(১)
—হ্যালো শুনছ? তোমার বাবা কিন্তু সেই সক্কালবেলা চা-জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে গেছেন, এখনও পর্যন্ত বাড়ি ফেরেন নি। আমি কিন্তু কিছু জানি না। এই বয়সে এত আড্ডা মারার যে কী শখ জানি নে বাপু! তোমার বাবা, তুমি বোঝো এবার।
—তুমি কিছু বলো নি তো?
—আমি আবার কী বলব? আমার বয়ে গেছে। তোমার বাবার সাথে কেউ কি কথায় পারে? আমি তো কথা বলা ছেড়েই দিয়েছি।
—রীতুকে জিজ্ঞেস করেছিলে সে কিছু জানে কি না?
—পাগল, সে তো তার বাবার পক্ষেই সওয়াল করবে। আমার কাঁড়ি কাঁড়ি ভুল বের করে দশ কথা শুনিয়ে দেবে একেবারে। যেমন বাবা, তেমন মেয়ে! হুঁঃ
—তাহলে রণিকে একবার ফোন করে বলো সে তার দাদুর ব্যাপারে কিছু জানে কি না।
—আমাকেই ফোন করতে হবে? যত্তসব! আমি জানতাম তোমার মুরোদে কিছুই কুলোয় না।
(২)
—হ্যালো, কে? কাকিমা? হ্যাঁ বলো। কী হয়েছে? দাদুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? সকালে সেই যে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে গেছে এখনও পর্যন্ত ফেরে নি? আশ্চর্য তো! না না, আমি কিছু জানি না গো। আচ্ছা, দেখছি। দাদুর কাছে তো আবার কোন ফোনও নেই! কী যে মুশকিল। আচ্ছা, দেখছি দাঁড়াও। তুমি চিন্তা কোরো না।
রণি মোবাইল ফোনটা পাশের টি-টেবিলে রেখে সোফায় গালে হাত দিয়ে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। আজ সে কলেজ বাঙ্ক করেছে সুমিকে নিয়ে সেন্ট্রাল পার্কে বেড়াতে যাবে বলে। কিন্তু দাদুটাই সব গড়বড় বাঁধিয়ে দিল। বেলা একটা বেজে গেছে এখনও তিনি বাড়ি ফেরেন নি। কাকিমা চিন্তা করছে। মুশকিলের ব্যাপার। আর কিছুক্ষণ বাদেই সে স্টেশনে গিয়ে সুমির সাথে মিট করবে। তারপর দুজনে যাবে সেন্ট্রাল পার্কে। এখন তো দাদুকে খুঁজতে বেরোলে হয়েই গেল।
বছর দুয়েক আগে পর্যন্ত রণি ওরফে রণজয় গাঙ্গুলীর দাদু শ্রদ্ধেয় শ্রী বীরেন্দ্র চন্দ্র গাঙ্গুলী তথাকথিত শিক্ষিত ও সুচাকুরে পুত্রদ্বয়ের সংসার বিভাজনের পর থেকে রণির বাবা শ্রী শিবেশ চন্দ্র গাঙ্গুলী ও তার পরিবারবর্গের সঙ্গেই থাকতেন। কিন্তু শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করা অতিরিক্ত স্পষ্টবক্তা বড় বৌমাটির সাথে তাঁর তেমন মিলমিশ না হওয়ায় তিনি ছোটছেলের আশ্রয়ে চলে যান। কিন্তু ছোটবৌমাটিও সামনাসামনি কিছু না বললেও মুখরা কিছু কম নয়। রণিও সে কথা বিলক্ষণ জানে।
রণি তার একমাত্র পিসি রীতুকে সর্বপ্রথম ফোন করার সিদ্ধান্ত নিল এই ভেবে যে দাদু হয়তো পিসির বাড়ি চলে গিয়ে থাকতে পারে।
(৩)
রীতু তখন সবে খেতে বসেছে। ঠিক সেই সময় তার মোবাইলে বেজে উঠল “পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়….”
সে একটু বিরক্তভাবে ডানহাত মুঠো করে বাঁ-হাতে ফোন ধরল,
—হ্যালো, হ্যাঁ রণি বল, ক্কি-কী? বাবা সেই সকাল থেকে বাড়ি ফেরে নি এখনও? কী সব্বোনাশ! কোথায় গেল? কিছু বলে যায় নি? মুশকিল তো! কোথায় গেল তাহলে? আমি জানতাম এরকমই কিছু একটা হবে। ছোটবৌদির ট্যাঁকশ ট্যাঁকশ কথা আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়? ওই উপরেই সবাই মুখমিষ্টি, ভেতরে ভেতরে বিষে ভরপুর। তুই জানিস না, ও কী সাংঘাতিক। আমি জানতাম… হুঁ হুঁ। ওরে রণি রে… বাবা কোথায় গেল রে… ও বাবা, তুমি কোথায় গেলে গো…
রণি ফোনটা কেটে দিল। তার মানে দাদু পিসির বাড়ি যায় নি। কিন্তু পিসিকে এখনই ফোনটা না করলে বোধহয় ভালো হতো। সে যদি এখন কাকিমাকে ফোন করে উল্টোপাল্টা কিছু বলে তাহলেই এখন ধুন্ধুমার বেঁধে যাবে।
(৪)
রীতুর ফোনটা কাটতেই আবার বেজে উঠল, “পাপা ক্যহতা হ্যায়...”
—হ্যাঁ বলো?
—আরে, তুমি কোথায়? আমি তো স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি।
—দাঁড়াও, দাদুকে এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
—মানে?
—মানেটা আমিও জানি না। মনে হচ্ছে কোথাও চলেটলে গেছে, কিংবা সুইসাইডও করে থাকতে পারে।
রণির গলাটা একটু ভারী হয়ে এল।
—সে কী? তাহলে তো পুলিশে খবর দিতে হবে।
—দেব, আর কিছুক্ষণ দেখি। তুমি আজ বাড়ি ফিরে যাও, প্লিজ। আমার মনটা একদম ভালো নেই।
—ইশ্, আজকেই এরকম হলো? আমি সেই গোলাপী রঙের কুর্তিটা পরে এসেছিলাম, যেটা তুমি লাস্ট উইকে আমার জন্মদিনে প্রেজেন্ট করেছিলে।
—কে রে রণি? কার সাথে কথা বলছিস রে?
পিছনে ওর মা কখন এসে দাঁড়িয়েছে টের পায় নি রণি। চট করে সে ফোনটা কেটে দিল।
—মা, দাদুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
—সে কী কেন? ওমা, কখন থেকে?
—কাকিমা ফোন করেছিল। দাদু সেই সক্কালবেলা চা-জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে গেছে, এখনও পর্যন্ত বাড়ি ফেরে নি।
—দেখ, দেখ, কোথায় গেল। আমাদের নাক না কাটলে তো ওনার চলে না। আর দেখুক সকলে আমি একাই খারাপ নই। ছোটবৌমা তো খুব ভালো, তবে কেন তার শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে চলে যায়? হুঁ হুঁ বাবা, আমি জানি সে কত ভালো। একসাথে যখন থাকত, আমার হাড় ভাজা ভাজা করে দিয়েছিল একেবারে।
(৫)
আজ বহু বছর বাদে পিঠে সেই পরিচিত হাতের চাপড় লাগতেই পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ মানুষটি ঘুরে তাকালেন। একে চোখের জোর কমে গেছে, তার উপর দুঃখের জলে ঝাপসা চোখটা ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারল না।
—আরে, আমায় চিনতে পারছিস না? আমি সুবিমল রে, তোর ছোটবেলাকার বন্ধু, সেই স্কুলে একসাথে পড়তাম? মনে নেই তোর?
—আরে সুবিমল? এখানে এলি কী করে? কেমন আছিস তুই?
—বিন্দাস আছি ভাই। (সুবিমল আজকালকার ভাষা একটু-আধটু রপ্ত করেছেন।) তা তুই কী করছিস এখানে?
—বসে আছি, আর বসে বসে নিজের দুঃখ-কষ্টের স্মৃতির জাবর কাটছি।
—দূর পাগলা। ওসব তো সবার জীবনেই আছে। অত ভেবে কী হবে? আমাকে দেখ, মনটা আজও ছেলেমানুষের মত রেখেছি, তাই রোগজ্বালা আমায় কাবু করতে পারে না। তা, তুই এখানে কোথায় থাকিস?
—এই যে স্টেশন থেকে বড় রাস্তা দিয়ে কিছুটা গিয়ে বাঁদিকের রাস্তাটা ধরে হিমাংশুশেখর স্মৃতি বিদ্যালয়ের পরেই তিনমাথার মোড়টায় একটা ছোট পার্ক আছে, ওর ঠিক পরেই আমার বাড়ি। অবশ্য বাড়িটা এখন আর আমার নেই। পুরোনো বাড়িটা ভেঙে দু’দিকে দুটো বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে ছেলেরা।
—তোর ছেলেমেয়ে ক’টি?
-দুই ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, জামাই খুব ভালো চাকরি করে। মেয়ের ঘরে একটা নাতি আছে আমার। পড়াশোনায় তুখোড় একেবারে। বড়ছেলের এক ছেলে, কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। ছোট ছেলের একটা মাত্র মেয়ে…
—এই শোন শোন, রানাঘাট লোকাল আসছে। অ্যানাউন্স করছে। আমি ওখানেই থাকি। তোকে এতদিন বাদে পেয়ে আর ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। যাবি আমার সাথে? ছেলেমেয়েরা চিন্তা করবে? আমি ফোনে ওদের বলে দেব ’খন।
লাঠিটা নিয়ে উঠে পড়লেন বীরেন্দ্র।
—চল, তোর সাথেই যাই। আমার জন্য কেউ চিন্তা করবে না। আমি গেলেই সবাই বাঁচে।
(৬)
—হ্যালো, রণি বলছি। সকাল থেকে আমার দাদুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
—সে কী রে! তা কোথায় কোথায় গেছিলি খুঁজতে?
—এখনও কোথাও যাই নি। ফোনে খোঁজ নিয়েছি আত্মীয়-স্বজনদের কাছে। কোথাও যায় নি।
—কী কুল ব্রেন রে তোর? শুধু ফোনেতেই খোঁজ নিয়েছিস? আমি হলে তো এতক্ষণে সাইকেল নিয়ে পাগলের মতো বেরিয়ে পড়তাম।
রণি ওর বন্ধুর খোঁচাটা নীরবে হজম করল।
—ভাই, তুই আমার সঙ্গে চল না। তোর দাদার বাইকটা নিয়ে নে। তাহলে দাদুকে খুঁজতে সুবিধা হবে।
(৭)
স্টেশনের কাছে রাস্তাটা ভীষণ জ্যাম। তার উপরে লেভেল ক্রসিং পার হতে গিয়ে কে নাকি ট্রেনে কাটা পড়েছে তাই স্থানীয় বাসিন্দারা ট্রেন লাইন অবরোধ করেছে। কাজেই সেখান দিয়ে যাওয়া যাবে না। পিকলু বাইকের মুখটা ঘোরাতে যাচ্ছিল। হঠাৎ রণি বলল, “দাঁড়া, দাঁড়া। আমি একটু আসছি।”
—কোথায় যাচ্ছিস?
—আসছি। দাঁড়া না।
রণি জানে তার দাদু মাঝে মাঝেই রেল লাইন পার হয়ে মেলার মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে যায়। রণি একটু এগিয়ে গিয়ে ভিড় ঠেলে দেখল রেল লাইনের উপর যে মৃতদেহ পড়ে আছে আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হচ্ছে তার দাদু। ঠিক ওরকম ধুতি আর ফতুয়া পরা। মাথায় অল্প সাদা চুল। তবে যেভাবে দেহটা বিকৃত হয়ে গেছে এবং উপুড় হয়ে পড়ে আছে তাতে করে মুখটা আর বোঝা যাচ্ছে না।
রণি কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করল।
(৮)
দিন কয়েক সুবিমল আর সুচরিতার সাথে খুব আনন্দে কেটে গেল। এতগুলো বছরে এত আনন্দে আর কাটে নি বীরেন্দ্রর। সুবিমল কলেজ জীবনের মতোই মিশুকে আর আমোদপ্রিয় আছে। আর সুচরিতার এই বয়সেও গানের গলা আর রান্নার হাত চমৎকার আছে দেখে বীরেন্দ্রর খুব ভালো লেগেছে। সন্তানহীন দম্পতি নিজেদের মধ্যে বেশ আনন্দেই আছে। ওদের বাড়িতে আসা পর্যন্ত বীরেন্দ্র ইচ্ছা করেই কাউকে খবর দিতে দেন নি। কয়েক দিনের এই নিরুদ্দেশ তাঁকে একটা আলাদা মুক্তির স্বাদ দিয়েছে। ভাবছেন কিছু জমানো টাকাকড়ি নিয়ে যদি এদের কাছাকাছি একটা কোথাও চলে আসা যেত…
কিন্তু বন্ধু সংসর্গে আর কতদিন? এবার তো ফিরতেই হবে। সুবিমল-সুচরিতা অবশ্য তাঁকে আরো কয়েক দিন থেকে যেতেই বলছিলেন। কিন্তু তাঁর নিজেরও একটা বিবেক আছে।
(৯)
স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে বীরেন্দ্র পরিচিত কাউকে দেখতে পেলেন না। অবশ্য কাউকে তো আর খবর দিয়ে আসছেন না। তাছাড়া কেই বা তাঁর খোঁজ রাখে? বাড়িতে তো রাতদিন বউমার মুখঝামটা আর সবার অবজ্ঞা-অবহেলাই সম্বল। হয়ত তারা ভেবেছে বুড়োটা গত হয়েছে, ভালোই হয়েছে। আপদ চুকল!
কিন্তু রীতু? সে তো বাবার একটা খোঁজ খবর করতে পারত? তাকে তো তিনি সবার থেকে বেশি আদরযত্ন দিয়ে বড় করেছেন। নিজেকে প্রায় নিঃস্ব করে তার বিয়ে দিয়েছেন।
অবশ্য তারা কেউ খোঁজ নিয়েছে কি না তাও সঠিক ভাবে জানেন না। কারণ তাঁর কাছে কোন মোবাইল ফোন নেই। হয়ত পুলিশে খবর দিয়ে থাকতে পারে। তবে কোন বাংলা খবরের কাগজের ‘নিরুদ্দেশ’ কলামে তাঁর কোন ছবি বা নিরুদ্দিষ্টের প্রতি কোন লেখা যে বেরোয় নি, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। টি.ভি.-র নিউজে বলছিল কে যেন তাঁদের ওদিকে ট্রেনে কাটা পড়েছে। কিন্তু নিরুদ্দেশের কোন খবর বলে নি।
(১০)
রিকশা স্ট্যান্ডে গিয়ে উঠে পড়লেন একটা রিকশায়। বাড়ির লোকেশন বলতেই রিক্সাওলা বলল, “ভাড়া বেশি লাগবে।”
—কেন?
—রাস্তা ভালো না।
—কে বলল রাস্তা ভালো না? আমি সাতদিন আগেই এসেছি। কিচ্ছু সমস্যা ছিল না।
রিক্সাওলাও বিজ্ঞের মত বলল, “আপনি সাতদিন আগের কথা বলছেন। আজ সকালেই কাদের জলের পাইপ ফেটে গেছে তাই রাস্তা খুঁড়ে ঠিক হচ্ছে পাইপ। তার মধ্যে সেই যে সুইসাইড করেছিল বুড়োটা রেললাইনে, তার ডেডবডি আটকে রেখে লোকজন স্টেশনে ফুটব্রিজ তৈরি করে দিতে বলেছিল—তার বাড়িতে আজ স্থানীয় কাউন্সিলর আর কোন এক নেতা এসেছেন, আজ তার শ্রাদ্ধ কিনা? ওদের গাড়িতে রাস্তা জুড়ে গেছে। এই তো একটু আগে আমি প্যাসেঞ্জার নামাতে গিয়ে দেখে এলাম। সেও ভাড়া বেশি দিয়েছে।”
(১১)
—এই রোকো, রোকো। এ রাস্তা দিয়ে ঘুরে যাচ্ছ কেন?
—আপনাকে তো বললাম ওই রাস্তায় জ্যাম লেগে গেছে, তাই ঘুরে যেতে হবে বলে ভাড়া বেশি লাগবে।
—পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। চলো, তাই চলো।
লুঙ্গি পরা লোকটা কালো লম্বা লম্বা পায়ে প্যাডেলে চাপ দিল।
বাড়ির কিছুটা দূরেই নামতে হ’ল। সরু রাস্তার একপাশে সারি সারি গাড়ি পার্কিং। অন্য দিনের তুলনায় কয়েকটা বেশি। টোটোর ধাক্কা থেকে নিজেকে রক্ষা করে বাড়ির দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেলেন তিনি। সারা বাড়িটা সাদা কাপড়ে মোড়া, সামনে সাদা গেট সাদা ফুলের রিং দিয়ে সাজানো।
আরে, এ বাড়িতে আবার কী হ’ল?
(১২)
বাড়ির সামনে দু-একজন অচেনা ব্যক্তি খড়কে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে গল্প করছিলেন তাদের পাশ দিয়ে বীরেন্দ্রবাবু ভিতরে প্রবেশ করলেন। কেউ কিচ্ছু বলল না। ভেতরে সবাই ব্যস্ত। ক্যাটারিং-এর ছেলেটা লুচির ঝুড়ি নিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বলল, “দাদু, একটু সরুন তো।”
কোন একটা ঘর থেকে মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ আসছে। ছোট ছেলের বাড়ির দোতলার ডাইনিং-এর পাশের ঘরটা থেকেই শব্দটা আসছে লক্ষ করে তিনি হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দেখলেন--ঘরের বাইরে আত্মীয়-পরিজনদের ভিড়। তাঁকে দেখে তারা ভয়ানক চমকে গেল, যে যেদিকে পারল ছিটকে সরে যেতে লাগল। ঘরের ভেতর বীরেন্দ্রবাবুর বড় ও ছোট ছেলে ন্যাড়া মাথায় ধুতি পরে বসে মন্ত্র পড়ছে তাঁর ছবির সামনে, পাশে রীতুও বসে আছে। আর পুরোহিতমশাই মন্ত্র বলতে বলতে তাঁর দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। মালা পরানো ছবির দিকে তাকিয়ে বীরেন্দ্রর মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগের কথা--সেই যে-বছর তিনি প্রথম চাকরি পেয়েছিলেন।
বীরেন্দ্রর দুই পুত্র হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। মন্ত্রপাঠ থেমে গেছে তাঁকে দেখেই।
আত্মীয়স্বজনরা বলাবলি করছে, “বেঁচে থাকা মানুষের শ্রাদ্ধ? ছি ছি।”
(১৩)
—বড়খোকা, আমি বেঁচে থাকতেই আমার শ্রাদ্ধ করে ফেললি তোরা?
—না, মানে, রণি যে বলল তুমি ট্রেনে কাটা পড়েছ?
—তোরা তো জানতিস আমার পিঠের বাঁদিকে একটা জড়ুল আছে। তোরা মৃতদেহটা ভালো করে পরীক্ষা না করেই আমায় মৃত বলে ধরে নিলি?
—আমাদের খুব ভুল হয়ে গেছে বাবা।
—না বাবা, তোমরা একেবারে সঠিক কাজই করেছ এবং জেনে বুঝেই করেছ। বুড়োটা মরে তোমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে একথাই ভেবেছিলে তোমরা।
ঠিক তখনই রীতু কেঁদে উঠল, “বাবা গো, তুমি আমাদের ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলে গো…!”
—থাক মা, তোমায় আর কাঁদতে হবে না।
বীরেন্দ্র সোজা ঢুকে গেলেন নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে একটা ব্যাগে নিজের কয়েকটা জামাকাপড় আর কিছু দরকারি কাগজপত্র ভরে নিলেন। আলমারির লকারে কোন টাকাপয়সা আর অবশিষ্ট নেই। যেটুকু ছিল ছেলে-বৌমারা কেউ তা বের করে নিয়েছে।
বন্ধ দরজায় সমানে করাঘাত করে চলেছে তাঁর মেয়ে-জামাই আর নাতি-নাতনিরা।
(১৪)
দরজা খুলতেই কানে এল বড় বৌমার টিপ্পনী, “ওহ্, তাহলে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতেই এখানে আসা!”
দরজা খুলে বীরেন্দ্র তখন ছেলে বৌমাদের মুখোমুখি।
—না বৌমা। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে নয়। তোমাদের মতো বেইমানদের সঙ্গে চিরতরে সম্পর্ক শেষ করতে।
—ওগো শুনছ? এই হতচ্ছাড়া বুড়োটা আমায় বেইমান বলছে?
—ওই ভেড়াটা আর কী বলবে? নিজের বাপের যে সম্মান রাখতে জানে না, তার আবার সম্মানবোধ! হুঁ…
—কী সাংঘাতিক লোক গো! সবার সামনে আমাদের নাক কেটে দিচ্ছে? তা কোন চুলোয় যাওয়া হচ্ছে শুনি?
বীরেন্দ্রবাবু কারো কোন কথার উত্তর না দিয়ে সোজা নেমে এলেন একতলায়। পিছনে পিছনে ছেলেমেয়ে, বৌমারা, জামাই ও কয়েকজন আত্মীয়স্বজন আসছিলেন। বীরেন্দ্র তাদের এক ধমক দিয়ে বললেন, “আমার পিছন পিছন আসছ কেন তোমরা? যাও, সব যাও এখান থেকে।”
(১৫)
বড় বৌমা বলে উঠল, “ব্যাগে করে কী নিয়ে যাচ্ছে একবার দেখা উচিত ছিল।”
বড় ছেলে ধমকে উঠল, “আহঃ, চুপ করো।”
আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে গুনগুন শুরু হয়েছে। কে যেন বলছে, “বাপরে, বৌমাটির তো বেশ খর মুখ! এজন্যই বুঝি….”
—বাবা, শোনো শোনো। আমাদের ছেড়ে যেও না।
ছোটছেলে বীরেন্দ্রর হাতটা চেপে ধরতেই তিনি জোর করে ছাড়িয়ে নিলেন।
বীরেন্দ্র সকলের টিপ্পনী উপেক্ষা করে একটা রিক্সায় চড়ে বসেছেন। রিক্সাওয়ালাকে বললেন, “শিগগির স্টেশনে চলো।”
—বাবা, এভাবে সিন ক্রিয়েট কোরো না। আমাদের তো একটা প্রেস্টিজ আছে, না কি?”
দুই ছেলে রিক্সার দু’দিকে ছুটে এসে বাবার হাত ধরল।
মেয়ে রীতু বলল, “দাদা, তোরা শোন। বাবা এখন দু’দিন আমার বাড়িতে থাকুক। রাগটা একটু কমলে ফিরে আসবে’খন।”
রীতুর যুক্তি দুই ভাইয়ের মনে ধরল। এখানে থাকলে বৌদের সাথে আবার কী ঝামেলা বেঁধে যাবে তার ঠিক নেই।
(১৬)
রীতুর বাড়িতে আসার সময়েই বীরেন্দ্রর শরীরটা ভালো লাগছিল না। রাত্রে বেশ জ্বর এল। বাঁদিকে বুকে একটু ব্যথাও করছে। মেয়েকে সেসব বলেন নি। শুধু বলেছেন, আজ রাতে কিছু খাবেন না। নাতির ঘরে শুতে দিয়েছে মেয়ে। নাতি হায়দ্রাবাদে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে।
বীরেন্দ্র শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবছিলেন। ছেলেদের উপর রাগ করে বন্ধুর বাড়ি চলে যাচ্ছিলেন বটে কিন্তু চিরকাল তাদের কাছে তো আর থাকা যায় না। মেয়ে-জামাই বা কতদিন তাঁকে দেখবে?
টাকা-পয়সার জোরও নেই যে কোন ভাল বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবেন। জীবনের সমস্ত সঞ্চয় তিনি যাদের জন্য খরচ করেছেন, আজ তাদের কাছেই তিনি বোঝা।
(১৭)
পেটের মধ্যে একটা অস্বস্তি বোধ করে মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে উঠলেন তিনি। মেয়েকে ডাকবেন ভাবলেন। কিন্তু কারা যেন কথা বলছে।
—দেখো, তোমার বাবাকে পরিষ্কার বলে দিও এখানে যেন পার্মানেন্টলি থাকার চেষ্টা না করেন। আমি অত দায়িত্ব নিতে পারব না কিন্তু। নিজের ছেলেরা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবে, সেটা হতে দিচ্ছি না আমি।
জামাইয়ের গলা। মেয়ে বলছে, “বাবা এখানে থাকবেও না। তাছাড়া আমিও অত ঝুটঝামেলা নিতে পারব না। আমি দাদা-বৌদিদের বলেই দেব বাবার দায়িত্ব তোমাদেরই নিতে হবে। সমস্ত সম্পত্তি যখন নিয়েছে, দায়িত্ব নেবে না কেন?”
—ঠিক বলেছ। সমস্ত সম্পত্তি, টাকা-পয়সা তো ওরাই নিয়েছে। আমাদের তো শুধু বিয়ের সময় দু’লাখ টাকা নগদ আর দশভরি সোনা দিয়েছিল। সেজন্য একটা লোকের সারা জীবনের দায়িত্ব নেওয়া যায় না নিশ্চয়ই।
একটু চুপ করে থাকার পরে জামাই আবার জিজ্ঞেস করল, “তা বাবা এখানে ক’দিনের জন্য তাঁবু ফেলল তা জিজ্ঞেস করেছ?”
—না এখনও করি নি। শরীরটা ভালো না বলে মনে হল। কালকে জিজ্ঞেস করব।
(১৮)
ভোরবেলা। তখনও ভালো করে আলো ফোটে নি। স্টেশনে একজন চা-বিক্রেতা লক্ষ করল একজন বয়স্ক মানুষ অনেক কষ্টে প্ল্যাটফর্মের ধার ধরে হেঁটে হেঁটে আসছে। খুব কষ্ট করে হাঁটছে যেন। হঠাৎ তার মনে হ’ল লোকটার মতলব খারাপ নয় তো? এই সময় তো একটা থ্রু-ট্রেন যাওয়ার কথা। লোকটার সাথে কোন ব্যাগও নেই। চা বিক্রেতা তার সরঞ্জামগুলো স্টেশনের একপাশে সরিয়ে রাখল। সিগন্যাল হয়ে গেছে। ট্রেন আসছে। বয়স্ক লোকটা লাফিয়ে পড়ার আগেই চা বিক্রেতা টেনে ধরে নিয়েছে তাকে।
—কেন? কেন বাঁচালে আমায়?
হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠল বয়স্ক মানুষটা। চা-ওয়ালা বলল, “আত্মহত্যা মহাপাপ।”
ঝাঁঝিয়ে উঠল লোকটা, “রাখো তোমাদের জ্ঞানের কথা। আমার কাছে মরণই শ্রেয়। যাকে পৃথিবীর কেউ চায় না। তার মরা ছাড়া আর গতি কী?”
স্টেশনে চিৎকার-চেঁচামেচি কান্নাকাটি শুনে প্ল্যাটফর্মে সামান্য লোক জড়ো হয়েছে। ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসেছে ভিখারিরা। হঠাৎ সৌম্যদর্শন একটি ছেলে এগিয়ে এ্ল।
—কে বলল এই পৃথিবীতে আপনার কেউ নেই? আমি আছি তো।
—তুমি কে বাবা?
—আমি আপনার ছেলের মতো। আমার নাম বিশ্বজিৎ চৌধুরী। আসুন একটু গরম চা খাওয়া যাক।
পুব আকাশে তখন লাল বলের ন্যায় সূর্য নতুন দিনের সূচনা করার জন্য উঁকি দিচ্ছে।
চা খেতে খেতে বিশ্বজিৎ বলল তার একটা এন.জি.ও. আছে। তারা অসহায় বৃদ্ধবৃদ্ধা এবং শিশুদের জন্য কাজ করে। তাদের বৃদ্ধাবাসের নাম হ'ল 'শেষ থেকে শুরু'। সেখানে থাকার কোন খরচ লাগে না।
--চলুন, আমাদের বৃদ্ধাবাসে। সেখানে আপনার মতো আরো অনেকে আছেন। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন সেখানে।
(১৯)
বীরেন্দ্র বৃদ্ধাবাসে এসেছেন তা প্রায় মাসখানেকের বেশি হয়ে গেছে। আগাগোড়া মার্বেল বসানো তিনতলা বাড়িতে অনেক আবাসিক। কেউ ছিলেন ডাক্তার, কেউ বা শিক্ষক। কেউ স্বেচ্ছায় এসেছেন ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে বলে, আবার কেউ বা বাড়ি থেকে বিতাড়িত। কিন্তু এখানে একটা ইউনিটি আছে। সকলেই নিজের বাড়ি ভেবে এক একটা দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। বীরেন্দ্রর উপর দায়িত্ব পড়েছে পরের দিনে কী কী সব্জি বা মুদিখানার জিনিসপত্র আনতে হবে তার লিস্ট বানানো ও টাকাপয়সার হিসাব রাখা। কারো উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয় না, যে যার ইচ্ছামতো নিজের কাজ বেছে নিতে পারে। আবার নাও করতে পারে। তবে কাজ করলে সবাই সুস্থ থাকবে এমন একটা ধারণা আছে আবাসিকদের মধ্যে।
কিছুটা সরকারি অনুদানে চলে। আবার আবাসিকদের অনেকে স্বেচ্ছায় তাঁদের সঞ্চয় তুলে দিয়েছেন 'শেষ থেকে শুরু'-র প্রতিষ্ঠাতাদের হাতে।
বীরেন্দ্র বিশ্বজিতের হাত দুটো ধরে বলেছেন, "আমার যে কিছু নেই বাবা। তোমাদের যে কী দিই?"
বিশ্বজিৎ তাঁর ডান হাতখানি টেনে নিয়ে নিজের মাথার উপর রেখে বলেছে, "শুধু আপনার আশীর্বাদ দেবেন, ব্যস।"
আজ বহুদিন পর বীরেন্দ্র সুবিমলকে একটা চিঠি লিখলেন, "ভাই সুবিমল, আশা করি তুই ও সুচরিতা খুব ভালো আছিস। আমিও ভীষণ ভালো আছি। কখনও ভাবিনি নিজের ছেলেমেয়ে, আত্মীয় পরিজন ছেড়ে অচেনা বন্ধুদের সাথে এত আনন্দে থাকব। যখন বয়স কম ছিল ভেবে ছিলাম সবাই আমার ভীষণ আপন, বড় কাছের। আমি চাইলেই নিজের মতো করে গড়তে পারি আমার চারপাশের পৃথিবীটাকে। কিন্তু না, সেটা ভীষণ বড় ভুল--তা আজ বেশ বুঝতে পারছি।
যেদিন তোর বাড়ি থেকে ফিরে দেখলাম আমার জীবদ্দশায় ছেলেরা আমার শ্রাদ্ধ করছে সেদিন আমি ভীষণভাবে আঘাত পেয়েছিলাম। তার থেকেও বড় আঘাত পেলাম নিজের মেয়ের কাছ থেকে, যাকে আমি সবচেয়ে বেশি আদরযত্নে বড় করেছি। আমার বাঁচার ইচ্ছাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দেবদূতের মত উদয় হ'ল বিশ্বজিৎ। কোথা থেকে সে এল তাও জানি না। কিন্তু এখন তাকে যত দেখছি, তত অবাক হচ্ছি। এমন উপকারী, ভালো মানুষও এই স্বার্থপরের দুনিয়ায় আছে? আমি বিস্মিত ও ততোধিক আনন্দিত। সেই আমাকে শেখালে শেষ থেকেও শুরু করা যায়। বোধহয় এই নতুন ঠিকানা না পেলে এতদিনে আমার মৃত্যুসংবাদ পেতিস সংবাদপত্রের পাতায়।
যাহোক, এখন আমি ভালো আছি। ভালো আছি। সুস্থও আছি। মনের সাথে শরীরের অনেকখানি সংযোগ আছে। তাই এখন আমি বেশ ভালো বোধ করি।
একদিন সময় পেলে ঘুরে যাস এখানে। সুচরিতাকেও নিয়ে আসিস।
আমার ঠিকানা চিঠির শেষে দিলাম। শুধু একটাই অনুরোধ কাউকে আমার ঠিকানা জানাস না।
ভালো থাকিস। ভালোবাসা নিস।
ইতি--
তোর বিরু"
চিঠি লেখা শেষ হতে না হতেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রণবেশ হাঁক পাড়লেন, "ও বীরেন্দ্র, তোমার লেখালেখি শেষ হ'ল? লনে হাঁটতে যাবে তো?"
--হ্যাঁ হ্যাঁ। চলুন।
বীরেন্দ্র কাগজ-কলম গুটিয়ে উঠে পড়লেন। ঘরের বাইরে এসে দেখলেন সূর্যের সোনালি আলোয় লনের সবুজ ঘাসের উপর শিশিরবিন্দু ঝলমল করছে।
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)
অলংকরণঃ লেখক এবং অনন্যা দাশ