ঘুম ভেঙে দেখলাম জানলায় অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বারান্দার নিচে মরশুমি ফুলের কেয়ারি, পার হয়ে জবা, টগর, শিউলি... একটা আখাম্বা কাঠচাঁপার গাছ। ঘাসজমি যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সেখান থেকে পাথরে বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে জলে। ঘাটের পৈঠায় একলাটি শীত ও শিশিরের মাঝখানে চুপটি করে দাঁডিয়ে আছে চৈতি। পরনে একটা রঙ ফিকে হয়ে যাওয়া সালোয়ার-কামিজ, রাতে পরে শুয়েছিল, ঘুমের দলা লেগে এখনও কুঁচকে আছে জায়গায় জায়গায়। মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা চুলের নিচে আমি তার খোলা পিঠের চাঁদ দেখতে পাচ্ছিলাম… দু’-এক গুচ্ছ আলগা চুল, একটা আড়াআড়ি চেরা নখের দাগ। দূর থেকে দেখে মনে হয় দাগটার প্রান্তসীমায় একবিন্দু রক্ত শুকিয়ে মামড়ি পড়ে গেছে। হেমন্তে এসময় কুয়াশা পড়ে, ভোরবেলা পুকুরের জল থেকে বাষ্প ওড়ে, স্পষ্ট অবয়ব দেখা যায় না। চেনা মানুষকেও অচেনা লাগে। মনে হল মানুষ নয়, পরি নেমেছে মাটিতে।
এই রকম একটা অলৌকিক দৃশ্য দেখলে কার না লোভ হয় কাছে যেতে, ছুঁয়ে দিতে! সাহস করে বারান্দার গ্রীলের দরজা খুলে কয়েক পা হাঁটতে পারলেই আমি তার সুষমা স্পর্শ করতে পারতাম। যদিও জানি এই মুহূর্তে সেটা করা উচিত হত না। গত রাতে যখন চৈতির পাশে দাঁড়িয়ে স্যালাড কাটছিলাম তখনও পারতাম। চৈতিদের কিচেনটা ছোট। কোনোমতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দু’জনে দাঁড়ানো যায়। সেখানে ছোঁয়াছুঁয়ি হলে চৈতিও হয়তো ভাবত অসাবধানে লেগে গেছে। আমি বলছিলাম, “দেখো, স্যালাড কেটে সাজানোটাও কিন্তু একটা আর্ট।”
চৈতি হেসেছিল, আমার কাছ থেকে অল্প সরে দাঁড়িয়ে আমার স্যালাড কাটা দেখতে দেখতে বলেছিল, “দেখি তোমার শিল্পকীর্তি, চক্ষু সার্থক করি...”
আমি শশার খোসা ছাড়িয়ে নেবার পর পিলারের খাঁজ-কাটা ধার দিয়ে সামান্য গা-কুরিয়ে নিচ্ছিলাম। তারপর গোল গোল করে কেটে শশার নক্সা-করা টুকরোগুলো প্লেটে সাজিয়ে রাখছিলাম। ছুরি একটু ত্যারচা করে ধরলে টুকরোগুলো লম্বাটে ডিম্বাকৃতি হয়, সুন্দর দেখতে লাগে। প্লেটের কিনারে শশার টুকরোর বৃত্তাকার বিন্যাস, দ্বিতীয় স্তরে গাজর, একদম কেন্দ্রে টোম্যাটো। সবুজ বোঁটা ছাড়ানো কাঁচালঙ্কা গুঁজে দিচ্ছিলাম টোম্যাটর নরম পাল্পের মধ্যে। অন্যান্য শিল্পর মত স্যালাড সাজানোর মধ্যেও একটা নিষ্ঠুরতা থাকে। লেটুস বা সেলেরি পাতার আড়াল দিয়ে ভেতরের ক্ষত ঢেকে রাখতে হয়। ওপরে অলিভ ওয়েল বা ভিনিগারেট-এর শুশ্রূষা ছড়িয়ে দিতে হয়। চৈতি মাংস চাপিয়েছিল গ্যাসে। ঢিমে আঁচে মাংস কষা হচ্ছিল। দরজায় কর্কশ শব্দ করে কলিং বেল বাজল। চৈতি দরজা খুলতে গেল। এ বাড়ির কলিং বেলটা সম্ভবত গত কুড়ি বছরে বদলানো হয়নি। আগের বার যখন এসেছিলাম তখনও কানের পর্দা ফাটানো শব্দ করে বেজে উঠত।
আগের বার কবে এসেছিলাম? সন-তারিখ মনে পড়ার আগেই বিপ্লবের গলা পেয়েছিলাম। দরজা খুলতে দেরি করার জন্য চৈতিকে বকাবকি করছে। ছেলেটা সারাদিন কোথায় থাকে, কী করে কে জানে? একটা সুস্থ-সবল মানুষ এই ভাবে নিষ্কর্মার মত ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে, ভাবলেও আশ্চর্য লাগে। সারাদিন ক্লাবে আড্ডা দিয়ে, পার্টি-অফিসে বসে দেশোদ্ধার করেও তার দম ফুরোয় না। সন্ধেবেলা নিয়ম করে স্টেশনের ধারের চুল্লুর ঠেকে গিয়ে বসে। যত মুটে-মজুর, অটোওলা-টোটোওলাদের সংগে তার গলায়-গলায় ভাব। তাদের সংগে ছোলাসেদ্ধর চাখ্না ভাগ করে চল্লু গিলে বাড়ি ফিরতে সেই টালমাটাল মাঝরাত। যতদিন শিউলিতলায় এসেছি এই রুটিনের ব্যত্যয় দেখিনি। বললে বলে, ওটা জন-সংযোগ, তুই বুঝবি না। গতকাল বিপ্লবকে বলেছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরতে। সুজন আর দেবলকে রাত্তিরে খেতে ডেকেছিলাম। আমরা চারজন, যাকে বলে সেই ন্যাংটা-বেলার বন্ধু। বিপ্লব হেসে বলেছিল, “ফোরেন খাওয়াবি তো বল, বিভু... তবেই ফিরব, নইলে নয়।”
যতদূর জানি নীহার-কাকা মদ তো দূরের কথা জীবনে বিড়ি-সিগারেটও ছুঁয়ে দেখেনি। সেই বাপের ছেলে হয়ে বিপ্লবটা যে কী করে এমন মদো-মাতাল হল কে জানে? বাবা আর নীহার-কাকা অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিল। আমরা যখন টাউন ছেড়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতার ফ্ল্যাটে চলে গেলাম, বাবা নীহার-কাকার হাতে আমাদের বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় না গেলে মায়ের চিকিৎসার অসুবিধে হচ্ছিল। আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং থার্ড ইয়ার। তারপর সব ওলটপালট হয়ে গেল। মা মারা গেল, ফোর্থ ইয়ারে। আমি পাস করে হায়ার স্টাডিজের জন্য বিদেশে চলে গেলাম, সেখানেই চাকরি-বাকরি... ছুটিছাটায় যখন ফিরতাম কলকাতাতেই সময় চলে যেত, শিউলিতলা আসা হত না, কলকাতা থেকে খুব দূর নয় যদিও, চল্লিশ-বিয়াল্লিশ কিলোমিটার। বাবা আসত অবরে-সবরে, সুবিধে মত। লোক লাগিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করিয়ে কলকাতা ফিরে যেত। বছর তিনেক হল নীহার-কাকা নেই, বাবা চলে গেল গত বছর। বিপ্লবই কোথা থেকে আমার ই-মেইল অ্যাড্রেস জোগাড় করে জানিয়েছিল, বাড়ির হাল শোচনীয়, আমার আসা জরুরি। তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেশে ফিরেছিলাম। শিউলিতলা এসে দেখলাম সত্যিই বাড়িটার ভগ্নদশা, বাগানে আগাছার জঙ্গল, বর্ষার জল ঢুকে দেওয়ালে ছাতা পড়ে গেছে, ছাদের চাঙড় খসে ওয়ারিং-এর তার ঝুলে পড়েছে। কলকাতায় থেকে বাড়ির কাজ করানো অসম্ভব। বিপ্লব বলল, “আমাদের বাড়িতেই থেকে যা ক’দিন।”
শুনেছিলাম সব বন্ধুদের মত বিপ্লবও বিয়ে-থা করে সংসার পেতেছে। জানতাম না ও চৈতিকে বিয়ে করেছে। জানলে হয়তো ওদের বাড়িতে থাকার প্রস্তাবে রাজি হতাম না। সেটা একপক্ষে ভাল হত। চোখের সামনে চৈতির হেনস্থা দেখতে হত না। বিপ্লবদের দোতলার ছাদে মাদুর পেতে বসেছিলাম আমরা চারজন। জুঁই ফুলের মত সাদা জ্যোৎস্না ফুটেছিল, গন্ধহীন যদিও। ডিসেম্বরের শুরু, ভাল করে ঠান্ডা পড়েনি। একটা হালকা চাদর হলেই চলে যায়। আমি স্যুটকেস থেকে বিলিতি মদের বোতল বার করে এনেছিলাম। দেশি হোক বা বিদেশি, জল খাবার মত কোঁত-কোঁত করে মদ খেলে কার না নেশা হয়! বেশিক্ষণ নয়, এক-দেড় ঘন্টার মধ্যেই বিপ্লব বেহেড মাতাল হয়ে গেল। আমরা তিনজন বিপ্লবকে সামলে রাখতে পারছিলাম না। উলটোপালটা বকছিল, উঁচু গলায় গান গাইছিল, “দুশমন না করে দোস্ত নে ও কাম কিয়া হ্যায়...”
একসময় গানের গলা মন্দ ছিল না বিপ্লবের। মাঝের কয়েক বছরের অত্যাচারে মন্বন্তরের কাকের মত খসখসে হয়ে গেছে। দেবল বলল, “বিপ্লব, মুতে আয়, নেশা কমবে।” সুজন বিপ্লবকে আটকেছিল, “দাঁড়া, আমিও যাব।”
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হচ্ছিল। আমরা তাকিয়ে দেখলাম চৈতি ছাদের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। রাত বাড়ছিল, সম্ভবত আমাদের ডিনারের জন্য ডাকতে এসেছিল। বিপ্লব সুজনের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। হাঁটতে গিয়ে ওর পা টলে যাচ্ছিল। নিজেই ছাদের নিচু প্যারাপেট ওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। চৈতি ভয় পেয়ে ওকে ধরতে এগিয়েছিল। বিপ্লব ঝটকা দিয়ে চৈতির হাত সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “ছাড়, আমাকে...”
চৈতি শোনেনি। হাত বাড়িয়েছিল আবার। ঠাস করে চৈতির গালে একটা চড় কষিয়েছিল বিপ্লব। জড়িয়ে জড়িয়ে বলেছিল, “ছুঁবি না আমায়, নোংরা মেয়েছেলে কোথাকার!”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল চৈতি। আমরা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। বিপ্লব যে আমাদের সবার সামনে চৈতিকে চড় মারবে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। চৈতি দ্রুত পায়ে নেমে গিয়েছিল ছাদ থেকে। বিপ্লব আবার বসে পড়েছিল, চোখ বুজে, ছাদের প্যারাপেট ওয়ালে হেলান দিয়ে। একটা অস্ফুট শব্দ শুনে পাশে তাকিয়ে জ্যোৎস্নার স্তিমিত আলোয় দেখেছিলাম দেবলের চোখ জ্বলছে, ধক-ধক করে। দাঁতে দাঁত ঘষছিল দেবল, নিঃশ্বাসের নিচে গালি দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তক্ষুণি বিপ্লবের ঘাড়ে লাফ দিয়ে পড়ে টুঁটি টিপে ধরবে।
দেবলকে শান্ত করার জন্য আমি ওর হাতে চাপ দিয়েছিলাম।
“তুই জানিস না বিভু, চৈতিকে ও কতটা কষ্ট দেয়। বাইরে থেকে দেখে বিলকুল বুঝতে পারবি না। সবাই ভাবে সর্বহারার বন্ধু, গরিব মানুষের দুঃখে বুক ফাটে... মাই ফুট! সব দেখনদারি! আসলে বিপ্লবটা একটা রিফাইন্ড খচ্চর,” রাগের চোটে দেবলের মুখ থেকে থুথু ছিটকোচ্ছিল। আমি সামনে থেকে একটু সরে বসলাম। দেবল খেয়াল করল না।
বললাম, “তাই তো দেখছি। আগে জানলে... ওদের সমস্যাটা কী জানিস?”
দেবল অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “চৈতিকে জিজ্ঞেস করেছি অনেকবার, বলতে চায় না।”
বললাম, “চৈতিকে দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়... তোর সংগে কি দেখা-সাক্ষাৎ হয়?”
দেবল বলল, “আগে প্রায়ই যেতাম... একা নয়, বৌকে নিয়েই যেতাম, এখন ওদের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তুই ডেকেছিলি বলে সেদিন গিয়েছিলাম, অনেকদিন পরে।”
আমি বললাম, “মাঝে-মধ্যে খোঁজখবর করতে পারিস, মেয়েটা ভরসা পাবে।”
দেবল অসহিষ্ণু গলায় বলল, “বিপ্লবটার এত নীচু মন, আমাদের যাওয়া নিয়েও বাওয়াল করত। আরে, আমি কি চৈতিকে খেয়ে ফেলব নাকি?”
আমাদের না আমার? ‘আমাদের’ শব্দটা গৌরবে বহুবচন কি না বুঝলাম না। সুজন বলেছিল, দেবল আজকাল নাকি বেশ কেউকেটা হয়েছে। টাউনে সবাই মানে-গোনে। ইদানীং প্রোমোটারির বিজনেস শুরু করেছে। শিউলিবাড়ির সিটিং এম-এল-এ দেবলের খুড়তুতো জামাইবাবু, সেই ভদ্রলোকই বকলমে... নইলে দেবলটা যা মাথামোটা, ওর পক্ষে বিজনেস-ফিজনেস করা সম্ভব ছিল না। এই সব বিজনেসে বহুত দু’-নম্বরি হয়। পয়সা হাতবদল হয় নিচে থেকে ওপর পর্যন্ত। তাছাড়া লোকাল ঝামেলা তো আছেই। দেবল বেশিরভাগ সময় সেগুলোই সামলায়। গুন্ডা পেলে রেখেছে গোটাকতক। বাকি দায়িত্ব সেই জামাইবাবুর।
ভেবেছিলাম, বাড়িটা সারিয়ে-সুরিয়ে নেবার ব্যাপারে দেবল হয়তো সাহায্য করতে পারবে। ফোন করেছিলাম, দেবল বলল, চলে আয়। বিদেশ থেকে আসার সময় বন্ধুবান্ধবদের গিফট করব বলে খানকতক বোতল এনেছিলাম। দেখলাম একটা বেঁচে আছে। সেটাকে বগলদাবা করে সন্ধে-সন্ধে দেবলদের বাড়িতে ঢুঁ মেরেছিলাম। ওর হাতে সেটা ধরাতে দেবল স্পষ্টতই খুশি হয়েছিল। পাব-বার দূরের কথা, আমাদের ছোটবেলায় শিউলিতলাতে সাকুল্যে একখানা মদের দোকান ছিল। পাশ দিয়ে সাইকেলে চড়ে যাবার সময় দেখতাম, গ্রীলের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে পয়সা আর বোতলের লেনদেন হচ্ছে। যারা কিনত তারা সন্তর্পণে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাঁধের ঝোলা-ব্যাগে বোতল ঢুকিয়ে চোরের মত সটকে পড়ত। ছেলে-ছোকরারা পালা-পার্বণে অন্ধকার গলির মধ্যে লুকিয়ে-চুরিয়ে মদ খেত না যে এমন নয়, তবে সাধারণ মানুষ মদ খাওয়াটাকে নিচু চোখেই দেখত। এখন আর মদ খাওয়া নিয়ে সেই ট্যাবু নেই। লোকে ঘরে বসে মদ খায়। কিন্তু বিলিতি মদের মর্যাদাই আলাদা। দেবল বোতলটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে প্রসন্ন মুখে বলল, “তুই যে মনে করে এনেছিস...”
আমি বললাম, “মানে... তোকে ভুলে যাব? মনে আছে বোসেদের পুকুরে একসঙ্গে সাঁতার শেখা... জলের মধ্যে যত রাজ্যের দামালপনা...”
দেবল দুটো কাট-গ্লাসের টাম্বলার আর জলের বোতল নিয়ে এল। মদ ঢালতে ঢালতে বলল, “মনে থাকবে না আবার, তুই ডুব-সাঁতার দিয়ে আমার গামছা টেনে নিয়ে পালিয়েছিলি...”
আমি বললাম, “আমায় কম করে দিস... তুই এখনও ঘটনাটা মনে করে রেখে দিয়েছিস?”
দেবল বলল, “লতুদি দাঁড়িয়েছিল পাড়ে, শালা উঠতে পারি না, জলের মধ্যে বসে থেকে থেকে জ্বর এসে গেল।”
আমি হেসে বললাম, “সরি রে...”
দেবল বড়সড় এক ঢোঁক মদ গিলে বলল, “আরে দূর, সেসব কথা কবে তামাদি হয়ে গেছে। টাউনটাই বদলে গেল কেমন। সেই বোসপুকুর বুজিয়ে সাততলা ফ্ল্যাট উঠে গেছে। বিপ্লবটাকেই দেখ না, কোন ফ্যামিলির ছেলে... ভাবলেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়।”
আমি বললাম, “সত্যি, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার, আমি তো ক’দিনের অতিথি, তোরা এতদিন ধরে টাউনে আছিস... কিছু করতে তো পারিস।”
দেবল আমার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলল, “ইচ্ছা করলেই পারি, ছেলেপুলে আমার হাতেও কম নেই।”
আমি ওর চোখের থেকে চোখ না সরিয়েই বললাম, “তাহলে চৈতিটা রেহাই পায়... এই আর কী? যা চেহারা হয়েছে মেয়েটার চোখে দেখা যায় না।”
দেবল বলল, “পুরনো বন্ধু বলে এতদিন কিছু বলিনি। কিন্তু ওর উপদ্রব আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ছোটলোকগুলোর সংগে মিশে নিজেও আগাপাছতলা ছোটলোক হয়ে গেছে। ভাবতে পারিস, ক’দিন আগেই লেবার কমিশনারকে চিঠিপত্র লিখে আমার একটা প্রোজেক্টে কাঠি করার চেষ্টা করেছিল।”
বিপ্লবের ওপর দেবলের রাগের কারণ তার মানে শুধুমাত্র চৈতি নয়। সম্ভবত চৈতি একটা উপলক্ষ্য, একটা ট্রিগার পয়েন্ট। দু’জনের সংঘাতের শেকড় আরও গভীরে ছড়িয়ে আছে। বললাম, “আমি আর কী বলব? তবে যা করবার সাবধানে করিস। ফেঁসে যাস না। একবার পার্টি-লেবেলে চলে গেলে হুজ্জুতির শেষ থাকবে না।”
দেবল একটা অশ্লীল গালি দিয়ে বলল, “ওর কোন বাপ ওকে বাঁচাবে? ওদের পার্টিকে তো জনগণ লাথ মেরে ফেলে দিয়েছে। আমাদের লাইফ টাইমে আর ভাঙা কোমর নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হচ্ছে না। এ আমি তোকে লিখে দিচ্ছি।”
আমি বললাম, “তা ঠিক। দেখ, যা ভাল বুঝিস... বিপ্লবটার ভাল-মন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে চৈতিটা একদম একা হয়ে যাবে। সেটাও একটা চিন্তা... ওদের ছেলেপুলেও তো হয়নি।”
দেবল বলল, “সেটা এক দিক দিয়ে বেটার। তুই মাথা খারাপ করিস না। আমি চৈতিকে সামলে নেব।”
দেবলের চৈতিকে সামলে নেওয়ার আশ্বাসে খুব একটা স্বস্তি পেলাম না। প্রসঙ্গ বদলে বললাম, “আমাদের বসত বাড়িটারও একটা ব্যবস্থা করা দরকার। ও বাড়ি মেনটেইন করা আমার কম্মো নয়। তোকে টেলিফোনে বলেছিলাম।”
দেবল অল্প চিন্তা করে বলল, “রি-ডেভেলপমেন্ট করতে চাইলে আমার হাতে দিতে পারিস, তবে সময় লাগবে, আমার আপাতত দুটো প্রোজেক্ট চলছে, একটা এখানেই, শিউলিতলায়, প্লিন্থ লেভেল পর্যন্ত উঠে গেছে, আর একটা ভদ্রেশ্বরে।”
আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “তুই নিলে আমার তো আর কোনও ভাবনাই থাকে না। দলিলের একটা কপি তোকে পাঠিয়ে দেব। বাকি কাগজপত্র, সই-সাবুদ যা দরকার পরের বার এসে না-হয়... আর্জেন্ট কিছু দরকার হলে ক্যুরিয়ার করে দিস।”
দেবল একটু ইতস্তত করে বলল, “পুরনো বাড়ির ইট-কাঠের তো দাম হয় না। বরং ভাঙতে খরচ লাগে। জমিটারই যা দাম পাবি। কত কাঠা জমি আছে? দরদাম কিছু ভেবে রেখেছিস নাকি?”
আমি বললাম, “সাড়ে-চার-পাঁচ কাঠা মতন... তুই কি আর আমায় ঠকাবি?”
দেবল বলল, “তা নয়, তবু... তুই চাইলে একটা ফ্ল্যাট রাখতে পারিস। সেই অনুযায়ী টাকা পাবি।”
দেবলের সঙ্গে বাড়ি বিক্রি সংক্রান্ত কথাবার্তা শেষ হতে রাত হয়ে গেল। দেবল বলল, “আমার এখানেই খেয়ে যা।”
আমি আপত্তি করলাম না। দেবলের বাড়ির ইন্টিরিয়র বেশ চড়া, মফস্সলের উঠতি বড়লোকেদের যেমন হয়। ফলস সিলিঙে জাম্বো সাইজের পদ্মফুল, ডাইনিং টেবিলের পেছনের দেওয়ালে উজ্জ্বল কমলা রং, ওপেন কিচেনে গ্রানাইটের প্ল্যাটফর্ম... একটা আঁটোসাঁটো চেহারার মেয়ে স্যালাড কাটছিল। বিদেশে একা থাকার সময় অধিকাংশ রাত স্যুপ-স্যালাডেই কেটে যায়। এখানে এসে হাবিজাবি খাওয়া হচ্ছে। আজকাল তাই স্যালাড কাটা দেখলেই মনকেমন করে।
মেয়েটা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছিল। সাজ-পোষাক দেখে মনে হল কাজের মেয়ে। দেবলের বৌকে দেখলাম না। জিজ্ঞেস করতে বলল, বাপের বাড়ি গেছে, ছেলেকে নিয়ে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। খেয়েদেয়ে মশলা চিবোতে চিবোতে বেরোবার সময় আর একবার ওকে মনে করিয়ে দিলাম, “চললাম রে, আমি হয়তো তিন-চার দিনের মধ্যেই কলকাতা ফিরে যাব, আবার কবে দেখা হবে! চৈতির কথাটা খেয়াল রাখিস।”
“তুই নিশ্চিন্তে চলে যা বিভু, আমার ওপর ছেড়ে দে পুরো ব্যাপারটা... আমি দেখে নেব,” দেবলের কথা শুনে মনে হল ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।
চৈতির ঠোঁটটা লাল হয়ে অস্বাভাবিক রকমের ফুলে আছে। পোকা কামড়ালে যেমন হয়। ওর নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছে নিশ্চয়ই। চোখ সরিয়ে নিলাম। বিপ্লব বোধ হয় আমার দিকে নজর রেখেছিল। হাতে টান দিল। ফিরে তাকাতে চোখ মেরে বলল, “বুঝলি বিভাস, নষ্ট মেয়েছেলে ভোগ করার মত মস্তি পৃথিবীতে আর কিছুতে নেই,” এমন নয় যে নিচু গলায় বলল। চোখের ইশারায় কার সম্বন্ধে বলল সে বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ রাখল না। সকালের জলখাবারের পর চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। চৈতি ডাইনিং টেবিল থেকে এঁটো প্লেট গুছিয়ে তুলছিল। না শোনার ভান করে তাড়াতাড়ি কিচেনের দিকে চলে গেল। আমি বললাম, “ছিঃ, ছিঃ, বিপ্লব, কোথায় নেমে গেছিস...”
বিপ্লব বলল, “শালা, বিয়ে করিসনি বলে এমন ভাব করছিস যেন কোনোদিন রাণ্ডী দেখিসনি। বিদেশে তো এসব জলভাত। পয়সা ফেললেই খুলে দাঁড়িয়ে পড়বে।”
মাথায় রাগ চড়ছিল, বললাম, “তোর সংগে আজকাল কথা বলাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখে আর কিছু আটকায় না।”
বিপ্লব তাচ্ছিল্যর হাসি হেসে বলল, “আমি তোদের মতো ন্যাকা-ন্যাকা কথা বলতে পারি না। আই কল আ স্পেড - আ স্পেড।”
আমি একটু ঠেস দিয়ে বললাম, “ঠিক জানিস তোর চোখ খারাপ হয়নি? এমন তো নয় ডায়ামন্ডকে স্পেড দেখছিস?”
বিপ্লব আমার কথায় পাত্তাই দিল না। কাপ উল্টে চায়ের তলানিটুকুও মুখের মধ্যে ঢেলে নিয়ে উঠে পড়ল। বলল, “আমার অনেক কাজ আছে বিভু। হীরে-জহরত খোঁজাখুঁজি করার মতো ফালতু সময় আমার নেই। তুই চাইলে ওই সব ঝুটো ডায়ামন্ড আংটি করে পরতে পারিস। আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।”
আমি চুপ করে রইলাম। বিপ্লব রোজকার মত বেরিয়ে গেল একটু পরেই। চৈতি সেই যে কিচেনে ঢুকেছিল আর বেরোয়নি। আমি কিচেনের দরজায় মুখ বাড়িয়ে বললাম, “কী এত রান্না করছ?”
চৈতি কাটিং বোর্ডের ওপর ছুরি দিয়ে সবজি কাটছিল। চমকে ফিরে তাকাল। দেখলাম চোখের নিচে কালি, খড়ি-ওঠা গালের চামড়ায় কান্নার দাগ শুকিয়ে আছে। ছুরির শেষ আঘাতটা কি আঙুলে পড়েছিল? বাঁ-হাতের তর্জনী তুলে জিভে ঠেকাল। দু’-ফোঁটা রক্ত শুষে নিল। বলল, “আমার এই দুর্দশা দেখে খুব মজা পাচ্ছ না?”
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “একেবারেই না, তবে তোমার সহ্যশক্তির তারিফ করতে হয়।”
চৈতি হাত ওল্টাল, “সহ্য না করে উপায় কী বল? আমার তো আর কোথাও যাবার জায়গা নেই।”
“ইচ্ছে করলেই উপায় হয়,” আমি বললাম।
চৈতি আমার ইঙ্গিতটা ধরতে পারল না। হতাশ গলায় বলল, “একটা চাকরি-বাকরিও যদি জোটাতে পারতাম! এই মুহূর্তে চলে যেতাম এই বাড়ি ছেড়ে।”
চৈতির আবেগ নিয়ে খেলা করতে ইচ্ছে করল না। হলুদ বনে বেচারির নাকছাবি হারিয়ে গেছে। ওর সঙ্গে সোজাসুজি কথা বলাই সমীচীন। বললাম, “তোমার আপত্তি না থাকলে আমার সঙ্গে আসতে পার।”
চৈতি খানিকটা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। যেন আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। আগের বার চৈতি আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিল। বছর দশেক আগে, বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ছিলাম তখন আমরা। ওই বয়সে যেমন হয়, বড়দের আড়ালে আবডালে পরস্পরের শরীর আবিষ্কার করার নেশা চেগেছিল দু’জনের। বললাম বটে শরীর, কিন্তু মন ছাড়া কি শরীর আসে? কে জানে? আমদের কলকাতা চলে যাওয়া স্থির হল। ফিরে আসার বাধ্যবাধকতা ছিল না। জানতে পেরে চৈতি সরে গেল নিজে থেকেই। আমার তখন পাগল পাগল অবস্থা হয়েছিল। কারণ জিজ্ঞেস করতে চৈতি বলেছিল, শিউলিতলা ছেড়ে যাওয়া ওর পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। ওর মা মারা গিয়েছিলেন অনেক ছোটবেলায়। বাবা প্রায় শয্যাশায়ী। বলেছিল, চলে গেলে বাবাকে কে দেখবে? তাছাড়া ভয় পেয়েছিল, কিছু দিন দূরে থাকলেই আমি ওকে ভুলে যাব। আমার ওপর ভরসা করতে পারেনি।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও কি আবার আমায় ফিরিয়ে দেবে? মাঝের কয়েক বছর কোনও খবর নিইনি, কিছুটা ব্যস্ততায়, অনেকটাই অভিমানে। চৈতিও তো খবর দেয়নি। সুজন বলছিল মেসোমশাই মারা যাবার পর চৈতিদের চার-শরিকের বাড়িটাও সাত-তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। জ্ঞাতিগুষ্টিকে দিয়েথুয়ে চৈতির ভাগে যা পড়ছিল তাতে শিউলিতলার মতো জায়গাতেও ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা যায় না। সহায়-সম্বলহীন একা একটা মেয়ে কোথায় যায়! বিপ্লবের দরদ উঠলে উঠেছিল। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। চৈতির কোনও উপায় ছিল না। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে চৈতি বলল, “নিয়ে যাবে আমায়? আমি আর সত্যিই পারছি না।”
যাক, মাথা থেকে ভার নামল, বললাম, “অবশ্যই, দু’-একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। মিটে গেলেই... তুমি তৈরি থেকো।”
চৈতি বলল, “তৈরি হবার মতো অবশিষ্ট পিছটান আর কিছু নেই, বিভাস। যখন বলবে...”
চৈতির কথা শুনে আমার আশ্চর্য লাগছিল। বিপ্লবের জন্য কি বিন্দুমাত্র স্নেহও ওর মধ্যে বেঁচে নেই। চৈতি বোধ হয় আমার মন পড়তে পারল। বলল, “অবাক হচ্ছ?”
আমি বললাম, “বিপ্লব কি প্রথম থেকেই এরকম অত্যাচার করে?”
চৈতি বলল, “বিয়ের পর বছর-খানেক ঠিক ছিল। তারপর থেকেই... সন্দেহ করাটা ওর রোগ। যত দিন যাচ্ছে বাড়ছে।”
আমি বললাম, “ওকে নিয়ে কোনও কাউন্সিলরের কাছে যেতে পারতে।”
চৈতি বলল, “তোমার মনে হয় ও যাবে? আসলে ও রোগটাকে পুষে রাখতে চায়। না-হলে আমাকে কষ্ট দেবে কী করে?”
আমার বুকের মধ্যে টনটন করছিল। এগিয়ে গিয়ে চৈতির মাথায় হাত রাখলাম। বললাম, “তোমাদের একটা বাচ্চা-কাচ্চা হলেও হয়তো সব স্বাভাবিক হয়ে যেত।”
চৈতি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। বলল, “ও আমায় কতখানি অবিশ্বাস করে নিজের চোখেই তো দেখেছ। ভাবতে পার, আমায় জোর করে দু’বার অ্যাবরশান পর্যন্ত করিয়েছে। পেটে ছেলে এলেই ভাবে অন্য কারো...”
আমি ওকে কাছে টানলাম। ওর পায়রার মতো রোগা শরীরটা আমার বুকের মধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম, “কেঁদো না, চৈতি। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
দেবল বলেছিল ওর সাইট চলছে শিউলিতলায়। সকাল সকাল দেখে আসব ভেবেছিলাম। হাজার হোক পূর্বপুরুষের বাড়িটা ওর হাতে তুলে দেব। অন্যরকম হয়ে গেল সব। চৈতি কড়াইয়ের ডাল, আলুপোস্ত আর কাজলি মাছের ঝাল চচ্চড়ি রেঁধেছিল। খেয়েদেয়ে বেরোতে বেরোতে বেলা গড়িয়ে গেল।
শীতের সন্ধে তাড়াতাড়ি নামে। ফিরলাম যখন হিম পড়তে শুরু করেছে। কুয়াশা নামছে টাউনের আধো অন্ধকার গলিঘুঁজিতে। চৈতি দরজা খুলে দিল। বিপ্লব ফেরেনি তখনও। হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসতে চৈতি চা করে আনল। নিজের জন্যেও... টুকটাক গল্প করছিলাম আমরা। চৈতির মুখচোখ পরিষ্কার লাগছিল। মনে হল আমি যাবার পর একটু ঘুমিয়েছে। মুখ ধুয়ে একটা টিপ পরেছে কপালে। আহা, এমনই খুশি থাকুক মেয়েটা। আমি চোখ ভরে দেখছিলাম ওকে। দরজায় কলিং বেল বাজল। সেই রাতচরা পাখির মতো দীর্ঘ তীক্ষ্ণ শব্দ, মাথার মধ্যে আমূল বিঁধে যায়। বিপ্লবকে বললে হত বেলটা বদলানোর জন্য। আসা ইস্তক ওর সংসারের সব খরচই আমি চালাচ্ছি। এটাই বা বাকি থাকল কেন?
চৈতি উঠে গেল। বিপ্লবের পার্টির এক ছোকরা খবরটা নিয়ে এসেছে। বিপ্লবের গলার নলী-কাটা বডি পাওয়া গেছে দেবলের শিউলিতলার কন্সট্রাকশন সাইটে।
পরের কটা দিন ব্যাপক ঝামেলার মধ্যে দিয়ে গেল। বিপ্লবের বডি পুলিশের হাত থেকে পাবার পর ওদের পার্টির ছেলেরা শহীদ মিছিল বার করল। জনরোষ বাড়ছিল। পুলিশের অকর্মণ্যতার প্রতিবাদে লোকজন দু’দিন শিউলিতলা থানা ঘিরে বসে থাকল। কী-করে যেন দেবলের নামটা জুড়ে গিয়েছিল। বোধ হয় ওর কন্সট্রাকশন সাইটে বডি পাওয়া গিয়েছিল বলে। অথবা পুলিশ কোনও উড়ো খবর পেয়েছিল। তারা দেবলকে কাস্টডিতে নিল। অন্যথায় দেবলের গণধোলাই খাবার সম্ভাবনা ছিল। পলিটিক্যাল মার্ডার বলে দেবলের জামাইবাবুর প্রতিপত্তি বিশেষ কাজে দিল না। বা তিনি নিরাপদ অবস্থান নিলেন। গোদের ওপর বিষফোঁড়া। দেবলের অ্যারেস্টের পরের দিন থেকে দেবলের ডানহাত গণেশ বেপাত্তা হয়ে গেল। মার্ডার উইপনটা পাওয়া গেল চার-পাঁচ দিন পরে, ওই কন্সট্রাকশন সাইটেই, ইট ভিজোনোর ট্যাংকির মধ্যে। দেবলদের কাজের মেয়েটা শনাক্ত করল, কিচেনের স্যালাড কাটা ছুরি, ক’দিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। গণেশ ধরা পড়ল বেনারস থেকে দিন সাতেক পরে, একটা বেশ্যা মেয়ের ঘরে লুকিয়ে বসেছিল। স্টেটমেন্ট দিল, দেবল ওকে বলেছিল বিপ্লবকে টপকে দিতে। পুলিশ দু’-ঘা দিতে না দিতেই সে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে ফেলল। বলল, কিছু করার আগেই, অন্য কেউ... মা কালীর দিব্যি, বাবা বিশ্বনাথের দিব্যি, সে বিপ্লবের খুনের ব্যাপারে বিন্দু-বিসর্গ জানে না। পালিয়েছিল স্রেফ ভয়ে। পুলিশ আমার আর চৈতির কাছেও এসেছিল, জিজ্ঞাসাবাদ করতে। আমরা যতটুকু যা জানতাম বললাম।
পুলিশ আমাদের গতিবিধির ওপর কোনও বিধিনিষেধ লাগায়নি। চৈতিকে নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। শিউলিতলার বাড়ির দায়িত্ব সুজনের ওপর ছেড়ে আসতে হল। দেবল আদৌ পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পাবে কি না, পেলেও কাজকর্ম কবে শুরু করতে পারবে কেউ জানে না। কোর্টে কেস উঠবে, শুনানি হবে... বেল পেতে পেতে বছর না ঘুরে যায়। এসব কেসে বেল পাওয়া সহজ নয়। আমার কাজ বেড়েছিল, চৈতির পাসপোর্ট, ভিসা... অন্যান্য কাগজপত্র পেতে সময় লাগছিল, অফিসের ছুটি বাড়াতে হল। চৈতি শারীরিক ও মানসিক ভাবে সেরে উঠছিল আস্তে আস্তে। কিচেনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। বলেছিল, অনেকদিন হাত পুড়িয়ে খেয়েছ, এবার তুমি আরাম করো। কিচেনের দরজার বাইরে প্রবেশ-নিষেধের গণ্ডী কেটে দিয়েছিল। যতই বলি, একা হাতে করছ, হেল্প করি তোমায়, আমার অভ্যেস আছে, কে জানে কেন, চৈতি আমাকে একবারের জন্যও কিচেনে ঢুকতে দিচ্ছিল না। এমনকি স্যালাড কাটার জন্যও না।
(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)