গুপীদের বাড়ি দক্ষিণ কলকাতায় লেকের কাছে। সম্ভ্রান্ত এলাকা। কলকাতার অনেক জ্ঞানীগুণীদের বাস এই অঞ্চলে। পুরনো অনেক বাড়ি ভেঙ্গে বেশ কয়েক আধুনিক বহুতল নতুন আবাসন তৈরি হয়েছে। গুপীদের একতলা বাড়িটা অবশ্য বেশ পুরনো। ওদের আর্থিক সামর্থ্যে এই বাড়ির যথোচিত মেরামত সম্ভব নয়। এটা গুপীর মামা-দাদু মানে বাবার মামার বাড়ি। এই বাড়িতেই থাকতেন। ভাগ্নে ছাড়া তিনকুলে কেউ ছিল না। বছর পাঁচেক আগে মারা গেছেন। তাঁর উইলের উত্তরাধিকার সূত্রে গুপীর বাবাই এখন এই বাড়ির মালিক।
গুপীর মা নেই। গুপীর বয়স যখন দশ উনি মারা গেলেন টিটেনাসে। মাছ কাটতে গিয়ে হাত কেটেছিল। গুপীর বাবার গাফিলতি। টিটেনাসের ইনজেকশন নিলে অকালে জীবনটা নষ্ট হত না। এইজন্য গুপীর বাবা নিজেকে কখনো ক্ষমা করেন নি। বেশ কয়েক বছর অনুতাপে মাছ মুখে তোলেন নি। আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। গুপীর কথা ভেবে করতে পারেন নি। বাবার ঘরে গুপীর মায়ের বাঁধানো ছবি দেওয়ালে টাঙ্গানো। প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে একদৃষ্টে ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলেন গুপীর বাবা। লুকিয়ে গুপী দেখেছে। কতটা ভালবাসা আর কতটা অনুশোচনা তা গুপীর জানা নেই। জানবার চেষ্টাও করে নি।
গুপীর বাবার কলেজ স্ট্রীটে একটা ছোট বইয়ের দোকান। বাবার বয়স ষাট পেরিয়েছে। দেখতে দেখতে গুপীরও হল তিরিশ। বছর দুয়েক হল বিয়েও হয়েছে। বি.কম. পাস করে একটা ছোটখাট চাকরি পেয়েছিল ডূয়ার্সের কোনও চা বাগানে। বাবা যেতে দেন নি। দোকানের কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। গুপী তাই এখন এক পাকাপোক্ত দোকানদার। লেক অঞ্চল থেকে কলেজ স্ট্রীট রোজ যাতায়াতের ধকল বাবার আর পোষায় না। তাই গুপীই দোকান দেখাশোনা করে।
বইঘর, গুপীদের ছোট দোকানটার সাদামাটা নাম। বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীটে কফি-হাউসের কাছে। বইএর তাকে ডাঁশ রাখা বই। বেশির ভাগই স্কুল কলেজের আর কম্পিটিটিভ পরীক্ষার। কিছু বাংলা গল্প উপন্যাস আর কবিতার।
দোকানে একটা হাতল ভাঙ্গা পালিশ চটা চেয়ার আর একটা টুল। চেয়ারটায় গুপী বসে টুলে উনিশ বছরের মাধব। খদ্দের এলে ছেলেটাই তাক থেকে বই নামায় কখনো টুলটায় কখনো বা এককোণে রাখা এ্যালুমিনিয়ামের মইটায় উঠে। বাবা যতদিন আসতেন মাধব ছিল না, ওর কাজটা গুপীই করত। বই নামিয়ে দোকানের সামনে কাউন্টারটায় রাখত। বাবা বিল বানাতেন আর নগদ নিতেন। গুপী অবশ্য পেটিএম আর গুগলপেও নেয়। বাবার ঘোরতর আপত্তি ছিল। বিক্রি বেড়েছে তাই মেনে নিয়েছেন।
গুপী দোকান খোলে বেলা এগারোটায়। সেন্ট্রাল স্টেশনে মেট্রো থেকে নেমে মেডিকেল কলেজের ভেতর দিয়ে হেঁটে কলেজ স্ট্রীট। তারপর বাঁদিকের ফুটপাথ ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে রাস্তা পেরিয়ে দোকান। মাত্র মিনিট সাতেক হাঁটা। কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পর রাস্তা পার করে সূর্যসেন স্ট্রীটে ঢুকেই ডানদিকে পুঁটিরামে দুটো সিঙ্গাড়া আর এক কাপ চা। পুঁটিরামের পাশের সরু গলিতে দর্জি সালিমের দোকান। সার্ট প্যান্ট, সায়া ব্লাউজ, শাড়ির ফল সবই সালিমের হাতে। গুপীর সমবয়সী। তাই বন্ধুর মত। কাজ না থাকলেও গুপী তাই এই পথে সালিমের দোকানে ঢুঁ মেরে যায়। তারপর আর একটু এগিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট। ঢুকে বাঁদিকে কলেজ স্কোয়ার আর সংস্কৃত কলেজ আর ডানদিকে প্যারামাউন্ট শরবতের দোকান আর মহাবোধি সোসাইটি ছেড়ে নাক বরাবর জালান কলেজের সামনে বাঁদিকে একটু এগোলেই বইঘর, গুপীর দোকান।
কলেজ স্ট্রীট পাড়া কলকাতার বই পাড়া। বইএর আড়তও বলা যায়। কলেজ স্ট্রীট বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট আর আশপাশের গলিতে অগুনতি ছোটবড় বইএর দোকান আর প্রকাশকদের অফিস। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে স্কুল কলেজে পড়ার বইএর চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সব দোকানে ক্রেতাদের ভিড়। কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আর জেলাগুলো থেকে পাইকারি আর খুচরো ক্রেতারা বই কিনতে আসেন এই বই পাড়ায়। রিক্সা ঠেলা অটো কার ভ্যানের যানজটে পায়ে হাঁটা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। দোকানে গুপী আর মাধবের এক মুহূর্তের ফুরসৎও থাকে না। বড় সুখের ব্যস্ততা। সংসারে বেশ কিছু টাকা আসে।
বছরে এই জমাটি ব্যবসার জোয়ার মাস দুয়েকের বেশি থাকে না। তবে সারা বছরই পড়ার বইএর চাহিদা থাকে বই পাড়ায়। কত কম্পিটিটিভ পরীক্ষা হয় সারাবছর। হাজার হাজার লাখ লাখ ছেলে মেয়েরা পরীক্ষা দেয়। তাদের প্রস্তুতির সহায়ক বই বাজারে আসে, জমিয়ে বিক্রি হয়। নববর্ষ, রথ আর পুজোর সময় বেরোয় গল্প কবিতার বই। এগুলোরও চাহিদা আছে। আমদানি করা বিদেশী বইও রাখে অনেক বইএর দোকান। গুপী রাখে না। পুঁজির জোর নেই।
গুপীর বই পড়ার সখ। তবে শ্রীজাত বা জয় গোস্বামীর কবিতা বোঝে না, সহজবোধ্য রহস্যরোমাঞ্চ বা প্রেমের উপন্যাস পড়ে। নতুন বই সাবধানে পড়তে হয়। আঁচড় লাগলে বিক্রি হলেও পুরো দাম পাওয়া যায় না। গুপীর সবচেয়ে পছন্দ সাধারণ জ্ঞানের বই। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার জন্য বাজারে আসে। এই গুগল-বাবার আমলেও গুপীর দোকানে বিক্রি মন্দ হয় না। গুপী খুব পড়ে। সময় পেলেই টিভিতে কোটি টাকার কুইজ প্রোগ্রাম দেখে। অনেক প্রশ্নের উত্তর অনায়াসে দিতে পারে।
গুপীর মামার বাড়ি শ্রীগোপাল মল্লিক লেনে। দোকান থেকে হাঁটা পথ। পুঁটিরামের দোকান ডান হাতে রেখে সূর্যসেন ধরে একটু এগোলেই কর্পোরেশন অফিস আর তার গা দিয়ে ডানদিকে ঢুকে যাওয়া গলিটাই হল শ্রীগোপাল মল্লিক লেন। এই গলিতে আছে স্বরাজ পাঠাগার। পাবলিক লাইব্রেরি। গুপীর খদ্দের। গল্প কবিতার বই কেনে। কয়েক পা পরেই অন্নপূর্ণা ভবন। গুপীর দিদিমার বাড়ি। অন্নপূর্ণা ভবন একশ বছরের বেশি পুরনো। কলকাতায় ছড়িয়ে থাকা সেই আমলের বনেদি বাড়িগুলোর মত। আগেকার আভিজাত্যের রমরমা আর নেই। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। মেরামত হয় না। তবে টিঁকে আছে।
তিন তলা বাড়ি। লাল রঙের দেওয়াল। রঙ অবশ্য মলিন। কোথাও শ্যাওলা ধরা কোথাও প্লাস্টার খসে পড়ছে। নিচের তলায় দেওয়াললিখনগুলোতে রাজনৈতিক প্রচার। কাঁচের জানালার বাইরে সবুজ রঙের খড়খড়ির অনেকগুলোই ভাঙ্গা। কয়েকটা ভাঙ্গা কাঁচে পিসবোর্ডের জোড়া-তাপ্পি। দোতলা আর তিনতলায় লম্বা ঝুলবারান্দা প্রায় ফুট চারেক চওড়া। পেটা লোহার রেলিং রংচটা মরচে ধরা। কারুকার্য করা কাঠের পেল্লায় মূল সদর দরজাটার ভগ্নাবশেষ দাঁড়িয়ে আছে বটে তবে কাজের নয়। কালো রঙের লোহার বিশাল বেমানান দরজাটাই এখন সদর দরজা। এই দরজা দিয়ে ঢুকেই বড় উঠোন। এখানে-ওখানে কালচে সবুজ শ্যাওলার ছাপ। কখনো এখানে প্রতি বছর অন্নপূর্ণা পুজো হত। তাই বোধ হয় বাড়ির নামে অন্নপূর্ণা। এখন সে সবের পাট উঠে গেছে। উঠোনের সামনের দিকে সদর দরজাটা ঢোকা আর বেরোনোর রাস্তা। বাকি তিন দিকে লাল সিমেন্টের বারান্দা। তবে বেশ কয়েক যায়গায় ভেঙ্গে গেছে আর তাতে বেমানান কালো সিমেন্টের প্লাস্টার। উঠোনের সামনে সদর দরজার দুদিকে বারান্দার পাশ দিয়ে দুদিকে দুটো সাদা সিমেন্টের সিঁড়ি উঠে গেছে তিন তলা অবধি।
গুপীর দাদামশাইয়ের বাবা ইংরেজ আমলে বর্মায় কাঠের ব্যবসা করে অনেক উপার্জন করেছিলেন। তিনি বাড়িটা কিনেছিলেন এক জমিদারের থেকে। সংস্কার করেছিলেন সপরিবারে বসবাসের জন্য। ওনার চার ছেলে গুপীর দাদুরা চার ভাই। সবচেয়ে ছোট গুপীর দাদু। কেউ আর বেঁচে নেই। বাড়িটা এই চার পরিবারের শরিকি পৈতৃক বাড়ি। দোতলায় দুই পরিবার, তিন তলায় দুই। প্রতি পরিবারের ভাগে চার খানা ঘর, রান্না ঘর, বারান্দা আর বাথরুম। এক তলায় থাকে গোটা কয়েক ভাড়াটে পরিবার। ওপরে বেশ বড় ছাদ। চার পরিবারেরই ব্যবহারের জন্য। কাপড় শুকানো, টবের গাছ, আচারের বোয়েম, রোদ পোয়ানো, বাচ্চাদের খেলা, নিছক আড্ডা, ঘুড়ি ওড়ানো সবই এই ছাদে। বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা অন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে ছাদে পাল বাঁধা হয়, ভিয়েন বসে, লোক খাওয়ানো হয়।
গুপীর দাদামশাই মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে, বয়স হয়েছিল পঁচাশি। দিদিমা বেঁচে আছেন। বয়স সাতাত্তর। তবে শরীরে সামর্থ্য আছে। দাদামশাই ব্যাংকে টাকা রেখে গেছেন। সুদ পান। ভাড়াটেদের ভাড়ার অংশ পান। দিব্যি চলে যায়। ওনার দুই ছেলে, গুপীর দুই মামা। বড়মামা দিল্লিতে চাকরি করতেন। ওখানে বাড়ি করেছেন। ছেলে বউ নিয়ে ওখানেই থাকেন। ছোট মামার পরিবার এই বাড়িতেই থাকতেন। বছর দুয়েক হল ব্যাঙ্গালোর নিবাসী। ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। দিদিমা একা থাকেন বটে, কিন্তু আনন্দেই থাকেন। বাড়ির বাসিন্দারা আত্মীয় ভাড়াটে নির্বিশেষে ওনার খোঁজ খবর রাখেন, অসুখবিসুখে দেখাশোনা করেন, যদিও তার বড় একটা প্রয়োজনই হয় না। কাজের লোকও আছে। এক মাঝবয়সী বিধবা বাড়িতেই থাকেন। বাড়ির সব কাজ তো বটেই, দোকান-বাজার করা আর বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের বিল জমা দেওয়াও এই মহিলার কাজ। বলতে গেলে উনি দিদিমার সংসারের ম্যানেজার।
দিদিমা গুপীকে খুব ভালবাসেন। গুপীর জগতে তিনজন পরম আপন। বাবা, দিদিমা আর বছর খানেক আগে বিয়ে হওয়া বউ। প্রায়ই গুপী দিদিমার কাছে আসে। বিশেষত উপোস তিরেসের দিনে। উপোসের দিনে দিদিমা সাধারণ খাবার খান না। খান ফল। নারকোল কুচি দেওয়া গোরুর সুগন্ধি ঘি ছড়ানো সবুজ মুগ সেদ্ধ। চিনি মিশিয়ে কলাপাতায় মোড়া সাদা মাখন। সন্দেশ মিষ্টি দই রাবড়ি আরও কিছু। দিদিমার ঘরের এক কোণে একটা কাঠের সিংহাসনে রাধা মাধবের মূর্তি। খাবার আগে দিদিমা ভোগ দেন তারপর নিষ্ঠাভরে প্রণাম করে খান। গুপী এলে এই খাবারে ভাগ বসায়। অন্যদিন আগে থাকতে বলে এলে দিদিমা ছানার কালিয়া আর ভাল ঘিয়ে ভাজা সাদা ময়দার ফুলকো লুচি খাওয়ান। ম্যানেজার বীণামাসি চমৎকার রাঁধেন। কাছেই বৌবাজারে হাসনাবাদের ছানা পাওয়া যায় আর তা দিয়েই হয় এই ছানার কালিয়া, অতুলনীয় এর স্বাদ। দক্ষিণ কলকাতায় গুপীদের পাড়ায় এই ছানা পাওয়া যায় না।
দিল্লির চাঁদনি চকে নঈ সড়ক বইয়ের বড় আড়ত। বিয়ের আগে বার কয়েক গুপী ওখানে গিয়েছিল। থাকত পাহাড়গঞ্জের একটা ছোট লজে। সেদিন ছিল রবিবার। আগস্ট মাসের ভ্যাপসা গরমে বাসে করে গিয়েছিল চিত্তরঞ্জন পার্ক। তার পর মিষ্টি কিনে পায়ে হেঁটে বিকেল পাঁচটায় অলকানন্দায় নীলগিরি এ্যাপার্টমেন্ট। গুপীর বড়মামার বাড়ি। বসবার ঘরের আয়তন আর সাজসজ্জা দেখে গুপী বুঝেছিল ওরা বড়লোক। গুপী আসায় মামা মামী যে খুব খুশি হয়েছিলেন তা অবশ্য গুপীর মনে হয় নি। বলেছিলেন ফোন করে এলে ভাল হত। ওঁদের সাকেতে ডিএলফের মলে যাবার প্রোগ্রাম আছে। মামার ছেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে আমেরিকায় মুভ করেছে মাস কয়েক আগে তা গুপী জানত। দিদিমা বলেছিলেন। মামাও বড় গলায় জানিয়ে দিলেন। জানালেন কলকাতা কত পেছিয়ে আছে দিল্লি না এলে বোঝা যায় না। বাংলা হিন্দি আর ইংরিজির জগাখিচুড়ি ভাষায় নিজেদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা আর ছেলের গুণগানের মাঝে দিদিমা কেমন আছেন একবার জিজ্ঞাসা করলেও গুপীর বাবার কথা একবারও নয়। মামা মামীর এই উন্নাসিক ব্যবহার গুপীর পছন্দ হয় নি। দিল্লি এলেও আর কখনো ওখানে যায় নি। তবে প্রতিবার দিদিমার জন্য চাঁদনি চকের আচার আর পেস্তা নিয়ে গেছে।
স্বরাজ পাঠাগার ছাড়াও এই পাড়ায় গুপীর বইএর আরও খদ্দের আছে। তাই এ পাড়ায় এলেই যে গুপী অন্নপূর্ণা ভবনে আসে তা কিন্তু নয়। তবে এই বাড়ির সামনে দিয়ে একটু এগিয়ে বাঁদিকে ঘুরে তারপর ডানদিকে ব্রজনাথ দত্ত লেন। এখানে থাকেন দাশ বাবু। হেয়ার স্কুলে জীববিজ্ঞান পড়ান। প্রেসিডেন্সি কলেজের লাগোয়া এই স্কুল। গুপীর দোকান থেকে পা কয়েক দূরে। মাঝে মধ্যে এই ব্রজনাথ দত্ত লেনেই গুপী ওনাকে দেখতে পায়। রাত আটটার পর ছাত্র পড়িয়ে বাজার করে হেলেদুলে বাড়ি ফিরছেন। গুপী জানে বাজারের থলিতে ওঁর পোষা খরগোশের জন্য গাজর নিশ্চয়ই আছে। দাশবাবু ছাত্রদের গুপীর দোকানে বই কিনতে বলেছেন। ওনার সৌজন্যে হেয়ার স্কুলের অনেক ছাত্রই গুপীর খদ্দের। ব্রজনাথ দত্ত লেনের ও মাথায় মধুগুপ্ত লেন। ঐ গলিতে ঢুকে বাঁদিকে কয়েক পা পরেই জগজ্যোতি গ্রন্থাগার। স্বরাজ পাঠাগারের তুলনায় একটু বড়। এরাও গুপীর খদ্দের। তাই এখানে এলে লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে দেখা করে। দুটো লাইব্রেরিই ধার করে বই কেনে। তাই পাওনা আদায় করতে গুপীকে বার বার আসতে হয়। মধুগুপ্ত লেন শেষ হয় একটু এগিয়ে এক চৌমাথায়। সোজা গেলে সিদ্ধেশ্বর চন্দ্র লেন, বাঁদিকে কানাই ধর লেন আর ডান দিকের গলিটা ছুতোর পাড়া লেন। অনেক বছর আগে, গুপীর মনে পড়ে জগজ্যোতি লাইব্রেরি পেরিয়ে মধুগুপ্ত আর কানাই ধরের সংযোগের জায়গাটায় হারাধন তার ঘুগনি আর তার বিশেষ আইটেম লড়ায়ের চপ নিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় বসত। চমৎকার স্বাদ। গুপী বাবার সঙ্গে খেতে আসত। হারাধন আর আসে না। বেঁচে আছে কি না জানা নেই।
একটা ছোট বইয়ের দোকানদারের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবার ইচ্ছে অবশ্য গুপীর দাদামশাইয়ের ছিল না। কিন্তু মেয়ে দেখতে শুনতে ভাল না, তারপর বার তিনেক চেষ্টা করেও স্কুলের গণ্ডি পেরোয় নি। যুতসই পাত্র জুটছিল না। গুপীর মামা-দাদু দাদামশাইকে চিনতেন। উনিই প্রস্তাব দিলেন। বছর ছয়েক বড় এই মামুলি দোকানদের হাতে মেয়েকে দিলেন দুটো কারণে। প্রথমত গরীব হলেও ছেলেটা ভালমানুষ আর দ্বিতীয়ত, হয়ত সেটাই প্রধান কারণ, মামা-দাদু আশ্বস্ত করেছিলেন ওনার অবর্তমানে ছেলেটাই বাড়িটার মালিক হবে।
গুপীর বিয়ে প্রেম করে। ও আর ওর বউ সোনালীর বাড়ি কাছেই গড়িয়াহাটে; কলেজে পড়েছে একই ক্লাসে। মেয়েটা দেখতে শুনতে মন্দ নয় আর পড়াশোনায় ভাল। বি কম পাস করে গুপী দোকানদারি শুরু করলেও মেয়েটা এম কম আর তারপর এম বি এ করে সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্টের কাজ করে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। গুছিয়ে কথা বলতে পারে শুধু বাংলাতেই নয় ইংরিজিতেও। গুপীকেও ইংরিজি বলা শেখাতে চেষ্টা করেছিল, গুপী শিখেছে তবে ততটা সাবলীল হতে পারে নি। এত অসামঞ্জস্য সত্ত্বেও গুপীকে কেন পছন্দ করেছিল তা গবেষণার বিষয় হতে পারে, তবে প্রেমপর্ব চলেছিল দীর্ঘ দশ বছর। ওরা প্রেম করত ইডেন গার্ডেন, গঙ্গার ধার বা ময়দানে। নিউমার্কেট আর ধর্মতলা অঞ্চলে হিন্দি বা ইংরিজি সিনেমা। পার্কস্ট্রিটে রাস্তার ধারে মাটন বা চিকেন রোল। রিজেন্টে কবিরাজি। সাবিরসে রেজালা আর আমিনিয়ায় বিরিয়ানি। ইংরিজি সিনেমা গুপীর ভাল লাগত না। কিন্তু সোনালীর ইচ্ছেয় দেখতেই হত। সিনেমা দেখা আর খাওয়াদাওয়া সব খরচই সোনালীর। তবে গুপী খুব জোর করলে মাঝে মাঝে উত্তরে শ্যামবাজার বা হাতিবাগানে গিয়ে বাংলা ছবি আর নাটকও দেখেছে। কলেজ স্ট্রীট বা গড়িয়াহাট অঞ্চলে কখনোই নয়। ওইসব জায়গায় পরিচিতদের সংখ্যা অনেক বেশি।
সোনালীর বাবা অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী। গড়িয়াহাটে বড় শাড়ির দোকান। সোনালী শাড়ি কুটির। সোনালীর বয়স বাড়তে বাড়তে সাতাশ ছুঁই ছুঁই। বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। আসাই স্বাভাবিক। বড় লোকের ঘরের লেখাপড়া জানা রোজগেরে স্মার্ট মেয়ে। একটার পর একটা অজুহাতে মেয়ে সব সম্বন্ধ নাকচ করছে দেখে বাবা মা দুজনেরই চিন্তা বাড়ছে। এই চিন্তায় বাড়তে বাড়তে যেদিন সোনালীর মার মেজাজ সপ্তমে চড়ল আর গলার আওয়াজ বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে পৌঁছল, সেইদিন সোনালীও জানিয়ে দিল ওদের প্রেম কথা আর ঘোষণা করলো গুপীকেই বিয়ে করবে। মেয়ে নিজের পছন্দমত পাত্র খুঁজেছে এতে আপত্তি ছিল না, কিন্তু তাবলে গুপীর মত এক অশিক্ষিত মামুলি বইওয়ালাকে? বাড়িতে চরম অশান্তি। সোনালীকে বেছে নিতে হবে গুপী কি নিজের পরিবার। অনেক বোঝানো হল। কত আদরে মেয়ে বড় হয়েছে তার আবেগপূর্ণ স্মৃতিরোমন্থন হল। সোনালীর মার চোখের জল পড়ল অনেক কিন্তু সোনালী রইল জিদে অনড়। বাবা গুণ্ডা ভাড়া করে গুপীকে একটু শিক্ষা দিতে চেয়েও পিছিয়ে গেলেন। মেয়েকে উনি চেনেন। বুঝলেন পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে নিজের সমস্যা ডেকে আনা সমীচীন নয়। শেষ পর্যন্ত দোকানের নাম পাল্টে সোনালী শাড়ি কুটির বদলে শাড়ি কুটির করতে চাইলেন। তাতে সোনালীর দাদার আপত্তি। সেও মার্কেটিংএ এমবিএ। নাম পালটালে ব্রান্ডভ্যালু কমে যেতে পারে। সোনালীর দাদা সোনালীর চেয়ে আট বছরের বড়। ভাই বোনে খুব ভাব। বোনের প্রেমকাহিনী কানাঘুষো শোনা ছিল, তবু অযথা প্রশ্ন করে তাকে বিব্রত করে নি। বিয়েতে তার আর তার বউ মানে সোনালীর বউদির তেমন উৎসাহ না থাকলেও আপত্তি ছিল না। আপত্তি ছিল গুপীর বাবার। বড়লোকের উচ্চশিক্ষিতা রোজকেরে মেয়ে ওই পরিবারে পুত্রবধূ রূপে যে একেবারেই বেমানান সেটা ছেলেকে বুঝিয়েছিলেন।
বিয়েটা সাড়ম্বরে না হলেও প্রথামত হয়েছিল। আপত্তি সত্ত্বেও সোনালীর বাবা কন্যাদান করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর বাবা মা কোনও সম্পর্ক রাখেন নি। বিয়ের পর সোনালী আর গুপী ওবাড়িতে পা রাখে নি। দোকানেও যায় নি। দাদা বউদির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। ওরা মাঝেসাঝে গুপীদের বাড়িতে কি বাইরে কোথাও দেখা করত।
বিয়ের পর গুপীর দৈনন্দিন জীবনে খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। প্রতিদিন মেট্রো চড়ে দোকান যায়। পাওনার তাগিদায় স্বরাজ পাঠাগার কি জগজ্যোতি গ্রন্থাগারে যায়। সময় পেলে পুঁটিরাম কি কাছেই ফেবারিট কেবিনে বা প্যারামাউন্ট শরবতের দোকানে সালিমের সঙ্গে একটু আড্ডা মারে। মাঝে মধ্যে দিদিমার বাড়ি যায়। ভাল মন্দ খাবার হলে খেয়ে তো আসেই সোনালীর জন্য নিয়েও আসে। বাড়ি ফিরে সময় হলে কোটি টাকার কুইজ প্রোগ্রাম দেখে। সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নোত্তরের প্রতিযোগিতায় ও সোনালীকে টেক্কা দিতে পারে। সোনালীর দাদা লেক ক্লাবের মেম্বার। বিয়ের আগে সোনালী কখনো-সখনো ক্লাবে যেত। রবিবারে বার দুয়েক গুপীকে নিয়ে গিয়েছিল। ওখানকার পরিবেশ গুপীর পছন্দ হয় নি। নিজেকে বড় বেশি বেমানান মনে হয়েছিল। সোনালী জোর করে নি। বিয়ের আগের মতই বেড়াতে যেত। সিনেমা দেখত। বড়লোকের মেয়ে বলে গুপীর বাবার যে আশঙ্কা ছিল সেটা ভুল প্রমাণ হল। সময় দিতে না পারলেও সোনালী শ্বশুরের খেয়াল রাখে। বাড়িতে একজন দিনরাতের কাজের মহিলাও রেখেছে। গুপীর বাবার অনুযোগের কোনও সুযোগ নেই। তবে ওনার ফতুয়া পাজামা সোনালীর পছন্দ নয়। এখন উনি ভাল পাঞ্জাবি পাজামা এমনকি জিনস টি-সার্টও পরেন। মাঝে মাঝে সোনালীর দাদা বউদি এলে বিয়ার কি হুইস্কি চলে। গুপীর বাবা মদ খেতেন গুপী জানত না। গুপী খেত ওর বাবা জানতেন না। এই লুকোচুরি শেষ। এখন বাড়িতেই খোলাখুলি। সোনালী আর তার বউদিও খায়। দক্ষিণ কলকাতার এই আধুনিক আর অভিজাত অঞ্চলে ইদানীং এই পশ্চিমি প্রবণতা বেড়েছে। কলেজ স্ট্রীট এখনো রক্ষণশীল। তবে এই অঞ্চলেও কিছু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার বাস করেন। ছোট দোকানদার বা কেরানি। এদের সকলেরই পুরনো শরিকি ভিটে। কয়েকজন এ পাড়ায় গুপীর বাবার বন্ধু। প্রায়ই গুপীদের বাড়িতে আসতেন দাবা খেলতে। আর আসেন ন। গুপীদের আর্থিক উন্নতি আর মানসিকতার পরিবর্তনই যে এর কারণ তা গুপী বুঝতে পারে। বাবা আর দাবা খেলেন না বটে, তবে গান শোনেন। বাংলা হিন্দি, হেমন্ত, লতা, মান্না, রফি, কিশোর, আশা সব কিছুই। স্মার্টফোনে ইউটিউব আর হেডফোন। গুপী কিনে দিয়েছে।
কলেজ স্ট্রীট পাড়ায় বড়দের বিজয়া দশমীর প্রণাম করার পুরনো প্রথা এখনো উঠে যায় নি। লক্ষীপুজোর পর এক রবিবার সন্ধ্যায় গুপী আর সোনালী দিদিমাকে প্রণাম করতে এসেছিল। বীণামাসি বানিয়েছিল মচমচে রাধাবল্লভী, আলুর দম আর নারকোল দেওয়া মাখোমাখো ঘুগনি। আনানো হয়েছিল ভীমনাগের সন্দেশ আর নবকৃষ্ণের রাবড়ি। কলকাতার অতি প্রসিদ্ধ দুটো পুরনো মিষ্টির দোকান। কলেজ স্ট্রীট বৌবাজার স্ট্রীটকে সমকোণে পেরিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারমুখী হলে তার নতুন নাম নির্মল চন্দ্র সেন স্ট্রীট। বৌবাজার মোড় থেকে ওয়েলিংটনের দিকে কয়েক পা এগোলেই এই রাস্তার ডানহাতে পাশাপাশি এই দুটো দোকান। দিদিমার বাড়ি থেকে হাঁটা পথ। বীণামাসি কিনে এনেছিল। খাওয়াদাওয়া সেরে দিদিমার ঘরে দিদিমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প মানে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ। দিদিমা গল্প করতে ভালবাসেন। কথা তাঁর শেষ হয় না। রাত দশটা বেজে গেছে। গুপী আর সোনালী উঠবে উঠবে করছে, হঠাৎ দিদিমা ঘরের দরজা খিল দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। আঁচল থেকে চাবির গোছা বার করে ঘরের কোণে রাখা লোহার সিন্দুক খুললেন। কিছু টাকা আর কয়েক গাছা সোনার চুড়ি ছাড়া তেমন মূল্যবান কিছু না থাকলেও একটা ফটো ছিল। দিদিমার বিয়ের ফটো। সাদা কালো, বেশ পুরনো তাই মলিন। বয়েস কতই বা হবে, কুড়ি হয়ত। গুপীর তাই মনে হল। ডাকসাইটে সুন্দরী না হলেও দিদিমার আকর্ষণীয় রূপ ছিল। গলায় হার আর সেটা গুপীর চেনা। হারটা দিদিমা সবসময় পরেন, এখনও পরে আছেন। ফটোতে হারের নিচে একটা লকেট, দিদিমার গলার হারে সেটা নেই। গুপী কখনও দেখে নি। সিন্দুকের এক কোণে পড়েছিল নীল ভেলভেটে মোড়া আংটির বাক্স। বিশেষত্বহীন সাধারণ বাক্স, অঢেল তৈরি হয় পাশের গলি রামকান্ত মিস্ত্রি লেনে। দিদিমা বাক্স খুলে যে জিনিসটা বের করলেন সেটাকে অবশ্য সাধারণ বলা যায় না। দিদিমার হারের লকেট। এক ইঞ্চি ব্যাসের সোনার লকেট। মধ্যিখানে হীরে আর তাকে ঘিরে দুটো বৃত্ত। ছোটটার পরিধিতে কয়েকটা লাল চুনি আর বড়টার পরিধিতে কয়েকটা সবুজ পান্না। নকল নয় সব আসল বউমা। সোনালীকে জানালেন দিদিমা। বললেন ওনার বাবা বিয়েতে যৌতুক দিয়েছিলেন।
লকেটটা দিদিমা সোনালীকে দিয়ে বলেছিলেন যত্ন করে রাখতে। জিনিসটা নাকি ওদের সৌভাগ্য আর উন্নতির কারণ হবে। ওরা বিশ্বাস করে নি। জিনিসটা নিতেও চায় নি। দিদিমা খুব জোর করছিলেন তাই নিয়েছিল। বেরোতে বেরোতে রাত এগারোটা বেজে গিয়েছিল। শেষ মেট্রো চলে গেছে। লকেটটা নিয়ে বাস না নিয়ে ট্যাক্সিতে ফিরেছিল।
কালীপুজোর দিন কয়েক বাদে দিদিমা হঠাৎ মারা গেলেন। ঘুমের মধ্যে হার্টফেল। গুপী খুব দুঃখ পেয়েছিল। ভাইফোঁটার দিন দিদিমা ডেকেছিলেন। গুপী যেতে পারে নি। সেইদিন সোনালী দাদাকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিল। খাবার এসেছিল ভজহরি মান্না থেকে আর দই মিষ্টি গাঙ্গুরামের। খুব মজাও হয়েছিল। সোনালীর দাদা গুপীর বাবাকে দাবায় হারিয়েছিলেন। তাস খেলা হয়েছিল। বাকি তিনজন ব্রিজ জানলেও সোনালী জানত না। অগত্যা টোয়েন্টি নাইন। তবে সঙ্গতে হুইস্কি তাই খেলাটা ভালই জমেছিল। কয়েকদিন বাদেই দিদিমার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে গুপী নিজেকে ক্ষমা করতে পারে নি। ওনার সঙ্গে দেখা না করে ও ফুর্তি করছিল এই কষ্ট ও ভুলতে পারে নি। বীণামাসির চাকরিটা অবশ্য যায় নি। সোনালীর ইচ্ছায় গুপীদের বাড়িতে হল তার নতুন চাকরি।
সেবছরই বড়দিনের দিন সোনালীর বাবা মারা গেলেন। নিউমোনিয়া। বড় হাসপাতালে আইসিইউতে তারপর সবশেষ। বিয়ের পর এই প্রথম সোনালী বাপের বাড়ি এল। স্মৃতিচারণ আর কান্নাকাটি অনেক হল। শ্বশুরবাড়ির দরজা গুপীর জন্যও খুলে গেল। তবে অনেক চেষ্টা করেও গুপী শোকাক্রান্ত হতে পারল না। সোনালীকে খুশি করার জন্য শোকের অভিনয়টুকুই করতে পেরেছিল। খুব ধুমধাম করে গুপীর শ্বশুরের কাজ হল। নিয়মভঙ্গের দিন জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হল। অনেক লোকের মধ্যে গুপীর বাবাও নিমন্ত্রিত ছিলেন।
দিদিমা ভুল বলেন নি। লকেটটা গুপীদের সৌভাগ্য এনেছিল। সোনালীর বাবা সোনালীকে বঞ্চিত করেন নি। উইলে দোকানের অর্ধেক মালিকানা সোনালীকে দিয়েছিলেন। ভাই বোনে ভাল সম্পর্ক, তাই কোনোরকম মনোমালিন্য সৃষ্টি হয় নি। সোনালী মোটা মাইনেতে উঁচু পদে নতুন চাকরি জয়েন করেছিল। গুপী বারকয়েক চেষ্টা করে কোটি টাকার কুইজে অংশগ্রহণ করেই বাজিমাত করেছিল। পঞ্চাশ লক্ষ টাকার জ্যাকপট। টাকা আর খ্যাতি রাতারাতি। গুপীর সাধারণ জীবনে এত খুশি কখনো আসে নি। গুপীর বাবা উত্তর কলকাতার ভীম নাগ আর নকুড় নন্দীর সন্দেশ বিলোলেন। পার্ক স্ট্রীটে মোকাম্বো রেস্টুরেন্টের নাম খুব শুনেছিলেন কিন্তু কখনো যান নি। সেখানেই তিনি পার্টি দিলেন। গুপী আর সোনালী তো বটেই, সোনালীর মা, দাদা, বউদি আর তাদের বছর সাতেকের ছেলেটাও এসেছিল। সোনালীর দাদা ওর ক্লাবে একটা জমজমাট পার্টি দিয়েছিল। এবার গুপী আর অস্বস্তি বোধ করে নি। বরং আত্মবিশ্বাসে বুক ফুলিয়েছিল। আর সেই আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠেছিল তার কথাবার্তায়। এত ইংরিজি শব্দ মিলিয়ে ও কখনো বাংলা বলে নি। টিভিতে ওকে অনেকেই দেখেছে। কয়েকজন কাছে এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। অভিনন্দন জানিয়ে দিল্লি থেকে বড় মামা আর ব্যাঙ্গালোর থেকে ছোট মামাও ফোন করেছিলেন। গুপী বুঝেছিল কুইজে সাফল্য নয় পুরস্কারের অঙ্কটাই সম্পর্কের দূরত্বটা কমিয়ে এনেছে। এত আনন্দের মধ্যে ও শুধু ভাবছিল দিদিমার কথা, জীবিত থাকলে নিশ্চয়ই তিনি খুব খুশি হতেন।
সোনালীও একটা পার্টি দিয়েছিল তাজ বেঙ্গলে একটা নামকরা রেস্তোরাঁয়। শুধু ওরা দুজন। গুপী আর সোনালী। গুপী এর আগে কখনো পাঁচতারা হোটেলে যায় নি। এত ভাল চীনে খাবার খায় নি, ফরাসি ওয়াইনও নয়। ওর মধ্যবিত্ত মানসিকতায় এই আকাশ ছোঁয়া দামের কারণটাও বুঝতে পারে নি।
সোনালী শাড়ি কুটির ভালই চলছিল। এবার ভাই বোনের যৌথ প্রচেষ্টা হল এই ব্যবসা আরও সমৃদ্ধ করা। নিউটাউনে এ্যাকশন এরিয়া ১-এ একটা মলে এই দোকানের একটা শাখা খোলার কথা চলছিল প্রায় বছর দেড়েক ধরে। সোনালীর উদ্যোগে এই কাজটা ভালভাবেই হয়ে গেল। শ্যামবাজার, হাতিবাগান, কলেজ স্ট্রীট মধ্যবিত্ত এলাকা। এখানে ক্রয় ক্ষমতা কম। কলকাতার ক্রয়ক্ষমতার অনেকটাই এখন নিউটাউনে সরে এসেছে। পয়সাওয়ালা অবাঙালিদের এখন নিউটাউন খুব পছন্দের। এখানে এ্যাকশন এরিয়া ২-এ একটা জনপ্রিয় মলে মাঝারি মাপের একটা দোকান বিক্রি হচ্ছিল। দোকানদার সোনালীর দাদার বন্ধুর। ওরা চাইছিল দোকানটা বিক্রি করে ওই মলেই আর একটা বড় দোকান নিতে। তাই বেচাকেনায় দুপক্ষেরই সুবিধে হল। তবে এই নতুন দোকানটা শাড়ির নয়। জুতোর। বাজারে নামকরা কয়েকটা কোম্পানির দামী জুতোর সাজানো গোছানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোকান। সোনালী ফুটগিয়ার। প্রথমে ভাবা হয়েছিল সোনালী পাদুকালয়। কিন্তু নামটায় বাঙালিপনা বড় বেশি। নিউটাউনের এই আধুনিক মলে একেবারেই মানানসই নয়। তাই ফুটগিয়ার। সোনালী অবশ্য নিজের নামের প্রচার চায় নি। ওর দাদার ইচ্ছে আর সেটা পুরোপুরি ব্যবসায়িক কারণে। প্রতিষ্ঠিত শাড়ির ব্যবসায় অর্জিত সোনালী ব্র্যান্ডমূল্যের সদ্ব্যবহার।
কলেজ স্ট্রীটে গুপীদের বইঘর বিক্রি হয়ে গেল। ঠিক পাশের দোকান পুস্তক ভাণ্ডার। বড় দোকান। ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর দামী বিদেশী বইও এরা রাখেন। মালিক গদাধরবাবু একটু বেশি দামেই বইঘর কিনলেন। গুপী ভেবেছিল মাঝের দেওয়ালটা ভেঙ্গে উনি নিজের দোকান আরও বাড়িয়ে নেবেন। গদাধরবাবু ব্যবসা বোঝেন। গুপীর বাবা আর গুপীর পরিশ্রমে কলেজ স্ট্রীট পাড়ায় বইঘরের সুনাম আছে। বইঘর বইঘরই থাকল, শুধু মালিকই পাল্টে গেল। বিক্রিতে গুপী খুব একটা রাজি ছিল না। শ্বশুরবাড়িতে শালার মানে সোনালীর দাদার সঙ্গে দামী মদ খেতে খেতে এই ব্যাপারে আলোচনা হয়েছিল। কলেজ স্ট্রীটের ছোট বইয়ের দোকানের ব্যবসায়িক মূল্য যে আকর্ষণীয় নয়, যুক্তি দিয়ে সোনালীর দাদা সেটাই বুঝিয়েছিল। বেঁকে বসেছিলেন গুপীর বাবা। বইঘরের মালিক উনি। ওনার সম্মতি ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। শ্বশুরকে বুঝিয়েছিল সোনালী। কয়েক সপ্তাহ ধরে ধীরে ধীরে। নানা যুক্তির মধ্যে দাবায় বাজিমাত করতে বিশেষক্ষেত্রে রানিকেও ষে বলিদান দিতে হয় সেই বহুলব্যবহৃত যুক্তিটাও ছিল। শেষে গুপীর বাবা নিমরাজি হয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন। দোকানটা যেদিন বিক্রি হয় সেদিন গুপীর বাবা লুকিয়ে চোখের জল ফেলেছিলেন। গুপীর নজর এড়ায় নি।
ব্যবসা ভালই চলছে। চালায় মূলত গুপীর দাদা। খদ্দেরদের চাহিদা বুঝে সময়মত সরবরাহ, টাকার লেনদেন, বিজ্ঞাপন, কর্মচারীদের পরিচালনা, ব্যাংক, জিএসটি, আয়কর সবই ওর দায়িত্ব। দক্ষিণ কলকাতায় সোনালী শাড়িকুটিরের আদি দোকানে এখন সোনালীর বউদি বসে। নিউটাউনের শাড়ির দোকান দেখাশোনা করে এক বিশ্বস্ত কর্মচারী আর জুতোর দোকানে বসে গুপী। বসে মানে পেমেন্ট কাউন্টারে নজর রাখে। নগদে কেনাবেচা প্রায় হয়ই না। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড। তাই নগদ-জনিত সাবধানতা আর চিন্তাও তেমন নেই। মানে গুপীর কোনও কাজ নেই তাই খই ভাজে। মোবাইল ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুক এসব দেখে। গুগল-বাবার দয়ায় সাধারণ জ্ঞানের পরিধি বাড়ায় আর হেডফোন লাগিয়ে ইউটিউবে গান শোনে। জুতো বিক্রির দায়িত্বে স্মার্ট কয়েকটা তরুণ ছেলে-মেয়ে। ভাল ইংরিজি বলে। বলতেই হয় কেননা এই দোকানে উৎকৃষ্ট মানের দামী জুতোর ক্রেতারা শিক্ষিত আর পয়সাওয়ালা। বাঙালি অবাঙালি নির্বিশেষে এরা ইংরিজিই বলে। কয়েকজন আবার হিন্দিও। বাংলা প্রায় না বরাবর। ছেলে-মেয়েগুলো খাটে খুব। জুতোর পর জুতো দেখায়। খদ্দের সন্তুষ্টিতে কোনও খামতি রাখে না। বিক্রি বাড়াতে যথাসম্ভব চেষ্টা করে। করতেই হয়। এদের মাইনে কম তবে বিক্রির ওপর কমিশন আকর্ষণীয়।
স্মার্ট আউট-ফিট প্রাইভেট লিমিটেড। এই কোম্পানিই সোনালী ব্রান্ডের মালিক। সোনালীর দাদা আর সোনালী দুজনেই বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রিধারী। ওরা ব্যবসা বাড়ানোর স্বপ্ন দেখে। তাই এই কোম্পানি। সোনালী তার দাদা বউদি আর গুপী সমান অংশীদার। নয়ডাতে একটা দোকান খোলার কথা চলছে। সোনালীর দাদার ইচ্ছে গুরগাঁওতেও একটা হোক। ব্যবসা বাড়াতে হলে ধার নিতে হয় তাই ঝুঁকি অবশ্যই আছে। গুপী মানসিকতায় সাধারণ বাঙালি নিম্নমধ্যবিত্ত। ঝুঁকি নিলে লোকসান আর লাভ দুটোরই সম্ভাবনা কিন্তু গুপী লোকসানটাই দেখে। তবে ও জানে বাকি তিন অংশীদার ইতিবাচক। তাই চুপ থাকে। শুধু বিক্রি হয়ে যাওয়া নিজের ছোট বইএর দোকানটার কথা ভাবে যেটা চালাত নিজের খেয়াল-খুশিতে। কোথায় ছিল গিজগিজে কলেজ স্ট্রীট পাড়ায় বই আর কোথায় এই নিউটাউনে ঝলমলে মলে জুতো। বই ছেড়ে একেবারে জুতোয় নেমে আসা কোথায় যেন গুপীকে অস্বস্তি দেয়।
মলের দোকান রোজ খোলে তাই গুপী রোজ দোকান যায়। মালিক গুপী এখানে গুপী স্যার। ওকে কোনোদিন কেউ এই নামে সম্বোধন করবে তা গুপী ভাবতেই পারত না। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ভালই লাগে। দোকানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মচারী গুপীর চেয়ে বয়সে বড়। সোনালীর জানাশোনা। ওদের পাড়ায় অনেকদিন একটা বড় জুতোর দোকানে কাজ করেছে। রোজ সকালে দোকান খোলার আগে স্টক মেলায়। গুপীকে তার হিসেব দেয়। এই কাজটা গুপী জানে। নিজের বইএর দোকানে করতেই হত। এখানে অবশ্য কম্পিউটারে। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হত, এখন আর হয় না।
গুপী দোকানে না থাকলেও দোকান দিব্যি চলে। শনি আর রবিবার সোনালীর অফিসে ছুটি। তবে শনিবারে প্রায়ই আধ-বেলা কাজ থাকে। সন্ধ্যেবেলা গুপী আর সোনালী ঘুরতে যায়। কখনো আইনক্স কি পিভিআরএ হিন্দি বা ইংরিজি ছবি দেখে। বাংলা ছবিতে সোনালীর রুচি নেই, বলে বড্ড ন্যাকা ন্যাকা। অবশ্য গুপী খুব জোর করলে ক্বচিৎ কদাচিৎ দেখে আর অন্যায্য মতামত দেয়। প্রায়ই তারা গঙ্গায় নৌকাবিহার করে। ভাসমান রেস্টুরেন্টে নৈশাহার করে। আজকাল গুপীও নামীদামী রেস্টুরেন্টের জাঁকজমক আর আদবকায়দায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তবে পাঁচতারা হোটেলের রেস্টুরেন্টে খাবার আর মদের দাম দেখে এখনও একটু মানসিক অস্বস্তিতে থাকে। ভাবে টাকা থাকলেও কি বেহিসাবি হতে হবে? সোনালী এসবের পরোয়া করে ন। ও অভাব দেখে নি।
গুপীরা আর দক্ষিণ কলকাতার সম্ভ্রান্ত পাড়ার পরিবেশে অপাংক্তেয় নয়। পাড়া প্রতিবেশীরা আগে বিশেষ পাত্তা দিত না এখন রাস্তাঘাটে দেখা হলে সৌজন্য বিনিময় করে। দুএকজন তো পারিবারিক অনুষ্ঠানেও নিমন্ত্রণ করেছে। দুটো বাড়ি পরে একটা বাড়ির দোতলায় মাসে একবার মদের আসর বসে। এরা সব স্থানীয় দুর্গাপুজো ক্লাবের সভ্য। ছেলেছোকরা নয়, জনাকয়েক স্থানীয় ব্যবসায়ী। বাকিরা উচ্চশিক্ষিত আর উচ্চপদস্থ চাকুরিজীবী। দুএকজন ডাক্তার আর উকিলও আছে। সেখানেও গুপী নিমন্ত্রণ পেয়েছে। গুপীর বাবারও কদর বেড়েছে। সোনালীর দাদার ক্লাব ওনাকে দাবার কোচ হবার প্রস্তাব দিয়েছিল। সোনালী রাজি হয় নি। শ্বশুর ক্লাবে গিয়ে দাবা শেখাবেন, সেটা তার পছন্দ হয় নি। সম্মানে বাধছিল। বাড়িতেই তাই দাবার কোচিং সেন্টার। কয়েকজন ছেলেমেয়ে শিখতে আসে নামমাত্র পারিশ্রমিকে। নিঃসঙ্গ গুপীর বাবা কিছুটা সঙ্গ পান।
দিল্লিতে চিত্তরঞ্জন পার্কে সোনালী শাড়িকুটিরের তৃতীয় শাখার উদ্বোধন হল। সোনালী ছুটি পায় নি। ও যায় নি, গুপী আর সোনালীর দাদা গিয়েছিল। অনুষ্ঠানে গুপীর মামাও এসেছিলেন। মামা মামী খুব জোর করায় গুপী আর সোনালীর দাদা ওদের বাড়িতে রাতের খাবার খেয়েছিল। অনেক খাবার আর দামী সিঙ্গলমল্ট হুইস্কি। আদর আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি তো ছিলই না বরং একটু বাড়াবাড়িই ছিল বোধ হয়। গুপীর মনে পড়ছিল এই বাড়িতেই সেইবারের প্রচ্ছন্ন উদাসীনতা। তখন অবশ্য ও ছিল এক অপাংক্তেয় ছোট দোকানদার।
কলেজ স্ট্রীট পাড়া গুপী ভুলতে পারে না। বিকেলের দিকে একবার গাড়িতে গিয়েছিল। বইঘরের সামনে গাড়ি রেখে নামতেই দোকানের মালিক বেরিয়ে এসে হাতজোড় করে আসুন আসুন বলে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। কাজের লোকটাকে বলেছিলেন গুপীবাবু বড়লোক। আমাদের চা ওনার পছন্দ হবে না। ঠান্ডা কিছু নিয়ে আয়। বড়লোক কথাটার মধ্যে যে মৃদু শ্লেষাত্মক কটাক্ষ লুকিয়ে আছে গুপীর সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় নি। সন্ধ্যে বেলা গিয়েছিল প্রথমে স্বরাজ পাঠাগার তারপর জগজ্যোতি গ্রন্থাগার। আগে এরা কেমন সহজে মিশত, খুলে কথা বলত। এখন কেমন আড়ষ্ট। বড় মানুষ আপনি আমরা তো ছাপোষাই রয়ে গেলাম। আমাদের যদি এমন তাগড়া শ্বশুরবাড়ি হত। এইসব মন্তব্য গুপীর ভাল লাগে নি তবে ও খামোখা কথা বাড়ায় নি। সালিমও ওকে এড়িয়ে গিয়েছিল। বলেছিল আমি ছোট দর্জি। তুই এখন বড় মানুষ। দামী দোকানের যে পোশাক তুই পরিস সেরকম আমি বানাতে পারব না। যে টিশার্টটা তুই পরে আছিস সেই টাকায় আমার এক হপ্তা সংসার চলে। কোনও কাজে লাগলে বলিস। গুপী বুঝেছিল আর্থিক অসমতা বন্ধুত্বে ফাটল আনলে ভরানো দুষ্কর। দিদিমা নেই তাই শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের অন্নপূর্ণা ভবনে যায় নি। পুরনো বাড়িটার সামনে মনটা বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
গুপীর বাবা নতুন জীবনযাত্রায় নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। পোশাকআশাক জুতো চশমা ঝকঝকে আধুনিক। পরিষ্কার দাড়িগোঁফ কামানো। রংকরা চুল নুন মরিচ। টিভিতে ইংরিজি সিনেমা দেখছেন। ইংরিজি খবর শুনছেন। ছাত্র ছাত্রীদের দাবা শেখাচ্ছেন। স্থানীয় পার্কে রোজ হাফ প্যান্ট আর স্পোর্টস জুতো পরে হাঁটতে যান। কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত ভদ্রলোক হাঁটার সহযোগী। এদেরই সঙ্গে সপ্তাহে দুদিন ব্রিজ খেলেন। ইংরিজি বলা রপ্ত না হলেও ভুল উচ্চারণে বেশ কিছু ইংরিজি শব্দ মিশিয়ে বাংলা বলেন। তবে ফেলে আসা জীবন ভুলতে পারেন নি। তাই মাঝে মাঝে কলেজস্ট্রীট পাড়া দেখে আসার সাধ হয়। গুপী তাই বাবাকে নিয়ে যায়। মেট্রোতে যায়। কখনও শ্যাম বাজার অবধি চলে গিয়ে নেতাজির স্ট্যাচু-ওয়ালা পাঁচমাথার মোড় থেকে বিধান সরণী ধরে কথা বলতে বলতে কলেজ স্ট্রীট। চলার রাস্তায় হাতিবাগান বাজার, নকুড় নন্দীর মিষ্টি, হেদুয়ার সুইমিংপুল, ঠনঠনের কালীমন্দির কপিলাশ্রমের শরবত। আরও কত কিছু। কতদিনের গভীর সম্পর্কের রং যা মুছে ফেলা সহজ নয়। কখনো গুপীরা সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমে অভ্যস্ত রাস্তায় মেডিকেল কলেজের ভেতর দিয়ে হেঁটে কলেজ স্ট্রীটে আসে। কখনো বা চাঁদনি চকে নেমে লম্বা হেঁটে নির্মল চন্দ্র সেন স্ট্রীট ধরে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে বাঁদিক ঘুরে ভীমনাগের দোকান ছেড়ে আগে গিয়ে বৌবাজার স্ট্রীট পেরিয়ে কলেজ স্ট্রীট। বিধান সরণি কলেজ স্ট্রীট আর নির্মল চন্দ্র সেন স্ট্রীট একই রাস্তার তিনটে অংশ জুড়েছে উত্তরের শ্যামবাজারকে মধ্য কলকাতার ধর্মতলার সঙ্গে। এই রাস্তায় চলতে চলতে গুপীর বাবা ভাবুক হয়ে গুপীর মার কথা বলেন। মা এই কলেজ স্ট্রীট পাড়ার মেয়ে। বাবাকে চিনিয়েছেন ওনার পছন্দের খাবার দোকান বসন্ত কেবিনের ডেভিল চপ, দিলখুশার কবিরাজি কাটলেট, ফেবারিট কেবিনের টোস্ট, কালিকার তেলেভাজা, প্যারামাউন্টের শরবত. ভীমনাগের মিষ্টি, পুঁটিরামের সিঙ্গাড়া আরও কত কি। পড়াশোনা আর বই ছাড়া কলেজ স্ট্রীট খাবারের পাড়াও বটে। গুপীর বাবা খেতে খেতে স্মৃতিচারণ করেন। এইসব ছোট সেকেলে দোকানে সোনালী আজকাল খেতে চায় না। ব্যতিক্রম ভীম নাগ বা নকুড়ের সন্দেশ, তবে মাঝে মাঝে।
গুপীর ছেলে হল। সোনালীর বিশ্বাস ছিল মেয়ে হবে। সেই বিশ্বাসের দৃঢ়তা গুপীকেও প্রভাবিত করেছিল। গুপীও ভাবত মেয়ে হবেই। নিজের ছেলে আছে তাই সোনালীর বউদিও চেয়েছিল মেয়ে হোক। হল ছেলে। আগে গুপী ভাবত ছেলে হলে কলেজ স্ট্রীটে হেয়ার বা হিন্দু স্কুলে পড়বে। এখন তা ভাবে না। সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে পড়ায় না। বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়ানোর কথা তো ভাবতেই পারে না। এদের অনেকেই ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে বাংলায় লেখালিখি করে। বাংলার সংস্কৃতি আর রাজনীতি নিয়ে বিদগ্ধ আলোচনা করে। তর্কের ঝড় ওঠায়। কিন্তু নিজেদের ছেলেমেয়েরা বাড়িতেও বাংলা মিশিয়ে ইংরিজি বলে। এটাই আধুনিকতা। হেয়ার স্কুলের দাশবাবুও আধুনিক হয়েছেন। ব্রজনাথ দত্ত লেন ছেড়ে সল্টলেকে নতুন বাড়িতে উঠে এসেছেন। খরগোশ আর নেই, এখন ক্যাকটাসের সখ। গুপীদের দোকানে জুতো কিনতে এসেছিলেন। ইংরিজিতে বললেন সময় এগিয়ে চলে, তাল তো মেলাতেই হবে। দাশবাবু আগে ইংরিজি বলেছেন কি না গুপীর মনে পড়ে নি।
সোনালীর ছেলের অন্নপ্রাশনে খুব ধুমধাম খাওয়াদাওয়া হয়েছিল। তার দিন কয়েক আগে গুপী দিদিমাকে স্বপ্ন দেখেছিল। দিদিমা খেতে দিয়েছেন। গুপীর প্রিয় খাবার। বলেছিলেন সোনালীকে বলিস ছেলের অন্নপ্রাশনে হারটা পরতে। যুক্তিবাদী সোনালী শুনে হেসে কুটোপুটি। তবে মা হলে বোধ হয় মেয়েরা পাল্টে যায়। সোনালী শাড়িকুটিরের সোনালীকে গুপী বেশ কয়েক বছর শাড়ি পরতে দেখে নি। অন্নপ্রাশনের দিন পরেছিল। সাদা কালো ঢাকাই জামদানি। গলায় জ্বলজ্বল করছে দিদিমার হার। খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। অতিথি সৎকারে কলেজ স্ট্রীট পাড়ার ভিয়েন এসেছিল। এলাহি মেনুতে গুপীর স্বপ্নে দেখা দিদিমার খাবারও ছিল। সাদা ফুলকো লুচি, বৌবাজারের হাসনাবাদি ছানার কালিয়া, ভীম নাগের দই আর নবকৃষ্ণের প্যারাডাইস সন্দেশ। দাশবাবু এসেছিলেন। চেখেই ইংরিজিতে নয় বাংলাতেই বললেন, এসব জিনিস পুরনো পাড়ার। বুঝলে বনেদি খাবারের ইজ্জতই আলাদা।
জীবনের সিঁড়ি বেয়ে গুপী অনেক উঠে এসেছে। অর্থ, সম্মান, সামাজিক প্রতিষ্ঠা সবই পেয়েছে। তবে কোথায় যেন ছেড়ে আসে সময়ের স্মৃতি মনকে নড়িয়ে যায়। পুরনো না নতুন জীবনের কোন অধ্যায়টা যে আসলে ভাল সেই সংশয় থেকেই যায়। সবকিছু পেয়েও এই শিকড় ছাড়ার আক্ষেপ যে থেকে গেছে সেটা গুপী বুঝতে পারে।
(পরবাস-৮৪, ১০ অক্টোবর, ২০২১)