছেন? আমি বললাম হ্যাঁ মানে না, কিছু না। লজ্জায় চুপ করে রইলাম, এ স্বপ্নর কথা কি আর বলা যায়। বাক্সটা কিন্তু কোথাও চোখে পড়ল না।

বাড়ি এসে জামা কাপড় বদলে চান করতে ঢুকলাম, কিন্তু ভয়ঙ্কর স্বপ্নটার কথা ভুলতে পারছিলাম না, ঘরে এসে আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অজান্তেই চোখ চলে গেল যেখানে স্বপ্নে অধীরদা মরণ কাঠিটা ফুটিয়ে ছিলেন। মনে হল একটা লাল ফুটকি, তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে দেখলাম একটা ছোট্ট ক্ষত অথচ ব্যথা নেই। তাহলে ——! সবটাই মনের ভুল? ছোট্ট লাল দাগটা আগে থেকেই ছিল? মানুষের শরীরে এরকম কতই তো থাকে। নাকি যা এতক্ষণ অধীরদার লাইব্রেরিতে স্বপ্ন বলে দেখেছি তার সবটাই স্বপ্ন নয়? বিষটা কি সত্যিই প্রয়োগ করেছিলেন অধীরদা খুব মৃদু ডোজে অথবা এই বিষে খালি সাময়িক সংজ্ঞা চলে যায়, সাময়িক স্মৃতি লোপ পায়? আমার কি সত্যিই কোনো স্মৃতি লোপ পেয়েছে? আমি তো বোধহয় সবটাই মনে করতে পারছি। আমিও কি মাইকের মতন সন্দেহ প্রবণ হয়ে পড়ছি! কানের কাছে কে যেন গুনগুন করে উঠলো বুড়ো ছুঁচো বুড়ো ছুঁচো!



(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)