‘Indian origin man claims son was killed by VIPS, Scotland Yard covered up murder.’
ডেইলি টেলিগ্রাফের হেডলাইনটায় আঙুল দেখিয়ে লিলি মানে আমাদের সুপরিচিত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুঁদে গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলির সুন্দরী এবং মুখরা
ধর্মপত্নী মিসেস লিলিয়ান ব্রিয়ারলি রোষ কষায়িত নেত্রে তার বাইরে বাঘ, ঘরে ভিজে বেড়াল স্বামীটিকে খালি বললেন, “ছিঃ ছিঃ, এতদূর অধঃপতন হয়েছে!”
মাইক, আমতা আমতা করে একটা কিছু উত্তর দিতে গেছিলেন, কিন্তু নিজের কানেই সেই ফিসফিস ধ্বনি ঠিক পৌঁছোল না। রবিবার সকালে জমিয়ে কফি সহযোগে খবরের কাগজে খেলার পাতাটা নিয়ে বসেছিলেন, আজ মাইকের একটু বেলায় বেরনোর কথা, লিলির মেজাজ দেখে বুঝলেন, গেল সব মাটি হয়ে। খেলার পাতা ছেড়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের শ্রাদ্ধ করে দেওয়া ভারতীয় ব্যবসায়ী বিশাল মালহোত্রর, ডেইলি টেলিগ্রাফকে দেওয়া ইন্টারভিউতে মন দিলেন। ইন্টারভিউটা পড়তে পড়তেই রবার্টসনের ফোনটা এল, মাইক বললেন আমি এখনই পৌঁছচ্ছি।
আমি বললাম, “অধীরদা এ তো মারাত্মক ব্যাপার, বিশাল মালহোত্র গুরুতর অভিযোগ এনেছেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়কর্তা টনি অ্যাডামস সম্বন্ধে যেটুকু পড়েছি, তাতে তো তিনি অতি দক্ষ প্রশাসক এবং কড়া ধাতের মানুষ বলেই পরিচিত, আর তার হাতে আছেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইতিহাসের চতুরতম গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলি, তার তরুণ উদ্যোমি সহযোগী রবার্টসন এবং অন্যান্য দক্ষ অফিসাররা। শেষে ব্রিয়ারলিও কি কোনও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন! মুখ দেখে কাউকে বোঝার উপায় নেই তা হলে? অবশ্য মাইক ব্রিয়ারলির মুখই বা পাঠক কবে দেখেছেন? তার মাঝারি উচ্চতা, পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স, পোশাক পরিচ্ছদ বা হাঁটা চলা তেমন নায়কোচিত নয়, কবিতা পাগল (প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ‘লিলির সঙ্গে অলিগলি’-নিজে একশো কপি কেনা ছাড়া, একটাও বিক্রি না হবার পর, একটু দমে গেছেন, বিনা পয়সায় সেই একশো কপি অবশ্য বিলি করতে পেরেছেন, তাই বা কম কী!), বউকে ভয় পায়। বিশেষত্বর মধ্যে চওড়া চোয়াল আর অতি উজ্জ্বল এক জোড়া চোখ, এর বাইরে লোকটার সম্বন্ধে, ‘দ্য ইনভেস্টিগেটর’ কোনওদিন কিছু লেখেনি।” উত্তেজিত ভাবে একটানা কথাগুলো বলে দম নিতে থামলাম, দেখলাম অধীরদা ওঁর ট্রেডমার্ক মিটিমিটি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। গতকাল রাতেই অধীরদা ফোনে বলে দিয়েছিলেন, ডাবলিন থেকে দ্য ইনভেস্টিগেটরের লেটেস্ট কপিটা এসে গেছে আর তাই রোববার সকালে মাইক ব্রিয়ারলির গোয়েন্দাগিরির টানে বাজারটা বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই এসে জুটেছি অধীরদার বৈঠকখানায়। কাহিনির শুরুতেই এ হেন গোয়েন্দাই যদি অভিযুক্তের কাঠগড়ায় থাকেন তবে মাথার ঠিক থাকে?
অধীরদা বললেন, “অতনুদা গল্পের গোয়েন্দার চেহারার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা থাকে, তার ম্যানারিজম পাঠকের মগজে ঢুকিয়ে দিয়ে গোয়েন্দার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়, গোয়েন্দার বৈঠকখানা ঘরটিও একটা চরিত্র হয়ে ওঠে বটে, মক্কেলরা সব সেখানেই এসে তাদের সমস্যার কথা জানিয়ে গোয়েন্দাটির হাতে তদন্তভার তুলে দেন, আর তার সহকারী সেইসব কেস লিপিবদ্ধ করে পাঠকের দরবারে পেশ করেন, এই সহকারীরা সকলেই এক একজন সাহিত্যিক আর কী! মাইক ব্রিয়ারলি তো গল্পের গোয়েন্দা নন, তিনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা। তা আপনি কোথাও দেখেছেন নাকি যে কোনও পুলিশ কেসে পুলিশ অফিসারের চেহারার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে? তিনি পাইপ খান, না মাথার বাঁ দিকে সিঁথি করেন তাতে কী আসে যায়? মাইক ব্রিয়ারলিকে ব্যক্তিগত ভাবে কেউ তার বৈঠকখানায় এসে কোনও রহস্য উদঘাটনের তদন্তভার তুলে দেয় না, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড যে ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব তাকে দেয়, তিনি সেটাই পালন করেন মাত্র।
মাইক ব্রিয়ারলির সহকারী রবার্টসন সাহিত্যিক নয়, সে কোনওদিন ব্রিয়ারলির রহস্য উদঘাটন প্রণালী নিয়ে বই লিখবে না, মাইকের তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী মন, নিখুঁত পর্যবেক্ষণ এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে সে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু সে মোটেই গল্পের গোয়েন্দার সহকারীর মতো মাইক ব্রিয়ারলির ভক্ত নয়, বরং মাইক তার উপরওয়ালা বলে এবং দক্ষতায় অনেক এগিয়ে বলে একটু পেশাদারি অসূয়াও আছে, কর্মক্ষেত্রে যা হয়। ডাবলিনের পত্রিকা, ‘দ্য ইনভেস্টিগর’-এর রিপোর্টারদের কাছে মাইকের উদ্ভট কবিতা এবং পত্নীভীতির কথা রবার্টসনই রটিয়েছে বলে সন্দেহ হয় এবং তাতে বেশ কিছু রং মেশানো থাকতে পারে। আপনিও মাইক পত্নী লিলির মতো পুরো ঘটনাটা না জেনেই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ফেলেছেন, কারণ আপনারা দু’জনেই মাইক ব্রিয়ারলিকে ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, তার সামান্য বিচ্যুতি আপনারা সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু মনে রাখবেন, মাইক ব্রিয়ারলি প্রখর বুদ্ধিমান হলেও রক্ত মাংসের একজন মানুষ, অতি নাটুকেপনা করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা,
আর প্রশংসা পেতে চাওয়ার রোগ মুক্ত নন। তবে আপনার আশঙ্কার কারণ নেই, আমি কাল রাতেই কৌতূহল দমন করতে না পেরে কেসটা কিছুটা পড়েছি, বিশাল মালহোত্র যে অভিযোগ করেছেন তা অনেক পুরনো ঘটনা, তার সঙ্গে মাইক ব্রিয়ারলি বা টনি অ্যাডামসের সরাসরি কোনও যোগাযোগ নেই, কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসার হিসেবে দায় তাদেরও আছে, মাইক ব্রিয়ারলি সেই দায়ভার থেকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে মুক্ত করতে পারেন কি না সেটাই দেখার। চলুন দেখা যাক রবার্টসন কেন মাইককে ফোন করল। টনি অ্যাডামসের নির্দেশেই যে ফোন তা বলার অপেক্ষা রাখে না, ঘটনা যে দিকে মোড় নিয়েছে তাতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়কর্তা তদন্তভার তার সেরা অস্ত্রের হাতেই তুলে দেবেন বুঝতে কোনও অনুমানের দরকার নেই।” আমি মনে মনে স্বীকার করলাম, কেন অধীরদা রহস্য কাহিনির এনসাইক্লোপিডিয়া, যে দক্ষতায় তিনি পুরো ব্যাপারটা বর্ণনা করলেন, তাতে তিনিও যে দক্ষ গোয়েন্দা হতে পারতেন তাতে সন্দেহ নেই। ঘটনাটা কী সেটাই জানবার জন্য এখন উশখুশ করছি।
উশখুশটা একটু দীর্ঘায়িত হলেও তেমন আফসোস হল না। নন্দিতা বৌদি মানে অধীরদার স্ত্রী গরম গরম ফুলকো ফুলকো দুধ সাদা লুচির সঙ্গে আলুর ছেঁচকি যা পরিবেশন করেছিলেন, তাতে নিরুপায় আমি গোটা দশেক লুচি সাবড়ে তবে থামলাম, এখন বসেছি গরম কফির পেয়ালা হাতে ঘটনার ঘনঘটা কোন দিকে অগ্রসর হয় তা জানার জন্য।
অধীরদা পড়া শুরু করলেন, “বিশাল মালহোত্রর আটবছর বয়সী ছেলে ২৮শে জুলাই, শনিবার, ২০০১-সকাল দশটা নাগাদ, উইন্ডসর ক্যাসেলে কোনও একটা অনুষ্ঠান দেখতে বার্কশায়ারে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে উধাও হয়ে যায়। উইন্ডসর ক্যাসেল বার্কশায়ারেই অবস্থিত, সুশীল মালহোত্র মানে বিশালের ছেলে, অনেকবার আগেও একা উইন্ডসর ক্যাসেলে গেছে। পুলিশ সুশীলকে খুঁজে বার করতে ব্যর্থ হয়। সপ্তাহ দুয়েক বাদে বিশাল এক অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের ফোন পান, যুবকটি তার পরিচয় গোপন রাখে, শুধু বলে সে একজন পুরুষ যৌন কর্মী এবং সুশীলকে বাচ্চাদের যৌন নির্যাতনকারী (Paedophiles)
একটা গ্যাং অপহরণ করেছে, এদের ক্লায়েন্টরা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং অভিজাত ব্রিটিশরা এতে জড়িত। বিশাল ওই অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের সাথে তার কথোপকথন টেপ করে রেখেছিলেন এবং প্রায় কুড়ি মিনিটের টেপটি তিনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেন। যুবকটির গলা শুনে বিশালের মনে হয় তার বয়স বছর ২০-২৫ হবে। যুবকটি কিন্তু কোনও প্রভাবশালীর নাম বলতে অস্বীকার করে, নিজের প্রাণ বাঁচাতেই সে ঝুঁকি নিতে চায়নি। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এই কেসের কোনও কিনারা করতে পারেনি, সুশীল উধাও হবার তিন সপ্তাহ বাদে, ১৮ই অগস্ট সমারসেটের একটা জলার ধার থেকে সুশীলের দেহ পাওয়া যায়।
পুলিশ রিপোর্টে বলা হয়, ‘সুশীলের উপর যৌন নির্যাতনের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।’ ইস্ট সমারসেট করোনার, ‘পিয়ার্স মুর’ সুশীলের মৃতদেহ inquest করার পর এটি একটি খুনের ঘটনা বলে রায় দেন।” অধীরদা একটা সিগারেট ধরাতে থামলেন। আমি বললাম, এ তো মারাত্মক ব্যাপার, তিন সপ্তাহ ধরে একটা আট বছরের বাচ্চা নিখোঁজ হয়ে গেল, একজন অজ্ঞাত পরিচয় যুবক সে সম্বন্ধে ফোন করে কিছু সূত্র দিল, তারপরেও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড কিছু করতে পারল না এবং বাচ্চাটিকে শেষ পর্যন্ত খুন হতে হল। বিশাল মালহোত্রর অভিযোগের যথেষ্ট সারবত্তা আছে, আচ্ছা এত বছর বাদে এই ঘটনা আবার সংবাদের শিরোনামে উঠে এল কেন? রবার্টসন কেন মাইক ব্রিয়ারলিকে ফোন করল সেটা এখনও খোলসা করলেন না।
অধীরদা বললেন, “এই শতাব্দীর প্রথম ভাগে, অর্থাৎ যে সময় সুশীল অপহৃত হয়, Paedophiles দের উপস্থিতি এবং কার্যকলাপ নিয়ে লন্ডন তোলপাড় হয়, ব্রডস্ট্রীট অঞ্চলের দু’টি হোটেলের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল, পুলিশ একাধিকবার এইসব হোটেলে হানা দিয়ে কিছুই পায়নি, বিবিসি আলাদা করে অনুসন্ধান চালিয়ে বলে এটা একটা গুজব ছাড়া কিছুই নয়। কোনও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া বাচ্চার খোঁজ পুলিশ পায়নি, শিশু অপহরণের সামান্য কিছু ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল, সেগুলো সবই মুক্তিপণের সঙ্গে যুক্ত, পুলিশের মতে আসলে এ গুলো অপরাধ জগতের বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিশেষ করে ড্রাগসের কারবারীদের অন্তর্কলহের ফল, একে অপরকে জব্দ করে কাজ হাসিল করতে বাচ্চা অপহরণ একটা প্রধান অস্ত্র। খুব সামান্যই এ সব পুলিশে রিপোর্ট হয়। আর একটা কথা উল্লেখ করব, সেই সময় পুলিশ বা বিশাল মালহোত্র কোনও পক্ষই সেই অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের কথা প্রকাশ্যে আনেননি, যুবকটির নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত এবং এখনও বিশাল মালহোত্র সেই অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ যৌনকর্মীর কথা সাংবাদিকদের সামনে বলেননি, সেই সংযম এবং কৃতজ্ঞতা তিনি বজায় রেখেছেন। এটা একেবারেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
১১ই জুন, ২০২১ তারিখে, এক ভদ্রলোক পুলিশে অভিযোগ জানান তার
বছর দশেকের ছেলেকে দক্ষিণ লন্ডনে একা উদভ্রান্তর মতো ঘুরতে দেখে এক সহৃদয় ব্যক্তি ছেলেটিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যান। ছেলেটির বাড়ি কেন্টের চিলহ্যামে, তাকে সেখান থেকে সেইদিন সকালেই অপহরণ করা হয় এবং তাকে একটি বাড়িতে তোলা হয়, সেখানে একজন মাঝবয়সী লোক তার বয়সী একটি বাচ্চা ছেলের উপর যৌন নির্যাতন চালাচ্ছিল, সেটা জানলার ফাঁক দিয়ে সে দেখে ফেলে।
এরপর সে নিজেই ফাঁকতালে ওখান থেকে পালিয়ে যায়। বাচ্চাটি কোন বাড়িতে তাকে অপহরণ করে রাখা হয়েছিল তার কিছুই বলতে পারেনি, এমনিতেও সে লন্ডনের রাস্তাঘাট বিশেষ চেনে না।
যে অজ্ঞাতপরিচয় সহৃদয় ব্যক্তি বাচ্চাটিকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যান, তিনিই নাকি বাচ্চাটিকে বলেন সে যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সেটি দক্ষিণ লন্ডনে অবস্থিত। এই ঘটনা সামনে আসতেই বিশাল মালহোত্র স্বভাবতই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে তুলোধনা করে বলেছে বাচ্চাদের যৌন নির্যাতনের চক্র প্রবল ভাবে সক্রিয় সেটা প্রমাণ হয়ে গেল এবং তার ছেলেকে এরাই হত্যা করেছিল, সব জেনেশুনে প্রভাবশালীদের আড়াল করেছে দুর্নীতিগ্রস্ত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। পুলিশের বক্তব্য, বাচ্চাটির বাবার বয়ানে যথেষ্ট অসঙ্গতি আছে এবং বাচ্চাটি খুব গুছিয়ে কিছু বলতে পারছে না। বাচ্চাটি অপহরণের ঘটনা কিন্তু তার বাড়ির লোক পুলিশে জানায়নি, জানিয়েছে সে ফিরে আসার পরে।
অতনুদা চলুন এবার দেখা যাক রবার্টসনের ফোন পেয়ে ব্রিয়ারলি কোথায় গেলেন, আমরা ঘটনাস্থলে ঢুকে পড়ি।”
সাসেক্স থেকে পশ্চিমে হ্যাম্পশায়ার যাওয়ার রাস্তায় একটা মাঠের ভিতরে মাইক যখন রবার্টসনের কথা মতো পৌঁছলেন, তখন দেখলেন বড়কর্তা টনি অ্যাডামস স্বয়ং উপস্থিত, একজন পুলিসকর্মী ঢাকা দেওয়া কাপড়টা সরিয়ে লাশটা মাইককে দেখাল, একটা বাচ্চার হাত, পা, মাথা কিছুই নেই, শুধু ধড়টুকু আছে, পুলিশের ডাক্তারের মতে, বাচ্চাটির বয়স ৯-১০ হবে।ব্রিয়ারলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই লাশ পরীক্ষা করে রবার্টসনকে বললেন দ্রুত পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা করতে। টনি অ্যাডামসকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল, তিনি মাইক এবং রবার্টসনকে তার গাড়িতে উঠতে বললেন। ফেরার রাস্তায় তিনি মাইককে বললেন, “বুঝতে পারছ ব্রিয়ারলি, কাল সকালে পুরো ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। লাশটা দেখে তো কিছুই বোঝার উপায় নেই, পরশুদিন যে ছেলেটা অপহৃত হয়েছিল, সে আরও একটা বাচ্চার কথা বলেছিল, মনে হচ্ছে একটা বাচ্চা পালানোতে অপহরণকারীরা কোনও ঝুঁকি না নিয়ে অন্য বাচ্চাটাকে খুন করেছে, তার পরিচয় গোপন করতে হাত, পা, মাথা কেটে নিয়েছে। তোমার কী মনে হয়? তুমি কোথা থেকে তদন্ত শুরু করতে চাইছ?” মাইক বললেন, “স্যার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না সেটা বলতে পারি না, মৃতদেহ সবসময়ই কথা বলে, এখানেও বলছে। আমি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের আর্কাইভ থেকে কাজ শুরু করতে চাই, বিশাল মালহোত্র যে টেপের কথা বলেছেন সেটা শুনতে হবে, ফরেন্সিক রিপোর্ট চলে আসার আগে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লাইব্রেরিতেও একটু সময় কাটাতে হবে। একবার চিলহ্যামে যেতে হবে উদ্ধার হওয়া বাচ্চাটার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলা দরকার। তার আগে পুলিশ যে তার বয়ান নথিবদ্ধ করেছে, সেটাও দেখতে হবে।” রবার্টসন বিড়বিড় করে ওঠে, “শুরু হল বুড়ো ছুঁচোর নাটক, লাশ পাওয়া গেল এখন, কুড়ি বছর আগের টেপ শুনতে আর্কাইভে যাবে, সবসময় নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার ধান্দা, বসকে দেখাচ্ছে কত বুদ্ধিমান।” টনি অ্যাডামস বললেন, “যা ভাল বোঝো ব্রিয়ারলি।” মুখে বললেন, “জানি তুমি সবসময়ই বিচিত্র পথে তদন্ত করো, তবে আর্কাইভে গিয়ে একটা পুরনো টেপ শুনে কী করবে আর লাইব্রেরিতে বসে খুনের তদন্ত কী করবে বুঝতে পারছি না।” মুখে যেটা বললেন না, সেটা হল মাইক ব্রিয়ারলির মতো বিচিত্র জীব তিনি জীবনে দেখেননি।
তিনদিন বাদে যখন রবার্টসন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লাইব্রেরিতে ঢুকল তখন মাইক মন দিয়ে একটা ছড়ার বই পড়ছিলেন। দেখে পিত্তি জলে গেল রবার্টসনের, শরীর চিড়বিড়িয়ে উঠল আর বিড়বিড়িয়ে গালাগাল দিয়ে উঠল, “শালা বুড়ো ছুঁচো, এখানে বসে কাব্যচর্চা করছে আর আমাকে দৌড় করাচ্ছে কোথায় কোথায় ৮-১০ বছর বয়সী এশীয় বাচ্চার এক সপ্তাহের মধ্যে মিসিং ডায়রি হয়েছে তার খোঁজ করতে, সেইসব কেসের পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট তৈরি করতে।”
মাইক, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে বলে উঠলেন, “সেরকমই তো হবার কথা। রবার্টসন তুমি ফরেন্সিক টক্সিকোলোজির ব্যবস্থা করো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই রিপোর্ট আমার চাই। এখন বলো ওই এশীয় বাচ্চাদের মিসিং ডায়রি কতগুলো হয়েছে?” রবার্টসন বলল, “গত এক সপ্তাহে তিনজন ৮-১০ বছর বয়সী এশীয় বাচ্চা নিখোঁজের ডায়রি জমা পড়েছে। এর মধ্যে আমি চিলহ্যামের বাচ্চাটিকে ধরছি না। আর মিসিং ডায়রি যা হয়েছে তা হয় ওই বয়সী বাচ্চাদের নয়, নয়তো তারা এশীয় বংশোদ্ভূত নয়। এই ফাইলে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তা বস, ছড়ার বইতে কী রহস্যর খোঁজ করছিলেন সেটা জানতে পারি? আমি তো পুরো অন্ধকারে।”
রবার্টসন খোঁচা মারার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না।
“তা বলতে পারো রবার্টসন, অন্ধকারের কথাটা নেহাত মন্দ বলোনি, একে অন্ধকারের ছড়া বা প্রবাদ বলতেই পারো। তবে এখন চিলহ্যাম যেতে হবে, আশাকরি, চিলহ্যামের ঘটনা পুরো খতিয়ে তোমার দেখা হয়ে গেছে।
লাঞ্চটা আগে সেরে নিই চলো। ছড়া পরে হবে।”
অধীরদা বললেন, “বলেছিলাম না অতনুদা, ব্রিয়ারলি অতি নাটুকেপনার মোহ ছাড়তে পারেন না, নিজের ঊর্ধ্বতন এবং অধস্তন দু’পক্ষকেই অন্ধকারে রেখে শেষে গিয়ে ওঁর আস্তিনের তাসগুলো দেখানোর একটা নেশা ব্রিয়ারলির আছে।”
আমি বললাম, “সে আপনি যাই বলুন অধীরদা। মাইকের প্রত্যেক কথার কিন্তু একটা গভীর অর্থ আছে, সেটা মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যায়। গোয়েন্দাপ্রবর প্রখর মস্তিষ্কের অধিকারী, ভগ্নাংশের কম সময়ে কর্তব্য ঠিক করে নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিলম্ব করেন না।”
অধীরদা শুধোলেন, “যেমন?”
আমি বললাম, “উদ্ধার হওয়া বাচ্চার মৃতদেহটি দেখে মাইক এমন কিছু টের পেয়েছে, যাতে করে তিনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের আর্কাইভ এবং লাইব্রেরিতে থেকে তদন্তের কাজ শুরু করেছেন, মোটেই তিনি এমনি এমনি ছড়ার বই পড়ছিলেন না, ওটা বিশেষ কোনও বই হতে বাধ্য, যার সঙ্গে এই কেসের সংযোগ রয়েছে, রবার্টসনের সে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা নেই বলে ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। বিশাল মালহোত্রর জমা দেওয়া কুড়ি বছরের পুরনো টেপ শোনাও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। আট-দশ বছরের এশীয় বাচ্চাদের নিরুদ্দেশ সম্বন্ধে জানতে চাওয়ারও কারণ আছে, রবার্টসন বলেছে ওই তালিকায় চিলহ্যামের বাচ্চাটিকে রাখেনি। তার মানে পরিষ্কার সেও এশীয় বংশোদ্ভূত, সম্ভবত সে যে আর একটি বাচ্চার উপর যৌন নির্যাতন হতে দেখেছে, সেও এশীয়, বিশাল মালহোত্রর ছেলেও তাই ছিল। অর্থাৎ একটা প্যাটার্ন মাইক খুঁজে পেয়েছেন।”
অধীরদা বললেন, “ব্র্যাভো অতনুদা, সঙ্গে আমি কিছু যোগ করি। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখেই মাইক রবার্টসনকে বলেছেন, ফরেন্সিক টক্সিকোলজির ব্যবস্থা করতে, এটা করতে হয় শরীরে নির্দিষ্ট বিষ বা ড্রাগসের উপস্থিতি জানার জন্য, সেরকম কিছুর ইঙ্গিত পোস্টমর্টেমে আছে নিশ্চয়ই, তাই মাইক সঠিক বিষের কথা জানতে চাইছেন, আমার ধারণা তিনি সেটা বুঝতেও পেরেছেন। আগে ফরেন্সিক টক্সিকোলজিতে অনেক সময় লাগত, এখন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মতো সংস্থা আধুনিকতম ল্যাবে সেরা বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে এই রিপোর্ট দ্রুত বার করে ফেলবে। চলুন, মাইকরা চিলহ্যামে সেই বাচ্চাটির বাড়িতে পৌঁছে গেছে, দেখি সেখানে কী কথোপকথন হয়।”
মি: নরেশ সিং, কেন্টের একটি শপিং মলের স্টোরে কাজ করেন। বিকেল চারটে নাগাদ যখন মাইক আর রবার্টসন তার বাড়িতে পৌঁছোল, তখন তিনি রবার্টসনের নির্দেশ মতো বাড়ি চলে এসেছেন, খুবই বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, “আপনাদের জন্য কাজের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল, আজ আমার ছুটি নেই, সবে অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসছে, এই সময় ম্যানেজার তো ছুটি দিতেই চাইছিল না।”
মাইক বললেন, “যাতে আপনার কাজের কম ক্ষতি হয়, সেটা দেখা আপনারই দায়িত্ব। আপনি পুলিশে একটা অভিযোগ জানিয়েছেন কিন্তু প্রচুর মিথ্যা বলেছেন বলে পুলিশের অনুমান। আপনি নিশ্চয়ই চান বাচ্চারা যাদের লালসার শিকার, তাদের শাস্তি হোক। আপনার ছেলে যতই বুদ্ধিমান হোক, সে নিজে অপহরণকারীদের ডেরা থেকে পালিয়ে এসেছে সেটা গল্প হিসেবে অত্যন্ত কাঁচা।
আপনার বাচ্চাকে যিনি বাঁচিয়েছেন তাকে আড়াল করতেই আপনি মিথ্যা বলেছেন, কিন্তু ভেবে দেখুন, তিনি সব বাচ্চাকে বাঁচাতে পারবেন না আর তিনিও চান অপরাধী ধরা পড়ুক। যত কম বার আপনি জেরার সম্মুখীন হবেন, তত আপনার কাজের ক্ষতির পরিমাণ কমে যাবে। আমার নাম, ‘মাইক ব্রিয়ারলি’ এবং আমার সঙ্গী, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বিখ্যাত গোয়েন্দা, ‘অ্যান্ড্রিউ রবার্টসন।’ আপনি হয়তো আমাদের নাম শুনে থাকবেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার ছেলেকে যিনি বাঁচিয়েছেন আমরা তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব, এখন তাকে খুঁজে বার করতে আপনার সাহায্য দরকার। নয়তো অপরাধীদের হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়।” একটুক্ষণ চুপ করে থেকে নরেশ বললেন, “কিন্তু আমি তো তাকে চিনি না।” মাইক বললেন, “আমরা চিনতে সাহায্য করছি। আপনি, আপনার ছেলে অপহরণের কথা পুলিশকে জানাননি, অভিযোগ জানিয়েছেন সে ফিরে আসার পরে। কারণটা হল ১১ই জুন, স্কুল যাওয়ার পথে আপনার ছেলে অপহৃত হয়।
তার স্কুল লকডাউনের পরে, জুনের ১ তারিখেই খুলে গেছিল। আমরা খোঁজ নিয়েছি ১০ বছরের একটি ছেলের হাঁটা পথে ওই স্কুলে পৌঁছতে মিনিট ১২ লাগার কথা। সেদিন পথেই তাকে অপহরণ করা হয়, সেটা আপনার ছেলে আগেই বলেছে। এখান থেকে লন্ডন গাড়িতে যেতে লাগে এক ঘন্টার কিছু বেশি সময়, তাকে লন্ডনে নিয়ে পৌঁছনোর মোটামুটি ঘন্টা খানেকের মধ্যে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির ফোন পেয়ে বেলা ১১ টা নাগাদ লন্ডনের উদ্দেশে আপনারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই রওয়ানা দেন। আপনার কর্মক্ষেত্র থেকে সে খবর আমরা জেনেছি। যে অ্যাপ ক্যাব আপনারা বুক করেছিলেন তার নম্বর এবং সেটি কোথায় আপনাদের ড্রপ করে, তার কিছুই আমাদের অজানা নয়।
বাকিটা আপনি বললে আমাদের সুবিধা হয়।” নরেশ বললেন, “আমি যা জানি, তা সত্যি বলব।
আমার ছেলের স্কুল শুরু হয় সকাল ৯টায়, সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল আনুমানিক তার মিনিট কুড়ি আগে। সে একাই স্কুলে যায়, স্কুলে যাওয়ার জন্য তাকে ফুটপাথও বদল করতে হয় না।
আমরা স্বামী-স্ত্রী বাড়ি থেকে বেরোই সকাল ৯.৩০ নাগাদ, দু’জনেই এক শপিং মলের ভিন্ন ভিন্ন স্টোরে কাজ করি। আমার ছেলে বাড়ি ফেরে ৪.৩০ নাগাদ এবং বাড়ির ল্যান্ডলাইন ফোন থেকে আমাদের ফোন করে সেটা জানিয়ে দেয়, ওর কাছে মোবাইল নেই। তার আগে স্বভাবতই আমাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় না। আমাদের সংসার মোটামুটি চলে যায় তবে এমন অবস্থা নয়, যে ছেলের জন্য গভর্নেস রাখতে পারি, তার প্রয়োজনই বা কী? দশ বছরের একটি ছেলে নিজের দেখাশোনা করতে পারে, আমার ছেলে সুরেশ খুবই স্মার্ট, সে নিজেকে সামলাতে জানে। অপহরণের ঘটনার পরেও আমি তাই বলব, সে ছেলে মোটেই ঘাবড়ায়নি।
যাইহোক সেইদিন প্রায় ওই ১১টা নাগাদই এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি আমাকে ফোনে করে বলে, আপনার ছেলের থেকে আপনার মোবাইল নম্বর পেয়ে আপনাকে ফোন করছি, সে Paedophiles দের খপ্পরে পড়েছে, তাকে অপহরণ করে লন্ডনে নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে দুপুরে একটা পার্টি আছে, সেখানে ওকে ব্যবহার করা হবে, আপনি ১টার আগে আসতে পারলে ওর কোনও ক্ষতি হওয়ার আগে ওকে ঠিক এখান থেকে বার করে দেব। নয়তো আপনার ছেলে হয়তো যথাসময়ে বাড়ি ফিরবে, কিন্তু ওর অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি এবং আমার স্ত্রী একটা ক্যাব বুক করে ওই ভদ্রলোকের বলে
দেওয়া জায়গায় সাউথ লন্ডনের নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করতে থাকি, আমাদের পক্ষে সেই ব্যক্তিকে ফোন করা সম্ভব হয়নি, যেহেতু সে পাবলিক ফোন থেকে কল করেছিল। কিছুক্ষণ বাদে আমরা আবার তার ফোন পাই, হতে পারে সে আমাদের আড়াল থেকে দেখতে পাচ্ছিল বা সময় আন্দাজ করে ফোন করেছিল।
লোকটি খুব দ্রুত কথা বলছিল এবং বলেছিল আপনার ছেলের কোনও ক্ষতি হয়নি, এখনই আপনার ছেলেকে পেয়ে যাবেন আর ওকে নিয়ে লন্ডন থেকে বেরিয়ে যাবেন, এরা খুব প্রভাবশালী লোক, নয়তো সমস্যা হবে। মিনিট পনেরো বাদে দেখি ফুটপাথ ধরে আমার ছেলে দৌড়ে আসছে। তারপর আমরা ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে পুলিশকে ফোন করি। এই হল আমাদের আসল কাহিনি।” মাইক বললেন, “মোটামুটি ঠিক আছে, তবে কিছু জিনিস লুকিয়ে গেছেন, পুলিশের কাছে যে গল্পটি সেদিন ফেঁদেছিলেন, সেটি আপনার অজ্ঞাতপরিচয় বন্ধুর বলে দেওয়ার সম্ভাবনা, আপনি কিছু হয়তো যোগ করেছিলেন। তবে আপনি অ্যাপ ক্যাব থেকে ঘটনাস্থলের আগেই নেমে গিয়ে যে কিছুটা পথ হেঁটে গেছিলেন, সেটি পুরোপুরি আপনার বন্ধুর অবদান, সে আশঙ্কা করেছিল, পুলিশ অ্যাপ ক্যাব ট্র্যাক করে ফেলবে। তারপর অকুস্থল বার করা খালি সময়ের অপেক্ষা এবং আপনার বন্ধুটির পরিচয় তাতে আর গোপন থাকত না এবং তার প্রাণ সংশয় হওয়া মোটেই বিচিত্র ছিল না।
ট্রেনে এলে ব্যাপারটা এড়ানো যেত, কিন্তু তখন অত হ্যাপা পোহানোর মানসিকতা আপনাদের ছিল না। কৃতজ্ঞতা থেকে আপনি এ টুকু করতেই পারেন। আপনার ছেলের সঙ্গে আমি আলাদা করে কথা বলব, ওকে ডাকুন।”
রবার্টসনের মনে হল, আজ একটু বসের পায়ের ধুলো নেওয়া উচিত। শুধু অপরাধী নয়, অপরাধের শিকার হওয়া মানুষের মনস্তত্ত্বও মাইক ব্রিয়ারলি এত ভাল বোঝেন যে লক্ষ্যে পৌঁছতে তাঁর কোনও অসুবিধা হয় না। গাড়িতে উঠে রবার্টসন বলল, “বস, আপনি বোধহয় জুরাসিক এজের অপরাধেরও কিনারা করে ফেলবেন, এ তো বছর কুড়ির আগের ঘটনা, আগেও এ রকম অনেক করেছেন। তবে আর একটু খুলে বললে আমার কাজ করতে সুবিধা হয়। সবাই তো আপনার মতো ক্ষুরধার মস্তিষ্কের মালিক নয়।” মাইক কিন্তু এত প্রশংসায় স্বভাবসিদ্ধ বিগলিত হলেন না, বললেন, “রবার্টসন, নরেশ সিং কেন্ট পুলিশকে যে বয়ান দিয়েছিল, তার অসঙ্গতি ধরতে বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার দরকার নেই। সে ব্যাখ্যা আগেই দিয়েছি। সুশীল মালহোত্রকে অপহরণ করেছিল Paedophiles গ্যাং, সুরেশ সিংকেও তাই। এদের দু’জনের বাবাকেই একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ফোন করে খবর দেয়। আমার খটকা লাগে এরা আসলে একই ব্যক্তি হতে পারে। বিশাল যে টেপ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে জমা দিয়েছিল, সেটা শুনতে গিয়ে আমি লক্ষ করি কুড়ি মিনিট কথোপকথনে অজ্ঞাতপরিচয় সেই ব্যক্তি মোট একানব্বই বার, ‘okay’ শব্দটি ব্যবহার করে। অর্থাৎ এটি তার মুদ্রাদোষ। প্রথম চিন্তা ছিল, ব্যক্তিটি অভিন্ন হলেও সেই মুদ্রাদোষ কী কুড়ি বছর বাদেও বজায় আছে? যদি ধরে নিই, সে যখন বিশাল মালহোত্রকে ফোন করেছিল, তখন তার বয়স ছিল কুড়ি, তা হলে এখন তার বয়স চল্লিশ, গলার স্বর খুব একটা বদলাবে না, কারণ কুড়ি বছর বয়সে একজন যুবকের গলা তৈরি হয়ে যায়, বার্ধক্য আসার আগে সেই স্বর পরিবর্তন হয় না। বড়জোর চেহারা ভারী হয়ে গেলে স্বর কিছুটা ভারী হতে পারে, একজন যৌনকর্মীর চেহারার দিকে নজর রাখতে হয়, সুতরাং সে সম্ভাবনা কম। কিন্তু টেপ শুনে নরেশ বা সুরেশ অল্প সময় কথা বলা একজনের গলা সঠিক ভাবে চিনতে পারবেই সেটা গ্যারান্টি দেওয়া যায় না, মনে রাখতে হবে সেই সময় তারা প্রবল উৎকন্ঠার মধ্যে ছিল। ভরসা করেছিলাম ওই প্রবল মুদ্রাদোষ কাটানো মুশকিল এবং সেটাই ঠিক প্রমাণিত হল, টেপ করা কথোপকথন শুনে নরেশ সেটা চিনতে পারল। আমার আর একটা ভয় ছিল, কুড়ি বছর আগে সুশীল মালহোত্রর অপহরণ এবং হত্যা নিয়ে যা তোলপাড় হয়েছিল, তাতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিটি বিশাল মালহোত্রর সংযম সত্ত্বেও পরিচয় গোপন রাখতে পেরেছিল কি না, বিশালের অভিযোগ অনুযায়ী যদি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তদন্তকারী অফিসাররা অপরাধীদের আড়াল করতে চাইত, তবে সেখান থেকেও ওই ব্যক্তির পরিচয় বেরিয়ে যেতে পারত। যার একটাই পরিণাম, মৃত্যু।
এখন নিশ্চিত করে বলা যায় সেই তদন্তকারী অফিসাররা কর্তব্যে চূড়ান্ত গাফিলতি করলেও দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল না। তা রবার্টসন, তোমার তো কর্তব্যে গাফিলতির কোনও নিদর্শন নেই, লন্ডন শহরে একজন বছর চল্লিশের পুরুষ যৌনকর্মী, যার ক্লায়েন্টরা সব তথাকথিত নীল রক্তের অভিজাত শ্রেণির, যার নাকি কথায় কথায়, ‘okay’ বলার মুদ্রাদোষ আছে, সে তোমার কাছে কত ঘণ্টা পরিচয় গোপন করে থাকতে পারবে? কালকের মধ্যে তাকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে আমার অফিসে হাজির করবে, তারপর দেখি কার রক্ত কত নীল। ফরেন্সিক টক্সিকোলজির রিপোর্টও তো দু’-তিন দিনের মধ্যে হাতে পাওয়ার কথা। মনে হচ্ছে এই রহস্যের যবনিকা পতনের সময় ঘনিয়ে এসেছে।”
অধীরদা আর আমি একটা কফিব্রেক নিলাম, সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে অধীরদা বললেন, “রবার্টসন যতটা কৃতিত্বের ভাগীদার, তার কিয়দংশ, ‘দ্য ইনভেস্টিগেটর’-এর কলমচি কিন্তু তাকে দেন না। মাইক ব্রিয়ারলির লার্জার দ্যান লাইফের ছবি যত তুলে ধরা যায়, ততই ওদের কাগজের বিক্রি বাড়ে। মি: ব্রিয়ারলির দক্ষতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে, তবু দৌড়-ঝাঁপের কাজই শুধু নয়, মাইক ব্রিয়ারলির নির্দেশ কাজে পরিণত করতে রবার্টসনকে যথেষ্ট বুদ্ধিও খরচ করতে হয়, রবার্টসনের ইনফর্মার বেস দুর্দান্ত, সেটা কাজে লাগিয়েই সে অজ্ঞাতপরিচয় সাহায্যকারীকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে হাজির করবে। ইদানীং কালের নিঁখোজ এশীয় বংশোদ্ভূত বাচ্চাদের সম্বন্ধেও তার নিখুঁত রিপোর্ট তৈরি। হাতে চলে এসেছে ফরেন্সিক টক্সিকোলজির রিপোর্ট।
চলুন দেখা যাক ব্রিয়ারলি আর রবার্টসন কেন ল্যাঙ্কাশায়ারে শ্রীলঙ্কার ব্যবসায়ী মি: ডিসিলভার বাড়িতে পৌঁছে গেছে। ডিসিলভার ছেলে এখনও নিখোঁজ।
মিসেস ডিসিলভা বললেন, তার স্বামী, মি: দাসুন ডিসিলভা ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে গেছেন। ভদ্রমহিলাকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল, স্বাভাবিক ভাবেই প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন, একটা দশ বছরের ছেলের যদি ছ’দিন ধরে কোনও খোঁজ না পাওয়া যায় তবে মায়ের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এই সময় ব্রিয়ারলির সঙ্গে মিসেস ডিসিলভার কথোপকথনটা বরং আমরা এড়িয়ে যাই, সোজা ঢুকে পড়ি তার তিন দিন বাদে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কনফারেন্স রুমে, যেখানে বড়কর্তা টনি অ্যাডামস ছাড়া উপস্থিত আছেন মাইক ব্রিয়ারলি, রবার্টসন, বিশাল মালহোত্র, নরেশ সিং, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অপর একটি ঘর থেকে অডিয়ো কনফারেন্সে পুরুষ যৌনকর্মী মি: ট্রেন্ট লিওন(সে এই কেসের চূড়ান্ত মীমাংসা হওয়ার আগে বিশাল মালহোত্র এবং নরেশ সিংয়ের মুখামুখি হতে রাজি নয়।), এবং পুরো ঘটনা ভিডিয়োগ্রাফির জন্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দু’জন অফিসার।
টনি অ্যাডামস নির্দেশ দিলেন, “শুরু করো ব্রিয়ারলি, মিডিয়া হাউসগুলো হাত-পা ধুয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পিছনে পড়ে আছে, তার যোগ্য জবাব দেওয়া চাই। যদিও এটা মেনে নেওয়া ভাল যে মি: মালহোত্রকে সুবিচার দিতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ব্যর্থ হয়েছে। হতে পারে আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমরা কেউ দায়িত্বে ছিলাম না। কুড়ি বছর পরেও তো একটা বাচ্চা খুন হয়ে গেল, দু’বারই মি: লিওন সতর্ক করেছিলেন, তবু বাচ্চা দু’টোকে বাঁচানো যায়নি। এবার তো মি: নরেশ সিং যেদিন সন্ধ্যায় পুলিশের কাছে গেলেন, তার একদিন বাদেই বাচ্চাটার মৃতদেহ পাওয়া গেল। তবে যত প্রভাবশালী চক্রই এর পিছনে থাকুক, তাদের আজীবন জেলের ঘানি টানিয়ে তবে ছাড়ব।”
ব্রিয়ারলি মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদনের ভঙ্গি করে বোমাটা ফাটালেন, “মি: নরেশ সিংয়ের ছেলে সুরেশ আর একটি বাচ্চার উপর যে যৌন নির্যাতন চলতে দেখেছিল, সেই বাচ্চাটি খুন হয়নি।” টনি অ্যাডামস যেন আঁতকে উঠলেন, “কী বলছ ব্রিয়ারলি, তবে কে খুন হল?”
“স্যার, আসলে ওখানে আর কোনও বাচ্চা ছিলই না। সুরেশ কিছুই বলেনি, তার মুখে কথা বসিয়ে বলেছিলেন মি: লিওন আর মি: নরেশ সিং, কথাটা মিথ্যা হলেও উদ্দেশ্যটা ভাল ছিল। তারা চেয়েছিলেন ব্যাপারটা নিয়ে তোলপাড় হোক, ভুয়ো বাচ্চাটাকে খুঁজতে গিয়ে আসল Paedophiles গ্যাংকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড খুঁজে বার করুক। কে খুন হল, সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
গত শতাব্দীর শেষভাগে এবং এই শতাব্দীর প্রথমভাগে এই Paedophiles গ্যাং লন্ডন এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রবল সক্রিয় ছিল, এদের লক্ষ্য থাকত আর্থিক এবং সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের বাচ্চারা, এই বাচ্চারা অনেকেই এশীয়, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের বংশোদ্ভূত বাচ্চা ছেলে। হ্যাঁ, মেয়েরা কখনও এদের লক্ষ্য হয়নি। এই গ্যাংটি কাজ করত একজন নরপিশাচের হয়ে, যে ব্রিটিশ সমাজে লর্ড উপাধি প্রাপ্ত, তবে তিনি একা নন, তার সঙ্গে ছিল দু’জন ব্রিটিশ বিজনেস টাইকুন, যারা নিজেরাও অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন। এই পিশাচ ত্রয়ীর লোলুপতার শিকার হয়েছে বহু বাচ্চা। এদের কোনও কোনও বিশেষ অতিথিও এদের প্রসাদ পেত।
মি: লিওনের কাছ থেকে জানতে পেরেছি সেই লর্ডের এশীয় বাচ্চাদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল, বাকি দু’জন সেই স্রোতে গা ভাসিয়েছিল। তবে এরা শুধু বাচ্চাদের ভোগ করেই সন্তুষ্ট ছিল না, মি: লিওনের মতো পুরুষ যৌনকর্মীদের তাদের ডেরায় ডাক পড়ত, তবে মি: লিওন আসলে সেই লর্ডের স্ত্রীর শয্যাসঙ্গী, সেই হিসেবে ওর একটা আলাদা খাতির এবং লর্ডের অন্দরমহলে অবারিত দ্বার ছিল।
এরা প্রথম ভুল করে বসে বিশাল মালহোত্রর মতো বিত্তশালী এবং লন্ডনে ভারতীয় কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় মানুষের সন্তানকে অপহরণ করে। এদের কর্মপদ্ধতির একটা বিশেষ প্যাটার্ন ছিল। এরা বাচ্চাদের অপহরণ করত সকালের দিকে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাকে ব্যবহার করে তার বাড়ির কাছাকাছি ছেড়ে দিত, লক্ষ্য ছিল বাড়ির লোক থানা-পুলিশ করবার আগেই বাচ্চা ফেরত দেওয়া। বাচ্চার পরিবারকে ভয় দেখানো ফোন, বা টাকা দিয়ে মুখ বন্ধের প্রস্তাব সবই এদের কর্মপদ্ধতির অন্তর্গত ছিল। কোনও বাচ্চাকে অপহরণের আগে তার সম্বন্ধে ভাল করে খোঁজখবর না নিয়ে এরা আসরে নামত না। এত সতর্কতার পরেও কেউ কেউ ভয়, লোভ এবং সামাজিক লজ্জা জয় করে পুলিশে গেছেন, কিন্তু পুলিশ কিছু কিনারা করতে পারেনি। অপহৃত বাচ্চারা কেউই কোথায় তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা বলতে পারেনি, এরা কতটা সতর্ক ও চতুর ছিল, সেটা এর থেকে সহজেই অনুমেয়। ব্রডস্ট্রিটের দু’টি হোটেলে এবং আরও কয়েকটি গেস্ট হাউসে রেইড করে পুলিশ কিছুই খুঁজে পায়নি। এই হোটেল বা গেস্টহাউসে বাচ্চাদের যৌন নির্যাতনের গুজবও রটিয়েছিল এই Paedophiles গ্যাং। মিডিয়াকেও এরা সুচতুর ভাবে উড়ো ফোনে খবর দিয়ে গেছে, সেই সময়ের খবরের কাগজের কপি দেখলেই এ সব জানা যাবে। আদতে এইসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটত তিন পিশাচের বাড়িতে, বিশেষ করে অভিজাত লর্ড উইলিয়ামসন সাহেবের বাড়িতে। এরা পুলিশের সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকা মানুষ, এরা কেন হোটেলে গিয়ে নিজেদের চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে! নিজেদের বাড়ি তো অভেদ্য দুর্গ, সেখানেই নোংরামির সবথেকে সুবিধা। এদের পরিবার থেকে কোনও বাধা আসেনি, এইসব পরিবারে তা আসেও না। প্রৌঢ় লর্ডের তরুণী স্ত্রী নিজেই একাধিক পুরুষ যৌনকর্মী সঙ্গ করেন, তবে মি: লিওন তার পছন্দের সঙ্গী এবং লিওনের উপর তার কিছুটা মানসিক নির্ভরতা আছে বলে তদন্তে টের পেয়েছি। লর্ড উইলিয়ামসনের প্রথম সঙ্গী জেফ ফিঞ্চ অকৃতদার, দ্বিতীয় সঙ্গী পল এলিসনের স্ত্রী একাধিক পরকীয়াতে জড়িত, তিন অভিজাত লোলুপের জন্য মঞ্চ একেবারে প্রস্তুত ছিল। আমার ধারণা সুশীল মালহোত্র অপহরণ আসলে ভুল করে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা, মি: বিশাল মালহোত্রর সামনে এই ঘটনার বর্ণনা দিতে আমার অস্বস্তি হবে, আমি আগেই মার্জনা চেয়ে নিলাম, কিন্তু বলতে তো হবেই। এই ঘটনার পুনর্নিমাণে মি: লিওন আমাকে সাহায্য করেছেন, নয়তো বর্ণনায় ফাঁক থেকে যেত।” মাইক জল খেতে থামলেন আর রবার্টসন বিড়বিড় করে উঠল, “না, থাকত না। তুমি বুড়ো ছুঁচো এক অতি ধুরন্ধর শয়তান। ফাঁক তুমি রাখতে না।”
রুমালে মুখ মুছে, ব্রিয়ারলি আবার শুরু করলেন, “সম্ভবত সুশীলকে দেখে অপহরণকারীরা অন্য কোনও বাচ্চার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিল। মি: বিশালের কাছ থেকে জেনেছি যে সেদিন সুশীল বাড়ি থেকে বেরনোর ঘণ্টাখানেক বাদে মিসেস মালহোত্র নিজেও উইন্ডসর ক্যাসেলে অনুষ্ঠানটি দেখতে যান, সেখানে নির্দিষ্ট স্থানে সুশীলকে না দেখতে পেয়ে প্রথমে নিজে খোঁজাখুঁজি করেন এবং তারপরেই বিশালকে ঘটনাটা জানান। বিশাল সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে ইনফর্ম করে, বিশালের মতো প্রভাবশালী মানুষের বাচ্চা উধাও হয়ে যাওয়ার খবর হাওয়ায় ছড়িয়ে পরে, মিডিয়া জেনে যায়, পিশাচ ত্রয়ী সিদ্ধান্ত নেয় এই বাচ্চাকে এখনই ছাড়া যাবে না। হাওয়া কিছুটা শান্ত হলে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। লর্ড উইলিয়ামসনের বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে সুশীলকে রাখা হয়। মিসেস উইলিয়ামসন নিজের স্বামীর কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে ভাল ভাবেই অবহিত ছিলেন, এই তিন মূর্তি নতুন নতুন শিকার ভোগ করতেই অভ্যস্ত, সুশীলকে সেখানে রেখে দেওয়া হয়েছে দেখে ওর সন্দেহ হয় এবং সুশীলের থেকে মি: বিশাল মালহোত্রর ফোন নম্বর যোগাড় করে মি: লিওনকে দিয়ে বিশালকে ফোন করায়। মিসেস উইলিয়ামসনের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তিনি একেবারে বিবেকশূন্য মহিলা নন, বাচ্চাদের যৌন নিপীড়নের ব্যাপারটা মন থেকে মানতে পারতেন না আবার নিজের লাম্পট্য ঢাকতে খোলাখুলিভাবে প্রতিবাদ করতে পারতেন না। কিন্তু একটা বাচ্চাকে দীর্ঘদিন চোখের সামনে আটকে রেখে নির্যাতন তাকে এতটাই বিচলিত করেছিল যে তিনি মি: লিওনের শরণাপন্ন হন।
লিওন নিজে যৌনকর্মী হলেও তার একটা সুকুমার মন আছে, সেও বাচ্চাদের উপর যৌন নির্যাতন মেনে নিতে পারে না, লিওন স্বভাবতই তার পরিচয় গোপন রেখে ফোন করেন, পরিচয় প্রকাশ হলে তার খুন হওয়াটা নিশ্চিত ব্যাপার ছিল। মি: বিশাল এই ফোনের ব্যাপারে কোনওদিন প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি কিন্তু কথোপকথন টেপ করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে তুলে দেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তদন্তকারী অফিসারদের কিন্তু ওই টেপটি আরও ভাল করে খতিয়ে দেখা উচিত ছিল, তারা তা করেননি, তার বদলে অপরাধীদের চাপে ফেলার কৌশল হিসেবে বলে দেন Paedophiles গ্যাং সুশীলের অপহরণের পিছনে আছে সেটা তারা তদন্ত করে জানতে পেরেছেন। এতে ফল হয় বিপরীত, সুশীলকে লর্ডের বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলা হয় এবং অন্যত্র নিয়ে গিয়ে হত্যা করে ফেলে দিয়ে আসা হয়। মি: লিওন সাহস করে লর্ডের পরিচয়ও বলতে পারেনি, সে প্রভাবশালীদের যুক্ত থাকার কথা শুধু বলেছিল। তবু বলব যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ ছিল এই ফোন, আমি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, তখন টনি অ্যাডামস স্যার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়কর্তা হলে খুনী পার পেত না, তবে এখনও পাবে না। ওই তিন তথাকথিত নীল রক্তের নরপিশাচদের পরিচয় আমরা এখন জেনে গেছি আর সুশীলের শরীরে পাওয়া বীর্যের স্পেসিমেন থেকে ওই তিন শয়তানকে কোর্টে শনাক্ত করানো খালি সময়ের অপেক্ষা, মি: লিওন আপাতত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দী দিতে রাজি হয়েছেন। তার অন্যান্য পুরুষ যৌন সহকর্মীরা এই গ্যাং সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছে, গত তিনদিন একাধিকবার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার পর এখন বলতে পারি
এদের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে গেছে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাত থেকে পার পাওয়া এদের পক্ষে অসম্ভব।”
টনি অ্যাডামস বললেন, “তুমি বলতে চাও সুশীল মালহোত্রকে হত্যা করার পর এই গ্যাংটা রাতারাতি সব ছেড়ে সাধু হয়ে গেল আর হঠাৎ এতদিন বাদে আবার মি: নরেশ সিংয়ের ছেলেকে অপহরণ করল? এর পিছনে তোমার যুক্তিটা কী?”
“যুক্তিটা খুবই সহজ স্যার। সুশীল মালহোত্রর ঘটনার পরে তিন নরপিশাচ সিদ্ধান্তে আসে, এত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তারা আর এ দেশে বসে করবে না। তারা একটি বিশেষ এশীয় দেশে বছরে কয়েকবার যাওয়া আরম্ভ করে, অভিবাসন দপ্তর থেকে জানতে পেরেছি এরা বছরে ৬-৮ বার ওই দেশে সফর করেছে, দুই বিজনেস টাইকু্নের ওই দেশের সঙ্গে আমদানি রপ্তানির ব্যবসার সুবাদে ভাল যোগাযোগ থাকায় ওদের সুবিধা হয়ে যায়। ওই রাষ্ট্রে, বালকদের যৌনসঙ্গী হিসেবে ট্যুরিস্টদের হাতে তুলে দেওয়া একটা ওপেন সিক্রেট। কোভিড এসে এদের সব হিসেব গোলমাল করে দিল, ওই রাষ্ট্রে ট্যুরিস্টদের ঢোকা বন্ধ হয়ে গেলে এরা বিপদে পড়ল, শুধু তাই নয়, উইলিয়ামসন এবং ফিঞ্চ নিজেরাই কোভিড আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ সময় হাসপাতালে ভর্তি ছিল, ফিঞ্চের অবস্থা তো খুবই খারাপ হয়ে গেছিল। উইলিয়ামসনও দ্বিতীয়বার কোভিড আক্রান্ত হয়, এইসব ধাক্কা সামলে নেবার পর তিন মূর্তি দেখল, শুধু বয়স্ক যৌনকর্মীতে মন উঠবে না, এরা তিনজনেই এখন ষাটোর্ধ্ব, চট করে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ অতিমারির সময় বিপজ্জনক হবে, সেই বিশেষ রাষ্ট্রেও ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা আংশিক উঠেছে মাত্র, তাই সিদ্ধান্ত হল আবার বাচ্চা অপহরণ করা হবে। মি: লিওন এবং মিসেস উইলিয়ামসন মনে করছেন এই পর্বে এটিই প্রথম বাচ্চা অপহরণের ঘটনা।
সুরেশকে যেদিন অপহরণ করে লর্ড উইলিয়ামসনের বাড়িতে আনা হল, সেদিন মিসেস উইলিয়ামসন লর্ডের সঙ্গে তার অপকর্মের দুই সঙ্গীর ফোনালাপ শুনে ফেলেন, বুঝতে পারেন এরা দুপুর একটা নাগাদ অপকর্মের জন্য মিলিত হবে।
সুরেশের উপর লর্ডের বাড়িতে আলাদা কোনও পাহারা ছিল না, Paedophiles গ্যাংয়ের গুণ্ডা বাহিনীর কারও লর্ড উইলিয়ামসন বা তার দুই সঙ্গীর বাড়িতে প্রবেশাধিকার নেই। তারা বাড়ির গেটে সুরেশকে হস্তান্তর করে দিয়ে চলে যায়, অভিজাত পাড়ায় তাতে কোনও সমস্যা নেই। এখানে মানুষজন থাকেন না, লর্ড বা লেডিরা থাকেন, তাদের নজর আকাশের দিকে, মাটিতে নজর নামান না, আশেপাশে কী হচ্ছে খেয়ালও করেন না।
পাহারা ছিল গেটে, সুরেশকে একটা ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, মিসেস উইলিয়ামসন সুরেশের কাছ থেকে তার বাবার ফোন নম্বর নিয়ে ফোন করে সেটা মি: লিওনকে দেন। তারা দু’জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন সুশীলকে তারা বাঁচাতে পারেননি, কিন্তু সুরেশকে বাঁচাবেনই। লিওন ফোনে নরেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে, সে সেদিন লর্ডের বাড়িতে আসেইনি। লিওন শুধু মিসেস উইলিয়ামসনের নির্দেশ অনুযায়ী সময়ে সময়ে বুথ পাল্টিয়ে নরেশকে ফোন করে গেছে, আর উইলিয়ামসনের বাড়ির অদূরে নির্দিষ্ট জায়গায় নিজের বাইকে সুরেশের জন্য অপেক্ষা করে গেছে। মিসেস উইলিয়ামসন এর পর ফোন করে মূল গেটের দুই সিকিউরিটি গার্ডকে বলেন, তার পোষা বিড়াল বাড়ির পিছন দিকের ক্যাম্পাসে গাছে উঠে বসে আছে এবং তাদের যেভাবেই হোক সেই বিড়ালকে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেন। তাদের তো মালকিনের হুকুম অগ্রাহ্য করবার ক্ষমতা নেই, আর মিসেস উইলিয়ামসনের অদ্ভুতুড়ে বায়নাক্কা শুনতে তারা অভ্যস্ত, সুতরাং
গেট ভিতর থেকে বন্ধ করে তারা বাড়ির পিছনে বিড়াল খুঁজতে যায়, মিসেস উইলিয়ামসন সুরেশকে সেই ফাঁকে গেট দিয়ে বার করে দেন, বলে দেন একটা লাল বাইকে, একটা কালো জ্যাকেট পরা লোক তাকে মা-বাবার কাছে পৌঁছে দেবে। লিওন সুরেশকে বাইকে তুলে একটু ঘুরপথে গিয়ে তাকে নামিয়ে দেওয়ার পরে, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তার মা-বাবাকে দেখিয়ে দেয়। লিওনের মুখ হেলমেটে ঢাকা ছিল, সে সুরেশের সঙ্গে দু’-একটার বেশি কথা বলেনি, সেই সময় বা সুযোগও ছিল না, সতর্ক লিওন, সস্ত্রীক নরেশদের সামনে আসতে চায়নি, তার বাইকে করে সুরেশকে ছেড়ে যাওয়ার কথাও নরেশকে গোপন রাখতে বলে।
তাই আমি যখন সুরেশকে লিওনের গলার টেপ শোনাই তখন সে ওই গলা স্বভাবতই চিনতে পারেনি। নরেশ সহজেই পেরেছিলেন, কেননা লিওনের সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়েছিল। লর্ড সাহেবের বাড়িতে সিসি টিভির কোনও ব্যাপার নেই, নিজের বহু পাপ ঢাকতেই এই ব্যবস্থা। নরেশ আমাদের কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন যে ওঁর ছেলে সুরেশ খুবই স্মার্ট, বাস্তবিকই তাই। মিসেস উইলিয়ামসন এবং মি: লিওন দু’জনেই জানিয়েছেন, সুরেশ বিন্দুমাত্র ঘাবড়ায়নি। আমি সুরেশের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তার সঙ্গে কী পৈশাচিক কাণ্ড ঘটতে পারত, সে সম্বন্ধে সে মোটেই ওয়াকিবহাল নয়। পুরো ঘটনাটিই তার কাছে একটা অ্যাডভেঞ্চার ব্যতীত কিছুই নয়। এমনকী সে দাবি করেছে, যখন অপহরণকারীরা রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে, তাকে ফুটপাথ থেকে ডেকে একটা কাগজে লেখা ঠিকানা জানতে চায়, তখনই সে জানত, কী হতে চলেছে, এ সব সে বইয়ে অনেক পড়েছে। এই স্কুলটায় যেতে তার খুব একঘেঁয়ে লাগে, তার থেকে একদিন অপহৃত হলে কেমন লাগে সে দেখতে চেয়েছিল। স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরেও তাকে অনেকক্ষণ একা একা থাকতে হয়, পাড়ায় তার কোনও বন্ধুও নেই। বাচ্চাদের এই একাকিত্ব একটা সামাজিক সমস্যা, সুরেশের মা-বাবা, আরও অনেক অভিভাবকদের মতো বাচ্চার মনের খবর রাখেন না। অভিভাবকদেরও অনেক বাধ্যবাধকতা আছে, তবে তা একটি বাচ্চার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কি না সেটা তাদেরই ভেবে দেখতে হবে।
সুরেশ পালিয়ে যাওয়াতে দুই সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি যেত, শাস্তির মাত্রা আরও মারাত্মক হতে পারত, মিসেস উইলিয়ামসন ওদের লর্ড উইলিয়ামসনের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন, সেই বিড়ালের গল্প দিয়েই। কুড়ি বছর আগের উইলিয়ামসন আর
বয়সের ভারে ন্যুব্জ এখনকার উইলিয়ামসনের মধ্যে পার্থক্য আছে। লালসার নীল রং ফিকে না হলেও বিষ দাঁত কিছুটা কমজোরী, নয়তো এই বিড়ালের গল্পে এত সহজে বিশ্বাস করবার লোক সে নয়। আর সুরেশের ব্যাপারটা নিয়ে নরেশ চিলহ্যামে ফিরে গিয়ে হইচই শুরু করে দেন, তাতে তিন মূর্তি ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছে হতে পারে।
লিওন সেদিন নরেশকে দু’বার নয়, বহুবার ফোন করেছিল, যেটা নরেশ লুকিয়ে গেছেন, ঘটনাস্থলে আর একটি বাচ্চার আমদানির মাস্টার প্ল্যান আদতে মিসেস উইলিয়ামসনের, তিনিই নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন। মিসেস উইলিয়ামসন চেয়েছিলেন এই চক্রটি চিরতরে ভেঙে যাক, পুলিশ কল্পিত বাচ্চাটির খোঁজ শুরু করলে তিন মূর্তি আর বাচ্চা অপহরণের ঝুঁকি নেবে না।
কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি লর্ড উইলিয়ামসনের পরিচয় গোপন করতে চেয়েছেন, পারিবারিক সম্মান রক্ষা করতে। সম্ভবত নিজের পুরুষ যৌনকর্মী সংসর্গ গোপন রাখতে চাওয়াটাও একটা কারণ। উনি ম্যাজিসট্রেটের কাছে জবানবন্দী দিতে এখনও রাজি হননি, স্বেচ্ছায় হলে ভাল, না হলেও ওঁর পক্ষে আইনি জেরা কাটানো সম্ভব হবে না। তা ছাড়া যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ আমাদের হাতে এসে গেছে। সুরেশ মালহোত্রর শরীরে তিনজন পুরুষের বীর্য পাওয়া গেছিল, এটা কোন তিনজনের তা প্রমাণ করতে এখন আর বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হবে না।
স্যার, আপনার টেবিলে আমার বিস্তারিত রিপোর্ট সীলবন্ধ খামে আগেই জমা দিয়েছি, ওখানে তিন অভিজাত নীল রক্তের নরপিশাচের পরিচয় দেওয়া আছে। লালসার রং যে কতটা নীল হতে পারে, তা জেনে অচিরেই সমগ্র ব্রিটেন শিউরে উঠবে।
মি: মালহোত্র আমি দু:খিত, আইনি প্রক্রিয়া শুরুর আগে ওই তিন ধর্ষকের নাম আপনাকে জানাতে পারছি না। মি: সিং আপনার ছেলের অপহরণকারীদের নাম জানার জন্য আপনাকেও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমি এতক্ষণ আমার বর্ণনায় তিন নরপিশাচ, লর্ড পত্নী, পুরুষ যৌনকর্মীর পরিবর্তিত নাম ব্যবহার করেছি, তদন্তের স্বার্থে এটা ছাড়া উপায় নেই। আপনারা দু’জনে আপাতত বাড়ি যেতে পারেন, আমরা সময় মতো যোগাযোগ করে নেব।”
আমি বললাম, “এটা কেমন হল অধীরদা? মাইক ব্রিয়ারলি তো হাত, পা, মাথা কেটে যে বাচ্চাটিকে খুন করা হল, তার কথা কিছু বললেন না!” অধীরদা মৌজ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে আমাকেও একটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আরে হচ্ছে হচ্ছে, একটু দম নিয়ে নিই দাঁড়ান। টনি অ্যাডামসও আপনার প্রশ্নটাই ব্রিয়ারলিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। বিশাল মালহোত্র, নরেশ সিং, ট্রেন্ট লিওন বিদায় নিয়েছেন। তার বদলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে শ্রীলঙ্কার ব্যবসায়ী মি: ডিসিলভা, তার স্ত্রী মিসেস ডিসিলভা, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দু’জন মহিলা অফিসার। আসুন ব্রিয়ারলির বয়ানেই আমরা বরং ঘটনাটা শুনি।”
“স্যার, প্রতিটি খুন হয়ে যাওয়া লাশই নীরবে বলে দিয়ে যায় হত্যারারীর ঠিকানা, শুধু সেই ঠিকানাটি ঠিকঠাক পড়ে নেওয়া চাই। সেদিন রবার্টসনের ফোন পেয়ে অকুস্থলে গিয়ে আমরা দেখলাম হতভাগ্য বাচ্চাটির হাত, পা, মাথা কিছুই নেই। পুরো শরীর রক্ত শূন্য, যেন শেষ বিন্দু রক্ত বার করে নেওয়া হয়েছে। কেন? প্রথমে মাথায় আসতে পারে পরিচয় গোপন করবার জন্য, বাচ্চাটির দাঁত বা ফিঙ্গার প্রিন্ট কোনও কিছুই পাওয়ার প্রশ্ন নেই, শনাক্ত করা সত্যিই শক্ত, কিন্তু এই এত নিখুঁত করে কাটল কে? সাধারণ পেশাদার খুনীদের এই দক্ষতা নেই, প্রাথমিক সন্দেহ গেছিল Paedophiles গ্যাংয়ের দিকে, কিন্তু সুরেশ মালহোত্রকে তারা মেরেছিল শ্বাসরোধ করে, পরিচয় গোপন করতে পরে ভারী কিছু দিয়ে মেরে মুখ বিকৃত করে দেওয়া হয়েছিল। এই গ্যাং নৃশংস, প্রয়োজনে খুন করতে পারে, গুলি করতে পারে, ছুরি মারতে পারে, তবে এইভাবে শরীর থেকে রক্ত বার করে নেওয়া তাদের পদ্ধতি নয়।
বাচ্চাটির মৃতদেহ বস্তুত অন্য কিছু ইঙ্গিত করছিল। তাই আমি ডুব দিয়েছিলাম স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের আর্কাইভে এবং লাইব্রেরিতে। আর রবার্টসন বাচ্চাটির দেহ পাওয়ার এক সপ্তাহ পূর্বের সময়কালের মধ্যে নিখোঁজ ৮–১০ বছরের বাচ্চাদের তালিকা তৈরি করে, তাদের সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট তৈরি করছিল। আমি এশীয় বংশোদ্ভূত বাচ্চাদের বিষয়ে বিশেষ জোর দিতে বলেছিলাম, কারণ শুধু ধড়টুকু পাওয়া গেলেও, সেটি যে কোনও শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ বা লাটিন আমেরিকান বাচ্চার দেহাবশেষ নয় তা বুঝতে পেরেছিলাম। এই ধরনের মৃতদেহে ডিএনএ অ্যানালিসিস হবেই, যদি আমি ভুল প্রমাণিত হতাম তবে রবার্টসনের কাজের পরিধি অর্থাৎ নিখোঁজ বাচ্চাদের সম্মন্ধে খোঁজ করবার পরিধি বিস্তৃত করতে হত, কার্যক্ষেত্রে দেখলাম, আমার ভুল হয়নি। যদি বাচ্চাটির শরীর রক্তহীন না হত, তবে আরও নিশ্চিত করে তার অরিজিন বলা যেত, ব্ল্যাকবার্ন পুলিশের দেওয়া একটি তথ্য থেকে বুঝতে পেরেছিলাম, আমি সঠিক পথে এগোচ্ছি, সেই তথ্যের কথা যথাসময়ে বলব। যাইহোক, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যখন হাতে এল, তাতে স্পষ্ট বলা হল বিষ প্রয়োগে মৃত্যু, পরে হাত, পা-মাথা কেটে নেওয়া হয়েছে, ডিএনএ অ্যানালিসিস বলছে বাচ্চাটি ভারতীয় উপমহাদেশের হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। আমার আন্দাজ মিলে গেল আর এখান থেকেই সংশয়ের শুরু হল, খুনের পদ্ধতি তো আফ্রিকা মহাদেশের দিকে ইঙ্গিত করছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর্কাইভে পূর্বে এইরকমের ঘটনার দৃষ্টান্ত আছে। রবার্টসন, তুমি যে ছড়ার বইটি আমাকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লাইব্রেরিতে পড়তে দেখেছিলে, সেটি আদতে আফ্রিকান ব্ল্যাক ম্যাজিক বা ভুডু সম্বন্ধীয়। সেখানে ডুব দিয়েই খুঁজে পেয়ে গেলাম একটি আফ্রিকান ওকাল্টের, যেখানে একটি বাচ্চাকে দেবতা বা অপদেবতার সামনে বলি দেওয়া হয়, তার রক্ত উৎসর্গ করা হয় দেবতার কাছে, এই বলির কাজটা করে একজন ওঝা, এই ওঝারা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে রক্ত বার করে নিতে সংশয়াতীত ভাবে দক্ষ। এই ওকাল্টের বিশ্বাস অনুযায়ী, মানুষের রক্তের মধ্যেই থাকে তার সৌভাগ্য, সুতরাং দেবতার চরণে একটি বাচ্চার রক্ত উৎসর্গ করার মধ্যে পাওয়া যাবে সৌভাগ্য, ক্ষমতা এবং অগাধ সম্পদ। দুর্ভাগ্যবশত এই আদিম বর্বর প্রথা এখনও বিলুপ্ত হয়নি, কিছু মানুষ এই অন্ধ কুসংস্কারে এখনও বিশ্বাস রাখে এবং তারা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের নাকের ডগায় বসে এই কাজ করতেও পিছপা নয়।”
আমি বললাম, “অধীরদা, দেখেছেন তো আমি ঠিকই ধরেছিলাম, মাইক ব্রিয়ারলি কোনও সাধারণ ছড়ার বই পড়ছিলেন না।” অধীরদা হাসলেন, “অতনুদা, তা ঠিক ধরেছেন, তবে এশীয় বংশোদ্ভূত নিখোঁজ বাচ্চাদের নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করার জন্য ব্রিয়ারলি কেন রবার্টসনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই অনুমানটা মেলাতে পারেননি, তবু আপনি পাশ মার্ক পাবেন, ব্রিয়ারলির মতো ধুরন্ধর গোয়েন্দার চালের হদিশ টনি অ্যাডামসের মতো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের শীর্ষকর্তা বা রবার্টসনের মতো তরুণ ছায়াসঙ্গী সহকর্মীও পায় না, আপনি তো কাছাকাছি আন্দাজ করেছেন। চলুন ব্রিয়ারলির বয়ানে ফেরা যাক।”
এই সময় ব্রিয়ারলি মিসেস ডিসিলভার দিকে ঘুরে বললেন, “আপনাদের কেন এখানে ডেকেছি, নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, আমি এ বার আমার বক্তব্যের সব থেকে কঠিন পর্যায়ে যাব, আপনি যা আন্দাজ করেছেন তার থেকেও এটা কঠিন হবে, চাইলে আপনি বাইরে অপেক্ষা করতে পারেন।”
মিসেস ডিসিলভা বললেন, “যে মায়ের বাচ্চা খুন হয়ে গেছে, তার কাছে এর থেকে কঠিন কিছু হতে পারে না, আপনারা দু’জন যেদিন আমার বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেছিলেন সেদিনই আমি সব আঁচ করতে পেরেছিলাম।”
“স্যার, রবার্টসনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল পূর্ব ল্যাঙ্কাশায়ারের ব্ল্যাকবার্ন পুলিশ স্টেশনে নথিবদ্ধ নিখোঁজ দশ বছরের বালক, ‘অশোকা ডিসিলভা’ সেই হতভাগ্য বালক। ডিএনএ অ্যানালিসিস অনুযায়ী সে ভারতীয় উপমহাদেশের বাচ্চা এবং সেই সময়কালে নিখোঁজ অপর দুই এশীয় বংশোদ্ভূত বাচ্চাকে পরে খুঁজে পাওয়া গেছিল। ফরেন্সিক টক্সিকোলজির রিপোর্টে মৃতদেহের পৌষ্টিক নালীতে ক্যালাবার বিনের(calabar bean) অস্তিত্বের প্রমাণ স্পষ্ট, ক্যালাবার বিন এক ধরনের বিষাক্ত আফ্রিকান লতার বীজ, নির্দিষ্ট পরিমাণে-এর ওষুধ হিসেবে ব্যবহার আছে, তবে মূলত এই বিষের প্রয়োগ সেই আফ্রিকান ভুডুর সঙ্গে যুক্ত। এই ওকাল্ট অনুসারে এই বিষ খাওয়ালে নির্দোষ ব্যক্তির কোনও ক্ষতি হবে না, কিন্তু দুষ্টু আত্মার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আসলে এই বিষ খেলে কারও বাঁচার সম্ভাবনা নেই। আর সেই মৃত্যু প্রবল যন্ত্রণাদায়ক। আফ্রিকান ওঝারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে এবং প্রভাব বজায় রাখতে এই বিষ প্রয়োগ করে। মৃত বালকের পরিচয় জানার পর আমরা তদন্তে গেছিলাম মি: ও মিসেস ডিসিলভার বাড়িতে, মি: ডিসিলভা যদিও সেই সময় বাড়িতে ছিলেন না। আমরা মিসেস ডিসিলভার সঙ্গেই কথাবার্তা বলে ফিরে আসি। মিসেস ডিসিলভার দেওয়া তথ্য এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের করা তদন্তের উপর ভিত্তি করে আমি এই হত্যা রহস্যের যবনিকা টানব।
স্যার, ‘মি: দাসুন ডিসিলভা’র ছেলের পুরো নাম, ‘অশোকা হাতুরাসিঙ্ঘে ডিসিলভা।’ অশোকার মায়ের এটি দ্বিতীয় বিবাহ, তার প্রথম পক্ষের স্বামী অশাঙ্কা হাতুরাসিঙ্ঘে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান, তখন অশোকার বয়স ছয় বছর। তার এক বছর বাদে মিসেস রুহি হাতুরাসিঙ্ঘের সঙ্গে মি: দাসুন ডিসিলভার বিবাহ হয়, মি: দাসুন ডিসিলভা এবং মিসেস ডিসিলভার একটি এক বছর এক মাসের পুত্র সন্তান আছে, মিসেস ডিসিলভার কাছ থেকেই এই তথ্যগুলো আমরা জানতে পেরেছি।
ডিসিলভা সাহেবের সঙ্গে মিসেস ডিসিলভার প্রথম পক্ষের ছেলের সদ্ভাব ছিল, মিসেস ডিসিলভা আমাদের বলেছেন অশোকা তার বর্তমান বাবাকে খুবই ভালবাসত। অশোকার মিসিং ডায়রি করা হয়েছিল তার দেহাবশেষ পাওয়া যাওয়ার আগের সন্ধ্যায়, সেইদিন বিকেলেও ডিসিলভা সাহেব অশোকাকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন, বলেছিলেন রাতের খাবার খেয়ে দু’জনে ফিরবেন, মিসেস ডিসিলভার সেদিন একটু পেট খারাপ ধরনের হয়েছিল, তাই তিনি ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন।
ডিসিলভা সাহেব অশোকাকে নিয়ে যান ব্ল্যাকবার্ন কর্পোরেশন পার্কে, এই পার্কে যেতে অশোকা খুব পছন্দ করত। এই পার্ক থেকেই অশোকা উধাও হয়ে যায়, ডিসিলভা সাহেব তখন একটা বেঞ্চে বসে ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন, অশোকা আশেপাশে খেলছিল, ফোন সারার পর ডিসিলভা সাহেব অশোকাকে আর দেখতে পাননি। প্রথমে তিনি সেটাতে গুরুত্ব দেননি, ওটা অশোকার চেনা জায়গা, তিনি ওই বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে থাকেন, কিন্তু আধ ঘন্টা কেটে গেলে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। অশোকার পরনে ছিল সাদা প্যান্ট এবং লাল টি শার্ট, ওখানে অনেককে অশোকার বর্ণনা দিয়ে তার খোঁজ করেন, কেউ কেউ বলেন, ওই বয়সী লাল টি শার্ট, সাদা প্যান্ট পরা একটি ছেলেকে তারা ৩০-৩৫ বয়সী একজন মহিলার সঙ্গে দেখেছেন,
তখন মি: ডিসিলভার ধারণা হয় যে মিসেস ডিসিলভা পরে সুস্থ বোধ করে, বেবি সিটারের কাছে ছোট বাচ্চাটিকে রেখে পার্কে এসেছেন এবং তার সঙ্গে মজা করবার জন্য অশোকাকে নিয়ে লুকিয়ে আছেন। তিনি মিসেস ডিসিলভাকে ফোন করে জানতে পারেন, মিসেস ডিসিলভা বাড়ি থেকে বেরোননি। তখন তিনি গিয়ে ব্ল্যাকবার্ন পুলিশ স্টেশনে অশোকার নিখোঁজ হবার অভিযোগ জানান। কি, মি: ডিসিলভা, আমি সব ঠিক বললাম?” মি: দাসুন ডিসিলভা, মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
“কিন্তু, কিছুই যে ঠিক নেই ডিসিলভা সাহেব। আপনি তো সেদিন অশোকাকে নিয়ে পার্কে যাননি। আপনি অশোকাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন বিকেল চারটে নাগাদ, আর মিসিং ডায়রি করতে গিয়ে জানিয়েছিলেন যে অশোকাকে শেষ দেখেছিলেন সন্ধ্যা ৫.৩০ নাগাদ, অথচ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে তার মৃত্যু হয়েছে ৫.০০-৬.০০-এর মধ্যে। তার মানে হত্যাকারী ৫.৩০-৬.০০-এই আধঘণ্টা সময়ের মধ্যে অশোকাকে পার্ক থেকে সরিয়ে ফেলা সহ বিষ দিয়ে হত্যার কাজটি সেরে ফেলেছে, সেটা অসম্ভব, দেবতার কাছে বাচ্চা উৎসর্গ করবার আগে আফ্রিকান ওকাল্টে কিছু তথাকথিত ধর্মীয় রীতি পালনের রেওয়াজ আছে, সেই সময় তা হলে পাওয়া যেত না।
তা ছাড়া, অনেকেই নিয়মিত জনপ্রিয় ওই পার্কে যান, একজন প্রত্যক্ষদর্শীকেও ব্ল্যাকবার্ন পুলিশ খুঁজে পায়নি, যারা সেদিন একটি বাচ্চা ছেলে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা মনে করতে পেরেছে। ছবি দেখেও মি: ডিসিলভা এবং অশোকাকে কেউ চিনতে পারেনি। আপনি সুকৌশলে একজন কাল্পনিক মহিলাকে অশোকার অপহরণকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন। মি: ডিসিলভার অভিযোগ নথিবদ্ধ করার সময়, পুলিশ স্বভাবতই তার মোবাইল থেকে দু’জনের ছবি চেয়ে নেয়। ব্ল্যাকবার্ন পুলিশ চীফ, ‘ডমিনিক স্টার্লিং’ একজন অত্যন্ত দক্ষ অফিসার। তিনি, দু’জন পুলিশ কর্মীকে, অশোকা এবং মি: ডিসিলভার ছবি দিয়ে ব্ল্যাকবার্ন কর্পোরেশন পার্কে তদন্ত করতে পাঠান, পুলিশ কর্মীরা পার্ক থেকেই ওঁকে ফোনে সব জানান, স্টার্লিং ডিসিলভাকে সেটা বলেননি, আসলে অভিযোগকারী পিতা যে পুত্রের অপহরণের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন সেটা তিনি ভাবতে পারেননি, তবে অসঙ্গতি কিছু আছে সেটা বুঝেছিলেন। স্টার্লিং ঘটনাটি আরও তদন্ত করে দেখবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। পরের দিনই অশোকার দেহাবশেষ আবিষ্কার হয়, তখন যদিও দেহাবশেষ শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পক্ষ থেকে আমি এবং রবার্টসন সেই তদন্তের ভার গ্রহণ করেছি জানতে পেরে, ‘স্টার্লিং’ আমাকে ফোনে তার সন্দেহর কথা জানিয়ে বলেন, মি: ডিসিলভার কথায় অসঙ্গতি আছে, সে যদিও অশোকার খোঁজে একটুও ঢিলে দেয়নি, তবু তার আশঙ্কা হচ্ছে অশোকা ডিসিলভার দেহাবশেষই খুঁজে পাওয়া গেছে, বাচ্চাটির দেহাবশেষ দেখে আমার তাকে এশীয় বংশোদ্ভূত মনে হয়েছিল, আর আগেই বলেছি ব্ল্যাকবার্ন পুলিশের দেওয়া একটি তথ্য আমার ধারণাকে সুদৃঢ় করেছিল।
মি: ডিসিলভা তবে সেদিন অশোকাকে নিয়ে গেলেন কোথায়? আমি বলব, না আপনি বলবেন ডিসিলভা সাহেব?” মিসেস ডিসিলভা এইসময় বললেন, “আপনি কী বলতে চাইছেন যে আমার স্বামী আমার ছেলেকে হত্যা করেছে? এটা কখনই হতে পারে না, সে অশোকাকে খুবই ভালবাসত, সে তাকে কেন মারবে? একটি দশ বছরের বাচ্চাকে মেরে তার কী লাভ হবে? যদি তিনি অশোকাকে অপছন্দ করতেন তবে তাকে বোর্ডিংয়ে পাঠাতে পারতেন, মারবেন কেন?”
টনি অ্যাডামস মিসেস ডিসিলভাকে থামালেন, “ব্রিয়ারলি, দ্রুত এবং সংক্ষেপে ব্যাপারটা শেষ করো।”
ব্রিয়ারলি নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, “তাই করছি স্যার। অশাঙ্কা হাতুরাসিঙ্ঘের পূর্ব পুরুষ বহু বছর আগে শ্রীলঙ্কা থেকে সাউথ আফ্রিকায় গিয়ে ব্যবসা শুরু করে, কালে কালে তারা সেখানে একটি ছোট লৌহ আকরিক খনির মালিক হয়ে ওঠেন, অশাঙ্কা ছিলেন তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, মা মারা গেছেন আগেই, বছর পাঁচেক আগে অশাঙ্কার বাবার মৃত্যুর পর অশাঙ্কা খনিটির মালিক হন, তার আগে মূলত তিনি ইংল্যান্ডে তাদের খনিজ দ্রব্য রপ্তানির ব্যাপারটা দেখতেন। হাতুরাসিঙ্ঘেদের লন্ডন অফিসের ম্যানেজার ছিলেন দাসুন ডিসিলভা, অশাঙ্কা তাকে সাউথ আফ্রিকায় খনি দেখভালের জন্য নিয়ে আসেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ডিসিলভার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকাতে আলাপ হয় আর এক স্থানীয় লৌহ আকরিক খনি মালিক আবিমবোলা ওকেরোর সঙ্গে, ওকেরোরও ইংল্যান্ডে রপ্তানির ব্যবসা আছে এবং ইংল্যান্ড তার বড় পছন্দের দেশ।
আবিমবোলা নামটি খুব অর্থপূর্ণ, ‘যে সম্পদশালী হতেই জন্মেছে।’ সত্যি তাই, আবিমবোলা ওকেরো অত্যন্ত ধনী ব্যবসায়ী। দক্ষিণ আফ্রিকায় ওকেরো পরিবার বৃহৎ শিল্পপতি হিসেবে সুপরিচিত, তাদের আসল সম্পদের উৎস একাধিক ম্যাঙ্গানিজের খনি, ব্যবসা দেখে মূলত তার বাবা, সে ব্যবসার থেকে বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং নানারকম আফ্রিকান ব্ল্যাক ম্যাজিকের প্রতি আকৃষ্ট। শুনতে ছোট লৌহ আকরিক খনি হলেও অশাঙ্কারাও যথেষ্ট ধনী, কিন্তু দাসুন ডিসিলভা ম্যানেজার হবার জন্য জন্মাননি, তার লক্ষ্য মালিক হওয়া। সুযোগ এল যখন চার বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকাতে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় অশাঙ্কা মারা গেলেন। মি: ডিসিলভা অশাঙ্কার স্ত্রী রুহিকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। রুহি পড়লেন অথৈ জলে, তিনি ব্যবসার কিছু বোঝেন না, এই বিষয়ে দাসুনের উপর নির্ভর না করে তার উপায় ছিল না। কিছুদিন টালবাহানার পরে তিনি দাসুনকে বিবাহ করেন। দাসুন ধীরে ধীরে রুহির মন জয় করতে সক্ষম হন।
রুহির ভয় ছিল যে অশোকা দাসুনকে কীভাবে নেবে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তাদের ভাব দেখে রুহি নিশ্চিন্ত বোধ করেন, দাসুন ডিসিলভা ম্যানেজার থেকে আংশিক খনি মালিক হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার তখন লক্ষ্য আবিমবোলার সঙ্গে ম্যাঙ্গানিজের ব্যবসায় নামা। আবিমবোলা ঘন ঘন ইংল্যান্ডে আসত, ডিসিলভা তার ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন, এক সম্পর্কীয় ভাইয়ের হাতে দক্ষিণ আফ্রিকার খনি দেখার ভার দিয়ে নিজে আবিমবোলার সঙ্গে লেগে থাকতেন। রুহি ছেলেদের নিয়ে পাকাপাকি ভাবে ল্যাঙ্কশায়ারেই থাকতেন, বছরে দু’-একবার মাত্র দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতেন। ডিসিলভাদের ছোট ছেলের এক বছরের জন্মদিনের পার্টিতে এসে নিষ্ঠুর আবিমবোলার অশোকাকে দেখে তাকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করবার জন্য মনে ধরে, অশাঙ্কা হাতুরাসিঙ্ঘের মৃত্যু এবং দাসুন ডিসিলভার সঙ্গে রুহির বিবাহর ঘটনা আবিমবোলা জানত, সে দাসুনকে প্রস্তাব দেয়, অশোকাকে তার হাতে তুলে দিলে সে দাসুনকে ম্যাঙ্গানিজ ব্যবসায় নামার সুযোগ করে দেবে। মি: ডিসিলভা দেখেন এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে, অশোকা বেঁচে থাকলে সে লৌহ আকরিকের ব্যবসায় সমান অংশীদার হবে, তাকে পথ থেকে সরাতে পারলে সবটাই নিজের এবং নিজের ঔরসজাত সন্তানের করায়ত্ত হবে।
তাই সেদিন কর্পোরেশন পার্কে না গিয়ে ডিসিলভা তাকে আবিমবোলার হাতে তুলে দিয়ে আসেন। আর আবিমবোলার উইচ ডাক্তার লেব্রাফো প্রথমে বিষ দিয়ে অসহায় অশোকাকে হত্যা করে, তারপর নিখুঁত ভাবে তার অঙ্গ ছেদন করে সমস্ত রক্ত অপদেবতার কাছে উৎসর্গ করে আবিমবোলার জন্য সম্পদ এবং ক্ষমতার প্রার্থনা করে, সেই দেহাবশেষ তারা ফেলে দিয়ে আসে সাসেক্স থেকে হ্যামপশায়ার যাওয়ার রাস্তার পাশে মাঠের ভিতরে, ভেবেছিল ওই লাশ শনাক্ত করা অসম্ভব। ‘লেব্রাফো’ শব্দের অর্থ ঈশ্বরের আশির্বাদ, কিন্তু সে হতভাগ্য অশোকার জীবনে মূর্তিমান অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছিল।
যেদিন আমরা মি: ডিসিলভার বাড়ি যাই, সে তখন আবিমবোলার বাড়িতে ম্যাঙ্গানিজ ব্যাবসার শুভ সূচনার সেলিব্রেশনে গেছিল। ম্যাঙ্গানিজের ব্যবসায় ডিসিলভা কীকরে প্রবেশ করবে, সেটা ঠিক করতেই আবিমবোলার ঘৃণ্য প্রস্তাবের পর মাস খানেক সময় মাঝখানে ব্যয় হয়েছে বলে অনুমান।
আবিমবোলা এবং লেব্রাফোকে এতক্ষণ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসাররা হেফাজতে নিয়ে নিয়েছেন। মি: ডিসিলভা ঘুণাক্ষরে টের পাননি, তার পিছনে চব্বিশ ঘন্টা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড নজর রাখছে, আফ্রিকান ওকাল্ট অশোকার মৃত্যুর কারণ জানার পর এবং ডিসিলভাদের আফ্রিকান যোগ জানার পর আবিমবোলার নাড়ি-নক্ষত্র বের করে ফেলা খুবই সামান্য ব্যাপার। এবার বুঝেছেন মিসেস ডিসিলভা কেন মি: ডিসিলভা এই কাজ করেছেন? মি: ডিসিলভা শুধু অশোকাকে শারীরিক ভাবে হত্যা করাননি, তার সঙ্গে সঙ্গে অশোকা এবং আপনার বিশ্বাস ও ভালবাসাকে হত্যা করেছেন। এই নির্মম সত্যর বর্ণনা নিজের কানে শোনা আপনার পক্ষে কতটা হৃদয়বিদারক হবে বুঝেই আপনাকে বাইরে অপেক্ষা করার সুযোগ দিতে চেয়েছিলাম।
অশোকার দেহাবশেষ ফেলে দেওয়াই আবিমবোলা এবং লেব্রাফোর জন্য কাল হল। ওরা আবিমবোলার ল্যাঙ্কাশায়ারের বাড়ি থেকে আনুমানিক চার ঘণ্টা ড্রাইভ করে অশোকার দেহাবশেষ ভোর রাতে ফেলে দিয়ে এসে ভেবেছিল ধরা ছোঁওয়ার বাইরে চলে গেল।
এই দেহাবশেষ ফেলে দেওয়ার মধ্যেও বিশেষ আফ্রিকান ওকাল্টের প্রভাব আছে, আফ্রিকান ব্ল্যাক ম্যাজিকে দেবতার চরণে রক্ত উৎসর্গ করবার পর সেই দেহাবশেষ শকুন দিয়ে খাওয়ানোর প্রথার কথা উল্লেখ আছে, পুরো দেহ লোপাট করে দিলে ফল পাওয়া যাবে না বলে এই ওকাল্টের বিশ্বাস।
অশোকার দেহাবশেষ শকুন দিয়ে খাওয়ানোর বাসনাতেই রাস্তার ধারে মাঠের ভিতরে ফেলে আসা হয় বলে অনুমান করা যায়। ওই মাঠটি রাস্তা থেকে যথেষ্ট ভিতর দিকে হওয়ায় দেহাবশেষ ফেলার নিরাপদ স্থান হিসেবে বাছা হয়েছিল, একজন প্রাতঃভ্রমণকারীর কুকুরই আবিমবোলার সব হিসেব গণ্ডগোল করে দিল। মিসেস রুহি ডিসিলভার অভিশপ্ত সেই দিনে পেট খারাপ হওয়ার পিছনে মি: ডিসিলভার হাত না থাকলে অবাক হতে হবে, আমার ধারণা রুহিকে বাড়িতে আটকাতে মি: ডিসিলভা তার খাবারে কিছু মিশিয়েছিল। অশাঙ্কা হাতুরাসিঙ্ঘের মৃত্যু হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় গাড়ি দুর্ঘটনায়, মি: ডিসিলভার যে পরিচয় পাওয়া গেছে, তাতে এই ঘটনার পুনরায় তদন্ত চেয়ে সেখানকার পুলিশকে, অফিসিয়াল রিকোয়েস্ট পাঠাতে হবে।
এ বার বুঝেছ রবার্টসন, কেন আমি কোনও ফাঁক রাখি না? এইসব জঘন্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে, ফাঁক রাখলে চলে না। এবার বলো তো, আবিমবোলা দক্ষিণ আফ্রিকার বদলে অশোকাকে বলি দেওয়ার জন্য ইংল্যান্ডকে কেন বেছে নিল?”
অধীরদা ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে বললেন, “বুঝেছেন অতনুদা, রবার্টসনের বিড়বিড় করে দেওয়া গালাগালি ব্রিয়ারলি ঠিক শুনতে পেয়েছিলেন, মোক্ষম সময়ে সেটা বুঝিয়ে দিলেন, সঙ্গে একটা গুগলি। তা সব কিছু দ্য ইনভেস্টিগেটরের পাতা উল্টে জানতে হবে কেন? মাইক ব্রিয়ারলির গোয়েন্দা কাহিনির পাঠক হিসেবে আমরা নিজেরাই গুগলিটা পড়বার চেষ্টা করি।”
আমি বললাম, “রবার্টসনের বিড়বিড়ানি আসলে গালাগালির ছলে মাইক ব্রিয়ারলির প্রশংসা ছাড়া কিছু নয়। সে মুখে যাই বলুক, মনে মনে আমাদের মতোই ব্রিয়ারলির ভক্ত। আর গুগলিটা বোধহয় ধরতে পেরেছি। আবিমবোলার ধারণা ছিল, লন্ডন শহরে বসে কেউ এই হত্যার সঙ্গে আফ্রিকান ওকাল্টের সম্পর্ক ধরতে পারবে না, দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ সেটা সহজেই ধরতে পারত, আর আবিমবোলা সেখানকার বিশিষ্ট শিল্পপতি, তার ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রীতির কথা নিশ্চয়ই অনেকে জানে, সন্দেহের তির এড়ানো বেশ কঠিন ছিল, আবিমবোলা, লেব্রাফোরা তো জানত না এ খানে অপরাধ বিজ্ঞানের ম্যাজিসিয়ান মাইক ব্রিয়ারলি তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।”
বৈঠকখানা ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময়ও দেখলাম, অধীরদা মুখে ট্রেডমার্ক মিটিমিটি হাসি নিয়ে সপ্রশংস দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছেন।
(পরবাস-৮৪, ১০ অক্টোবর, ২০২১)