Subscribe to Magazines






পরবাসে শ্রীতমা মাইতি-র
লেখা


ISSN 1563-8685




হুঁঃ

হুঁঃ!

--হ্যাঁ, শুধু এইটুকুই বললাম। হুঁঃ-এর বেশি এদের সঙ্গে কোন শব্দ খরচ করার মানেই হয় না। যত্তোসব ইয়ে—ব্যাপারখানা কী? না, বোনুদিদিটি একটি আস্ত ঢ্যাঁড়শ! না হলে কোন পাগল ছুরির ফলায় হাত দেয়, আবার সেই হাত চোখেও দেয়। এই তো সেদিন শুনলাম, পঁচিশ বছর বয়স হয়েছে অর্থাৎ কিনা আমার থেকে পাক্কা কুড়ি বছরের বড়ো তুই, এই যদি তার বুদ্ধি হয় তবে কী আমার দোষ? আমি বেচারি ছোট্ট মেয়ে একা একা কতই বা বোর হব, ছুরিটা দিয়ে পড়ে থাকা শুকনো কাঁচালঙ্কাগুলোকে কেমন মিহি করে কাটলাম, তারপর জানি তো কেউ ওমলেট ভেজে দেবে না (অত ভালো যে তোমরা নও সে আমার ভালোই জানা আছে)। তাই নিজেই কুচো লঙ্কাগুলো নিয়ে গাছতলায় বসে ওমলেট ভাজা ভাজা খেলছি—এমনি সময় যাকে বলে ‘রক্ত জল করা’ চিৎকার। আমি অবশ্য প্রথমেই দৌড়ে যাইনি কারণ জানি তো যার যা কিছু সমস্যা সবেতেই আমাকে দোষী ঠাওরানো হবে। তাও একগাদা ‘হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ’-র জ্বালায় শেষ অবধি পায়ে পায়ে গেলাম। কী হয়েছে? গোলমালের মধ্যে বুঝলাম, বোনুদিদি ছুরি দিয়ে আপেল কেটে খেতে গিয়ে আপেল ঝাল লেগেছে, হাতে ঝাল লেগেছে, সেই ঝাল আবার চোখেও লেগেছে!

এইবার নিয়মমাফিক তদন্ত শুরু হল। অবশ্য তদন্ত না করলেও হতো কারণ সবেতেই তো আমিই দোষী। আমার ভাবতে না ভাবতেই সবাই সাব্যস্ত করল ‘সবই রিমির দোষ’। একধার থেকে, না না একসঙ্গেই সবাই শুরু করল, তুই লঙ্কা কেটেছিলি? কেন লঙ্কা কেটেছিলি? ছুরিতে কেন হাত দিয়েছিলি? ছুরিতে হাত দিতে না বলা হয়েছে না? ইত্যাদি ইত্যাদি। একটু ফাঁক পেতেই আমি বললাম, বোনুদিদিই বা ছুরিটা না ধুয়ে আপেল খেল কেন? বলেছি কি বলিনি মা এসে কানটা পেঁচিয়ে বলল—দোষ করেছিস, আবার জ্ঞান দেবার বেলায় ষোলো আনা! বাকিরাও কেউ উত্তর না দিয়ে জোড়া জোড়া রাগী চোখে আমায় দেখতে লাগল। এদের সঙ্গে কথা বলারই কোন মানে নেই। তাই একটাই কথা বললাম—হুঁঃ। দিয়ে চলে আসছি তমতম করে, শুনলাম মা বলছে, রিমি হাতটা ভালো করে ধুয়ে নে। এবার আমি আরো জোরে বললাম—হুঁঃ! তবে সেটা বললাম মনে মনে।

এত বিচ্ছিরি লাগছিল মনটা যে কী বলি, একটুও ভালোবাসি না কাউকে। আমার ওমলেটটা ভাজা হচ্ছিল, সেটাকে আর উনুন থেকে নামালাম না। বিরক্ত লাগছিল কিনা। আমি বসেছিলাম এক কামিনী গাছের নীচে, আমার সামনে একটা ছোট্ট সরু নালা, সেটা একেবারেই পাশে মাঠে গিয়ে মিশেছে। ওটাকে কিন্তু আমি সবসময়ই নদী বলে ভাবি, ওর জলে আমি পা ডুবিয়ে বসে থাকি। দুটো ইট নিয়ে গিয়ে আমি একটা ঘাটও করেছি। আমি আমার নিজের ছোট্ট ঘাটে নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসেছিলাম আর আমার চারদিকে ছোট্ট, নরম, সাদা-সাদা কামিনী ফুল তিরতির করে পড়ছিল। তাই দেখে আমার মনটা সামান্য একটু ভালো হল, খুব বেশি নয় কিন্তু। ভাবলাম, বেচারি ওমলেটটার কী দোষ! ও কেন পুড়ে মরবে, তাই ওকে নামিয়ে রাখলাম। সত্যি বলতে, সমস্ত কিছুর দোষ আমার ওপর চাপানো কিছু নতুন কথা নয়, আমি ছোট কিনা! তবে আজ আমি যে প্রশ্ন করলাম সেটার উত্তর কেউ দিল না, উল্টে মা আমার কান মুলে দিল কেন? আমি ভারি রেগে আছি। যাকগে, আমি একটা কিছু খেলা ভাবি।

ওমলেটটাকে দিয়ে কী করা যায়? ভেবে দেখলাম, পিকনিক সবথেকে ভালো হবে। এই কদিন আগে আমরা পিকনিক করতে গেছিলাম, মন্দ লাগেনি। তবে মা যে কেন সবার সামনে মাছের কাঁটা বেছে দিচ্ছিল! বললাম, আমি পারি, তাও শুনল না। যাইহোক, এই তো সামনেই আমার নিজের নদী বয়ে চলেছে, ওপরে কামিনী গাছ, তার ছোট ছোট ফুল কী সুন্দর ঝরে পড়ছে, পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ আসছে। এত ভালো পিকনিকের স্পট তো কোত্থাও নেই। তার ওপর রান্নার জিনিসপত্রও সব আমার নদীর ঘাটে বসে ধুয়ে নেওয়া যাবে!

কিন্তু একা একা পিকনিক আবার কেমন করে হবে? পিকনিকের জন্য বন্ধু চাই। কাকে করা যায়? ভেবে-চিন্তে দুটো লাঠি নিয়ে এসে দাঁড় করালাম। তারা কি আর সহজে দাঁড়াতে চায়? তাও কোনোমতে ঠোকাঠুকি করে দাঁড় করালাম। কিন্তু ধ্যাত! একেবারে বিচ্ছিরি দেখতে। বন্ধু না ভূত!

বসে বসে ভাবছি এবার কি করা যায়? পেছন থেকে বোনুদিদি এসে বলে, কি রে বোনু? রাগ করেছিস? (ও আমায় বোনু বলে ব’লে ওকে আমি বোনুদিদি বলি) আড়চোখে দেখে গম্ভীর ভাবে বললাম--না।

--কী করব বল? হঠাৎ করে চোখে ঝাল লেগে…

--জানি জানি। ছুরিটা ধুয়ে খাসনি কেন?

--ভুল হয়ে গেছে, বোনু। তুই এখানে বসে আছিস কেন? ঘরে চল না।

--না, যাব না। আমি খেলছি। তুই পিকনিক খেলবি আমার সঙ্গে?

--না রে, আমার পড়া আছে,পরীক্ষা…

--যা তবে।

বলেছি না, বোনুদিদিটা আস্ত ঢ্যাঁড়শ। না হলে পিকনিক ছেড়ে কেউ পড়া করতে যায়! আমি এবার উঠে পাতাবাহার গাছগুলোর কাছে ঘুরঘুর করতে লাগলাম। বোনুদিদি যতই ডাকুক, আমি কক্ষনো যাব না, যতক্ষণ না… যাকগে! মিথ্যে মিথ্যে বন্ধু বানিয়ে নিই বরং। একটা লাল-হলুদ পাতাবাহারের কাছে গিয়ে বললাম—এই, আমার সঙ্গে পিকনিক করবে? প্রথমটা দেখি সাড়া দেয় না। আমি তখন বানিয়ে বানিয়ে পিকনিকে কী কী রান্না হবে বলতে লাগলাম, প্রথমে থাকবে সিঙ্গাড়া, আলু টিক্কি, টমেটো কেচাপ আর সন্দেশ, তারপর আলুর দম, বেগুনের ভর্তা, মাছের চপ, ডিমের ওমলেট, তুমি চাইলে মাংসের ঝোলও হবে নিশ্চয়ই, কিশমিশ, খেজুর আর টমেটোর চাটনিও হবে (আমি শুধু কিশমিশ আর খেজুর খাব) আর হ্যাঁ, ভাত। আর শাক-সব্জি হল বন-জঙ্গল — ওসব না খাওয়াই ভালো। পিকনিকের মেনু শুনে তো সবাই রাজি। দেখতে দেখতে বিরাট দল হল আমার, কাঁটাওলা ঝাউগাছকেও নেমন্তন্ন করলাম, বেচারি একধারে থাকে।

তারপর লেগে পড়লাম। মনে করো যেন বালতিতে করে অনেক কষ্টে নদী থেকে এক বালতি ভর্তি জল নিয়ে এলাম। ওই দিয়ে রান্না হবে। তিনদিকে তিনটে পাথর সাজিয়ে উনুন বানালাম। কাঠগুলো যেন জ্বালানি হল। আমাদের গাঁদা গাছে এবার অনেক ফুল হয়েছিল। মেহগনি গাছের পাতাও ঝরতে শুরু হয়েছিল, সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে এলাম। আমার রান্নায় লাগবে। আমার পাতাবাহার বন্ধুদের বললাম ভারি উদার হয়ে, ‘তোমরা বরং খেলো, গল্পগাছা করো। রান্নার দিকটা আমি সামলে নেব।’ এই বলে আমি কিছু রান্না করলাম। এতগুলো তো করা যাবে না, তাই কিছু যেন বাড়ি থেকে প্যাক করে নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলোর প্যাকেট খুলে সব সাজিয়ে দিলাম বড় বড় সেগুন পাতায় করে, ওগুলো কিন্তু আসলে সেগুন পাতার মতো দেখতে থালা। তারপর একেকটা থালা আমার সব বন্ধুদের কাছে দিয়ে এলাম।

আমার খেতে ইচ্ছে করছিল না। খেলতেও আর ভালো লাগে না। বসে রইলাম আমার ঘাটে। মা এসে আমার পাশে বসল, হাসি-হাসি মুখে। হুঁঃ, আমার বয়েই গেছে, আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। মা বলতে রইল একা একাই, --কী বাজে তো এই রিমির মা’টা, ছিঃ ছিঃ! এমন মা কোথাও দেখিনি, এমন সোনার চাঁদ মেয়েটাকে মারে। না না, এমন মাকে আচ্ছাসে করে দু’ঘা লাগিয়ে দেওয়া উচিত। আমি জানি এগুলো আমাকে ভোলানো হচ্ছে। কিন্তু আমি বড়ো হয়ে গেছি, আমি মোটেই ভুলব না। তাই স্পষ্ট বললাম—আমায় ভোলানোর দরকার নেই।

মা বলল সঙ্গে সঙ্গে, না না আমি কাউকে ভোলাচ্ছি না। তাছাড়া রিমি এখন বড় হয়ে গেছে, তাকে ভোলানোও সম্ভব নয়। আমি শুধু এই বলছিলাম, আজ আমি এক ভারী অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছি। আমার সঙ্গে এক সোনালি লোমওয়ালা, চারপেয়ে ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হয়েছে।

--যত্তোসব মিথ্যে গল্প, আমি বললাম।

--মোটেই না, একটুও মিথ্যে নয়, মা বলল, আমি গিয়েছি পালং শাক তুলতে। ঝুঁকে পালং শাক তুলছি, মনে হল যেন আমার কাছ দিয়ে কারা গুটিগুটি চলে গেল। ও মা, চোখ তুলে দেখি, সোনালি লোমওয়ালা, চারপেয়ে, সূঁচোমুখো কে যেন লোমশ ল্যাজ দুলিয়ে চলেছে। তার পেছনে ওইরকমই দেখতে কতকগুলো খুদে ছানা, ভালো করে দেখি, তারা আসলে বেজি মা আর তাদের ছানারা। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বেজি মা আমায় বকলো—‘দ্যাখো দেখি, আমি কী সুন্দর ছানাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি, আর তুমি কিনা তোমার ছোট্ট মেয়েটারও কান মুলে দাও। ছিঃ!’

--সত্যি মা, সত্যিই তুমি বেজি দেখেছ?

--হ্যাঁ গো।

আর কী, তারপর আমি মায়ের কোলে চড়ে গলা জড়িয়ে বললাম—জানো মা, আমি কিন্তু আমার লঙ্কা হাত এখনো ধুইনি।

--সে তো জানিই। যা নোংরা ঘেঁটেছ, লঙ্কা আর হাতে নেই, সব পালিয়ে গেছে।




(পরবাস-৮৪, ১০ অক্টোবর, ২০২১)