Subscribe to Magazines




পরবাসে অদিতি ঘোষদস্তিদারর
লেখা




ISSN 1563-8685




একফালি আশা

"দিদি, এই দিদি, তোর হবু শ্বশুরবাড়ি দেখে এলুম! ওদের বারান্দা আছে জানিস? তোর মনের ইচ্ছে এবার পূরণ হবে রে…"

চিৎকার করতে করতেই বাড়ি ঢুকেছিল শুভ।

আজও যূথিকার কানে বাজে শুভর সেই গলা! যেন টের পান সেদিনের সেই বুকের ভেতরের ছলকানি!

সিনেমার মতন স্পষ্ট যেন সব!

লজ্জায় একছুটে পিছনের পুকুরপাড়ে। মনে তখন কত প্রশ্নের ভিড়।

"কেমন বারান্দা ওটা? ঝুল বারান্দা নাকি ঘরের লাগোয়া? জাফরি কাটা না কি শুধুই রেলিং? নাকি গ্রিলে ঘেরা লম্বা টানা..."

মনে হচ্ছিল একছুটে যদি একবার দেখে আসা যেত!

খেতে বসে লজ্জা লজ্জা মুখ করে চুপি চুপি বলেও ফেলেছিলেন ভাইকে, "একবার আমাকে দেখিয়ে আনবি?"

"উফফ, তর সইছে না, নারে? দাঁড়া।"

প্যান্টের পকেট থেকে বাঁ হাতে একটা ফটোগ্রাফ বের করেছিল শুভ।

সরু গোঁফ আর রিমলেস চশমাওলা এক তরুণের হাসিমুখ।

"ধুস! একে কে দেখতে চাইছে? আমি বলছিলাম ওই, ওই যা বলছিলি বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে..."

গলা জড়িয়ে এসেছিল কেমন।

"বারান্দা? উফফ দিদি তুই একটা আস্ত পাগলি!"

দোষ কি যূথিকার একার? বারান্দা নিয়ে পাগলামি কি আর কারুর নেই? না থাকলে আশাপূর্ণা লিখলেন কী করে সুবর্ণলতার গল্প?

বাবাকে একবার বলেই ফেলেছিলেন চুপি চুপি, যদি কখনো দোতলা তোলার প্ল্যান থাকে তাহলে যেন বারান্দা করেন।

বাবা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, "উঠোন, ছাদ, ঘাট, পুকুর, মাঠ, এত্ত খোলামেলাতেও তোর এত বারান্দার সাধ কেন মা?"

কী করে বোঝান যূথিকা যে বারান্দায় দাঁড়ানো আর উঠোনে হাঁটা এক নয়! দু'বছর আগে পুরীতে বেড়াতে গিয়ে যে হোটেলে উঠেছিলেন সবাই, সেখানের বারান্দায় দাঁড়িয়েই যূথী উপলব্ধি করেছিলেন, এ জিনিস একান্ত নিজেরই হয়!

যাক বাবা, আর বোঝাতে হবে না কাউকে! ক'দিন পরে গোটা বারান্দাই তো হবে যূথীর!

বৌভাত মিটে আত্মীয়স্বজনের ভিড় কমতে দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াবার সুযোগ মিললো। এতদিন তো প্যান্ডেলে ঢাকা ছিল।

পুরোনো আমলের বাড়ি। বারান্দায় জড় হয়েছে রান্নাঘরের বাতিল করা শিশি বোতল, ভাঙা টবে তুলসীচারা। সাদাকালো মেঝে আলাদা করে তফাৎ করার উপায় নেই।

শাশুড়ির কাছে আবদার করলেন যূথিকা, যদি মেলে বারান্দা সাজাবার অনুমতি।

"এ বাড়ি তোমার, তুমি যেমন করে ইচ্ছে সাজাও মা!”

বলেছিলেন এ বাড়ির মা বাবা দুজনেই। বড় ভালোমানুষ ছিলেন তাঁরা। চোখের কোণে জল চিক চিক করে উঠল যূথিকার এতদিন পরেও।

ঘষে মেজে চকচকে হয়ে সেজে উঠলো দোতলার বারান্দা। আবর্জনা, ঝুল দূর হলো, তুলসী চারা পেল নতুন টব, কোণে কোণে ঝুললো মানিপ্ল্যান্ট। শাশুড়ির ঠাকুর সকালে পেতে শুরু করলেন গাছের টগর, জবা, দুপুরে শ্বশুরমশায়ের পাতে পড়তে লাগলো টাটকা লঙ্কা।

দোতলার বারান্দার ঠিক নিচের একতলার বারান্দা দিয়েই বাড়িতে ঢোকা। সে বারান্দাও নতুন বৌয়ের নেকনজরে এল। রাশি রাশি জুতোতে ভরা বারান্দার মেঝে। রান্নাঘরের পুরোনো জালছেঁড়া মিটসেফে রং করে যূথিকা বানালেন জুতোর র‍্যাক। বাড়তি জুতোরা প্রমোশন পেয়ে ঢুকল রংকরা প্যাকিংবাক্সে।

মেঝে ঝকঝকে।

শাশুড়িমা তো উচ্ছ্বাসে বলেই ফেললেন, "এই বারান্দাটায় এত জায়গা ছিল?”

নতুন বৌয়ের এই শিল্পকর্মে মোহিত নতুন বরটিই শুধু নয়, আত্মীয়স্বজনরাও! এত সামান্য জিনিস দিয়ে এমন সাজানো যায়!

তবে বরটির অনুযোগ থেকেই যায়।

"তুমি তোমার বারান্দাদের আমার থেকেও বেশি ভালোবাসো!"

"ইসস! হিংসে দেখো!''

"একটু যদি আমাকে অমন ভালোবাসতে, তাহলে আমারও এমনি ভোল বদলে যেত!"

"না! আমার এমনটাই পছন্দ!" আদুরে, সোহাগ মাখা গলা।

কত কত বছর আগের কথা এসব! কতদিন কেটে গেল তারপর!

বারান্দার গ্রিল বেয়ে উঠত ছেলে! বেশি উঁচুতে উঠতে না পারলে কাঁদত। আজ উঠে গেছে অনেক ওপরে। কালেভদ্রে দেখা হয় তার সঙ্গে।

মেয়েটা স্কেল হাতে কেমন শাসন করত বারান্দার গ্রিলগুলোকে, টিচার টিচার খেলা। আজ সে কলেজের অধ্যাপিকা।

বারান্দাতে উঠেছে মাধবীলতা আর লতানে জুঁই। বহুদিনের আদরের সঙ্গী। বারান্দায় দাঁড়ালেই শরীর আর মন দুই-ই জুড়িয়ে গেছে সুবাসে। জীবনের কত না বলা কথা জেনেছে শুধু এরাই।

তাই কি আজ বাতাসে অভিমানের বাষ্প?

বাড়ি ফাঁকা। চলে যেতে হবে কাল। প্রোমোটারের দেওয়া থাকার জায়গায়। এবাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হবে, পরবর্তী প্রজন্মের তাই ইচ্ছে।

"বারান্দাটাকে বড্ড হিংসে করতুম! কিন্তু বিশ্বাস করো যূথী, কিন্তু এমনটি আমি চাইনি কোনোদিন!"

ধরে এল গলা।

"মন খারাপ কোরো না, আবার আমরা এইখানে এসে নতুন বারান্দায় দাঁড়াব। তারপর এমন সাজাব না! হিংসেয় তুমি সবুজ হয়ে যাবে!"

যূথিকা এসে দীর্ঘদিনের চলার সাথীর বুকে মাথা রাখলেন।



(পরবাস-৮১, ১২ জানুয়ারি, ২০২১)