উর্দু সাহিত্যের প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক-গল্পকার রাজিন্দর সিং বেদীর (১৯১৫ - ১৯৮৪) ‘কোয়ারাণ্টিন’ গল্পটি ৮০ বছর আগে লেখা। গল্পের প্রেক্ষাপট ১৮৯৬-এর প্লেগ এবং সংক্রামিতদের রোগান্তরণে রাখার তদানীন্তন আশ্রয়স্থলগুলি। ১৯৩৯ সালে লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘দানা-ও-দাম’ শীর্ষক গল্পসংগ্রহে গল্পটি প্রকাশিত হয়। ওই বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় প্রশস্তিসূচক যেসব উদ্ধৃতি আছে, তার প্রথমটি ‘দ্য ট্রিবিউন’ (৩রা অগস্ট, ১৯৩৯) পত্রিকা থেকে গৃহীত যাতে বলা হয়েছিল যে “এই গল্পকার একদিন মুন্সী প্রেমচন্দের সার্থক উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হবেন”। উর্দু সাহিত্যে তাঁর সমসাময়িক আরও দুই প্রখ্যাত গল্পকার, কৃষণ চন্দর এবং সাদাত হাসান মাণ্টো-র সঙ্গে রাজিন্দর সিং বেদীর নাম একত্রে উচ্চারিত হয়।‘এক চাদর মৈলি সি’ উপন্যাসের (যা পরবর্তীকালে সিনেমার মাধ্যমে সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তা পায়) জন্য ১৯৬৫-তে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত রাজিন্দর সিং বেদী উর্দু সাহিত্যে তরক্কি-পসন্দ মুসন্নিফিন অর্থাৎ প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। এই গল্পকার পরে সিনেমায় নির্দেশক এবং স্ক্রিপ্ট লেখক হিসেবেও কাজ করেছেন। হৃষীকেশ মুখার্জি নির্দেশিত অভিমান, অনুপমা অথবা বিমল রায়ের মধুমতীর মত বহু বিখ্যাত হিন্দি সিনেমার স্ক্রিপ্ট তিনি লিখেছেন।
—অনুবাদক
প্লেগ আর কোয়ারাণ্টিন!
কুয়াশার মত মেঘ যেমন হিমালয় পাদদেশের উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে চরাচরকে ঝাপসা করে তোলে, প্লেগের ভয় চারদিকে সেভাবেই ছড়িয়ে পড়েছিল। শহরের শিশুরা প্লেগের নাম শুনলেই কেঁপে উঠত।
প্লেগ তো ভয়ংকর ছিলই, কিন্তু কোয়ারাণ্টিন ছিল আরও ভয়াবহ। মানুষের মধ্যে প্লেগের সংক্রমণের ভয় যতটা ছিল, তার তুলনায় অনেক বেশি ছিল কোয়ারাণ্টিনে যাওয়ার ভয়। এই কারণেই স্বাস্থ্য দপ্তর নাগরিকদের ইঁদুর থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দেওয়ার জন্য মানবাকৃতির বিজ্ঞপ্তি ছেপে দরজায়, যাতায়াতের পথে আর দেওয়ালে সেঁটে দিয়েছিল। সেই ইস্তেহারগুলোতে ‘না ইঁদুর না প্লেগ’ এই স্লোগানটির পরিবর্ধিত রূপ ‘না ইঁদুর, না প্লেগ, না কোয়ারাণ্টিন’ লেখা হয়েছিল।
কোয়ারাণ্টিন নিয়ে এই ভয়ের পেছনে যুক্তি ছিল। চিকিৎসায় নিযুক্ত ডাক্তার হিসেবে আমার মতামত যদি নির্ভরযোগ্য হয়, তাহলে আমি হলফ করে বলতে পারি যে শহরে যত মৃত্যু কোয়ারাণ্টিনের কারণে হয়েছিল, প্লেগে মৃতদের সংখ্যা ছিল তার চেয়ে বেশি। যদিও কোয়ারাণ্টিন কোনও রোগ নয়, বরং সেই প্রশস্ত এলাকার নাম যেখানে প্লেগ আক্রান্তদের সুস্থ মানুষদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়। উদ্দেশ্য রোগ যাতে আরও ছড়াতে না পারে। কোয়ারাণ্টিনে পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার আর নার্সের ব্যবস্থা থাকলেও সংক্রামিতদের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি হওয়া সকল রোগীর প্রতি মনোযোগ দেওয়া চিকিৎসা কর্মীদের পক্ষে ক্রমশই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল।
আত্মীয়-স্বজন কাছে না থাকায় আমি অনেক রোগীকে সাহস হারাতে দেখেছি। আশপাশের মুমূর্ষু রোগীদের একে একে মরতে দেখায় অনেকেই মরার আগেই মরে ছিলেন। কখনও-সখনও এমনও হত যে সাধারণ অসুখে অসুস্থ কোনও রোগী আশ্রয়স্থলে গিয়ে মহামারীর জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। অসংখ্য মৃত্যুর কারণে কোয়ারাণ্টিনে অন্তিম সময়ে পালনীয় চিরাচরিত প্রথাগুলোর পরিবর্তে সেখানকার বিশেষ নিয়ম পালিত হত। অর্থাৎ, শয়ে শয়ে লাশ মরা কুকুরের দেহের মত টেনে নিয়ে গিয়ে স্তূপাকৃতি সাজিয়ে রেখে ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের তোয়াক্কা না করে পেট্রোল ঢেলে আগুনে পোড়ানো হত। সেই আগুনের রক্তাভ লেলিহান শিখা পড়ন্ত সূর্যের লাল আভার সঙ্গে যখন মিশে যেত, তখন অন্য রোগীদের মনে হত বুঝি বা গোটা দুনিয়ায় আগুন লেগেছে।
কোয়ারাণ্টিনে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার আরেকটি কারণ ছিল এই যে সেখানে আসার আগে উপসর্গ দেখা দিলে রোগী তা লুকিয়ে রাখতে চাইত যাতে তাকে জোর করে কোয়ারাণ্টিনে না নেওয়া হয়। সংক্রমণের খবর পেলেই দ্রুত জানানোর জন্য সব ডাক্তারদের সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু জানাজানির ভয়ে রোগীরা ডাক্তারের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিল। কোনও পরিবারে যে আক্রান্ত রোগী আছেন তা শুধু তখনই বোঝা যেত যখন বুকফাটা কান্নার রোলের মধ্যে দিয়ে সেই বাড়ি থেকে একটি লাশ বের করে আনা হত।
সেই সময় আমি কোয়ারাণ্টিন সেণ্টারের ডাক্তার হিসেবে কাজ করছিলাম। প্লেগের ভয় আমার দেহ-মনেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আমি কিছুক্ষণ কার্বলিক সাবান দিয়ে হাত ধুতাম, জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে গার্গল করতাম অথবা পেট পুড়িয়ে দেয় এমন গরম কফি অথবা ব্র্যান্ডি পান করতাম। এই সব করে আমি অনিদ্রা রোগে ভুগতাম আর চোখে ঝাপসা দেখতাম। কয়েকবার এমনও হয়েছে যে আমি রোগের ভয়ে বমি হওয়ার ওষুধ খেয়েছি যাতে আমার পেট পরিষ্কার হয়। যখন খুব গরম কফি অথবা ব্র্যাণ্ডি খাওয়ার কারণে পেটে অ্যাসিড হয়ে যেত আর জ্বরের ঘোরে আমি প্রায় সংজ্ঞাহীন হতাম, তখন অনেক সময় জ্ঞানহীন মানুষের মত কাল্পনিক ভয়ের শিকার হতাম। গলা যদি একটু খুসখুস করেছে, তাহলে আমি তাকে প্লেগের লক্ষণ বলে মনে করতাম। উফ্! আমিও তাহলে এই প্রাণঘাতী রোগের শিকার হলাম… প্লেগ! আর তারপর… কোয়ারাণ্টিন!
ওই সময়েই সদ্য খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত উইলিয়াম ভাগু খাকরুব আমার কাছে এসেছিল। সে আমাদের গলি সাফাইয়ের কাজ করত। ভাগু এসে বলল: “বাবুজি, তাজ্জব ব্যাপার! আজ অ্যাম্বু এসে আমাদের মহল্লা থেকে বিশ আর এক জনকে তুলে নিয়ে গেছে।”
“একুশ জনকে? অ্যাম্বুলেন্সে?” আমি তাজ্জব হয়ে বলি।
“জী হাঁ, পুরা বিশ আউর এক। ওঁদেরও কোণ্টিন-এ নিয়ে যাবে। আহ! বেচারারা কি আর কখনও ফিরে আসবে না?”
ভাগুর সঙ্গে কথা বলে আমি জানলাম যে সে রাত তিনটেয় ঘুম থেকে ওঠে। তারপরে আধ বোতল মদ ঢকঢক করে গিলে নিয়ে কমিটির গলি আর নালা-নর্দমায় চুন ছড়ানোর কাজে নিয়মমাফিক লেগে পড়ে যাতে জীবাণু ছড়িয়ে না পড়ে। ভাগু আমাকে বলে যে তার রাত তিনটেয় ওঠার আরও কারণ হল বাজারে পড়ে থাকা লাশগুলো এক জায়গায় জড়ো করা আর তার কাজের এলাকায় বাস করে এমন মানুষদের ছোটোখাটো ফাইফরমাশ খাটা যাঁরা রোগের ভয়ে বাইরে বেরোচ্ছেন না। ভাগুর নিজের সে ভয় একেবারেই ছিল না। ওর মনে হত, যদি মরণ আসেই, তাহলে সে যেখানেই পালিয়ে যাক না কেন, বাঁচতে পারবে না।
সেই সব দিনে যখন কেউ কারও ধারেকাছে ঘেঁষত না, সেই সময় ভাগু তার মুখ-মাথায় কাপড় জড়িয়ে নিয়ে একেবারেই ভয়ডরহীন হয়ে মানুষের সেবা করে চলেছিল। তার জ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত সীমিত হলেও সে তার অভিজ্ঞতায় ভর করে রোগ থেকে বাঁচার বিষয়ে সদুপদেশ দিত। সাফসুতরো থাকা, চুন ছড়ানো আর ঘরের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিত। এমনকী একদিন আমি তাকে অন্যদের সামনে অধিক মদ্যপানের সুপারিশ করতেও দেখেছিলাম। ওইদিন সে আমার কাছে এলে জানতে চাইলাম, “ভাগু, তোমার প্লেগের ভয়ও নেই?”
“না বাবুজি… আমার সময় এসে গেলে বিপদ থেকে দূরে থাকা যাবে না। ধরুন আপনি এত বড় হাকিম, হাজার হাজার মানুষ আপনার হাতে সুস্থ হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার দিন এসে গেলে আপনার চিকিৎসাও কোনও কাজ করবে না… হাঁ, বাবুজি, বুরা না মানেঁ। আমি ঠিকই বলছি, সাফ বলছি।” তারপরেই সে প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলে, “কুছ কোণ্টিন কি কহিয়ে বাবুজি… কোণ্টিন কি।”
“ওখানে কোয়ারাণ্টিনে হাজার হাজার রোগী এসেছে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি তাদের সারিয়ে তোলার। কিন্তু কতটুকুই বা করতে পারি যখন আমার সঙ্গে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা একটু বেশি সময় রোগীর কাছে থাকতে ভয় পান। ভয়ে তাদের গলা-জিভ শুকিয়ে যায়। তোমার মত রোগীদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে গিয়ে কেউ তাঁদের শুশ্রূষা করে না। তোমার মত কেউ নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে তাদের সেবা করে না। ভাগু! খোদা তোমার মঙ্গল করুন। তুমি অসুস্থ মানুষের এমন সেবা করো…।”
ভাগু মুখ নামিয়ে নেয়। মুখ বাঁধা কাপড়টা খুললে তার নেশাগ্রস্ত রক্তাভ মুখটা দেখা যায়। “বাবুজি, আমি আর কীই-বা করতে পারি, আমার এই নিষ্কর্মা শরীরটা যদি কারও কাজে লেগে যায়, এর চাইতে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? বাবুজি, বড় পাদ্রিসাহেব লাবে (রেভারেণ্ড মোতিন ল, অ্যাবে) যিনি আকছার আমাদের মহল্লায় প্রচারের জন্য আসেন, তিনি বলেন, “যিশু খ্রিস্ট এই চান যে রোগীর সেবায় আমরা যেন নিজেদের জান লড়িয়ে দিতে পারি… ম্যাঁয় সমঝ্তা হুঁ… ”
আমি ভাগুর হিম্মত বাড়াতে চাইলেও, আবেগ আমাকে গ্রাস করল। ওর আত্মপ্রত্যয় আর কর্মদক্ষতা যেন আমার মনে ঈর্ষারও সঞ্চার করল। আমি মনে মনে স্থির করলাম যে আজ কোয়ারাণ্টিনে মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করে বহু রোগীকে সুস্থ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করব। ওঁদের আরাম দিতে প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দিতেও আমি প্রস্তুত। কিন্তু মুখে বলা এক, আর কাজে করে দেখানো আরেক। কোয়ারাণ্টিনে পৌঁছে যখন রোগীদের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখলাম, আর তাদের মুখনিঃসৃত দুর্গন্ধ আমার নাকে পৌঁছোল, তখন আমার প্রাণ কেঁপে উঠল। ভাগুর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে সাহস হল না।
এ সত্ত্বেও, সেদিন কোয়ারাণ্টিনে ভাগুকে সঙ্গে নিয়ে অনেক কাজ করেছিলাম। যে কাজের জন্য রোগীদের খুব কাছে যাওয়ার প্রয়োজন, সে কাজ আমি ভাগুকে দিয়ে করিয়েছিলাম যা সে নির্দ্বিধায়, অবিলম্বে সম্পন্ন করেছিল। আমি নিজে রোগীদের থেকে দূরেই ছিলাম এই কারণে যে আমার মৃত্যুভয় তো ছিলই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল কোয়ারাণ্টিনের ভয়।
কিন্তু ভাগু কি মৃত্যু আর কোয়ারাণ্টিনের ভয়ের ঊর্ধ্বে ছিল?
সেদিন কোয়ারাণ্টিনে প্রায় চারশ রোগী ভর্তি হন, আর আনুমানিক আড়াইশ জন মারা যান। নির্ভীকচিত্ত ভাগুর জন্যই আমি অনেক রোগীকে সুস্থ করে তুলতে পেরেছিলাম। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের ঘরে রোগ নিরাময়ের পরে সুস্থ হয়ে উঠেছেন এমন রোগীদের হিসেব প্রদর্শন করে রেখাচিত্র টাঙানো ছিল। সেই রেখাচিত্রে আমার চিকিৎসায় যে রোগীরা আরোগ্য লাভ করেছেন, তাঁদের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখা গেল। আমি রোজই কোনও না কোনও ছুতোয় ওই ঘরে যেতাম, আর রেখাচিত্রের নির্দেশক রেখাটিকে ধীরে ধীরে একশ শতাংশ সাফল্যের দিকে উঠতে দেখে খুব খুশি হতাম।
একদিন প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্র্যাণ্ডি পান করেছিলাম। আমার বুক যেন ধড়ফড় করছিল, নাড়ি ঘোড়ার মত দৌড়চ্ছিল, আর আমি পাগলের মত এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছিলাম। আর সন্দেহ হচ্ছিল যে শেষ পর্যন্ত আমি হয়ত প্লেগের জীবাণুতে আক্রান্ত হলাম এবং শীঘ্রই আমার গলা অথবা ঊরুর গ্ল্যান্ডগুলো ফুলে উঠবে। খুবই ভয় পেয়ে গেলাম। সেদিন আমি কোয়ারাণ্টিন থেকে পালিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। সেখানে যতক্ষণ ছিলাম, সেই সময়টুকু যেন ভেতরে ভেতরে কাঁপছিলাম। সেদিন মাত্র দু’বার আমার সঙ্গে ভাগুর দেখা হয়েছিল।
দুপুরের দিকে একবার দেখলাম যে সে এক রোগীকে জড়িয়ে ধরে আছে। ভাগু পরম প্রেমের সঙ্গে রোগীর হাতে মৃদু চাপড় দিচ্ছিল। রোগীর শরীরে যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল, তাই জড়ো করে সে বলছিল, “ভাই, আল্লাহ্ই মালিক। এখানে খোদা যেন পরম শত্রুকেও না পাঠান। আমার দুই মেয়ে…”
ভাগু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “প্রভু যিশুকে ধন্যবাদ দাও ভাই… তোমাকে দেখে তো সুস্থ মনে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ ভাই, খোদারই দয়া… আগের থেকে একটু ভালোই আছি। যদি আমি কোয়ারাণ্টিনে…” কিন্তু সেই কথা মানুষটির মুখেই রয়ে গেল। তার ধমনী দপদপ করতে শুরু করল, মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরিয়ে এল, চোখ উল্টে গেল। আর সেই রোগী, যে কয়েক মুহূর্ত আগেই সকলের চোখে আর নিজের অনুভবেও সুস্থ ছিল, চিরদিনের জন্য শান্ত হয়ে গেল। ভাগুর চোখ জলে ভরে গেল। আর কেই বা সেই রোগীর জন্য কাঁদত? নিকটাত্মীয় কেউ সেখানে থাকলে হয়ত তাদের বিলাপ-ক্রন্দন আকাশ-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হত। শুধু এক ভাগুই ছিল, যে সকলের আত্মীয়। সকলের জন্য তার প্রাণ কাঁদত। সে প্রভু যিশু খ্রিস্টের সামনে অত্যন্ত বিনয়নম্রভাবে নিজেকে নব্য মানবজাতির সব পাপের প্রায়শ্চিত্তকারী হিসেবে যেন তুলে ধরেছিল।
সেদিন প্রায় সন্ধ্যের সময় ভাগু দৌড়তে দৌড়তে এল। জোরে জোরে তার নিঃশ্বাস পড়ছে। সে ব্যথায় কাতর হয়ে বলল, “বাবুজি, এই কোয়ারাণ্টিন তো দোজখ আছে। নরক...নরক। পাদ্রি লাবে এই রকম নরকের কথাই বলতেন…”
আমি বললাম, “হ্যাঁ ভাই, এ নরকেরও অধম…আমি তো এখান থেকে পালানোর পথ খুঁজছি। আজ আমার শরীরটা বেশ খারাপ।”
“হাঁ বাবুজি, ইস্ সে জেয়াদা আউর কেয়া বাত হো সকতি হ্যায় ...আজ এক রোগী রোগের ভয়ে এতই কাহিল হয়ে পড়ে যে মনে করা হয়েছিল সে মরে গেছে। তাকে কেউ লাশের ঢিবির মধ্যে ফেলে দিয়ে আসে। পেট্রোল ছড়ানোর পরে যখন আগুন সব লাশগুলোকে ঢেকে নিয়েছে, তখন আমি দেখলাম যে সেই রোগী আগুনের মধ্যে হাত-পা ছুঁড়ছে। আমি ঝাঁপ দিয়ে তাকে টেনে তুলেছি বাবুজি! লোকটার শরীর একেবারে ঝলসে গিয়েছিল। ওকে বাঁচাতে গিয়ে আমার বাঁহাত জ্বলেপুড়ে গেছে।”
আমি ভাগুর হাতটা দেখলাম। হাত পুড়ে গিয়ে চামড়ার নিচে সাদা সাদা চর্বি দেখা যাচ্ছে। সে দৃশ্য দেখে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। আমি জিগ্যেস করলাম, “লোকটি কি তাহলে বেঁচে গেল?” “বাবুজি, সে এক বহুৎ শরিফ আদমি ছিল। যিস্ কি নেকি আউর শরিফি সে… দুনিয়ার হয়ত কোনও ফায়দা হয়নি। ওই ভয়ানক ব্যথা আর জ্বালা নিয়েও তিনি মুখ তুলে তাঁর প্রায় নিভুনিভু চোখ দুটি আমার চোখে রেখে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন।”
“...আর বাবুজি,” ভাগু আরও বলে চলে, “তার কয়েক মুহূর্ত পরেই সে যন্ত্রণায় এমন কাতরাতে শুরু করল যে আজ পর্যন্ত আমি কারও জান এইভাবে যেতে দেখিনি। …তারপরেই সে চলে গেল। ভালো হত যদি আমি তাকে আগেই পুড়ে মরতে দিতাম। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে আমি তার কষ্টই বাড়ালাম, কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারলাম না। আমার এই পোড়া হাত দিয়েই আমি তাকে আবার সেই লাশের ঢিবিতে ফেলে এলাম।”
তারপরে ভাগু আর কিছু বলতে পারল না। ব্যথা সহ্য করতে করতেই সে থেমে থেমে বলল, “আপনি জানেন সে কোন্ রোগে মারা গেল? প্লেগ নয়… কোণ্টিন… কোণ্টি..!”
যদিও এই অপরিসীম দুর্দশার পরিস্থিতিতে পরিচিত জনেরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলেন, যন্ত্রণাকাতর মানুষের আর্ত চিৎকার রাতভর কানে আসত। যে সময়ে প্যাঁচাও ডাকতে ইতস্তত করে, সেই সময়ে মায়ের দীর্ঘশ্বাস, বোনের অনুতাপ, বিধবার বিলাপ, শিশুর চিল-চিৎকার শহরের আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে এক নিদারুণ বেদনার পরিবেশ তৈরি করেছিল। যখন সুস্থ মানুষের মনের ভার লাঘব হয় না, তখন তাঁদের অবস্থা কেমন হতে পারে যাঁরা অসুস্থ অবস্থায় ঘরে দিন কাটাচ্ছেন? যাঁদের চোখে জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীদের মত দেওয়াল থেকে হলুদাভ হতাশার বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়া ধরা পড়ত? তারপরে ছিলেন কোয়ারাণ্টিনে থাকা অসুস্থ রোগীরা, যারা হতাশার সীমা ছাড়িয়ে মৃত্যুদেশের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট দেখতে পেতেন। তাঁরা পৃথিবীর সঙ্গে এমনভাবে লেগে ছিলেন যেন ঝড়ের মধ্যে কেউ গাছে উঠে একদম ওপরের ডালটিকে জাপটে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছেন। আর শক্তিশালী ঢেউগুলো হরেক মুহূর্তে বাড়তে বাড়তে সেই বৃক্ষশীর্ষের ডালটিকেও ডুবিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় মেতে উঠেছে।
আমি সেদিন নেহাত ইচ্ছে করছিল না বলেই কোয়ারাণ্টিনে যাইনি। কোনও জরুরি কাজের অজুহাত খাড়া করেছিলাম, যদিও বিবেকের দংশনে খুবই ভুগছিলাম। এমন হতেই পারত যে আমার সাহায্য পেলে কোনও রোগী হয়ত উপকৃত হত। কিন্তু যে ভীতি আমার শরীর-মনের ওপর চেপে বসেছিল, তা আমাকে যেন শেকলে বেঁধে রেখেছিল। রাতে শোওয়ার সময় আমি খবর পেলাম যে সেদিন কোয়ারাণ্টিনে পাঁচশোর বেশি রোগী পৌঁছেছে।
আমি পেট জ্বালিয়ে দেয় এমন গরম কফি খেয়ে শোওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় দরজায় ভাগুর আওয়াজ পেলাম। চাকর দরজা খুলে দিলে ভাগু হাঁপাতে হাঁপাতে ভেতরে এল। বলল, “বাবুজি, মেরি বিবি বিমার হো গই। ওর গলায় গ্ল্যান্ড দেখা যাচ্ছে। খুদা কে বাস্তে...ওকে বাঁচান। ওর বুকে দেড় বছরের বাচ্চা দুধ খায়। সেটাও মরে যাবে।”
আমি কোনও সহানুভূতি তো দেখালামই না, বরং রাগ দেখিয়ে বললাম, “আগে আসতে পারলে না? রোগ কি এক্ষুনি শুরু হল?”
“সকালে সামান্য জ্বর ছিল…যখন আমি কোণ্টিনে যাই…”
“আচ্ছা। সে ঘরে অসুস্থ … আর তা সত্ত্বেও তুমি কোয়ারাণ্টিনে গেলে?”
“জী বাবুজি,” ভাগু কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দেয়। ওর একদমই কম বুখার ছিল। আমি ভেবেছিলাম বুকে দুধ আছে বলে গা গরম। তাছাড়া আর কোনও কষ্ট ছিল না। আর আমার দুই ভাই তো ঘরেই ছিল। ওদিকে কোণ্টিনে শয়ে শয়ে রোগী বিমার পড়ে আছে…”
“তাহলে তুমি তো তোমার সহমর্মিতা দেখিয়ে আর আত্মত্যাগ করে এবার প্লেগের জীবাণুকে নিজের ঘরেই ঢুকিয়ে ফেলেছ। আমি তোমাকে বলেছিলাম না যে রোগীদের অত কাছে থেকো না। দেখো আমি আজ এই কারণেই সেখানে যাইনি। এসব তোমারই দোষ। এখন আমি আর কী করতে পারি? তোমার মত সাহসী লোককে তো সাহসের মূল্য চোকাতেই হবে। যেখানে শহরে শয়ে শয়ে রোগী পড়ে আছে…”
ভাগু কাকুতি-মিনতি করে বলতে চাইল, “কিন্তু প্রভু যিশু খ্রিস্ট…”
“চলো, হঠো…কেউকেটা এসেছে একজন…তুমি জেনে বুঝে আগুনে হাত দিয়েছ। এখন তার শাস্তি আমাকে পেতে হবে? আত্মবিসর্জন এভাবে দেওয়া যায় না। আমি এত রাতে তোমাকে কোনও সাহায্য করতে পারব না…”
“কিন্তু পাদ্রি লাবে…”
“চলো। যাও… পাদ্রি ল, অ্যাবে’র যদি কিছু হত…”
ভাগু মাথা নামিয়ে চলে গেল। আধ ঘণ্টা পরে আমার রাগ পড়লে আমি আমার আচরণের জন্য অনুতপ্ত বোধ করলাম। আমি কেমন বুদ্ধিমান যে ঘটনার পরে পরিতাপ করছি? আমার সবচেয়ে বড় শাস্তি এটাই হতে পারে যে আমার ভ্রান্ত আত্মসম্মানবোধ ঝেড়ে ফেলে ভাগুর কাছে আমার পূর্বের আচরণের জন্য ক্ষমা চাওয়া আর পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে তার বিবির চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে তোলা। আমি তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে দৌড়তে-দৌড়তে ভাগুর ঘরে গেলাম। পৌঁছে দেখলাম যে ভাগুর দু ভাই তাদের বৌদিকে চারপাইয়ের ওপর শুইয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে আসছে।
আমি ভাগুর দিকে তাকিয়ে বললাম, “ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”
ভাগু অস্ফুটে উত্তর দিল, “কোণ্টিন…”
“তাহলে তোমার মতে কোয়ারাণ্টিন এখন আর নরক নয় ভাগু?”
“বাবুজি, আপনি যখন আসতে রাজি হলেন না, তখন এছাড়া আর উপায়ই বা কী ছিল? আমার মনে হল ওখানে গেলে হাকিমের মদত মিলতেও পারে। আর অন্য রোগীদের খেয়ালও রাখতে পারব।”
“এখানে রাখো চারপাই…এখনও তোমার মন থেকে অন্য রোগীদের নিয়ে চিন্তা গেল না? …আহাম্মক…”
চারপাই আবার ঘরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো যে ওষুধ ছিল, আমি ভাগুর বিবিকে তাই খাইয়ে আরও একবার আমার সেই অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলার জন্য তৈরি হলাম। ভাগুর বিবিকে চোখ খুলতে দেখা গেল।
ভাগু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আপকা এহসান সারি উমর না ভুলুঙ্গা, বাবুজি।”
আমি বললাম, “আমি আগে যা করেছি তার জন্য আমার ভীষণ আফসোস হচ্ছে, ভাগু। ঈশ্বর যেন তোমার বিবিকে সুস্থ করে তোমার অক্লান্ত সেবার পুরস্কার দেন।”
কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি আমার অদৃশ্য শত্রুকে যেন তার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করতে দেখলাম। ভাগুর বিবির ঠোঁট কাঁপতে লাগল। আমার হাতে ধরা নাড়ির গতি অত্যন্ত শ্লথ হয়ে গেল। আমার শত্রুর কাছে আমি আরও একবার হারতে শুরু করলাম। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে বললাম, “ভাগু! বেচারা ভাগু! তুমি নিজের আত্মত্যাগের এই পুরস্কার পেলে?...আহ্!”
ভাগু কাঁদছিল।
সে দৃশ্য কতই না হৃদয় বিদারক ছিল যখন ভাগুকে দেখলাম যে সে একটানা কেঁদে চলা বাচ্চাকে চিরদিনের মত তার মায়ের বুক থেকে টেনে সরিয়ে দিচ্ছে। তারপরে ভাগু তার স্বভাবগত বিনয়ের সঙ্গে আমাকে ঘরে পৌঁছে দিল।
আমি ধরে নিয়েছিলাম যে সেই বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর ভাগু আর অন্যদের প্রতি মনোযোগ দিতে পারবে না। কিন্তু তার পরদিনই আমি তাকে আবার কোয়ারাণ্টিনের রোগীদের সেবায় নিয়োজিত দেখলাম। সে শত শত পরিবারকে স্বজন হারানোর বেদনা থেকে বাঁচিয়ে দিল, নিজের জীবনটাকে কোনও গুরুত্বই দিল না। আমিও তার অনুপ্রেরণায় দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করলাম। কোয়ারাণ্টিন আর হাসপাতালে আমার কাজ শেষ হলে আমি শহরের গরীব মানুষদের মহল্লায় গিয়ে কাজ শুরু করলাম। ওই সব পাড়ায় নোংরা নর্দমা আর জঞ্জালের কারণে রোগের প্রকোপ ছিল সবচেয়ে বেশি।
এখন পরিবেশ রোগের জীবাণু থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। শহর একদম ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। ইঁদুরের কোনও চিহ্নই দেখা যায় না। সারা শহরে এক-আধটা ঘটনা শোনা যায় যেখানে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে রোগ আর বাড়তে পারেনি।
শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছে, স্কুল-কলেজ-অফিস-কাছারি খুলতে শুরু করেছে।
একটা ব্যাপার যা আমি বাজারে গেলেই গভীরভাবে অনুভব করেছি তা হল অনেকেরই নজর আমার প্রতি। জনগণ কৃতজ্ঞ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। সংবাদপত্রে আমার ছবি ছেপে কাজের তারিফ করে প্রতিবেদন লেখা হচ্ছে। চারিদিক থেকে প্রশস্তি বর্ষিত হওয়ার ফলে আমি এক ধরনের আত্মশ্লাঘা অনুভব করছি এমন বললে ভুল হবে না।
শেষ পর্যন্ত একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন হল যেখানে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি আর ডাক্তারদের আমন্ত্রণ জানানো হল। পুরমন্ত্রী সেই সভার সভাপতি। আমার আসন সভাপতির ঠিক পাশেই, যেহেতু আমাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্যই আসলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। মালার বোঝায় আমার কাঁধ ঝুঁকে পড়েছে, আমাকে বেশ একটা কেউকেটা বলে মনে হচ্ছে। গর্বের দৃষ্টিতে আমি একবার এদিক একবার ওদিকে তাকাচ্ছি। জনসাধারণের সেবায় আত্মনিবেদনের অসাধারণ দৃষ্টান্ত তুলে ধরার জন্য কমিটি আমাকে ধন্যবাদ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে এক হাজার এক টাকার ইনাম দিয়ে আমাকে পুরস্কৃত করলেন।
উপস্থিত সকলে সামগ্রিকভাবে আমার দফতরের কর্মীদের এবং বিশেষভাবে আমাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। তাঁরা জানালেন যে পেরিয়ে আসা বিপর্যয়ের সময় আমি যে অসংখ্য জীবন বাঁচিয়েছি, তার তারিফ করার ভাষা নেই। আমি দিনরাত এক করে, নিজের অস্তিত্বকে দেশের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে, নিজের সম্পদকে দেশের সম্পদ ভেবে রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মরণাপন্ন রোগীদের হাতে ওষুধের পাত্র তুলে দিয়েছি।
পুরমন্ত্রী মঞ্চের বাঁদিকে দাঁড়িয়ে একটা সরু লাঠি হাতে নিয়ে উপস্থিত অভ্যাগতদের দৃষ্টি একটি রেখাচিত্রের দিকে আকর্ষণ করলেন। প্রতিদিন কীভাবে আরোগ্য লাভ করা অসংখ্য মানুষের সংখ্যা বেড়েছে তা সেই রেখাচিত্রের নকশায় ফুটে উঠেছিল। শেষমেশ উনি নকশায় সেই দিনটিও দেখালেন যেদিন আমার দায়িত্বে থাকা চুয়ান্ন জন রোগীই সুস্থ হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ আমি একশ শতাংশ সাফল্য পেয়েছি, যার প্রমাণ হল সেই কালো রেখাটি যেটি সেদিন সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছেছিল।
এরপরে পুরমন্ত্রী আমার সাহসের প্রশস্তি গেয়ে ঘোষণা করলেন যে জনগণ জানতে পেরে খুশি হবেন বক্সিজীকে তাঁর সেবামূলক দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালনের জন্য লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল উপাধিতে ভূষিত করা হচ্ছে।
হলঘর আমার প্রশংসা-অভিনন্দনে আর জোরদার হাততালির আওয়াজে ভরে উঠল।
সেই হাততালির আওয়াজের মধ্যেই আমি সগর্বে মুখ তুলে চারিদিক অবলোকন করলাম। সভাপতি আর উপস্থিত ব্যক্তিদের ধন্যবাদ জানিয়ে বেশ লম্বাচওড়া একটি বক্তৃতা দিলাম। সেই বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয় ছাড়াও আমি জানালাম যে ডাক্তারদের নজর শুধু হাসপাতাল আর কোয়ারাণ্টিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, গরীব মানুষদের ঘরের দিকেও তাঁদের গভীর মনোযোগ ছিল। সেই মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব নিতে সমর্থ নন এবং সেই কারণেই তাঁরা মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমার সহকর্মীদের সাহায্যে আমি সেই এলাকাগুলো চিহ্নিত করি যেখানে মহামারীর প্রাদুর্ভাব সর্বাধিক এবং ওই সব এলাকা থেকে রোগটিকে নির্মূল করতে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করি। হাসপাতাল আর কোয়ারাণ্টিনে দিনের কাজ শেষ হলে আমরা সারা রাত ওই সব ভয়াবহ জায়গায় গিয়ে মানুষের সেবা করে কাটিয়েছি।
সেদিন অনুষ্ঠানের শেষে আমি লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল পদমর্যাদায় ভূষিত হয়ে, সগর্বে, বুক ফুলিয়ে, ফুলের মালার ভারে ন্যুব্জ হয়ে, মানুষের দেওয়া সামান্য উপহার এক হাজার এক টাকা পকেটে ভরে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন যেন একটা অস্ফুট আওয়াজ কোনও দিক থেকে শুনতে পেলাম। “বাবুজি, বহুৎ বহুৎ মুবারক হো।”
আমাকে অভিনন্দন দিতে দিতেই ভাগু তার সেই পুরোনো ঝাড়ুটি কাছেই একটি সেফটি ট্যাঙ্কের ঢাকনার ওপরে রেখে দুহাত দিয়ে তার মুখে বাঁধা কাপড়টা খুলে ফেলল। আমি যেখানে ছিলাম, সেখানেই স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলাম।
“তুমি? ভাগু ভাই?” আমার গলা দিয়ে যেন কথা সরে না। “ভাগু, দুনিয়া তোমাকে চিনল না। তাতে কী? আমি তো চিনি। তোমার যিশু তো জানেন। পাদ্রি ল, অ্যাবে’র অনন্য শিষ্য তুমি….খোদা তোমার মঙ্গল করবেন।”
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। ভাগুর মরণাপন্ন বিবি আর তার বাচ্চার মুখদুটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমার গলায় যেন ফুলের মালার ভার আরও চেপে বসেছে। টাকার ভারে আমার পকেট যেন ছিঁড়ে যায়। এত সম্মান পাওয়ার পরেও আমি যেন সব কিছু থেকে সরে গিয়ে এই অকৃতজ্ঞ পৃথিবীর জন্য বিলাপ করতে চাইছি।
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)
অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার এবং রাজিন্দার সিং বেদী-র ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত।