উপক্রমণিকাঃ
তাঁর স্ব-মূল্যায়ন দিয়েই শুরু করি এই সশ্রদ্ধ বিশ্লেষণঃ
বছর কয় আগে শ্রীযুক্ত সুধীরচন্দ্র সরকার সম্পাদিত “মৌচাকে” আমি যখন “যকের ধন” উপন্যাস লিখতে শুরু করি, তখন বাংলা-সাহিত্যে [এই] শ্রেণীর ছেলেদের উপন্যাস একখানিও ছিল না। … এবং ছেলেদের উপন্যাস লেখবার জন্যে, আমার প্রদর্শিত পথে এখন যে কত লোক এসে দাঁড়িয়েছেন, বিভিন্ন পুস্তকালয়ের প্রকাশিত পুস্তক-তালিকায় দৃষ্টিপাত করলেই সকলে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। … এতগুলি বাঙালী লিখিয়ে যে আমার পথ অনুসরণ ক’রে আজ দেশের বাল্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ ক’রে তোলার জন্যে আত্মনিয়োগ করেছেন, এজন্যে আমি অনায়াসেই, গর্ব্ব নয়, আনন্দ প্রকাশ করতে পারি।[১]
যকের ধন ছিল ছোটদের জন্য আধুনিক প্রেক্ষাপটে প্রথম বাংলা ‘অ্যাডভেঞ্চার’ কাহিনী। আশা গঙ্গোপাধ্যায় রচিত বাংলা শিশু-সাহিত্যের ক্রমবিকাশ (১৮০০ – ১৯০০) থেকে আমরা জানতে পারি যে যকের ধন ১৩৩০ বঙ্গাব্দ (১৯২৩ খৃষ্টাব্দ) থেকে মৌচাক পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়ে বাংলা ‘শিশু সাহিত্যে একটি নবীন প্রবাহ’ মুক্ত করে দেয়। যকের ধন শেষ হতে, ১৩৩২ বঙ্গাব্দে (১৯২৫ খৃ:) মৌচাকে হেমেন্দ্রকুমার লেখেন মেঘদূতের মর্তে আগমন, এবং ১৩৩৩-এ (১৯২৬ খৃ:) ময়নামতীর মায়াকানন, দুটিই কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক অ্যাডভেঞ্চার-উপন্যাস। আশা গঙ্গোপাধ্যায়ের মূল্যায়নে, ‘ভাষার সাহিত্যিক সৌন্দর্য্যে এবং গল্প [জমিয়ে তোলবার] কুশলতায়’ হেমেন্দ্রকুমার বাংলা শিশু-সাহিত্যে এইচ জি ওয়েলস এবং স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের দ্বৈত ভূমিকা গ্রহণ করলেন। তাঁর বিশ্লেষণের শেষে লেখিকা পঞ্চাশ দশকের অন্তে ও ষাটের দশকের শুরুর শিশু সাহিত্যে হেমেন্দ্রকুমারকে ‘গোয়েন্দা কাহিনী ও অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের পথিকৃৎ’ অভিধা দিয়ে মানুষটিকে ‘পরিণত বার্দ্ধক্যেও … শ্রেষ্ঠতার আসনে সমাসীন’ বলে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিয়েছেন।[২]
হেমেন্দ্রকুমারের কর্মসূচি
আবার যকের ধনের অমূল্য ভূমিকাটি মন দিয়ে পড়লে, বিশেষ করে চরিত্র-চিত্রায়নে, লেখকের যে মনোভাব এবং তার জন্যে যে কর্মসূচি কাজ করেছিল, তা পরিষ্কার হয়ে যায়ঃ
বাঙালী ছেলেদের দেহের সঙ্গে মনও যাতে বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে, স্বদেশকে ভালোবেসেও তাদের চিত্ত যাতে বিপুল বিশ্বের জলে-স্থলে-শূন্যে বেপরোয়া হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, মৃত্যুবন্ধুর বিপদের পন্থায় তাদের আনন্দের উৎস যাতে অসঙ্কোচে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, নানা বিরোধী ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতেও সমান-অটল থেকে তারা যাতে নিজেদের গঠন করতে শেখে, আমার এ-শ্রেণীর উপন্যাস রচনার আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাই । ... ইস্কুলের মরা পুঁথির কালির আঁচড়ে ছেলেরা মানুষ হয় না, তারা মানুষ হয় পাঠশালার বাইরে বিপুল বিশ্বের ভিতরে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে বিচিত্র "living book" পাঠ ক'রে। বিজ্ঞ প্রাচীনরা যা চান না, বাঙালীর ছেলেদের আমি তাই হ'তে বলি। তারা ডানপিটে হোক্! তারা আপদ-বিপদের কোলে মানুষ হোক্! তারা বীরত্বে মহান্ হোক![৩]
আবার যকের ধন হলো হেমেন্দ্রকুমারের সবচেয়ে জনপ্রিয় (এবং, মনে হয়, তাদের স্রষ্টার কিশোর সাহিত্যে প্রথম মানস-সন্তানদ্বয় হিসেবে লেখকেরও অতি প্রিয়) জুটি বিমল-কুমারের চতুর্থ অভিযান। আশা গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের জানিয়েছেন যে তাদের প্রথম তিনটি অ্যাডভেঞ্চার ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় ১৯২৩-২৪, ১৯২৫-২৬, ও ১৯২৬-২৭ সালে।[৪] আবার যকের ধন-এর আখ্যানে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের উল্লেখ নেই (যা হেমেন্দ্রকুমারের একাধিক কিশোর-উপন্যাসে কিন্তু আছে)। যেহেতু বাংলা প্রকাশনার গ্রন্থপঞ্জী প্রায়শই অলভ্য, উপন্যাসটির রচনাকাল অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখিত ১৯৩৬ বলেই মেনে নেওয়া হলো[৫], অর্থাৎ, আগের কাহিনীগুলির মতোই পরাধীন ভারতবর্ষে। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের সম্বন্ধে যা মনোভাব পোষণ করত, তা মেকলের নিম্নে-উদ্ধৃত মন্তব্য থেকে স্পষ্টঃ
The physical organisation of the Bengalee [sic] is feeble even to effeminacy…His pursuits are sedentary, his limbs delicate, his movements languid. During many ages he has been trampled upon by men of bolder and more hardy breeds. Courage, independence, veracity, are qualities to which his constitution and his situation are equally unfavourable. His mind bears a singular analogy to his body. It is weak even to helplessness for purposes of manly resistance …[৬]
যকের ধনউপন্যাসের কথক এবং দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র কুমার, অন্তত প্রথমার্ধে, খানিকটা হলেও, মেকলের চরিত্রায়নকে সমর্থন করে। কাহিনীর খলনায়ক করালী মুখুজ্যে কুমারের ঠাকুরদাদার সাঙ্কেতিক নির্দেশ-সম্বলিত মড়ার মাথাটি কাহিনীর প্রধান চরিত্র বিমলের কাছ থেকে চুরি করে। নির্ভীক বিমল কুমারকে জানায় যে তারা, কুমারের ভাষায়, “চোরের ওপর বাটপাড়ি” করবে। ভয় পেয়ে কুমার বলে যে এত দুঃসাহসে কাজ নেই; “শেষটা কি পাড়ায় একটা কেলেংকারি হবে?” ক্ষিপ্ত বিমলের সঙ্গে এরপর কুমারের বাদানুবাদ লক্ষ্যণীয়ঃ
বিমল বেজায় চটে গিয়ে বললে, ‘দূর, ভীতু কোথাকার! এই সাহস নিয়ে তুমি যাবে রূপনাথের গুহার যকের ধনআনতে? তার চেয়ে মায়ের কোলের আদুরে খোকাটি হয়ে বাড়িতে বসে থাকো …
‘… যদি মানুষ হতে চাও, ডানপিটে হও।’
আমি হেসে বললুম, “কিন্তু ডানপিটের মরণ যে গাছের আগায়!’
বিমল বললে, ‘… মরতেই যখন হবে, তখন বিছানায় শুয়ে মরার চাইতে বীরের মতো মরাই ভালো। তোমরা যাদের ভালো ছেলে বলো, সেই গোবর-গণেশ মিনমিনে ননীর পুতুলগুলোকে আমি দুচোখে দেখতে পারি না! সায়েবের জুতো খেয়ে তাদেরই পিলে ফাটে, বিপদে পড়লে তারাই আর বাঁচে না, মরে বটে, তাও কাপুরুষের মতো! এরাই বাঙালীর কলঙ্ক! জগতে যেসব জাতি আজ মাথা তুলে বড় হয়ে আছে, বিপদের ভেতর দিয়ে, মরণের কুছ পরোয়া না রেখে তারা সবাই শ্রেষ্ঠ হতে পেরেছে! বুঝলে কুমার? বিপদ দেখলে আমার আনন্দ হয়!’[৭] (১ম-৩য় অনুচ্ছেদে জোর দেওয়া বর্তমান প্রবন্ধকারের)
বিমল বাঙালি ছেলেদের যে বদগুণগুলির তীব্র ও কঠোর সমালোচনা করেছে, সেগুলি কি আমাদের মেকলের বাঙালি-চরিত্র বর্ণনাকে প্রতি পদে মনে করিয়ে দেয় না? এর প্রতিবাদ কিন্তু বাঙালি যুব-সমাজে উঠতে আরম্ভ করেছিল ১৯২৩ সালে যকের ধন রচিত হবার অনেক আগে থেকেই। শুধু একজনের উদাহরণ দিইঃ যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ১৯০৬ সালে একহাতে ব্যাঘ্র-বধ করে ক্ষান্ত থাকেন নি! ১৯০৮-এ শিলিগুড়ি রেলস্টেশনে আবার সেই একহাতেই একদল ইংরেজ সৈন্যকে – যারা বিমলের ভাষায় জুতোর লাথি মেরে বাঙালি ননীর পুতুলদের পিলে ফাটাতে অভ্যস্ত ছিল - মেরে শুইয়ে দেন! কুমার যদি হয় ‘ভেতো বাঙালি’র প্রতিভূ, বিমল হলো বাঘা যতীনের ভাবশিষ্য, এবং হেমেন্দ্রকুমারের কাছে, কুমারের মতো বাঙালিদের আদর্শ।
যকের ধন-এ গুপ্তধনের হদিশ ছিল কুমারের কাছে তার ঠাকুরদাদার সূত্রে। এবার আবার যকের ধন-এ নিজের বড়কাকা সুরেনবাবুর সূত্রে সুদূর আফ্রিকায় গুপ্তধনের মানচিত্রের উত্তরাধিকারী হলেন ভোজনরসিক এবং পরম ভীতু মানিকবাবু, যাঁর মতে আফ্রিকার ‘প্রত্যেক ঝোপই হচ্ছে কোন-না-কোন ভয়ঙ্কর জানোয়ারের বৈঠকখানা এবং প্রত্যেক গাছই হচ্ছে ভূত-প্রেতের আড্ডা!’[৮] তিনি কাতরভাবে প্রশ্ন করেন যে বিমল-কুমারের কাছে তিনি কোন দোষ না করা সত্ত্বেও তারা কেন তাঁকে “দেশ থেকে এখানে টেনে এনে অপঘাতে মারতে চান”! (পৃঃ ৫৮) প্রত্যুত্তরে বিমল তাঁকে প্রবচন শোনায় যে “কাপুরুষ মরে দিনে একশো বার, কিন্তু সাহসী মরে জীবনে একবার মাত্র” এবং মরণের ভয় কাটাতে মরণকে নিয়ে খেলা করার পরামর্শ দেয়! (পৃঃ ৫৯) জঙ্গলে নিজের তাঁবু থেকে একরাত্রে মানিকবাবু অদৃশ্য হওয়ায় বিমল ও কুমার তাঁকে খুঁজতে বেরোয়। কুমার সহানুভূতির সঙ্গে মানিকবাবুকে “বেচারা” বলায় (পৃঃ ৬৫), বিরক্ত বিমল বলেঃ
“শুধু বেচারা নয়, গো-বেচারা! এইরকম সব গো-বেচারা সন্তান প্রসব করছেন বলেই বাংলা-মায়ের আজ এমন দশা! আমাদের বঙ্গজননীকে ব্যাঘ্রবাহিনী বলে বর্ণনা করা হয়, কিন্তু কোথায় সে ব্যাঘ্র?”
কুমার বললে, “আলিপুরের চিড়িয়াখানায় বন্দী হয়ে হালুম-হুলুম করছে।”
বিমল বললে, “কিন্তু [সে] যেদিন খাঁচা ভেঙ্গে বেরোবে, মায়ের ভক্ত এই গো-বেচারার দল কি করবে?” (৬৬)
মানিকবাবুর বিপরীত মেরুতে বিমল তো আছেই, তার প্রভাবে কুমারের চিন্তাধারা কী পরিণতি লাভ করেছে, তা প্রকাশ পায় আবার যকের ধন-এর সর্বজ্ঞানী কথক কর্তৃক কুমারের মনের এই ভাবগুলির বর্ণনায়ঃ
… কুমার বরাবরই দেখে এসেছে, বিপদ যত গুরুতর হয়, বিমলের মাথাও হয়ে উঠে তত-বেশী শান্ত। … কুমারের কাছেও বিপদ অপরিচিত নয়। আসামের জঙ্গলে যকের ধনআনতে গিয়ে, মঙ্গলগ্রহে বামনদের হাতে বন্দী হয়ে এবং ময়নামতীর মায়াকাননে পথ হারিয়ে যতরকম মহাবিপদ থাকতে পারে, সে-সমস্তেরই সঙ্গে তাকে পরিচিত হতে হয়েছে, সুতরাং আজকের এই মস্ত বিপদ দেখেও কুমারের মনের ভাব যে-রকম হল, তা কাপুরুষের মনের ভাব নয়। (৬৭-৬৮)
এ কুমার আর সেই কুমার নেই যে করালীর বাড়িতে নিজের ঠাকুরদাদার পাওয়া মড়ার মাথা উদ্ধার করার জন্য ঢুকতে ভয় পেয়ে বিমলের কাছে “মায়ের কোলের আদুরে খোকা”-র অভিধা পেয়েছিল! অর্থাৎ, উপন্যাসের ভূমিকায় হেমেন্দ্রকুমার বাঙালি ছেলেদের যা হতে বলেছেন, এবং যকের ধনে কুমার যা ছিল না, এই চতুর্থ অভিযানে আসতে-আসতে সে তাইই হয়ে উঠেছে। অপরিবর্তনীয় ভেতো বাঙালির স্থান পূরণ করেছেন মানিকবাবু। তাঁকে নানাভাবে উৎসাহিত, এবং প্রয়োজনে ভর্ৎসনা করলেও, তিনি যখন আবার সিংহদমন সর্দার গাটুলার সামনে নিজের ভীরুতা প্রকাশ করে ফেলেন, তখন কিন্তু বিমলের জাত্যাভিমান মাথা চাড়া দেয়ঃ
“না, সর্দার, বাঙালী কখনো ভীতু হয় না! মানিকবাবুও ভীতু নন, তবে দেশের জন্যে ওঁর মন কেমন করছে বলেই উনি এমনি সব নানান মিথ্যে ওজর তুলছেন।” (৯৭)
বিদেশী প্রভাব এবং তার প্রতি উত্তর-উপনিবেশবাদী ভর্ৎসনা
এখন অবধি হেমেন্দ্রকুমারের শিশু ও কিশোর সাহিত্যে অবদান নিয়ে প্রশংসা করেছি এবং অন্তত আরেকজন সমালোচকের প্রশংসাত্মক লেখা উদ্ধৃত করেছি।[৯] কিন্তু ‘অ্যাডভেঞ্চার’ genre-টিই তো উদ্ভাবিত হয় সেইসব দেশের সাহিত্যে যেসব দেশ আদর্শগত ভাবে সাম্রাজ্যবাদী। তাদের উৎপাদিত অ্যাডভেঞ্চার-কাহিনী হল যেসব, প্রধানত প্রাচ্য, দেশগুলিতে তারা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সেখানকার ‘অসভ্য’, মনুষ্যেতর দু-পেয়ে জীবদের মধ্যে পাশ্চাত্যের আলোকপ্রাপ্ত যুক্তিশাসন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা। আর বাংলায় অ্যাডভেঞ্চার-কাহিনীর লেখকেরা নির্বিচারে এই বিদেশী মনোভাব আত্মস্থ করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির সারসংক্ষেপ হিসেবে আমার এক সময়ের শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মী, অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারেঃ
অসন্দিহান কোয়াটারমেন[১০], কালো মানুষের তুলনায় শাদা মানুষ অনেক বেশী উন্নত; জ্ঞানের ব্যাপারে তো বটেই, ন্যায় বা নীতিবোধের দিক থেকেও আফ্রিকার অধিবাসী ইউরোপীয়র চেয়ে লক্ষ যোজন পেছিয়ে। আফ্রিকার সন্তানেরা অনাথ, নিরাশ্রয়; তাদের পরিত্রাতা ভিনদেশি সাহেবরা। সাহেবদের নিঃস্বার্থ ‘সেবা’, ‘করুণা’ ও ‘বদান্যতা’ প্রসন্ন মনে নির্বিবাদে মেনে নিলে আখেরে তাদেরই লাভ। এই ‘সরল’ সত্যটি যে হৃদয়গত করে না সে-ই কোয়াটারমেনের চোখে ‘সভ্যতা’র শত্রু। … কথায় কাজ না-হলে একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বন্দুক ধরতে হয় তাকে। আর তাই যে-পথ দিয়ে কোয়াটারমেনেরা হেঁটে যায় সে-পথ ভরে ওঠে কালো মানুষের শবে, ভিজে সপসপে হয় কালো মানুষের রক্তে।[১১]
এই ভাবাবেগপূর্ণ বাগ্মিতার কিছু পরে অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় উত্থাপন করেছেন রাইডার হ্যাগার্ডের কিং সলোমন’স মাইনস উপন্যাসের মুখ্য ‘কালো’ মানুষ, জুলু-গোষ্ঠীভুক্ত উমবোপার প্রসঙ্গ। আমাদের ভাষ্যকারের কথায় সে শুধু ‘সাহেব-অনুরক্ত ও বশম্বদ’ই নয়ঃ
[উম্বোপার] শরীরী রেখাচিত্র দিতে গিয়ে কোয়াটারমেন একাধিকবার লেখে যে উম্বোপার গায়ের রঙ অন্যদের মতো কালো কুচকুচে নয়, অনেকটা ফিকে, প্রায় শাদাই। অতি অবশ্যই কোয়াটারমেনের চোখে উম্বোপা এক আদর্শ আফ্রিকী। অন্যদের তুলনায় তার বুদ্ধি ও নীতিজ্ঞান প্রখরতর। শাদা আদমির ‘স্বাভাবিক’ কর্তৃত্ব বিষয়ে নির্দ্বিধ সে। উম্বোপার গাত্রবর্ণ যেন তার নৈতিক উৎকর্ষের প্রত্যক্ষ প্রমাণ, প্রশ্নাতীত আনুগত্যের নির্ভরশীল নিশানা। (২৬২-৬৩)
কিং সলোমন’স মাইনস-এর আখ্যান – যার প্রভাব হেমেন্দ্রকুমারের আবার যকের ধন-এ দেখা যায় ব’লে অনেকে মনে করেন – এখানে সংক্ষেপে বলা প্রয়োজন। উপন্যাসের কথক অ্যালান কোয়াটারমেন দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে বসবাসকারী একজন শিকারী। স্যার হেনরি কার্টিস এবং ক্যাপ্টেন গুড তার সাহায্য চায় কার্টিসের ভাইয়ের খোঁজে একটি অভিযান শুরু করতে। এই ভাই আফ্রিকার অনাবিষ্কৃত অভ্যন্তরে রাজা সলোমনের খনির সন্ধান করতে গিয়ে আর ফেরে নি! কোয়াটারমেনদের অভিযানে অন্যান্য কৃষ্ণবর্ণ কুলিদের মধ্যে ব্যতিক্রমী হল সুপুরুষ, রাজকীয় ও সুভাষী উমবোপা। প্রথমে বলদ-গাড়ি ব্যবহার করে ও পরে পদব্রজে দলটি পৌঁছোয় ‘কুকুয়ানা’ নামক রাজ্যে। এখানকার অত্যাচারী রাজা টোয়ালা ক্ষমতায় এসেছিল ভ্রাতৃহত্যা করে, এবং সেই ভাইয়ের স্ত্রী ও পুত্র ইগনোসিকে নির্বাসিত ক’রে। উমবোপা এবার শ্বেতাঙ্গদের জানায় যে সেইই হল কুকুয়ানার বৈধ রাজা, শৈশবে টোয়ালা-দ্বারা নির্বাসিত ইগনোসি! সে তার ন্যায্য অধিকারের পুনরুদ্ধারে কোয়াটারমেনদের সাহায্য চায়, এবং বলে যে বিনিময়ে সে শ্বেতাঙ্গদের সলোমনের খনিতে যেতে, আর কার্টিসের ভাইয়ের সন্ধান পেতে সহায়তা করবে।
কোয়াটারমেনরা ইগনোসিকে সাহায্য করে রাজা হতে, ইগনোসির হুকুমে টোয়ালার সঙ্গিনী, ক্রূর, কুৎসিত ডাইনি বুড়ি গাগুল কোয়াটারমেনদের খনিতে নিয়ে যায় কিন্তু সেখানে তাদের কৌশলে বন্দী করে। পরে সেখান থেকে পথ খুঁজে বেরোবার সময় কোয়াটারমেনরা সলোমনের বিপুল ঐশ্বর্যভাণ্ডারের যৎসামান্য পকেটে করে আনতে সক্ষম হয়।
তা’ হ’লে ইগনোসি/উমবোপা কোয়াটারমেনদের সফরসঙ্গী হয়েছিল তল্পিবাহক-হিসেবে একেবারেই নয়। সে জানত যে সলমনের খনির পথেই পড়বে তার নিজের হারানো রাজত্ব, যার পুনরুদ্ধারে সে ব্যবহার করতে পারবে তার শ্বেতাঙ্গ সহযাত্রীদের – প্রভুদের নয় একেবারেই – তার নিজের স্বার্থে। সে কার্টিসের অভিযানে যোগ দিয়েছে বটে, কিন্তু অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ ‘কুলি’দের মতো সে কোন পারিশ্রমিক দাবী করে নি। তার উদ্দেশ্য ছিল এই বিত্তবান শ্বেতাঙ্গের সুসজ্জিত অভিযানের অংশ হয়ে আফ্রিকার দুর্গম অঞ্চলসমূহ অতিক্রম করে তার রাজ্যে পৌঁছনো, যা তার একার পক্ষে দুরূহ, এমন কী অসম্ভবও হতে পারত। ইগনোসি তার প্রকৃত পরিচয় জানাবার পর যদি কোয়াটারমেনরা তার পক্ষে না দাঁড়াত, তাহলে একদিকে বৈধ রাজা ইগনোসি ও তার সমর্থক ইনফাদুসের অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্য এবং অপরদিকে দখলদার রাজা টোয়ালার সংখ্যায় বৃহত্তর সৈন্যদলের মাঝখানে পড়ে হাতে-গোনা ক’টি বন্দুক নিয়ে আমাদের শ্বেতাঙ্গ ‘উপনিবেশবাদীদের’ অবস্থা প্রবচনের উলুখাগড়ার মতো যে হতোই, তা কি বলে দিতে হবে? আর এই দুই কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যদলের মধ্যে যুদ্ধে যে কালো মানুষদের রক্তে মাটি ভিজে সপসপে হয়েছে, সেই রক্তপাতের সিংহভাগ ঘটিয়েছে একদল কালো মানুষ আরেক দল কালো মানুষদের!
সলোমনের খনি থেকে ছিটেফোঁটা হিরে উদ্ধারের পর আসছে শ্বেতাঙ্গদের প্রতি ইগনোসির বিদায় বার্তা, যা এখানে উদ্ধৃত করা আবশ্যিকঃ
“No other white man shall cross the mountains, even if any man live to come so far. I will see no traders with their guns and gin. My people shall fight with the spear, and drink water, like their forefathers before them. I will have no praying-men to put a fear of death into men's hearts, to stir them up against the law of the king, and make a path for the white folk who follow to run on. If a white man comes to my gates I will send him back; if a hundred come I will push them back; if armies come, I will make war on them with all my strength, and they shall not prevail against me. None shall ever seek for the shining stones: no, not an army, for if they come I will send a regiment and fill up the pit, and break down the white columns in the caves and choke them with rocks, so that none can reach even to that door of which ye speak, and whereof the way to move it is lost.”[১২]
ইগনোসি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার তিন ইংরেজ সহকারীকে জানিয়ে দিচ্ছে যে তারা তিনজন বাদে কুকুয়ানা রাজ্যে ভবিষ্যতে কোন শ্বেতাঙ্গ প্রবেশাধিকার পাবে না। সে বিশেষ করে উল্লেখ করছে তিন শ্রেণীর উপনিবেশবাদীদেরঃ যারা বাণিজ্যের অছিলায় আগ্নেয়াস্ত্র (সামরিক পুরুষেরা) আর মদ (বণিকেরা) নিয়ে ঢোকে; আর যারা প্রার্থনা করাবার নাম করে দেশের মানুষের মনে (নরকবাসের) ভয় জাগিয়ে তাদের নিজের রাজার অনুশাসনের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে ওই ধর্মযাজকদের পিছু-পিছু আসা সাম্রাজ্যবাদীদের পথ তৈরি করে দেয়। ঔপনিবেশিক সমস্ত কৌশলকে ইগনোসি চিনেছে, এবং সেগুলির প্রতিরোধ সে করবে। কুকুয়ানার মানুষ বর্শা নিয়েই যুদ্ধ করবে, বন্দুক তাদের প্রয়োজন নেই, আর তাদের পানীয় হবে জল, মদ নয়। একজন সাদা মানুষ এলে, ইগনোসি তাকে ফিরিয়ে দেবে। একশোজন এলে তাদের প্রতিহত করা হবে। এক হাজার এলে হবে যুদ্ধ! যদি সলোমনের খনির ঐশ্বর্যের লোভে পুরো সৈন্যদল আসে, ইগনোসি প্রত্যুত্তরে তার সৈন্যদের পাঠিয়ে খনির গর্ত ভরিয়ে, তার গুহাগুলির থাম ভেঙে পাথর দিয়ে রুদ্ধ করে দেবে, যার ফলে রাজা সলোমনের রত্নভাণ্ডার, দুর্গম নয়, অগম্য হয়ে যাবে!
এ তো উপনিবেশবাদের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেওয়া! উত্তর-উপনিবেশবাদী সমালোচকেরা কি আদৌ কিং সলোমন’স মাইনস মন দিয়ে পড়েছেন?
উত্তর-উপনিবেশবাদী সমালোচনাবিদ্যা ও আবার যকের ধন
যে তাত্ত্বিক প্রশ্ন দিয়ে আগের অংশটি শেষ করেছি, তার উত্তর, “না!” সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও এই বিধ্বংসী মানসিকতা লক্ষ্য করেছিঃ আগেভাগে একটি আদর্শবাদ-ভিত্তিক দৃষ্টিকোণের ঠুলি মানসিক নয়নযুগলে পরে নাও। তারপর সাহিত্যের পাঠ্যটিকে টেনে-হিঁচড়ে সেই আদর্শবাদ-ভিত্তিক কাঠামোর মধ্যে ঢোকাও। আর পাঠ্যের যে অংশটি তোমার পূর্ব-নির্ধারিত বক্তব্যকে সমর্থন করে, সেটুকুই নাও। যা তোমার বক্তব্যকে নস্যাৎ করে, সে অংশগুলো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করো।
এই মানসিকতার প্রভাব পড়েছে হেমেন্দ্রকুমারের রচনার বিশ্লেষণের ওপরেও। যকের ধনের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল বাঙালি করালী মুখুজ্যে। আবার যকের ধনেও প্রধান খলনায়ক বাঙালি, মানিকবাবুর ছোটকাকা মাখনবাবু। কিন্তু তার সহায়ক ভৃত্যদের মধ্যে মুখ্য হচ্ছে এক নামহীন ‘কাফ্রী’। এই শব্দটি কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জাতিগতভাবে আপত্তিকর ইংরেজি kaffir-এর বিকল্প রূপ। অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার কীভাবে তাঁর পাশ্চাত্য অনুপ্রেরণার দ্বারা মগজ-ধোলাইয়ের শিকার হয়েছেন, তার প্রমাণ-স্বরূপ কাফ্রীটির বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেনঃ
... সব-চেয়ে ভীষণ হচ্ছে তার মুখ! তার রং আবলুস কাঠের মতো কালো-কুচকুচে ও তার চোখ দুটো আশ্চর্য-রকম জ্বলজ্বলে ও জন্তুর মতো হিংস্র! তার নাকটা বাঁদরের মতো থ্যাবড়া! আর মাংসহীন মড়ার মাথার দাঁতগুলো যেমন বেরিয়ে থাকে, তারও দু-পাটি দাঁত সেভাবে ছরকুটে বাইরে বেরিয়ে আছে … (আবার যকের ধন, ৩৮-৩৯)
অনস্বীকার্য যে হেমেন্দ্রকুমার, এক্ষেত্রে অন্তত, অভিযুক্ত-হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘আমেরিকা বা আফ্রিকার নিবাসীদের … প্রতি ঘৃণার অভিব্যক্তিতে কি বাঙালী ‘ক্যালিবান’-এর আত্মঘৃণার আত্ম-অবমাননার প্রক্ষেপ নেই?’ (২৯০)। বর্তমান প্রবন্ধকার আবার যকের ধন থেকে হেমেন্দ্রকুমারের আরেকটি বর্ণবাদী মস্তিস্ক-ধৌত হবার উদাহরণ দেবে, যার উল্লেখ অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় করেন নি (সন্দেহ হয় যে উপন্যাসের শুরুর দিকে তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করার জন্য কাফ্রী খলনায়কের বর্ণনাটি পেয়ে যাবার পর আর তিনি বইটি একেবারে শেষ অবধি মন দিয়ে পড়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি)। বিমল মুখ্য বাঙালি খলনায়ক মাখনবাবু ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের হাতে বন্দী হয়েছে। তাকে ঘিরে আছে ত্রিশ-চল্লিশজন লোক, যাদের গায়ের রং কষ্টিপাথরের মতো কালো। কোমরে এক টুকরো ন্যাকড়া বাদ দিলে, তারা নিরাবরণ (৭৪)। বিমল মাখনবাবুকে গুপ্তধনের মানচিত্র দিতে অস্বীকার করায় মাখনবাবু তাঁর হুকুমের চাকর রামুকে (আরেকজন বাঙালি) আদেশ দেন বিমলকে ফাঁসি দিতে। ফাঁসির আয়োজন দেখে সেই ‘প্রায়-উলঙ্গ অসভ্য’ কৃষ্ণাঙ্গদের চোখগুলো ‘নিষ্ঠুর হিংস্র পশুর মতো’ প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে (৭৭-৭৮)। এরপর সেই কাফ্রী বিমলকে একটা বাওবাব গাছের কাছে টেনে নিয়ে যায়, রামু সহাস্যে বিমলের গলায় ফাঁস পরিয়ে দেয়, আর কাফ্রী দড়ির অন্য প্রান্ত ধরে তাকে শূন্যে তুলতে প্রস্তুত হয়। এ কিন্তু যৌথ উদ্যোগের নমুনাঃ হুকুম দিচ্ছে হিন্দু বাঙালি খলনায়ক, তা’ তামিল করছে আরেকজন হিন্দু বাঙালি ও একজন মুসলমান আফ্রিকী[১৩], আর দেখে উল্লসিত হচ্ছে একদল অসভ্য, প্রায়-উলঙ্গ আফ্রিকী!
এবার আসা যাক অপোহ বা পাল্টা-যুক্তিতে। কাফ্রী এবং অসভ্য কৃষ্ণাঙ্গ ছাড়াও আবার যকের ধন উপন্যাসে যে আরেকটি প্রধান আফ্রিকী চরিত্র আছে, তার উল্লেখ মানিকবাবুর কাপুরুষতা প্রসঙ্গে আগেই করা হয়েছে! সে হলো মানিকবাবুর বড়কাকার বিশ্বস্ত অনুচর, সিংহদমন সর্দার গাটুলা। অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সতীর্থরা অবজ্ঞাভরে বলবেন, ‘তাতে হল কি? গাটুলা তো আরেক কোয়াটারমেনের উমসলোপোগাস![১৪] এরা সব মগজ-ধৌত কালা আদমি, সাদা মানুষের প্রভুভক্ত সারমেয়! আর বিমল তো এই উপন্যাসে, যাকে বলে, Brown Sahib, কালো মুখে সাদা চামড়া চড়ানো সেই ঔপনিবেশিক সাহেবদেরই রং-রূপান্তরিত প্রতিভূ!”[১৫] প্রত্যুত্তরে কিং সলোমন’স মাইনস উপন্যাসে উমবোপার চরিত্রায়ন মনে করিয়ে দেব।
এবার গাটুলাকে নিয়ে আলোচনা করা যাক। তার প্রথম আবির্ভাবের সময় হেমেন্দ্রকুমারের চিত্রণ মনে হতে পারে অতিরঞ্জিত এবং বিদঘুটেঃ
তার মুণ্ডটা প্রকাণ্ড এক ফুটবলের মতন গোলাকার, তার বক্ষদেশ প্রকাণ্ড এক বৃক্ষের কাণ্ডের মতন চওড়া, তার ভুঁড়িটি প্রকাণ্ড এক পোঁটলার মতন, যেন কোমরে বাঁধা থেকে ঝুলছে ও দুলছে এবং তার প্রকাণ্ড পা দুটো পৃথিবীর ওপর দিয়ে চলছে, আর মনে হচ্ছে দু’দুখানা কোদাল যেন মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে এগিয়ে আসছে। এ লোকটার আগাগোড়া সমস্তই প্রকাণ্ড! (৮৮)
এই হল সিংহদমন সর্দার গাটুলা। তার এই অভিধার কারণ সে সতেরোটি সিংহকে যমের বাড়ির পথ দেখিয়ে দিয়েছে। শারীরিক ভাবে পরাক্রমী হওয়া ছাড়াও গাটুলা বহুভাষিকঃ ফার্সী, ইংরেজি ও জার্মান ছাড়াও সে মানিকবাবুর বড় কাকা সুরেনবাবুর কাছ থেকে বাংলা শিখেছে।
উত্তর-উপনিবেশবাদী বিশ্লেষণে অবশ্য গাটুলা শেক্সপীয়রের The Tempest নাটকে ক্যালিবানের সগোত্র! ইউরোপীয় ডিউক প্রসপেরো নিজের রাজ্য থেকে নির্বাসিত হয়ে ক্যালিবানের দ্বীপে এসে সেখানে সর্বেসর্বা হয়ে বসে, আর ক্যালিবানকে ইউরোপীয় ভাষা শেখায় – মানে এই ভাবে ক্যালিবানের স্থানীয় পরিচয় হরণ করে। সুরেনবাবু, এবং তাঁর আগে যে সব ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে গাটুলা এসেছে, সবাই তার পরিচয়-হরণ করেছে, ভাষার মাধ্যমে। আবার, শেক্সপীয়রের টেম্পেস্ট নাটকের লক্ষণা ব্যবহার করে গাটুলাকে, তার আনুগত্যের নিরিখে, ক্যালিবানের চেয়েও এরিয়েলের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যে সবসময় প্রভু প্রসপেরোর প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছে। কিন্তু, দু’টি তুলনার একটিও শেষ অবধি টেঁকে কি?
প্রথম সাক্ষাতেই গাটুলা ওয়া-কিকুউ জাতের যোদ্ধাদের আক্রমণ থেকে বিমল ও তার সাথীদের প্রাণ রক্ষা করে। পরে সে যে এক বিচক্ষণ কৌশলবিদ, তাও আমরা দেখি। যখন কাবাগো পাহাড় থেকে সম্রাট লেনানার গুপ্তধনের রক্ষীরা বিমলদের আক্রমণ করে, গাটুলা বিমলের ভাড়া করা ‘আস্কারি’ বা সশস্ত্র রক্ষীদের বলে ওই গুপ্তধনের পাহারাদারদের সামনে দাঁড়িয়ে পিছিয়ে পড়ার ভাণ করতে। রত্নগুহার রক্ষীরা পরমোৎসাহে তাদের পেছনে ধাওয়া করলে, গাটুলা বিমল, কুমার, রামহরি, বাঘা আর মানিকবাবুকে নিয়ে বিনা রক্তপাতে গুপ্তধনের দিকে যাত্রা করে। উত্তর-উপনিবেশবাদী পণ্ডিতরা খেপে গিয়ে বলবেন, ‘আর [সাদা বা পিঙ্গলবর্ণ] সাহেবরা যে এই সব উমসলোপোগাসদের প্রভুভক্ত কুকুরের সগোত্র মনে করে! গাটুলা তো নিজেকে বিমল ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের “গোলাম” বলেছে, তার বেলা?” উত্তরে বলব, ‘একেই বলে নিজের বক্তব্যের সমর্থনে নির্বাচিত মূলপাঠটিকে খুব পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে বাছাই করে পড়া! গাটুলা নিজেকে শুধুই “গোলাম” বলে নি! বলেছে যে সে “সাহসীর গোলাম” (৯৭)। প্রয়াত সুরেনবাবু বা জীবিত বিমল-কুমারের মৃত্যুভয়-উপেক্ষা-করা উদ্দীপনা গাটুলার নিজেরও আছে। সে এই প্রবৃত্তির মূল্য দেয়, তা দিয়ে সে আপন সত্তার বৈধতা প্রতিপন্ন করে। তাই আর কারোর মধ্যে এই প্রবৃত্তির উপস্থিতি দেখলে সে আসলে এই প্রবৃত্তির কাছে নিজেকে নিবেদন করে।’ এর সঙ্গে যোগ করব, কাবাগো পাহাড়ে যাবার সময় গাটুলা যেভাবে বিনা রক্তপাতে পথ পরিষ্কার করল, তার জন্য বিমলের মনে ওই বৃদ্ধ সর্দারের প্রতি ‘শ্রদ্ধা-ভক্তির সঞ্চার’ (১০৮)। ক্যালিবান তো দূর-অস্ত, বশম্বদ এরিয়েলের প্রতিও প্রসপেরো কোনদিন অনুরূপ মনোভাব বোধ বা প্রকাশ করেছে কি?
উপন্যাসের অন্তিম লড়াই ঘটে এক রহস্যময় জীবের সঙ্গে, কাহিনীর প্রতিপক্ষরা যার নামকরণ করেছে মধ্যম-পাণ্ডব ভীম ও তার রাক্ষসী স্ত্রী হিড়িম্বার সন্তানের নামেঃ ঘটোৎকচ। মাখনবাবুরা যে এক বাক্স ধনরত্ন উদ্ধার করতে পেরেছিলেন, তার লোভে ঘটোৎকচ তাদের ছুরি মেরে হত্যা করে পালাবার মতলবে ছিল। গাটুলা তাকে আক্রমণ করলে সে প্রায় গাটুলাকে শেষ করে ফেলছিল, হঠাৎ বিমলকে দেখে সে সর্দারকে ছেড়ে বিমলকেই হত্যার চেষ্টা করে। ‘কুস্তি, যুযুৎসু ও বক্সিঙে সুদক্ষ … অসুরের মতো বলবান’ (১২৫) বিমল এই আপাতদৃষ্টিতে গোরিলাটিকে মল্লযুদ্ধে পরাস্ত ও বধ করে। কিন্তু সংশয়ী কুমার বলে যে গোরিলা কখনো পোষ মানে না (ঘটোৎকচ তো মাখনবাবুদের আজ্ঞাবহই ছিল প্রথমে), গোরিলার মতো বন্য পশু ধনরত্নের লোভে কখনো খুন করবে না, আর, সর্বোপরি, মানুষ বিমলের এক আছাড়ে গোরিলার মতো মহাশক্তিশালী জীব মরবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অবশেষে দেখা যায় যে ঘটোৎকচ আসলে গোরিলার চামড়া-পরা, বিমলের ভাষায় “সেই মড়া-দেঁতো ঢ্যাঙ্গা কাফ্রীটা” (১২৮)! ব্যাস! উত্তর-উপনিবেশবাদীরা জিতে গেলেন! যতই গাটুলাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করো, ওই তো, বাঙালি খলনায়ক মাখনবাবুর সঙ্গেও যে যকের ধনের করালীর মতো বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাকে হেমেন্দ্রকুমার বানিয়েছেন এক কুৎসিত ‘কাফ্রী’, যে ধর্মে মুসলমান, এবং, সবচেয়ে মারাত্মক, সে পশু সেজে যাবতীয় কুকর্ম করে! কি ভয়ঙ্কর ত্রিস্তরীয় stereotyping!
হেমেন্দ্রকুমারের ইতিহাস-ভিত্তিক আখ্যানসমূহ
'ঔপনিবেশিক সাহিত্যে যে উপনিবেশের মানুষদের ইতিহাস মুছে দেওয়া হয়, তাতে সন্দেহ নেই, সাহিত্য সেক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক দর্প ও ক্ষমতার দর্পণমাত্র। কিন্তু কোনো উপনিবেশের সাহিত্যেও যদি একই পদ্ধতি প্রযুক্ত হয়, তাহলে কি অন্যান্য উপনিবেশের সঙ্গে সেই দেশেরও ইতিহাস খানিক মুছে যায় না? আমেরিকা বা আফ্রিকার নিবাসীদের নস্যাৎ করার ক্রিয়াকরণে বাঙালিরা কি, হলেও বা অচেতনে, নিজেদেরও নস্যাৎ করে না?'[১৬]
হেমেন্দ্রকুমারের উপন্যাসে ফেরার আগে তিনি তাঁর ‘রক্ত পাথারের সাঁতারু’ শীর্ষক ঐতিহাসিক রচনায় আমেরিকার উপনিবেশবাদীদের সম্বন্ধে কী লিখেছেন একবার দেখা যাক![১৭] রচনাটি শুরু হচ্ছে এই বাক্য দিয়েঃ
‘আমেরিকা শ্বেতাঙ্গদের দেশ নয়। তিন-চারশো বৎসর আগেও তারা সেখানে বাস করত বিদেশির মতো।’
এরপর তিনি পণ্ডিতদের মত উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন যে--
‘আমেরিকার আদিবাসীরা এসেছিল এশিয়া মহাদেশ থেকে। তাদের জন্মভূমি ছিল বৃহত্তর ভারতের কোন দ্বীপে, এটাও অনেকে অনুমান করেন।’ (৩৪৯)
পরে এই ভারত-যোগের কথা আর লেখক তোলেন নি, বরং লিখেছেন, ‘কলম্বাসের ভ্রমের জন্যে আদিবাসীদের ‘রেড ইন্ডিয়ান’ বা ‘লাল ভারতীয়’ নামে ডাকা হয়। কিন্তু তারা ভারতসন্তান নয়, কাজেই আমরা তাদের শুধু ‘লাল মানুষ’ বলেই ডাকব।’ (৩৫০)
রচনার পরবর্তী অংশের নাম ‘কলম্বাসের শয়তানি’, এবং তা শুরু হচ্ছে এই ভাবেঃ
জার্মানির কুখ্যাত হিটলার ইহুদি জাতিকে সমগ্রভাবে ধ্বংস করবার চেষ্টা করে ছিলেন বলে নিন্দিত হন।
অশ্বেত জাতিদের উপরে পাশবিক অত্যাচার করা হচ্ছে বলে দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার অন্যান্য শ্বেতাঙ্গরাও কি চরম নিরীহ ও পরমসাধু? সাম্য ও মৈত্রীর উপাসক?
আমেরিকা হচ্ছে লাল-মানুষদের স্বদেশ। শ্বেতাঙ্গরাই এই সেদিন সেখানে উড়ে গিয়ে জুড়ে বসেছে। কিন্তু তাদের ঠকামি, নির্লজ্জতা ও নিষ্ঠুরতার কাছে হিটলার ও দক্ষিণ আফ্রিকার বুয়ররাও হার মানবে। লাল-মানুষদের স্বদেশের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা তাদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করবার চেষ্টা করেছে। এবং তাদের সে পৈশাচিক চেষ্টা প্রায় সফলও হয়েছে। (৩৫০-৩৫১)
১৫১৯ খৃষ্টাব্দে কোর্টেজ কর্তৃক ‘চলুলান’ লাল-মানুষদের নিরস্ত্র অভিজাতবর্গের সহস্রাধিকের গণহত্যা বর্ণনা করে হেমেন্দ্রকুমার মন্তব্য করেছেনঃ
ঠিক তিনশত[১৮] বৎসর পরে শ্বেতবর্ণগর্বিত ইংরেজরাও ভারতের জালিয়ানওয়ালাবাগে অবিকল এই দৃশ্যেরই পুনরাভিনয় করেছিল। (৩৫৩)
ফ্রান্সিস্কো পিজারো ইনকা সম্রাট আতাহুয়াল্পাকে বোকা বানানোর জন্য যে ভাবে পাদ্রী ভিন্সেন্ত দেল ভাল্ভারদেকে পাঠিয়েছিল, তা নিয়ে লেখক বলছেনঃ
এ হচ্ছে শ্বেতাঙ্গদের চিরকালের চলতি চাল। ভারত ও আফ্রিকারও নানা দেশে অমঙ্গলের আয়োজন করবার আগে লোকের চোখে ধাঁধা দেওয়ার জন্যে অগ্রদূত রূপে পাঠানো হয়েছে খ্রিস্টানদের পাদরি। তিনি প্রথমে বীজবপন করেন। তারপরেই দেখা দেয় বিষবৃক্ষ। (৩৫৬)
পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই কিং সলোমন’স মাইনস উপন্যাসে ইগনোসি/উমবোপার ঘোষণা যে তার রাজ্যে কাহিনীর তিন প্রধান শ্বেতাঙ্গরা বাদে উক্ত জাতির কেউ ভবিষ্যতে প্রবেশাধিকার পাবে না, বিশেষ করে সামরিক ও বণিকশ্রেণী আর ধর্মযাজকেরা।
‘আমেরিকান’ অভিধার ব্যাখ্যা করে হেমেন্দ্রকুমার বলেছেন যে তারা হলো ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি, এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সমষ্টি। তিনি যোগ করেছেন যে স্পেনদেশীয়, পর্তুগিজ ও ইংরেজদের পরে এই আমেরিকানরাই লাল-মানুষদের মহাশত্রু কারণ সম্ভবত ওইসব জাতেরই রক্ত তাদের ধমনিতে প্রবাহিত। প্রমাণ-স্বরূপ তিনি আমাদের জানাচ্ছেন কীভাবে প্রেসিডেন্ট জ্যাকসন সুপ্রিম কোর্টের রায় উপেক্ষা করে চেরোকি লাল-মানুষদের তাদের নিজস্ব ভূমি থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। এই আখ্যানের সবচেয়ে বীভৎস অংশ হলো প্রাক্তন ‘মেথডিস্ট’ ধর্মপ্রচারক কর্নেল জন মিল্টন শিভিংটন-কর্তৃক অনুষ্ঠিত ‘স্যান্ড ক্রীক’ বা বালির খাঁড়িতে ১৮৬৪ সালের নরমেধ যজ্ঞ। প্রায় ১৫০ থেকে ৫০০ শেয়েন ও আরোপাহো প্রজাতির শান্তিপ্রিয় লাল-মানুষদের – যাদের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল নারী ও শিশু – নির্বিচারে হত্যা এবং অঙ্গচ্ছেদ করা হয়। জয়ের স্মারক হিসেবে শিভিংটন এবং তার সৈন্যরা রাশীকৃত করে লাল মানুষদের শিরস্তক (চুলসুদ্ধ মাথার চাঁদির ছাল) ও অন্যান্য দেহাংশ। যেহেতু লাল যোদ্ধারা বিজিত ও মৃত শত্রুদের শিরস্তক অস্ত্র দিয়ে কেটে নিত, মহাবীর শিভিংটনও দাঁতের বদলে দাঁত নেবার নীতি ফলায় প্রধানত নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ওপর! এই দানবের কীর্তিকেই লেখক রচনার শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। শিভিংটন বলেছিল, “লাল-মানুষদের রক্তে পা ডুবিয়ে আমি হাঁটতে চাই” (৩৫৯)!
বোম্বেটেদের নিয়ে লেখা রক্তবাদল ঝরেতে ইংরেজ দস্যু হেনরি মর্গ্যান জিব্রাল্টারে যেসব বর্বরোচিত দুষ্কর্ম করেছিল তা বর্ণনা করে লেখক মন্তব্য করেছেনঃ
এরাই হচ্ছে প্রেমের অবতার খ্রিস্টদেবের শিষ্য … এবং এরাই ভারতবাসীদের ও আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের[১৯] ঘৃণা করে বর্বর বলে। উপরন্তু এদের মতে এশিয়ার বাসিন্দারা নাকি নিষ্ঠুরতায় পৃথিবীতে অতুলনীয়। কিন্তু যেসব অকথ্য নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে ইংরেজ-রাজের কাছ থেকে মর্গ্যান সম্মান, উপাধি ও উচ্চপদ লাভ করেছে, সেগুলোকে আমরা কি পরম করুণার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বলে মাথায় তুলে রাখব? (২৯৫)
যিশু খ্রিস্ট-র উল্লেখ মনে করায় যে এই বইটিতে হেমেন্দ্রকুমার লিখেছেন (২৮৩) যে গুয়াটামেলার ‘রেড ইন্ডিয়ান’রা কিছু সময় খ্রিস্টধর্মের নিয়ম পালন করে থাকলেও তাদের স্পানিয়ার্ড প্রভুদের অধার্মিকের মতো ব্যবহার ও হিংস্র আর পশুপ্রবৃত্তি দেখে সম্ভবত সেই প্রভুদের ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে নিজেদের পিতৃ-পিতামহের ধর্মেই ফিরে যায়। উপনিবেশবাদের এক প্রধান উপকরণ, প্রাচ্যের ‘অসভ্য’ মানুষদের পৌত্তলিকতা ছাড়িয়ে তাদের ‘সভ্য’ সাহেবদের ধর্মে দীক্ষিত করার, এ বড়ই বিদ্রূপাত্মক পরিণতি!
উত্তর-উপনিবেশবাদী প্রত্যুত্তর অবশ্য মানসিক শ্রবণে শুনতে পাচ্ছিঃ “অন্য দেশের ইতিহাস নিয়ে লেখার সময় হয়তো এইসব (মহিমান্বিত বটতলার?) লেখকেরা কিছুটা সচেতনতা দেখাতে পারেন! কিন্তু, যে মুহূর্তে তাঁরা অ্যাডভেঞ্চারের মতো পাশ্চাত্য-থেকে আমদানি করা আখ্যানের অনুকরণে লিখতে বসেন, তাঁরা ভুলে যান কিভাবে পশ্চিমী ভাষা, লক্ষণা প্রভৃতি তাঁদের স্বজাতি এবং অভিপ্রেত পাঠককুলকে অধঃপতিত করে!”
আবার কল্পিত আখ্যানঃ সূর্যনগরীর গুপ্তধন[২০]
‘অবনমিত জাতিদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের নমুনা কম-বেশি প্রায় সব বাঙালি শিশু-সাহিত্যিকের অভিযান-কাহিনিতে মিলবে।’ (২৮৬) এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় যে বহুসংখ্যক উক্ত genre-এর বাংলা উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তার মধ্যে হেমেন্দ্রকুমারের লেখা আছে দুটিঃ আবার যকের ধন নিয়ে আলোচনা ইতিপূর্বেই করা হয়েছে। তার প্রেক্ষাপট ছিল আফ্রিকা। সূর্যনগরীর গুপ্তধন উপন্যাসের মূল ঘটনাবলীর ক্ষেত্র দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়াডোর। এখানেও ভাষ্যকার উপন্যাসের মোটামুটি শুরুর দিকেই, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে, তাঁর তত্ত্বের সমর্থনে উক্তি পেয়ে গেছেন!
“দুর্গম গহন অরণ্য, তার মধ্যে আছে হিংস্র জন্তু, নির্জন মরুর চেয়েও শুষ্ক বিশাল পর্বত-রাজ্য – তারই আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকবে লাল-মানুষদের সতর্ক চক্ষু। সে সব নিষ্ঠুর চোখ যখনই আমাদের আবিষ্কার করবে তখনই ছুটে আসবে উত্তপ্ত বুলেটের ঝটিকা!”[২১] ((জোর বর্তমান প্রবন্ধকারের)
এই উক্তি করেছেন বিদেশী (সম্ভবত ইংরেজ) ভূ-পর্যটক মিঃ ফিলিপ। কিন্তু, এর আগেই, প্রথম পরিচ্ছেদে তিনি লাল-মানুষদের সম্বন্ধে কী বলেছেন?
“আজ যারা আমেরিকার কর্তা হয়ে বসেছে, আসলে তারা আমেরিকার আধুনিক পোষ্যপুত্র ছাড়া আর কেউ নয়। পণ্ডিতরা প্রমাণ করেছেন, আমেরিকার প্রাচীন ও প্রথম সন্তানরা এসেছিল এশিয়া থেকে।
…
“আমরা আমেরিকার আদিম বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ান বা লাল-মানুষদের অসভ্য বলে মনে করে থাকি। এ বিশ্বাস ভুল … ষোলো শতাব্দীতেও স্পেনীয় দস্যুরা যখন আমেরিকা আক্রমণ করেছিল, তখন তারা অ্যাজটেক ও ইনকা-সাম্রাজ্যের সভ্যতা ও ঐশ্বর্য দেখে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।” (১২৬-১২৭। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে জোর দেওয়া বর্তমান প্রবন্ধকারের)
সারা উপন্যাস-জুড়েই ফিলিপের মানসিকতায় প্রকট হয় হেমেন্দ্রকুমারেরর ঐতিহাসিক আখ্যানে পাওয়া সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি। আরও উপভোগ্য এই ইউরোপীয় ভদ্রলোকের বিমল-কুমারকে নিয়ে উচ্ছ্বাস যা বিমলকেও লজ্জিত করেঃ
“বিমলবাবু! কুমারবাবু! এই গোটা পৃথিবীর ওপর আমি সারাজীবন ছোটাছুটি করে বেড়িয়েছি বটে, কিন্তু আপনাদের সামনে আমি হচ্ছি চাঁদের কাছে জোনাকির মতন তুচ্ছ! … আমার দৌড়াদৌড়ি তো কেবল মানুষের চেনাশোনা পৃথিবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ কিন্তু আপনারা … পৃথিবীর বাইরে মঙ্গল গ্রহে গিয়েও … হানা দিতে ছাড়েন নি! আপনাদের অগম্য স্থান বোধ হয় ত্রিভুবনের কোথাও নেই!” (১২৪)
জানতে ইচ্ছা হয়, পরশুরামের ‘উলটপুরাণ’ সূর্যনগরীর গুপ্তধন-এর আগে না পরে প্রকাশিত! অন্তত হেমেন্দ্রকুমারের ১৯৪৪ সালের এই লেখায়[২২] – দেশ তখনো ব্রিটিশ-শাসিত - উপনিবেশ-স্থাপনকারী শ্বেতাঙ্গের প্রতি পরাভূত পিঙ্গলাঙ্গের বশম্বদতা যে একেবারে উল্টে গেছে, তা স্পষ্ট! এরপর অবশ্য, ফিলিপ যখন বাঙালি বিমল-কুমারের দক্ষিণ আমেরিকায় অভিযানে যাবার ইচ্ছেকে কিছুটা সস্নেহ-ব্যঙ্গের সুরে “কল্পনাতীত” আখ্যা দেবার চেষ্টা করেন, বিমল তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয় উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রেজিলে কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের কথা! (১৩০)
এবার শুরু হয় ইনকাদের এল-ডোরাডো (সোনার দেশ) সন্ধানে বিমল-কুমার-রামহরি-বাঘা-বিনয়বাবু-মৃণু-মিঃ ফিলিপের অভিযান। ইকুয়াডোর থেকে ল্লাঙ্গানাটি পাহাড়ের দিকে রওনা দেবার পর – যে পাহাড়ের কোন-এক গোপন স্থানে আছে দলটির অভিষ্ট লক্ষ্য, ইনকাদের সূর্যনগর, যা ফিলিপের মতে হচ্ছে সেই এল-ডোরাডো – তাদের দেখা হয় প্রধান প্রতিপক্ষ লাল-মানুষ ‘কালো বাজ’-এর সঙ্গে। পাঠক নিশ্চয়ই আবার যকের ধনের সেই কাফ্রীকে ভুলে যান নি? তার চেহারা মনে রেখে, আসুন কালো বাজ কেমন দেখতে তা কাহিনীর কথক কুমারের ভাষায় শুনিঃ[২৩]
লম্বায় সে অন্তত সাত ফুটের কম নয়, কিন্তু … চওড়ায় তার দেহ এমন আশ্চর্য-রকম বৃহৎ যে, তুলনায় লোকটার অস্বাভাবিক দীর্ঘতাও সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আবার, সেই অসাধারণ লম্বা ও চওড়া দেহের অনুপাতে তার মুখখানা হচ্ছে অসম্ভব-রকম বড়! তার চোখ দুটো কুৎকুতে হলেও অত্যন্ত তীক্ষ্ণ তাদের দৃষ্টি – যেন বিষধর সর্পের মতন। মস্ত নাকটা শিকারি পাখির মতন ব্যাঁকানো। উপর ঠোঁটের মাঝখানটা কাটা – ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে বড় বড় দুটি হিংস্র ও হলদে দাঁত। মাথায় পালকের টুপি, দেহে রঙিন ঝলমলে পোশাক, পেশী স্ফীত, বলিষ্ঠ, দীর্ঘ ডান হাতে একটা বর্শা। (১৪৭)
কালো বাজের শারীরিক বিশালতা মনে করায় গাটুলাকে, যার ‘আগাগোড়া সমস্তটাই [ছিল] প্রকাণ্ড’, আর তার কুদর্শনতা স্মৃতিতে আনাবে সেই নামহীন কাফ্রীকে। কিন্তু নির্বাক কাফ্রীর অসদৃশে, এবং গাটুলার মতো, কালো বাজ অতি স্পষ্টবক্তা এবং তদোপরি তার স্বজাতির ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন, এবং হয়তো খানিকটা অতি-মাত্রায় সংবেদনশীল! আমাদের নায়কেরা যে ভারতীয়, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর কালো বাজ বলে যে তারও পূর্বপুরুষেরা এশিয়া থেকে এসেছিলেন। ভারতবর্ষ এশিয়ার মুকুটমণি, সে দেশের ওপর কালো বাজের শ্রদ্ধা আছে! কিন্তু বিমল ও তার সঙ্গীদের সূর্যনগর দেখার আগ্রহের কথা তাকে ক্ষিপ্ত করে তোলেঃ
“আগ্রহ? কিসের আগ্রহ? সূর্যনগর হচ্ছে আমাদের স্বপ্ন-নগর – আমাদের সাধনার তীর্থভূমি – আমাদের কল্পনার আনন্দলোক! তার মধ্যে কোন বাইরের লোকের পদার্পণ করার অধিকার নেই! সেখানে যে কোন বিদেশী আসবে মৃত্যু তার নিশ্চিত!” (১৬৮)
কালো বাজ যদি হয় এই আখ্যানের ক্যালিবান, তাহলে এরিয়েল কি উপন্যাসের আরেক প্রধান আদিবাসী চরিত্র ইকটিনাইক, যে বিমলদের সূর্যনগরে যাবার পথপ্রদর্শক হতে রাজী হয়, কারণ সে একদল নরাকৃতি বনমানুষদের আক্রমণে মরণোন্মুখ হবার পর ফিলিপ তাকে চিকিৎসা করে বাঁচান? কিন্তু ইকটিনাইক শুধু নিজেকে স্বজাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকই মনে করে না, সে সবসময় অভিযানকারীদের মনে করিয়ে দেয় যে তারা ইকটিনাইকের দেশে একান্তই বহিরাগতঃ
“বিদেশী, তোমরা এসে আমাদের দেশ কেড়ে নিয়েছ, স্বাধীনতা হরণ করেছ – আমাদের করে রেখেছ ভেড়া-গরুর মতো। তোমাদের কাছ থেকে সরে এসে বিজন পর্বতের কোলে গহন বনের ভিতরে আমরা একটি ছোট স্বপ্নপুরী রচনা করেছি, সেইখানে লুকিয়ে বসে মাঝে মাঝে আমরা কল্পনায় ভবিষ্যতের স্বর্গকে দেখবার চেষ্টা করি, কিন্তু সে সুখেও তোমরা আমাদের বঞ্চিত করতে চাও! তোমরা আমার দেশের শত্রু, তোমাদের কাছে আমাদের স্বপ্নস্বর্গের পথের সন্ধান দেওয়া কি বিশ্বাসঘাতকতা নয়? কিন্তু … প্রাণের মায়ায় আমাকে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হবে!” (১৬৫-১৬৬)
এ তো এরিয়েলের বাধ্য, বশম্বদ মানসিকতা নয় একেবারেই! এর পরে ইকটিনাইকের মুখ দিয়ে যা শোনা যাবে তা হলো একেবারে বর্তমান সময়ে উত্তর-উপনিবেশবাদী শিবির থেকে যা প্রায়শই দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষিত হয়ে থাকেঃ প্রাচ্যের সবই ভালো, আর যদি মানবিকতা বা নৈতিকতার খাতিরে কোনকিছুকে ভালো বলা না যায় তাহলেও তার স্বপক্ষে (কু)যুক্তি খাড়া করাই হলো আমাদের নৈতিক কর্তব্য! ইকটিনাইক ফিলিপকে জানায় স্বজাতির কাছে ধরা পড়লে তার শাস্তি কি হবেঃ
“আমাকে বন্দী করে সূর্যমন্দিরে নিয়ে যাওয়া হবে, তারপর প্রধান পুরোহিত এসে জ্যান্ত অবস্থায় আমার বুক ছ্যাঁদা করে হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে নিয়ে সূর্যদেবের সামনে উপহার দেবেন।” (১৮২)
ফিলিপ শিউরে উঠে বলেন যে তিনি ভেবেছিলেন বিংশ শতাব্দীর হাওয়ায় ইকটিনাইকেরা এইসব “বর্বর প্রথা’ ভুলে “সভ্য” হয়ে উঠেছে। ঔপনিবেশিক-জাতের ফিলিপ ঘাড়ে ক’টা মাথা ধরেন? ইকটিনাইক ফোঁস করে উঠে জানতে চায় যে তার দেশে শ্বেতাঙ্গরা আসার আগে কি লাল-মানুষেরা অসভ্য ছিল? দোষকুণ্ঠিত ফিলিপ তৎক্ষণাৎ মায়া-অ্যাজটেক-ইনকাদের স্থাপত্য, নগর-সভ্যতা ও শিল্প-শাস্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেও অত্যন্ত ন্যায্যভাবে একটি সমাপ্তিসূচক মন্তব্য রাখেন, “কিন্তু তাঁদের কোন কোন প্রথা যে নিষ্ঠুর ছিল, এ কথা মানতেই হবে!” (১৮৩) ইকটিনাইকের প্রত্যুত্তর অন্তত এই প্রবন্ধকারকে আজকাল টেলিভিশনের পর্দায় দুই পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলের বক্তাদের মনে করায়। একজন আঙুল তুলে বলেন, “তোমাদের দল অমুক সময় অমুক কুকর্ম করেছে!” সঙ্গে-সঙ্গে অপর পক্ষ হুঙ্কার ছাড়েন, “আর তোমার দল যে অমুক সময় …”! ইকটিনাইকও তার হিসেবে, ক্রিকেটের পরিভাষায়, ‘গুগলি’ ছোঁড়েঃ “য়ুরোপেও কি ধর্মের রোম্যান ক্যাথলিক পুরোহিতরা অমানুষিক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেন নি?” (১৮৩)
ফিলিপ আবার অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য জবাব দেন যে Inquisition একালে আর চালু নেই। মানে, সময়ের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গরা নিজেদের অন্তত কিছু কু-প্রথা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। ইকটিনাইকের উত্তর ভাবের ঘরে চুরির চূড়ান্ত উদাহরণঃ
“ … সূর্যনগরে […] আধুনিক কোন যুগধর্মই নেই। এ হচ্ছে বর্তমানের কোলে অতীতের স্বপনপুরী। আধুনিক যুগ আমাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছে। আমাদের ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য কেড়ে নিয়েছে। … [সূর্যনগরে] এসে আমাদের গৌরবময় অতীত কালের পরিমাপ হারিয়ে স্তম্ভিত হয়ে আছে। প্রাচীন যুগ ঠিক যেমন ছিল, আমরা তাকে ঠিক তেমনিভাবেই রেখেছি – তার কোন ভাব, রূপ, রীতি-নীতি নিষ্ঠুর বা সেকেলে হলেও একটুও বদলাতে দিই নি। দুর্দশাগ্রস্ত একালকে আমরা ব্যাধির মতো ঘৃণা করি – আমরা ভালবাসি আমাদের মহিমময় সেকালকে, তাই তার দোষকেও সহ্য করতে নারাজ নই।” (১৮৩; জোর দেওয়া প্রবন্ধকারের)
এই একই মানসিকতা চালিত করে বিংশ শতাব্দী-উত্তর অসংখ্য ভারতবাসীকে। রাজা রামমোহন রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ভক্তসমাগম ঘটে রাজস্থানের দেওরালা গ্রামে। ১৯৮৭ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর এখানে নাকি স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় আরোহণ করেন সতী রূপ কানোয়ার। আর যদি তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ভক্তদের আমরা কুসংস্কার-আচ্ছন্ন বলে তাচ্ছিল্য করি, আমরা কি শৈশব থেকেই জহর-ব্রতকে পরম শ্রদ্ধার চোখে দেখিনি, যার রেশ টেনে বলিউডি অভিনেত্রী তাঁর ছবির সম্বন্ধে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন
"It looks at the power of women. Today again we are standing up for ourselves with dignity... I find her journey so relevant today"?[২৪]
এই ছবিটিতে ওই অভিনেত্রী-রূপায়িত প্রধান নারীচরিত্রকে আমরা বলতে শুনেছি যে স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীদের মরবার অধিকারও নেই! আর, এক বিশেষ শিবিরের – এবং লিঙ্গের - বিদ্বজ্জনেরা তো শুনেছি এখন রামমোহন-বিদ্যাসাগরকে নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখেন!
বর্তমান প্রবন্ধকারের মনে হয় ইকটিনাইকের এই ভাবাবেগ-মথিত বক্তৃতার জন্য উত্তর-উপনিবেশবাদীদের ধর্মশাস্ত্রে তো সূর্যনগরীর গুপ্তধন এক প্রোটো-উপনিবেশ-বিরোধী পাঠ্যের মর্যাদা পাবার দাবী রাখে, বিশেষ করে যেখানে ইকটিনাইকের বক্তব্যের কোন বিরোধিতা কোন চরিত্রই করে না। ফিলিপ না হয় ইউরোপীয় হবার জন্য ঐতিহাসিক অপরাধ-বোধের বিলাসে গা ভাসিয়েছেন, কিন্তু বাঙালি চরিত্রগুলি?
যে গুপ্তধনের সন্ধানে এই অভিযান, সেই ধনভাণ্ডার নিয়ে কিছু কথা। ইকটিনাইক বিদেশী দলটিকে প্রতিজ্ঞা করতে বলে যে সে যদি তাদের নিরাপদে সূর্যনগরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়, বিনিময়ে তারা কিন্তু গুপ্তধনে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। শ্বেতাঙ্গ ফিলিপ এ ব্যাপারে ইতস্তত করলেও বিমল তাঁকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেঃ
“মিঃ ফিলিপ, আসবার আগেই তো আপনাকে বলেছিলুম, আমরা গুপ্তধনের খোঁজে বিপদকে বরণ করি নি। আমরা চেয়েছিলুম … জীবনের নিশ্চেষ্টতা দূর করতে, নূতন বিস্ময়ের সঙ্গে পরিচিত হতে। আমাদের সেই ইচ্ছা সফল হয়েছে। কেন আমরা এদের গুপ্তধন হরণ করব? আমরা কি দস্যু?” (২০৪)
শেষ অবধি তারা গুপ্তধনের দিকে দৃষ্টিপাতই করে না। উত্তর-উপনিবেশবাদী ভাষ্যকার প্রশ্ন করেন, ‘বাংলা উপন্যাসে অ্যাডভেনচার-প্রবণ যুবকদের … মানসযাত্রার শেষে … মনের কি মৌলিক রূপান্তর ঘটে?’ তাঁর ঊহ্য জবাব, “না!”[২৫] প্রত্যুত্তরে বিমল-কুমারের যে মানসিক রূপান্তর তাদের অভিযানের গতিপথে ঘটেছে তার প্রমাণ এবার দেব।
নীলসায়রের অচিনপুরে[২৬]
বিনয়বাবুর সঙ্গে তাদের তৃতীয় অভিযানে[২৭] বিমল-কুমার-বিনয়বাবুরা পুনরাবিষ্কার করেন গ্রীক দার্শনিক প্লেটো-বর্ণিত কাল্পনিক ও রূপকধর্মী মহাদেশ ‘লস্ট অ্যাটলান্টিস’কে। এই দেশকে হেমেন্দ্রকুমার রূপকের মণ্ডল থেকে বার করে কল্পবিজ্ঞানের জগতে স্থাপিত করেছেন। হারা মহাদেশের মানুষেরা বাস করে অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে অর্ধ-নিমজ্জিত এক (আগ্নেয়) পর্বত-দ্বীপের অভ্যন্তরে। তারা প্রাগৈতিহাসিক ক্রো-ম্যাগ্নন নরগোষ্ঠীর অন্তর্গত, কিন্তু তারা প্রযুক্তিগত ভাবে যথেষ্ট অগ্রসর। তাদের জীবনদাতা তাদের স্বর্ণনগরীর মধ্যস্থলে অবস্থিত এক প্রকাণ্ড হ্রদ। একাধিক খাল দিয়ে পুষ্ট এই হ্রদের ওপর আছে সোনা দিয়ে তৈরি সেতু, নগরে আছে চারতলা-উঁচু ইমারত-সমূহ এবং তাদের খাদ্য উৎপন্ন হয় একাধিক কর্ষিত জমি থেকে। কিন্তু, বহিরাগতদের ঠেকিয়ে রাখতে, এবং তাদের মনে আতঙ্কের সঞ্চার করতে, এই ক্রো-ম্যাগ্ননরা তাদের ধরতে পারলে নরমাংস ভক্ষণ করতে দ্বিধা করে না! ক্রো-ম্যাগ্ননদের সৈন্যদল-দ্বারা আক্রান্ত হলে, বিমলের হুকুমে তার ভাড়া-করা সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যুত্তরে তাদের ওপর গুলি চালিয়ে তাদের একাধিক জনকে হত্যা করে। মর্মাহত বিনয়বাবুকে বিমল আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গেলে, তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েনঃ
তখন বিমলের খেয়াল হলো – সত্যই তো, পরের দেশ আক্রমণ করেছে এসে তারা তো নিজেরাই! সুতরাং তাদের বিদেশি শত্রু বলে বাধা দেবার বা বধ করবার অধিকার যে এই পাতালবাসীদের আছে, সেবিষয়ে তো কোন সন্দেহই নেই! তখন সে লজ্জিতভাবে বললে,
“হুঁ, আত্মরক্ষাই বটে! চমৎকার আত্মরক্ষা! আমরা হচ্ছি লোভী দস্যু! ওরা কি আমাদের দেশ আক্রমণ করেছে? আমরাই তো পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছি ওদের সোনার দেশ লুণ্ঠন করতে – একটা প্রাচীন জাতিকে ধ্বংস করতে। ছি, ছি, ঘৃণায়, অনুতাপে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে! ধিক আমাদের!”
“বিনয়বাবু, আমি মাপ চাইছি। লস্ট আটলান্টিস সম্বন্ধে আপনি কি জানেন বলুন। যদি বুঝি ওরা সত্যই কোন প্রাচীন সভ্য জাতির শেষ বংশধর, তাহলে ওদের বিরুদ্ধে আর একটি মাত্র আঙুলও তুলব না, এখনই এখান থেকে বেরিয়ে সোজা জাহাজে গিয়ে উঠব … প্রতিজ্ঞা করছি।” (২৬৬-৬৭)
বিনয়বাবুর তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্য শুনে আলোকিত বিমল বলেঃ
“বিনয়বাবু, আপনার কথাই ঠিক। এই প্রাচীন জাতির উপরে অত্যাচার করা মহাপাপ, আমরা যে ধারণাতীত অপূর্ব দৃশ্য দেখবার আর নূতন জ্ঞানলাভ করবার সৌভাগ্য পেলুম, সেইটুকুই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট পুরস্কার। আমরা দস্যু নই – কাল সকালেই এখান থেকে বিদায় নেব। (২৭৪)
এই উক্তি কি বর্তমান স্থান-কাল-পাত্রের সম্বন্ধে সচেতন হবার ফলে বিমলের মানসিকতার যে ‘মৌলিক রূপান্তর’ ঘটেছে, তার লক্ষণ নয়? পাঠকদের স্মরণ করাই যে যকের ধনের শেষে গুপ্তধন হস্তগত করায় ব্যর্থ হয়ে বিমল বলেছিল, “আঙুর যখন নাগালের বাইরে তখন তাকে তেতো বলেই মনকে প্রবোধ দেওয়া যাক!” (রচনাবলী ১ম খণ্ড, ১৩১) আবার যকের ধনে অন্তত এক সিন্দুক ধনরত্ন উদ্ধার হয়েছিল (যদিও তার ন্যায্য অধিকারী মানিকবাবু)। এরপর লস্ট আটলান্টিসের স্বর্ণনগরীতে বিনয়বাবুর ভর্ৎসনার ফলে ঘটে বিমলের মানসিক বিবর্তন। সূর্যনগরীর গুপ্তধনের শেষে বিমল ফিলিপকে নীলসায়রের অচিনপুরে থেকে তার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলছে যে তাদের লক্ষ্য গুপ্তধন নয়, গুপ্তধনের সন্ধানকে অছিলা করে তাদের চিত্তের বিকাশ। আর তারা যে দস্যু নয়, এই কথা সে আবার বলেছে। ওই উপন্যাসের শুরুতে ফিলিপ বলেছিলেন ভারত আজ পিছিয়ে পড়েছে কারণ ভারতীয়রা গ্রহণ করেছে ‘জড়ের ধর্ম’ (রচনাবলী ১১শ খণ্ড, ১৩১)। বিমল-কুমারের সমস্ত কীর্তিকাহিনীর মূলে আছে এই জড়ত্বের সক্রিয় প্রত্যাখ্যান, এবং একাধিক ক্ষেত্রে - যেমন ‘লস্ট আটলান্টিসে’ আর সূর্যনগরে - কোন বস্তুবাচক ঐশ্বর্যের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী লোভ, বা কোন তথাকথিত ‘অসভ্য’ জাতিকে ‘সভ্যতা’য় দীক্ষিত করে তোলা নয়। আর ‘বাংলা উপন্যাসে অ্যাডভেনচার-প্রবণ’ যুবকেরা ‘কোন নিক্তিতে অপরিচিত অঞ্চলের অধিবাসীদের … জরিপ করে’ (বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৮৩) তাতেও বেশ বড় রকম রূপান্তর কি দেখা গেল না আফ্রিকায় আবার যকের ধনের কাফ্রী ও সর্দার গাটুলা থেকে লস্ট অ্যাটলান্টিসের ক্রো-ম্যাগ্নন হয়ে ইকুয়াডোরের ‘আরুয়াকো’ লাল-মানুষ কালো বাজ আর ইকটিনাইক সম্বন্ধে বিমলদের মানসিকতায়?
উত্তর-উপনিবেশবাদী ব্যাখ্যায় এও বলা হয় যে পাশ্চাত্য থেকে আমদানি-করা অ্যাডভেঞ্চার-আখ্যানে বহিরাগত শ্বেতাঙ্গ, বা, বাংলা রচনার ক্ষেত্রে পিঙ্গলাঙ্গ, তো প্রাচ্যের কোন অজানা দেশে এসে সেটি নিজেদের ক্ষমতার কুক্ষিগত ক’রে, সেই দেশের মানুষের ওপর নিজেদের অধিবিদ্যা, প্রয়োজনে বলপূর্বক আরোপিত ক’রে, তবেই তাদের নিজেদের উন্নততর ‘সভ্যতা’ প্রসারের যে ‘মহৎ’ উদ্দেশ্য, তা সিদ্ধ করার পরিতৃপ্তি লাভ করে। অনেক এ জাতীয় আখ্যানে এই মনোভাব হয়তো প্রকটও হয়ে ওঠে। বিমলের মধ্যে যদি এই মনোভাবের ইঙ্গিত থেকেও থাকে, বিনয়বাবুর ভর্ৎসনার ফলে তার মানসিকতার যে তাৎক্ষণিক সংস্কারসাধন দেখি তা যে ক্ষণস্থায়ী ছিল না, তার প্রমাণ বিনয়বাবুর সঙ্গে বিমল-কুমারের সপ্তম অভিযান, সূর্যনগরীর গুপ্তধন উপন্যাসের শেষাংশ থেকে উদ্ধৃত বক্তব্য, যেখানে বিমল এই অভিযানের আসল উদ্দেশ্য ফিলিপের কাছে ব্যক্ত করেছে। আর কিছু অভিযানে অজানা দেশ, কুক্ষিগত হওয়া দূরের কথা, অভিযানকারীদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। এমন দু’টি উদাহরণ এবার আলোচিত হবে।
অমৃত দ্বীপ[২৮]
অমৃত দ্বীপের পূর্ববর্তী উপন্যাস ড্রাগনের দুঃস্বপ্নে কলকাতায় একাধিক রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের কিনারা করতে গিয়ে বিমল-কুমারের সঙ্গে গোয়েন্দা জয়ন্ত ও তার সতীর্থ মানিক হস্তগত করে চীনে ‘তাও’ ধর্মের প্রবর্তক লাউ-ৎজুর ‘জেড’ পাথরে গড়া একটি মূর্তি এবং উক্ত ধর্মাবলম্বীদের পরম গন্তব্য অমরদের দ্বীপে যাবার একটি মানচিত্র। যে সব অকল্পনীয় – এবং অলৌকিক – বিপদ তারা অতিক্রম করে, সেগুলির ক্ষেত্রে তাদের রক্ষা করে তাদের নিজস্ব ক্ষমতা ও দক্ষতার চেয়েও বড় ও পবিত্র কিছু। এক তাও-সাধকের মূর্ত আত্মার ভাষায়ঃ
“এটা নশ্বর মানুষের বেড়াবার জায়গা নয় … মূর্খ! তোমাদের বধ করতে পারি এই মুহূর্তেই! কেবল প্রভু লাউ-ৎজুর পবিত্র মূর্তি তোমাদের সঙ্গে আছে বলেই তোমরা এখনো বেঁচে আছ!” (১২৭)
বিমল যখন এই সাধককে জানায় যে সাধক বলে লাউ-ৎজুকে তারা শ্রদ্ধা করে, তিনি খানিকটা রূঢ়ভাবেই প্রত্যুত্তর দেন, “কেবল মুখের শ্রদ্ধা ব্যর্থ, তোমাদের মন অপবিত্র! … শীঘ্র চলে যাও এখান থেকে!” (১২৭)
আমাদের বহিরাগত অভিযাত্রীরা যে অজানা দেশের রহস্য ভেদ করে তাকে ‘জানা’র পর্যায়ে নামিয়ে আনতে চেয়েছিল, সেই অমৃত দ্বীপ তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা প্রতিহত ক’রে, তাদের দস্তুরমতো ল্যাজে-গোবরে ক’রে নিজের অঞ্চল থেকে তাদের এককথায় উৎখাত করে! তারা যে মানসিকভাবে কতটাই বিপর্যস্ত তা প্রকাশ পায় বিমলের তুলনায় বদ্ধ-মনা জয়ন্তের বিতৃষ্ণা-উদ্গীরণেঃ
“আপনাদের ‘অ্যাডভেঞ্চার’ আমার ধারণার বাইরে! এখানকার মাটিতে আর পাঁচ মিনিট দাঁড়ালে আমার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে! … ছুটে চলুন নৌকোর খোঁজে!”
…
অমৃত দ্বীপের আরও কত রহস্য অমৃত দ্বীপের ভিতরেই রেখে তারা খুলে দিল নৌকোর বাঁধন। (১২৯)
মান্ধাতার মুল্লুকে[২৯]
তাও-সাধকদের অমৃত দ্বীপ তো এক অলৌকিক জগৎ। বিমল-কুমারের শেষ অভিযান আবার যকের ধন-এর সময় থেকে তাদের পরিচিত পূর্ব আফ্রিকায়। আদিম মানব, কেনিয়ার স্থানীয় ভাষায় ‘কামা মুনটু’দের খোঁজে এসে আমাদের অভিযানকারীরা পড়ে বাস্তব দুনিয়ার ‘মউ-মউ’ বিদ্রোহীদের কোপের মুখে। ইংরেজ-শাসকের বৈষম্যমূলক অত্যাচারের বিরুদ্ধে ওই বিদ্রোহ। কিন্তু, কেনিয়ার কিছু ভারতীয় অধিবাসীদের মধ্যে, বিনয়বাবুর ভাষায়ঃ
এক শ্রেণির নির্বোধ লোক আছে, যারা দুইশত বৎসর ইংরেজদের অত্যাচার সহ্য করেও আজ স্বাধীন হয়ে সে দুর্দশার কাহিনী ভুলে গিয়েছে। কেনিয়ার স্বাধীনতা-যুদ্ধে যোগ না দিয়েও তারা নিরপেক্ষ হয়ে থাকতে পারত, কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা … ইংরেজদের সঙ্গে কোন কোন বিষয়ে সহযোগিতা করতেও কুণ্ঠিত হয় নি। ফল হয়েছে … বিদ্রোহীরা ভারতীয়দেরও শত্রু বলে ভাবতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই কয়েকজন ভারতীয় তাদের হাতে মারা পড়েছে।” (১৯৭-১৯৮; জোর প্রবন্ধকারের)
মউ-মউ বিদ্রোহীরা আমাদের অভিযানকারীদের শিবিরের ওপর ঝাঁপিয়ে প’ড়ে ভাড়া করা সেপাই ও কুলিদের পালাতে বাধ্য করে, আর তারপর তাঁবুতে করে অগ্নিসংযোগ। এক ‘কামা মুনটু’ দানবের নিক্ষেপিত বর্শার আঘাত থেকে কুমারকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেয় বিমল-কুমার-রামহরির প্রাণাধিক প্রিয় বাঘা। ভগ্নহৃদয় বিমল-কুমার ইতি টানে তাদের অ্যাডভেঞ্চার-সর্বস্ব জীবনযাত্রায়।
‘বাংলা উপন্যাসে অ্যাডভেনচার-প্রবণ যুবকদের … মানসযাত্রার শেষে … মনের … মৌলিক রূপান্তর’ ঘটার চরম উদাহরণ কি পাওয়া গেল? তাও-ধর্মাবলম্বীদের অমৃত দ্বীপ – এক অলৌকিক জগৎ - পর্যু্দস্ত করেছিল বিমল-কুমার-জয়ন্ত-মানিককে। এর পরে তারা কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো, এবং একাধিক অভিযানে বেরিয়েছিল। পূর্ব-পরিচিত কেনিয়ার অরণ্য এবং ঐ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিধ্বস্ত করে দেয় বিমল-কুমারের অভিযান-সর্বস্ব জীবনযাত্রা, তাদের উদ্যোগের বাহ্যিক নিদর্শন – তাদের ভাড়া করা সৈন্য ও তাদের শিবির – ধ্বংস ক’রে, এবং তদুপরি, তাদের প্রিয়তম সফরসঙ্গীকে কেড়ে নিয়ে! অ্যাডভেঞ্চারের কল্পবিশ্বে লেখক নামিয়ে আনেন নির্মম বাস্তবের নিদান!
উত্তর-উপনিবেশবাদী ভাষ্যকার তো বিভূতিভূষণকেও এক হাত নিয়েছেন! এই ‘সংবেদনশীল’ লেখকেরও চাঁদের পাহাড় উপন্যাসে ‘কোথাও বর্ণবৈষম্যবাদের, কালোদের ওপর শাদাদের অকথ্য নির্যাতনের, বার্তাটুকু নেই। নিষ্কর্ষঃ একদিকে যারা সাড়ম্বরে বিজ্ঞাপিত করে তারা স্বভাব-বাউণ্ডুলে … তারাই আবার নিজেদের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। অন্যের মাপকাঠিতে নিজেকে যাচাই করার দায় থেকে রেহাই পেতে চায় বলেই বিকল্প জীবনযাত্রাকে তারা আমল দেয় না।’ (বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৮৬)
এর উত্তরে হেমেন্দ্রকুমারের মান্ধাতার মুল্লুকে থেকে এই উদ্ধৃতিটি দিলাম। বক্তা ফরাসী মিঃ (পরে অবশ্য কমল তাঁকে ‘মঁসিয়ে’ সম্বোধনই করছে) রোলাঁ। বিষয় উপরে উল্লেখিত পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ায় মউ-মউ আন্দোলনঃ
“… কেনিয়া প্রদেশে কৃষ্ণাঙ্গজাতির লোকসংখ্যার তুলনায় ইউরোপীয়রা তুচ্ছ – অর্থাৎ পঞ্চান্ন লক্ষের ভিতরে মাত্র বিয়াল্লিশ হাজার। এই সংখ্যায় নগণ্য শ্বেতাঙ্গরা অধিকাংশ ভালো জমি জোর করে নিজেদের দখলে রেখেছে… শ্বেতাঙ্গরা হাজার হাজার কফির চারা বপন করতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের একশোর বেশী চারা বপন করবার অধিকার নেই। ইংরেজরা এখানে নিরঙ্কুশ প্রভু, আফ্রিকান[দের] … জন্ম যেন কেবল কুলির মতন খেটে মরবার জন্যেই। রাজকার্যে শিক্ষিত আফ্রিকানরাও ইংরেজদের ছায়ার পাশেও দাঁড়াতে পারেনা … কেনিয়ায় … প্রধান হচ্ছে কিকিয়ু জাতের লোকেরা। তারা অধিকতর শিক্ষিত … তারা আর স্বদেশে প্রবাসীর মতন ক্রীতদাসের মতন থাকতে রাজী নয় – ন্যায়ত ধর্মত নিজেদের যা প্রাপ্য তারা তা আদায় করে নিতে চায় … কিকিয়ুদের বহু লোক মউ-মউ আন্দোলনে যোগ দিয়ে ঘোষণা করেছে – (১) ইংরেজদের কেনিয়া ছাড়তে হবে। (২) আমাদের প্রাপ্য জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। (৩) আমাদের স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। (৪) আমাদের স্বাধীনতা দিতে হবে। ইংরেজরা একেবারেই নারাজ। বিদ্রোহীরা করেছে অস্ত্রধারণ। ইংরেজরাও নির্বিচারে … [কিকিয়ুদের] গ্রাম-কে-গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নারী, বৃদ্ধ ও নিরস্ত্রদেরও ক্ষমা করছে না, যারা মউ-মউ আন্দোলনে যোগ দেয় নি, সন্দেহক্রমে তাদেরও দলে দলে গুলি করে মেরে ফেলছে। বিদ্রোহীরাও … যেখানে সুযোগ পাচ্ছে ইউরোপীয়দের হত্যা করছে। ইংরেজরা বিলাত থেকে অসংখ্য সৈন্য আমদানি করেছে; তাদের সঙ্গে আছে বড় বড় কামান আর বোমারু বিমান প্রভৃতি, বিদ্রোহীরা তাই সম্মুখ-যুদ্ধে তাদের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা করে না, তারা করে গেরিলা-যুদ্ধ।” (১৯৬-১৯৭)
এতো গেল ইংল্যান্ডের মতোই আরেক সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় দেশ, ফ্রান্সের, এক অধিবাসীর বক্তব্য। অবশ্য মনে রাখা ভাল যে দেশের সরকার কুপথগামী হলেও সেই দেশের সব মানুষ সেই পথের পথিক নাও হতে পারে। বাস্তবে জেনারেল ডায়ারদের পাশাপাশি ডেভিড হেয়ারদের কথা স্মর্তব্য, আর হেমেন্দ্রকুমারের জগতে এর আগেই মিঃ ফিলিপের দেখা আমরা পেয়েছি সূর্যনগরীর গুপ্তধন উপন্যাসে। এবার, বিমল যখন জানতে চায় ভারতীয়দের প্রতি মউ-মউ বিদ্রোহীদের আক্রোশ আছে কিনা, আসরে নামেন সর্বজ্ঞ বিনয়বাবু, যাঁর কেনিয়া-নিবাসী ভারতীয়দের সম্বন্ধে উক্তি আগেই উদ্ধৃত হয়েছে। উপন্যাসের শেষে আমরা দেখেছি কীভাবে বিমল-কুমারদের শিবির বিদ্রোহীদের সফল আক্রমণের মুখে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
এ তো গেল সাধারণ প্রেক্ষাপট। আমাদের পরিচিতদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কী রকম? তাদের মোম্বাসা থেকে নাইরোবি ট্রেনযাত্রা শেষ হ’লে লেখক জানাচ্ছেন যে ট্রেনের ‘প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কামরা থেকে নামল শ্বেতাঙ্গ যাত্রীর দল, এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কামরায় ছিল যথাক্রমে ভারতীয় ও আফ্রিকার দেশীয় যাত্রীরা।’ (১৯১) খুব জানতে ইচ্ছে করে, মসিয়েঁ রোলাঁ সহযাত্রীদের সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠেছিলেন কিনা! সম্ভবত, ‘যস্মিন দেশে যদাচার’-এর নীতি মেনে তিনি প্রথম, বড়জোর দ্বিতীয় শ্রেণীর স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করেছিলেন, আর বিমল-কুমার অভিযানের অর্ধেক ব্যয়ভার বহন করেও (১৮৬) এই বৈষম্যের প্রতিবাদ করে নি। করলে লেখক অবশ্যই তার উল্লেখ করতেন। অবশ্য, অরণ্যে প্রবেশ করার পর পিঙ্গলাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গের সাম্যবাদী সহাবস্থানই উপন্যাসে দেখা গেছে!
উত্তর-উপনিবেশবাদী ধারাভাষ্যে বিভূতিভূষণের শঙ্করকে প্রতীক মেনে আরও বলা হয়েছে যে তার অধিকাংশ আদর্শ পুরুষেরা – স্ট্যানলি, লিভিংস্টোন, মার্কো পোলো, আরো অনেকে, এমনকি কাল্পনিক চরিত্র রবিনসন ক্রুসো – ‘অনেকেই তো নির্বিচার ধর্ষণের জন্য উন্মোচিত করে দিয়েছিলেন একের পর এক ভূখণ্ড। … বরেণ্য দুঃসাহসিকদের ফিরিস্তিতে পাওয়া যাবে কলম্বাস ও ভাস্কো-ডা-গামারও নাম; ক্বচিৎ কোথাও কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের উল্লেখ।’ (বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৮৮) পাঠকদের স্মরণ করাই হেমেন্দ্রকুমার ‘রক্ত পাথারের সাঁতারু’তে ঠিক কী ভাষায় কলম্বাসকে বর্ণনা করেছিলেন; ঠিক কীভাবে বিমলের মুখে কর্নেল বিশ্বাসের নাম এনে ইউরোপীয় ফিলিপের বাঙালির দক্ষিণ আমেরিকা অভিযানকে ‘কল্পনাতীত’ বলার সমুচিত উত্তর দিয়েছিলেন। এবার আসি ‘ধর্ষণের’ প্রসঙ্গে। কিং সলোমন’স মাইন্স’-এ প্রকাণ্ড রত্নভাণ্ডারের ছিঁটে-ফোঁটা কোনরকমে পকেটস্থ করে তিন শ্বেতাঙ্গ দেশে ফেরে – সেও ঘটে কৃষ্ণাঙ্গ উমবোপার ইচ্ছানুসারে তার ভূখণ্ড, কুকুয়ানা রাজ্য, তাকে পুনরুদ্ধার করার কাজে সাহায্য করার পরে! বিমল-কুমার-মানিকবাবু ঠিক ওই তিন শ্বেতাঙ্গের মতোই সম্রাট লেনানার বিপুল পরিমাণ গুপ্তধনের থেকে একটিমাত্র সিন্দুক – সেটিও খলনায়ক মাখনবাবুদের উদ্ধার করা (অন্তত কোয়াটারমেন, কার্টিস আর গুড যা পেয়েছিলেন তা তাঁদের নিজেদের হাতে নেওয়া!) – নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হন। এ নাহয় তবু পরোক্ষভাবে ‘বলপূর্বক লুণ্ঠনের’ (যা’ হ’লো rape শব্দটির আরেকটি আভিধানিক অর্থ) উদাহরণ ব’লে মানা গেল! লস্ট আটলান্টিস থেকে বিনয়বাবু-কর্তৃক ভর্ৎসিত হয়ে বিমল শূন্য হাতেই ফেরে। ক্রো-ম্যাগ্ননদের স্বর্ণনগরী এবং তা লুণ্ঠন করার অভিলাষী গোমেজ ও তার সঙ্গীদের গ্রাস করে ক্ষুব্ধ অ্যাটলান্টিক মহাসাগর। ‘তাও’ সাধকদের অমৃত দ্বীপ ও সবশেষে কেনিয়া বহিরাগত অভিযানকারীদের কী অবস্থা করে ছাড়ে তা কিছু আগেই বর্ণিত হয়েছে! সবশেষে, কেনিয়ার বিদ্রোহীরা আর সেখানকার অরণ্য-নিবাসী আদিম মানবেরা তো অভিযানকারীদের বাহ্যিক ও মানসিকভাবে চিরতরে বিধ্বস্ত করে তাড়ায়। শারীরিক হিসেবেও, মসিয়েঁ রোলাঁ জঙ্গলে ম্যালেরিয়া-আক্রান্ত হয়ে, নাইরোবিতে চিকিৎসায় ফল না পেয়ে, স্বদেশে ফিরে মারা যান। ‘বাছাই করা’ পাঠ এবং উদ্ধৃতির বিপদ এইখানেই![৩০]
প্রথম পর্বের শেষে রাখব হেমেন্দ্রকুমার-সৃষ্ট অপর দু’টি চরিত্রের ভারতের ইতিহাস ও স্থাপত্য নিয়ে কিছু উক্তি।
জগৎশেঠের রত্নকুঠী[৩১]
হেমেন্দ্রকুমার-সৃষ্ট আরেক চরিত্র, যার দেখা আমরা ইতিমধ্যে অমৃত দ্বীপে পেয়েছি, তার রোষ উগরে দেয় আক্রমণকারী বিদেশীদের যারা তোষামুদে ভৃত্য, তাদের ওপর। মুর্শিদাবাদে ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রে যোগদানকারী জগৎশেঠের প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ দেখে জয়ন্ত বলেঃ
“রাজপুতানার শুকনো মরুপ্রান্ত থেকে বিদেশি মারোয়াড়ি এসেছিল সুজলা সুফলা বাংলাদেশের অর্থ লুণ্ঠন করতে। তারা লক্ষ্মীলাভ করেছিল বটে, কিন্তু বাংলার প্রতি ছিল না তাদের এতটুকু প্রাণের টান, তাই তারা বংশানুক্রমে প্রথমে রাজার, তারপর দেশের বিরুদ্ধে বারবার চক্রান্ত করতে কুণ্ঠিত হয় নি। অবশেষে আরও কোন কোন দুরাত্মার সঙ্গে মিলে জগৎশেঠরাই বাংলা দেশকে লুটিয়ে দেয় ফিরিঙ্গিরাজের বুটজুতোর তলায়। সেই মহাপাপের ফলেই তো এই দেশদ্রোহী বংশের ওপর পড়েছে বিশ্বদেবের অমোঘ অভিশাপ, ইতিহাসে আছে কেবল তাদের চরম অপযশ, নিয়তি কেড়ে নিয়েছে তাদের ঐশ্বর্যের শেষ স্মৃতিটুকুও, লাভ করেছে সলিল সমাধি! পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা অবধি তাদের ক্ষমা করেন নি! সুদূর মুঙ্গেরে তাদের দুই ভাইয়ের জীবন্ত দেহ গ্রাস করেও তাঁর ক্ষুধা মেটেনি, মুর্শিদাবাদে এসে বিশ্বাসঘাতকের স্থাবর সম্পত্তি পর্যন্ত নিজের জঠরের জলাবর্তে টেনে না নিয়ে তিনি ছাড়েন নি!”
এর কিছুক্ষণ আগেই জয়ন্ত মুর্শিদাবাদের প্রধান পর্যটক-আকর্ষণ হাজার দুয়ারীর স্থাপত্য নিয়েও দুঃখপ্রকাশ করেছেঃ
“যারা একদিন গড়েছিল কবির স্বপ্ন তাজমহল আর আগ্রা-দিল্লীর অপরূপ দুর্গপ্রাসাদ, তাদেরই রুচিহীন, ভাগ্যতাড়িত বংশধররা আজ গড়ে তুলেছে ইংরেজদের অনুকরণে মস্ত বড় এক বিজাতীয় প্রাসাদ … এ হচ্ছে দাস-মনোভাবের অসহনীয় পরিচয়!” (২৯)
অন্ধকারের বন্ধু[৩২]
হেমেন্দ্রকুমারের আরেক সৃষ্টি, হেমন্ত চৌধুরীর মুখে শুনি খাস কলকাতায় আধুনিক স্থাপত্য নিয়ে বিলাপঃ
“ … বাংলাদেশে নতুন এক উৎপাত শুরু হয়েছে। ‘স্কাই[স্ক্রে]পার’ নামে এক অদ্ভুত – এমন কি, বেয়াড়া ধরণের বাড়ি আমরা আমেরিকায় দেখে এসেছি। আমেরিকার বায়স্কোপওয়ালারা এই ‘কনারক মন্দির’ আর ‘তাজমহলের’ দেশে এসেও সেই ঢঙে ‘মেট্রো’ সিনেমার বাড়ি তৈরি করেছে! সেটা আমাদের চোখকে আঘাত দিলেও ‘মেট্রোর’ কর্তৃপক্ষকে দোষ দিতে চাই না। কারণ, তারা হচ্ছে সেই দেশের লোক, যারা বিদেশের ঠাকুর ফেলে, স্বদেশের কুকুর ধরে আদর করে মনুষ্যত্বের পরিচয় দেয়। কিন্তু আজকাল বাঙালিরাও দেখছি কলকাতার পথে পথে স্কাই[স্ক্রে]পারের নকলে ঘর-বাড়ি তৈরি করতে লজ্জিত হয় না! … এই বিদেশী আদর্শের বদ-হজম সহ্য করা অসম্ভব। এমন অনুকরণপ্রিয় জাতি কোনদিনই স্বাধীন হতে পারবে না।” (৯১)[৩২]
প্রথম পর্বের উপসংহার
এর পরেও কি আমরা একমত হ’ব যে বাংলা অ্যাডভেঞ্চার-কাহিনীর অন্যতম লেখক হিসেবে হেমেন্দ্রকুমার, তাঁর সতীর্থদের মতো, শুধুই ‘ঔপনিবেশিক শাসকদের ঔদ্ধত্য, নিঃসংকোচ অহমিকা … এত অনায়াসে আত্মস্থ করেছিলেন, [যে তা’ নিয়ে] লেখার পর লেখায় … সামান্য খটকাও দেখা যায় না’? (বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৮৯)।
তথ্যসূত্রঃ:
[১] হেমেন্দ্রকুমার রায়, আবার যকের ধন, ভূমিকা, (দেব সাহিত্য কুটীর, কলকাতাঃ ১৯৩৬, পুনর্মুদ্রণ, ভাদ্র ১৩৫৬ [August - September 1949])
[২] আশা গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলা শিশু-সাহিত্যের ক্রমবিকাশ (১৮০০-১৯০০) (ডি এম লাইব্রেরী, কলকাতাঃ ১৩৬৬ (1959-60]) ২৮১। দুই ইংরেজ কাহিনীকারের তুলনা এক্ষেত্রে যথার্থ। মেঘদূতের মর্তে আগমন-এর বিষয় মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দাদের পৃথিবী আক্রমণ, যা ওয়েলসের The War of the Worlds (১৮৯৮)-কে মনে করায়, যদিও ইংরেজী উপন্যাসে ভিন গ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীকে তাদের উপনিবেশ বানাতে চেয়েছিল। হেমেন্দ্রকুমারের কাহিনীতে তারা পৃথিবীর প্রাণী ও অন্যান্য বস্তু তাদের নিজের গ্রহে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। ময়নামতীর মায়াকানন উপন্যাসে বিমল-কুমার প্রমুখেরা মঙ্গল গ্রহ থেকে নিজেদের উদ্ধার করে পৃথিবীতে ফেরে বটে, কিন্তু এসে পড়ে প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তু-অধ্যুষিত এক দ্বীপে। এখানে কোনান ডয়েলের The Lost World (১৯১২)-এর প্রভাব স্পষ্ট।
[৩] আবার যকের ধন, ভূমিকা।
[৪] উপরে, পৃঃ ১
[৫] শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্বসমাসঃ উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য (১৯৯১, পরিবর্ধিত কারিগর সংস্করণ, কলকাতাঃ ২০১৩), ২৮৪।
[৬] Macaulay, Thomas Babington. “Warren Hastings.” http://www.columbia.edu/itc/mealac/pritchett/00generallinks/macaulay /hastings/txt_complete.html. Accessed 23 May 2016.
[৭] যকের ধন, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১ম খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৭৪, ৫ম মুদ্রণ, ১৯৮৪) ৯-১৩১ । উদ্ধৃত অংশটি ২৯-৩০ পৃষ্ঠায় আছে। জোর দেওয়া শব্দগুলি প্রবন্ধকারের।
[৮] আবার যকের ধন, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ৭ম খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত, সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮৫) ৯-১২৯। উদ্ধৃত বাক্য ৫৮ পৃষ্ঠায়। পরবর্তী উদ্ধৃতি সবই এই সংস্করণ থেকে।
[৯] উপরে পৃঃ ১-২ দ্রষ্টব্য।
[১০] হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের King Solomon’s Mines (১৮৮৫) উপন্যাসের কথক এবং অন্যতম প্রধান চরিত্র। এই উপন্যাসের পরে একাধিক হ্যাগার্ড-রচিত কাহিনীতে চরিত্রটির পুনরাবির্ভাব ঘটেছে।
[১১] বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৬২।
[১২] Haggard, Henry Rider. King Solomon's Mines (1885: Lost World Classic) – Unabridged: Adventure Novel (p. 176). e-artnow. Kindle Edition.
[১৩] কাফ্রীর প্রথম আবির্ভাবের সময়ই বিমল তার ‘ফেজ’ টুপি দেখে তাকে মুসলমান সাব্যস্ত করেছে। প্রাচ্যবিদ আলোচনায় একেবারে দ্বিগুণ othering – বাঙালি হিন্দু লেখকের কাহিনীর খলচরিত্র একাধারে কৃষ্ণাঙ্গ আর মুসলমান! উপন্যাসের শেষে এই দ্বিগুণ ত্রিস্তরীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে!
[১৪] এই কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রটি জুলু প্রজাতির এক সর্দার, যা’কে পাঠক প্রথম দেখেন কিং সলোমন’স মাইনস-এর পরবর্তী উপন্যাস, ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত অ্যালান কোয়াটারমেন-এ।
[১৫] Brown Sahib বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সেই পুরুষদের যারা পশ্চিমী, বিশেষ করে ইংরেজ, জীবনধারা অনুকরণ করে। অনেক সময় তাদের প্রাচ্যের তুলনায় পাশ্চাত্যের প্রতি খানিকটা অন্ধ পক্ষপাতিত্ব থাকে।
[১৬] বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৯০।
[১৭] ‘রক্ত পাথারের সাঁতারু’, (হেমেন্দ্রকুমার রায়, ঐতিহাসিক সমগ্র, সম্পাদনা শোভন রায়, পত্র ভারতী, কলকাতাঃ ২০১৪) ৩৪৯-৩৬২। পরবর্তী উদ্ধৃতি সবই এই সংস্করণ থেকে)
[১৮] লেখকের ভ্রম। ওটি হবে ‘চারশত বৎসর’; জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা ঘটানো হয় ১৯১৯ সালে।
[১৯] ‘রক্ত পাথারের সাঁতারু’ এবং সূর্যনগরীর গুপ্তধন-এ ‘লাল মানুষ’ লিখলেও, রক্তবাদল ঝরে-তে ‘রেড ইন্ডিয়ান’-এর ব্যবহার ধন্দ জাগায়। হয়তো রক্তবাদল ঝরে আরও আগে লেখা, যেখানে লেখক প্রচলিত ইংরেজি শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। অপর লেখাদুটিতে সম্ভবত তিনি সজ্ঞানেই ‘লাল মানুষ’ প্রয়োগ করেছেন।
[২০] সূর্যনগরীর গুপ্তধন (১৯৪৪), হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী ১১শ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত, সুখময় বন্দ্যোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮৯) ১২৩-২১২।
[২১] উদ্ধৃত বাক্যটি আছে ১৩৪ পৃষ্ঠায়। দু’টি শব্দে প্রবন্ধকার জোরের সঙ্কেত রেখেছে। বাকি সব উদ্ধৃতি এই সংস্করণ থেকেই।
[২২] প্রকাশের বছর উল্লেখিত হয়েছে বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৮৪-তে।
[২৩] যকের ধনের পর এই দ্বিতীয়বার আমরা কুমারকে কথকরূপে পাচ্ছি।
[২৪] https://www.hindustantimes.com/bollywood/deepika-padukone-on-the-women-power-in-padmaavat-i-find-her-journey-so-relevant-today/story-aJkhr0S5hosTtetmAyNNhP.html, 29 August 2020.
[২৫] বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৮৩।
[২৬] নীলসায়রের অচিনপুরে, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী ৮ম খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত, সুখময় বন্দ্যোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮৫, দ্বিতীয় মুদ্রণ একই বছরে)) ১৭৫-২৮২।
[২৭] বিমল-কুমারের কীর্তিকাহিনীর প্রথম আখ্যান যকের ধন। এতে বিনয়বাবু-কমল নেই। তাঁদের প্রথম দেখা পাই বিমল-কুমারের দ্বিতীয় অভিযান মেঘদূতের মর্তে আগমন-এ। এই আখ্যানের শেষ থেকেই শুরু হচ্ছে ময়নামতীর মায়াকানন, যা বিনয়বাবুদের সঙ্গে বিমল-কুমারের দ্বিতীয় অভিযান। এর পর আবার যকের ধন, তারপর অমাবস্যার রাত – দু’টি অভিযানেই আবার বিনয়বাবু-কমল অনুপস্থিত। এর পরেই নীলসায়রের অচিনপুরে, যা’তে বিমল অমাবস্যার রাত-এ তার গোয়েন্দাগিরির কথা কুমারকে মনে করিয়েছে।
[২৮] অমৃত দ্বীপ, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী ৪র্থ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮০) ৭০-১২৯। এই একই খণ্ডে ড্রাগনের দুঃস্বপ্নও পাওয়া যাবে।
[২৯] রচনাবলী ১৩শ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত, সুখময় বন্দ্যোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৯২) ১৬১-২৫৯।
[৩০] বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৮৩-২৮৬।
[৩১] জগৎশেঠের রত্নকুঠী, ৫-৫৮, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ২৫শ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত (এশিয়া, কলকাতাঃ ২০১০)। উদ্ধৃত অংশ ৩০ পৃষ্ঠা থেকে। পরের উদ্ধৃতিও এই সংস্করণ থেকে। এই উপন্যাসটি লেখকের প্রয়াণের পর সম্ভবত ১৯৬৫-৬৬ সালে ধারাবাহিকভাবে শুকতারায় প্রকাশিত হয়।
[৩২] অন্ধকারের বন্ধু, ৫৫-১২২, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১১শ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত, সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া, কলকাতাঃ ১৯৮৯)। উদ্ধৃত অংশ ৯১ পৃষ্ঠা থেকে।
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)