Subscribe to Magazines





পরবাসে
ইন্দ্রনীল দাশগুপ্তের

আরো লেখা


ISSN 1563-8685




আগুন, নদী আর বসন্তের কবিতা




বাংলা ইস্কুলের মেয়ে

কেউ জানত না কেন দুপুরবেলা
পায়রাগুলো যখন উর্দুতে কথা বলত মানুষের গলায়
দুতলার গরাদহীন জানলা থেকে প্রিয় রথীনবাবু
বাঁড়ুজ্জেকে ছুঁড়ে দিতেন মাঠে-

শান্ত দিদিমনিরা নেচে উঠতেন বাচ্চাদের মতো
হালদার-বাবুর বদলে তাঁর চেয়ারে শুধু পড়ে থাকত কম্বল কোট
ছেলেরা সবাই বেঞ্চের উপর উঠে
ঘুমিয়ে পড়ত শালগাছের মতো;

একটা মেয়ের কাজ হত পরীর রূপ ধরে
তাদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে তাকে নিজের পছন্দমতো শাস্তি দিয়ে
তার পছন্দের কোনো শাস্তি নেওয়া।

কেউ জানত না কেন দুপুরবেলা
আলোর মধ্যেই হয়ে যেত ঘোর অন্ধকার
দরজা খুলে ঢুকে পড়ত মাঠের গোলপোস্ট
একা একা বৃষ্টিতে ভিজব কেন বলে।

করিডরে বেরিয়ে এসে সবাই
ভিজে ধুলোর গন্ধে হামাগুড়ি
দিয়ে মুছে পরিষ্কার করত গোটা দালান

যার একদিকে ছিল বারোটা খিলান
আর অন্যদিকে বারোটা ঘর -

সেই বারোটা ঘর, যেখানে পরীরা রেলগাড়ির মতো লাইন করে ঢুকে
চমকে বিষম খেত
এবং বিষের কৌটো খুলে হয়ে যেত স্বয়ম্বর।

পরীদের সেই স্বপ্ন-কৌটোগুলো
দিদিমনিরা বাঁধিয়ে দিতেন সোনালী রাংতায়
যাতে সেগুলো কোনোদিনও না ভাঙে
যদি বা হারিয়ে যায় দূরপাল্লার ট্রেনে

ছেলেরা একটা করে সরিয়ে নিত লাল বিল্ডিংয়ের ইট
যেভাবে আস্তে আস্তে পায়রাগুলো হল ঘরছাড়া
ধুলোর উপর গজিয়ে গেল ঘাস

যখন একুশ বসন্তের পর ভাসতে ভাসতে উঠে বসল লাশ
যমুনা নদীর বুকে, যেখানে প্রতিমার মতো ডুবেছিল সেইসব বাংলা ইস্কুলের মেয়ে
যারা বুঝত না তারা একটা রূপকথার মধ্যে বাস করে...


আগুন ও নদী

অনেকদিন পরে একটা প্রেমের কবিতার কাছে এসেছি আমি
প্রেম না মৃত্যু?
কারণ ভালোবাসতে হয় তাদের যারা বিকেলের শেষ আলোর মতো দামী,
অমর ইলোরার মতো নয় যার মনের আয়না খুলে নিয়েছে কেউ -

হাসতে হাসতে আমাদের বালিতে আছড়ে দিয়ে ফিরে যেত কত রাজনন্দিনীর ঢেউ
যাদের দীর্ঘ গ্রীবাগুলি পর্ণমোচী অরণ্যের মতো দূরে
একশো পা হাঁটার পর একসঙ্গে হঠাৎ তাকাত ঘুরে...

অনেকদিন পরে এসেছি একটা প্রেমের কবিতার কাছে - বলছে সে - শুনুন প্লীজ়
একটু দাঁড়ান, গয়নাগুলো ছেড়ে একদম সিম্পল্‌ হয়ে এসে
আপনার সঙ্গে যাব, আমরা দেখে আসব কোন বাড়িগুলো ভেঙেছে ঝড়ে
দেখে আসব মিউজিয়াম, জু-গার্ডেন, ইস্টেশন - এই আগুন ও নদীর শহরে -

হ্যাঁ, এখানেই দেখা যেত তাদের - যখন রিং রোড জুড়ে আষাঢ় ফুটিয়ে নিত জল
আহাঁটু বর্ষাতি পরা নায়িকারা হঠাৎ সংলাপ ভুলে বার করত ভুরুর পিস্তল
তারপর বাধ্য হয়ে গোটা ম্যাগাজিন করে দিত খালি
এখনো বাতাসে তার হর্ষধ্বনি, গ্যালারিতে তুমুল হাততালি।

আমরা টেনে আনতাম তাদের গদ্য রচনার অর্বাচীন ক্লাসে
"অনামিকাকে শাস্তি দেব", এই প্রতিজ্ঞায় অলংকৃত ছিল যেখানকার ভাষা
"আমার ব্যর্থতার জন্য ইস্কুল নয় দায়ী", এই স্বীকারোক্তিতে নিবন্ধ হত শেষ
সেই লেখা লুকিয়ে পড়ার পর সরস্বতী ছিঁড়ে ফেলত তার ভালো মেয়ে হওয়ার ছদ্মবেশ।

তারপর কতবার ঘুরে গেছে বসন্তের রথ
মুখোমুখি আবার কি পাব - আগুনের মালায় সাজানো যমুনার সেই অপরূপ পথ?

একবারও ভয়ে না থমকিয়ে -

যেই পথ নিরুপায় রাজনন্দিনীরা
                                      পার হয়েছিল ঝাঁপ দিয়ে।


বসন্তের ফিনফিনে ব্লাউজে রেখে মাথা

আমাদের ইস্কুল যদি নিজের সামলাতে পারত শাড়ি,
বা যদি আরেকটু গম্ভীর হত, আরেকটু বেতের ঘা'য়ে শান্ত
তাহলে কি সে এরকম বারবার হারিয়ে যেত নিজেরই পাড়ায়
রাজপুর রোডের কাছে অরণ্যে, এক চিলতে আরাবল্লীর প্রান্তে?

যেখানে ফাল্গুনের হুরীরা তাদের ছাতা দিয়ে খুঁচিয়ে নেভাত গতবছরের উনুন, নামাত হাঁড়ি
বার করত গনগনে ছাইয়ের টুকরোর মতো কয়ক ডজন জিনও
হুরীদের হাত পুড়ে যেত তাদের ঝেড়েঝুড়ে দাঁড় করাতে গিয়ে
চুলের কাঁটা দিয়ে চোখ ফোটাতে ফোটাতে তারা হয়ে যেত ক্লান্ত।

বাতাস থামত না, যেন অরণ্যই হয়েছে স্মৃতিহারা
উড়ন্ত শাড়ি ও সায়া, অগুনতি রুমাল ও স্কার্ফের ধারায়
অল্প কিছু খসখসে আর প্রচুর ফিনফিনে কাপড়ের সেই বছরের শেষ স্রোতে
জানলা দিয়ে বাঁড়ুজ্জেকে গরম ছাইয়ের ঢিলের মতো ছুঁড়ে
হাত ঝাড়তে ঝাড়তে হয়ত জ্যামিতির শিক্ষক বলতেন - আয়াম সরি।

বসন্তের ফিনফিনে ব্লাউজে মাথা রেখে আমরা গিয়েছিলাম মরে -
আবার যদি বেঁচে না উঠতাম তাহলে জীবনে নালিশ থাকত না আমারও।


আমার অপ্রিয় শব্দে

যদি জানতাম এই দিনগুলো এমনভাবে জখম
হয়ে পড়ে থাকবে পিছনে, আর যেখানে আমরা ছিলাম ষাট কোটি ধ্বংসস্তূপের ইট
সেখানে নিঃশ্বাস নিতে চাইবে দুশো সত্তর কোটি জ্যান্ত ফুসফুস
শহরটা পুড়তে পুড়তে এমন ছোট হয়ে যাবে যে আকাশের ঘুড়িরা তাকে চাপা দেবার ভয়ে
আর নামতে পারবে না -

তাহলে আমি কাঁটার শয্যা থেকে উঠে পড়তাম না ভুলেও
বসন্তের সেই তীক্ষ্ণ কাঁটার শয্যা যার কথা তুললে আজ পাঠক ভাবে প্রসঙ্গটা সেক্সের
তাহলে আমি প্রিয়ভাষিণীকে নিঃশব্দে ফাক ইউ বলে বেরিয়ে আসতাম না পার্ক ছেড়ে
শুধু এই ভয়ে যে সবাই বলবে বেকুব তোর দুহাতের কালি সমাজ দেখছে -
মূর্খপ্রচোদিতর মতো দিস না সে হাত কারো মুখে কিম্বা চুলে।

তাহলে আমি বাসস্টপে হাঁটু গেড়ে অলৌকিক সাইরেনের মতো আলোয়
নিজেরই খুলিতে তর্জনী ঠেকিয়ে বলতাম - জাস্ট ফায়ার!
আমি দিওয়ানে খাস থেকে লাল ইটে গাঁথা একটি আমীরজায়ার
দেয়াল সমেত দেহ ঘাড়ে নিয়ে জ্যোৎস্নায় হেঁটে যেতাম যমুনার চরে -

আমি সেই ঘুড়ি আর বাতাসের চেয়ে শস্তা এবং প্রতুল মূর্খতার দিনে
শাবল দিয়ে ভূমি খোঁড়ার আগে প্রিয়ভাষিণীর কাছে চেয়ে নিতাম নিঃশ্বাস নেবার মতো একটুকরো স্থান

আমার অপ্রিয় শব্দে বোঝাই তার আগুন আর বালির কবরে।


    স্বর্গ ও নরক
স্বর্গ ও নরক খুব
স্বর্গ চানাচুর পেলে,
ঝট করে দেখলে মনে
কে জানে একজনই কিনা,

মন্দাকিনী নদী যান
ভাই-বোন, বাবা-মা, ও
স্বর্গ ও নরক থেকে

যেখানেই আছো, তোমরা
কাছাকাছি আজকাল থাকে
নরককে মাদুর পেতে ডাকে
হয় একই মুখ, একই দাড়ি
হয়তো বেনামে দুটো বাড়ি

দুজনের মাঝখান দিয়ে
ছেলে-মেয়ে সবাইকে ভাসিয়ে -
দূরে গিয়ে ফেরে না তারাও

সমুদ্রের প্রশান্তি যেন পাও।

সেকেন্ড ফ্লাশ চা

বিকেলবেলা আমরা দুজন যখন বসেছি জানলার পাশের টেবিলে,
পড়ন্ত রোদ্দুরের কোলে উঠে
আমাদের মাঝখানে চলে এসেছে ঘুম পাড়ানি সেকেন্ড ফ্লাশ চা,
যেটা আমাকেই বানাতে হয়েছিল, চীনেমাটির পটটা যত্ন করে ধুয়ে।
দুটি ধূমায়িত কাপ টুং টাং শব্দ করে সবে গল্প জুড়েছে
কিন্তু স্মৃতির মেঘগুলি যত ঘনিয়ে ওঠে ততই তারা নীরব হয়ে যায়।

তখন কাপদুটি কারো তোয়াক্কা না করে অনর্গল বক বক করবে
হঠাৎ খিল-খিল করে হেসে উঠবে আনন্দে, যেন কতদিন পরে এই মুখোমুখি বসা
অথচ কালকেই তো গল্পের ধোঁয়া ভর্তি জলে তারা দু-দুবার করেছিল স্নান
এবং আবার কালকেই হবে দেখা -

আসলে তা মোটেও সত্যি নয়
কোনও একদিন বিকেলে একটা কাপ এসে দেখবে অন্যজন আসেনি
সে অবাক হয়ে পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করবে
কিন্তু অন্য কাপটা আসবে না পরের দিনও
এবং তার পরের, ও তারও পরের দিন...

আমি যেন ঠিক জানি যে তখনও চীনেমাটির পটটা আমাকেই ধুয়ে যেতে হবে
মাঝে মাঝে ধোবও না, আধোয়া পটের মধ্যে যোগ করব খানিকটা নতুন পাতা -
আমার কাপটা অবুঝের মত তাকিয়ে থাকবে যেন এ সবের জন্য আমিই দায়ী
বাধ্য হয়ে আমাকে নিয়ে আসতে হবে তার সঙ্গীকে

আমি দেখতে পাই হয়তো এভাবেই দুটো কাপ নিয়ে বসেছি কোনও দিন
যাতে তারা আবার শুরু করতে পারে তাদের গল্প
দুটো হাল্কা চামচ দিয়ে ঘুরিয়ে দিচ্ছি তাদের কথার খেই
এবং স্মৃতির মেঘগুলি আস্তে আস্তে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে টেবিল ক্লথের উপর -
ঝাপসা চোখের দৃষ্টিতে আমার বারবার হয়ে যাছে ভুল

আমি দেখছি যেন বিকেলবেলা আমরা দুজন আবার এসেছি জানলার পাশের টেবিলে,
আর পড়ন্ত রোদ্দুরের কোলে উঠে
আমাদের মাঝখানে এসে বসেছে ঘুম পাড়ানি সেকেন্ড ফ্লাশ চা।



(পরবাস-৮৪, ১০ অক্টোবর, ২০২১)