বিষ্ণুপদ লোধের অঢেল টাকা। বাপের টাকা। মায়ের সম্পত্তি। নিজের ভেড়ি। একটাই ছেলে। হরিপদ।
দু'মাসের ফুটফুটে নাতি গলু। ভালো নাম তুহিন।
ছেলের বৌ সরমা। রাণাঘাটের মেয়ে। লক্ষ্মীমন্ত। ঘরে এনে ব্যবসা ফুলেছে। সাতটা ভেড়ি। দশটা হয়েছে। খলবল করে পয়সা। খাওয়ার লোক নেই।
করোনার মন্দার বাজারেও রমরমিয়ে চলছে ব্যবসাপত্র। শুনছে বটে চারদিক আকাল। লোকে বিনা চিকিৎসায় মরছে। লক্ষ লক্ষ টাকা হাসপাতালের বিল। খুব হইচই হচ্ছে মাঝেমধ্যে। বিষ্ণুর সে-সবে ভাবনা নেই।
তবুও মনে সুখ নেই। অবশ্য এই অসুখটা আর কেউ জানে না। লোকে জানে বিষ্ণুপদ হেঁপো। এমন লোকের আরও অসুখ? হয়ত আছে। গোপন।
বিষ্ণুপদর বয়স একান্ন। শরীরে শ্বাসকষ্ট। রোগ বেঁধেছে অনেকদিন। প্রথমদিকে গুরুত্ব দেয়নি। তাবিজ। মাদুলি। কবচ । শিকড়বাকড় গায়েমাথায় জড়িয়েছিল। তখন বয়স অল্প। কুড়ি-বাইশ। দেদার ব্যবসা। চৌপাটে খেলছে।
ডাক্তারের কথা মনেও হয়নি। আর সময়ই বা কোথায়। অন্ধকার থাকতে ব্যবসা। সারাদিনই চলছে। উৎসবের মরশুমে তো কথাই নেই।
বছর চল্লিশে রোগের বাড়াবাড়ি হল। ডাক্তার-বদ্যি।
দৌড়ঝাঁপ। বিস্তর ডাক্তার বদলেছে। শেষে ডাক্তার সরকার। চিকিৎসায় এখন মোটামুটি সুস্থ ।
দু'বেলা ওষুধ চলে। পঁচিশটা। ডাঃ সরকার বললেন, ‘লোধবাবু সিগারেট ছাড়তে হবে। অনেক ফুঁকেছেন। শরীরের বারোটা বেজেছে। বাঁচতে হলে নো সিগারেট।'
দিনে খেত চার প্যাকেট। দামি। উড়ে যেত তেরো/চোদ্দো হাজার। প্রথমে কষ্ট হয়েছিল। বাঁধা মেয়েছেলে মরলে যেমনটা হয়। এখন সয়ে গেছে। গন্ধও সহ্য হয় না। ওষুধের খরচ বেড়েছে। মাসে লাখের ওপর। ইনহেলার। তিন-চার রকম। এছাড়াও ট্যাবলেট। সরমা নিয়ম করে ওষুধপত্র দেয়। কোন ভুলচুক নেই।
বছর দশেক আগের কথা। সেবার কি একটা অসুখ ছড়িয়েছিল। মার্স। না সার্স।
ডাঃ সরকার তখন বিদেশে। ফিরেই বিষ্ণুপদকে সাবধান করছিলেন। সে রোগটাও ছিল নাকি বেয়াড়া। প্রাথমিক লক্ষ্মণ শ্বাসকষ্ট। বলেছিলেন, 'অন্যের হাঁচি-কাশি থেকে সাবধান। মুখে মাস্ক মাস্ট।'
বললেই কী আর ওসব হয়। মাছের ব্যবসা। চোর ছ্যাঁচোড়দের নিয়ে কারবার। এছাড়াও মাছের পেটে চোরাইমাল। ডাক্তারকে কি আর সব বলা যায়?
একদিক থেকে দেখলে ছ্যাঁচড়া বিজনেস। পয়সা আছে ঠিকই। মাল টপকানো। পুলিশটুলিশ।
তাছাড়া ফড়েদেরও ফ্যাকড়া। ব্যাটারা নেশা-ভাং করে। এখানে ওখানে রাত কাটায়।
সব সময় মাস্ক থাকলে হয়? মাকালগুলো কথা ভালো বোঝে না। হাজারও ঝামেলা ছিল। হরিপদ থাকত। ব্যবসাও বোঝাত। কথাবার্তার ঝামেলা কম ছিল। যাহোক। সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছে।
ডাক্তারের ডেট ছিল ডিসেম্বরে। ভিড় হয়। নতুন রুগির ডেট পেতে মাসতিনেক। বিষ্ণুপদর সঙ্গে আলাদা খাতির। সেসব সবাইকে বলা যায় না।
ডাক্তারবাবু এবারও সাবধান করলেন। প্রথমেই।
--লোধমশাই, বিদেশে একটা রোগ ছড়াচ্ছে। প্রাথমিক লক্ষণ সর্দি-কাশি। জ্বর । শ্বাসকষ্ট। মনেহয় ইনফ্লুয়েঞ্জা। আসলে তা নয়।
বিষ্ণুপদ ভুরু কোঁচকায়। 'রোগটার নাম কী?'
--নতুন অসুখ। নাম ঠিক হয়নি।
--ওষুধ?
--ওই রোগের এখনও কোন ওষুধ নেই। একজন থেকে আরেকজনের হচ্ছে। ছোঁয়াচে। বিদেশে হু-হু করে ছেয়ে গেছে। এদেশে আসতে কতক্ষণ ! সাবধানে থাকবেন। নাক-মুখ যেন ভালো মত ঢাকা থাকে।
--কীসের থেকে হচ্ছে?
--তা ঠিক বলা যাচ্ছে না। ওদেশের ডাক্তারবাবুরা তো বলছেন বাদুড় থেকে এসেছে।
--বাদুড়? বাদুড় আবার রোগ ছড়ায় নাকি?
--ওরে বাবা! বাদুড় অনেক রোগের বাসা।
--কোন উপায় নেই?
--উপায় বলতে ঐ সাবধানে থাকা। যেমন আগের রোগটার সময় থাকতেন। তবে এটার একটা নতুন উপসর্গ । কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। বাচ্চারা বাদে জোয়ান বুড়োবুড়ি সবাই কাত।
--বাচ্চারা বাদ কেন?
--ওদের ইমিউনিটি স্ট্রং।
বিষ্ণুপদ ভয়ে ভয়ে বলে, 'আমাদের ,কোন উপায় নেই?'
--না। এখনও পর্যন্ত নেই। গবেষণা চলছে। তবে আপনার হলে মুশকিল। কারণ ফুসফুসকে অকেজো করে। 'সিওপিডি'র রুগীই মরছে বেশি।
বিষ্ণুর 'সিওপিডি' মানেটা জানা।
তারপর তো সবই জানা। দেখতে দেখতে এদেশে ছেয়ে গেল। নামও জানা গেল করোনা। লোক মরছে পটাপট। রোগটা যেন ক্ষ্যাপা বাতাস। যাকে সামনে পাচ্ছে কাত করছে।
কোথায় কী। বলা নেই কওয়া নেই। লকডাউন। শব্দটাই শুনল প্রথমবার। সব বন্ধ।
গাড়িঘোড়া। ট্রাম-বাস। ট্রেন। প্লেন। দোকান-পাট। রাস্তায় লোকজন নেই। ভয়ে লুকিয়েছে ঘরে।
বারবার ফোনে বলছে। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা। পরিচ্ছন্ন থাকার কথা। প্রথম মাসতিনেক ভেড়ি খাঁ-খাঁ। কেনা-বেচা নেই।
বন্ধুবান্ধবদের চারজন মরেছে রোগটায়। তাদেরও বিষয়-আশয় কিছু কম ছিল না। চিকিৎসারই সুযোগ হয়নি।
ডাক্তারবাবুও বলেছিলেন, 'শ্বাসের রুগী, ভয় বেশি। যে কারোরই হচ্ছে। তবে বাচ্চা-কাচ্চারা রোগেও তেমন কাবু হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি সুস্থও হচ্ছে।'
মোদ্দাকথাটা বুঝছে বিষ্ণুপদ। ওর বিপদ বেশি ।
বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত বিষ্ণুমন্দির আছে। ঠাকুরদা স্বপ্নাদেশে ঐ বিগ্রহ স্থাপনা করেন। সে প্রায় একশো বছর তো হবেই। সেই থেকে নিত্যপুজো। পূজারী ব্রাহ্মণ আছে। ওরাই সেবায়েত। এখন পুজোর দায়িত্বে অচিন্ত্য মুখার্জি। তিনপুরুষের সেবা। এই চার শতকের উত্তর-পূর্বে বিষ্ণুমন্দির। পেছনেই অচিন্ত্যের পরিবার থাকে।
লোধ পরিবারের ঠাকুরদেবতায় অচল ভক্তি। কোন পুজোপার্বণই বাদ যায় না। সকাল সন্ধ্যেয় যাগযজ্ঞ। প্রতিবেশীরা ঠাকুর দালানে ভিড় করে।
নতুন ব্যাধির আতঙ্ক। ভিড় পাতলা। তবু কম কিছু নয়। মুখোশের চেয়েও বেশি ভরসা ঠাকুরের আশীর্বাদে। এদের বুঝিয়েও লাভ হয় না। একজন দুজন করে শেষমেশ ভিড় হয়েই যায়।
বারণ করা যায়? অমাবস্যা পূর্ণিমায় বিশেষ পুজো।
বিষ্ণুপদ নিচে আসে না। বসতবাড়ি দক্ষিণ-পূর্বে কাচঘর। ঐখান থেকে দেখা যায়। পরিষ্কার
বিষ্ণুপদর মনমেজাজ ভালো নেই। সর্বক্ষণ মৃত্যুভয়। বাড়িতে বাইরের লোক ঢোকায় না। শুধুমাত্র ছেলে। বৌমা। নাতি আসে। তাও অনেক নিয়মটিয়ম। আপাদমস্তক স্যানিটাইজড করে।
বিষ্ণুপদ বিদেশী টানেল স্যানিটাইজার আনিয়েছে। এ তল্লাটেই নেই। টানেলের মতো। ইউভি চেম্বার।
কোনকিছুর ঘাটতি নেই। কাজের লোকজন সবাই এখানে থাকে। বাইরে যাওয়া নিষেধ।
জিনিসপত্র আসে। সাত-আটদিন বাইরের ঘরে পড়ে থাকে। হরিপদ হরিপদর আড়তে যায়। দু'সপ্তাহ কোয়ারিন্টিন। বার-বাড়িতে।
রোজ নিয়ম করে খবর শোনায় আশু বৈদ্য।
ইংরেজির মাস্টার। মাসে বারো দিত। এখন কুড়ি। এ অভ্যেসটা অনেকদিনের। আগে বাড়িতেই আসত। এখন ভিডিও কল। দেশ-বিদেশের নানা ভাষার খবর। বাংলা করে বলে।
টিভিতে যে শোনা যায়। দুমিনিটে দশটা বিজ্ঞাপন। ধেৎ।
তাই এই ব্যবস্থা। আগে শেয়ারবাজার। সোনা। পেট্রোল। সব খবরই শোনাত। এখন ওসব কম। সপ্তাহে একদিন। এখন বিষ্ণু নিয়মিত শোনে রোগের প্রকোপ। মৃত্যুহার। সুস্থ কত। তাদের বয়েস।
এমনকী হালের খবরও। যা এদেশের কোন কাগজে বেরোয়নি তাও।
এই যেমন অক্সফোর্ডে 'অ্যাস্ট্রো-জেনেকা'র ভ্যাকসিনের খবরটা। ওরা 'আইসিজে' থেকে ছাড়পত্র নিয়েছে। এই ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ে ।
ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিল। চমৎকার বুঝিয়ে দিয়েছে।
এই ভ্যাকসিনের হিউম্যান ট্র্যায়াল ঠিকমতো হয়নি। তাই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন এর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা। যদি থাকে ঐ সংস্থাকে দায়ী নয়।
'আইসিজে' হল ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস। সবদেশের আইন নিয়ে বিচার করে। রায় দেয়। দেশগুলো মানতে বাধ্য। না হলে মানসম্মান নাকি থাকে না।
বিষ্ণুর মাথায় একসঙ্গে অনেক কিছু খেলে। সারাজীবন জল ঘেঁটে হাতেপায়ে হাজা ধরিয়ে ব্যবসা করল। কাকভোর থাকতে ওঠে। নিত্যদিন বাপ-মা তুলে খিস্তি। মদ্যপ আড়তদারের গন্ধওলা ট্যাঁক থেকে মালকড়ি বের করা। ….ছ্যা ছ্যা..এ কোন জীবন!
এসব ভ্যাকসিনট্যাকসিনের চক্কর আগে টের পেলে! ... জান লড়িয়ে দিত। .. বাপ ঠাকুরদা কী পয়হা করছে। ... সুযোগ পেলে.. বিষ্ণুপদ লোধ ব্যবসা কাকে বলে দেখিয়ে দিত। ..শুধু পড়ে পড়ে ভেড়ির পাঁক ঘাঁটা.. কভি নেহি।
বড়ো দেরি হয়ে গেল। এদেশে থেকে কিস্যু হবার নয় । লোকজনের পয়হা নেই। টিপে চেপে টুথপেস্টের মতো হিসেব করে। মাল খসায়।
আহা হা হা ….পয়সার মণ্ড তৈরির এমন সব সুবর্ণ সুযোগ ! ...ইস...মনের আফশোস মনের মধ্যেই গুমরায়। আরও কিছুদিন সুযোগ পেলে ….দেখিয়ে দিত। টাকা-গাছের বীজতলা কী করে বানাতে হয়!
দূর, ছেলেকে দিয়ে এত সব হবে না। মাথামোটা। সামান্য কাঁটাপাল্লার হিসেব করতে এদিকওদিকে হোঁচট খায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে।
...কী এমন বয়েস... এই বয়েসে ঠাকুরদার বাবা পঞ্চম বার বিয়ে করে...ইস শালা যত না বয়েস ..রোগেই মেরেছে বেশি। মন খুলে যুক্তি করতে হবে ।
কুলপঞ্জিকা নিয়ে গুষ্টির হিসেব কষে। কে কত বয়েসে মরেছে। খাতা-পেন্সিলে লেখে। ভালো করে দেখে। পূর্বপুরুষের গড় আয়ু পঞ্চান্ন। মরেছে সব ব্যভিচারে।
বিষ্ণুপদর সে বালাই নেই। বউ মরেছে বছর দশেক।
বিষ্ণুপদ তখনও জোয়ান। বিয়েটিয়ের চক্করে যায়নি। ঝটপট ছেলের বৌ এনেছে।
হরিপদ সবে কুড়ি। সরমা আঠেরো। বৌমা ওস্তাদ। এসেই টক করে হাল ধরল। এখন বিষ্ণুর ডানহাত। প্রতিটা লাভের কড়ি ওর নখদর্পণে। আলাপ আলোচনায় ব্যবসাটা ধরে নিয়েছে ।
বিষ্ণু মাথা খাটায়। ভাবে। এভাবেই কি বাকি জীবন ...ঘরবন্দি! থাকতে হবে? ডাক্তারও আশা দিতে পারেনি..
অচিন্ত্য বেশ করিৎকর্মা। মাঝেমাঝে ফোনে আলাপ করে। পুজোপাঠের বহর বেড়েছে। বলতে নেই। হয়ত দেবতার আশীর্বাদেই। বিষ্ণুপদকে বুদ্ধি দিল।
--যাগযজ্ঞের তো কিছুই বাকি রাখছেন না। ভালো দিন দেখে 'মনোবাঞ্ছা' যজ্ঞটা করেই ফেলুন।
--সেটা কী?
--সেও একপ্রকার যজ্ঞ। মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
--মনস্কা…! আচ্ছা। ভেবে দেখি।
অচিন্ত্য ধূর্ত। বুঝেছে বিষ্ণুপদ একটা চিজ। সহজে ছেলের হাত দিয়ে মালকড়ি খসিয়ে নেয়। বাপটা কঠিন। পয়সার আখরোট। তাই ফিকির খোঁজে কী পথে আখরোজ ভাঙ্গা যায়।
উপায় আপাতত একটাই পেয়েছে। বুড়োর ধর্মকর্মে মতি আছে। ঠাকুরদেবতা আশীর্বাদের চকচকে লোভ। যজ্ঞের ছুতোতে পঞ্চাশ/ষাট লাখ নস্যি। ছক কষেছে। এরপর তান্ত্রিক। কাপালিক।
...নেড়ানেড়ি…। দেখা যাক। কত কী হয় ।
বিষ্ণুপদ সন্ধ্যারতি দেখতে দেখতে ভাবে। অচিন্ত্য মন্দ বলেনি। মনোবাঞ্ছা! আহা কী শব্দ। শুনলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ..আছে..আছে। ..
অচিন্ত্য.. সে তো অনেকেই… সে কী সব ...একটা একটা করে দেখতে হবে। তন্ত্রমন্ত্রের কাজ তো একেবারে অব্যর্থ। ঠিকমত গুরু ধরে এগোতে পারলে…
কখন যে আরতি শেষ হয়ে গেছে খেয়াল নেই। চমক ভাঙল। সরমা প্রসাদ নিয়ে এসেছে।
--বাবা ইউভি চেম্বারে প্রসাদ রেখে গেলাম। তামার পাত্রে ঢাকা।
বিষ্ণুপদ খোঁজ নিয়েছে। তামার পাত্রে করোনা কাবু। পাঁচঘন্টাও বাঁচে না। পরিবারের সবার জন্যই ঐ ব্যবস্থা।
প্রসাদ পড়ে রইল। বিষ্ণুপদর মাথায় ঘুরছে অচিন্ত্যের কথা। বাংলা পাঁজি উল্টে দেখে। পরশু পূর্ণিমা। ফোনে ডাকল অচিন্ত্যকে। সরমাকেও।
সরমার আগ্রহই বেশি। খুব খুশি। বলল, 'অচিন্ত্যদা। পরশু তো পূর্ণিমা। ঐ দিন কি করা যায়?'
--কী?
--ঐ যে বললেন মনস্কামনা যজ্ঞ।
--ও মনোবাঞ্ছা ...আচ্ছা আচ্ছা..একটু থেমে বলে হাতে মাত্র একটা দিন। চেষ্টা করে দেখব। চিন্তা করবেন না। ঠাকুরের ইচ্ছায় সব হয়ে যাবে।
বিষ্ণুপদ বলে, 'আচ্ছা বেশ। খরচাপাতি নিয়ে ভেব না আয়োজন শুরু করে দাও।'
--একটা কথা। যজ্ঞ কি সংগোপন না উন্মুক্ত?
সরমা বলে, 'মানে?'
--মনোবাঞ্ছা বলে কথা। অনেকে সংগোপনেই সম্পন্ন করে। খুব ঘনিষ্ঠ লোকজন ছাড়া কেউ থাকে না। আর উন্মুক্ত হলে তেমন বাধা নেই।
--আচ্ছা বেশ। এখন যা রোগবালাই শুনছি সংগোপনই ভালো।
--বেশ তাই হবে।
--আপনারা সংকল্প করে রাখবেন।
--সেটা কী?
--মানে যা আপনাদের মনোবাঞ্ছা ঠিকমত ভেবে রাখবেন। যজ্ঞে আহুতি দিতে হবে।
সরমা ঘাড় নাড়ে। 'ঠিক আছে। বুঝেছি।'
ছেলে হরিপদ এখন কোয়ারিন্টিনে। বিষ্ণুপদ যজ্ঞের বৈষয়িক উদ্দেশ্য জানাল শুধু সরমাকে। সরমা চমৎকার পরামর্শ দেয়। সরমার কথাটায় বিষ্ণু পুলকিত। সরমা বুদ্ধিমতী। বিষ্ণু বলল, 'হরিপদ?'
সরমা বলল, 'ওটা একটা হাঁদা। বাবা, নতুন কাপড়চোপড় লাগবে কি?'
--অচিন্ত্য ব্যবস্থা করবে সব। কথাটা গোপন রেখো।
সরমার একটা হাসি। অনেক উত্তর। নিশ্চিন্ত বিষ্ণুপদ ।
পূর্ণিমা লাগল রাতে। বারোটা পাঁচ। উত্তর-পূর্বের বাগানে বড় যজ্ঞের আয়োজন। মাটি খুঁড়ে শক্তপোক্ত বেদী। উপরে বালি ছড়ানো।
'কতক্ষণ লাগবে অচিন্ত্য?' বিষ্ণুপদর প্রশ্ন।
--ঠিক মতো করলে ঘন্টাখানেক।
--আচ্ছা। বেশ।
হু হু করে আগুন জ্বলে। পাশেই ঠাকুরদালান। কাচের দরজায় সাক্ষী ছায়া আগুন। নাচে।
বেলকাঠ। ঘি। মধু। কর্পুর। দুধ। যব। সর্ষে। ফুল। মিশেলের ঘোর বৈষয়িক গন্ধ।
অচিন্ত্য আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ জুড়ে চাঁদের আলো। আগুনের শিখা ঢেউ খেলছে। পাকা ধানের মত।
যজ্ঞের একদিকে অচিন্ত্য। উত্তর মুখে। বাঁদিকে বিষ্ণুপদ। আগুনের ধোঁয়ার অল্প শ্বাসকষ্ট উঠছে। একটু পেছনে সরে বসল।
পাশে ছেলে কোলে সরমা। তুহিন ঘুমিয়ে কাদা। যজ্ঞ শেষ হতে একটা বাজল।
অচিন্ত্য বলল, 'লোধমশাই সংকল্প করেছেন?'
'হুঁ।' অতি কষ্টে শ্বাস টেনে বলল, 'বৌমা, ..আমার ইনহেলারটা.. উপর থেকে...আনবে মা?'
'এক্ষুনি আনছি।' নাতিকে দাদুর কোলে দিয়ে সরমা নিচে গেল।
অচিন্ত্য আগুনের মধ্যে থেকে চন্দনলেপা কচি বেলপাতা বের করে। আধপোড়া। বিকলাঙ্গ।
তীরকাঠিতে খাগের কলম। দুধভর্তি মাটির দোয়াতে ডোবায়। কপালে ছুঁইয়ে বিষ্ণুপদর হাতে দেয়। কলমের মুখে ফোঁটা ফোঁটা দুধ। টুপ টুপ। এই বুঝি পড়ে গেল।
--লোধমশাই, ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করুন। মনোবাঞ্ছার কথাটি গুছিয়ে নিন। মনে মনে। এই যে মন্ত্রপূত খাগের কলম। দুধে ডোবানো। একটি বাক্যে লিখবেন। ভাঁজ করে। অগ্নিকে আহুতি দেবেন। আগুন । ছুঁড়ে।
--আচ্ছা।
বিষ্ণুপদর কাঁপা হাত। সংকল্পটি গুছিয়ে লিখলেন। ভাঁজ করে ছুঁড়লেন। বেশিদূর যায়নি বিল্বপত্রটি। আগুনের প্রবল তাপ। ভাঁজ খুলে গুটিয়ে কালো হয় নিমেষেই।
ভাঁজখোলা বিল্বপত্রের লেখাটা একমুহূর্ত চোখে পড়ল। অচিন্ত্যের শরীর কেঁপে ওঠে ।
'ওঁ বিষ্ণু, তুহিনের আয়ু আমায় দিয়ে রোগমুক্ত করো ঠাকুর।'
চোখের নিমেষে ঘুমন্ত নাতি নিক্ষিপ্ত হয় যজ্ঞাগ্নিতে।
(পরবাস-৮১, ১২ জানুয়ারি, ২০২১)