‘এও এক ব্যথা-উপশম’ তিন পর্বে বিভাজিত কাব্যগ্রন্থটি বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতির দর্পণস্বরূপ; আবার এ হল জীবন-সায়াহ্নে কবি শঙ্খ ঘোষের আত্মোপব্ধির নির্যাস। কাব্যগ্রন্থটির প্রবেশকটি পড়লেই চমক লাগে। গোটা কতক শর্ত দিয়ে কবি বলেন, “না যদি, তবে নিশ্চিত জেনো/ লোকটার হয়ে গেছে!” প্রশ্ন জাগে, লোকটার কী হয়ে গেছে? আসলে কবি শঙ্খ ঘোষ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, মানুষ নামক জীবের অন্যতম যে গুণ সেই মানবিক সত্তার সবটুকু আজও নিঃশেষিত হয়ে যায় নি। শুধুমাত্র আত্মগত সুখ আর অজানা আতঙ্কে নিজেকে করেছে প্রতিনিয়ত চলতে থাকা অন্যায়ের সঙ্গে অভিযোজিত। তাই তো প্রদত্ত সহজ কয়টি শর্ত পূরিত হলে আজও একজন মানুষ বলেই বিবেচিত হবে বলে মনে করেন তিনি।
‘জন্মভূমি’ পর্বের ‘গুরুশিষ্য-সংবাদ’-এ স্বচ্ছ এবং সমৃদ্ধ রাজ্যপাট পরিচালনায় শিষ্যের করণীয় ও পালনীয় কর্তব্যসমূহ বাতলে দিয়েছেন গুরুদেব। সহজ, সরল কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপটি। “গণতন্ত্র তন্ত্র মাত্র, গণ শুধু শোভা”। কবিতাটির শেষ কয়টি লাইন তুলে ধরলে কবির শ্লেষটুকু আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
সকলেই দূর থেকে ভালবাসে ভিড়। একাকী যে, তাকে নিয়ে নেই কোনো ভয়।এই ভিতরে ভিতরে একা হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর করুণ পরিণতি নির্দেশিত হয়েছে কবির অমোঘ কলমে।
অনুবর্তী সবাইকে ভিতরে ভিতরে শুধু একে একে একা করে দাও
তার পরে চেয়ে দেখো ক’টা মাথা আছে কার ঘাড়ে!
পরস্পর হন্যমান প্রত্যেক-সে একা হোক তোমারই দুহাতে বাঁধা সুতোয় ঝুলোনো‘নিরুত্তর চিঠি’তে এক প্রান্তিকের আত্মহত্যার পূর্ব-মুহূর্তে লিখিত চিঠির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সন্দিগ্ধতা। “—একবার মাত্র বলুন অসির চেয়ে আজও যে মসিই বড়ো/ আপনিও তা অকাতরে বিশ্বাস করেন?” আবার উপায় খুঁজেছেন ব্যথা নিরাময়ের। বলেছেন, তবু কেন সে এই চিঠি লিখে রাখছে। “এ-চিঠি লিখবার কোনো মানে হয় না— তবু লিখে যাই/ এও এক ব্যথা-উপশম!”
মানুষেরই মতো দেখতে প্রায়—
আত্মগত সুখ আর অজানা আতঙ্কে তারা মেনে নেবে যে-কোনো অন্যায়—
‘দেখতে তো হবেই সব আজ’ কবিতায় ফুটে উঠেছে আত্মহারা মানুষের আত্মগ্লানি। ‘অক্ষরে অক্ষরে ঝুঁকে’ কবিতাটিতে মানুষের হিংস্রতার নিদর্শন মেলে। হত্যাকাণ্ডহীন একটি দিনকে আশ্চর্য লেগেছে তাঁর। তাই তো প্রশ্ন করেছেন, “মানুষ কি জঙ্গলের ভব্য সহিষ্ণুতা পেল পুরো এক দিন?” এছাড়া সাক্ষীগোপাল, স্বচ্ছ পরিচয়, তিস্রা ঝাঁকি, ধ্বস প্রভৃতি কবিতাগুলির মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন ধর্ম, রাজনীতির অধোগতিতে তীব্র শ্লেষাঘাত শানিয়েছেন আবার নিজের অপারগতাকেও রেয়াত করেন নি। এ পর্বের প্রত্যেকটি কবিতায় যেন এক একটি মাইল ফলক। বিশেষ করে ‘জন্মভূমি’ কবিতাটি উল্লেখ না করলে হয়ত এই পর্বটির মূল্যায়ন অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। তাই কবিতাটির পুরোটাই তুলে দিচ্ছি—
১জন্মভূমির এমনতর অবস্থায় বসে বসে কবিতা লেখার অপরাধবোধ কুরে খায় বিবেকবান কবি শঙ্খ ঘোষকে। অথচ বুঝে উঠতে পারেন না ঠিক কী করা উচিত। সিদ্ধান্তহীনতায় কেটে যায় জীবন।
‘এখনও কবিতা লিখছ? বাঃ!’
ব’লে পিঠ চাপড়ে দিয়ে হাল্কা পায়ে চলে গেলে তুমি।
হতভম্ব চেয়ে দেখি, ওই কাছে দূরে
হাড়ভাঙা আনমনে পড়ে আছে আমার নিভৃত জন্মভূমি!
২
ঠিক। সব জানি।
দুহাতে অঞ্জলি করে তুলে নিচ্ছি আগুনের শাঁস।
দুচোখ যদিও পুড়ছে, তবু
এ-দুই চোখেই আমি দেখে যাচ্ছি সমস্ত— সমস্ত রাহাজানি।
৩
সব দিকে ঘিরে ফেলছে। কোন্ দিকে দৌড়োব সেটা বুঝতেও পারি না ঠিক আর।
এই দিকে?— কাটা পড়বে হাত।
ওই পাশে?— হল্কা আগুনের।
অন্যেরা কোথায়?— সঙ্গে নেব কাকে?
কাউকে কি ডেকেছি একবারও?
তবে কি পিছিয়ে যাব আরো?
পিছোতে পিছোতে— শুধু পিছোতে পিছোতে— কেটে গেল গোটা এ জীবন।
আরো যাবি? মন?
আচম্কা সেদিন ফোনে প্রশ্ন করলেন একজনঃআবার দেখেছেন, পুরোদস্তুর গৃহীর মধ্যেও বাস করে সন্ন্যাসী সত্তা। নইলে গৃহীও বাঁচতে পারে না। ‘কৃপার বাতাস’ কবিতায় সে কথাই বলেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ।
‘অমন কবিতা লিখতেন
যে সমর সেন
মাত্রই তিরিশে এসে তিনি কেন এমনই হঠাৎ
লেখা ছেড়েছেন?
এর কোনো আছে সদুত্তর?’
আদ্যোপান্ত গৃহীও যে, প্রশ্ন করে দেখি তারও কাছে—সন্ন্যাস পর্বের যে কবিতাটি পাঠকদের নিবিড়ভাবে ভাবিয়ে তোলে, নাড়িয়ে দেয় ভাবনার মূল সে’টি হল ‘উদ্ভাস’
ভিতরে সন্ন্যাস যদি না থাকে তো ঘূর্ণিটানে প্রতিদিন কীভাবে সে বাঁচে?
জেল-প্রাঙ্গণের মধ্যে সেদিন বিকেলেএমন সময় উদ্ভাসিত হলো সেই পরম সত্য। ঠিক কী দেখলেন তিনি?
যখন গাছের পাতা স্থির
শিখরে ছড়িয়ে আছে গোধূলির মায়াভরা আলো
প্রাচীরবেষ্টনে আমি একা একা ঘুরি প্রতিহত
কোনোখানে অন্য কিছু নেই—
এমনই সময় এক হঠাৎ উদ্ভাসে যেন ভরে যায় সমস্ত শরীরউপনিষদের কতখানি আত্মীকরণে এবং আত্মোপব্ধিতে কবির কলমে নিঃসৃত হয়েছে এমনতর লেখা, পাঠককুল ভেবে দেখুন একটিবার। এছাড়া ‘নিঃস্ব’, ‘শেষ চতুর্থে’, ‘অর্ধপাপী অর্ধসন্ত’, ‘গৃহ-স্থ সন্ন্যাস’ কবিতাগুলি গভীরভাবে নাড়া দেয় মনকে।
কোথায় মিলিয়ে যায় সব
যেদিকে তাকায় দেখি তুমি
গাছ আর গাছ নয় সামনের গারদও নয় বাধা
সবই যেন কোমল গান্ধার
এ তো তুমি
ওই প্রহরীরা এসে দাঁড়ালেও মনে হয় তুমি
উঁচু ও-প্রাচীর কিংবা কুঠুরিতে ছড়ানো কম্বল
কোথাও বিরূপ নয় সমস্ত তোমারই আলিঙ্গন
যেদিকে তাকাই দেখি তুমি ছাড়া কিছু নেই আর
আমিও সে-তুমি
জ্যোতির্বলয়ের মধ্যে বিকশিত বিশ্ববিহ্বলতা
একাকার জেগে এই চিরপ্রবাহণে বলে কথা
যেখানেই দুই চোখ পাতি
আনন্দরূপম্ যদ্বিভাতি!
‘নিরাশাযাপন’
… দিনগুলি রাতগুলি কিছুই করেনি তবে দাবিঅন্তিম সময়ে এসে বুঝতে পারেন এই বিশ্বজগৎ তাঁর কাছে কিছুই করে নি দাবী। ভুলে যান সমস্ত ক্ষত আর ত্রাস। বড় শান্তি পান মনে। মুছে যায় সব গ্লানি।
আজ এই শেষরাতে এসে
দাঁড়ালে তোমার সামনে সব গ্লানি মুছে যেতে থাকে
আ-জু রজনী হাম ভা-গে পোহায়লুঁ, ভাবি।
‘ডাহুক’… সে-পথে তোমার ডাক— সম্বল কেবল ডাহুকেরা।‘নিশ্বাস’
তারাও তোমারই মতো অন্তহারা হলো খুঁজে খুঁজে।
উপরে আকাশ কত নীরব সুনীল স্নেহ ঢালে
দুই চোখে তুলসীপাতা ভরে উঠছে অগাধ সবুজে!… যতদূর দেখা যায় সবই শুধু সেই মুখচ্ছবি‘পরিমাপ’
ভুলে যাই সমস্ত আঘাত ক্ষত, ভুলে যাই ত্রাস
মিহি শিশিরের কণা নিপাট শরীরে ঝরে পড়ে
শেষ নিশ্বাসের পাশে ভেসে আসে প্রথম নিশ্বাস।” …… পূর্ণতাতে পৌঁছলে আর ভাবব আমি কাকে?আসলে পূর্ণতা তো শূন্যই যেখানে সকলকেই পৌঁছতে হবে একদিন। সেই পরম সত্য ঘোষিত হয়েছে কবি-কণ্ঠে।
শূন্য থেকে শূন্য নিলে শূন্য বাকি থাকে। …
‘পুবের কোঠা’… অন্ধকার কি নিজেকে পায়? যে জানে সে-ই জানে।‘দিদিমার চোখ’
বিশ্ববিকাশ দেখছি আজও তোমারই মাঝখানে। …… সে-জানলায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক মলিন কিশোরগহন গোপনে
মৃত্যুর প্রথম স্পর্শ পায়। জীবনেরও।সমস্ত সংসার তার অল্পে অল্পে ভরে উঠেছেপ্রিয়জনের বিয়োগ-ব্যথায় আসে জীবনবোধ। চোখের সামনে ঘটে চলা ঘটনাগুলো দেখে মনে হয় এমনই হবার কথা ছিল। অথচ মানতে চায় না মন। একেই ‘মায়া’ বলেন কবি।
নিজেরই শ্মশানদেখা দিদিমার সেই স্থির অবিকার চোখে।”
‘মায়া’
… “মাটি তার বুক পেতে সবই নেবে বলে স্থির হয়ে আছে
ভাঙা পাঁচিলের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বিকেলে
সমস্তই দেখি
অথচ তোমার জন্য মায়া আজও জটিলতাময়।
(পরবাস-৮৩, ১০ জুলাই, ২০২১)