|| ৪ ||
ওরা যখন পুজো-মণ্ডপে পৌঁছল তখন শেষ ব্যাচের অঞ্জলি চলছে। পুরোহিত মশাই ডাকাডাকি করছেন, কেউ অঞ্জলি দিতে বাকি পড়ে গেল কি না। ভিড়ের মধ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাতে ফুল নিয়ে জয়ন্ত আর দময়ন্তী পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রোচ্চারণ করল। সাধারণত সালোয়ার কুর্তাই পরে দময়ন্তী। আজ একটা হালকা খোলের লাল পাড় শাড়ি পরেছে, কপালে লাল রঙের বড় টিপ, জয়ন্ত চোখ ফেরাতে পারছিল না। অঞ্জলি শেষ, একজন প্লাস্টিকের চুবড়িতে ফুল সংগ্রহ করছিল, একসঙ্গে মায়ের পায়ে ঢেলে দেবে। দময়ন্তী কনুইয়ের ঠেলা দিয়ে জয়ন্তকে বলল, প্রণাম করতে। জয়ন্ত সামলে নিল। সকাল থেকে উপোস করে আছে দময়ন্তী। জয়ন্ত চা টোস্ট খেয়েছিল, বলল, “চলো, কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।”
পুজো চত্বর ঘিরে বাঙালি খাবার-দাবারের স্টল লাগে। দময়ন্তীর পছন্দ লুচি আর পাঁচফোড়ন দিয়ে সাদা আলুর চচ্চড়ি। জয়ন্ত নিজের জন্য ভেটকি-ফ্রাই অর্ডার করতে যাচ্ছিল। দময়ন্তী চোখ রাঙাল, আজ অষ্টমী না! জয়ন্ত মনমরা হয়ে অগত্যা লুচিতেই মনোনিবেশ করল। স্টলের সামনের চেয়ারে বসে সকাল থেকে দ্বিতীয়বার উপবাস ভঙ্গ করতে-করতে জয়ন্ত নিজের মনকে প্রবোধ দিচ্ছিল, এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়া অনুচিত, দেখল বিজন আসছে। ওদের দেখতে পেয়ে বাঁ-হাত নাড়ল, কাছে আসতে জয়ন্ত দেখল বিজনের ডান হাতে কাগজের প্লেটের ওপর থাকে থাকে মোগলাই পরোটা সাজিয়ে রাখা। জয়ন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, সুখে থাকতে কেন যে মানুষকে ভূতে কিলোয়! বিজন একগাল হেসে জয়ন্তকে বলল, “কী রে, নিরামিষ খাচ্ছিস, মানত-টানত রেখেছিস নাকি?”
দময়ন্তী বলল, “বিজুদা, তুমি আর পাগলকে সাঁকো নাড়া দিও না।”
বিজন কাসুন্দি লাগিয়ে এক পিস মোগলাইতে কামড় দিয়ে বলল, “তোমার বরের ভালর জন্যই বললাম। নিরামিষ খেয়ে পেট-ফেট ছাড়বে... কুকুরের পেটে কি ঘি-ভাত সহ্য হয়?”
দময়ন্তী বলল, “সহ্য না হলেও চলবে, মহাষ্টমী... বচ্ছরকার দিনে আমিষ খেতে হবে না।”
জয়ন্ত মোগলাইয়ের সদ্গতির দিকে লোলুপ দৃষ্টিপাত করে বলল, “যা নজর দিচ্ছি তা’তে দেখ তোরই আবার পেট না ছাড়ে!”
দময়ন্তীর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, বলল, “সন্ধিপুজো শুরু হবে এবার, তোমরা বসে গল্প করো, আমি পুজোমণ্ডপে যাচ্ছি।”
দময়ন্তী উঠে যেতেই বিজন বেঁচে থাকা দু’পিস মোগলাই থেকে এক পিস মোগলাই জয়ন্তর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “চোখ বুজে খেয়ে ফেল, মহাষ্টমীর দিন না-জেনে আমিষ খেলে কোনও দোষ হয় না।”
জয়ন্ত নির্দ্বিধায় মোগলাইয়ে কামড় দিয়ে বলল, “জেনে খেলেও দোষ হয় না।”
টিস্যু পেপারে হাত মুছতে-মুছতে দুই বন্ধু চারদিক দেখছিল। একটু পরেই ভোগ বিতরণ শুরু হবে। গরমে ঘামতে-ঘামতে সবাই ভোগের লাইনে দাঁড়াবে। আজ পোলাও ভোগ, সঙ্গে পনীরের তরকারি, কাজু-বখরার চাটনি আর রাজভোগ। অন্যবার বাসুও আসে ওদের সঙ্গে ভোগ খেতে। জয়ন্ত অন্যমনস্ক ভাবে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই নিশ্চিত ওটা বাসুর বডি ছিল?”
আগেও এই নিয়ে কথা হয়েছে বিজনরা মর্গ থেকে ফিরে আসার পর। জয়ন্ত কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে বাসু আর নেই। বিজন বলল, “আয়াম নট হান্ড্রেড পারসেন্ট শ্যুয়ার। আসলে জল খেয়ে বডি এত ফুলে ছিল, গড়ন-পেটন বাসুর মতই, তবে চোখ-মুখ ক্ষত-বিক্ষত... ঠিক করে চেনা যাচ্ছিল না। তার ওপর ওর দাদা এমন হাউমাউ করে কান্না জুড়ল যে তাকে সামলাতেই...”
জয়ন্ত ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “পুলিশ বডি হ্যান্ডওভার করছে না কেন?”
বিজন বলল, “কে জানে? কনফার্ম করতে পারছে না বলে হয়তো। বা ওদের কাছে কোনও ইনফরমেশান আছে।”
জয়ন্ত মুখ ফেরাল, “বাসুর দাদা ফিরে গেছে?”
বিজন বলল, “না, রিজার্ভেশান পাচ্ছে না, দু’-এক দিনের মধ্যেই ফিরে যাবে। কাজকর্ম নেই, এখানে বসে থেকেই বা কী করবে? পুলিশও কিছু বলছে না। দরকার হলে পরে আবার আসবে।”
জয়ন্ত কথা বদলে বলল, “চল, বইয়ের স্টলটা ঘুরে দেখে আসি।”
বিজন বলল, “তুই যা, বই-ফই দেখা আমার পোষাবে না। তাছাড়া রাধিকা আসবে বলেছে...”
জয়ন্ত উঠল, বলল, “ঠিক আছে, দময়ন্তী এলে বলিস আমি বুকস্টলে আছি।”
সন্ধিপুজোর ঢাক বাজছে। ক’দিন ধরে আকাশ মুখ ভার করে ছিল। রাত্তিরের দিকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছিল। আজ বেশ কড়া রোদ উঠেছে। এই সময়টা মুম্বাইতে বেশ গরম পড়ে। লোকাল লোকেরা বলে সেকেন্ড সামার। ঢোলা পাঞ্জাবির নিচে বিনবিন করে ঘাম হচ্ছিল। জয়ন্ত বুকস্টলের দিকে হেঁটে যেতে যেতে ভাবল, ক’দিনের মধ্যে সব কিছু কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল। বাসু বেপাত্তা হয়ে গেল। ছেলেটা বেঁচে আছে না মরে গেছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। ভাল করে চেনাজানা হল না, তার আগেই দময়ন্তী এসে পরম নিশ্চিন্তে তার সঙ্গে অর্ধেক জীবন ভাগ করে নিল। যেন সেটাই স্বাভাবিক, না হলেই আশ্চর্য লাগত। বিয়ে নিয়ে একটা মেয়ের কত স্বপ্ন থাকে। শড়ি, গয়না, আচার-অনুষ্ঠান... কিচ্ছু না, জয়ন্ত আর্য সমাজে বিয়ের প্রস্তাব দিতেই এক কথায় মেনে নিল। বিন্দুমাত্র অভিযোগ করল না। একটা সোনার আংটি কিনে অফিসের ব্যাগে লুকিয়ে রেখেছিল জয়ন্ত। বিয়ের রাতে সেটা আঙুলে পরিয়ে দিতে খুশি হয়েছিল খুব।
দুটো পুজোবার্ষিকী কিনল জয়ন্ত, তার মধ্যে একটা ছোটদের। প্রতি বছরই কেনে। ছোটদের জন্য লেখা অ্যাডভেঞ্চার গল্পগুলো পড়তে পড়তে দশ বছর আগে ছেড়ে আসা মফস্সলের হলুদ রোদ্দুর পুইয়ে নেওয়া যায়। দময়ন্তীর জন্য বুদ্ধদেব গুহর গল্প সংগ্রহ কিনল। আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা। মেয়েটা কী পড়তে পছন্দ করে সেটা পর্যন্ত এখনও জানা হয়ে ওঠেনি। বইগুলো কাঁধের ঝোলায় ঢুকিয়ে ফিরে গিয়ে দেখল দময়ন্তী আর রাধিকা ছায়ায় চেয়ার টেনে বসে গল্প করছে, রাধিকা মেয়েটা ভারি মিশুকে। চট করে সবাইকে আপন করে নিতে পারে। বিজন ভোগের লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোগ দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। বড় বড় গামলায় খাবার সাজানো, পুজো কমিটির দাদারা মাথায় ফেট্টি বেঁধে, বৌদিরা কোমরে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে ভোগ বিতরণ করছেন। জয়ন্ত বিজনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল, লাইন এগোলে দময়ন্তী আর রাধিকা উঠে আসবে। বিজন জয়ন্তর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, “আমাদের অমিতাভদা কিন্তু শৌকিন লোক, ভাই।”
আগে নজর করেনি, বিজন বলার পর জয়ন্ত দেখল লাইনে চার-পাঁচ জনের আগে অমিতাভদা দাঁড়িয়ে। ওদের দেখেনি। জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, “কেন? কী দেখলি আবার?”
বিজন বলল, “আগে খেয়াল করিনি। মালটার বাঁ কানের লতিতে দেখ, পিয়ার্সিং করানো... মাকড়ি-ফাকড়ি পরে নিশ্চয়ই।”
জয়ন্ত বলল, “আজকাল অনেকেই পরে। ও আর এমন কী?”
বিজন বলল, “রাজস্থানি, মারোয়াড়িরা পরে, বামুন না হলে খুব কম বাঙালিকেই দেখেছি কান বিঁধোতে। আজকাল অবশ্য বামুনের ব্যাটারাও বেঁধায় না, নয়ডায় আমাদের এক রিলেটিভের ছেলের পৈতেয় দেখেছিলাম নাপিত কানের লতিতে ছুঁচ ছুঁইয়ে সরিয়ে নিয়েছিল।”
জয়ন্তর হঠাৎ মনে হল বাসু নিখোঁজ হবার পরে অমিতাভদার সঙ্গে কথা বলা হয়নি। একই বিল্ডিঙে থাকে, হয়তো কিছু আন্দাজ দিতে পারত। পুলিশ কি কোনও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে? বিজনকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, অমিতাভদা ওদের দেখে হাত তুলল, বলল, “বাঃ, তোমরাও আছ, ভালই হল সবাই মিলে বসে গল্প করতে করতে খাওয়া যাবে।”
দময়ন্তী আর রাধিকাও এসে দাঁড়িয়েছিল। একসঙ্গে খাবার নিয়ে বসা হল। জয়ন্তর মনে হল, দময়ন্তী একটু যেন চুপচাপ, স্বাভাবিক উৎফুল্ল ভাবটা নেই। হয়তো গরমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অমিতাভদা বলল, “সন্ধেবেলা একটা বাউল গানের অনুষ্ঠান আছে, মিস কোরো না। যারা আসছে তারা সবাই যদিও প্রোফেশনাল, সারা বছর দেশে বিদেশে প্রোগ্রাম করে বেড়ায়, মনে হয় ভালই লাগবে। অন্তত লাল মাটির সুবাসটা পাবে।”
*
একাদশীর দিন সকালে মোবাইল ফোনের ঝঙ্কারে ঘুম ভাঙল জয়ন্তর। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল বিজনের ফোন। আগের দিন রাত্তিরে প্রতিমা বিসর্জনের পর খালি প্যান্ডেলে বসে আড্ডা দিয়ে মিষ্টিমুখ করে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। শুতে দেরি হয়েছে, চোখে এখনও ঘুম জড়িয়ে আছে। ফোন ধরে কানে তুলতে বিজন বলল, “সাব ইন্সপেক্টর মোহিতে ফোন করেছিল, পুলিশ স্টেশনে যেতে বলছে, কী কাজ আছে। এদিকে বাসুর দাদা গত কালকেই তৎকালে টিকিট কেটে ফিরে গেছে। তুই কি সঙ্গে যাবি?”
জয়ন্ত বলল, “আধঘন্টা সময় দে, আসছি...”
দু’জনে পুলিশ স্টেশনে যখন পৌঁছোল, বেশ রোদ চড়ে গেছে। পুলিশ স্টেশনের উঁচু ছাদ থেকে একটা আদ্দিকালের পাখা ঝুলছিল। সেটা হাওয়া দেওয়ার থেকে শব্দ করছিল বেশি। এস-আই মোহিতে টেবিলে রাখা কাটিং চায়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে মুখ ভেটকে পাশে সরিয়ে রাখল। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, “আরে ভাউ, তুমহারা দোস্ত তো ছুপা রুস্তম নিকলা।”
বিজন আর জয়ন্ত মুখ চাওয়া চাওয়ি করল, মানে?
মোহিতে বলল, অনেক কষ্টে লাশটা শেষ পর্যন্ত শনাক্ত করা গেছে। এলজিবিটি কম্যুনিটির একজন খবরি পাছার ওপর একটা উল্কি চিহ্ন দেখে চিনতে পেরেছে বডিটা ভিকির।
ওরা দুজন আকাশ থেকে পড়ল, ভিকি কে?
জয়ন্ত বলল, “মোহিতে-সাব, কঁহিপে কুছ গলতি হো রাহা হ্যায়, হামারা দোস্তকা নাম হ্যায় বাসুদেব রাও...”
মোহিতে গোঁফের ফাঁকে হাসল, জয়ন্তকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আপকো শায়েদ পতা নেহি, এলজিবিটি কম্যুনিটিমে সবকা এক নিকনেম হোতা হ্যায়। উও আপনে লোগোকো উসহি নামসে পহেচানতে। বোলে তো, বাসুদেব আনি ভিকি, দোনো সেম-সেম... এক হি আদমি থা। এক হি সিক্কেকে দোনো বাজু য্যায়সা।”
বলে কী লোকটা? বাসু সমকামী ছিল? পাগল না পেট গরম? সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল জয়ন্তর।
বিজন বলল, “বিশোয়াস নেহি হো রাহা হ্যায়। আপ ইতনে সুনিশ্চিত ক্যায়সে হো কে বাসু হি, কেয়া নাম বোলা আপনে... ভিকি হ্যায়?”
মোহিতে বলল, বাসুর সিম নম্বর শেষ ট্রেস করা গিয়েছে ওয়েস্টার্ন সাবার্বে, সান্তাক্রুজের আশেপাশে। যেদিন ও মারা যায় তার আগের দিন রাত্তিরে। কল-লগ থেকে জানা যায় ওই রাতে ও একটা বিশেষ নম্বরে আধ ঘণ্টার মধ্যে সাত-আট বার ফোন করে। পুলিশ খোঁজ নিয়ে দেখেছে সেই ফোন নম্বরটা জনি ডিসুজা বলে একজনের নামে নেওয়া। সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছে দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে দেখেছে সেই ঠিকানায় জনি বলে কেউ থাকে না। অর্থাৎ নামটা জালি, যে ডকুমেন্টটা সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল সেটা ফর্জি। স্পষ্টতই ভিকির মতই জনিও একটা ছদ্মনাম।
জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল ওই ঠিকানায় যারা থাকে পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। মোহিতে বলল, করেনি আবার। ঠিকানাটা মাহিমের একটা চ্বলের। ঘরটায় একটা মারাঠি পরিবার ভাড়া থাকে, হাজব্যান্ড, ওয়াইফ, দুই মেয়ে এক ছেলে, ছেলেটা ছোট। লোকটা অটো চালায় আর বৌটা হিন্দুজাতে আয়ার কাজ করে। আগে কোলহাপুরে থাকত, বছর দুয়েক হল মুম্বাইতে এসেছে। তারা জনি বলে কাউকে চেনে না। তাদের কাছ থেকে বাড়ির মালিকের ঠিকানা পেয়ে পুলিশ সেখানে চড়াও হয়। সে বান্দা শাণা আদমি, নামে বেনামে চার-পাঁচখানা খোলি, ট্রান্সপোর্টের বিজনেস... চেপে ধরতে স্বীকার করেছে মাল বাইসেক্সুয়াল। বছর তিন চার আগে জনি ডিসুজার সঙ্গে তার একটা গোপন সম্পর্ক ছিল। বৌকে লুকিয়ে মাঝেমধ্যে চ্বলের ওই ঘরে জনির সঙ্গে পিরিত করতে যেত। জনির কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকত, সে এসে কয়েক দিনের জন্য আস্তানা গাড়ত। আর এই মক্কেল রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে অভিসারে আসত।
মোহিতে বেশ রসিয়ে-রসিয়ে গল্প শোনাচ্ছিল, ট্রেন বেলাইন হয়ে যাচ্ছে দেখে জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, “বাসুকে কি তার মানে জনিই খুন করেছে?”
মোহিতে বলল, পুলিশের তাই সন্দেহ। চ্বলের লোকজন আপত্তি করায় সেবার জনির প্রেমপর্বে ছেদ পড়ে যায়। যে লোকটা লাশ শনাক্ত করেছে সেও জনিকে চিনত। কোনও পার্টি-টার্টিতে দেখেছিল। জনি আপাতত ফেরার। তার ফোন স্যুইচ অফ। তবে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে যাবে কোথায়? মুশকিল হল জনির সম্বন্ধে কেউ বিশেষ কিছু জানে না। তার আসল নাম কী, কোথায় থাকে, পরিবারে আর কে কে আছে, কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না। লোকটা আশ্চর্য দক্ষতায় নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল। বিজন বলল, “কিন্তু বাসুর ওপর তার কীসের আক্রোশ? বাসুকে মারল কেন?”
মোহিতে বলল, বলা খুব মুশকিল। জনিকে ধরতে পারলে জানা যেত। এদের অধিকাংশরই একাধিক পার্টনার থাকে। ভিকিরও হয়তো ছিল। জনি ডিসুজার সেটা সহ্য হয়নি। গে’রাও মানুষ, তাদেরও রাগ, দুঃখ, অভিমান হয়।
জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, যে লোকটা লাশ শনাক্ত করেছে তার কাছ থেকে ভিকির কোনও আত্মীয়-স্বজনের হদিশ পাওয়া যায়নি? তারা কেউ এসে বডি ক্লেম করেনি?
মোহিতে বলল, সেখানেও গোলমাল ঘোটালা, ওরা জানত ভিকি অনাথ, লাওয়ারিশ...
জয়ন্ত বলল, জনিকে তো অনেকে দেখেছে। শুনেছি কিছু আর্টিস্ট প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনে হুবহু সেই মানুষের ছবি আঁকতে পারেন। সেই চেষ্টা করে দেখা যায়।
মোহিতে বলল, সহি বাত, পুলিশের প্যানেলে সেই রকম কিছু আর্টিস্ট আছে। একজনকে ডাকা হয়েছে। সামনের সপ্তাহে আসবে। তবে সরকারি কাজ, সময় লাগবে। আপাতত শনাক্তকরণ যখন হয়ে গেছে, ক্রিমেশানের জন্য ওরা বাসুর বডি নিয়ে যেতে পারে।
বিজন বলল, মোহিতে যদি কালকেও বলত ব্যাপারটা মিটে যেত। বাসুর দাদা গাঁওয়ে ফিরে গেছে গত কাল। তার আসতে সময় লাগবে। কাগজপত্রে সই করার জন্য অন্তত একজন নিকটাত্মীয়ের থাকা দরকার। ততদিন বাসুর বডি পুলিশের হেফাজতে রাখা গেলে ভাল হয়।
মোহিতে বলল, তাতে অসুবিধে নেই। তবে বাসুর দাদা যত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারে ততই ভাল। কতদিন আর...
জয়ন্ত বলল, “মোহিতেজি, কুছ আইডিয়া দে শকতে ইয়ে জনি ডিসুজা দেখনেমে ক্যায়সা হ্যায়?”
মোহিতে বলল, “জরুর! শুনা হ্যায় বান্দা কাফি হ্যান্ডসাম, গোরা, লম্বা... ভয়েস আচ্ছা হ্যায়, গানা গাতা হ্যায়... আপ আগলে উইক আয়েঙ্গে তো উসকা চেহরা ভি দেখা দেঙ্গে।”
মোহিতেকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা দু’জন ফিরে আসছিল। বিজনের বাইকটা একটু দূরে একটা আঞ্জির গাছের নিচে পার্ক করা ছিল। সেদিকে হেঁটে যেতে যেতে বিজন বলল, “শালা, বাসুটা যে এইরকম দু-নম্বরি মাল ছিল স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।”
জয়ন্ত চিন্তিত মুখে ঘাড় নেড়ে বলল, “আমি এখনও নিশ্চিত হতে পারছি না। বাসু অন্যদের থেকে একটু আলাদা ছিল ঠিকই, তাই বলে...”
বিজন বলল, “আমার ভয়ানক রাগ হচ্ছে বাসুর ওপর। এতদিন ধরে আমাদের ঠকিয়ে গেল আমরা ঘুণাক্ষরে আন্দাজ পেলাম না।”
জয়ন্ত বলল, “মরা মানুষের ওপর রাগ করে কী লাভ?”
জয়ন্তকে ওর বাড়ি নামিয়ে দিয়ে বিজন ফিরে যাচ্ছিল। জয়ন্ত ডাকল, কফি খেয়ে যা। দময়ন্তী উদগ্রীব হয়ে বসেছিল ওদের ফেরার জন্য। তিন কাপ কফি বানিয়ে এনে বসল, বলল, “বলো কী হল?”
জয়ন্ত আর বিজন বলছিল, কথার মাঝখানে মাঝখানে প্রশ্ন করে খুঁটিনাটি জেনে নিচ্ছিল দময়ন্তী। বিজন বলল, “উফ, একদম উকিলের মত জেরা করছ।”
জয়ন্ত হেসে বলল, “উঁহু, পুলিশের মত...”
দময়ন্তী বলল, “দেখো, পুলিশ যদি নিঃসন্দেহ না হতো, বডি ছেড়ে দিত না। বডিটা যে ভিকির সে নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। এখন ভিকিই বাসু কি না সেটা তোমরাই বলতে পারবে। অফিস ফাইলে নিশ্চয়ই থাকবে ওর শরীরে কী কী আইডেন্টিফিকেশান মার্ক ছিল। বা ওর দাদা জানবে।”
বিজন বলল, “অফিস ফাইল তো চেক করাই যায়... এনওয়েজ ওর দাদা এসে পৌঁছোন পর্যন্ত হাতে সময় আছে।”
দময়ন্তী বলল, “আর একটা কথা, যদি ধরে নিই বাসুই ভিকি, তা’হলে এই জনি ডিসুজা বলে লোকটা নিশ্চয়ই বাসুর আশপাশেই ঘুরঘুর করত, তোমরাও নিশ্চয়ই দেখে থাকবে। চিনতে পারোনি সেটা আলাদা কথা।”
বিজন কফির কাপ হাতে তুলেও নামিয়ে রাখল, বলল, “তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ?”
দময়ন্তী বিজনের প্রশ্নের জবাব দিল না, কথা ঘুরিয়ে বলল, “বিজুদা, পালিয়ে যেও না যেন, খিচুড়ি বসাচ্ছি, সঙ্গে টোম্যাটোর চাটনি আর ডিমভাজা, খেয়ে যেও...”
*
বিজন বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার খুলে কন্ডোমের প্যাকেট নেবার জন্য হাত বাড়িয়েছিল। রাধিকা আটকাল। বিজন বলল, “কী হল?”
রাধিকা বলল, “না...”
বিজন থমকে গিয়ে বলল, “না, মানে?”
রাধিকা আহ্লাদী মেয়ের মত আদুরে গলায় বলল, “আমার একটা বেবি চাই।”
বিজন সাংঘাতিক ঘাবড়ে গেল, “বেবি মানে? পাগল হলে নাকি? কী বলছ, ভেবে বলছ?”
রাধিকা নাছোড়বান্দার মত বলল, “ভেবেই বলছি, আমার একটা বেবি চাই, ব্যাস!”
বিজন রাধিকার ওপর থেকে সরে এসে বিছানার ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। ঘরের ছাদের দিকে চোখ তুলে দেখল একটা ষণ্ডামার্কা টিকটিকি জুলজুল করে ওদের দুজনের খোলা শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে। ক’দিন হল টিকটিকিটা উপদ্রব শুরু করেছে, বিনা ভাড়ার বাসিন্দা। টিকটিকিটাকে ভাগানোর জন্য বিজন হাততালি দিয়ে বলল, “যাঃ...”
রাধিকা বলল, “রাগ করলে?”
বিজন চুপ করে রইল। রাধিকা পাশ ফিরে বিজনের বুকের ওপর উঠে এল, বলল, “রাগ কোরো না, প্লীজ...”
বিজন রাধিকার পিঠে হাত রাখল, বাচ্চা মেয়েকে বোঝাবার মত করে বলল, “রাধিকা, বেবি কি বার্বি ডল যে মলের দোকান থেকে কিনে এনে শো-কেসে সাজিয়ে রাখবে?”
রাধিকা বলল, “আমি কি তাই বলেছি? আমরা দু’জনে মিলে তাকে একটু একটু করে বড় করব, চান করাবো, খাওয়াবো, আদর করব... আমাদের চোখের সামনে সে ফুলের মত ফুটে উঠবে।”
বিজন বলল, “একটা বাচ্চা মানুষ করা ছেলেখেলা নয়, সিরিয়াস ইনভল্ভমেন্ট...”
রাধিকা বলল, “আয়াম সিরিয়াস বিজন... ড্যাম সিরিয়াস...”
বিজন অসহিষ্ণু গলায় বলল, “ওয়াট ’বাউট মি, আমি এখনও রেডি নই... কোনও চালচুলো নেই, মাথার ওপর নিজস্ব ছাদ নেই, এর মধ্যে দুম করে একটা বাচ্চাকে নিয়ে আসার জাস্ট কোনও মানে হয় না।”
রাধিকা বলল, “অত ভেবো না, উই উইল ম্যানেজ।”
বিজন বলল, “রাধিকা, ইউ নো মি, আই ডোন্ট কেয়ার ’বাউট দিস ব্লাস্টেড ইন্সটিচ্যুশান কল্ড ম্যারেজ। বিয়ে-থার কথা ভাবলেই আমার কেমন দম-বন্ধ লাগে।”
রাধিকা বিজনের বুকের ওপর আঙুল দিয়ে দাগ কাটছিল, বলল, “আমি কোনওদিন তোমায় জোর করব না, বিশ্বাস করো।”
বিজন অবাক হল। মেয়েটা কী সমাজ-টমাজের তোয়াক্কা করে না? বলল, “যদি একদিন তোমায় ছেড়ে চলে যাই?”
রাধিকা বলল, “আমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে না হলে, চলে যেও। জোর করে কাউকে আটকে রাখা যায় না, আমি জানি।”
বিজন বলল, “তোমাকে যত দেখছি, ততই আশ্চর্য হচ্ছি। তুমি কি এই পৃথিবীর মেয়ে? নাকি স্পেসশিপে চড়ে সোজা ভেনাস থেকে উড়ে এসেছ?”
রাধিকা কুল-কুল করে হাসল, বলল, “সাবধান, আমি মানুষের মেয়ে নই। আমার ক্যানাইন দেখোনি? আমি রাক্ষুসী। সুযোগ পেলেই ভালমানুষের ছেলেদের ঘাড় মটকাই, আর রক্ত খাই। এখন আমি তোমায় খাব,” বলে রাধিকা কুটুস করে বিজনের কানের লতিতে কামড় দিল। বিজন বলল, “তবে রে, দেখাচ্ছি মজা!”
ভালবাসাবাসি শেষ হলে রাধিকা পায়ের কাছ থেকে একটা চাদর টেনে নিল। তৃপ্তির চাদরে শরীর ঢেকে শুয়ে রইল, ছাদের দিকে তাকিয়ে। বিজন বেডসাইড টেবিলের ওপরে রাখা সিগারেটের প্যাকেট খুঁজছিল। রাধিকা ওর পাঁজরে খোঁচা দিয়ে বলল, “টিকটিকিটাকে দেখছি না তো, তোমার দামালপনা দেখে মনে হয় পালিয়েছে।”
বিজন বলল, “সে যে চুলোয় যায় যাক, কিন্তু তুমি এত ভাল বাংলা শিখলে কোথা থেকে?”
রাধিকা বলল, “ঠাম্মার কাছ থেকে। ঠাম্মা আমাদের সঙ্গে থাকত। বাপি ছিল মা-অন্ত প্রাণ। ঠাম্মা যা বলত অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত। মাও ঠাম্মাকে শ্রদ্ধা করত। আমায় খুব ভালবাসত ঠাম্মা, কতদিন বায়না করে রাত্তিরে ঠাম্মার বিছানায় ঘুমিয়েছি। ছোটবেলায় ঠাম্মা মুখে মুখে লালাবাই শোনাত, ঘুমপাড়ানি ছড়া। একটু বড় হতে বাংলা বই থেকে আমায় গল্প পড়ে শোনাত, সুকুমার রায়, বিভূতিভূষণ...”
বিজন ফস করে সিগারেট ধরাল। রাধিকা নিজের মনেই বলে যাচ্ছিল, “ঠাম্মা যতদিন ছিল, বাড়িটা অন্যরকম লাগত। ঠাম্মা চলে যাবার পর বাপি-মা-আমি... আমাদের সম্পর্কগুলো কেমন আলগা হয়ে যাচ্ছিল। যেন ঠাম্মাই আমাদের এক সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল।”
বিজন বলল, “আমার যদি ওইরকম একজন ঠাম্মা থাকত! তাহলে হয়তো...”
রাধিকা হাত বাড়িয়ে বিজনের আঙুলের মধ্যে থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে টান দিল। ধোঁয়া ইন করল না, পাতলা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে, সিগারেট ফেরত দিয়ে বলল, “আমার পড়াশুনোর চাপ বাড়ছিল। শুকনো নেশা ধরলাম। পরে অনেক কষ্টে ছেড়েছি। মা কিটি-পার্টি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাপি সন্ধে হলেই ক্লাবে গিয়ে বসত। তাস খেলত। রাত্তিরে যখন বাড়ি ফিরত, মুখ দিয়ে ভুরভুর করে অ্যালকোহলের গন্ধ বেরোত। আমি শুয়ে পড়ার পর বাপি আর মা ঝগড়া করত। দেওয়ালের উল্টোদিক থেকে আসা পরস্পরের প্রতি অনর্গল দোষারোপ শুনতে শুনতে আমার ঘুম আসত না।”
বিজনের মাথার মধ্যে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বাঁ-দিকের রগের কাছে ঘেঁষে একটা ব্যথা উঠছিল। আধ খাওয়া সিগারেটটা অ্যাশ-ট্রেতে গুঁজে দিয়ে উঠে গিয়ে একটা জলের বোতল নিয়ে এল। নিজে এক ঢোঁক খেয়ে রাধিকাকে জিজ্ঞেস করল, জল খাবে কি না। রাধিকা ঘাড় নেড়ে না বলল। বিজন বলল, “তবু তোমার বাপি-মা একসঙ্গে রয়েছেন এখনও... সেটাই বা কম কীসের?”
রাধিকা বলল, “প্রতি উইকেন্ডে গিয়ে দেখি দু’জনে দু’মুখো হয়ে বসে আছে, কথাবার্তা নেই, আমি জোর করে দু’জনের ভাব করাই। আমি না থাকলে কবেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যেত।”
বিজন বলল, “রাধিকা, তোমায় বলেছি কি, আমার বাবা মাও ঝগড়াঝাঁটি করে আলাদা হয়ে বসে আছে দু’-বছর হয়ে গেল। দুটো মানুষের এক সঙ্গে থাকা কি এতই কঠিন? কে জানে?”
রাধিকা বলল, “অভ্যেস একটা সম্পর্ককে শেষ করে দেয়। অভ্যেসের বাইরে বেরিয়ে যদি অন্য মানুষটার মধ্যে নতুন কোনও দারুচিনি দ্বীপ আবিষ্কার করতে পার, সম্পর্কটা বেঁচে থাকবে। না-হলেই নিত্যদিন অশান্তি।”
বিজন বলল, “বেশ বললে, দারুচিনি দ্বীপ... ভয় করে, আমি পারব না।”
রাধিকা হেসে বলল, “ডরকে আগে জিত হ্যায়... তুমি না পারলে আমিও হেরে যাব যে।”
বিজন বলল, “তুমি সঙ্গে থাকলে হয়তো...” তারপর যেন সত্যি সত্যি সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে নীল জলরাশির মধ্যে দূরে কোনও সবুজ তটরেখার আভাস পেয়েছে এমন আলো আলো মুখ করে বলল, “বাই দ্য ওয়ে রাধিকা, হোয়াই ডোঞ্চিউ মুভ ইন... হোস্টেল ছেড়ে আমার এখানে চলে এসো।”
টিকটিকিটা কোথায় লুকিয়ে ছিল কে জানে, বলল, ঠিক, ঠিক, ঠিক...
বিজন ভাবল, হতচ্ছাড়াটা আড়াল থেকে সব শুনছে। মনে মনে একটা কাঁচা খিস্তি দিয়ে বলল, কে তোর সমর্থন চাইছে?
রাধিকা এক মুহূর্তও না ভেবে এক গাল হেসে জবাব দিল, “কালকেই চলে আসব বোরিয়া-বিস্তার নিয়ে, ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ...”
বিজন বলল, “আজ আর তাহলে হোস্টেল ফিরতে হবে না। কাল সকালে আমি তোমার সঙ্গে যাব, মাল-পত্র নিয়ে আসব। চলো, এখন একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসা যাক, গুমোট লাগছে। ডিনারটা না-হয় বাইরেই সেরে নেওয়া যাবে।”
টিকটিকিটা বলল, “কটর, কটর... যাও তোমরা, মস্তি করো। তোমাদেরই দিন। আমার তো আর বাড়ির বাইরে পা রাখার জো নেই।
*
দময়ন্তী বলল, “তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি, সেদিন অমিতাভদা শিমুলের সঙ্গে ভারি অদ্ভুত আচরণ করেছে...”
জয়ন্ত বলেছিল, দশ-বারো মিনিটের তো রাস্তা। চলো হেঁটে ফিরি। ওরা হোটেল প্লাজা থেকে ফিরছিল। আজ শুক্রবার, শনি বাদ দিয়ে রবিবার ওদের পার্টি। দেখতে গিয়েছিল ঠিকঠাক আয়োজন হচ্ছে কিনা। কিছু অ্যাডভান্স পেমেন্ট করে দিল। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে মেনুতে দু’-একটা পদ বদলে দিল। অতিথিরা যে দরজা দিয়ে ঢুকবে তার দু’-দিকে ফুলের তোড়া লাগাতে বলল। হাঁটতে হাঁটতে জয়ন্তর মাথায় বোধহয় সেই সব কথাই ঘুরছিল, আচমকা প্রসঙ্গ বুঝতে সময় লাগল, বলল, “কবে? কোথায়? অদ্ভুত মানে?”
দময়ন্তী বলল, “অষ্টমীর দিন সকালে শিমুলের বাসায় গেলাম, মনে নেই? তার কিছুক্ষণ আগেই নাকি অমিতাভদা সেখানে গিয়েছিল।”
জয়ন্ত রাগী গলায় বলল, “জোর করে অসভ্যতা করার চেষ্টা করেছে নাকি?”
দময়ন্তী বলল, “ঠিক তার উলটো। অমিতাভদার ওপর শিমুলের একটা দুর্বলতা আছে। সেদিন ইচ্ছা করলে অমিতাভদা সুযোগ নিতে পারত। কিন্তু...”
জয়ন্ত বলল, “কিন্তু কী?”
দময়ন্তী বলল, “শিমুলের কথা অনুযায়ী সেদিন অমিতাভদা ওকে ছোঁয়া তো দূর বরং ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল।”
জয়ন্ত ধাতস্থ হয়ে বলল, “তাহলে তো মিটেই গেল।”
দময়ন্তী বলল, “শিমুল যেন অন্যরকম ইঙ্গিত দিল...”
জয়ন্ত সন্দিগ্ধ হল, “এতদিন বলোনি কেন? অন্যরকম মানে? শিমুল তোমায় ঠিক কী বলেছিল বলো তো।”
দময়ন্তী বলল, “ভেবেছিলাম মেয়েলি কথা, তাই বলিনি। কিন্তু সেদিন তোমরা পুলিশ স্টেশন থেকে ফিরে যা বললে তাতে সন্দেহ বাড়ল। শিমুল খুব পরিষ্কার করে বলেনি, কান্নাকাটি করছিল, আন্দাজ পেয়েছিলাম... অমিতাভদা ওকে কাছে টানতে উৎসাহ দেখায়নি। কী করে যে বোঝাই ছাই... আচ্ছা, এমন তো নয় যে মেয়েদের ওপর অমিতাভদার আদৌ কোনও আকর্ষণ নেই? না-হলে শিমুলের মত একটা ফুটফুটে মেয়েকে কেউ ফিরিয়ে দিতে পারে?”
জয়ন্ত বলল, “কী যে বলো... এমনও তো হতে পারে অমিতাভদা আগে থেকেই কোনও মেয়ের প্রতি অনুরক্ত।”
দময়ন্তী বলল, “সেসব নয়, মেয়েরা ঠিক বুঝতে পারে... অবশ্য শিমুলের ভুল হতেই পারে,” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “দেখো, আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু মনের মধ্যে সেদিন থেকে খচখচ করছে। তোমাদের মোহিতে জনি ডিসুজার যা বর্ণনা দিয়েছিল তার সঙ্গেও অমিতাভদার চেহারা অনেকটা মিলে যায়।”
জয়ন্ত রাস্তার দিকে দৃষ্টি ফেলে হাঁটতে-হাঁটতে বলল, “শুধু সন্দেহের বশে তো কারোর ওপর দোষারোপ করা যায় না। মোহিতে বলেছে সামনের সপ্তাহে জনির স্কেচ দেখাবে। ততদিন অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।”
দময়ন্তী বলল, “ঠিক কথা, তবে এই জনি ডিসুজা লোকটা জাতে ক্রিমিনাল। বাই চান্স... শিমুলকে সাবধান করা দরকার।”
জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, “শিমুল কেমন আছে জানো? সেদিনের পর আর ফোন করেছিল?”
দময়ন্তী বলল, “না। শিমুলের বাড়ি তো এই সেক্টরেই, ঘুরে গেলে হয়।”
জয়ন্ত এক কথায় রাজি হয়ে গেল, বলল, “চলো...”
বেল বাজাতে শিমুল এসে দরজা খুলে দাঁড়াল। দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ শিমুল?”
“ভাল আছি গো,” অর্ধেক দরজা খুলে রেখেছিল শিমুল। দময়ন্তীর মনে হল কিছু আড়াল করতে চাইছে, বলল, “তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।”
শিমুল দরজা না ছেড়েই বলল, “বলো না।”
দময়ন্তীর সন্দেহ হল। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে শিমুলের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল ভেতরে সোফার ওপর কেউ বসে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কেবল দোলায়মান পা দেখা যাচ্ছে। পুলিশে কাজ করলে জবরদস্তি করার হরেক রকম উপায় শেখা যায়। শিমুলকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে দময়ন্তী বলল, “দরজায় দাঁড়িয়ে হবে না গো, সময় লাগবে।”
জয়ন্তও দময়ন্তীর পেছন-পেছন ঘরে ঢুকল, দেখল অমিতাভদা সোফার ওপর গ্যাঁট হয়ে বসে চা খাচ্ছে। ওদের দেখে হাত তুলল, “এসো, এসো... চা খাবে নাকি? শিমুল আরও দু’-কাপ চায়ের জল বসা,” যেন নিজেরই ঘর। শিমুলের মুখ দেখে মনে হল ওরা আসায় বেজায় দুঃখ পেয়েছে। কিচেনে যেতে যেতে করুণ চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “দুধ চিনি চলবে তো? নাকি অমিতাভদার মত লিকার চা?”
জয়ন্ত বলল, “সব চলবে। লিকার হলেও অসুবিধে নেই।”
অমিতাভদা বলল, “ওরে শিমুল, আমার জন্যেও হাফ-কাপ জল নিস,” তারপর ওদের দিকে ফিরে বলল, “দুধ চিনি দিলে চায়ের ফ্লেভারটাই চলে যায়। চা হবে টলটলে, সোনালী, পেয়ালার নিচ পর্যন্ত দেখা যাবে, চুমুক দেবার আগেই তার সুগন্ধ নিজে থেকে চা-বাগানের নামটি জানিয়ে দেবে।”
জয়ন্ত অমিতাভদার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী ব্যাপার? নতুন নাটকের পরিকল্পনা চলছে নাকি?”
অমিতাভদা বলল, “না, না... আগেরটার থেকে এই তো সবে রেহাই পেলাম, এখনও গায়ের ব্যথা মরেনি। শিমুল জ্বরে পড়েছিল, তাই খবর নিতে এসেছিলাম।”
দময়ন্তী ভাবল, দরদ দেখে মরে যাই! সত্যিই ভাল নাটক করে লোকটা।
অমিতাভদা বলল, “তারপর... জয়ন্ত তুমি যে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজ্যুয়েশানের জন্যে ইভনিং কোর্সের খোঁজ করছিলে তার কী হল?”
জয়ন্ত বলল, “কাছাকাছির মধ্যে ইভনিং কোর্সের সন্ধান পেলাম না। করেস্পণ্ডেন্স কোর্সের খোঁজখবর নিচ্ছি, দেখা যাক।”
অমিতাভদা বলল, “ভাল, ভাল... পড়াশুনো করার ইচ্ছেটা যেন কোনওদিন মরে না যায়।”
দময়ন্তী উঠে গিয়েছিল কিচেনে, শিমুলকে সাহায্য করতে, জিজ্ঞেস করল, “তুমি চা খাবে না?”
শিমুল বলল, “ধ্যুর, আমার লিকার চা খেতে ভালই লাগে না। বেশি করে দুধ দিয়ে, চিনি দিয়ে না খেলে মনেই হয় না চা খাচ্ছি।”
দময়ন্তী বলল, “এক কাজ করো, তোমার আর আমার দুধ-চা বানাও আর ওদের জন্যে লিকার। আমাদের চা বানানোর সময় জলে এক টুকরো আদা ফেলে দিও।”
জয়ন্ত আর অমিতাভদা টুকটাক কথা বলছিল। চারটে কাপ ট্রেতে সাজিয়ে শিমুল নিয়ে এল। সঙ্গে একটা প্লেটে নমকিন আর বিস্কুট। দময়ন্তীও এসে বসল সোফায়, শিমুলের পাশে, চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “শিমুল, পরশুর পার্টিতে গেস্টদের জন্যে কিছু খেলা রাখব ভাবছি, মজা হবে। আমি একা একা সামলাতে পারব না, তোমার সাহায্য চাই।”
অমিতাভদা বলল, “বাঃ, খুব ভাল আইডিয়া, গান-টানের ব্যাপার থাকলে আমাকেও দলে রাখতে পারো।”
দময়ন্তী বলল, “অন্তাক্ষরী বা ওই ধরনের একটা খেলা রাখা যেতে পারে, কী বলো শিমুল?”
খালি চায়ের পেয়ালা নামিয়ে রেখে অমিতাভদা উঠে পড়ল, বলল, “আচ্ছা, তোমরা কথা বলো। আমি চলি। কোনও মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট লাগলে জানিও। আমি নিয়ে আসব। শিমুল আমায় ফোন করে দিস।”
অমিতাভদা যতক্ষণ না দরজার বাইরে বেরিয়ে গেল, শিমুল চুপ করে সেদিকে তাকিয়ে রইল। দময়ন্তী আর জয়ন্ত মুখে চাওয়া–চাওয়ি করল। দময়ন্তী বলল, “শিমুল, অমিতাভদাকে কতদিন ধরে চেন?”
শিমুল চমকে তাকিয়ে বলল, “এখানে এসেই আলাপ হয়েছে, বাঙালি অ্যাসোসিয়েশানে, কেন জিজ্ঞেস করছ গো?”
দময়ন্তী বলল, “অমিতাভদারা কোথাকার লোক, আদি বাড়ি কোথায়, কিছু জান?”
শিমুল বলল, “ঠিক জানি না, বর্ধমানের দিকে কোনও একটা গ্রামে।”
দময়ন্তী থামল না, ভুরু কুঁচকে বলল, “বাড়িতে কে কে আছে, বাবা, মা, ভাই, বোন...”
শিমুল মুখ চুন করে বলল, “জানি না গো।”
দময়ন্তী বলল, “একটা লোকের আগু-পিছু জানো না, তাকে মন দিয়ে বসে আছ?”
শিমুল ভাবেনি দময়ন্তী কথাটা এইভাবে সরাসরি ফেলবে। অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “সে ভাবে কোনোদিন ভাবিনি...”
দময়ন্তী খানিকটা ধমকের সুরেই বলল, “মানুষকে বিশ্বাস করা ভাল। কিন্তু চোখ বুজে বিশ্বাস করা ভাল নয়।”
শিমুলের চোখ ছলছল করে উঠল। জয়ন্ত বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে... অমিতাভদার সঙ্গে কথা বলে জেনে নেবে না-হয়। আসলে যা দিনকাল পড়েছে, সকলেরই সতর্ক থাকা উচিত। সেই জন্যেই বলা...”
শিমুল আর চোখের জল আটকাতে পারল না। পাশে বসা দময়ন্তীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল, হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল, “ওকে ছাড়া বাঁচব না গো, দময়ন্তীদি...”
দময়ন্তী ভাবল, আচ্ছা ছিঁচকাঁদুনে তো মেয়েটা!
(পরবাস-৮৩, ১০ জুলাই, ২০২১)