(১)
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়ো কর্তা টনি অ্যাডামসের ঘর থেকে বেরিয়ে, মাইক ব্রিয়ারলি তার সহকারী রবার্টসনকে বললেন, “চল হে একটু অ্যাক্টন পার্ক থেকে হাওয়া খেয়ে আসি।” রবার্টসন গজগজ করে উঠল, “বস একটা তামাদি হয়ে যাওয়া হত্যার ঘটনা, যার কোনও কূলকিনারা ব্রিটিশ পুলিশ করতে পারেনি, কুড়ি বছর আগের ঘটনা, কোনও সাক্ষী নেই, তিরিশ হাজার পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করে যে কেসের সূত্র পাওয়া যায়নি, সেই কেস বড়ো কর্তা আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিল, যত কেঁচে যাওয়া কেসে টনি অ্যাডামসের আপনার কথাই মনে পড়ে, আর আপনিও অম্লান বদনে এই বেলা এগারোটায়, তখনই চললেন অ্যাক্টন পার্কে তদন্ত করতে! যেন খুনীর দল এখনও আপনার জন্য বসে আছে, গেলেই টুক করে জোড় হস্ত হয়ে বলবে আসুন হুজুর হাতকড়া পরিয়ে দিন। এখন বাইরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, কোথায় কফি খেতে খেতে আপনার কবিতা শুনব।” রবার্টসন, মাইকের কিম্ভূত কবিতা নিয়ে খোঁচা দিতে ছাড়ে না।
টাটকা কফির মন কেমন করা গন্ধে চোখ তুলে দেখি, ট্রেতে কফির পেয়ালা আর ফিসফ্রাইয়ের প্লেট সাজিয়ে বৌদি মানে অধীরদার স্ত্রী ঘরে ঢুকছেন, ঢুকেই হুকুমজারি করলেন, “অতনুদা আপনারা আগে খেয়ে নিন, তারপর যত ইচ্ছে খুনখারাপি নিয়ে মেতে থাকুন।” অগত্যা অধীরদাকে থামতে হল।
গত শনিবার সকালে অফিস যাওয়ার সময়ে সোদপুর স্টেশনেই অধীরদা বলে দিয়েছিলেন, “অতনুদা ডাবলিন থেকে, ‘দ্য ইনভেস্টিগেটর’-এর লেটেস্ট কপি কিন্তু এসে গেছে আর সূচীপত্রে দেখে নিয়েছি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা চূড়ামণি, মাইক ব্রিয়ারলির হাতে এবার প্রবাসী ভারতীয় আইনজীবী সুনীল শর্মার হত্যা রহস্য উদঘাটনের ভার।” তা শনিবার আমাদের দুজনেরই হাফ ছুটি, আর তর সইছিল না, বাড়ি ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে, হালকা জলখাবার সেরেই সোজা এসে জুটেছি অধীরদার বৈঠকখানায়। ফিসফ্রাইতে একটা বড়ো কামড় দিয়ে বললাম, “অধীরদা রবার্টসনের গজগজ করবার যথেষ্ট কারণ আছে, মাইক ব্রিয়ারলি দুঁদে গোয়েন্দা হতে পারেন, কিন্তু ভোজবাজি নিশ্চয়ই জানেন না যে কুড়ি বছর আগের খুনের কিনারা করে ফেলবেন।” অধীরদার চোখ তখনও দ্য ইনভেস্টিগেটরের পাতায় স্থির। সংবিৎ ফিরে পেয়ে কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে একটা তৃপ্তির চুমুক দিয়ে বললেন, “যেটুকু চোখ বোলালাম, তাতে ঘটনাটা আরও জটিল। সুনীলের ওপর দু’জন লোক অ্যাক্টন পার্কে হামলা চালায় ২০০১-এর মে মাসে। কিন্তু তার মৃত্যু হয় ২০১৯-এ, মানে আসলে কুড়ি বছর নয়, আঠারো বছর আগের ঘটনা। শুনে তো আমি, ‘থ’। আমাকে হাঁ হয়ে যাওয়া অবস্থায় রেখেই অধীরদা ফের শুরু করলেন, ‘“অ্যাক্টন’ নামক পশ্চিম লন্ডনের এই এলাকাটি একদম মেজাজে কসমোপলিটান। এখানে আপনি ভারতীয়, জাপানী, পোলিশ, আইরিশ, আফ্রিকান, আরবীয়ান সমস্ত রকমের মানুষের বসবাস দেখতে পাবেন, একটা দু’হাজার বাড়ির বড়ো হাউজিং এস্টেট আছে, বেশ কিছু বার আছে, স্কুল-কলেজ আছে, অ্যাক্টন স্ট্রিটে একটা বাজার বসে বৃহস্পতি থেকে শনিবার, যেটা অনেকটা আমাদের গ্রামাঞ্চলের হাটের মতো। অ্যাক্টন একসময় আদতে গ্রামই ছিল, কালে কালে শহর তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। আর আছে অ্যাক্টন পার্ক তার মিনি গল্ফ কোর্স, সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট, বার, কফি শপ, পিৎজা সেন্টার নিয়ে জমজমাট। অ্যাক্টন পার্কের দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে একটা বিরাট পুকুর, প্রচুর বুনো ফুল গাছ আর অন্যান্য গাছপালা। এই অ্যাক্টন পার্কেই সুনীল শর্মার ওপর হামলা হয়েছিল, এখানেই আমরা আপাতত মনোসংযোগ করব।
মাইক আর রবার্টসন এখন অ্যাক্টন পার্কের একটা কফিশপে মুখোমুখি বসে আছে। আমরা ওদের কথোপকথনের মধ্যে ঢুকে পড়ব।”
(২)
মাইক বললেন, “রবার্টসন তুমি তো ঘটনাটা অ্যাডামসের কাছে শুনলে, পুরো ঘটনাটা আস্তে আস্তে বলো, দেখি কোনও আলোর সন্ধান পাওয়া যায় কি না।” রবার্টসন মনে মনে বলল, “শালা বুড়ো ছুঁচো একটা, পুরো ব্ল্যাক হোলের মধ্যে বসে আলোর সন্ধান!” মুখে বলল, “এর আর শুরু আর শেষ! সুনীল শর্মা আর তার এক বন্ধু বছর কুড়ি আগে অ্যাক্টন পার্কে এসে একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে।” মাইক, রবার্টসনকে থামালেন। “উঁহু, বছর কুড়ি আগে বললে কিছুই বোঝা যায় না। তারিখ কত ছিল? কী বার ছিল? বন্ধুর নাম কী ছিল? সে কোথায় গেল? তোমার হাতের ফাইলে তো সব তথ্য মজুদ। কফি আর কুকিজ আসতে আসতে শুরু করো, ব্যাপারটা দিব্যি ঝালিয়ে নেওয়া যাবে। আচ্ছা থাক, আমি বলছি, তুমি পরে মিলিয়ে নিয়ো। ঘটনাটা ঘটে ২০০১-এর মে মাসের ২০ তারিখ, শনিবার দুপুর বারোটা নাগাদ এই পার্কে। অ্যাক্টন পার্ক সেইসময় আজকের মতো জমজমাট না হলেও তার মিনি গল্ফ কোর্স, বার, পিৎজা সেন্টার, কফিশপ নিয়ে বেশ জনপ্রিয় একটা জায়গা ছিল।
সুনীল শর্মার বাড়ি হল লন্ডনের রয়্যাল পার্কে, সুনীল প্রতি শনি-রবিবার বেলা সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ রয়্যাল পার্ক টিউব স্টেশন থেকে টিউব রেলে অ্যাক্টন পার্ক টিউব স্টেশন হয়ে, অ্যাক্টন পার্কে আসতেন, দুই স্টেশনের দূরত্ব মাত্র ৬-৭ মিনিটের। অ্যাক্টন পার্কে কোনও পার্কিং ফেসিলিটি নেই, তাই সুনীল নিজের গাড়ি আনতেন না। সুনীল অ্যাক্টন পার্কে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন, এখানকার বার, পিৎজা সেন্টার, কফি হাউসে সবাই তাকে চিনত। গল্ফ ক্লাব, সুইমিং পুল সর্বত্রই তার অনেক বন্ধু বান্ধব ছিল। সুনীল সেদিন অ্যাক্টন পার্কে এসে এক বন্ধুকে নিয়ে ঢোকেন ওয়েস্টার্ন কফি হাউসে।” রবার্টসন বলল, “সেখানেই তো আমরা বসে আছি বস।” মাইক বললেন, “হ্যাঁ, ভাবো রবার্টসন, ঘটনাটা পুননির্মাণের চেষ্টা করো, আমি অ্যাক্টন পার্কে শুধু হাওয়া খেতে আসিনি। তুমি তো খবরের কাগজ পড়ো, আর বড়ো কর্তার মুখে সব শুনলে, সমস্ত সংবাদপত্রগুলো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে ছিঁড়ে ফেলছে, লিখছে সুনীল শর্মার পরিবারকে সুবিচার দিতে, তার খুনীদের কাঠগড়ায় তুলতে ব্যর্থ এই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আসলে নখদন্তহীন এক বৃদ্ধ শার্দূল, এদের অপদার্থতার কোনও সীমা নেই। ভারতীয় দূতাবাস থেকেও কেসের অগ্রগতি সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের ডিপার্টমেন্টের সুনামের প্রশ্ন। যাইহোক, এই কফি শপ থেকে বেরনোর পরেই সুনীলের বন্ধুর সঙ্গে কয়েকজন আফ্রিকান যুবকের ঝামেলা বাঁধে, সুনীল মধ্যস্থতা করতে গেলে তারা না কি সুনীলের ওপর চড়াও হয়ে সুনীলকে মারধর করে। গণ্ডগোল শুনে অ্যাক্টন গার্ডেন বারের সিকিউরিটি গার্ড প্রথম চিৎকার করে দৌড়ে আসেন, তার চিৎকারে অন্যরাও চলে আসে, আফ্রিকান যুবকরা ওখান থেকে চম্পট দেয়, কাউকে ধরা যায়নি। সুনীলের মাথার আঘাত গুরুতর ছিল, ঘটনাস্থল থেকে একটি অদ্ভুত অস্ত্র পুলিস উদ্ধার করে, সেটি একটি বাগান ছাঁটার কাঁচি, তদন্তকারী অফিসার নীল স্মিথ তার রিপোর্টে লেখেন ঐ কাঁচি দিয়েই সুনীলের মাথায় স্ট্যাব করা হয় তাতে সন্দেহ নেই। বারের গার্ড অ্যাশলে নেভিল তার জবানবন্দীতে বলেন আফ্রিকান যুবকরা সংখ্যায় দু’জন ছিল, তার থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব ছিল আন্দাজ ৫০-৬০ মিটার, নেভিলের পেছন পেছন সামান্য পরেই বারে থাকা সুনীলের বন্ধুরা এসে পড়ে এবং সুনীলকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সুনীল দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে ছাড়া পান, প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু মাথায় গুরুতর আঘাতের ফলে তার নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, যা থেকে তিনি কখনই পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। ২০১৮-এর জানুয়ারিতে সুনীলের একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়, আর ২০১৯-এর এপ্রিল মাসে সুনীলের মৃত্যু হয়। মাঝখানের সময়টাতে সুনীলের নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল না। সুনীলের মৃত্যুর পর তার দেহে স্পেশাল পোস্টমর্টেম করা হয় সেই রিপোর্টে বলা হয় ২০০১-এর অ্যাক্টন পার্ক হামলায় মাথায় গুরুতর আঘাতের সঙ্গে সুনীলের হার্ট অ্যাটাক এবং পরবর্তী সময় মৃত্যুর যোগসূত্র আছে। আসলে সুনীলের ওপর হামলার মামলাটি চলছিলই, সুনীলের স্ত্রী মানালি শর্মা এবং সুনীলের বন্ধুরা সমানে তদ্বির করে গেছেন। করোনারের পরামর্শ অনুযায়ী স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড খুনের মামলা রুজু করে, সুনীলের আক্রমণকারীদের খোঁজ দিলে তিরিশ হাজার পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করে, তাতেও কোনও লাভ হয় না।” রবার্টসন ফোড়ন কাটল, “আর প্রেস ও স্বরাষ্ট্র দফতরের যৌথ চাপে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড শরণাপন্ন হল তাদের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলির।” মাইক মনে মনে খুশি হলেও, নির্বিকার ভাবে বললেন,
“এখন কফি শপে আমরা যে জানলার ধারে বসে আছি, সেটা আমার ডানদিকে আর তোমার বাঁদিকে পড়ছে, জানলা দিয়ে তাকাও, আন্দাজ দেড়শো মিটার দূরে অ্যাক্টন গার্ডেন বারের আলোকসজ্জিত গেট চোখে পড়ছে। সুনীল তার বন্ধুকে নিয়ে বারের দিকে যাচ্ছিলেন সেটা বলাবাহুল্য, মাঝপথে আফ্রিকান যুবকদের সঙ্গে তাদের বচসা হয়, এই অঞ্চলে প্রচুর কেনিয়ান, তানজানিয়ান, সোমালি বসবাস করেন। এই আফ্রিকানদের কারও কারও বিরুদ্ধে ছোটখাটো মারপিটের অভিযোগ থাকলেও সেরকম বিশাল কোনও অপরাধের ঘটনায় এরা অভিযুক্ত নন, সেটা করলে প্রথম সুযোগেই ব্রিটিশ পুলিশ যে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করবে, সেটা ওদের জানা আছে। আর এরা বাগান কাটার কাঁচি নিয়ে কেন ঘোরাফেরা করবে, সেটাও পরিষ্কার নয়। ওটা বহন করবার মতো কোনও চালু অস্ত্র নয়। সবথেকে বড়ো প্রশ্ন, সেদিন সুনীলের সঙ্গে কে ছিলেন? সেই মুহূর্তে সবাই সুনীলকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, কেউ সে ব্যাপারে খেয়াল করেনি। পরে বারের গার্ড নেভিল বলে, সুনীলের বন্ধু ঐ আফ্রিকান যুবকদের পেছনে তাড়া করে যায়, তারপরের ঘটনা সে বলতে পারবে না। পুলিশ পরে ধারণা করে আফ্রিকান যুবকরাই ঐ বন্ধুকে অপহরণ করে খুন করে। কিন্তু ওরকম কোনও মৃতদেহ পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি। সেসময় কোনও নিরুদ্দেশের ডায়রি পুলিশের কাছে জমা পড়েনি। দিনের বেলায় একটা জোয়ান লোককে অপহরণ করা সোজা নয়, অ্যাক্টন পার্কে কেউ গাড়ি আনে না, কোনও ক্যাবে কাউকে জোর করে তুলতে গেলে ক্যাব ড্রাইভার রাজি হবে না। আফ্রিকানদের শারীরিক সক্ষমতার কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, দু’জনে মিলে একজনকে অপহরণ করা কঠিন কাজ।
এই বন্ধুটি কে ছিল রবার্টসন? কফি শপের কেউ তাকে আগে দেখেনি। বেয়ারা তার বর্ণনা দিয়েছিল ভাসা ভাসা, সে আসলে ঐ নতুন আগন্তুককে সেভাবে লক্ষ করেনি। শুধু বলেছিল, সুনীলের সেই বন্ধু ছিল মাঝারি উচ্চতার একজন শ্বেতাঙ্গ। চোখে রোদ চশমা, কাঁধে সাইড ব্যাগ। সুনীলই কফির অর্ডার করেছিলেন, সুনীলরা মিনিট পনেরো কফি শপে বসেছিলেন। একটা লোক কর্পূরের মতো উবে যেতে পারে না, আমার মন বলছে সুনীলের সেই শ্বেতাঙ্গ সঙ্গীর কাছেই রয়েছে এই ঘটনার চাবিকাঠি। সুনীলের মাথার আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল, যে সে পুলিশকে সেই বন্ধু সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারেনি। পুলিস সুনীলের এই বন্ধুর নাম পর্যন্ত জানতে পারেনি। ইনি, সুনীলের অ্যাক্টন পার্কের বন্ধুদের মধ্যে কেউ নন।” রবার্টসন বলল, “বস কী বারের গার্ড অ্যাশলে নেভিল আর এই কফি শপের বেয়ারা জোনাথন কোলকে আবার জেরা করবেন?” মাইক বললেন, “স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এদের সদ্য আবার জেরা করেছে, ভাগ্যক্রমে এরা এখনও একই জায়গায় একই পেশায় যুক্ত আছে, তবু আমি এদের সঙ্গে কথা বলতে চাই জেনে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়ো কর্তা টনি অ্যাডামস কফি শপ এবং বার কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন।” জোনাথন বলল, নতুন করে কিছু বলার নেই, যা বলার আগেই বলেছে। এতদিনকার কথা এমনিতে হয়তো মনে থাকত না, কিন্তু সেদিন অতবড় গণ্ডগোল হয়েছিল বলেই কিছু মনে আছে, আর সুনীল শর্মা অ্যাক্টন পার্কে একজন স্টার ছিল, তার হাসিখুশি চেহারা, মজাদার কথাবার্তা ভোলা যায় না। মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “সেদিন সুনীলের সঙ্গে তার বন্ধুর কথাবার্তা কিছু কানে এসেছিল?” জোনাথন একটুক্ষণ ভেবে বলল, “আমি যখন কফি সার্ভ করছি তখন যেন সুনীল বলছিল আমি উইকএন্ডে ব্যবসার কথা বলি না, এ রকমই কিছু, ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।”
মাইক জোনাথনকে ধন্যবাদ দিয়ে বিল মিটিয়ে উঠে পড়লেন, কফি শপ থেকে বেরিয়ে ওয়েস্টার্ন গার্ডেন বারের দিকে যেতে যেতে স্বগতোক্তি করলেন, “ব্যবসাটা কি আইনব্যবসা?” অ্যাশলে নেভিলকেও বারের দরজাতেই পাওয়া গেল। মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার বিবৃতি আমি পড়েছি, এর বাইরে কোনও খুঁটিনাটি ঘটনা যদি থাকে তা যতই তুচ্ছ হোক আমাকে বলতে পারেন।“ নেভিল বলল, “তখন খেয়াল না করলেও পরে মনে হয়েছে সুনীলের ওপর অ্যাক্টন পার্কে হামলা করা সহজ নয়, এখানে ওর প্রচুর বন্ধু। হামলাকারীরা যদি অ্যাক্টনের বাসিন্দা হয়েও থাকে, তারা নিশ্চিতভাবেই এখানে নিয়মিত আসত না।”
”মাইক বললেন, “এটা একটা পয়েন্ট বটে, তবে এই পার্কে নিয়মিত আসা লোকজনের বাইরেও তো লোকজন আসে।” নেভিলের থেকে বিদায় নিয়ে মাইক বললেন, “চলো রবার্টসন এ বার গন্তব্য রয়্যাল পার্কে সুনীলের বাড়ি, সুনীলের স্ত্রী মানালি বাড়ির একতলায় একটা বিউটি পার্লার চালান, ওনাকে ওখানেই পাওয়া যাবে, তোমার হাতের ফোল্ডারে মিসেস শর্মার ফোন নম্বর আছে, ওনাকে জানিয়ে দাও আমরা আসছি।”
৩)
টিউব রেলে উঠে রবার্টসন বলল, “বস এটা মনে হচ্ছে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া ঘটনা, ওই যুবকেরা বুঝতে পারেনি এটা প্রাণঘাতী হামলা হয়ে যাবে। সুনীল শর্মাকে কেউ পরিকল্পনা করে খুন করতে চাইলে অ্যাক্টন পার্ক একদমই উপযুক্ত জায়গা নয়। অ্যাক্টন পার্কে সুনীলের পাল্লাই ভারি।” মাইক বললেন, “রবার্টসন খুনী যদি সুনীলের সম্বন্ধে বিশদ না জানে, তবে সে অ্যাক্টন পার্কে হামলার পরিকল্পনা করতে পারে। সে যদি শুধু এইটুকু জানে যে সুনীল সেদিন ওই সময় পার্কে আসবে, তবে সে ছক সাজাতে পারে। জানতে হবে কে এবং কেন? খুনের অস্ত্রটা ভুলে যেও না রবার্টসন। ওটা সঙ্গে করে আনা হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই।”
অধীরদা ম্যাগাজিনটা উল্টে রেখে বললেন, “অতনুদা একটু বসুন, কফি করে আনি, মাইক আর রবার্টসন সুনীলের বাড়িতে ঢুকে পড়ার আগে একটু কফি না হলেই চলছে না, আপনার বৌদির ভরসায় বসে থাকলে আরও এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে, সিরিয়াল না দেখে উঠবেন না।” অধীরদা কফি নিয়ে এলে আমি বললাম, “ব্যাপারটা কোনদিকে গড়াচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া হামলা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না, হতে পারে ওই যুবকদের কেউ সেদিনই গাছ ছাঁটার কাঁচিটা কিনেছিল, সঙ্গে ছিল, ঝামেলার সময় মাথা গরম করে চালিয়ে দিয়েছিল, পরে ভয় পেয়ে ফেলে দিয়ে পালায়। আচ্ছা কোনও ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া যায়নি?” অধীরদা বললেন, “অসংখ্য পাওয়া গেছিল, সুনীলের উদ্ধারকারীরা অনেকেই ওটা ধরেছিল।” আমি বললাম, “যাঃ তা হলে তো হয়ে গেল।” অধীরদা হেসে একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার শুরু করলেন, “চলুন দেখি আগে কী হয়, মাইক আর রবার্টসন এখন সুনীল শর্মার বাড়িতে বেল বাজাচ্ছেন।
”মিসেস শর্মাই দরজা খুললেন, পরনে শাড়ি, মধ্য পঞ্চাশের একজন ঈষৎ স্থূলকায় মহিলা, সামনের চুলে কয়েকটা রুপোলি রেখা। মাইকদের ড্রয়িং রুমে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলেন, কিছুক্ষণ বাদে ফিরলেন পেছনে একজন সালোয়ার কামিজ পরিহিত অল্পবয়সী বউয়ের হাতে ট্রেতে সাজানো কফি আর কয়েকরকমের স্ন্যাক্স। মানালি পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার বড়ো ছেলের বউ বলে। বললেন, কফি নিন, খেতে খেতে কথা বলা যাবে। কোনওরকম ভণিতা না করে মাইক কাজের কথায় চলে এলেন, “মিসেস শর্মা, আপনি কি মনে করতে পারেন সুনীলের ওপর যেদিন হামলা হয় সেদিন সকালে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল কি না?” মানালি বললেন, “যতদূর মনে পড়ে কেউ আসেনি। সুনীল খুব ফুর্তিবাজ মানুষ ছিলেন, শুক্রবার রাতে তার কাজ শেষ হয়ে যেত। শনি-রবিবার কারও সাথে দেখা করত না, সকাল এগারোটা সাড়ে এগারোটায় বেরিয়ে যেত অ্যাক্টন পার্কে আড্ডা দিতে, ওর বন্ধু সংখ্যা ওখানে বিরাট, সুনীলকে অজাতশত্রু মানুষ বলা যায়, এ রকম চার্মিং পার্সোনালিটির লোকের ওপর হামলা বিশ্বাস করা যায় না, ওর সামনে দাঁড়িয়ে কড়া কথাও বলা যায় না। ও কাউকে এমন কিছু বলবেই না যেটা শুনে কেউ ওকে মারতে আসবে।” মাইক বললেন, “ম্যাডাম সুনীল একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী ছিলেন, উনি ক্রিমিনাল লইয়ার ছিলেন না, কিন্তু তবুও পেশাগত শত্রুতা কিছু থাকতে পারে, সেরকম কোনও হুমকি পেয়েছিলেন কি না জানেন?” মানালি বললেন, “কিচ্ছু না। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে আমাকে জানানো হয়েছে আপনিই মাইক ব্রিয়ারলি, এখন থেকে সুনীলের কেসটা দেখবেন, আপনার বহু অসাধ্য সাধনের কীর্তি আমি পড়েছি, দেখুন কিছু করতে পারেন কি না। আমি বুঝতে পারছি না কী করে এত বছর বাদে হামলাকারীদের খুঁজে বার করবেন? ওই হামলার সঙ্গে সুনীলের পেশার কী সম্পর্ক থাকতে পারে?” মাইক বললেন, “আমার কাজ সমস্ত কোণ থেকেই ঘটনাটা খুঁটিয়ে দেখা। সুনীলের কোনও সেক্রেটারি আছেন?” মানালি বললেন, “২০০১-এর সেই হামলার পরে সুনীল কোনওদিন কর্মক্ষম হয়নি। কাউকে না কাউকে সবসময় ওর দেখাশোনা করতে হত। সুনীলের ওপর যখন হামলা হয় তখন ওর ৪২ বছর বয়স, আমাদের দুই ছেলের বয়স ছিল যথাক্রমে ১২ আর ১০, ওরা দু’জন সেই বয়স থেকেই আমার সঙ্গে পালা করে ওদের বাবাকে দেখেছে। এখন ওরা দু’জনেই আইনজীবী, সুনীলের সলিসিটর ফার্ম, ‘শর্মা & স্টুয়ার্ট’ দেখাশোনা করছে। ছেলেরা বড়ো হওয়ার আগে সুনীলের পার্টনার মি: জিমি স্টুয়ার্ট একাই সব সামলেছেন, অতি সজ্জন ব্যক্তি, এখন বৃদ্ধ হয়েছেন, তবুও সুনীলের কেসে এক সুতো আলগা দেননি কখনও।
২০০৩-এ আমি বিউটি পার্লারের ব্যবসা শুরু করি, আর সুনীল যখন কর্মক্ষম ছিল তখন আমিই বাড়িতে তার সেক্রেটারির কাজ সামলেছি।” মাইক বললেন, “তবে তো আপনি সুনীলের কর্মজীবনের শেষ সপ্তাহে কে কে তার সঙ্গে বাড়িতে দেখা করতে এসেছে সেটা বলতে পারবেন। আমার মনে হচ্ছে তার আগের তথ্য লাগবে না।”
মানালি বলল, “ওটা কম্পিউটার দেখে বলে দিতে পারব। চলুন সুনীলের অফিসে ডেস্কটপে সব তথ্য পেয়ে যাব।” সুনীলের অফিস আর সব আইনজীবীর চেম্বারের মতো, তিনদিকের দেওয়ালের কাচের বুক সেলফে আইনের মোটা মোটা বইতে ভর্তি। বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের এক দিকে গদি আঁটা চেয়ারে সুনীল বসতেন বোঝা যায়, উল্টোদিকে কয়েকটা চেয়ার ক্লায়েন্টদের জন্য। সুনীলের টেবিলের ডান দিকে আর একটা ছোট টেবিলে মানালি বসতেন, সেখানেই কম্পিউটার রাখা আছে। মানালি কম্পিউটার খুলে অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলো মাইককে দেখালেন। ক্লায়েন্টের নাম, ঠিকানা, বয়স, দেখা করবার কারণ লেখা আছে। সুনীল সকালে চেম্বারে বসতেন না, সন্ধ্যাবেলা কোর্ট থেকে ফিরে বসতেন এবং কোনওদিন ২-৩ জনের বেশি ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করতেন না। সুনীল অত্যন্ত সফল আইনজীবী ছিলেন এবং তার ক্লায়েন্টরা অনেকেই ছিলেন সমাজের উঁচুতলার মানুষ।
২০০১-এর ১৯শে মে, শুক্রবার অর্থাৎ সুনীলের ওপর হামলার আগের দিনের একটা এন্ট্রিতে থমকালেন মাইক। ক্লায়েন্টের নাম মিসেস উইলিয়ামস স্মিথ, বয়স ষাট, দেখা করবার কারণ উইল। মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন? মানালি বললেন, স্মিথ পরিবার সুনীলের পুরনো ক্লায়েন্ট, সেদিন মিসেস স্মিথ উইল সংক্রান্ত কিছু কথা বলতে এসেছিলেন, কিন্তু ডিটেলস আমি বলতে পারব না। তারপর দিন সকালে আমাদের জীবনে ঝড় নেমে আসে, সুনীল আমাকে কিছু ব্রিফ করবার সময় পায়নি আর সে রাতে কী কথা হয়েছিল আমার খেয়াল নেই, বাস্তবিক আমি ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে অংশ নিতাম না।” মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “মিসেস স্মিথের সঙ্গে কেউ ছিল?” মানালি বললেন, “কেউ না।” “সেদিন কোনও উল্লেখ করবার মতো ঘটনার কথা মনে করতে পারেন কী? অতি তুচ্ছ মনে হলেও সেটা বলুন।” মিসেস শর্মা বললেন, “না। তবে পরের দিন সকালে সুনীল আমাকে বলেছিল আমি না কি এই ঘরের জানলা বন্ধ করিনি, হাওয়াতে ওর টেবিলের কাগজপত্র, কয়েকটা মাটিতে পড়ে গেছে। সুনীল শনি-রবিবার কাজ না করলেও এই ঘরে নিজের চেয়ারে বসেই কফি খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ত। সুনীলের এই কাগজপত্র গোছানো নিয়ে একটা বাতিক ছিল, এ রকম হামেশাই বলত, তাই গুরুত্ব দিইনি। তারপর তো বুঝতেই পারছেন, সেদিন দুপুরে সুনীলের ওপর হামলার খবরটা পেয়ে হাসপাতালে দৌড়োলাম, এই ঘরে রাতে ঢোকা হয়নি। পরের দিন রাতে জানলা বন্ধ আছে কি না দেখতে এসে দেখি, সুনীল ঠিক বলেছিল, জানলা খোলাই ছিল, স্লাইডিং উইন্ডো বাইরে থেকে চাড় দিয়ে খোলা হয়েছিল, ছিঁচকে চোরের কাজ।” মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছু খোয়া গেছিল?” মানালি বললেন, “এ ঘরে আছে কী? আইনের বই নিয়ে কে কী করবে?” মাইক বললেন, “পুলিশকে ঘটনাটা জানিয়েছিলেন?” মানালি মাথা নাড়লেন, “এটা কোনও ঘটনা বলেই মনে হয়নি, তখন সুনীলকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি চলছে, অন্য দিকে নজর দেওয়ারও সময় ছিল না।” মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, আর মামলা সংক্রান্ত নথি কোথায় থাকত? মানালি জানালেন, মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথি সব সুনীলের ফার্মেই থাকত, বাড়িতে মামলা সংক্রান্ত নথি আনা বিরল ঘটনা। কোনও ক্লায়েন্ট মামলা নিয়ে ওর চেম্বারে পরামর্শ নিতে এসে কোনও কাগজ দিলে সুনীল সেগুলো এক একটা ড্রয়ারে এক একজনের কাগজপত্র রেখে দিত। সুনীলের ওপর হামলার পরে এ রকম দুটো মামলার কাগজ ওর সলিসিটর ফার্মে মি: স্টুয়ার্টের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।” মাইক বললেন, তার মধ্যে বোধহয় মিসেস স্মিথের কোনও কাগজপত্র ছিল না?” মানালি, মাথা নেড়ে না বললেন।
মাইক উঠে গিয়ে ড্রয়ারগুলো পরীক্ষা করলেন, বেশ প্রশস্ত, সবগুলোতেই চাবি ঝুলছে, কিন্তু চাবি লাগানো নেই। মিসেস শর্মা জানালেন, “ওগুলো সুনীলের সময় বন্ধ হত না, এখন তার ছেলেরাও বন্ধ করবার প্রয়োজন মনে করে না।”
মিসেস স্মিথের ঠিকানা, আর মি: স্টুয়ার্টের ফোন নম্বর রবার্টসনকে নোট করতে বলে মাইক উঠে পড়লেন। বিদায় নেওয়ার আগে মানালিকে কফির জন্য ধন্যবাদ দিয়ে বলে গেলেন শিগগিরই দেখা হবে। বাইরে এসে রবার্টসনকে বললেন, “আজ অনেক তদন্ত হয়েছে, খাওয়া দাওয়া করতে হবে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফেরা যাক। কাল সন্ধ্যায় গ্রীনফোর্ডে মিসেস স্মিথের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ঠিক করো। তার আগে ওনার সম্বন্ধে সব খবর আমার চাই।” রবার্টসন বলল, “বস হঠাৎ মিসেস স্মিথের ব্যাপারে ইন্টারেস্ট নিচ্ছেন কেন?” মাইক বললেন, “কারণ অন্য কোনও এন্ট্রিতে ইন্টারেস্টিং কিছু পাইনি।”রবার্টসন মনে মনে বলল, “শালা বুড়ো ছুঁচো, হেঁয়ালি করছে।”
অধীরদা জল খেতে থামলেন, মুখে মিটিমিটি হাসি। বললেন, “বলুন তো অতনুদা কী বুঝছেন? দেখি কেমন আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তি।”আমি বললাম, “এ টুকু বুঝেছি যে যদি এক মুহূর্তের জন্য ধরে নেওয়া যায় সুনীলের মৃত্যু কোনও তাৎক্ষণিক মারামারির ফলে হয়নি, তবে ধরে নিতে হয় খুনীর খুব তাড়া ছিল, সুনীলের বেঁচে থাকা তার পক্ষে খুব বিপজ্জনক হয়ে পড়েছিল, সেই কারণেই মাইক ব্রিয়ারলি সুনীলের কর্মজীবনের শেষ সপ্তাহে কে কে তার কাছে আইনি পরামর্শ নিতে এসেছিল সেটুকুই খতিয়ে দেখেছিলেন।”অধীরদা বললেন, ব্র্যাভো অতনুদা। “আমি শুধু এইটুকু যোগ করব, খুনীর কাছে খোঁজখবর নেওয়ার মতো সময়টুকুও ছিল না, সে শুধু জানত, সুনীল অ্যাক্টন পার্কে আসছে। হাতে সময় থাকলে অ্যাক্টন পার্কে জনপ্রিয় সুনীলের ওপর হামলার ঝুঁকি সে নিত না। তাড়া খেয়ে দিশাহারা হয়েই তাকে হাতের অস্ত্র ফেলে পালাতে হয়। চলুন দেখা যাক রবার্টসন মিসেস স্মিথের ব্যাপারে মাইককে কী রিপোর্ট দিল।”
পরের দিন বিকেল চারটের সময় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে মাইকের ঘরে ঢুকে রবার্টসন বলল, “সন্ধ্যা ছ’টায় গ্রীনফোর্ডে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিয়েছি, তবে মিসেস স্মিথ নয়, মিসেস অ্যান্ডারসনের সঙ্গে। মিসেস স্মিথ আর জীবিত নেই।
আমার রিপোর্ট তৈরি।” হাতের ফাইলটা দেখিয়ে বলল, “আমিই পড়ি?” মাইক মাথা নাড়লেন, রবার্টসন শুরু করল-
“মিসেস স্মিথের স্বামী রবিন স্মিথ একদা কোলিয়ারি ব্যবসায় ব্যাপক টাকা রোজগার করেন, কিন্তু একসময় তিনি ব্যবসা সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন এবং তার পার্টনার জন বার্নসকে তার অংশের ব্যবসা বেচে দিয়ে ধর্মে কর্মে মন দেন, চার্চে তিনি অনেক দান ধ্যান করতেন। মি: স্মিথ সেরিব্রাল স্ট্রোকে মারা যান ১৯৯৫-এ, তখন তার বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর। স্মিথ দম্পতি নিঃসন্তান। মিসেস অ্যান্ডারসন হলেন মিসেস স্মিথের ভাইঝি, তিনি মিসেস স্মিথের কাছেই মানুষ, তার স্বামী স্টুয়ার্ট অ্যান্ডারসন পেশায় ডাক্তার, গ্রীনফোর্ডেই একটি প্রাইভেট হসপিটালের সঙ্গে যুক্ত। মিসেস স্মিথের বাবার একটি মুদিখানার দোকান ছিল সেন্ট্রাল অ্যাক্টনে, বাবা মারা যাওয়ার পর মিসেস স্মিথ সেখানে বসতেন, কিন্তু মি: স্মিথ মারা যাবার পর তিনি দোকানে যাওয়া ছেড়ে দেন, দোকানটা বন্ধ পড়ে ছিল। আন্দাজ করা যায় মিসেস স্মিথের কিছু পৈতৃক সম্পতিও ছিল এবং সেন্ট্রাল অ্যাক্টনের মতো জায়গায় চালু দোকান থেকে ভালো রোজগার করেছিলেন।
সে বিষয়ে আশাকরি, ‘শর্মা & স্টুয়ার্ট’ সলিসিটর ফার্ম আলোকপাত করতে পারবে, এখনও ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। রবিন স্মিথের একজন ভাইপো আছে, ইয়ান স্মিথ। ইয়ান একটু খ্যাপাটে গোছের, ঘোর নাস্তিক, চার্চের অনুগামী কাকার সঙ্গে তাই একদম বনিবনা ছিল না। ইয়ানের বাবা-মা তার ছোটবেলাতেই সমুদ্রে চান করতে গিয়ে ডুবে মারা যান। ইয়ানকেও মানুষ করেন মিসেস স্মিথ। কাকার সঙ্গে বনিবনা না হলেও মিসেস স্মিথ প্রতিভাবান ইয়ানকে স্নেহ করতেন। ইয়ান যে কোনও বাদ্য যন্ত্র বাজাতে ওস্তাদ। শুধু তাই নয়, বাদ্যযন্ত্রের ওপর তার লেখা অনেক প্রবন্ধও দেশে বিদেশের বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। ১৯৯০-এ, ২২ বছর বয়সে ইয়ান আমেরিকা চলে যায়, কাকার সঙ্গে বনিবনা না হবার ফলেই তার দেশত্যাগ। তবে কাকিমার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। মি: স্মিথ মারা যাবার পর, মিসেস স্মিথ ইয়ানকে দেশে ফিরতে বলেন, কিন্তু ফিরছি ফিরব করে ইয়ানের দেশে ফেরা হয় না, সে আমেরিকায় একটি ব্যান্ডের সঙ্গে বাজনা বাজানোয় মেতে ছিল। ইয়ান শেষ পর্যন্ত দেশে ফেরে ২০০০-এর অক্টোবরে, দীর্ঘ দিনের অনিয়মে তার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গেছিল, ফলে তার মনে হয় দেশে ফিরে থিতু হওয়ার চেষ্টা করাই ভালো। ভালো যন্ত্রী হলেও তেমন টাকা পয়সা ইয়ান রাখতে পারেনি। এদিকে কাকার টাকা নিতেও সে নারাজ। মিসেস স্মিথ তার পারিবারিক সূত্রে পাওয়া সেন্ট্রাল অ্যাক্টনের বন্ধ দোকানটিতে ইয়ানকে একটা বাদ্য যন্ত্রর দোকান খুলে দেন।
আমি সেই দোকান থেকেই ইয়ানের সঙ্গে কথা বলে ফিরছি।”
মাইক এবার প্রথম প্রশ্ন করলেন, “ইয়ান কি দেশে ফিরে তার কাকিমার কাছেই উঠেছিল?” “না বস। সে, দোকান সংলগ্ন রেস্টরুমে একাই থাকে, প্রথমত রবিন তার উইলে ভাইপোকে কানাকড়িও দিয়ে যাননি, মিসেস স্মিথের অবর্তমানে সমস্ত সম্পতি পাবেন মিসেস অ্যান্ডারসন এবং একটা ছোট অংশ পাবে চার্চ। দ্বিতীয়ত অ্যান্ডারসন দম্পতি ইয়ানকে পছন্দ করত না, মিসেস স্মিথও তাই চাননি ইয়ান ওই বাড়িতে উঠুক। ইয়ান জানিয়েছে যে মিসেস স্মিথ ইয়ানের জন্মদিনে তাকে একটা সারপ্রাইস গিফ্ট দেবেন বলেছিলেন। কপালের ফের, ইয়ানের জন্মদিন ২২শে মে, আর মিসেস স্মিথ ২০০১-এর ২১শে মে, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন।” মাইক সোজা হয়ে বসলেন, “এবং রবার্টসন সুনীল শর্মার ওপর হামলা হয়েছিল ২০০১-এর মে মাসের ২০ তারিখে, মিসেস স্মিথ সুনীলের সঙ্গে দেখা করেছিলেন ১৯শে মে। একটা আবছা ছবি যেন ফুটে উঠছে।”
(৪)
মিসেস স্মিথের বাড়িটিকে ছোটখাটো প্রাসাদ বলাই ভালো, গেট ঠেলে ঢুকলেই মনোরম বাগানে, অসংখ্য নয়নাভিরাম ফুলের গাছের সমারোহ, পুরো বাগান ঘিরে সমান করে ছাঁটা ওলিয়েন্ডার(oleander) ফুলের ঝাড় দিয়ে আয়তক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র, ত্রিভুজাকৃতির ডিজাইন তৈরি করে ভেতরে অন্যান্য ফুল গাছ রাখা হয়েছে, প্রশিক্ষিত মালির হাতের কাজ বোঝা যায়। জায়গায় জায়গায় বসবার জন্য মার্বেল ও কাঠের বেঞ্চ রাখা, বাড়ির কম্পাউন্ডে দু’খানা দামি গাড়ি দাঁড়িয়ে, মোরাম বিছানো রাস্তা পেরিয়ে মাইক আর রবার্টসন মূল বাড়িতে বেল বাজানোর আগেই দরজা খুলে দিলেন মিসেস অ্যান্ডারসন, প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় হলেও, যৌবনকে এখনও চৌকাঠ পার হয়ে চলে যেতে দেননি, রবার্টসনের রিপোর্টে মিসেস অ্যান্ডারসনের বয়স বছর পঞ্চাশেক উল্লেখ না থাকলে, চল্লিশ বলে ভুল হতে পারত। মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন, তিনি মাইকদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। ডা: অ্যান্ডারসনও বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছিলেন, ওনাকে দেখলেই মধ্য পঞ্চাশের বলে বোঝা যায়। মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন, “বলুন অফিসার, হঠাৎ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আমার বাড়ির দরজায় কেন?” মাইক বললেন, “আমরা এসেছি মিসেস স্মিথের আইনজীবী সুনীল শর্মার খুনের ব্যাপারে তদন্ত করতে। ২০০১-এর ১৯শে মে, শুক্রবার রাতে একটা উইল সংক্রান্ত ব্যাপারে কথা বলতে মিসেস স্মিথ সুনীলের বাড়িতে তার চেম্বারে গেছিলেন, সেদিন ঠিক কী বিষয়ে উনি কথা বলতে গেছিলেন আপনার কোনও ধারণা আছে?” মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন, “মনে আছে, পিসি উইল পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন, সেটা সম্ভব হয়নি, পরের দিনই দুর্ভাগ্যবশত উনি হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। কিন্তু সুনীলের মৃত্যুর সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? সুনীলের পুরো ব্যাপারটাই জানি, সংবাদপত্রে এটা তো বড়ো খবর।” মাইক বললেন, ওই উইলের ব্যাপারে কী কথা হয়েছিল নির্দিষ্ট করে সেটা বলতে পারবেন?” ডা: অ্যান্ডারসন এবার বললেন, “এটা কী আমরা বলতে বাধ্য? এটা তো গোপনীয় ব্যাপার।” মিসেস অ্যান্ডারসন, স্বামীকে থামিয়ে বললেন, “পিসির উইলে বেশ কিছু টাকা চার্চকে দেওয়া হয়েছিল, পিসি শেষ পর্যন্ত মত পরিবর্তন করেছিলেন, চেয়েছিলেন ওই অংশটা আমার স্বামীকে দিয়ে যেতে, পিসির শরীর কিছুদিন যাবৎ ভালো যাচ্ছিল না, ডা: অ্যান্ডারসনই ওনার চিকিৎসা করতেন, হয়তো তাই কৃতজ্ঞতা বশত ওকে কিছু দেবেন ভেবেছিলেন, উইল যেহেতু পরিবর্তন হয়নি, তাই আমি চার্চের টাকা তাদের বুঝিয়ে দিয়েছি। আপনারা অ্যাক্টন চার্চে খোঁজ নিতে পারেন।” মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “আর মি: স্মিথের ভাইপো ইয়ানকে কিছু দিতে চাননি? তার সঙ্গে আপনাদের সম্পর্কই বা কেমন?” মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন, “মি: রবিন স্মিথের নির্দেশ ছিল ইয়ানকে কিছু দেওয়া যাবে না। ইয়ান চিরকাল একটু পাগলাটে গোছের, কোনওদিন সামাজিক জীবন পালন করল না, আমরা ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান আর ও কট্টর নাস্তিক, সেই কারণেই মি: স্মিথ ওকে কানাকড়িও দেননি। ইয়ানের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই বলাই ভালো। পিসিমা অর্থাৎ মিসেস স্মিথ মারা যাওয়ার সময় ইয়ান শেষবার এই বাড়িতে এসেছে, তবে এই নয় যে ও আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলে আমরা দেখা করব না। ইয়ানের সঙ্গে আমাদের কোনও শত্রুতা নেই।” মাইক বিদায় নেবার সময় বললেন, “আপনাদের মালির হাতের কাজ কিন্তু চমৎকার, ব্রিটিশ মালি কিন্তু খুব খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার।” মিসেস অ্যান্ডারসন হেসে বললেন, “ঠিক, তবে ব্রিটিশ গায়নার মালিরা ততটা নয়। আমাদের দু’জন মালি ব্রিটিশ গায়নার লোক।” মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “এরা কী মিসেস স্মিথের সময় থেকে আছেন?” মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন, “না। তখনকার মালিরা আর নেই, দেশে ফিরে গেছে।
এটাও কী আপনার তদন্তের
অন্তর্গত!” মাইক বললেন, “আরে না না, বাগানটা এত সুন্দর যে কৌতূহল হল, কী নিঁখুত করে ওলিয়েন্ডার ঝোপগুলোকে ছাঁটা হয়েছে, দেখার মতো।” মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন, “ওটা মেশিনে ছাঁটা হয়, আপনিও পারবেন।”
(৫)
গাড়িতে উঠে মাইক বললেন, “ইয়ানের দোকানে চলো, ওর সঙ্গে কথা বলা দরকার। তার আগে রবার্টসন বলো দেখি ধর্মপ্রাণ পরিবারের কর্ত্রী হঠাৎ চার্চকে বঞ্ছিত করে ডা: অ্যান্ডারসনকে টাকা দেবেন কেন? যেখানে মিসেস অ্যান্ডারসন প্রচুর সম্পত্তি পেয়েছেন। আর উইল তো রেজিস্ট্রি করবার দরকার নেই তবে মিসেস স্মিথ অশক্ত শরীরে রাতে একা সুনীলের বাড়ি গেলেন কেন? তোমার রিপোর্ট বলছে, মিসেস স্মিথ পারিবারিক ভাবে ভালো সম্পত্তি পেয়েছিলেন, সেটা কী হল? তার কোনও উল্লেখ অ্যান্ডারসনরা করেননি। ইয়ানকে মিসেস স্মিথ বলেছিলেন জন্মদিনে সারপ্রাইস গিফ্ট দেবেন। সেটা কী? আমার মনে হচ্ছে মিসেস মানালি শর্মা মিসেস স্মিথের অ্যাপয়েন্টমেন্টের কারণ লিখতে একটা টেকনিকাল ভুল করেছেন। ওটা ঠিক উইল নয়। তুমি সুনীলের সলিসিটর ফার্মের পার্টনার মি: স্টুয়ার্টের সঙ্গে কাল দেখা করবে এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ফর্মাল রিকোয়েস্ট নিয়ে গিয়ে মিসেস স্মিথের সব সম্পত্তির খতিয়ান নেবে। এই উইলের ব্যাপারটা সন্দেহজনক, এ বিষয়ে যতটা সম্ভব তথ্য স্টুয়ার্টের থেকে যোগাড় করবার চেষ্টা করবে।
এই তদন্ত তুমিই চালিয়ে নিয়ে আমাকে রিপোর্ট দেবে যত শীঘ্র সম্ভব।”
অধীরদা সিগারেট ধরাতে থামলেন, “কয়েকটা সুখটান দিয়ে বললেন, মাইক ব্রিয়ারলি রক্তের গন্ধ পেয়ে গেছেন মনে হচ্ছে, কিন্তু কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না, কোথাও কোনও মোটিভ দেখতে পাচ্ছি না অতনুদা।” আমি বললাম, “ঠিক তাই, উইল পরিবর্তন হলে অ্যান্ডারসনদের অতিরিক্ত লাভ হত, মিসেস স্মিথ ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান হয়েও কেন চার্চকে শেষে টাকা দিতে চাননি, সেটা অন্য প্রশ্ন। অ্যান্ডারসনরা তো আইন মেনে চার্চের প্রাপ্য হস্তান্তর করে দিয়েছে। উইল রেজিস্ট্রি না করলে চলে ঠিকই, হয়ত মিসেস স্মিথ তাঁর আইনজীবীর পরামর্শ নিতে চেয়েছিলেন, অনেক সাবধানী মানুষ আছেন যারা রেজিস্ট্রি করান, এটা বিরল কোনও ঘটনা নয়, আর সুনীলের ওপর হামলার সাথে এর যোগ কোথায়?”
অধীরদা বললেন, “মাইক ব্রিয়ারলির মতি গতি কখনই বোঝা যায় না। এই কেসে তো একদমই বোঝা যাচ্ছে না। চলুন, মাইকরা ইয়ানের দোকানে ঢুকে পড়েছে।”
(৬)
‘ইয়ান্স প্যারাডাইস’ নামক বাদ্যযন্ত্রের দোকানটিতে ঢুকে মাইক স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, দোকানটি একটি বহুতলের একতলায়, খুব বড়ো নয়, কিন্তু ঠাসাঠাসি করে হরেক রকমের বাজনা রাখা, যাদের চোখে দেখা দূরে থাকুক, নামই জানেন না মাইক। ক্রেতা কেউ দোকানে ছিল না। ইয়ান একটা চেয়ারে বসে একটা তারের যন্ত্র বাজাচ্ছিল, অদ্ভুত মিষ্টি সুর। হঠাৎ বলল, “এটা দোতারা, ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র।” বলে আবার বাজাতে থাকল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দু’জন গোয়েন্দা কেন ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে সে নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। রবার্টসন কালকেই ওর সঙ্গে কথা বলে গেছে যেন খেয়ালই নেই, মাইকদের আবির্ভাব যেন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। একমুখ দাড়ি, গোঁফ, লম্বা লম্বা চুল, চোখে চশমা, জিন্স আর ঢোলা টি শার্টে ইয়ানকে দোকানের সঙ্গে একাত্ম লাগছিল, অন্যরকম হলে যেন মানাত না। হঠাৎ করেই ইয়ান বলে উঠল, “শুরু করুন অফিসার, কী জানতে চাইছেন?” মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “মিসেস স্মিথ কবে আপনাকে সারপ্রাইস গিফ্ট দেওয়ার কথা বলেছিলেন মনে আছে?” ইয়ান বলল খুব মনে আছে, ২০০১-এর ১৯শে মে শুক্রবার সন্ধ্যায়। কাকিমার সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। কাকিমা আমার মা ছিলেন, নিজের মাকে মনে পড়ে না, যখন মারা যান আমি খুব ছোট। কাকিমা মাঝে মাঝেই দোকানে চলে আসতেন তার পাগল ছেলেকে দেখতে, ওনার শরীরটা শেষ কয়েক মাস ভালো ছিল না। সেদিনও ভালো বোধ করছিলেন না, বসলেন না। বললেন, সোমবার তোমার জন্মদিনে একটা সারপ্রাইস গিফ্ট দেব, আমার হাতে আর বেশি সময় নেই, বলে গাড়িতে উঠে পড়লেন, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।” মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “কী গিফ্ট দিতেন বলে মনে হয়?” ইয়ান বলল, “কোনও বাজনা হবে নিশ্চয়ই।” মাইক-“আর মিসেস স্মিথ কী ধরনের শরীর খারাপে ভুগছিলেন?” ইয়ান-“গা গোলানো, বমি বমি ভাব, শরীর খুব দুর্বল, অনেকসময় ঝাপসা দেখতেন, নতুন চশমা করিয়েছিলেন, লাভ হয়নি। হার্টেরও সমস্যা ছিল।
বাড়িতেই ডাক্তার রয়েছে, ভেবেছিলাম সেরে উঠবেন, সেটা হল না।” মাইক-“আপনি জানতেন উনি সেদিন ওনার আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন?” ইয়ান-“না, পরে শুনেছি।” মাইক-“মি: স্মিথ আপনাকে সম্পত্তির ভাগ দেননি, কিন্তু আপনার বাবা-মা আপনার জন্য কিছু রেখে যাননি?” ইয়ান-“না। আমার দাদু, অ্যালেক্স স্মিথ ব্রিটিশ গায়নায় গিয়ে বক্সাইটের ব্যবসায় কিছু টাকা করেছিলেন, অ্যান্ডারসনরা যে বাড়িতে থাকে সেটা তাঁরই তৈরি, পরে গ্যাম্বলিংয়ের নেশায় ঐ বাড়ি আর জমিটুকু ছাড়া দাদুর সব যায়। শুনেছি আমার বাবারও ঐ রোগ ছিল, বাড়িতে নিজের অংশটুকু কাকাকে বেচে দিয়ে উনি জুয়ায় সব উড়িয়ে দেন।” মাইক-“ব্রিটিশ গায়নার সঙ্গে আপনাদের বেশ যোগাযোগ আছে মনে হচ্ছে, অ্যান্ডারসনদের দুই মালি শুনলাম ব্রিটিশ গায়নার লোক।” ইয়ান-“হ্যাঁ, দাদুর আমল থেকেই এটা চলছে। দাদু দেশে আসার সময় ওখানকার কয়েকজন কর্মচারীকে সঙ্গে এনেছিলেন, তারপর থেকে পুরুষানুক্রমে ব্যাপারটা চলছে।” মাইক-“আপনার কাকিমার সময়ের মালি ক’জন ছিল? তারাও কি ব্রিটিশ গায়নার?” ইয়ান-“হ্যাঁ, কলিন আর মাইকেল বুচার। দুই ভাই ছিল, কাকিমা মারা যাবার পর আর থাকতে চায়নি, দেশে ফিরে যায়। আমার সাথে ওদের একটা গভীর বন্ধুত্ব ছিল, ওদের কখনও মালি ভাবিনি, আমার কাকিমা সেরকমই শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমি যখন দেশ ছাড়ি তখনও ওরা ছিল, ফিরে এসেও ওদের দেখে খুশি হয়েছিলাম, বুচাররা খুবই অনুগত, ওরা মনিবের জন্য হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়ে দেবে। এখনও আমাকে নিউ ইয়ার্স কার্ড পাঠাতে ভোলে না, মোবাইলেও আমার সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়, এখন যারা আছে তাদের ওরাই পাঠিয়েছে, ওদের গ্রামের ছেলে, কিন্তু পরিবারের নয়, বুচারদের পরিবারের বাইরের কেউ এই প্রথম ওই বাড়িতে ব্রিটিশ গায়না থেকে এসে কাজে লেগেছে।” মাইক-“ওদের পরিবারের কেউ এল না কেন জানেন?” ইয়ান-“জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওরা চুপ করে থাকে।” মাইক-অ্যান্ডারসন দম্পতির সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা? ইয়ান-ডা: অ্যান্ডারসন সম্বন্ধে কিছু বলতে পারব না, ক্রিশ্চিনার সঙ্গে মানে আপনাদের মিসেস অ্যান্ডারসনের সঙ্গে ওর যখন বিয়ে হয় তখন আমি আমেরিকায়, ফিরে আসার পরে যখন মাঝে মাঝে কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি, তখন দেখা হলে সৌজন্যমূলক হাই হ্যালোর বেশি কথা এগোয়নি। আমি আর ক্রিশ্চিনা একসাথে বড়ো হয়েছি, ছোটবেলাতে ভাব ছিল, একটু বড়ো হয়ে মি: স্মিথের নির্দেশে আমাকে এড়িয়ে চলত, ততদিনে আমি নাস্তিক ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত। কাকিমা মনে করতেন, ওরা আমাকে পছন্দ করে না, বোধহয় ওনার ধারণা ঠিক ছিল।”
বুচার ভাইদের ফোন নাম্বার রবার্টসনকে নোট করতে বলে, মাইক ইয়ানের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। গাড়িতে রবার্টসনকে বললেন, “কালকে তুমি স্টুয়ার্টের সঙ্গে সকালেই দেখা করবে। আমার মন বলছে আরও একটা স্পেশাল পোস্টমর্টেমের নাটক করতে হবে শিগগিরই। রবার্টসন মনে মনে বিড়বিড় করল, “তোমার সবেতেই নাটক, পোস্টমর্টেমেরও না কি নাটক!” মুখে বলল, “কালকে দুপুরের মধ্যে মি: স্টুয়ার্টের থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করে আপনার সামনে ফেলে দেব বস।”
আমি অধীরদাকে বললাম, “মাইক আরও একটা স্পেশাল পোস্টমর্টেমের ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সেটা কী মিসেস স্মিথের না মি: স্মিথের? এতদিন বাদে তাতে কোনও লাভ হবে কি?”
অধীরদা বললেন, “অতনুদা আপনি বোধহয় লক্ষ করেননি যে মাইক ঠিক পোস্টমর্টেমের কথা বলেননি, বলেছেন পোস্টমর্টেমের নাটকের কথা। আর পল কারির কেসটা ভুলে গেলেন? সেই যে বউকে স্লিপিং পিল খাইয়ে নিকোটিন ইঞ্জেকশন করে মেরেছিল, সেই কেসে পল কারিকে সাজা দিতে কুড়ি বছর লেগেছিল। আমি বললাম, ও: হ্যাঁ, মনে পড়েছে ক্যালিফোর্নিয়া কোর্টে এটার শুনানি হয়েছিল।” অধীরদা বললেন, “চলুন মনে হচ্ছে আমরা যবনিকা পতনের খুব কাছে চলে এসেছি।
করিৎকর্মা রবার্টসন পরের দিন সকালে মি: স্টুয়ার্টের সঙ্গে দেখা করে এসে মাইককে রিপোর্ট করেছে। দেখা যাক কী আছে সেই রিপোর্টে, আমরা বরং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে মাইক ব্রিয়ারলির ঘরে ঢুকে পড়ি।”
রিপোর্টটা মন দিয়ে পড়ে মাইক বললেন, “বলেছিলাম না রবার্টসন মিসেস শর্মা, মিসেস স্মিথের অ্যাপয়েন্টমেন্টের কারণ লেখার সময় একটা টেকনিকাল ভুল করেছিলেন, উনি তো আইনজ্ঞ নন। আজই খুনীর পর্দা ফাঁস করব।”
(৭)
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কনফারেন্স রুমে সেদিন সন্ধ্যা ছ’টার সময়ে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড প্রধান টনি অ্যাডামসের নির্দেশে একে একে জড়ো হয়েছেন এই নাটকের সমস্ত কুশীলবেরা। মিসেস মানালি শর্মার সঙ্গে এসেছেন তার দুই ছেলে অনিল ও নিখিল, বড়ো ছেলে অনিলের বউ রুচিরা, সুনীলের পার্টনার মি: স্টুয়ার্ট। এসেছেন ডা: অ্যান্ডারসন, মিসেস অ্যান্ডারসন এবং ইয়ান স্মিথ। আর অবশ্যই উপস্থিত আছেন সুনীল শর্মা হত্যা মামলার তদন্তকারী অফিসার মি: মাইক ব্রিয়ারলি ও তাঁর সহকারী রবার্টসন। ডিম্বাকৃতি টেবিলের একপ্রান্তে বসেছেন টনি অ্যাডামস স্বয়ং, অপর প্রান্তে বসেছেন মাইক ব্রিয়ারলি। মাইকের ডানপাশে বসেছেন শর্মা পরিবার এবং মি: স্টুয়ার্ট। বামপাশে অ্যান্ডারসন দম্পতি, ইয়ান স্মিথ এবং রবার্টসন। এ ছাড়া রয়েছেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দু’জন অফিসার যারা সমস্ত ঘটনার ভিডিয়ো রেকর্ডিং করবেন। টনি অ্যাডামস ঘরের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে প্রধানসুলভ গাম্ভীর্যে বললেন, “মঞ্চ প্রস্তুত, শুরু করো মাইক।” মাইক বললেন, “হ্যাঁ স্যার শুরু করি, তার আগে আপনাকে ধন্যবাদ, আপনি হস্তক্ষেপ না করলে এত তাড়াতাড়ি স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে অনুমতি আদায় করে আমার কাঙ্ক্ষিত মৃতদেহটি তুলে ফেলে ফরেন্সিক টেস্ট করা সম্ভব হত না, সবার কাছে মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি, মৃতদেহ না বলে কঙ্কাল বলাই উচিত। রবার্টসন প্রাথমিক রিপোর্ট এসে গেছে, সেটা স্যারের হাতে দাও, বিস্তারিত রিপোর্ট কয়েকদিনের মধ্যে এসে যাবে, তবে এই রিপোর্ট থেকে স্যার যা বোঝার বুঝতে পারবেন। ফরেন্সিক সায়েন্স আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে হাড়ের কার্বন টেস্ট এবং অন্যান্য পরীক্ষা করে আঠারো বছরের আগের দেহকে কথা বলিয়ে ছাড়ে। সেসব টেকনিকাল কচকচিতে আমি ঢুকছি না, কারণ ডা: অ্যান্ডারসন কিছুটা ধরতে পারলেও বাকিরা কিছুই বুঝবেন না।” রবার্টসনের হাত থেকে রিপোর্টটা নিয়ে তাতে চোখ বুলিয়ে টনি অ্যাডামস বললেন, “খুবই ঘৃণ্য ব্যাপার। তুমি বলতে থাকো।”
মাইক আবার শুরু করলেন, “সুনীল শর্মার ওপর হামলার ঘটনা আসলে একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, এত নৈপুণ্যের সঙ্গে এর চিত্রনাট্য লেখা হয়েছিল যে পুলিশ আঠারো বছর ধরে এটিকে অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া হামলার ঘটনা ধরে নিয়ে দু’জন আফ্রিকান যুবকের খোঁজ চালিয়ে গেছে, তাদের পরিচয় জানার জন্য মোটা অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এইভাবেই এই মামলা যুগ যুগ ধরে অমীমাংসিত থেকে ধামা চাপা পড়ে যেত, যদি না বিচক্ষণ টনি অ্যাডামস স্যার, মাইক ব্রিয়ারলির হাতে এর তদন্ত ভার তুলে দিতেন।” মাইক নাটকীয় ভাবে থেমে ঘরের সবার ওপরে চোখ বুলিয়ে নিলেন প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। রবার্টসন বিড়বিড় করে উঠল, “শালা বুড়ো ছুঁচো, আবার নাটক শুরু করেছে।” মুখে বলল, “হ্যাঁ বস, তা আর বলতে।” টনি অ্যাডামস বিরক্ত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে, কাম টু দ্য পয়েন্ট ব্রিয়ারলি।” মাইক, অ্যাডামসকে অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, “স্যার, ঘটনার সূত্রপাত মি: ইয়ান স্মিথ ২০০০-এর অক্টোবর মাসে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে এলে। মিসেস স্মিথ তাঁর স্বামীর এই ভাইপোটিকে পুত্রবৎ দেখতেন, ইয়ান একজন প্রতিভাবান বাদ্যযন্ত্র শিল্পী এবং টাকা পয়সা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন, বিরল একজন মানুষ। মিসেস স্মিথ তাঁর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সেন্ট্রাল অ্যাক্টনের দোকানটিতে ইয়ানকে একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান খুলে দিলেন, বিচক্ষণ মিসেস স্মিথ বুঝেছিলেন এই একটি ব্যাপারে ইয়ানের উৎসাহ আছে, এই ব্যবসা সে চালাতে পারবে। আমরা তদন্ত সূত্রে জানতে পারি মিসেস স্মিথ ২০০১-এর ১৯শে মে, শুক্রবার ইয়ানের দোকানে দেখা করতে গিয়ে ২২ তারিখ সোমবার ইয়ানের জন্মদিনে তাকে একটি সারপ্রাইস গিফ্ট দেবেন বলেন, তিনি আরও বলেন তাঁর হাতে সময় খুব কম। যেটা আমার মতে খুব ইঙ্গিতপূর্ণ, তাঁর ষষ্ঠেন্দ্রিয় সম্ভবত বলছিল দিন ঘনিয়ে এসেছে। ইয়ান ভেবেছিল মিসেস স্মিথের সেইসময় তাড়া আছে। ওখান থেকে মিসেস স্মিথ চলে যান তার আইনজীবী সুনীলের সঙ্গে দেখা করতে। ইয়ানকে যখন জিজ্ঞাসা করি, সারপ্রাইস গিফ্টটা কী হতে পারত বলে মনে হয়? তখন সে বলে কোনও বাজনা হবে। ইয়ানের ভাবনায় বাদ্যযন্ত্রই সব, কিন্তু তার ধারণা ঠিক ছিল না। মিসেস শর্মা আপনি মিসেস স্মিথের অ্যাপয়েন্টমেন্টের কারণ হিসেবে লিখেছিলেন উইল, হয়তো ফোনে উনি তাই বলেছিলেন, আসলে ওটা ছিল দানপত্র। সাধারণ মানুষের কাছে ও দুটোর খুব একটা পার্থক্য না থাকলেও আইনের চোখে আছে। দানপত্র রেজিস্ট্রি করতে হয়, উইল না করলেও চলে। দানপত্র রেজিস্ট্রি করা মানে গ্রহীতা সঙ্গে সঙ্গে সম্পত্তির মালিকানা পেয়ে যাবে। উইলে সেটা নয়।
সুনীল শর্মার পার্টনার মি: স্টুয়ার্ট আমাদের জানান, মিসেস স্মিথ অ্যাক্টন পার্কের দোকানটি ইয়ানকে দানপত্র করেই হস্তান্তর করেছিলেন। আরও জানতে পারি মিসেস স্মিথের কোনও উইল ছিলই না, তাই সেটা পরিবর্তন করতে তিনি সুনীলের কাছে যেতে পারেন না। মি: রবিন স্মিথ যে উইল করে গেছিলেন তাতে পরিষ্কার লেখা আছে মিসেস স্মিথের অবর্তমানে কিছু অর্থ পাবে অ্যাক্টন চার্চ এবং বাকি সমস্ত সম্পতি পাবেন মিসেস অ্যান্ডারসন। উইল এমন ভাবে করা হয়েছিল, যেটা পরিবর্তনের ক্ষমতা মিসেস স্মিথের ছিল না। সুতরাং মিসেস অ্যান্ডারসন যে বলেছিলেন মিসেস স্মিথ উইল পরিবর্তন করতে গেছিলেন সেই তথ্য সঠিক নয়। মিসেস স্মিথ তাঁর বাবা মি: জো রাইটের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে একটি দোকান ছাড়া বেশ কিছু টাকা পেয়েছিলেন, সেই টাকা দিয়ে তিনি অ্যাক্টন হাউসিং এস্টেটে একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন, বাকি টাকা দিয়ে পরে তিনি ইয়ানের দোকান সাজিয়ে দেন। এ ছাড়া তার বেশ কিছু জুয়েলারি এবং ব্যাঙ্ক বন্ড ছিল। যে সন্ধ্যায় তিনি সুনীলের সঙ্গে দেখা করতে যান, সেদিন সকালে তিনি সুনীলকে ফোন করে তাঁর সেই অ্যাপার্টমেন্টটিকে ইয়ানের নামে হস্তান্তর করার দানপত্র তৈরি করতে বলেন, সন্ধ্যাবেলায় গিয়ে সেই দানপত্র স্বচক্ষে দেখেন এবং সোমবার কোর্ট খুললে সেটা রেজিস্ট্রি করতে বলেন, সেটাই হত ইয়ানের সারপ্রাইস বার্থডে গিফ্ট। মিসেস স্মিথ চেয়েছিলেন তাঁর জীবদ্দশায় ইয়ানকে থিতু করে যেতে, তাই এই দানপত্র।”
টনি অ্যাডামস, মাইক ব্রিয়ারলিকে থামালেন, “ব্রিয়ারলি তুমি এটা কী করে জানতে পারলে?” মাইক বললেন, “স্যার সেখানে পরে আসছি, কিন্তু খুনীও সেটা জানতে পারল। মিসেস স্মিথই সেটা তাকে বা অপরাধে যুক্ত তার সহকারীকে বললেন। সে জন্য তাঁর ওপর বলপ্রয়োগ করা হয়েছিল কি না সেটা অপরাধীরাই বলতে পারবেন, তবে সুনীল শর্মার সঙ্গে দেখা করার কারণ সাধারণ ভাবেই তিনি বলে থাকতে পারেন। মিসেস স্মিথ বুঝেছিলেন তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছে না, আন্দাজ করেছিলেন বেশিদিন বাঁচবেন না, কিন্তু এটা সম্ভবত আন্দাজ করতে পারেননি যে বেশ কয়েকমাস যাবৎ তাঁর শরীরে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা হলে তিনি অনেক সতর্ক হতেন।
ইয়ান, মিসেস স্মিথের যেসব শারীরিক উপসর্গর কথা বলেছিল তা কয়েকটা বিষ থেকে হতে পারে, তবে স্যার আপনার হাতের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে নির্দিষ্ট বিষের কথা উল্লেখ করা আছে।” মিসেস অ্যান্ডারসন এইসময় উত্তেজিত ভাবে বললেন, “সে কী! আমাকে না জানিয়ে কী করে আমার পিসির দেহ কবর থেকে তোলা হল?” মাইক বললেন, “শান্ত হোন মিসেস অ্যান্ডারসন, মিসেস স্মিথের শরীরের ময়না তদন্তের অনুমতি দিয়েছেন, মি: ইয়ান স্মিথ। ওনার এ ব্যাপারে পূর্ণ অধিকার আছে, আপনি প্রয়োজনে পরে আপনার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে নেবেন, এখন আমাকে বাধা দেবেন না।”
মাইক বলে চললেন, “দানপত্রের কথা জানার পর, খুনী দুটো লক্ষ্য ঠিক করল, ওটা রেজিস্ট্রি বন্ধ করা এবং দানপত্রে কী আছে জানা। হয় মিসেস স্মিথ দানপত্রে কী আছে বলেননি, নয়তো বললেও খুনী সেটা বিশ্বাস করেনি, ভেবেছিল আরও কিছু আছে। বিশ্বাসঘাতকরা নিজেরাও কাউকে বিশ্বাস করে না। লক্ষ্যপূরণের জন্য দরকার ছিল দানপত্রটি হস্তগত করা। তারপর মিসেস স্মিথকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়। সে প্রক্রিয়া আগেই চালু হয়ে গেছে ইয়ানকে দোকান দান করবার পর থেকে, যা গেছে তা গেছে কিন্তু আর কিচ্ছু যেন মিসেস স্মিথ ইয়ানকে না দিতে পারেন। একজন ষাট বছরের মহিলাকে কয়েক মাস ধরে স্লো পয়জনিং করার পর একজন অভিজ্ঞ লোকের পক্ষে সঠিক মাত্রায় বিষ প্রয়োগ করে সেটাকে হার্ট অ্যাটাক বলে চালিয়ে দেওয়া সাধারণ কাজ। লক্ষণগুলো হার্ট অ্যাটাকের মতোই লাগবে বটে।”
মিসেস অ্যান্ডারসন চেঁচিয়ে উঠলেন, “এটা তো সরাসরি আমার আর আমার স্বামীর দিকে আঙুল তোলা বলে বোঝা যাচ্ছে, কী আজেবাজে বকছেন অফিসার, তখন থেকে মনগড়া গল্প বলছেন, প্রমাণের কোনও বালাই নেই। আঠারো বছর আগের একটা ঘটনা, সব কথা মনে থাকে! হতে পারে তাই ভুল করে সেদিন উইল পরিবর্তনের কথা বলেছিলাম, তার মানে আমরা পিসিকে মেরেছি?” মাইক বললেন, “আপনি পরে বলবেন, আগে আমার কথা সবাইকে শুনতে দিন।” সামনে রাখা বোতল থেকে এক ঢোঁক জল খেয়ে মাইক আবার শুরু করলেন, “খুনী আসরে নামাল সেই দু’জন আফ্রিকান যুবককে, ওরা সেদিন রাতে জানলা ভেঙে সুনীলের চেম্বারে ঢুকল এবং দানপত্রটি হস্তগত করে খুনীর হাতে তুলে দিল। যারা পরের দিন অ্যাক্টন পার্কে সুনীলের ওপর হামলা করেছে বলে আমরা জানি, কিন্তু আসলে তারা জানত না সুনীলের ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণ হবে। খুনী জানত সোমবার সকালেই সুনীল বিষয়টা জেনে যাবে এবং আবার একটি দানপত্র তৈরি হবে, সুতরাং সুনীল যেন কিছুতেই চুরির কথা জানতে না পারে। সুনীল এবং মিসেস স্মিথ কেউই যেন সোমবারের সকাল না দেখতে পায়, তবে এই দানপত্রের কথা চিরকালের মতো ধামাচাপা পড়ে যাবে। এদের একজন বেঁচে থাকলেও সেটা সম্ভব নয়।
বাস্তবিক মি: স্টুয়ার্ট বিষয়টা জানতেন না, রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে নিশ্চয়ই জানতে পারতেন।” যাইহোক, দানপত্র হাতে পাবার পরদিন সকালে খুনী সুনীলকে ফোন করে কোনও একটা আইনি সহায়তা চায়। সুনীল শনি-রবি কাজ করতেন না, পূর্ব পরিচিত হওয়ার সুবাদে তবু খুনীকে অ্যাক্টন পার্কে কফিশপে এসে দেখা করতে বলেন। খুনী সুনীলের গতিবিধি জানার জন্যই আইনি সাহায্য চেয়ে ফোন করেছিল, সুযোগ যখন এসে গেল তখন সে
আফ্রিকান দুই যুবককে অ্যাক্টন গার্ডেন বারে অপেক্ষা করতে বলে তাদের কর্তব্য বুঝিয়ে দিল, বলল, সুনীলকে একটু হুমকি দিতে হবে, সে টাকা ধার নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না, আফ্রিকান যুবকরা সুনীলকে চিনত না। রবার্টসন, সেদিন যে সময় আমরা অ্যাক্টন পার্কে গেছিলাম মোটামুটি ঠিক সেই সময়েই আঠারো বছর আগে ঐ স্থানে সুনীলের ওপর হামলা হয়। বেলা বারোটা নাগাদ সেদিন ক’জন লোককে অ্যাক্টন পার্কের রাস্তায় দেখেছ? হাতে গোণা কয়েকজন, লোকজন যা থাকার বার, রেঁস্তোরা গুলোতেই ছিল, অ্যাক্টন পার্ক জমে ওঠে দুপুরের পর।
আঠারো বছর আগে অ্যাক্টন পার্ক স্বভাবতই এত জমজমাট ছিল না, লোকজন আরও কম থাকার কথা। বারের গার্ড নেভিল যে সেদিন বলল, সুনীলের ওপর ওখানে হামলা চালানো সহজ নয়, সেটা এখনকার সময়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে বলেছে। খেয়াল করে দেখো, ওখানে বারংবার সুনীলের অনেক বন্ধু থাকার কথা বলা হলেও, হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাদের একজনের জবানবন্দীও পুলিশ রেকর্ড করেনি। তারা আহত সুনীলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাই বলেছে, আর খুনী মরীয়া ছিল, সে যেকোনও অবস্থাতেই সেদিন হামলা চালাত। কফি শপের বেয়ারা বলেছিল সুনীল তার বন্ধুকে বলছে উইকএন্ডে সে ব্যবসার কথা বলে না, সেটা আইন ব্যবসা। এরপর খুনী পূর্ব পরিকল্পনা মতো সুনীলকে বারে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়, সুনীল সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং বারে যাওয়ার পথে ঘটে হামলার ঘটনা। এখন আমরা বলতে পারি সুনীলের সঙ্গে থাকা কফিশপের বন্ধুটিই খুনী। রবার্টসন এখন আমি সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করব। ভুল হলে ডা: অ্যান্ডারসন একটু শুধরে দেবেন।” ডা: অ্যান্ডারসন বললেন, “আপনি নাটক চালিয়ে যান, বেশ উপভোগ করছি।” মাইক নাটুকে ভঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার শুরু করলেন, “রবার্টসন, বারের জানলায় বসে লক্ষ রাখলে, কফি শপ থেকে কেউ বেরিয়ে যদি বারের দিকে আসতে থাকে তবে সেটা অনায়াসে দেখা সম্ভব। নেভিল তার জবানবন্দীতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে হলফ করে বলেছিল, হামলাকারী যুবকরা বার থেকেই বেরিয়েছিল। কফি হাউস থেকে বারের দূরত্ব আন্দাজ দেড়শো মিটার, সুনীলের ওপর হামলারারীরা চড়াও হয় বারের আন্দাজ ষাট মিটার দূরে। তার মানে সুনীলরা কফি শপ থেকে বেরিয়ে নব্বই মিটার পথ অতিক্রম করেছিল আর হামলাকারীরা বার থেকে বেরিয়ে ষাট মিটার। ঘটনা যদি পূর্ব পরিকল্পিত হয় তবে হামলাকারীরা সুনীলদের কফি শপ থেকে বেরনোর পর দ্রুত নিজেদের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে কফি শপের দিকে যাওয়ার সময় সুনীলদের থেকে কিছুটা কম পথ অতিক্রমই করবার কথা। এই পরিকল্পনা এতই সরল যে এর জন্য রিহার্সালের প্রয়োজন নেই। খুনী সেদিন সকালে সুনীল অ্যাক্টন পার্কে আসার আগেই তার ভাড়া করা দু’জন আফ্রিকান যুবককে, থুড়ি তার কর্মচারী দু’জন আফ্রিকান বংশোদ্ভূতকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছিল। খুনীর সাইড ব্যাগে রাখা ছিল গাছ কাটার কাঁচিটি, যেটা সেদিন সকালেই সে তুলে নেয় তার কর্মচারীদের কাছ থেকে, তখন তারা বাগানে গাছ ছাঁটছিল, যা দেখে কাঁচি ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত খুনী ওটাকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়। সে যদিও একটু অন্য কাঁচি ব্যবহারে অভ্যস্ত, তবে হিউম্যান অ্যানাটমিতে বিশেষজ্ঞ একজনের পক্ষে একটি মোক্ষম আঘাতে একজনের ভবলীলা সাঙ্গ করে দেওয়া সামান্য ব্যাপার। বেচারা দুই যুবক বুঝতেই পারেনি তাদের সঙ্গে বচসার সুযোগ নিয়ে খুনী মুহূর্তের মধ্যে ব্যাগ থেকে কাঁচি বার করে সুনীলের মাথার পেছন দিকে স্ট্যাব করবে, তারা ভয় পেয়ে দৌড়তে আরম্ভ করে, পেছনে পেছনে খুনীও পগারপার হয়ে যায়, তবে উত্তেজনার কারণে তার হাত থেকে কাঁচিটি পড়ে যায়। বারের গার্ড নেভিল ভেবেছিল সুনীল ও তার বন্ধুদের সঙ্গে আফ্রিকানদের বচসা হয়েছে এবং সুনীলের বন্ধু আফ্রিকানদের তাড়া করেছে। খুনী অ্যাক্টন পার্কে নিয়মিত আসত না মানে কখনই আসেনি তা নয়। সে তো অ্যাক্টনের লাগোয়া জায়গার বাসিন্দা, নিশ্চয়ই কখনও কখনও আগে এসেছে। অনিয়মিত আগন্তুককে মনে রাখা বার বা কফি শপের কর্মচারীদের পক্ষে সম্ভব নয়। নয় কী রবার্টসন? ”রবার্টসন মনে মনে বিড়বিড় করে উঠল, “উফ! শালা সাক্ষাৎ শয়তান, এ ব্যাটা অপরাধী হলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডটাই উঠে যেত।” মুখে বলল, “হ্যাঁ বস আপনি ঠিকই বলেছেন।”
টনি অ্যাডামস এবার মুখ খুললেন, “খুনীর পরিচয়টা বুঝতে পেরেছি, তবু তুমি নিজ মুখে বলো ব্রিয়ারলি, আর সেই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত দুই যুবকের পরিচয় কী? তারা গেলই বা কোথায়?” মিসেস স্মিথকে কী ভাবে মারা হয়েছে সেটা আর একটু প্রাঞ্জল করে দাও।”
মাইক শুরু করলেন, “মিসেস অ্যান্ডারসন, গাছ ছাঁটতে মেশিন ব্যবহার হয় ঠিকই, কিন্তু কাঁচি দিয়েই ফিনিশিং টাচ দেওয়া হয়। হ্যাঁ, ডা: অ্যান্ডারসনই সুনীলকে খুন করেছেন। মিসেস স্মিথকেও উনিই খুন করেছেন এবং স্বামীকে যোগ্য সহায়তা দিয়ে গেছেন মিসেস অ্যান্ডারসন। মি: স্মিথের এত সম্পতি পেয়েও অর্থগৃধ্নু এই দম্পতি মিসেস স্মিথের সম্পতি ছাড়তে চায়নি।” ডা: অ্যান্ডারসন বললেন, “আপনি কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না। ব্রিটিশ কোর্টে আপনার নাটক চলবে না। দু’জন আফ্রিকান যুবকের গল্পটা অসাধারণ, তারা কী ভ্যানিশ হয়ে গেল না কি? সংবাদপত্র গুলো আপনার মতো অফিসারদের জন্যই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে নখ দন্তহীন বাঘ আখ্যা দিয়েছে।”
মাইক হেসে টনি অ্যাডামসের দিকে চেয়ে বললেন, “স্যার এবার আমরা ভিডিয়ো কনফারেন্সে কথা বলব ব্রিটিশ গায়নার দুই অধিবাসী স্মিথ পরিবারের প্রাক্তন দুই মালি কলিন এবং মাইকেল বুচারের সঙ্গে। এরাই আমাদের মামলার রাজসাক্ষী। এরাই সেদিনের সেই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত দুই যুবক। দু’জন সৎ মানুষ তাদের মনিবের চাপে পড়ে তার অপরাধের সঙ্গী হতে বাধ্য হয়েছে। সুনীলের ওপর হামলার পরেই এরা দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন, অ্যান্ডারসনরাও চাননি ওরা এখানে থাকুক। দিন দশেকের মধ্যে ব্যবস্থা করে ওদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়, ভয় দেখায় মুখ খুললে খুন আর চুরির কেসে ফাঁসিয়ে দেবে। তবে এরা বুঝতে পারেনি পরের দিনই মিসেস স্মিথের মৃত্যুটা অস্বাভাবিক। আমি যখন স্মিথ পরিবারে ব্রিটিশ গায়নার অধিবাসীদের ধারাবাহিক ভাবে কাজ করবার কথা জানতে পারি এবং ইয়ানের মুখে বুচার ভাইদের নাম শুনি তখন বুঝতে পারি এরা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। ব্রিটিশ গায়নার ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের নাম ভারতীয় ঘেঁষা হয়। সুনীলের ওপর হামলা এবং মিসেস স্মিথ মারা যাবার পরই ওদের ইংল্যান্ড ছাড়া, তদন্তর গতি প্রকৃতি নির্দেশ করতে থাকে এরাই সেই তথাকথিত দুই আফ্রিকান যুবক হতে পারে। রবার্টসন যখন মি: স্টুয়ার্টের থেকে মিসেস স্মিথের সম্পত্তির খতিয়ানের রিপোর্ট এনে আমাকে দেখায় তখন আর কিছুই বুঝতে বাকি থাকে না এবং আমি ইয়ানকে ডেকে এনে ওর সামনে বুচার ভাইদের ফোন করি।
স্যার, আমি বুচার ভাইদের কাছ থেকেই দানপত্রে কী আছে জানতে পারি। সুনীলের চেম্বার বাড়ির একতলায়, সেই রাতে স্লাইডিং ডোর চাড় দিয়ে খুলে দুই ভাই সহজেই ভেতরে ঢোকে, মি: অ্যান্ডারসন বাইরে অপেক্ষায় থাকে। এ সব জানলায় গরাদের কোনও ব্যাপার থাকে না, ওদের কাছে টর্চ ছিল, আলো জ্বেলে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করার তো মানে হয় না, টেবিলের কাগজপত্র সরিয়ে কিছু না পেলেও, ড্রয়ার খুলে সহজেই দানপত্রটি পেয়ে যায়। অ্যান্ডারসন ওদের বুঝিয়েছিল মিসেস স্মিথের মাথার ঠিক নেই, বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা সব চার্চকে দান করে দিচ্ছেন, এটা আটকাতে হবে, নয়তো মিসেস স্মিথ নিজেই পথে বসবেন। মাইকেল কৌতূহল বশত দানপত্রে চোখ বুলোতে গিয়ে বোঝে তাতে কী আছে এবং সেটা ইয়ানকে দেওয়া হয়েছে। ওরা ঠিক করে, এখন অ্যান্ডারসনকে দানপত্রটি দিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই, কিন্তু ওরা পরে ইয়ান আর মিসেস স্মিথকে সব জানিয়ে দেবে, ইয়ানের ক্ষতি হতে দেবে না। কিন্তু পরের দিন সকাল থেকে ঘটনা পরম্পরায় তারা সে সুযোগ পায়নি, মিসেস স্মিথের নাগাল বুচার ভাইয়েরা পাবার আগেই তিনি সবার নাগালের বাইরে চলে যান। কলিন আর মাইকেল লজ্জায় আর ইয়ানকে কিছু জানায়নি, ওরা ভাবে মিসেস স্মিথ যখন মারা গেছেন তখন আর ইয়ানকে ওই দানপত্রর কথা বলে লাভ নেই। কিন্তু অনুশোচনা বুচার ভাইদের পিছু ছাড়েনি, ওদের সব সময় মনে হয়েছে মিসেস স্মিথ এবং ইয়ানের সঙ্গে তারা অজান্তে হলেও বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেলেছে, তাই আজ যখন সুযোগ উপস্থিত হয়েছে, তখন সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে ওরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি আশাকরি আইন ওদের সহানুভূতির চোখে দেখবে।
নেহাত পেটের তাগিদে ওরা অ্যাক্টন পার্ক যেতে রাজি হয়েছিল, নয়তো ডা: অ্যান্ডারসন ওদের টিঁকতে দিত না। অ্যান্ডারসনদের স্বরূপ জেনে গিয়েই ওরা আর ওদের পরিবারের কাউকে কাজে পাঠায়নি।
সুনীলের ওপর হামলার দিন সকালে বুচাররা ওলিয়েনডারের ঝোপ ছাঁটছিল, সেখান থেকেই ঘাতক কাঁচিটি তুলে নেন অ্যান্ডারসন। আপনি জানেন স্যার, এই ওলিয়েনডারের এই মামলায় একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। আরও আছে, সুনীল কিন্তু দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে প্রাণে বেঁচে যান, মিডিয়া সুনীলের ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে সমানে প্রচার করেছে। অ্যান্ডারসনরা জানত সুনীল মুখ খুললে তারা ফেঁসে যাবেন। তাই সুনীল সুস্থ হচ্ছে জেনেই তারা জর্জিয়া পালিয়ে যায়, যে দেশের সঙ্গে ইউকের প্রত্যার্পণ চুক্তি নেই। পরে যখন নিশ্চিত হয় সুনীল কখনই সেদিনের ঘটনার বিবৃতি দিতে পারবে না তখন দেশে ফিরে আসে। অভিবাসন দপ্তর এ বিষয়ে কোর্টে বিস্তারিত প্রমাণ দেবে। দেশে ফিরে এসে মিসেস অ্যান্ডারসন নিকটতম রক্তের সম্পর্কের দাবিতে, সাক্সেশন সার্টিফিকেট দাখিল করে মিসেস স্মিথের অ্যাপার্টমেন্ট, জুয়েলারি আর যা কিছু ছিল সব দখল করেন, তার পরিমাণ খুব কম নয়, সে তালিকা দেবেন মি: স্টুয়ার্ট। বলছিলাম কী ডা: অ্যান্ডারসন, বাঘে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা, কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ছুঁলে কত ঘা তা কেউ জানে না। এখন কলিন আর মাইকেল ওদের বক্তব্য বলবে, অনিল আর নিখিল আপনারা মানালি এবং রুচিরাকে নিয়ে বাইরে যান। কলিন এবং মাইকেল সেদিনের অ্যাক্টন পার্কের ঘটনার যে বর্ণনা দেবে তা ওনাদের না শোনাই ভালো।”
অধীরদাকে চুপ করে যেতে দেখে আমি বললাম, “কিন্তু পোস্টমর্টেমের কী নাটকের কথা মাইক বলছিলেন সেটার কী হল। আর মিসেস স্মিথের মৃত্যুর ব্যাপারটাও তো পরিষ্কার হল না।” অধীরদা বললেন, “হ্যাঁ, সেখানে আসছি, আসলে মাইকের কেস ডিটেকশন পড়তে পড়তে ভাবছিলাম একজন আধুনিক প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা রহস্যের কোন অতল অন্ধকারে ডুব দিয়ে সেখান থেকে আলোর উৎস খুঁজে আনতে পারেন, গল্পের গোয়েন্দার পক্ষে তা কল্পনা করাও অসম্ভব। ইয়ানের মুখে মিসেস স্মিথের অসুখের উপসর্গ জানার পরেই, মাইকের অ্যান্ডারসনদের বাগানে ওলিয়েন্ডার ফুলের ঝোপের কথা মনে পড়ে। এই ফুল সুন্দর হলেও এর পাতার নির্যাস থেকে তৈরি হতে পারে মারাত্মক বিষ, সেই বিষ প্রয়োগ করলে যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে তার সবকটি মিসেস স্মিথের ছিল, কিন্তু এই বিষ ফরেন্সিক রিপোর্টে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ডা: অ্যান্ডারসন অনায়াসে মৃত্যুটাকে হার্ট অ্যাটাক বলে চালাতে পেরেছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে সেটাই মনে হয়। মিসেস স্মিথের মৃত্যু নিয়ে কারও মনে প্রশ্নই জাগেনি। এখন এটা প্রমাণ হবে কী করে? পৃথিবীর কোনও ফরেন্সিক পরীক্ষা আঠারো বছরের পুরনো দেহ পরীক্ষা করে ওলিয়েন্ডার বিষের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারবে না। তাই মাইক রবার্টসনকে এমনকি ইয়ানকে নিয়ে পোস্টমর্টেমের নাটক ফেঁদে বসলেন, বললেন ইয়ান পোস্টমর্টেমের অনুমতি দিয়েছে। ইয়ানকে আগেই সব কিছু অবহিত করা হয়েছিল। যাতে অংশ নিয়েছিলেন টনি অ্যাডামস স্বয়ং। মাইকের একটা সন্দেহ ছিল যে মি: অ্যান্ডারসন নিজে ডাক্তার, ব্যাপারটা ধরে না ফেলেন, কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের স্থান মাহাত্ম্য, মাইকের একটার পর একটা নিখুঁত বিশ্লেষণ এবং সর্বোপরি বুচার ভাইদের আসরে হাজির করা অ্যান্ডারসন দম্পতির প্রতিরোধ ভেঙে দেয়। তা ছাড়া মি: অ্যান্ডারসন ডাক্তার এবং অপরাধী হলেও সম্ভবত আধুনিক অপরাধ বিজ্ঞান কতটা উন্নতি করেছে, ফরেন্সিক রিপোর্ট থেকে অত পুরনো মৃতদেহে বিষের অবস্থান বলা যায় কি না, সে বিষয়ে সম্যক ধারণা ছিল না, তাই মাইকের আধুনিক ফরেন্সিক বিজ্ঞান কি না করতে পারে ভাষণে প্রভাবিত হয়। সে স্বীকার করে মিসেস স্মিথকে ২০ তারিখ রাতে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সে ওলিয়েন্ডার বিষ মেশানো ইন্জেকশান পুশ করে, মৃত্যুর সময় বলা হয় রাত বারোটার পরে অর্থাৎ ২১ তারিখ।”
মাইক বললেন, “চলো হে রবার্টসন তোমাকে যাওয়ার পথে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাই। আর সেদিন তুমি কবিতা শুনতে চাইছিলে, এই ক’দিন আর সময় করে উঠতে পারিনি, চলো আজ যাওয়ার পথে কয়েকটা কবিতা শুনিয়ে দিই।” রবার্টসন মনে মনে বলল, “সর্বনাশ, বুড়ো ছুঁচো ঠিক মনে রেখেছে।” মুখে বলল, “হ্যাঁ স্যার চলুন, এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব।”
মাইকের কবিতা শুরু হবে শুনেই প্রমাদ গুণলাম, “বললাম অধীরদা, গল্পে গল্পে রাত ন’টা বেজে গেল, আমাকে আবার দোকান থেকে কয়েকটা জিনিস কিনে বাড়ি ফিরতে হবে। মাইকের কবিতা আর এক দিন শোনা যাবে না হয়।” অধীরদার মুখ দেখে মনে হল, বেশ স্বস্তি পেয়েছেন। বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই বরং ভালো।”
(পরবাস-৮৩, ১০ জুলাই, ২০২১)