অমিয় দেখেছে, অপমানে মুখ লাল হয়ে গেছে রাজকন্যের। দু-চোখ ছাপিয়ে ঝরনাধারা।
রাজকন্যের চোখের জলের অপচয় দারুণ সাংঘাতিক ব্যাপার।
মহারাজ নাগকেশর সবে বাথরুম থেকে বেরিয়েছেন, এবার তিনি বাগানে চায়ের কাপ নিয়ে বসবেন। মেঘ মেশানো চা।
বেশ কিছুকাল ধরে চায়ে মেঘের ছায়া গুলে না খেলে তাঁর চা খেতে ভালোই লাগে না। চায়ে তাঁর দারুন নেশা। কিন্তু বয়েস বাড়তে দুধ-চিনি সব বন্ধ হয়ে গেছে পাকড়াশী ডাক্তারের আদেশে। বাগানে বসে চা খাওয়ার সুবিধে হলো এই, চাপ চাপ সাদা মেঘের প্রতিবিম্ব কাপে ভাসে, ঠিক যেন গুঁড়ো দুধ। খেয়ে বেশ তৃপ্তি হয়। তবে বর্ষাকালে কিছু করার থাকে না, তখন আকাশ মোটেও দুগ্ধবতী থাকে না।
এখন শীতকাল হলেও আকাশটি বেশ পরিষ্কার। বকের পালকের মতো ছোটো ছোটো মেঘ। ওরা মাথার ওপরেও আছে, পেয়ালাতেও আছে। কে বলতে পারে, হয়ত সুদূর দার্জিলিং থেকে ভাসতে ভাসতেই আসছে এই মেঘ-শিশুরা। দার্জিলিং-চায়ের স্বাদ-গন্ধ নিয়ে। কিন্তু তবু, মন ভালো নেই — মন ভালো নেই। রাজকুমারীর নিগ্রহ মহারাজকে থেকে-থেকে কেবলই পীড়িত করছে। নিগ্রহ মানে হেনস্থা। কিন্তু এরকম হালকা শব্দে মহারাজ আজ নিজেকে ব্যক্ত করতে পারছেন না।
রাজকন্যে ছোটোবেলা থেকেই তাঁর কাছে মানুষ। তিনি ঠিক করেছেন রাজ্যের ভার এবার তিনি এই মেয়েটির হাতেই অর্পণ করবেন। সে একদিকে যেমন তেজস্বিনী, তেমনি তার মন মমতায় ভরা। একেবারে আদর্শ রানি।
মহারাজের কাছে একটা গুপ্ত খাতা আছে। ভীষণই পুরোনো। সাত-আট পুরুষ আগের হবে। মহারাজ সেটার কথা আজ অব্দি কারুকে বলেননি। খাতাটা বেশ আশ্চর্যই বলতে হবে। একটু ভালো করে খুঁজলেই দেখা যায়, এখন প্রতিদিন যা ঘটনা ঘটে সেই সুদূর অতীতেও — হুবহু না হলেও, এবং পারম্পর্য একটু ওলোটপালট হয়ে থাকলেও — কাছাকছি ঘটনা একটা না একটা ঠিক ঘাপটি মেরে বসে আছে। তখন মহারাজের পূর্বপুরুষদের প্রতিক্রিয়া কীরকম হয়েছিল চোখ বুলোলেই বোঝা যায়। এতে মহারাজের খুব সুবিধে হয়। তাঁকে বেশি মাথা ঘামিয়ে কিছু করতে হয় না। সেদিনের পুরো খসড়াটা সামান্য অদল-বদল করে নামিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যায়।
গন্ডারের কাণ্ড শুনে তাড়াতাড়ি খাতাটা বের করে মহারাজ একটু পরেই তাঁর সংলাপ ঠিক করে ফেললেন।
‘ওরে, কে আছিস, বন্দুকে শান দে।’
২
কথাটা বলেই মহারাজ জিভ কাটলেন।
খাতায় বন্দুকের উল্লেখ নেই। আছে, ‘ওরে, অস্ত্রে শান দে।’
মহারাজ ভেবেছিলেন, তাঁর যখন বন্দুক একটা আছে, খাতার কথাটাকে একটু এডিট করে বলাই ভালো। তা সংশোধন করতে গিয়েই ব্যাকরণে ভুল।
তবু যে বোঝার ঠিক বুঝে গেছে। অমিয়।
অমিয় তাড়াতাড়ি মহারাজের দু-নলা বন্দুক নিয়ে হাজির। তার পিছনে না জানি কেন তিওয়ারিও এসেছে।
মহারাজ অমিয়কে শুধোলেন, ‘হিপোটি কার?’
সে কিছু বলার আগেই তিওয়ারি বলল, ‘জি হুজুর, উ তো হিপো নেই আছে। রাইনো আছে।’
মহারাজ মুখ ভার করে বললেন, ‘বাঃ, তুমি তো বেশ শিক্ষিত এবং বেয়াদপ হে। তা রাইনোটিই বা কার শুনি?’
অমিয় বলল, ‘আজ্ঞে, মহারাজ প্রত্যূষপ্রসূন পাঠিয়েছেন রাজকন্যের জন্মদিনের উপহার।’
নাগকেশর মহারাজ চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, ‘পচা পাঠিয়েছে?’
তারপর চোখ বন্ধ করে কী যেন ভেবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘উঁহু, এ তো উপহার নয়। উপহাস।’
তারপর পিছন ফিরে চুপিচুপি গুপ্ত খাতায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে হঠাৎ অমিয়র দিকে ফিরে বললেন, ‘ষড়যন্ত্র। যাও, যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। আজই।’
অমিয় অমনি দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে বলতে লাগল, ‘যুদ্ধ — যুদ্ধ — যুদ্ধ।’
৩
মহারাজ প্রত্যূষপ্রসূনের ডাক নাম পচা। কিন্তু নিজের নাম নাগকেশর মহারাজের নিজেরই রাখা। এই নাম তাঁর বাড়িরও কেউ জানে না। ঘরে-বাইরে সবাই জানে তিনি হলেন কেদারনাথ পূততণ্ডী।
তা মহারাজ নাগকেশর, মানে কেদারবাবু আর প্রত্যূষপ্রসূনবাবু ছোটোবেলার বন্ধু।
আসলে এরা কেউই রাজা-গজা কিছু নন। একসময় তাঁদের পূর্বপুরুষ ওসব ছিলেন। পাশাপাশি রাজ্য। তবু যুদ্ধ-টুদ্ধ কোনোদিন দুই রাজ্যে হয়নি। অনেক দিনের পারিবারিক বন্ধুত্ব। আজও সেটা বজায় আছে। আছে মানে হয়ত খুব তাড়াতাড়ির মধ্যেই সেটা ‘ছিল’ হয়ে যাবে। যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে যে।
যা ছিল দুটি ভিন্ রাজ্য, সেগুলি এখন আড়েবহরে কমতে কমতে সরকারের খাতায় দুটি ব্লক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। একজন হলেন রঘুনাথপুর-১ ব্লকের বাসিন্দা তো অপর জন থাকেন রঘুনাথপুর-২ ব্লকে। পুরোটাই বেশ মনোরম এলাকা। চারিদিকে পাহাড়-জঙ্গল।
দুই মহারাজই কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করতেন। অবসর নেওয়ার পরে, বিশেষ করে মহারাজ নাগকেশর ওরফে কেদারবাবুর মনে হলো, সব কেমন যেন রংচটা। নিরানন্দে ভরা। সময় অফুরন্ত। অগাধ। ধড়-মুড়ো কিছুই বোঝা যায় না সময়ের। এগোচ্ছেন নাকি পিছোচ্ছেন তাও তো দুর্বোধ্য। মাথা নেড়ে তিনি মাঝে মাঝেই বলে উঠতে লাগলেন, ‘দূর দূর!’ এবং তাঁর কেবলই ইচ্ছে করল মনেপ্রাণে সুদূর অতীতে চলে যেতে। সেই যখন পৃথিবীটা ছিল বর্ণময়। দিগন্তের কাছে এক পার্মানেন্ট রামধনু। সে সবাইকে রং ধার দিচ্ছে। আর ডেকে ডেকে বলছে — এসো হে, জীবন ভরিয়ে দাও রঙে রঙে।
বন্ধু প্রত্যূষপ্রসূনও এসব শোনা অব্দি স্বীকার করলেন, হ্যাঁ, এরকম ধারা ঘটলে সে হবে এক দারুন রোমাঞ্চকর ব্যাপার।
ঘটলও একটু একটু করে। দেখতে দেখতে দু-জনই মনে মনে অতীতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। এ তো অভিনয় নয় রে বাপু। ঘোর অনুশীলন। ইচ্ছাশক্তির নানা রকম চমৎকারের কথা তাঁরা দু-জনই মাঝে মাঝে শুনেছেন বটে, এখন নিজেরাই পরখ করে দেখলেন, ব্যাপারটা নিছক আজগুবি নয়।
রাজকুমারীও নয় সত্যিকার রাজকুমারী। সে এখানে দাদুর কাছে থেকে কলেজে পড়ে। দাদুর বাবার নামেই কলেজ। রাজকুমারীর মা-বাবা থাকেন দিল্লিতে।
রাজকুমারীর নাম, অনুষ্কা। কিন্তু মহারাজের সব সময় এই সব কথা মনে থাকে না। তিনি জানেন রাজকুমারীর নাম কাঞ্চনকুন্তলা। প্রত্যূষপ্রসূনবাবুর এই আচ্ছন্ন অবস্থাটা অবিশ্যি কিছুটা ফিকে। তাঁর বাড়ি সব সময় জমজমাট। অনেক লোকজন। তাঁর গৃহিণীও খাণ্ডার রমণী। প্রত্যূষবাবুকে আচ্ছন্ন হতে দেখলেই তিনি তাঁর গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়েন। তখন মাছের শ্বাস নেওয়ার মতো তাঁকে ভাবসমাধি থেকে বাস্তবে উঠে আসতেই হয়। ফলে, দেখতে গেলে প্রত্যূষবাবুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বর্তমান আর অতীতের মধ্যে ডেলিপ্যাসেনজারি।
৪
যুদ্ধ ঘোষণা করে মহারাজ নাগকেশর পত্র লিখলেন প্রত্যূষপ্রসূনের নামে। পত্রবাহক অমিয়।
‘অমিয়, তুমি কি চিঠি নিয়ে সত্যিই যাচ্ছ নাকি?’—এই গল্পের একজন পাঠক শুধালেন অমিয়কে কৌতূহলী হয়ে।
অমিয় কান খোঁচাতে খোঁচাতে এক চোখ বুজে বলল, ‘মাথা খারাপ! ফোন করে দিচ্ছি। ওদিকের কর্তাবাবুর দুই মেয়ের বা নাতিনাতনিদের কেউ ফোনটা ধরবেন। সক্কলেই যুদ্ধুর ব্যাপারটা খুব জানেন। শুনে হাসবেন। ফোনের কথা দুই কর্তার কারুরই মনে থাকে না। তাই করিৎকর্মা ডাকহরকরা হিসেবে আমার খুব সুনাম। প্রায় চোখের পলকেই খবর পৌঁছে যায় তো, তাই তড়িৎকর্মাও বলতে পারেন, আজ্ঞে।’
‘কিন্তু যুদ্ধ —’
‘যুদ্ধ না কচুপোড়া। দাবা—দাবা—বুঝলেন না?’
তা দাবার বোর্ড রণাঙ্গনের চেয়ে কীসে কম হলো। সেই হাতি, সেই ঘোড়া, রাজা-সেপাই-সান্ত্রী সবই তো।
৫
প্রত্যূষপ্রসূন মহারাজের খুব অভিমান। তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু কিনা তাঁরই সঙ্গে যুদ্ধ করবে!
বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে তাঁর চোখ ছলোছলো হয়ে গেল, ‘কিছুই কি শুনবি না তুই আমার, কেদার?’
নাগকেশর মহারাজ ওরফে কেদারবাবু বললেন, ‘নাঃ। আজ তোরই একদিন কী আমারই একদিন। তোর গণ্ডক রাজকুমারীর প্রেস্টিজ হরণ করেছে।’
প্রত্যূষবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘গণ্ডক! সে আবার কী?’
নাগকেশর মহারাজ বললেন, ‘হস্তীমূর্খ বলে একটা কথা আছে। আবার গণ্ডমূর্খও হয়। তোমাকে কি আমি গণ্ডকমূর্খ বলেও ডাকতে পারি, মহারাজ?’
প্রত্যূষবাবু বললেন, ‘তোমার মুখ ফসকে মাঝে মাঝেই সংস্কেতো শব্দ বেরিয়ে যায় জানি। সংস্কেতোরও পোশাকি নাম আবার তৎসম। তবে কি গন্ডারও যা গণ্ডকও তাই? সে যাকগে, কিন্তু আমি বলছি, রাজকুমারীকে দেখে গন্ডার কক্ষনো হাসবে না। হাসতে পারে না। আচ্ছা, অমিয়র কথাই যদি সত্যি বলে ধরে নিই—হাসছিল—তা অমিয়ই বা তখন করছিল কী? একটা ভেংচি কাটতে পারল না ওকে?’
নাগকেশর বাঁকা হাসি হেসে বললেন, ‘আজ্ঞে না। ওসব করে কিছুই হতো না। গন্ডারের গায়ে গন্ডারের চামড়া। ওদের মান-অপমান নেই।’
প্রত্যূষবাবু দুঃখিত হয়ে বললেন, ‘কিন্তু আমার কী দোষ বলো, আমি তো পাঠিয়েছি গন্ডারকে বাঁচাতে। জানি, রাজকন্যে কাঞ্চনকুন্তলা পশুপ্রেমী, পারে তো ও-ই পারবে বিপন্ন বন্যপ্রাণীটিকে বাঁচাতে।’
নাগকেশর বললেন, ‘সে যাই বলো না কেন তুমি, একবার যুদ্ধ ঘোষণা হলে তো আর ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই।’
এই সময় কাঞ্চনকুন্তলা ওরফে অনুষ্কাকে দেখা গেল দরজার কাছে।
কাঞ্চনকুন্তলা নাগকেশর মহারাজকে বলল, ‘পিতামহ, কোনো পথই কি খোলা নেই যুদ্ধ ছাড়া?’
কেদারবাবু বললেন, ‘আছে। কিন্তু যুদ্ধ না হলে আমার অসুখ করবে। ভারী শক্ত অসুখ। রাজি?’
প্রত্যুষবাবু জানেন, অনুষ্কা একবার বকে দিলেই এক্ষুনি কেদারবাবুর যুদ্ধের ভূত মাথা থেকে নেমে যাবে। কিন্তু তাঁর নিজেরই তো মাঝে মাঝেই রণাঙ্গনে যেতে সাধ হয়।
অনুষ্কাও চায়, এই বুড়োরা যেমন থাকতে চান থাকুন। সে নিজেও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই এই নাট্যের অন্তর্গত হয়ে যায়। কাঞ্চনকুন্তলা নামটা বার বার উচ্চারণ করে দাদুকে শুনিয়ে। হাঁটাটা পালটে দেয়। ফাইবার চেয়ারেও এমন ভঙ্গিমায় বসে যেন ময়ূর সিংহাসন।
অনুষ্কা বাইরে বেরিয়ে এসে বেশ সিরিয়াস গলায় অমিয়কে বলল, ‘নাও, লাগালে তো যুদ্ধ! এবার হয়েছে শান্তি, বাবা রোমিও?’
অন্য কাজের লোক তিওয়ারি বলল, ‘দিদি, ইবার সোব কাম হামারা উপর আ গিয়া।’
অনুষ্কা বলল, ‘আমার ছেলেপুলেদের যত্নটত্ন করে যেটুকু সময় বাঁচবে, তোমার সঙ্গে হাত লাগাব, হয়েছে?’
ছেলেপুলে মানে, যত রুগ্ন-পীড়িত পশুপাখি। এখন অনুষ্কার আশ্রয়ে এসেছে, অনেক পশুপাখির সঙ্গে আশ্চর্য এক পক্ষীরাজ। শকুন। ডান দিকের ভাঙা ডানাটা তার ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে আসছে। এই বিষয় নিয়েই তার ইউটিউব চ্যানেল, ‘জটায়ু’। প্রচুর তার সাবস্ক্রাইবার। এক লাখ পেরিয়ে গেছে তিন মাস আগেই। চ্যানেলে সাধারণত সে নিজের মুখ দেখায় না। ক্যামেরার পিছনে থেকে শুধু মাত্র পশু-পাখিদের বিষয়ে তার প্রচেষ্টাকে ফ্রেমবন্দী করে। আসল উদ্দেশ্য, পশু-পাখিদের প্রতি সব্বাই যেন আরো মানবিক, আরো দায়িত্বশীল ও যত্নবান হয়ে ওঠেন। কমেন্ট-বক্সে কেউ কিছু পরামর্শ দিয়ে মন্তব্য লিখলে সে ভীষণ আনন্দ পায়। সঙ্গে সঙ্গে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে।
৬
সব রাজবাড়িতেই অমিয়র মতো একটা না একটা ধূর্ত লোক থাকবেই। বাড়ির কাজের দায় দু-জনের পালা করে। ওর আর তিওয়ারির। তবে চা করবে শুধু অমিয়। কেদারবাবু নাতনিকে ভীষণ ভয় পান। অমিয়র সঙ্গে তাঁর গোপন বোঝাপড়া আছে। যতোবার চা দেওয়ার কথা, অনুষ্কার চোখ এড়িয়ে একমাত্র অমিয়ই পারে সেই বরাদ্দ বাড়িয়ে দিতে। তাই অমিয়কেই কেদারবাবুর বেশি পছন্দ।
যে-কোনো যুদ্ধ-পরিস্থিতিতেই সুযোগ-সন্ধানীদের খুব বাড়বাড়ন্ত হয়। অমিয়ও ঠিক এরকম একটা কিছুই চাইছিল অনেক দিন ধরে। এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে কেউ তা জানে না। একেকজন একেকটা চাল দিতেই হয়ত গোটা দিন গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে থাকলেন। তখন অমিয় সারাক্ষণ দোরগোড়ায় বসে থাকবে। সেই সময় দফায় দফায় তাকে চা দিতে হবে বটে, কিন্তু অন্য কাজ থেকে তার অব্যাহতি। খোদ কর্তার তৈরি আইন, ভাঙার সাধ্য কারুর নেই। অমিয়কে খুব পুলকিত দেখাচ্ছে।
৭
দাবা খেলা হলো যুদ্ধেরই ইনডোর সংস্করণ। হাতি, ঘোড়ায় সজ্জিত হয়ে দু-পক্ষকেই নানা রকম কৌশল নিতে হয়। ব্যূহ তৈরি করতে হয়।
মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল টানা আঠারো দিন। এই দুই বন্ধুও খেলতে খেলতে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
প্রথম দিকে প্রত্যূষপ্রসূনবাবুর খেলোয়াড়ের মনোভাব একেবারে ছিল না। তাঁর বুকের কাছে বাষ্প জমে ছিল। কিন্তু খেলা কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরে তিনি নড়েচড়ে বসলেন। কেদারকে হারাতে পারলে তবেই সে তাঁর কথা শুনবে। নচেৎ তার অহংকার আরো বেড়ে যাবে।
দু-রাত তিন দিন কেটে গেল। অমিয়র এখন খুব ফুর্তি। প্রত্যকবার চা বানানোরও দরকার হয় না, একবার বেশি করে চায়ের জল চাপালে ওতেই চার-পাঁচ দফা কুলিয়ে যায়।
এখন শুয়ে বসে সময় কাটানোই তার একমাত্র কাজ। অমিয়র কি-প্যাড দেওয়া ফোনেও সোশ্যাল মিডিয়া আছে। অনুষ্কার নজর এড়িয়ে সারাদিন সে ওতেই ডুবে আছে।
প্রথম দিন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হওয়ার পরই ফোন আসে প্রত্যূষদাদুর বাড়ি থেকে। দিদু। অনুষ্কাকে ভীষণ ভালোবাসেন।
দিদু বললেন, ‘এখনো পাশা খেলছে মিনসে? আচ্ছা, তুই কী করে এদের সহ্য করিস বল তো দিদিভাই? বুড়ো খোকা দুটোকে কান ধরে উঠবোস করিয়ে দিতে পারিস না?’
স্পিকারে না থাকলেও অনুষ্কার ফোন কম্বুকন্ঠী। কম্বু মানে শাঁখ। এমনিই তার আওয়াজ শোনা যায় কাছাকাছি থাকলে।
দিদুর কথা শুনতে পেয়ে তিওয়ারি বলে উঠল, ‘হাঁ, হাঁ, উঠ্ক-বেঠ্ক।’
অনুষ্কা বলল, ‘তুমি কিচ্ছু ভেবো না দিদু, যুদ্ধের নেশা কেটে গেলে ওরা নিজেরাই টায়ার্ড হয়ে যাবেন। তার আগে উঠিয়ে দিলে দুই বুড়োর শরীরে নানা ফ্যাংড়া গজাবে। গ্যাস, অম্বল, না-ঘুমোনো। আগে দেখোনি?’
‘কিন্তু তুই এদের নিয়ে রাতে থাকবি কী করে?’
‘আমি আমার বন্ধু স্নেহাকে আসতে বলেছি। সে থাকবে আমার সঙ্গে।’
দিদুর তবু দুশ্চিন্তা দূর হলো না। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘কিছু দরকার হলে ফোনে জানিও কিন্তু, ঠিক আছে?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে বাবা, জানাব, হয়েছে?’
৮
সেদিন গন্ডারের কাণ্ডে অনুষ্কা কিছুটা অপদস্থ হয়েছিল বটে, কিন্তু সে তো পশু-পাখিদের ভালোবাসে, সে মোটেও রাগ করেনি গন্ডারের ওপর। কান্না তো নয়ই। চোখে জল তার সহজে আসেই না। গোটা ঘটনাকেই অমিয় রং চড়িয়ে বলেছে। দাদুকে বলেছে, অনুষ্কার নাকি ভীষণ অপমান হয়েছে। পাগলা কোথাকার!
প্রত্যূষদাদু আসলে গন্ডারটি তাকে উপহার দেননি। আগে বনের পশু-পাখি ইচ্ছে মতো মারতেন রাজা-গজারা। উপহার-টুপহারও দিতেন। এখন অনেক পশু ঘরে পোষাই বেআইনি। গন্ডারটি আসলে অসুখী। সুখের উল্টোই হলো অসুখ, তবু অসুখ আর অসুস্থতা ঠিক যেন একরকমের ব্যাপার নয়। বন্যদের শুধু খিদে-তৃষ্ণার মতো দু-তিনটি মোটা দাগেরই হৃদয়বৃত্তি আছে, এরকম ধারণাও এখন সেকেলে।
গন্ডারটির মধ্যে একরকমের ছটফটানির ভাব আছে। বন দপ্তরের কর্মীরা তাকে ইন্জেকশান দেওয়ার চেষ্টা করেও পারেননি। সে এখনো কিশোর। তার ওপর বলপ্রয়োগ অন্যায়।
রঘুনাথপুর-২ ব্লকের ফরেস্ট রেঞ্জের অফিস-বাড়িটি ভেঙে নতুন হচ্ছে। ভবনটি তাই আপাতত উঠে এসেছে কাছেই প্রত্যূষদাদুর বিশাল বাড়িতে।
প্রত্যূষদাদুই রেঞ্জ অফিসারকে অনুষ্কার কথা বলেন। রেঞ্জ অফিসার প্রত্যূষদাদুর অনেক দিনের পরিচিত। তিনি অনুষ্কার ইউটিউব চ্যানেলও দেখিয়েছেন অফিসারকে। সে অবিশ্যি দাদুর বুদ্ধি নয়। দিদুর। দিদুও অনুষ্কার চ্যানেলের একজন সাবস্ক্রাইবার। বেশ শিখে গেছেন স্মার্ট ফোনের ব্যাপার-স্যাপার। যাই হোক, অফিসারটি বলেছেন, দশদিন পরে কিন্তু যে অবস্থায়ই থাকুক গন্ডার-কিশোরটি, ফেরৎ নিয়ে যাবে বন দপ্তর।
এক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা গেছে তার সুস্থতার লক্ষণ। অনুষ্কার হাতে সে দু-দুটো বাঁধাকপি খেয়েছে। হাসিটা উধাও। অনুষ্কা জানে ওটা হাসি নয়। শরীর ও মন ভালো না-থাকায় একরকমের শব্দ-বিকৃতি। হায়েনা ডাকলেও মনে হয়, কেউ যেন হি-হি করে হাসছে।
৯
যুদ্ধের ফলাফল এখন যে-কোনো দিকে হেলে পড়তে পারে এমনি অবস্থা। যে সব খাবার দেওয়া হয়েছে দুই যোদ্ধাকে সবই আধ খাওয়া, নয়ত একেবারে ছুঁয়েও দেখা নয়।
এমন সময় এক কাণ্ড। ভূমিকম্প। দাবার বোর্ড উলটে গেল। ঘুঁটি ছিন্নভিন্ন।
অবস্থাটা বুঝতে দুই মহারাজেরই সময় লাগল কিছুক্ষণ।
দেখা গেল, ভূমিকম্প-টম্প কিছু নয়। যে টেবিলে বোর্ড রেখে হচ্ছিল খেলা, থুড়ি যুদ্ধ, তার তলায় ঘাপটি মেরে বসে আছেন মিনু দেবী। কোন সময় কোণার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজরে কোনো ইঁদুরের দুষ্টুমি ধরা পড়েছিল হয়ত, তা তিনিও অমনি তৎক্ষণাৎ দস্যুরানি হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তার ওপর। এমনিতে মিনুর ইঁদুর ধরা বারণ। অনুষ্কার কড়া নির্দেশ। অন্য যা খুশি খাও। দুধ, মাছ। নিজে মারতে পারবে না কারুকে। কিন্তু মিনু ভুলে যায়। বা, লুকিয়ে-চুরিয়ে পুষিয়ে নেয় শিকারপ্রবৃত্তি। এখন অবিশ্যি মিনু দেবীর ক্ষিপ্রতাকে কাঁচকলা দেখিয়ে নেংটি অদৃশ্য হয়ে গেল, কিন্তু বেচারা মিনু পড়ে গেল নাগকেশর মহারাজের রোষ নজরে ।
অনুষ্কার আদরের বেড়াল মিনুকে কেদারবাবুও অন্য সময় ভীষণ ভালোবাসেন বটে, কিন্তু এখন তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য।
কাণ্ডটি করেই মিনুও বুঝি জেনে গেছে, কী অনর্থ সে ঘটিয়ে ফেলেছে।
কেদারবাবু বললেন, ‘ওরে, কে আছিস, বন্দুক আন।’
অমিয় বন্দুক নিয়ে হাজির।
প্রত্যূষবাবু বললেন, ‘দেখো কেদার, এতক্ষণ আমি তোমার সব কথা শুনেছি। ইচ্ছে না করলেও যুদ্ধ করেছি। এবার তুমি যদি মিনুর ওপর তোমার বিটকেল বন্দুকটি চালাও তাহলে তোমারও কিন্তু শাস্তি হবে বলে দিলাম ভাই।’
কী যেন মনে পড়ে যেতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজামশায় কেদারবাবুও তো-তো করতে লাগলেন, ‘ক্কী-কী শাস্তি হবে শুনি?’
প্রত্যূষবাবু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘সে যখন হবে দেখতেই পাবে।’
কেদারবাবু পড়লেন আতান্তরে। প্রত্যূষবাবুর শাস্তির কথা শুনে তাঁর ভয় একটু একটু যে হচ্ছে না তা নয়। এদিকে কথা ফিরিয়ে নিলেও মান যায়। অগত্যা তিনি বন্দুক চালানোই স্থির করলেন।
বন্দুকটা আসলে পিচকিরি। ঠান্ডা কনকনে জল ভরে এনেছে অমিয়। কিন্তু মিনুর একটা লোমও স্পর্শ করতে পারল না বন্দুকের ফোয়ারা। ভিজে বেড়াল হওয়ার দুর্নাম এড়িয়ে সে কোন ফাঁকে কেটে পড়েছে।
কেদারবাবুর বেয়াদপির প্রত্যুত্তরে প্রসূনবাবুও হাঁক দিলেন, ‘ওরে, কে আছিস?’
যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল কলের সরু জলধারার মতো সিড়িঙ্গেপানা একটা লোক। হাতে বেহালা। এসেই সে এলোপাথাড়ি ছড় ঘষতে লাগল বেহালায়। ওফ, সে কী আর্তনাদ বেহালার। বাড়িসুদ্ধু লোকের কান ঝালাপালা হয়ে গেল।
সবচেয়ে অসোয়াস্তি হতে লাগল কেদারবাবুর। প্রত্যূষবাবু আগে থেকেই বন্ধুকে জব্দ করার কূটকৌশল জানেন। পলেস্তারা ওঠা পাঁচিলে টিনের কৌটো ঘষলে, এরকম উন্মত্ত বেহালা বাজালে কেদারবাবুর দাঁতের গোড়া সুড়সুড় করতে থাকে, লোম খাড়া হয়ে যায়। মানে, যাকে বলে রোমহর্ষক ব্যাপার।
বেহালা বাজতেই কেদারবাবু কানে হাত দিয়ে বললে, ‘ওহে থামাও থামাও—ওর চেয়ে তোমায় আমি বেশি পয়সা দেব।’
বাদক লোকটি কেদারবাবুর অঙ্গভঙ্গি দেখে এক মুহূর্ত থেমে নিজের কানে হাত দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে দিল সে শুনতে পায় না, কেদারবাবুর কথা সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তারপর আগের মতোই আবার শুরু হয়ে গেল বেসুরো উন্মাদনা।
১০
এদিকে বন দপ্তরের গাড়ি এসে গেছে।
অনুষ্কাই ফোনে আসতে বলে দিয়েছে।
গন্ডার-খোকার অসোয়াস্তি কেটে গেছে বটে, কিন্তু সে কিছুতেই গাড়িতে উঠবে না।
অনুষ্কা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, ‘এরা তোমার কিচ্ছু ক্ষতি করবে না সোনা, যাও।’
অনুষ্কা রেঞ্জ-অফিসারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে, গন্ডার-কিশোরের মা আজও নিখোঁজ। তার খোঁজ চলছে। পাওয়া যাবে কিনা কিছুই বলা যায় না। হয়ত বাচ্চাটাকে কুনকি হাতির মতো ব্যবহার করে মা-কে ধরে ফেলেছে চোরাশিকারির দল। ওরাই হয়ত কিছু প্রয়োগ করেছে এই শাবকটির ওপর। হয়ত কোনো ওষুধ, কোনো রাসায়নিক। যথাসময়ে জানা যাবে। অনুষ্কা ইতিমধ্যেই ওর নাম রেখেছে একটা। একাকী।
যে অফিসার সদলবলে একাকীকে নিতে এসেছেন তিনি নেপালি। দেখা গেল বাংলা বলতে পারেন অনর্গল। তিনি একাকীকে বললেন, ‘তুমি ম্যাদামের ভাষা বোঝো জেনে গেছি, আমার কতা বুঝবে কিনা জানি না, তবু বলি, আমি কতা দিচ্ছি, ম্যাদামের সঙ্গে আবার তোমার দেকা করিয়ে দেব।’
অনুষ্কার চোখ ছলছল করছে, সে মাথা নেড়ে একাকীকে বুঝিয়ে দিল, হ্যাঁ, এই মানুষ যা বলছেন, তা সত্যি।
গাড়িতে উঠতে গিয়েও ফিরে দাঁড়িয়ে অফিসার বললে, ‘ও ম্যাদাম, এতা আপনার জন্য।’
এই বড়ো একটা ক্যাডবেরি।
অফিসার বললেন, ‘আমি যদি অ্যাত প্রেসেন্ত (অ্যাট প্রেসেন্ট) কিং হতাম, আপনাকে একটা অ্যাপেলেশন—মানে, নতুন নাম—হাঁ, এবার থিক (ঠিক) মনে পড়েছে--খেতাব — দিতাম।’
চোখ মুছে অনুষ্কা জোড় হাত করে, মিষ্টি হেসে বলল, ‘আবার নতুন নাম? রক্ষে করুন।’
অনুষ্কার কথা না শুনে অফিসার বললেন, ‘আপনি তো গন্দারের মাতা থান্ডা করে দিয়েছেন, তাই আপনার নাম হতো —মিস রাইনোকুলার — হা-হা-হা —’
(পরবাস-৮১, ১২ জানুয়ারি, ২০২১)